ডাংগুলি ছেলে এবং আমসত্ত্ব মেয়ে- ৪

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: মঙ্গল, ০১/০৪/২০০৮ - ৩:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

****১ম পর্ব****
****২য় পর্ব****
****৩য় পর্ব****

****৪র্থ পর্ব****

অনেক ছোটবেলায় নৌকায় উঠলে আমার ভয় ভয় লাগত। নৌকাটা কেমন দোলে! মনে হত- এই বুঝি আমাকে নদীতে ছুঁড়ে দেবে। মা'র বুকে মুখ লুকাতাম তখন। মা বাবাকে বলত...
- মনুর বাপ দেখছেন... আমাগো মনু ভয়ে কেমুন লাল হইয়া গ্যাসে!
আমি রাশু'র দিকে তাকালাম। এই কয়দিনে রাশুটা কেমন বড় হয়ে গেছে। কেমন বড় মানুষদের মতন তাকিয়ে আছে!
- ঐ রাশু।
- ক!
- মন বুঝি ভালা না?
রাশু আমার দিকে তাকিয়ে হাসে! সেই হাসি! স্কুলের মাঠের পেছনে - বাঁশি হাতে নিয়ে হাসা- সেই হাসি! রাশু আমার পাশে এসে বসে...
- আমাগোরে ছাইড়া থাকতে তোর কষ্ট অয় না, মনু?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। আমি রাশুর দিকে তাকাই না কিংবা তাকাতে পারি না।
আজ এশাকে দেখব। আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া বুকের মধ্যে একটা কাটা বিঁধে আছে। মাকে বলি নি। আমি জানি- মা আমাকে যেতে দেবে না। কিন্তু নৌকার ওপর বসে... নদীর জল দেখতে দেখতে মা'র জন্য আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। এতক্ষণে মা নিশ্চয়ই আমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। জুয়েলকে বলেছি বিকেলের দিকে মাকে গিয়ে বলতে। কিন্তু গাধাটা যদি না যায়? মা তো কাঁদবে!
রাশু আমার কাঁধে হাত রাখল...
- কী রে ... কান্দস ক্যান?
- মারে বইলা আসা উচিত আছিল রে রাশু।
রাশু কেমন করে যেন তাকায়! ধীরে ধীরে বলে...
- আসার পর আমারে একবারও হাবলু কইয়া ডাকস নাই তুই!
আমি কিছু বলি না। পাশে তাকিয়ে থাকি। এক লোক বিড়ি ধরাতে যাবে এমন সময় লোকটার পাশে বসা মেয়েটা বলে উঠল...
- আব্বা... তোমারে কতবার কইছি...বিড়ি খাইবা না... বিড়ি খাওন ভালা না। আমাগো ইশকুলের টীচার কইছে।
লোকটা কোমল হেসে মেয়েটার দিকে তাকায়। ভালোবেসে মাথায় হাত রাখে... বিড়িটা নদীতে ফেলে দিয়ে বলে...
- যা। খামু না। আমার রাজকইন্যা মানা করলে আমি খামু- অত্তবড় বুকের পাটা- আমার নাই।
আমার আব্বার কথা মনে পড়ে... মেয়েটার দিকে তাকিয়ে এশার কথা মনে পড়ে। এটাই বোধহয় পৃথিবীর নিয়ম। যখন প্রিয় কেউ কাছে থাকে না... তখন এমন কারো দিকে তাকালে মানুষ তার সেই প্রিয় মুখটা খুঁজে পায়! খুঁজতে চেষ্টা করে!

আমাদের গ্রামে ঢোকার সাথে সাথেই সালামকে দেখলাম। সালাম ছুটে আসল... জড়িয়ে ধরে বলল...
- আসতে অতক্ষণ লাগে... কেমন আছস গাধা?
আমি বড় স্বার্থপরের মত সালামের কথার কোন উত্তর দিই না। শুধু জিজ্ঞেস করি...
- এশা কই?
- ইশকুলের মাঠে ছিল... কিন্তু অখন তো আন্ধার হইয়া আসতেসে... এতক্ষণ আছে কীনা আল্লায় জানে!
আমি ছুটতে থাকি ইস্কুলের দিকে। সালাম- রাশু আমার সাথে দৌড়াচ্ছে। সালাম বলছে...
- ঐ গাধা... আস্তে দৌড়া। পইড়া যাবি তো!

স্কুলের মাঠের কাছে পৌঁছেই আমি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাই। সন্ধ্যার ফিকে হয়ে আসা আলোয় স্কুলের সবুজ মাঠটাকে কেমন কালচে লাগে- ঠিক মাঝখানেই যেন সাদা রঙের একটা পরী বসে আছে। আমি দূর থেকে এশার দিকে তাকিয়ে থাকি। মাথা নীচু করে এশা ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে। এশার মুখটা ঠিকমত দেখা যায় না। আমার ওর কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে না। আরো অনেক্ষণ কালচে হয়ে থাকা সবুজ ঘাসের মাঝে বসে থাকা- পরীটাকে দেখতে ইচ্ছে করে। সালাম অধৈর্য্য হয়ে ওঠে...
- কীরে খাড়ায় আছস ক্যান?
তখনই এশা চোখ তুলে তাকায়... সেই ভঙ্গিতে হেসে বলে...
- অবশেষে আপনি আসছেন!
আমার চোখদুটো ভিজে যায়। আমার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে সেখান থেকে। সাদা রঙের পোশাক পরে থাকা পরীটার সাথে কথা বলার শক্তি- আমার মত মানুষের নেই।

মাঠের ওপর আমি আর এশা বসে আছি। মাগরিবের আযান শুরু হয়েছে। মুয়াজ্জিমের কণ্ঠটা কেমন অচেনা লাগে। ছোট হুজুর কী চলে গিয়েছেন?
এশা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে...
- ভালো আছেন আপনি?
আমার কিচ্ছু বলতে ইচ্ছে করে না। এশার হাত ধরে চুপ চাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে!
- কী ব্যাপার? কথা বলছ না কেন?
আমি চোখে একরাশ জল নিয়ে এশাকে সব কথা বলি। আমারর আব্বার কথা। আমার মায়ের কথা। এশা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড়মামাদের বাড়িতে আমাদের অবস্থার কথা শুনে এশার চোখে পানি জমা হয়।
- আমাদের বাসায় চলে আস না... তুমি আর আন্টি। আমাদের কত্ত বিশাল বাড়ি। অথচ আমি আর আব্বু ছাড়া আর কেউ থাকে না।
- এইডা হয় নাকি?
- কেন হবে না?
- হুঁ...
- তুমি খুব পচা। একটা চিঠিও লিখ নাই।
এশার এসব কথা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়! মেয়েটা এত ভালো কেন? আমি নীচের দিকে ঘাস ছিঁড়তে থাকি। এশা বলে...
- আচ্ছা... এসব ফালতু কথা বাদ! নানাবাড়িতে তোমার কোন বন্ধু হয় নাই?
আমি জুয়েলের কথা বলি। ''চোরের পোলা'' জুয়েল। এশা হি হি করে হাসে। আমার মন ভালো হয়ে যায়। হাসতে হাসতে এশা বলে...
- জুয়েলকে সাথে করে নিয়ে আস নাই কেন?
আমি মুগ্ধ চোখে এশার দিকে তাকাই। আকাশ থেকে নেমে আসা এই পরীটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে- আমার বিশ্বাস হয় না।
- কালকে বাঁশি আর বই নিয়ে আসব... ঠিক আছে?
- আইচ্ছা!
- অনেকগুলো বই এনেছি! আর বাঁশিটা দেখলে তুমি ভয় পেয়ে যাবা। বাঘের মত ডোরা কাটা বাঁশি... হি হি হি...
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। সেই আঁধারে এশাকে বড় রহস্যময়ী মনে হয়! রহস্যময়ী সেই মানুষটার পাশে থাকতে আমার বড় ভালো লাগে! রহস্যময়ী সেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার বড় ভালো লাগে। এশা বলে...
- কালকে দেখা হবে... এখন যাই?...আব্বু বকা দিবে।
আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এশার সাথে আরো কিছুক্ষণ থাকার অজুহাত খুঁজি...
- চল... তোমারে বাড়িত দিয়া আসি!
পরী উঠে দাঁড়ায়...
- চল।
আকাশের অবাক হওয়া দৃষ্টির মাঝে আমি আর এশা পাশাপাশি হাঁটি। ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান ভেসে আসে। হঠাৎ এশা বলে...
- তুমি কই থাকবা?
- আমার বাড়ি আছে না?
- ঐখানে একটা পচা লোককে দেখেছি।
- হা হা হা... কিচ্ছু হইব না।

হাশেম মেম্বার বোতলটায় আরেকবার চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকাল...
- তুই কইত্থেকা? তোর মায়ে কই?
আমি হাশেম মেম্বার আর তার আশেপাশে লোকগুলোর দিকে তাকালাম। সবার হাতে একটা করে বোতল। কী বিশ্রী একটা গন্ধ! লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার প্রচণ্ড ঘৃণা করল। হাশেম মেম্বার চিৎকার করে ওঠে...
- কী চাস? দূর হ... এইখান থেইকা।
চাঁদহীন এই রাতে হাশেম মেম্বারের কথা শুনে আমার রাগ হয় খুব। এটা আমার বাড়ি! আমি এখান থেকে হাশেম মেম্বারের কথায় চলে যাব কেন? আমার কী যেন হয়ে যায়! কিছুক্ষণ আগে একটা পরীর মুখ দেখেছি বলেই হয়ত... একটা পরীর কথা শুনেছি বলেই হয়ত...আমি বলি...
- এইটা আমার বাপের বাড়ি! আপনে দূর হন...
হাশেম মেম্বার এবং তার লোকজন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। হাশেম মেম্বার বোতলে আরেকটা চুমুক দিয়ে কেমন করে যেন হেসে ওঠে...পাশের মাস্তানের মত দেখতে লোকটাকে বলে...
- কী কয় হারামজয়াদা?
হঠাৎ করে আমার মনে হয়- আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। আমি পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম...
- আমারে গালি দিবি না... হারামজাদা আমি না, তুই? আমার বাড়ি থেইকা বাইর হ!
পাশের লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসে...
- ওস্তাদ... শুয়োরের বাচ্চারে ফালায়া দিই?
হাশেম মেম্বার হা হা করে হেসে ওঠে...
- পোলা দেখি মায়ের মত__ হইছে।
রাগে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। আমার গলা কাঁপতে থাকে...
- আমার মারে লইয়া ফালতু কথা কইবেন না...
হাশেম মেম্বার সব দাঁত বের করে দেয়...
- ক্যান? কইলে কী অইব?

আমি আর তাকালাম না। পাশে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো নিয়ে হাশেম মেম্বারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হাশেম মেম্বারের লোকজন আমাকে টানতে লাগল। জ্ঞান হারানোর আগে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ মনে হয় আজ একেবারেই দেখা দিবে না বলে ঠিক করে ফেলেছে।

আমার চোখ ভিজে উঠল না। শুধু আলতো স্বরে ডাকলাম... মা... মা...

(চলবে...)


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো তো লাগতেইয়াছে...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আলহামদুলিল্লাহ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আবারও সেই অনুভূতি হলো!
এটা আমার পড়া সচলায়তনের খুব চমতকার সিরিজগুলোর একটা। এটা যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে আর কিছু বলার নেই।

চলুক

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ!!!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

সাংঘাতিক হইছে... খাদকেরন মতো কই পরেরটা তাড়াতাড়ী পাঠান বড়ই পড়ার ক্ষিদা হইতাছে দেঁতো হাসি

কল্পনা আক্তার
কল্পনাআক্তার@হটমেইল.কম

..............................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ক্ষুদার্থ অবস্থায় যত থাকা যায়...তত ভালো দেঁতো হাসি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রায়হান আবীর এর ছবি

সুন্দর!!

---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কে সুন্দর!!!
মিলা ভাবী নাকি তিশমা খালাম্মা??
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

ধুসর গোধূলি এর ছবি
পরিবর্তনশীল এর ছবি

দেঁতো হাসি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

ঝরাপাতা এর ছবি

এই পর্বটা রীতিমতো দুর্দান্ত ।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

তার মানে????
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

বহুত খুব।চালিয়ে যান...।
-নিরিবিলি

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হোটেল নিরিবিলি...কী খবর?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রানা মেহের এর ছবি

সিরিজটা চমতকার হচ্ছে পরিবর্তনশীল।
শুধু হাসেম মেম্বার পান করছে।
বালক বীরের মতো গেছে ঘর উদ্ধার করতে।
মাকে ডাকছে ।

এই ব্যাপার গুলো কেমন যেন মনে হচ্ছে সিনেম্যাটিক।

এষা একবার আপনি করে বলছে আবার তুমি।
এটা কি ইচ্ছাকৃত?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হুম...
প্রিয় মানুষকে হঠাৎ আপনি করে বলাটা বলতে পারেন এশার বৈশিষ্ট্য
আর গল্প যদি পুরোপুরি বাস্তব হয় তবে... কল্পনার মূল্য কোথায়?
ধন্যবাদ।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অনিন্দিতা এর ছবি

আমি পরিবর্তনশীলের লেখা দেখলেই পড়ার চেষ্টা করি।
খুব ভাল হচ্ছে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অমিত আহমেদ এর ছবি

পড়লাম।
পরের পর্বের অপেক্ষায়।
সব শেষে একটা বড় মন্তব্য দেয়ার ইচ্ছে আছে।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

পরিবর্তনশীল এর ছবি

পুরাটা শেষ হইলে আপনি আর শিমুল ভাই ভুলগুলা সব ধরিয়ে দেবেন
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

খাইছে!
এই ভয়ে কমেন্ট বন্ধ করতে হবে।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

এবারের টাও খুব ভালো লাগলো হাসি আচ্ছা এশা এত সুদ্ধ ভাষা আর মনা সাধু ভাষায় কথা বলে কেনো?

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সাধু ভাষা কই পাইলেন হে...
আছে মানে হইল (আস্‌এ) দেঁতো হাসি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রিসালাত বারী এর ছবি

পরের পর্ব কই?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।