চীনা পাড়ায় বসবাস

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: মঙ্গল, ০১/০১/২০০৮ - ১১:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইনকে (সংক্ষেপে UIUC) ঠাট্টা করে যে নামগুলোতে ডাকা হয়, তার একটা হলো - ইউনিভার্সিটি অফ ইন্ডিয়ান অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ চাইনিজ। কারণটা আসলেই ঠিক - এখানে চীনা ও ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা খুবই বেশি। এটা প্রকৌশলে অনেক শাখাতেই আমেরিকার প্রথম ৫টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে পড়ে, কিন্তু প্রথম সারির অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে এখানে বিদেশি ছাত্র ভর্তি করে অনেক বেশি।

যাহোক, এখানে আমি থাকি ফ্যামিলি অ্যান্ড গ্রাজুয়েট হাউজিং, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায়। যেসব ছাত্রদের পরিবার আছে, তারা অনেকেই এখানে থাকে। আমাদের এলাকাটাকে দেখলে অনেক সময় চায়নাটাউন বলে ভ্রম হতে পারে। কারণ, এখানে বসবাস করা অধিকাংশ মানুষই চীনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস হতে বাসায় আসতে বাসে দশ মিনিট লাগে। এই দশ মিনিট চীনা ভাষায় বিভিন্ন কথা শুনতে হয়।

অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সিঁড়িঘরে ঢুকলেই বিচিত্র সব গন্ধ পাওয়া যায়। চীনাদের রান্না আমরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কিন্তু কখনোই খাই না। আসলে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চীনা খাবারের নামে আমাদেরকে দেশী খাবারই অন্য কায়দায় গছিয়ে দেয়। আসল চীনাদের খাবার পুরা আলাদা, আর আমাদের বাঙালি নাকে তা সহ্য করা বড় দায়।

মানুষ হিসাবে চীনারা কিন্তু খুব পরিশ্রমী। চীনা ছাত্র বা অধ্যাপকেরা পাগলের মতো খাটতে পারে। তাই দেশ হিসাবে এদের উন্নতি এরকম হচ্ছে। এদের গলা দিয়ে ইংরেজি বের হয় না, কিন্তু তার পরেও এরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা পায় প্রচন্ড অধ্যাবসায়ের জোরে।

গরম কালে আমাদের বাসস্ট্যান্ডে কাঁচাবাজার বসে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার পাশে ক্ষেত আছে, যা থেকে বাগান করার জন্য গ্রীষ্মকালে প্লট বরাদ্দ দেয়। চীনারা অনেকেই বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে। ঐসব বুড়াবুড়িরা রীতিমত কোদাল, বালতি, শাবল ইত্যাদি নিয়ে চাষবাস শুরু করে। তাই গরমকালে একেবারে টাটকা ফল, শাক, এসব পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, চীনা যে বুড়িরা এসব বেচতে বসে, তারা বিন্দুমাত্র ইংরেজি জানে না। ওদেরকে যাই প্রশ্ন করিনা কেনো, জবাব একটাই One Dollar!!! ওরা কেবল এইটাই জানে। অবশ্য কিছু প্রশ্ন করলে উৎসাহের সাথে চীনা ভাষায় অনেক অনেক কথা বলতে থাকে। আমি আর আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে বোঝার চেষ্টা করি, কোনো শব্দ যদি কোনোদিন আঁচ করতে পারি।

এখানে যারা পিএইচডি করতে আসে, সবাই প্রচন্ড মেধাবী, তবে অন্যরকম ব্যাপার ঘটে গরম কালে। সামারের ৩ মাসে এখানে সাধারণত ক্লাস বন্ধ থাকে, কিন্তু অনেক শর্ট কোর্স থাকে। আর আমাদের দেশের মতো চীনেও "মামা-চাচা ধরা"র ব্যাপারটা চালু আছে। তাই সামারে যেসব চীনারা এক দঙ্গল বেঁধে এই শর্ট কোর্স করতে আসে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের দেখেই বোঝা যায়, খুব অগা-মগা টাইপের। আমি এই অ্যাপার্টমেন্টে প্রথম আসি বছর তিনেক আগে। একদিন বিকালে বাইরে হাটছিলাম। হঠাৎ দেখি পুরাপুরি খালি গায়ে শুধু শর্টস পরে এক লোক হাটা হাটি করছে। আমার নিচের তলার চীনা বেশ কয়েকজন ঐ শর্ট কোর্স করতে এসেছিলো, তাদের বাসার পর্দা টর্দা কিছুই নাই। ভিতরে চীনা লোকগুলো শর্টসও বাদ দিয়ে কেবল অন্তর্বাস পরে দিব্বি হাটা চলা, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া সব করছে। বাইরে থেকে তাদের দেখা যাচ্ছে, এটা নিয়ে তাদের কোনোই মাথা ব্যাথা নাই। আমার বেকুব বনে যাওয়া দেখে পাশের বিল্ডিংএর বাংলাদেশী ভাই জানালেন, এরা ঐ "মামা-চাচা-ধরা" পার্টি। অন্য চীনারা, যারা একটু শিক্ষিত, তারা অন্তত খালি গায়ে এভাবে ঘুরাঘুরির অসভ্যতাটা করে না।

শেষ করছি ডিপার্টমেন্টে ল্যাবের কথা বলে। আমাদের ল্যাবে বেশ কয়েকজন প্রফেসরের ছাত্ররা বসে। এর অনেকেই চীনা। আমার প্রফেসর একদিন আমাদের গ্রুপের একজনকে প্রশ্ন করলো, "এখানে অন্য কে কী কাজ করছে"। ঐ মার্কিনী ছেলেটা জানালো, ল্যাবে ইংরেজিতে তো কেউ কথা বলেনা। ল্যাবের জাতীয় ভাষা এখন চীনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফোন থেকে শুরু করে আড্ডা, সবই চীনা ভাষায় হয়।

এই ঘটনা শোনার পরের দিনই প্রফেসরেরা সব বৈঠক করে পরে ইমেইল করলেন, ল্যাবে আজ থেকে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় নিজেদের মধ্যে আড্ডাবাজি বন্ধ। এখন কিছুটা মুক্তি পেয়েছি, চীনা ভাষার কথোপকথন শোনা থেকে। নইলে হয়তো চীনা ভাষাটা নিজেও বলা শুরু করতাম!!

(লেখাটি বছর খানেক আগে সামহয়ারইনব্লগে প্রকাশিত হয়েছিলো। )


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

চীনাদের গন্ধের পাশাপাশি আরেকটি ব্যাপার লক্ষ না করে পারা যায় না, চীনাদের শব্দ!

গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়
কে যেন আমারে ডাকে
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

ছুটির দিনের আগের রাতে, যাকে বলে রাত্রি দ্বিপ্রহর, ঘুম ভেঙে যায় পাড়াকাঁপানো ভালোবাসার আওয়াজে। উৎস আমার চৈনিক প্রতিবেশিনীর ঘর। কিছুক্ষণ পর আবারও সবকিছু অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট হবার পর যখন কম্বলমুড়ি দিয়ে আবার ঘুমানোর তোড়জোড় করছি, তখন আবারও শুরু হয় সেই আকূল আর্তনাদ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

সেটা আর বলতে; ডরমে আমাদের রুমগুলো নাকি সাউন্ডপ্রুফ ছিল। এই কথাটা আমার এক বড়ভাই মানতেন না। ওনার রুমের পাশে থাকতো জনৈক চৈনিক তরুণী। প্রায় রাতেই ওনার

গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়
- অবস্থা হতো সেই তরুণীর আর্তনাদে। সেই আর্তনাদ ওনার কাম-অতৃপ্ত কর্ণকুহরে এমনই শিহরণ তুলতো যে উনি "ঘুম জেগে" বসে রইতেন। সবসময় এভাবে স্রেফ বসেই পার পেতেন এমন নয়। মাঝরাতের ঘুম জাগানিয়া অনেক অযাচিত শ্রমের মাশুলও গুনতে হতো ওনারে!!

নজমুল আলবাব এর ছবি

পড়া শেষ করে কমেন্টের ঘরে আসতেই আমি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

মানুষ হিসাবে চীনারা কিন্তু খুব পরিশ্রমী।

একেবারে খাঁটি কথা। কিয়েভে ওদের দৌলতেই সামারে খেতে পারছি দেশি লাউ, করলা, নানা ধরনের শাক এবং আরও সব সবজি, যা এই দেশে চীনাদের আগে কেউ চাষ করেনি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

হিমু এর ছবি

ওরা আসলেই বেশ খাটে দেঁতো হাসি ...


হাঁটুপানির জলদস্যু

স্নিগ্ধা এর ছবি

রাগীব,

ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে রাখা ভাল - কারণ grad life এর নামচার খুঁটিনাটি অংশ হিসেবে কখনো যদি এসেই পড়ে - আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের একজন বাংলাদেশী প্রফেসর আমার খুব পরিচিত ঃ)

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যতজন চীনাকে চিনি, কাউকে কখনো পরীক্ষায় 'খারাপ ফল' করতে দেখি নি। একজনকে চিনতাম যে এক হাতে Chinese to English Dictionary নিয়ে পড়তে বসতো এবং অবশ্যই সবচেয়ে বেশী নাম্বার পেত। তবে সেটা quantitative বিষয়ে যেখানে নাম্বার এর আধিক্য, আমার বিভাগে চীনাদের এই জয় জয়কার ছিলো না, আমার ধারণা ভাষায় দাখিল্যের অভাবে।

রাগিব এর ছবি

তাহের ভাইয়ের কথা বলছেন, আন্দাজ করছি। হাসি

চীনাদের নাকি শুনেছি চীনা ভাষায় পুরো পরীক্ষার "চোথা" রেডি থাকে (বুয়েটীয় ভাষায় চোথা মানে হলো notes), আর সেই চোথা বংশানুক্রমে নতুন আসা ছাত্রদের কাছে আসে।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

লেখায় দিলাম বিপ্লব, আর হিমু ভাইয়ের মন্তব্যে প্লাবন!!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

চীনাদের যৌথ বসবাস একটি আশ্চর্য শিল্প বটে। সিঙ্গাপুরে আমার পাশের ফ্ল্যাটে একটি চীনা পরিবার থাকতো। তাদের আবার রীতি বাসার বাইরে জুতা-স্যান্ডেল খুলে রাখার। এক গভীর রাতে গুনে দেখি আঠারো জোড়া।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

বিপ্লব রহমান এর ছবি

(বিপ্লব)


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

তানভীর এর ছবি

নুডলস চীনাদের প্রিয় খাবার কিনা জানি না। তয় আমেরিকায় এসে চীনাদের খুবই আরাম হইছে। এক ডলারে ১০ প্যাকেট রামেন নুডলস পাওয়া যায়। ল্যাবের চীনাদের দেখতাম লাঞ্চে এক প্যাকেট আর ডিনারে এক প্যাকেট নুডলস- এই ছিল দৈনিক খাবার। সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসে খাওয়ার পেছনে ওদের ব্যয় মাত্র এক ডলার। আমার এক বন্ধুর চীনা কলিগ আরো দুই কাঠি সরেস। সে লাঞ্চের বরাদ্দটা একটু এদিক-ওদিক করে পুরো সপ্তাহই এক ডলারে চালাত! আর পুরো মাসের খাবার খরচ মাত্র চার ডলার!! আমার বন্ধু তাকে রসিকতা করে মাঝে মাঝে ডাকত " One Dollar Man" একদিন সেই চীনা তাকে আড়ালে ডেকে রিকোয়েস্ট করল, সবার সামনে এই উপাধিতে না ডাকতে- হাজার হলেও ইজ্জতের ব্যাপার!

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আমার ধারণা, এটা নেহাতই এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। চীনাদের ঢালাওভাবে কিপটে বলতে পারছি না। ছাত্রদের হস্টেলে ওদের রান্নার উপকরণ আর সুপারমার্কেটে কেনাকাটার বহর দেখে টাশকি খেয়ে গেছি বহুবার।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শামীম এর ছবি

জাপানে চৈনিক বর্ণমালা দিয়ে লেখে অনেক কিছু। তাই ওদের বর্ণমালার বিশালতা সম্পর্কে একটু আইডিয়া আছে।

যে সকল চীনারা ইংরেজি ভাল জানে.... তাদেরকে অবশ্যই অন্য চোখে দেখি ... আফটার অল যে ভাষায় বর্ণমালা নেই বরং প্রতিটি চিহ্ণই একেকটি শব্দ/বাক্য/ভাব প্রকাশ করে, সেই ভাষা (দশ হাজারের বেশি চিহ্ন=কাঞ্জি সমাহার) শেখার পরে আরেকটি ভাষা... ভাবাই যায় না!

আর শুনেছেন কি না জানিনা .... .... চাইনিজ কাঞ্জির উৎপত্তি হয় ডার্ট বোর্ডে নুডুলসওয়ালা ডার্ট (চপস্টিক) ছুড়ে মারার পর যে আকৃতি হয় সেখান থেকে। গড়াগড়ি দিয়া হাসি

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।