ছেঁড়া ঘুড্ডি ...(০১)

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১১/২০০৮ - ১:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘যেখানে দেখিবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ মিলিলে মিলিতে পারে/ অমূল্য রতন...।’ কে লিখেছিলেন ? রামনিধি গুপ্ত ? ঈশ্বর গুপ্ত ? না কি অন্য কেউ ? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এই চরণগুলো সেই শৈশব-কৈশোরে স্তোত্রের মতো ঠোটস্থ করেই কি ক্ষান্ত হয়েছিলাম ? মোটেই না। স্তোত্র বা শ্লোক কি আর মিথ্যে হতে পারে !

আজ থেকে ত্রিশোধিক বছর পূর্বে মফস্বল শহরগুলোতে এখনকার মতো তো আর প্রাকৃতিক জ্বালানী গ্যাসের কায়কারবার ছিলো না। লাকড়ি, খড়ি, তুষ, শুকনো লতা-পাতা খড় নির্ভর চুলাসমৃদ্ধ বাঙালির রান্নাঘরের বাইপ্রোডাক্ট বর্জ্য হিসেবে ছাইয়ের চেয়ে হীন তুচ্ছ পদার্থ আমাদের ইহলৌকিক জীবনে আর কিছু ছিলো বলে জানা ছিলো না। পরিবারের সবচেয়ে অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলেটিকেও যখন বলা হতো ‘তোর পাতে ছাই দেবো’, শতকরা নিরানব্বইভাগ সম্মানবোধহীন ছেলেটিরও বাকি একভাগ সম্মানবোধ ধপ করে জ্বলে উঠতো অপমানে ! দেশ-গাঁয়ের বাক্যবাণ সমৃদ্ধ ঝগড়াটে দুই প্রতিবেশিনীর ঝগড়ার চূড়ান্ত অস্ত্র প্রয়োগ হতো ‘তোর মুখে ছাই পড়ুক’ বলে। অতএব এতো হীনমানের বস্তুটি যে হাটেমাঠেঘাটে পথে গলিতে যত্রতত্র অতি সহজলভ্য হবে তাতে আর বিচিত্র কি !

আজ যারা অগ্নিমূল্যে ক্রয়কৃত মাছের সাথে মহার্ঘ গিফট হিসেবে এক পুটলি ছাই পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে উঠেন, তাদের কথা ভেবেই সেই যুগের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবি উপরোক্ত চরণগুলো রচনা করেছিলেন কিনা কে জানে। তবে অতি তুচ্ছ এই ছাইয়ের মধ্যে অমূল্য রতনের এতো সহজলভ্য উৎসের খোঁজ পেয়ে আমাদের সেই বালকবেলার রত্নপ্রাপ্তির প্রেরণা যে কোথায় গিয়ে ছুঁয়েছিলো তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! আশে পাশে কাছে দূরের যতো টাই করা ছাই আর ছাইয়ের ডিপো ছিলো প্রতিদিন সেগুলোর দশমদশারও দফারফা ঘটতে লাগলো। ঘাটাঘাটির চূড়ান্ত আর উড়ানো প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করে ব্যর্থ অনুসন্ধান শেষে প্রতি ত্রিসন্ধ্যায় যে ভস্মমূর্তি ঘরে ফিরে আসতো তার বর্ণনা আর না-ই দিলাম। এই ত্রিকালমূর্তি দশায় ‘ওরে মুখপোড়া, ওই ছাইভস্মের মধ্যে পড়ে না থেকে আমার হাড় জ্বালাতে এখানে এলি কেন ! যা হতভাগা ওই ছাইভস্মে যা!’ মায়ের অনিবার্য বর্ষণে তোয়াক্কা না করলেও ছাই সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞানতার করুণ হাল দেখে বিস্মিত হতাম বৈ কি। এতে অবশ্য পরের দিনের উদ্যমে কিছু মাত্র ভাটা পড়তো না। মা না জানতে পারে, তাই বলে ইস্কুলের বইয়ে কি আর মিথ্যে লিখেছে !

আহা, কি দিনগুলো চলে গেছে ! হঠাৎ করে আয়নায় একদিন দেখি আমি বড় হয়ে গেছি ! আসলেই কি বড় হয়েছি ? অমূল্যের সন্ধান না পেয়েই সেই রত্ন-সন্ধানী শৈশব আর কৈশোর কি সত্যিই হারিয়ে গেছে ? এক বিশাল শূণ্যতা বুকে নিয়ে এখনো ছাই খুঁজে ফিরি আমি। অথচ আশেপাশে তাকিয়ে মনে হয়, কী ভীষণ ছাইভস্মের মধ্যে এই জীবনটাকে নিয়ে গড়িয়েই যাচ্ছি কেবল ! কিন্তু কোথাও আর আমার সে-ই ছাই দেখি না...!


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

জাঝা
মারাত্মক।

দুধ ভাতের বদলে মাছ ভাত। মাছ ভাতের বদলে ডাল ভাত। এর পরে পান্তা ভাতের দিনও বোধ হয় ফুরালো।
এবার না হয়, ছাই দিয়েই মুখ ভরুক আমাদের...

পুতুল এর ছবি

মাছের সাথে ছাই দেয়ার ব্যাপার চালু হয়ে গেছে! আমাদের ছাই উড়ানো বিফল হয়নি কখনো! আমন ধান কেঁটে নিয়ে অবশিষ্ট খরের উপর বুনতো মটরশুটি বা কলাই। সে ফসলটা তুলে নারায় আগুন দিত ক্ষেতের মালিক। আগুনটা নিভে গেলে খুঁজতে থাকতাম আগুনে পোড়া মটর শুটি। কী মজা করে যে খেতাম! এই উপায়ে মটর খাওয়ার বরতি ঝামেলা ছিল মায়ের বকুনী।
সুন্দর লিখেছেন ছেলে বেলার কথা।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

-

কী ভীষণ ছাইভস্মের মধ্যে এই জীবনটাকে নিয়ে গড়িয়েই যাচ্ছি কেবল!
ভাবছি, কোনো বাঁধাধরা গণ্ডি আর প্রথাগত কোনো পথে না চালিয়ে আমার ক্রমাগত এক্সপেরিমেন্টাল জীবন নিয়ে আমি 'হ্যাপি' কীনা!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

সারা সপ্তাহ ছাই-ভস্ম গুতিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা আবার সপ্তাহান্তে ছাই-ভস্ম গেলা। কবে কোনো একদিন ছাই-ভস্ম হয়ে এভুবনে মিলিয়ে যাওয়া।

রণদীপমদা, খুব ভালো হয়েছে (ছাই-ভস্ম নয়) লেখা।

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ছাই নিয়ে কী সব ছাইভস্ম লিখলেন রণদা। চোখ টিপি
লেখায় জাঝা

কীর্তিনাশা এর ছবি

দুর ছাই! এমন লেখা পড়লে তো মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ

তবে মন খারাপ হলেও আপনাকে পাঁচতারা। চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুর্দান্ত লেখা, ইয়োগা-গুরু রণ'দা। হাসি
শেষ প্যারাটা ভীষণ ভাল লাগল। চলুক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইহা হয় ছাইপাশ লেখা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।