বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১৩: শিয়াকুল

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৫/২০১৩ - ৩:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তারপর সে ভয়ে ভয়ে বনের মধ্যকার সুঁড়িপথ দিয়ে বিছুটি লতার কর্কশ স্পর্শ গায়ে মেখে, সেঁয়াকুল কাঁটায় শাড়ির প্রান্ত ছিঁড়ে অতিকষ্টে এসে গ্রাম-প্রান্তের কাওয়ার পাড়ায় পা দিলে।
—ইছামতী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

শিয়াকুলকে কি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত উদ্ভিদ বলা যায়? কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে ‘হ্যাঁ’-টা বোধহয় বলাই যায়। কারণ, একমাত্র আমাদের গ্রামে কুদ্দস পার্ক ছাড়া আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। যদি কোথাও থেকে তা—নিশ্চিত বলে দেয়া যায়, আঙুল ধরে ধরে সেগুলোর সংখ্যা গোণা যাবে। তাই কুল বা বরই প্রজাতির ক্ষুদ্রতম এই সদস্যকে বৈঁচির চেয়েও বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের কাতারে ফেলতে পারেন।

আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। সাধারণ এক জাতের বুনো কুলকে এতোদিন আমি শিয়াকুল বলে মনে করতাম। বছর পাঁচেক আগে জানতে পারলাম আমাদের গাঁয়ের ‍কুদ্দুস পার্কে ডালপালা মেলে বেড়ে উঠেছে একটা শিয়াকুল গাছ। সেই গাছটা দেখতে গিয়েই আমার বহুদিনের ভুলটা ভাঙল।


শিয়াকুল ঝোপ জাতীয় বহুবর্ষজীবী গুল্ম বা বৃক্ষ। সাধারণ কুলগাছেরও একটু ঝোপালো বেশিষ্ট্য আছে। কিন্তু শিয়াকুল পুরোটাই ঝোপালো। একেবারে নতুন জন্ম নেয়া চারাও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হেলে পড়ে। চারাগাছের একেবারে গোড়া থেকেই ডালপালা গজায়। ডাল ছাঁটলেও কাণ্ড ওপরের দিকে উঠতে চায় না। শিয়াকুলের ঝোপ ৮-১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে।


ঝোপ হলেও তো কাণ্ড থাকে। শিয়াকুলেরও আছে। এর কাণ্ড ধূসর রংয়ের। কাণ্ড চার-পাঁচ ফুট লম্বা হয়। তবে কাণ্ড সোজা হয় না। সাপের মতো আকাবাঁকা। কাণ্ড অত্যন্ত শক্ত হয়—প্রায় বাবলা কাঠের মতো।


ছবি : Flickr.com
শিয়াকুলের পাতার রং গাঢ় সবুজ। সাধারণ কুলের পাতা গোল। কিন্তু শিয়াকুলের পাতা ডিম্বাকৃতির অথবা বর্শার ফলার মতো। পাতা একপক্ষল। পাতার দের্ঘ্য ১-১.৫ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে। প্রস্থ সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি। সাধারণত পাতা মৃসণ নয়, তবে খুব বেশি খসখসেও নয়। পাতা নরম এবং পাতলা। প্রতিটা পাতার গোড়ায় ছোট্ট ছোট্ট কাঁটা থাকে। কাঁটার আগাটা বরশির মতো বাঁকানো।


ছবি : Flickr.com
শিয়াকুলের প্রান্তিক ডালের গায়ে প্রতিটা পাতা আর কাঁটার গোড়ায় ৫-১০টা করে ফুলের কুঁড়ি বের হয়। ফুটন্ত ফুল দেখতে মহিলাদের নাকফুলের মতো। প্রতিটা ফুলে পাঁচটা ছোট এবং পাঁচটা বড় পাঁড়ড়ি থাকে।


ছবি : Flickr.com
একটা ছোট পাঁপড়ির পর একটা বড় পাঁপড়ি—এবাবে সাজানো থাকে।পাঁপড়ির রং সাদাটে সবুজ। ফুলের ব্যাস .৫ সেমি করে হতে পারে। পাপঁড়িগুলোর মাঝখান থেকে সবুজ রংয়ের লিম্বাটে ফল গজিয়ে ওঠে। হেমন্তে শুরুতেই শিয়াকুলে মুকুল আসে। শেষের দিকে ফল গজায়।


ছবি : উইকিমিডিয়া
ফল দেখতে কুলের মতো হলেও দেশি কুলের চেয়ে অনেক ছোট। বরং বৈঁচি ফলের সাথে এর অনেক মিল। ফলের আকার একটা মটর দানার মতো। কাঁচা ফলের রং গাঢ় সবুজ। ডাসতে শুরু করলে সামান্য হলদে ভাব দেখা দেয়। পাকা ফল কালচে সবুজ। পাকা ফলের স্বাদ সামান্য টক। দেশি কুলে যেমন টক-মিষ্টি স্বাদের মিশেল থাকে, শিয়াকুলের স্বাদে কোনো মিষ্টিভাব থাকে না। বরং কাঁচা পেয়ারার স্বাদের সাথে সামান্য টকাভাব যোগ করলে যেমন হতে পারে পাকা শিয়াকুলের স্বাদটাও তেমন। আসলে পরিষ্কার করে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। ফলের ভেতর গোল-দ্বিবীজপত্রী শক্ত-অথচ ভঙ্গুর বিঁচি থাকে। বর্ষাকালে শিয়াকুলের বীজ থেকে চারা গজায়।


ছবি : Flickr.com
শিয়াকুলের বৈজ্ঞানিক নাম : Ziziphus oenoplia


প্রিয় সচল, শিয়াকুল নিয়ে এতক্ষণ যে বকবকানি শুনলেন তা কুদ্দুস পার্কের গাছদুটোর কল্যাণেই জানা। যাইহোক, কোনো সচলের কাছে কোনো শিয়াকুল গাছের সন্ধান জানা থাকে তবে আজয়াজ দেবেন। বাংলাদেশে আদৌ আর কোনো শিয়াকুল গাছ আছে কিনা তার একটা জরিপ প্রয়োজন। সুখের কথা হলো, কুদ্দুসপার্কের মালিক প্রভাষক আব্দুল কুদ্দুস তাঁর বাগানে গোটা বিশেক নতুন শিয়াকুল চারা জন্মাতে পেরেছেন। ভদ্রলোককে সচলের পক্ষ স্যালুট জানাতেই পারি, না-কি?

--------------------------------------------------------
এই সিরিজের অন্য পোস্টগুলো—
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১ : শিয়ালকাঁটা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-২ : ভাঁটফুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৩ : কালকসুন্দা / কালকসিন্দা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৪ : আকন্দ
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৫ : আশশেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৬: কচুরিপানা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৭ : বৈঁচি
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৮ : শেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৯ : শিমুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১০ : ভেরেণ্ডা / কচা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১১ : হাতিশুঁড়
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১২ : বট

ছবি: 
17/05/2012 - 12:40পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

রণি, এবারের ছবিগুলোতো বেশ। লেখাতো ভাল অবশ্যই।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ আপু। এবারের ছবি তো আমার নয়, এজন্যই ভালো হয়েছে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

লেখা চালিয়ে যান। আগেও বলেছি, আবারও বলি, ভালো একটা সিরিজ হচ্ছে, প্রয়োজনীয়ও বটে।
এমন একটা কাজের জন্য লেখককে ধন্যবাদ।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, হাতে যে পরিমাণ রসদ আছে তাতে আরো ১০ পোস্ট অনায়াশে চালিয়ে নেয়া যাবে। তবে তারপরও থামার কোনো ইচ্ছে নেই।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তারেক অণু এর ছবি

আব্দুল কুদ্দুস সাহেবকে স্যালুট, দেশে গেলে আপনার সাথে যোগাযোগ করে সেই বাগানের যাব

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আবার দেশে কবে আসবেন?

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

রনি ভাই ,
একটা চারা কি জোগাড় করা যাবে?

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

হ্যাঁ যাবে, কুদ্দস কাকা তো আমাকে দিতেই চেয়েছিলেন। যেহেতু আমি বাড়ি থাকি না তাই অযত্নে মারা পড়তে পারে বলে নিই নি।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই আপনার ছোটখাটো কাজ থাকলে আমাকে বলতে পারেন, করে দিতাম। আর আপনি সময় করে সুন্দর সুন্দর লেখা ছবি সহ পোস্ট করতেন। অনেক ভালোলাগলো। ধন্যবাদ জানবেন

রাসেল জামান

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনি কি এলাকায় থাকেন, তাহলে আমার কাজে লাগতে পারে। বিশেষ করে ছবি তুলতে আপনার সহযোগিতা লাগতে পারে।
আমার ফেসবুকের দিলাম যোগাযোগ করবেন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হয় আপনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারব বনে বাঁদাড়ে। আসলে এ ধরনের কাজকে অন্যরা ছেলেমানুষি মনে করে। কিন্তু সাথে একজন সহযোগী থাকলে সুবিধা হয়। আপনার বাড়ি কোন এলাকায়, মানে কোন থানায় জানাবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

কৌস্তুভ এর ছবি

লেখা -গুড়- হয়েছে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই, ফেসবুকে যোগাযোগ করিলাম

রাসেল জামান

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

খুব ভালো হলো, হলিণাকুণ্ড উপজেলায় এখনো আমার পা পড়েনি। আপনার সাথে এলাকাটাও দেখা হবে গাছ গাছড়ার দেখাও মিলবে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

শেখ আহমদ আলী এর ছবি

আমি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। আমাদের গ্রামে আগে অনেক ছিল এই কুলের গাছ। এখনও আছে, তবে সংখ্যাটা খুবই কম। আমি আমার বাগানে দুটি ছাড়া লাগিয়েছিলাম বছর 15 আগে। বর্তমানে সেগুলিতে ফলও পাই, আর গাছ গুলিও বেশ বড় জঙ্গল করে ফেলেছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।