বিবর্তন ৭: পাঞ্জিয়ার পঞ্চতত্ত্ব

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: রবি, ২২/০৪/২০১৮ - ৮:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা সবসময় এরকম ছিলোনা। এর বহু পরিবর্তন হয়েছে। ধারণা করা হয়, এবং ভূতত্ত্ববিদগণ প্রমাণও পেয়েছেন যে আজকের যে বিভিন্ন মহাদেশ তারা একসময় খুব কাছাকাছি অবস্থান করে একটা মহা-মহাদেশ তৈরি করেছিলো। যাকে আমরা পাঞ্জিয়া বলে জানি। পরে বিভিন্ন অংশ ভেঙে, ভূগর্ভের টেকটোনিক প্লেটের কারিকুরিতে আমরা ছড়িয়ে ছিটেয়ে পরেছি।

পাঞ্জিয়া ভেঙে যাওয়ার পর ২৫ মিলিয়ন বছরেরও বেশি আগে ভারত ভূখন্ড এসে এশিয়ার মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়, ফলে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর এই দুইটা ভূখন্ড এখনও সংঘর্ষিত হচ্ছে, যা প্রতিবছর হিমালয়ের উচ্চতা দেড় থেকে দুই ইঞ্চি বাড়িয়ে চলেছে (প্রচ্ছদ এনিমেশানটা দেখুন, নিচে বামের সময়টা বোঝাচ্ছে মিলিয়ন বছর আগে)। নেপাল দুই ভূখন্ডে প্রায় সংঘর্ষের জায়গাটিতে অবস্থিত। নেপালে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। এখানে যে ভূমিকম্প হবে সেটাই স্বাভাবিক। প্রতি ৭৫ বছরে একবার রিখটার স্কেল ৮ এর কাছাকাছি ভূমিকম্প এই এলাকায় হবে সেটা ধরে নেয়াই যায়। এখানে ৮১ বছর আগের ভূমিকম্পটির ফলে প্রায় ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। এখনতো আরও ঘনবসতি হয়েছে।

এবার আসি কেন এসব বলছি সেই গুঢ় তথ্যে! বিবর্তন তত্ত্বের একটা সমস্যা ছিল এই প্রশ্ন- যদি বিবর্তনের ফলে বিভিন্ন জীবের উদ্ভব হবে তবে কিভাবে বিভিন্ন মহাদেশে একইধরনের প্রাণীর উদ্ভব হল? যেমন ব্যাঙের মত উভচর প্রাণী সবগুলি মহাদেশে দেখা যায় (এন্টার্টিকা ছাড়া)। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে বিভক্ত। কিন্তু ব্যাঙের ত্বক পারমিয়েবল বা ভেদ্য, ফলে তারা তো সাঁতার কেটে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে পারবেনা।

তবে কি ভিন্ন দুইটি যায়গায় একদম একইরকমের প্রাণীর উদ্ভব সম্ভব? সম্ভবত নয়। ডারউইন ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছিলেন এভাবে- হয় ব্যাঙগুলি কোনকিছুর সঙ্গে ভেসে ভেসে অন্য মহাদেশে গেছে অথবা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকাকে যুক্ত করা কোন ভূমির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ডারউইন নিজের ব্যাখ্যায় মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে একজন জার্মান ভূতত্ববিদ (আলফ্রেড ওয়েঙ্গার) একটা অসাধারণ তত্ত্ব দিলেন- পৃথিবীর ভূমির বেশিরভাগই একসময় একজায়গায় যুক্ত ছিল। এখনকার মানচিত্রে মহাদেশগুলির আকৃতি দেখলে আসলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। এই সুপার-কন্টিনেন্ট বা সুপার-মহাদেশকে নাম দেয়া হল পাঞ্জিয়া। পাঞ্জিয়া ভেঙে একসময় অনেকগুলি মহাদেশ হল। তাই ধারনা করা যায় ব্যাঙের মত উভচরের উদ্ভব পাঞ্জিয়া ভেঙে যাওয়ার আগেই হয়েছিল। ফলে সবগুলি মহাদেশে তারা ছড়াতে পেরেছে।

পাঞ্জিয়া ভাঙনের পরে যেই পরিবর্তনগুলি হয়েছে সেটা এখনও চলমান। আমাদের ভূখন্ডগুলি এখনও নড়ছে, তবে এত ধীরে যে আমরা বুঝছিনা। উদাহরণ হিসেবে বলি, পাঞ্জিয়া ভাঙার পরে ভারতীয় উপমহাদেশ (বাংলাদেশ সহ) কোন এক সময়ে আফ্রিকার নিচের দিকের অংশ, এন্টার্টিকা এবং অষ্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। তারপর ভারতীয় ভূখন্ড সরে আসতে আসতে এশিয়ার মূল ভূখন্ডের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়। এই চাপে হিমালয় পর্বতমালা তৈরি হয়েছে।

যেসব জীব পাঞ্জিয়া ভাঙনের পরে বিবর্তনের ফলে উদ্ভব হয়েছে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরকম। যেমন, প্রকৃতিবিদ এবং যৌথভাবে বিবতর্ন তত্ত্বের প্রবক্তা আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস খুঁজে পেয়েছিলেন যে ইন্দোনেশিয়ার থেকে অষ্ট্রেলিয়ার উত্তর দিক (নিউ গিনি) একটা অদৃশ্য রেখায় বিভক্ত যেখানের জীববৈচিত্র ভিন্নরকম। এই লাইনটাকে বলা হয় ওয়ালেসের রেখা। রেখার উত্তরদিকের অংশে ম্যামালেরা বা স্তন্যপায়ীরা হল বানর গোত্রীয়, আর দক্ষিণ দিকের অংশ হল ক্যঙ্গারু গোত্রীয়। কোন মিশ্রণ নেই এখানে। এই সূক্ষ রেখা আসলে জল, যেটা দুই দিকের ভূখন্ডকে আলাদা করে দিয়েছে এবং দুই অংশের স্থলজ জীব (পাখি নয়) সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে।

এখন তাহলে ব্যাঙের মত উভচর যদি পাঞ্জিয়া ভাঙনের আগে উদ্ভব হওয়ায় মহাদেশগুলিতে ভাঙনের সঙ্গে ছড়িয়ে পরে তবে মানুষতো পাঞ্জিয়া ভাঙনের অনেক পরে উদ্ভব হয়েছিল। তবে সব মহাদেশে মানুষ একইরকম (একই স্পেসিস) হল কি করে? আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটা টাইমলাইন এখানে দেখে নেই-

> উভচরের উদ্ভব ৩০ কোটি বছর আগে।
> পাঞ্জিয়া ভাঙন শুরু ২০ কোটি বছর আগে।
> আধুনিক মানুষের উদ্ভব ২ লক্ষ বছর আগে।
> শেষ বৃহৎ গ্লাসিয়াল যুগ (গ্লাসিয়াল ম্যাক্সিমাম) প্রায় ২০ হাজার বছর আগে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আধুনিক মানুষ পাঞ্জিয়া ভাঙার প্রায় ২০ কোটি বছর পরে (১৯ কোটি ৯৮ লক্ষ বছর পরে) উদ্ভব হয়েছে। তাই, সব মহাদেশে একই সঙ্গে বিবর্তিত হয়ে একই প্রজাতি তৈরির কোন অবকাশ নাই, সম্ভবও না। যেটা হয়েছে সেটা হল মানুষের মাইগ্রেশান বা স্থান পরিবর্তন করে ছড়িয়ে পড়া। কিন্তু ঝামেলা হলো পাঞ্জিয়া ভেঙে যাওয়ায় সমুদ্র দিয়ে বিভক্ত ভূমিতে ছড়াবে কিভাবে মানুষ?

উপরের টাইমলাইনের শেষটাতে গ্লাসিয়াল যুগের কথা আছে, কারন তখনই আধুনিক মানুষের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারনটা বলছি। আইস এইজ বা বরফ যুগের এর নাম শুনেছেন তো, পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে কিছু বছর পর পর ঠান্ডা নেমে আসে, প্রায় পুরো পৃথিবী ঠান্ডায় ছেয়ে যায়। একে বলে আইস এইজ, বা গ্লাসিয়াল পিরিওড। তো, গ্লাসিয়াল ম্যাক্সিমামের শেষ সময়ে সমুদ্রের জল ১১০ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গিয়েছিল! সমুদ্রের জল এত পরিমান নিচে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বিরাট পরিমান নিমজ্জিত ভূমি স্থলভাগে পরিণত হয়। যেসব যায়গা সমুদ্র দিয়ে বিভক্ত ছিল তারা যুক্ত হয়ে যায়। ফলে প্রাণীর ভ্রমণের পরিসরও বেড়ে যায়।

একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। ধারণা করা হয় আধুনিক মানুষের উদ্ভব আফ্রিকা মহাদেশে। আর আফ্রিকার সঙ্গে সমগ্র ইউরোপ এবং এশিয়া স্থলভাগদিয়ে যুক্ত। তাই, এখানে মানুষ ছড়াতে কোন অসুবিধাই হয়নি। খোঁজ পাওয়া গিয়েছে যে আফ্রিকা থেকে ইয়েমেন হয়ে এশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ। কিন্তু আমেরিকা এবং অষ্ট্রেলিয়া তো আলাদা ব্যাপার। নৌকা দিয়ে এতদূর যাওয়া তখনকার মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাহলে কি হয়েছিল? মানচিত্রে লক্ষ্য করলে দেখবেন, রাশিয়ার পূর্ব অংশ এবং আমেরিকার পশ্চিমাংশ (আলাস্কা) খুব কাছাকাছি, এবং একটি চিকন সমুদ্রের জলরেখা দিয়ে বিভক্ত। গ্লাসিয়াল ম্যাক্সিমাম এর শেষের দিকে এই অংশটুকু উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ধারনা করা হয় সেই সময় কিছু মানুষ ভ্রমণ করার চেষ্টা করে রাশিয়া থেকে আলাস্কা, এই অংশ দিয়ে, এবং যারা বেঁচে থাকে তারা 'রেড ইন্ডিয়ান' হয়ে যায়! অর্থাৎ আমেরিকা আবিষ্কার আসলে কলম্বাস বা অন্য কেউ করেনাই। করেছেন হাজার হাজার বছর আগে পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া কোন এক অজানা মানুষের গোত্র। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন যে নেটিভ আমেরিকানরা আসলে সাইবেরিয়া থেকে এসেছে ঠিক গ্লাসিয়াল ম্যাক্সিমাম এর কাছাকাছি সময়ে। ফলে আবিষ্কারটি দিয়ে উপরের তত্ত্বটার পক্ষে একটা প্রমাণ পাওয়া গেল!

এখানে একটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি। আইস এইজের তাত্ত্বিক সঞ্জা হিসেব করলে বর্তমান পৃথিবী এখনও আইস এইজ এ আছে! কারন গোলকের উত্তর দিক, যেমন গ্রীণল্যান্ড বা নরওয়ে এবং কানাডার উত্তর অংশ এখনও সারাবছর বরফে ঢেকে থাকে!

বিবর্তন সিরিজের আগের পর্ব:

১। কেন সবারই বিবর্তনতত্ত্ব শেখা উচিত
২। বিবর্তন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার তথ্যচিত্র
৩। কিভাবে মানুষ হলাম?
৪। চোখের সামনে নতুন প্রজাতির উদ্ভব
৫। চোখের সামনে ঘটতে থাকা মানুষের বিবর্তন
৬। আমাদের আধুনিক চিন্তনে ডারউইনের প্রভাব। প্রথম পর্ব: জীবনের ইহসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গি


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

এরকম চলতে চলতে ভবিষ্যতে আবারো আরেকটা পাঞ্জিয়ারে গোটা পৃথিবীর মানুষ একদেশের অধিবাসী হয়ে পড়লে বেশ হয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সজীব ওসমান এর ছবি

হুমম। সেতো হবেই। তবে একইরকম হয়তো হবেনা। সবগুলা একসাথে চলে নাও আসতে পারে। আবার এখন লাগানো কিছু অংশ ভেঙেও যেতে পারে।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার তো!!!
বরফ যুগ চলছে কিন্তু বরফ ক্রীমের কি দাম! এটা কোনো কথা??
প্রথম প্যারায় একটা শব্দ চোখে পরলো 'কারিকুরি' শব্দটা হয়তো 'কারিগরি' হবে।
-বৃদ্ধ কিশোর

সজীব ওসমান এর ছবি

হাসি । কারিকুরিই থাকুক।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

গ্লাসিয়াল ম্যাক্সিমামের শেষ সময়ে সমুদ্রের জল ১১০ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাওয়ার কারন কী? সমুদ্রের পানি সরাসরি বরফ হয়ে যায় নি কেন? যেমনটা এখন মেরু অঞ্চলে ঘটে থাকে?

সজীব ওসমান এর ছবি

বেশিরভাগ পানি বরফ হয়ে গিয়েছিলো বলেই বরফ না হওয়া থেকে যাওয়া পানিটুকু এতোই কম ছিলো যে সেটা নেমে গিয়েছিলো। বরফ না হওয়ার জন্য শুধু তাপমাত্রা ছাড়াও আরও কিছু প্রভাবক থাকে, যেমন স্রোতের তীব্রতা এবং অভিমুখ। সেগুলার কারণে হয়তো।

হিমু এর ছবি

সমুদ্রের পানি বরফ হয়ে সমুদ্রেই যদি রয়ে যায়, তাহলে সমুদ্রসমতলের নড়চড় হবে না, কারণ ভাসমান বরফ তার সমান আয়তনের পানি অপসারণ করে। যদি সমুদের পানি ডাঙায় গিয়ে প্রথমে তুষার, তারপর জমাট বরফ (এবং এক পর্যায়ে হিমবাহ) হয়, তবেই কেবল সমুদ্রসমতল নিচে নামবে। পৃথিবীর পানির একটা বড় অংশ এভাবে অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড আর অন্যান্য পর্বতশ্রেণীর হিমবাহগুলোতে বন্দী আছে, এবং এরা গলে ফের সমুদ্রে নামছে বলেই সমুদ্রসমতল ওপরে উঠে এসে ভূমি গ্রাস করছে।

সজীব ওসমান এর ছবি

হু। গুড পয়েন্ট। পানিচক্র বাধাগ্রস্থ হয় আবহাওয়া থেকে পানি বরফ হিসেবে জমে গেলে। সেটাও কারনের মধ্যে পরে হয়তো।

শিক্ষানবিস এর ছবি

আচ্ছা, প্যানজিয়াকে ‘সর্বভূমি’ আর প্যানথালাসাকে ‘সর্বসাগর’ ডাকলে কেমন হয়?

হিমু এর ছবি

সার্বভৌম বিশেষণটার কারণে সর্বভূমি একটু বাটে পড়ে থাকবে সারাক্ষণ।

"অভেদখণ্ড" আর "অভেদসায়র" কেমন শোনায়?

সজীব ওসমান এর ছবি

অখন্ডভূমি আর অখন্ডসায়র?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।