আফ্রিকায় নয়া ঔপনিবেশিক থাবা-২

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৭/২০০৮ - ১১:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আফ্রিকায় নয়া ঔপনিবেশিক থাবা-১

আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক চেষ্টার দ্বিতীয় শক্তি সারাবিশ্বের “ব্যাক-অফিস” ভারত। সময় বিচারে ভারত গণচীন থেকে এব্যাপারে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এখন তারা আফ্রিকাতে দ্রুত প্রভাব বলয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ভারতের প্রচেষ্টা গণচীনের চেয়ে আরো গভীর এবং সুদূরপ্রসারী।

আফ্রিকায় ভারতের উদ্যোগগুলোর ব্যাপারে আলোচনা শুরু করার আগে এই শতাব্দীতে ভারত যে নতুন চেহারা পেতে যাচ্ছে তার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সম্ভবতঃ আগামী দুই দশকের মধ্যে ভারতের জনসংখ্যা গণচীনকে ছাড়িয়ে যাবে। সময়টাকে হয়তো একটু পেছানো যাবে, তবে এটা যে হবেই সেকথা সবার জানা। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের (তখন প্রায় ১.৫ বিলিয়ন হবে) দেশকে স্থিতিশীলতার সাথে উন্নয়নের পথে চালানোর জন্য বিপুল পরিমান খাদ্য, জ্বালানী, ইউটিলিটিসহ (পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) অন্যান্য পণ্য ও সেবার প্রয়োজন। অর্থাৎ ভারতকে বিপুল পরিমান পণ্য সরবরাহের সাথে সাথে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে।

ভৌত অবকাঠামোগত দিক দিয়ে ভারত গণচীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীন কর্মসংস্থান, সামরিক শক্তি ইত্যাদি সব দিকেই তুলনামূলকভাবে ভারত পিছিয়ে। সুতরাং নিজের জনসংখ্যা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা গণচীনের চেয়ে অনেক অনেক বেশী। ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আবশ্যিক জ্বালানী ও কাঁচামালের জন্য ভারত আফ্রিকাতে গণচীনের পথ যদি অনুসরণ করে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। বস্তুতঃ ভারত সেই পথেই অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। এই আলোচনার পরবর্তী অংশে সে সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দেয়া হবে।

যে কোন উপায়ে শিল্পায়ণের পথে ভারতের অন্যতম অন্তরায় তার রাজনৈতিক কাঠামো এবং ট্রেড ইউনিয়ন। শক্তিশালী আঞ্চলিক দলের সাথে কেন্দ্রিয় সরকারের নীতিগত পার্থক্য থাকলে শিল্পায়নের বা কর্মসংস্থানের কেন্দ্রিয় নীতি বাস্তবায়ণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাধার মূখে পড়তে পারে, এবং তা হরহামেশাই হয়। বেশ কিছু রাজ্যে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের উপস্থিতি যে কোন উপায়ে শিল্পায়ণের পথে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। এদুটো ব্যাপারে পশ্চিম বঙ্গের নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর কান্ড স্মর্তব্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ভারতে শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত বৃহতায়তণ বুর্জোঁয়া শ্রেণীর উপস্থিতি। স্বাভাবিকভাবেই এরা নিজেদের মুনাফার ব্যাপারটিকে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাই দেশে বিনিয়োগের চেয়ে যদি বিদেশে বিনিয়োগ অধিক লাভজনক হয় তবে তারা তাই করবেন, এবং তাই তারা করছেন। এই তিনটি বিষয়ের একটিও গণচীনে উপস্থিত নয়। তাই ভারতের সমস্যা গণচীনের চেয়ে অনেক জটিল ও বহুমাত্রিক।

ভারতের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভ। ভারতের মত বহুজাতির এবং বিপুল জনসংখ্যার দেশে রাষ্ট্রিয় অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং বৈরী প্রতিবেশীর উপস্থিতির প্রশ্নে এধরনের তকমা জরুরী। বহু মেরুর বিশ্বের যে ধারনা গড়ে উঠতে যাচ্ছে তাতে এখনই যদি ভারত নিজের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে তাহলে ভবিষ্যতে তাকে অনেক বেশী মূল্য দিতে হবে। এককথায় আঞ্চলিক শক্তি হতে পরাশক্তি হতে চাওয়ার ভারতীয় প্রচেষ্টা এখন বাস্তব এবং তার জন্য জরুরী। এর জন্য তাকে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে মধ্য এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করতে হবে। সেই লক্ষ্যে ভারত অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ২০০৪ সাল থেকে তাজিকিস্তানের ফারখোর এয়ারবেসের উন্নয়ন ও সহযোগিতাতে ভারতের অংশগ্রহন বাইরের দুনিয়ায় তার প্রথম স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি। এই আলোচনা আফ্রিকাকে নিয়ে বলে ভূ-গোলকের অন্যত্র ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব না। তবে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের প্রসঙ্গ যৌক্তিকভাবেই থাকবে।

আফ্রিকায় ভারতের হাত বাড়ানোর প্রথম কারন প্রথমটি গণচীনের মত জ্বালানী আর কাঁচামালের অব্যাহত যোগান নিশ্চিত করা। ভারতীয় শিল্প ও ভৌত অবকাঠামোর প্রায় পুরোটাই আমদানীকৃত জ্বালানীর উপর নির্ভরশীল। ভারত তার চাহিদার ৭০% জ্বালানী বাইরে থেকে আমদানী করে। এই আমদানী বাড়তে বাড়তে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তেল আমদানীকারক দেশে পরিনত হবে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে এক নাইজেরিয়াই ভারতের জ্বালানী তেল আমদানীর ১১% যোগান দেয়।

২০০২ সালে কানাডার Talisman Energy Inc. পশ্চিমা মানবাধিকার গ্রুপগুলোর চাপে সুদানের Greater Nile Oil Project থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় ভারতের Oil and Natural Gas Corporation Videsh Limited (ONGC) তাদের ২০% শেয়ার ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয়। এই প্রকল্প থেকে ভারতের আমদানী চাহিদার ৫% অপরিশোধিত তেল পাওয়া যাবে। নিজ দেশে ভারত সরকার এব্যাপারে সমালোচনার মূখে পড়লেও এই বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয় যে, এটি প্রাচীন কাল থেকে সুদানের সাথে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার আওতায় করা হয়েছে। তাছাড়া চীন এবং মালয়েশিয়াও সেখানে আছে। সুদানের তৈলক্ষেত্রে বিনিয়োগে ভারতের নীতি, সুদান সরকারের কাছে গণচীনের অস্ত্র বিক্রয়ের নীতির অনুরূপ। এখানে অন্য দেশ বা বিরোধী রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠণগুলো কি বলল তা বিবেচ্য নয়।

সুদানের তেলের রিজার্ভ বিশ্বে সৌদী আরবের পরপরই। সুদানের প্রতি ভারতের আগ্রহ তাই বোধগম্য। সুদান সরকারের ভেতর ভারতের গ্রাউন্ডওয়ার্কও লক্ষ্যনীয়। ২০০৭ সালের ৩১শে মে প্যারিসে ইউনেস্কোর মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে সুদানের জ্বালানীমন্ত্রী আওয়াদ আহমাদ আল-জায ভারতের পেট্রোলয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসমন্ত্রী মুরলী দেওরাকে সুদানের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলোতে ভারতীয় কোম্পানীগুলোকে আরো “আগ্রাসী” ভাবে বিড করার জন্য অনুরোধ করেন। সুদান সরকার ভারতকে এই বলে নিশ্চিত করেছে যে, ভবিষ্যতে ভারতের বিনিয়োগকৃত তৈলখনিগুলো জাতীয়করণ বা অধিগ্রহণ করা হবে না। এমনকি সুদানে যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীন গোলযোগের কারনে যদি ভারতের কোন আর্থিক ক্ষতি হয়, তবে সুদান সরকার তা যথাযোগ্যভাবে পূরণ করবে।

২০০৫ সালে ভারতের তেল অনুসন্ধান কোম্পানী ONGC নাইজেরিয়াতে রেলপথ নির্মানের জন্য ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই বিপুল বিনিয়োগ যে আফ্রিকার কামধেনু নাইজেরিয়ার তেলসম্পদে ভাগ বসানোর জন্য তা বলাই বাহুল্য।

ভারত থেকে আফ্রিকা যাবার পথের দেশ ইরানের সাথে ভারতের জ্বালানী সংক্রান্ত সম্পর্কটি এখানে প্রাসঙ্গিক। ২০০৮ সালের অগাস্টের মধ্যে ইরান-পাকিস্তান-ভারত ২,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৮ -এর ২৯শে এপ্রিল ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের পাঁচ ঘন্টার নয়াদিল্লী সফরের সময় এই বিষয়ের এক যুগের টানা-পোড়েনের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। গ্যাসের দামের ব্যাপারে সমঝোতা হলে ইরান আগামী ২৫ বৎসর ভারতকে প্রতি বৎসর ৫ মিলিয়ন টন করে গ্যাস সরবরাহ করার কথা। এর আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইরানের পরমাণু স্থাপণা বিষয়ে আন্তর্জাতিক দলাদলিতে ভারত ইরানের প্রতিপক্ষ গ্রুপের দেশ। তাছাড়া ভারতের ইসরাইলের সাথে গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক উৎক্ষেপণের বিষয়টিও ইরানের স্বার্থের পরিপন্থী। এহেন বৈরী দেশদ্বয়ের দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানী চুক্তির বিষয়টি ভিন্ন আলোচনার দাবী রাখে। সম্ভবতঃ পরাশক্তি হতে চাওয়া ভারতের জন্য ইরানের সাথে এই কৌশলগত সিমবায়োটিক অবস্থান প্রয়োজনীয়।

যেহেতু ভারতের আমদানীকৃত জ্বালানী তেলের ৮৯% সমূদ্র দিয়ে আসে তাই জ্বালানী নিরাপত্তার জন্য ভারত মহাসাগরে তার কৌশলগত উপস্থিতি জরুরী। ইরান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস পাইপলাইনের কথা বিবেচনা করলে তা আরো জরুরী। এলক্ষ্যে ভারত ইতোমধ্যে সিচেলিস, মরিশাস ও মোজাম্বিকের সাথে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

৬ই মার্চ, ২০০৬-এ নয়াদিল্লীতে ভারত ও মোজাম্বিক প্রতিরক্ষা বিষয়ক এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। মোজাম্বিকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তোবাইস জোয়াকিম দাই-এর ভারত সফরকালে তার প্রতিপক্ষ প্রণব মুখার্জীর সাথে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় ভূমি, আকাশ ও নৌ তিনটি ক্ষেত্রেই টেকনিক্যাল, লজিস্টিক ও ট্রেনিং-এ সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকছে। তবে এতে বিশেষভাবে থাকছে মোজাম্বিক উপকূলে জোরদার প্রহরা, সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ, সামরিক যান, বিমান ও জাহাজ সংযোজন ও মেরামত, এবং সামরিক স্থাপণাসমূহ সংস্কার। বলাই বাহুল্য কিছু আনুষ্ঠানিক বিষয় ছাড়া সব সামরিক কর্মকান্ডই হবে মোজাম্বিকে। মোজাম্বিকের এক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও ভারতের প্রয়োজন অপরিসীম যা পূর্বেই বলা হয়েছে।

মোজাম্বিকের সাথে গণচীনের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগের প্রায় এক বৎসর আগেই ভারত এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেশ এক হাত দেখে নিল। এই সামরিক উদ্যোগের বীজ প্রোথিত হয়েছিল ২০০৩ সালের ১০ থেকে ১৫ই মে-তে মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট জোয়াকিম আলবের্তো চিসানোর ভারত সফরের সময়। ১২ই মে, ২০০৩-এ দেয়া দুই দেশের যুক্ত বিবৃতিতে ভারতের সুদূর প্রসারী লক্ষ্যর কথা স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে পারস্পারিক স্বার্থ (আসলে ভারতের স্বার্থ), EXIM Bank of India-এর মাধ্যমে মোজাম্বিককে ঋন প্রদান, EXIM Bank of India-র কাছে Banco de Moçambique -র দেনাকে বিনিয়োগে রূপান্তর, কৃষি ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সহযোগিতা, সড়ক, বন্দর ও রেলপথ নির্মান, যৌথ কর প্রত্যাহার, সন্ত্রাসবাদের বিরূদ্ধে লড়াই, কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের অবস্থান সমর্থন, সর্বোপরি নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পেতে ভারতকে সমর্থন দানের কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ এই যুক্ত বিবৃতিতে সরাসরি সামরিক বিষয় ছাড়া আর সকল অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত আর কৌশলগত ক্ষেত্রে ভারত মোজাম্বিকে নিজের অপরিহার্য ভূমিকা নিশ্চিত করল। পরবর্তী ধাপে সামরিক দিকটাও পরিষ্কার করে নিল। এর ঠিক আগে ৯ই মে, ২০০৩ মোজাম্বিকের খনিজসম্পদ মন্ত্রী এসপারানকা লরিন্দা বিয়াস তার ভারত সফরে তার দেশের স্বর্ণ, হীরক, সীসা, লৌহ, তাম্র, টিন, দস্তা, গ্রাফাইট, কয়লা এবং অন্যান্য খনিজসম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে ভারতীয় বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরকে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান।
মোজাম্বিকের এই বিপুল খনিজ সম্পদের বিবরণ শুনলে ভারতের সরকারী-বেসরকারী যেকোন উদ্যোক্তা পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এরপর Coal India Ltd. ও Steel Authority of India Ltd. আরো তিনটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে মোজাম্বিকের একটি কয়লাখনি কিনে নেবার উদ্যোগ নিয়েছে। বস্তুতঃ NTPC Ltd., Steel Authority, Rashtriya Ispat Nigam Ltd. এবং NMDC Ltd. মিলে ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মূলধন গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবী ও মোজাম্বিকের খনিজ সম্পদ এবং ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কয়লা খনি কেনার জন্য। এব্যাপারে ভারতীয় ব্যাংকগুলোর সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। কৌশলগত, জ্বালানী নিরাপত্তা এবং শিল্প কাঁচামাল যোগানোর জন্য এধরনের বিনিয়োগ মোজাম্বিকসহ পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ভারতের শক্তিশালী উপস্থিতিকে আবশ্যিক করে তোলে।

২০০৭ সালের জানুয়ারীতে মরিশাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মদন মুরলীধর দুল্লোর নয়াদিল্লী সফরের সময় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী কমল নাথের সাথে যৌথ কর প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা হয়। যদিও এবিষয়টির সুরাহা এই বৈঠকে হয়নি। ভবিষ্যতে সুরাহা হলেও তা ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসের পক্ষে যাবার কোন উপায় নেই। তবে কৌশলগত অবস্থান এবং মরিশাসে বসবাসকারী ভারতীয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে এক্ষেত্রে ভারত ভিন্ন অবস্থান নিতে পারে।

২০০৫-এর অগাস্টে সিচেলিসের প্রেসিডেন্ট জেমস আলিক্স মাইকেল ভারতীয় বণিকদের সাথে এক সাক্ষাতকালে তার দেশের পর্যটন, মৎস্য, সাগরে পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান এবং টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতের বিনিয়োগ আহ্বান করেন। সেখানে সিঙ্গাপুর ও মরিশাসের মত সিচেলিসের সাথেও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনার কথা বলা হয়। এরপর ২০০৫-এর ডিসেম্বরে Bharti Airtel Group সিচেলিসে 3G নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য Telecom Seychelles -এর নামে ৮.৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উদ্যোগ নেয়। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সিচেলিসের টেলিযোগাযোগের জন্য এই বিনিয়োগ বিশাল। লক্ষ্য সম্ভবতঃ গোটা ভারত মহাসাগরে ভারতের নিজস্ব টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

ভারত-আফ্রিকা বাণিজ্য গত চার বৎসরে ২৮৫% বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গণচীনের আফ্রিকা বাণিজ্যের তুলনায় এই অংক অনেক কম। আফ্রিকায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত গণচীনের থেকে পিছিয়ে থাকলেও ব্যবধান অনেকটাই হ্রাস পাবে যদি “Bharati Airtel” দক্ষিণ আফ্রিকার “MTN”কে ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নিতে পারে। এটি হবে ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক অধিগ্রহন। এরফলে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৬৮ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী “Bharati Airtel” গ্রাহকে পরিনত হবেন। তৃণমূল পর্যায়ে শোষণ আর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় মোবাইল ফোনের চেয়ে কার্যকর প্রযুক্তি আর হয় না।

ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও তাদের চৈনিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে পিছিয়ে থাকছেনা। তবে ভারত আপাততঃ গণচীনের মত আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে অধিকমাত্রায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়তে চাইছেনা। বরং তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক বিষয়গুলোতে সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে আগাতে চাইছে। এর একটি কারন হয়তো আফ্রিকাতে বসবাসকারী প্রায় ২৮ লাখ ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী। যাদের মাধ্যমে ভারত অনেকটা পথই এগিয়ে যেতে পারে কোন আফ্রিকান একনায়কের সাথে গাঁটছড়া না বেঁধেই।

গণচীনের “China-Africa Cooperation Forum”র আদলে গড়া “India-Africa Forum Summit” এর উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে (নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত) ভারত ৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋনের ঘোষনা দিয়েছে। সাথে সাথে আগামী পাঁচ বৎসরে আরো ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১৪টি আফ্রিকান দেশের নেতারা (এর মধ্যে সাতজন রাষ্ট্রপ্রধান) এতে যোগ দেন। দেশগুলো হচ্ছে উত্তর আফ্রিকার মিশর, আলজেরিয়া ও লিবিয়া, পশ্চিম আফ্রিকার বুর্কিনা ফাসো, ঘানা, নাইজেরিয়া ও সেনেগাল, পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া ও উগান্ডা, এবং দক্ষিণের জাম্বিয়া, গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো (সাবেক জায়ারে) ও দক্ষিণ আফ্রিকা। অর্থাৎ আফ্রিকার সব অঞ্চলের হেভীওয়েট দেশগুলোই এতে অংশগ্রহণ করেছে।

১৪ই এপ্রিল, ২০০৮ -এ ভারত গণচীনের মত ৩৪ টি আফ্রিকান দেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে একতরফা ট্যারিফ প্রত্যাহার করেছে। এখানেও ভারতের নীতি গণচীনের অনুরূপ, আর তাদের প্রকৃত লাভ হবে গণচীনের মতই।

২০শে মার্চ, ২০০৮-এ নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত India-Africa Project Partnership conference-এ “Exim Bank of India” “African Export-Import Bank (Afreximbank)”-র সাথে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋনচুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে আফ্রিকান দেশগুলো ভারত থেকে আমদানী করার জন্য ঋন পেতে পারে। অর্থাৎ আফ্রিকার দেশগুলো ভারতের কাছ থেকে টাকা ধার করে ভারতের পণ্য আমদানী করতে পারে। এতে ভারত যেমন পণ্য রফতানীতে লাভ করতে পারবে, সেই সাথে ঋনের সুদও পাবে - দুই তরফা লাভ। এই ঋন ভবিষ্যতে ১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দীর্ঘমেয়াদী ঋনে ঠেকবে। এর মাধ্যমে সেনেগাল ভারতের টাটার কাছ থেকে ৫০০টি বাস কিনবে। ভারতীয় রেলওয়ের কনসালটেন্সী বিভাগের তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য অ্যাঙ্গোলার রেলওয়ে প্রকল্পে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়া হবে।

ভারতের আফ্রিকা নীতি গণচীনের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। গণচীনের লক্ষ্য মূলতঃ বাণিজ্যিক। তার কৌশলগত অবস্থান এখানে বাণিজ্যকে সহায়তা করার জন্য। অর্থাৎ গণচীনের এখনকার ভূমিকা প্রথম দিককার ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মত। পক্ষান্তরে আফ্রিকায় ভারতের উপস্থিতি অনেকাংশেই কৌশলগত। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন লাভ করার জন্য আফ্রিকান দেশগুলোর সমর্থন ভারতের প্রয়োজন। আফ্রিকার পূর্ব ও দক্ষিণের দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী যারা সেসব দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং যারা এখন পশ্চিম আফ্রিকাতেও তাদের ব্যবসার প্রসারণ ঘটাচ্ছে তাদের সহায়তা করার জন্যও ভারতকে এক্ষেত্রে কৌশলী ভুমিকা নিতে হচ্ছে। এছাড়া সেখানে বিপুল পরিমান সরকারী-বেসরকারী ভারতীয় বিনিয়োগের ব্যাপারটিতো থাকছেই। এসমস্ত ক্ষেত্রে ভারতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে ভারতীয় হাতি যাতে “মত্ত হস্তী”র রূপধারন করতে পারে সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। সেখানে আফ্রিকার উন্নয়ন বা স্বার্থ একেবারেই বিবেচ্য হবে না।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিন্ন স্বার্থ রক্ষার্থে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পরস্পরকে কিছু কিছু বিষয়ে ছাড় দেয়। যেমন এককালে এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে ব্রিটেন ও রাশিয়া কৌশলগত সমঝোতার পথ নিয়েছিল। ভারত আর গণচীনও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের মধ্যেও সমঝোতা আছে। তাই সুদান, ইরান বা মায়ানমারের ব্যাপারে এই দুই শক্তির অবস্থানে অনেক মিলই খুঁজে পাওয়া যায়। আফ্রিকার প্রশ্নে ভারত গণচীনের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র। সদূর আফ্রিকাতে এই দুই দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মত ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশেষতঃ ভারতের, ভারত মহাসাগরের অপর পাড়ে আরেকটি ১৯৬২-র অভিজ্ঞতায় যাবার কোন কারন নেই। দুই দেশের মধ্যকার “ব্যাম্বু কার্টেইন” তাই আফ্রিকাতেও বজায় থাকবে। তবে আফ্রিকার দরিদ্র, পশ্চাদপদ মানুষের তাতে কোন লাভ হবে না। নয়া ঔপনিবেশিক ধারনার বাহক এই দুই দেশ দিয়ে তারা ক্রমাগত শোষিতই হতে থাকবে।

[তথ্যসূত্র প্রদানের ক্ষেত্রে এরকম বড় আয়তনের লেখায় যথাস্থানে যদি লিংক দেয়া যেত তাহলে সবচে ভাল হত। দিতে না পারার কারন এব্যাপারে আমার অদক্ষতা। প্রতিটি পর্বের শেষেও ঐ পর্বের তথ্যসূত্র দেয়া যেত। এক্ষেত্রেও আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। তাই তথ্যসূত্রের ব্যাপারে পাঠকদের কাছে বিরক্তি উৎপাদনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আগামী পর্বে লেখাটা শেষ করতে পারলে তথ্যসূত্রগুলো একবারে দেয়া হবে।]


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।