আফ্রিকায় নয়া ঔপনিবেশিক থাবা-১

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: শনি, ১২/০৭/২০০৮ - ১১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দৃশ্যতঃ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের হাত গুটিয়ে নিতে থাকে। দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের পর আফ্রিকার জাতিগুলো একে একে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। স্বাধীনতা পাবার পরও দেশগুলোতে সাবেক প্রভুদের অদৃশ্য উপস্থিতি থেকেই যায়। দেশগুলোতে সৃষ্ট অবিরাম হানাহানিতে সাবেক প্রভুদের হাত অনস্বীকার্য। সময় সময় তাদের অযাচিত উপদেশ আর সদম্ভ উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়।

গত শতকের শেষ দশকে জাতিসঙ্ঘের আবরনে peacekeeping-এর নামে peace enforcement-এর জন্য বহুজাতিক বাহিনী দৃশ্যপটে আসে। আফ্রিকার আর প্রকৃত স্বাধীনতা পাওয়া হয় না। এই শতকের শুরুতে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে আরো কিছু নতুন শক্তির যারা নতুন আঙ্গিকে আফ্রিকাতে নতুন ধরনের উপনিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই লেখায় অইউরোপীয় দেশগুলোর এধরনের প্রচেষ্টার কথা আলোচনা করা হবে।

এই চেষ্টার প্রথম শক্তি সারাবিশ্বের “ফ্যাক্টরী” গণচীন। এখনকার বিশ্বে যেকোন ক্ষেত্রে গণচীন একটি অগ্রগণ্য নাম। এক মেরু বিশ্বতে গণচীনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা বিস্তারে গণচীনের বড় হাতিয়ার তার তৈরী সস্তা পণ্য। সস্তা পণ্য তৈরীর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সস্তা কাঁচামাল এবং সস্তা জ্বালানী। অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় যেমন সস্তা শ্রম, বিপুল পূঁজি, ভৌত অবকাঠামো, দক্ষ ব্যবস্থাপনা দেং-পন্থী চীন ইতোমধ্যেই যোগাড় করে ফেলেছে। কিছু উদ্ভাবন করে, কিছু কিনে আর বাকীগুলো নকল করে প্রযুক্তিও তারা আয়ত্বে এনেছে। সুতরাং সস্তা কাঁচামাল আর সস্তা জ্বালানীর জন্য গণচীনকে বাইরে হাত বাড়াতে হচ্ছে।

এককালে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্দোচীন, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ আর বার্মার দিকে গণচীন নজর দিয়েছিল। কিন্তু গণচীনের নয়া শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমান কাঁচামাল আর জ্বালানীর নিয়মিত যোগান দিতে এরা অক্ষম। তাছাড়া আসিয়ানের মত শক্তিশালী আঞ্চলিক সংস্থা কার্যকর থাকায় গণচীন এদিক থেকে নিজের হাত অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের চাহিদা মেটাতে তাদের তাই ভূ-গোলকের অন্যদিকে হাত বাড়াতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য আর লাতিন আমেরিকায় প্রথম বিশ্বের প্রবল উপস্থিতি থাকায় গণচীন বাধ্য হয়েছে সম্পদশালী আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিতে।

২০০৭ সালে আফ্রিকাতে গণচীনের বিনিয়োগের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে যা আগের বৎসরের চেয়ে ২০% বেশী। এই বিনিয়োগের বড় অংশই হচ্ছে জ্বালানী খাতে। গণচীনের সরকারী সংস্থা “China National Offshore Oil Corporation” এখন সুদানের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক বিনিয়োগকারী। ২০০৭ সালের জুনে তারা সুদান সরকারের সাথে ২০ বৎসরের চুক্তি করেছে স্বাক্ষর করেছে লোহিত সাগরের সুদানী উপকূলে তেল অনুসন্ধানের জন্য। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে নাইজেরিয়া। এরপরের তালিকাতে আছে অ্যাঙ্গোলা, গ্যাবন ও শাদ। একথা বোধগম্য যে উত্তোলিত তেলের সিংহভাগ রফতানী হবে গণচীনে, এবং তার আমদানী ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্য বা লাতিন আমেরিকা থেকে আমদানীকৃত জ্বালানীর থেকে অনেক কম হবে। এর বিপরীতে গণচীন থেকে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় হেন জিনিষ নেই যা আফ্রিকাতে রফতানী হচ্ছে না।

শুধুমাত্র জ্বালানী খাতই নয়, “Industrial & Commercial Bank of China” দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম ব্যাংক “Standard Bank Group”-এর ২০% মালিকানা ২০০৭-এর ২৪শে অক্টোবরে কিনে নিয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। শুধুমাত্র গণচীন সরকারই নয়, বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশী চীনা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আফ্রিকাতে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি গণচীন তার অন্যতম পণ্য - অস্ত্রেরও বিপুল সরবরাহ করছে আফ্রিকাতে। যুদ্ধপীড়িত আফ্রিকাতে এ যে কত বড় ব্যবসা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে গণচীন কোন নীতির ধার ধারছে না। জিম্বাবীর বিতর্কিত সরকারই হোক আর দারফুরে হামলা চালানো সুদান সরকারই হোক গণচীন সবার কাছেই অস্ত্র বিক্রী করছে।

ক্ষমতায় বসার পর প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও দুই দুইবার আফ্রিকা সফর করেছেন নিজেদের প্রভাব বলয় বাড়ানোর জন্য। প্রথম সফর করেছেন ২০০৬-এর ২৪ থেকে ২৮শে এপ্রিলে, মরক্কো, নাইজেরিয়া এবং কেনিয়ায়। এটি একই সময়ে তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদী আরব সফরের সাথে যুক্ত। এসময় মরক্কোর সাথে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক চুক্তির পাশাপাশি মরক্কোকে healthcare ও sanitation খাতে সাহায্য করার চুক্তিও হয়েছে। ২০০৫ সালে মরক্কোর সাথে গণচীনের বাণিজ্য আগের বৎসরের চেয়ে ২৮% বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। নাইজেরিয়ার সাথে কৃষি, অবকাঠামোগত নির্মান, শক্তি উৎপাদন ও টেলিযোগাযোগের সাথে সাথে counter-terrorism ও peacekeeping এর মত বিষয়েও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৫ সালে নাইজেরিয়ার সাথে গণচীনের বাণিজ্য আগের বৎসরের চেয়ে ২৯.৬% বেড়ে দাঁড়ায় ২.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কেনিয়ার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পর্যটন খাতে। ২০০৫ সালে কেনিয়ার সাথে গণচীনের বাণিজ্য আগের বৎসরের চেয়ে ২৯.৭% বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এসময়ে চীনা কোম্পানীগুলো কেনিয়াতে ৭৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প সমাপ্ত করে এবং নতুন ৮৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে।

প্রথম সফরের লক্ষ্যনীয় দিক হচ্ছে সফরটি কৌশলগত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদী আরব সফরের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে তার সাথে উত্তর আফ্রিকার একটি, পশ্চিম আফ্রিকার একটি এবং পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ সফর যোগ করা সফরটির আফ্রিকায় কৌশলগত প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করে। নাইজেরিয়ার সাথে counter-terrorism ও peacekeeping এর মত বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করার উদ্দ্যেশ্য আর কিছু নয়, নাইজেরিয়াতে অবস্থিত চীনা তেল কোম্পানীগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ। কারন, নাইজেরীয় বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রিয় কর্মকান্ড হচ্ছে তেলের পাইপলাইন আক্রমন করা।

প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-এর দ্বিতীয় আফ্রিকা সফর চলে ২০০৭-এর ৩০শে জানুয়ারী থেকে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১২ দিনব্যাপী। এবারে সফর চলে ক্যামেরুন, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, সিচেলিস, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া এবং লাইবেরিয়াতে। এবারের লক্ষ্য প্রথম সফরের ঘাটতি পূরণ। তালিকার দেশগুলো উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিম আফ্রিকার।

এই সফরের বিস্তারিত বিবরন না দিয়ে লক্ষ্যনীয় দিকগুলোতে দৃষ্টি দেয়া যাক। সুদান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার গুরুত্বর ব্যাপারে আগেই স্পষ্ট করা হয়েছে। সিচেলিস এবং মোজাম্বিকের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। সিচেলিস ও মরিশাস দ্বীপপুঞ্জে বৃহৎ শক্তিগুলোর সামরিক উপস্থিতি আছে বহুকাল আগে থেকেই। প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-এর সিচেলিসে সফরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় এবার গণচীনও নামলো। মোজাম্বিক হচ্ছে land-locked জাম্বিয়া, জিম্বাবী, বতসোয়ানা ও মালাওয়ীতে প্রবেশের সহজ ও নিরাপদ দ্বার। তাই মোজাম্বিকের সড়ক নির্মান খাতের সবচেয়ে বড় কন্ট্রাকটর হচ্ছে খোদ গণচীন সরকার। চীনা প্রেসিডেন্টের মোজাম্বিক সফরের অন্য সব লোক দেখানো বিষয়ের আড়ালের মূল বিষয় হচ্ছে আফ্রিকা থেকে ভারত মহাসাগর দিয়ে চীনগামী তেলবাহী জাহাজগুলোর নিরাপত্তা আর আফ্রিকার দক্ষিণ দিকের দেশগুলোতে চীনা পণ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। নামিবিয়া সফর কালে প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও নামিবিয়াকে তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার ব্যাপারে চীনের সমর্থন নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ নামিবিয়াকে সমর্থনের মাধ্যমে গণচীন পরোক্ষভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও তার মিত্রদের হুঁশিয়ারী দিল।

আফ্রিকার ব্যাপারে গণচীনের এই বিশেষ ধরনের আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০০০ সালে China-Africa Cooperation Forum গঠণের মাধ্যমে। এর সর্বশেষ সম্মেলনে আফ্রিকার ৩৩ টি দেশের চৈনিক ঋন মওকুফ করা হয়েছে, ২৬ টি দেশের ৪৫৪ টি পণ্যের উপর থেকে ট্যারিফ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বস্তুতঃ এধরনের ট্যারিফ সুবিধা আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য কোন সুবিধা বয়ে আনবে না। কারন, আফ্রিকার ৫৭% রফতানী হচ্ছে জ্বালানী, ২৩% হচ্ছে খনিজ সম্পদ (মূলতঃ ধাতু বা ধাতুর আকরিক)। বাকী ২০% এর অধিকাংশই বনজ বা কৃষিজাত পণ্য। ট্যারিফমুক্ত জ্বালানী ও কাঁচামাল রফতানী উচ্চমূল্যে তৈরী পণ্য আমদানীর পথ খোলে।

গণচীনের ক্ষেত্রে ফোরাম করার দীর্ঘ মেয়াদী লাভও উল্ল্যেখযোগ্য। এক ২০০৬ সালেই African Development Bank-এর গণপূর্ত বিষয়ক সব কাজের এক তৃতীয়াংশ পেয়েছে চীনারা যা অন্য যেকোন দেশের তুলনায় কমপক্ষে আটগুন বেশী। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ আগের তুলনায় চারগুন বেড়েছে।

আফ্রিকায় চীনা সাহায্যের ৮০% গেছে তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়া, সুদান আর অ্যাঙ্গোলায়। এসব দেশ থেকে পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে গণচীন এমনকি টাকার বদলে তেলের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থাও নিয়েছে। বিনিয়োগ ও ঋন প্রদানের ক্ষেত্রে আফ্রিকাতে তারা আকর্ষনীয় শর্তের ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ঋন নেবার পরিবর্তে তারা গণচীনের দ্বারস্থ হয়।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই গণচীন আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকে “এক চীন” নীতিতে তাদের সমর্থন আদায় এবং সেসময়ের ফরমোজাকে হঠিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিজেদের আসন নিশ্চিত করতে। এব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মত আফ্রিকাতেও গণচীন সফল হয়। ফলে ২০০৬ সাল নাগাদ মাত্র পাঁচটি আফ্রিকান দেশের সাথে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকে।

আপাত দৃষ্টিতে গণচীনের আফ্রিকাতে কর্ম-কান্ড ব্যবসা-বাণিজ্যমূখী এবং কল্যানমূলক। এব্যাপারে তাদের সরকারী মতামত প্রকাশিত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত গণচীনের রাষ্ট্রদূত লিউ গুইজিনের ভাষ্যে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে জোহানেসবার্গে African Business Leaders Forum-এ তিনি বলেন, “৬০০ বৎসর আগে চীনা অভিযাত্রী ঝেং হি আফ্রিকার ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি সেসব দেশে চা, চীনামাটির দ্রব্যাদি, রেশম আর চীনা প্রযুক্তি পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি আফ্রিকার এক ইঞ্চি জমি দখল করেন নি, বা একজন আফ্রিকানকে দাস হিসাবে নিয়ে যান নি। তিনি বাইরের বিশ্বের জন্য সভ্যতা আর শান্তির বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন। এটি প্রাচীন চীনের বিশ্বস্ততা এবং সংশ্লিষ্ট দেশ ও তাদের জনগণের প্রতি শক্তিশালী বিনিময়ের প্রতিফলন। এই শান্তিপ্রিয়তার সংস্কৃতি চীনা জনগণের অন্তরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গভীরভাবে প্রোথিত”।

কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই এত সহজ? এটি ঠিক যে গণচীন আজ পর্যন্ত কোন আফ্রিকান দেশে তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়নি (জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ছাড়া)। তারা কোন আফ্রিকান দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়েও নাক গলায়নি। দেং-পন্থী বিপ্লবও রফতানী করার চেষ্টা করা হয়নি। যদিও জিম্বাবী বা সুদানের বিতর্কিত সরকারের সাথে বিশ্ব মতামত উপেক্ষা করে তারা সহযোগিতা করে গেছে। আপাতঃ দৃষ্টিতে একে বাণিজ্যমূখী মনে হলেও তাদের এসব কর্ম-কান্ড ও উদ্যোগের মূল গভীরে প্রোথিত।

নয়া ঔপনিবেশিক ধারনায় প্রথমেই কোন দেশে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা হয় না। শুরুটা হয় সস্তায় নিজেদের পণ্য বিক্রয় করে তাদের সেগুলোতে অভ্যস্থ করাতে। তারপর তাদের পণ্য নিজেদের কাছে সস্তায় বিক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। এরপর নিজেদের পণ্যের মূল্য আস্তে আস্তে বাড়ানো হয়। যেমন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সেখানকার মূল্য হিসাবে প্রায় তিন লিটার তেলের দামে এক লিটার কোক পাওয়া যায়। সহজ শর্তে ঋন দিয়ে তাদের সরকারকে নিজেদের ব্যাপারে নমনীয় এবং অন্যায় আচরনের ক্ষেত্রে উদাসীন করা হয়। সেসব দেশে বিনিয়োগের পরিমান যখন বৃদ্ধি পায় কৌশলগত মিত্রতার নামে তখনই সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়।

অবকাঠামোগত উন্নয়নে ইচ্ছাকৃতভাবে বাজার দরের চেয়ে সস্তায় কাজ করে দেয়া হয় ভবিষ্যতে ঐ দেশটিতে নিজেদের সুবিধাজনক কৌশলগত অবস্থানের কথা মাথায় রেখে। সামাজিক বিষয়গুলোতে সাহায্য করা হয় সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহের বাইরে রাখতে। চৌ এনলাই-এর সময় থেকে চীনা নেতারা বার বার একথা বলেছেন যে আফ্রিকায় তাদের সাহায্য কার্যক্রম দাতব্যমূলক নয়, বরং পারস্পারিক স্বার্থ সংরক্ষণমূলক। গণচীনের ক্ষেত্রে এই স্বার্থ নিজের জন্য সস্তায় জ্বালানী ও কাঁচামাল যোগান এবং নিজের পণ্য অবাধে বিক্রয় করা।

যতদিন পর্যন্ত গণচীন আফ্রিকার কাছ থেকে তার শর্তে জ্বালানী ও কাঁচামাল পাবে ততদিন পর্যন্ত চীনা ড্রাগনের আগ্রাসী চেহারা বাইরে দেখা যাবে না। কিন্তু যেই মাত্র তার স্বার্থে বাধা বা আঘাত আসবে, অথবা সেসব দেশে অপ্রত্যাশিত domestic competition দেখা দেবে তখনই চীনা ড্রাগন স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হবে। এমন কি তৃতীয় কোন শক্তির প্রবল উপস্থিতি দেখা দিলেও একই ঘটনা ঘটবে। সামরিক সহযোগিতার নামে সেনাবাহিনী পাঠানো, অজনপ্রিয় একনায়ককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা, সরকার ও বিদ্রোহী উভয় পক্ষকে অস্ত্র সরবরাহ করা সবই দেখা যেতে পারে।

অস্ত্র ব্যবসায়ের স্বার্থে মায়ানমারের সামরিক সরকারের ব্যাপারে গণচীনের যেমন উদাসীনতা আছে, আফ্রিকার যুধ্যমান পক্ষগুলোর ব্যাপারেও তাদের একই ধরনের উদাসীনতা আছে। আফ্রিকার জ্বালানী আর কাঁচামাল যখন ফুরিয়ে যাবে, বা আরো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর চাপে পিছু হটতে হবে, অথবা আফ্রিকানরা যখন অন্য কারো তৈরী আরো সস্তা পণ্যের অবাধ সরবরাহ পেতে থাকবে গণচীন তখন আজকের বলা সব সুবচন ভুলে আফ্রিকাকে নাইজেরিয়ার পরিত্যক্ত তৈলখনিগুলোর মত ত্যাগ করবে।

[লেখাটি তিন পর্বে সমাপ্ত করার ইচ্ছা আছে। শেষ পর্বে তথ্যসূত্র উল্ল্যেখ করা হবে।]


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বিশ্লেষণ এবং তথ্য-উপাত্ত দুদিক থেকেই প্রয়োজনীয় ও সার্থক লেখা। আফ্রিকায় যা যা ঘটছে বাংলাদেশে তার সামান্যই আলোচনায় আসে। এ নিয়ে লেখার তাগাদা বোধ করছিলাম। আপনি করলেন বলে, আবারো ধন্যবাদ জানাই। সার্বিকভাবেই একমত।
তবে কেউ ভাবতে পারে যে, আফ্রিকা আগে ঠিকই ছিল, এখন চীন সেখানে ঊপনিবেশিক থাবা বসাচ্ছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার থাবার বিষয়টিও সংযোজিত হতে পারতো। কিংবা আফ্রিকাকে ঘিরে আমেরিকার সামরিক আয়োজনের বিষয়টাও।
চীনের এ রূপান্তরটি খেয়াল করার মতো। চীনের বহিঃস্থ শোষণের উতস কম ছিল, পুঁজি রপ্তানির জায়গাতেও সে যাওয়ার অবস্থায় ছিল না। সেহেতু অভ্যন্তরীণভাবে শ্রম শোষণ করে, এবং সেই শোষণের ভাগ বিদেশি ক্যাপিটালকে দিয়ে থুয়েই তাকে কারবার চালাতে হচ্ছিল। শ্রমিক পীড়ন করে সস্তায় পণ্য বানানোই ছিল তার এযাবতকার পন্থা। এখন সরাসরি পুঁজি রপ্তানি ও বাইরের রিসোর্স এক্সপ্লয়েট করার সামর্থ্য যে হয়েছে আপনার লেখাতেই তার প্রমাণ রয়েছে। বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনে নতুন এ শক্তির উদয় ভূমিকা রাখবে।
লেখার জন্য আবারো ধন্যবাদ।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

পান্ডব,

সুলেখা হয়েছে। পরবর্তী এপিসোডের অপেক্ষায় থাকলাম। এই বিষয় নিয়ে ফারুক ভাইয়ের মত আমিও ভাবছিলাম গত কয়েক মাস যাবত। জরুরী বিষয় সন্দেহ নেই, আপনার লেখা জন্যে তাই ধন্যবাদ।

একটা সাজেশান রাখতে পারি? এরকম তথ্যমূলক ব্লগ পোস্টের জন্যে বৃহত্তর ইন্টারনেট হচ্ছে পাঠক এবং লেখক, উভয়েরই বড় বন্ধু। আপনি তথ্যসূত্র একদম শেষের জন্যে জমিয়ে না রেখে এখনই আপনার লেখার মধ্যে বিভিন্ন লিংক হিসাবে দিয়ে দিতে পারেন। পাঠক আগ্রহী হলে নিজেই আদিসূত্রতে গিয়ে আরো বিস্তারিত পড়ে জেনে নিতে পারবে। বাংলায় তথ্যমূলক বা নিউজভিত্তিক ব্লগিং-এ বিস্তর লিংকের ব্যবহার এখনো তেমন প্রসার পায়নি, যদিও অন্যান্য ব্লগে এটা বেশ সাধারণ প্র্যাক্টিস। প্রথম রিসোর্স হিসাবে গুগল নিউজ তো আছেই, এছাড়াও বিবিসি, লন্ডন টাইমস, গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ইকনমিস্ট, নিউজউইক সহ আরো অনেক মিডিয়া মাধ্যম গুগল সার্চে চলে আসে। চীন-আফ্রিকা ইস্যুটি এরকম অনেক ডেইলি বা সাপ্তাহিকে সম্প্রতি কভারেজ পেয়েছে। সরাসরি কিছু লিংক পেলে পাঠক উপকৃত হবে। আশা করি বিষয়টা ভেবে দেখবেন।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটি... টুকটাক কিছু জানছিলাম... আপনার লেখায় ডিটেইল পেলাম... ভালো লাগলো...
ধন্যবাদ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পলাশ দত্ত এর ছবি

অভিনন্দন।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

দিগন্ত এর ছবি

এ তো ঘটবেই, চিন সরকার নাহলে দেশের লোকজনকে খাওয়াবে কি ভাবে? চিনের কারখানা চালাবার জন্য মালমশলা আসবে কি ভাবে? ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সরকার একই কাজ করতে পারে না তাই করে না ... এর মধ্যে অনৈতিক তো আমি কিছু দেখি না। আফ্রিকার লোকজনে সজাগ হলেই আবার এই সমস্যার সমাধান হবে। সে হতে আপাতত অনেক দেরি আছে ... তাই আপাতত লুটেপুটে খাও।

অষ্টাদশ শতকে গোটা এশিয়ারও একই অবস্থা ছিল - সেটা যতটা না ইউরোপীয়দের সাম্রাজ্যবাদের কারণে তার চেয়েও বেশী হল আমাদের পশ্চাদপদ সমাজের কারণে। আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তাই। এখন সমস্যা হল দেশে সুষ্ঠু শাসন না বসালে সমাজের অগ্রগতি হয় না। আবার সমাজের অগ্রগতি না হলে সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তি নেই। তাই ... সেই মুরগী আগে না ডিম আগে সমস্যা ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

স্নিগ্ধা এর ছবি

ষষ্ঠ পান্ডব - পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় থাকলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।