তারার ফুল - অহমীয়া গল্পের রূপান্তর-০১

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: শুক্র, ০১/০৫/২০০৯ - ১২:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রায় বোধের অগম্য, খুবই স্পর্শকাতর, কিন্তু ভুল করার মত না। তারার ফুলের এক ঝলক। তিনি জানেন ধারে কাছে কোথাও তারার ফুল নেই। কিন্তু তার সুবাস পঞ্চাশ বছরের পথ পেরিয়েও তার তন্ত্রীতে ধাক্কা দিচ্ছে। এই সুবাস তার মগজে সারা জীবনের জন্য গেঁথে গেছে। সুবাসটা সেখান থেকেই আসছে। যে সময়, যে স্থানে, যে ঘটনায় এই সুবাস তার নাকে প্রথম লেগেছিল তা তার জীবনে অন্যস্থান করে নিয়েছে। সব কিছু তিনি আবার মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দূরে দেখা একটা ছোট পাখির মত এক ঝলকে তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চৌধুরী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।

আমরা অতীতের দিকে তাকাই নস্টালজিয়া নিয়ে আর ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখি। কিন্তু বর্তমান? বর্তমান আসলেতো একটা অর্থহীন শব্দ। সময় প্রবাহের কোন অংশটিকে আমরা বর্তমান বলব? পাঁচ মিনিট? পাঁচ সেকেণ্ড? এক সেকেণ্ডের এক শতাংশ নাকি এক লক্ষাংশ? বর্তমানের যদি মানেই না থাকে তাহলে “বর্তমান”টা কী? যে কোন কিছু ঘটতেই তো কিছু না কিছু সময় লাগে, তাহলে তো বর্তমানে কিছুই ঘটা সম্ভব না। হয় কিছু ঘটে গেছে অথবা কিছু ঘটবে। আমরা হয় অতীতে অথবা ভবিষ্যতে বাস করি। অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন এই নিয়েই আমাদের জীবন। দিন চলে গেছে, অনেক কিছুই আছে যা চৌধুরী এখন আর করেন না বা করার কথা ভাবেনও না। তিনি ফুটবল খেলতে পারেন না, লাফালাফি করতে পারেন না, অথবা প্রেমে পড়তে পারেন না। কিন্তু আগামী নিয়ে ভাবা তার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চৌধুরী চোখ বুঁজলেন। এবার তিনি সব কিছু যেন আগের মত পরিষ্কার আর উজ্জ্বল ভাবে দেখতে পেলেন। অনেক খুঁটিনাটিই আজ আর মনে নেই, অনেক কিছু হয়তো তখন তার চোখেও পড়েনি। কিন্তু ঘটনার সবকিছুই তার মনে রেয়ে গেছে। গোটা ঘটনাটি আদ্যপান্ত তার আবার মনে পড়ল।

তখন চৌধুরীর ছিল তরুণকাল। সারা দুনিয়া তখন তার হাতের মুঠোয়। আবেগপ্রবন, সুদর্শন তরুন। চোখে তার আনন্দ আর গভীর ভালোবাসা। সেদিন সকালেও পাখিরা গাইছিল। বিছানা ছেড়ে সবে জানালা খুলেছেন, বাইরে তাকাতেই তার হৃদস্পন্দন থমকে গেল। কূয়ার ধারে একটা মেয়ে স্নান করছিল। ধারে কাছে আর কেউ নেই। মনের আনন্দে, নিশ্চিন্ত মনে সে বালতি ভরে পানি গায়ে ঢালছিল। কূয়া থেকে পানি ভরা বালতি টেনে তুলতে তার নিরাবরণ স্তন লাফিয়ে উঠছিল।

চৌধূরী পাথরের মত জমে গেলেন। জানালা তখনো অর্ধেক খোলা, তার হাত তখনো ছিটকিনিতে। একই সাথে অব্যক্ত আনন্দ আর অদ্ভূত কষ্টে তার বুকটা ভরে উঠল। তার জন্য সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ঠিক তক্ষুনি তার নাকে এসে লাগল তারার ফুলের সুবাস। গোটা ঘটনার সাথে এ’ এক অব্যাখ্যাত মিশ্রন। নতুন এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি। তার বোধের পৃথিবীকে মেয়েটা যেন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। নিঃশ্বাস চেপে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুবাসটা যেন রঙ আর আকার নিয়ে তার সামনে হাজির হল। অবর্ণনীয় আনন্দালোকে তার হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল। হঠাৎ তিনি জেগে উঠলেন।

“বাবা, ফলের রসটা খেয়ে নিন”, পুত্রবধূর কন্ঠ এক ধাক্কায় তাকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবের দুনিয়ায় নিয়ে এল।

“আবার? একটু আগেই না একবার খেলাম!” পুত্রবধূ কোন তর্কে গেলেন না। সবাই জানেন যতই দিন যাচ্ছে ততই চৌধুরীর স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে। এমন সময় সমর ঢুকলেন।

“কে?” চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন।

“বাবা, আমি সমর। আমাকে চিনতে পারছেন না?”

“ওহ! তা তুই কখন আসলি? তোর কলেজ কী বন্ধ হয়ে গেছে?”

সমর, চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র, সকালেই এসেছেন, একবার বাবার সাথে কথাও হয়েছে। সন্দেহ নেই তার বাবার সে’কথা কিছু মনে নেই।

চৌধুরী কিন্তু দূর অতীতের কথা ভোলেননি। তার মনে আছে প্রথমবার বাবা হবার স্মৃতি। সেটা ছিল ১৯৩১ সালের চৌদ্দই জানুয়ারী সন্ধ্যে সাতটা তের মিনিট। অমরের জন্মানোর খবর শুনে মুহূর্তে তার উদ্বিগ্নতা কেটে গিয়ে উচ্ছ্বল আনন্দে মন ভরে উঠেছিল।

সমরের উৎকন্ঠিত প্রশ্ন আবার তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল।

“ব্যাপার কী? আপনার কী শরীর খারাপ?”

“না।“

“আপনার কী কোথাও ব্যথা লাগছে? কিছু খাবেন?’

বিরক্ত হয়ে চৌধুরী বললেন, “কেন আমাকে বারবার এত পানি আর খাবার গিলতে বলিস?”

“উনি কিন্তু সকাল থেকে এই এক গ্লাস ফলের রস ছাড়া আর কিছু খাননি”, পুত্রবধূ নিশ্চিত করলেন।

চৌধুরী এখন আর ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা বুড়ো নন। তিনি এখন বাইশ বছরের তরুণ। স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে তিনি জানালা খুলে ফেললেন। হঠাৎ করে গান থেমে গেল, আনন্দ হারিয়ে গেল। নিমিষেই মেয়েটি পর্দার পেছনে দাঁড়ানো চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি গামছায় গা ঢেকে দৌড়ে পালালো। তার সাথে সাথে তারার ফুলের সুবাসও চলে গেল।

সহসা চারদিকের আলো যেন নিভে গেল। পৃথিবীটা বিষন্ন হয়ে পড়ল। ভালো, ভদ্র ছেলে হিসেবে এতদিন তার সুনাম ছিল। এখন নিজের কাছেই নিজেকে নিরাবরন, উন্মূক্ত মনে হল।

মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন সবার কাছে এই কথা বলে দেবে। কেউ তখন আর তার কাছে কোন ব্যাখ্যা চাইবে না। সবাই নিজের মত করে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে চলে যাবে। তার উদ্দেশ্য যে সৎ, পবিত্র ছিল, তিনি যে সৌন্দর্যের নিষ্কাম পূজা করছিলেন - এ’কথা কেউ আর বিশ্বাস করবেনা। তার সকল কৈফিয়তই বৃথা যাবে। অপরাধের গ্লানিবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে তার দিনটাকেই মেঘে ঢেকে দিল।

সেদিন সন্ধ্যায় বাজার যাবার পথে তিনি দেখলেন সেই মেয়েটা আরো দু’টো মেয়ের সাথে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখেই সচেতনভাবেই তাদের এমনভাবে পাশ কাটালেন যেন তিনি তাদের দেখতেই পাননি। আড়চোখে তাকাতেই দেখা গেল মেয়েটা তার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে শুনিয়ে বেশ জোরের সাথেই মেয়েটা বলল, “ওর চোখ উপড়ে ফেলা দরকার”।

না, ক্ষমার কোন আশাই ছিল না। এই ব্যাপারটা থেকে বের হবার কোন উপায়ও ছিলনা। পৃথিবীতে অন্ততঃ একজনের মনে তার নামের সাথে সারা জীবনের জন্য কালি লেগে গেল। সে’দিন সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। তার পরদিন সকালে ভারী মন নিয়ে তিনি জানালা খুললেন, প্রতিদিন যেমন খোলেন। অবাক ব্যাপার! মেয়েটা গতদিনের মতই চারপাশের কোন কিছুর দিকে খেয়াল না করে স্নান করছিল। শান্তি আর মুক্তির আনন্দে তার হৃদয় ভরে উঠল। দিনটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, পাখিরা আনন্দে গান গেয়ে উঠল, তারার ফুলের সুবাসে বাতাস আবার ভরে উঠল।

চৌধুরী আসলে গোটা ঘটনাটাই ভুলে গেছেন। এমনকি ঐ মেয়েটির কোন স্মৃতিও আর তার মনে অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সেদিন থেকে তারার ফুলের সুবাস তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর ধরে সেই সুবাস তার ক্ষয়ে যাওয়া দিনগুলোকে আনন্দ আলোয় ভরে দিয়েছে।

দোহাইঃ

১। “তারার ফুল” গল্পটি প্রখ্যাত অহমীয়া সাহিত্যিক শীলভদ্রের (রেবতী মোহন দত্ত চৌধুরী) গল্পের ইংরেজী অনুবাদ “Star Lily”-র বাংলা রূপান্তর।
২। Liliaceae পরিবারের কন্যা Star Lily (Zigadenus fremontii)-র ভালো বাংলা নাম আমার জানা নেই। পাহাড়ী এই ফুলটিকে কোথাও কোথাও লিলিফুল আবার কোথাও রওশন ফুল বলা হয়েছে। আমি এর ইংরেজী নামের আক্ষরিক অনুবাদ করেছি তারার ফুল। তবে এই নামটি আমার কাছেই মেকি লাগে। সমতলে জন্মানো কাছাকাছি গোত্রের ফুলটি বাংলাদেশে ফোটে জংলা জায়গায় অনাদরে, অবহেলায়। চমৎকার সুবাস আছে। সাদা সরু ছয় পাপড়ির ফুল গোড়াতে একীভূত। ছয়টি পুংকেশর স্পষ্ট, সমকোনে সংযুক্ত পরাগধানী লম্বা ও হলুদ পরাগ সমৃদ্ধ। গর্ভকেশর একটি, বড়, মাথাযুক্ত। মাটির নিচে বড় কন্দ থেকে গাছ জন্মায় বলে ছোটবেলায় একে রশুন ফুল (!) নামেও ডাকতে শুনেছি।


মন্তব্য

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

পুষ্পকোষ রচনার মৌসুমে ফুল নিয়ে গল্প হাসি
একেবারেই ভিন্ন ধরনের। সত্যিই ভালো লাগলো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। পুষ্পকোষের পথ চলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

চমৎকার লাগলো গল্পটা পড়ে। আর প্রতিটি ভুক্তির সাথে একটা করে গল্প যদি আমরা দিতে পারতাম!



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটা করে গল্প হয়তো বেশি বেশি চাওয়া হয়ে যায়। তবে একটা করে গান বা কবিতার লাইন কিন্তু আমরা পেতেই পারি। অসংখ্য বিখ্যাত গান-কবিতা এমন আছে। আর যেগুলোতে নেই সেগুলোর জন্য সচলের কবিরাতো আছেন। তারাই নতুন কবিতা-গান লিখে দিতে পারেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

যুধিষ্ঠির এর ছবি

আমার তো মনে পুষ্পকোষের জন্য এটা আবশ্যক হওয়া উচিৎ যে প্রতিটা ভুক্তির সাথে একটা গল্প বা একটা গান বা কবিতার লাইন থাকতে হবে। এটা তো আর টেকনিক্যাল কোন কোষ না যে খটমটে রসকষহীন হতে হবে!

রণদীপম বসু এর ছবি

দারুণ লাগলো পাণ্ডব দা' !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কদম নিয়ে আপনার শুরুটাও অসাধারণ। এমন চালিয়ে যান।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

খেকশিয়াল এর ছবি

দারুণ গল্প! আরো ছাড়ুন

------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

খান বিশেক অহমীয়া গল্প রূপান্তরের পরিকল্পনা আছে। তবে আপাতত পুষ্পকোষ ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে বা কাজ করতে চাইছি না।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অসামান্য গল্প। খুবই ভাল লাগল। সময় লাগলেও, বাকি উনিশটা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম...

যুধিষ্ঠির এর ছবি

বেশ ঝরঝরে অনুবাদ। ভালো লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।