সংস্কৃতি - নির্মাণ, ধ্বংসের

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: রবি, ২৩/০১/২০১১ - ৩:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

গত শুক্রবার পুরনো ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যকর্মগুলো দেখতে বের হয়েছিলাম। সব দেখাতো সম্ভব না, তাই একদিনে যতটুকু বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া যায় ততটুকু দেখা। বেশির ভাগ অনেক আগে দেখা বা বহুবার দেখা - তবু এই ভ্রমণ মন্দ লাগেনা। দলে আমরা কখনো “ডার্টি ডজন”, কখনো “আনলাকি থার্টিন”। পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে মাথার সংখ্যা বার বার কমে বাড়ে। দলে বছর কুড়ি আগে জন্মানো ছোঁড়া যেমন ছিল, আবার প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে জন্মানো বুড়োও ছিল। একাধিক প্রজন্ম দ্রষ্টব্যগুলো সম্পর্কে নিজেদের বয়ান দেয়। তাতে প্রাজ্ঞের জ্ঞান তারুণ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়, নবীনের সাহস প্রবীনের স্পর্শে আত্মবিশ্বাসে পরিণত হয়।

টিকে থাকা এই স্থাপত্য কর্মগুলোর প্রায় সবই হচ্ছে উপাসনালয়। ধর্মের হাত শক্তিশালী বলে জমিখাদক পিরানহার দল সেখানে দাঁত বসাতে পারে কম। তবু মসজিদকে চারদিক দিয়ে চাপতে চাপতে দমবন্ধ করে ফেলা হয়, মন্দির শেষমেশ একটা চার হাত বাই চার হাত ঠাকুরঘরে পরিণত হয়। অন্যদিকে কেল্লার গায়ের ওপর হাইরাইজ বাক্সবাড়ি হুমড়ি খেয়ে পড়ে, মুসাফিরখানাকে দোকানদাররা দখল করে ফেলে, রাজবাড়ি পুরানা শিশি-বোতল আর ছিঁড়া-ফাঁড়া-স্যান্ডেলের বিনিময়ে “গাট্টা মিঠাই” বার্টার করাদের মালগুদামে পরিণত হয়।

সবার জানা সত্যটা হচ্ছে এই যে, এই প্রাচীন স্থাপত্যকর্মগুলোকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কেন? সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান আর ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বোঝা আর তা দিয়ে ভবিষ্যতের গতিধারা কী হবে সেটা নির্ধারণের জন্য এই স্থাপত্যকর্মগুলো রক্ষা করতে হবে। আমরা এও জানি যে, এগুলোর খুব কমগুলোই ঠিকভাবে রক্ষিত হয়েছে। আমাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বাকিসব গ্রাস করেছে। এই ক্ষেত্রে অন্ততঃ আমরা সভ্যজনের মত আচরণ করতে পারিনি। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো যা কিছু বাকি আছে সেগুলো রক্ষা করা নিয়েও বিশেষ কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

দুই কাটারার কোনো একটির সাবেক মালিকদের একটি পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আজো পর্যন্ত ঐ পরিবারের কোন পুরুষকে কোন চাকুরী বা ব্যবসা করতে দেখিনি। তাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমাগত কেবল খারাপ থকে খারাপতর হতেই দেখেছি। ছিল ঢেঁকি হলো তুল, কাটতে কাটতে নির্মূল - এই নিয়মে ঐতিহ্যের অংশ দোকানদারদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। সরকার অধিগ্রহন করে এইসব ঘোড়ার ঘাসিদের উৎখাত না করলে আজ যা দেখতে পাচ্ছি তাও আগামীকাল বিক্রি হয়ে যাবে। সব দোষ পিরানহাদের নয়, বা’ণ মাছ নিজে নিজের ডিম খায়।

লালবাগের কেল্লা বানিয়েছিল বহিরাগত মোগলরা, যাতে ঢাকাতে মোগল বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিতে না পারে। কাটারাগুলো বানানো হয়েছিল মোগলদের প্রতিভূদের জন্য। আহসান মঞ্জিল বানানো হয়েছিল ঢাকার টুটা-ফাটা কাগজী নবাবদের ঠাঁট-বাট দেখানোর জন্য। ঢাকার আমজনতাকে শোষণ করে তাদেরই অর্থ-শ্রম-রক্ত-ঘামের বিনিময়ে নির্মিত এই নিষ্প্রাণ ইমারতের সারি। এখানে স্থপতির, নির্মাণকর্মী আর পরিকল্পনাবিদের মুন্সিয়ানা হয়তো দেখা যায়; মোগল স্থাপত্যরীতির সাথে গ্রেকো-রোমান রীতি বা ভারতীয় রীতি, এমনকি কোথাও রুশ রীতির সম্মিলন দেখে চমৎকৃত হওয়া যায়; সংস্কৃতির বহতা নদীতে কোথাকার কোন স্রোত কবে-কীভাবে এসে মিশেছিল তা নিয়ে গবেষণাও করা যায় কিন্তু এর কোন কিছু নিয়েই গর্ব করা যায় না। বাংলা স্থাপত্যরীতি বলে প্রতিষ্ঠিত কোন রীতি আমরা দেখতে বা শুনতে পাইনা। স্থানীয় কোন স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদের নামও শতাব্দী পেরিয়ে আমাদের কানে আসেনা।

তবু এগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে এই জন্য যে আমরা আমাদের অতীতকে যেন ভুলে না যাই। নিজেদের শত্রু-মিত্রকে যেন বার বার চিনে নিতে পারি। নিজেদের আত্মপরিচয়টাও যেন ততোধিক গর্বে তুলে ধরতে পারি। তাই জুলুমের কেল্লার পাশে দেখতে চাই এমন স্থাপত্য কর্ম যাকে দেখে বিশ্ব বলবে - চিনে রাখো এটা বাংলা স্থাপত্যরীতির একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চিনে রাখো এটা জালিমের প্রসাদ নয় - আমজনতার কেন্দ্র।

২.

কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার থেকে ঢাকা মেডিকেল আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স অংশের মাঝখান দিয়ে দক্ষিণগামী পথ ধরে আগালে মেডিকেলের জরুরী বিভাগের সামনে আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হবে। কেন? কোন মুমূর্ষু রোগী এসেছেন বলে? না, গোটা রাস্তাটাই সেখানে থমকে গেছে বলে। রাস্তাটার বুক জুড়ে সেখানে বহুতল বিশিষ্ট সুপার মার্কেট তৈরি হচ্ছে, আর পথটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠটার এক কোনা কেটে একটু বাঁয়ে ঘুরিয়ে নেয়া হয়েছে।

যারা মার্কেটটা বানাচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই ঐ জায়গাটার বৈধ মালিক। তাহলে গত নব্বই-একশ’ বছর ধরে এই বৈধ মালিকদের বঞ্চিত করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কোন অধিকার বলে সেটাকে রাস্তা হিসাবে চালিয়ে আসছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বা কীভাবে এত দিন ধরে সরকারের রাস্তাটিকে খেলার মাঠ হিসাবে চালাচ্ছিল? এনিয়ে মামলা হয় না কেন? সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের শাস্তি দাবী করেনা কেন ঐসব নিরীহ-বঞ্চিত মার্কেটওয়ালারা?

আমরা জানি, রাস্তাওয়ালারা, নদী-খালওয়ালারা, পার্ক-উদ্যানওয়ালারা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ওয়ালারা খুবই দুষ্ট প্রকৃতির। তারা প্রায়ই মার্কেটের জমি দখল করে রাখে আবার বড় গলায় কথা বলে। আমরা যে আসলে দোকানদারের জাত; লেখা-পড়া-চলাচল-প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি যে কোনভাবেই দোকানদারীর চেয়ে বড় না এই মূর্খগুলো সেগুলো কোনভাবেই বুঝতে চায় না। দেশের উন্নতি হবে কীভাবে?

বহুতল বস্তির মতো বেড়ে ওঠা এই মার্কেটগুলো রাজউকের কতটুকু নিয়ম মেনে হয় সে প্রশ্ন তুলবনা। তবে এই বিপুল স্থাপত্যকর্মগুলোর যে ধরনের চেহারা তা জাতি হিসাবে ভবিষ্যতের কাছে আমাদের কোন পরিচয় তুলে ধরবে? কোন রীতি আমরা এখানে নির্মাণ করছি। শশাঙ্কের পর গোপালের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে রাজনৈতিক বিবেচনায় মাৎস্যন্যায় বলা হয়; ঔপনিবেশিক শাসকদের গড়া ভিক্টোরিয় স্থাপত্যরীতির পর সুসংহত কোনো স্থাপত্যরীতির আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই যুগটাকেও কি সংস্কৃতির এই ক্ষেত্রের মাৎস্যন্যায় বলবো? একটা ধ্বংস পরবর্তী নির্মাণের পথ তৈরি করে দেয় বটে কিন্তু পরবর্তী নির্মাণ যদি উৎকৃষ্টতর না হয় জাতীয় সংস্কৃতি কি তাহলে সামনে আগায়?

৩.

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বা পটুয়া কামরুল হাসান ঢাকায় কোন বাড়িতে থাকতেন? কোথায় থেকে তাঁদের মহৎ শিল্পকর্মগুলো নির্মাণ করেছেন? পুরানা পল্টনের কোন্‌ বাড়িতে বুদ্ধদেব বসু থাকতেন? জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর শেষ দিনগুলো কোথায় কাটিয়েছিলেন? মরমী গায়ক আব্বাসউদ্দীনের বাড়িটাই বা ঢাকার কোথায়? এমন শত শত প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তাঁদের কীর্তিগুলো টিকে থাকে কিন্তু তাঁদের স্মৃতিচিহ্নগুলো হারিয়ে যায়। শেক্সপীয়ারের বাড়ি দেখার চেয়ে “মার্চেন্ট অভ ভেনিস” পড়াটা জরুরী বটে; তবে তার মানে এই নয় যে তাঁর বাড়িটাকে সুপার মার্কেট বা হোটেল বানিয়ে ফেলতে হবে। একটা জাতির পরিচয় তার কৃতি সন্তানদের প্রতি আচরণের দ্বারা এভাবে নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির নির্মাতার পরিচয় ধ্বংস করে যারা পকেট গরম করে তাদের কোন সাংস্কৃতিক পরিচয় অবশিষ্ট থাকেনা।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

এইসব পুরান বিল্ডিং রেখে লাভ কী? তার চাইতে জমিটা কোন ডেভলপারকে দিয়ে দিলে ৪/৫টা অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যাবে। অ্যাপার্টমেন্ট প্রতি ৫০ লাখ করে হলেও কমসে কম ২/৩ কোটি টাকা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লাভের হিসাবটা আরো অনেক বড় মেম্বর। ঢাকা শহরে জমির দাম দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গার চেয়ে বেশি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাংলা স্থাপত্যরীতি বলে প্রতিষ্ঠিত কোন রীতি আমরা দেখতে বা শুনতে পাইনা।

বাংলো?

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার কিছু কনফিউশন আছে। কেন?

১। এই রীতিতে বাড়ি ভারতবর্ষের অনেক জায়গায়ই বাড়ি করা হয়, শুধু বৃহত্তর বাংলায় নয়।
২। টিনের চালের স্টাইলে পাকা ছাদ বানানোর কৃতিত্বটা সম্ভবতঃ সাহেবদের, আমাদের কারো না।
৩। এদেশে বাংলো ধাঁচের উল্লেখযোগ্য বাড়িগুলো মূলতঃ বৃটিশদের করা। আমরা এই রীতিটা জনপ্রিয় বা প্রচার করার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করিনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

স্থাপত্য রীতির কথা জানিনা, তবে হাতের মাপের ইঁট ব্যাবহার করে স্থাপনা তৈরীতে বাংলাদেশের কিছুটা পটুতা আছে। কার আদেশে স্থাপনা গড়ে উঠেছে, এই কথাটি বাদ দিয়ে দেখলে কিন্ত কান্তজির মন্দির আর ষাটগম্বুজ মসজিদের স্থাপত্যে (কাঠামোগত, সৌন্দর্যবোধে) মিলগুলো চোখে পড়ে। যেখানে এই মিলগুলো স্থাপনার প্রয়োগ ছাপিয়ে এসে পড়েছে সেগুলোকেই মনে হয় বাংলা স্থাপত্যরীতি বলা যেতে পারে। ভেতর ভিটায় পুস্করিনী ও চার মহলা বাড়ীর মাঝে উঠানটিও বোধ করি আমাদেরই দেশী নকশা। আগের একটা টাকার গায়ে যে ছন-খড়ের তৈরী ধনুকের মত বাকা চালওয়ালা মাটির ঘরের ছবি ছিল, সেটাও কি আমাদের নয়?

টেকসই স্থাপত্যকলা ঔপনিবেশিক শক্তির কাজে লাগে বেশী। শান্তিপ্রিয় মানুষ নিতান্ত নিরুপায় না হলে এত মজবুত কাঠামো বানানোর ঝামেলায় যায়না। স্থাপত্য তো শেষমেষ প্রায়োগিক বাস্তবতারই প্রতিফলন। যেখানে এত নদীভাংগন আর ঝড় বয়, সেখানে ইংরেজ আমলের আগে খুববেশী পাকা বাড়ী বা ঢেউটিন আবিস্কারের আগে খুব বেশী চারচালা ঘরের প্রয়োজন বোধ করি প্রকট হয়নি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. যতদূর জানি, দেশী কায়দার ইট ছিল ৯"X৪"X২ ১/২" এখনকার ১০"X৫"X৩" নয়। আমাদের ছোটবেলায় অমন ইট অল্পস্বল্প দেখা যেতো। সেটা আর টেকেনি। চুন-সুরকির মর্টার ব্যবহারও সিমেন্ট আসার পর বন্ধ হয়ে গেছে।

২. ছন দিয়ে যে কুঁড়েঘর তৈরি করা হয় সেটাও একটা স্থাপত্যকর্ম - তবে তা টেকসই নয়। টেকসই স্থাপনার চিন্তা সামন্ততান্ত্রিক ধারনার সাথে বিকশিত হয়েছে। ঔপনিবেশিকতা তাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আমরা চাই বা না চাই মোটামুটি টেকসই স্থাপত্যকর্মই এখন নির্মিত হয়। সেখানে কিন্তু ঐতিহ্যবাহী অ-টেকসই স্থাপত্যকর্মের ফরম্যাটটা ব্যবহৃত হচ্ছে না। এখনকার বিবেচনায় utility aesthetic-কে গ্রাস করেছে। অ-টেকসই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতি এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, নবায়িত হয়ে বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করতে পারছেনা।

৩. কান্তজীউ মন্দির বনাম ষাট গম্বুজ মসজিদ আলোচনায় যাচ্ছিনা এব্যাপারে আমার জানার ঘাটতি আছে বলে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

পাণ্ডবদা, পুরানা পল্টনে বুদ্ধদেব গুহ না বুদ্ধদেব বসু থাকতেন? কনফিউজড হয়ে গেলাম!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কনফিউজড হবার কিছু নেই, আমার ভুল হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু হবে। ঠিক করে দিচ্ছি। অসংখ্য ধন্যবাদ। বুদ্ধদেব গুহ রংপুরের মানুষ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরানা পল্টন নাকি সেগুন বাগিচা ?

মনমাঝি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যতদূর জানি পুরনো পল্টনই। এখনকার আইডিয়াল আর আজাদ প্রডাক্টের গলিটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুদূর গেলে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

পশ্চিমে (বোধ করি ভারতেও) 'লিস্টেড প্রপার্টি' বলে একটি ধারনা চালু আছে। বিষয়টি আর কিছুই না, দেশের ঐতিহাসিক/প্রত্নতাত্বিক/স্থাপত্যকলা বা অন্য কোন ভিত্তিতে একটি স্থাপনার ফর্দ থাকে। এই ফর্দে নাম উঠে গেলে সেই স্থাপনাতে কোন ধরনের পরিবর্তনে আগে একটি সরকারি দফতরের অনুমতি নিতে হয়। সরকারের সেই দফতরটি সাধারনত দেশের হালনাগাদ নামিদামী ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্বিক ও স্থপতিদের দিয়ে গঠিত হয়। যদিবা কেই সেইসব স্থাপনার চুল স্পর্শ করে, তাহলে সেই ব্যাক্তির নাম মিছা হয়।

গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে এই ফর্দটির দেখভাল কিন্তু সরকারি নাগালের বাইরে মানে ইংরেজ স্থপতিদের সমিতি থেকেই করা হত। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সেটা ফর্দটি সরকারের পরিচালনায় আনা হয়।

আমাদের দেশেও এই শুরুটা করতে হবে বেসরকারি উদ্যোগেই।

---
বিষয়টি এভাবে ভেবে একটি ভীত হলাম। আরো সময় যখন পেরিয়ে যাবে, তখন কি বেক্সিমকো বেল টাওয়ার, বসুন্ধরা সিটি অথবা ধানমন্ডির লেকের পাশের সেই লাল ইটের বাড়ীটির কড়িকাঠ খসে পড়তে থাকবে, পেলেস্তারা উঠে গিয়ে কংক্রীটের হাড়্গোড় বেরিয়ে আসবে, তখন নিশ্চই সেদিনও আরেকটি দল সেগুলোর দুর্দশা দেখে আফসোস করবে। ভয়ঙ্কর।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১. একটু দ্বিমত করি। অন্ততঃ লিস্টের কাজটা পুরোপুরিই সরকারী উদ্যোগে করতে হবে। এর মানে হচ্ছে লিস্ট করার দায়িত্ব আর সংরক্ষণের সীমা সরকারের হাতে থাকতে হবে। Execute করার কাজটা টেন্ডার দিয়ে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যেতে পারে। আমাদের দেশে প্রত্মতত্ত্ব সংরক্ষণ আইন আছে। তবে তার প্রয়োগ কম। সেটাকে একটু পরিমার্জন করলেই লিস্ট করার সমস্যাটার সমাধান হয়ে যায়।

২. এখনকার কোন নির্মাণ যদি নান্দনিক হয়, representing কিছু হয়; আর অদূর ভবিষ্যতে তা যদি অবহেলার দরুন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তার জন্য আফসোস করাতাই স্বাভাবিক হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

আমাদের দেশেও এই শুরুটা করতে হবে বেসরকারি উদ্যোগেই।

ফর এক্সাম্পল, গ্রামীন ফোনের তত্ত্বাবধানে? হাসি

দুর্দান্ত এর ছবি

আকিজ, গ্রামীন, মিলিটারি ট্রাস্ট, বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রসমিতি - একটা হলেই হয়।

রানা মেহের এর ছবি

এখানে যখন দেখি একটা সাধারণ জিনিস শুধু পরিবেশন আর সংরক্ষনের গুণে বিখ্যাত হয়ে যায়। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসে দেখতে। আমাদের দেশের কথা ভেবে খারাপ লাগে শুধু।

একটু ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারলে বাংলাদেশ খুব ভালো পর্যটন কেন্দ্র হতে পারতো

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চারদিকে একটু বেড়ার ব্যবস্থা করে টিকিট কেটে দেখার ব্যবস্থা করলে মানুষ লাইন ধরে টিকিট কাটতে লেগে যাবে - এটা মানুষের সাধারণ মনস্তত্ত্ব। তাতে যে টাকা আসবে সেটা দিয়ে প্রহরীদের বেতনের পাশাপাশি সংরক্ষণের খরচটাও উঠে আসবে। খালি সেখানে খাবারের দোকান দেয়া যাবে না। একটা ছোট স্যুভেনির-এর দোকান করা যেতে পারে যেখানে তার মিনিয়েচার আর ছবি বিক্রি হবে। ছবি তুললে টাকা দিতে হবে এমনটা করা যেতে পারে। এগুলোর জন্য মাথা, ইচ্ছে আর উদ্যোগ থাকতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অদ্রোহ এর ছবি

১. পুরনো ঢাকা সফরটাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা যায়, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া"। ঘর থেকে আদপে দুপা ফেললেই অনেক কিছু দেখা হয়ে যায়, কিন্তু সেই ফুরসতটুকুও আমাদের অনেকের হয়না। নতুন ঢাকার শান-শওকত আমাদের অহর্নিশ চোখ ঠারায়, অথচ ঢাকার পুরনো অনেক জৌলুসে যে এখনো মরচে ধরতে পারেনি সেটা কজনই বা জানে।

২.ঢাকায় তো এসব আখন আকছার হচ্ছে, নিয়মনীতির (নান্দনিকতাবোধের প্রসঙ্গ তো দিল্লি দূর অস্ত) কোনো তোয়াক্কা না করেই সরকারী জমিতেও আজকাল নির্বিবাদে বহুতল ভবন রাতারাতি উঠে দাঁড়াচ্ছে। এসব দেখে বিচলিত হওয়ার দিন বোধহয় ফুরলো বলে।

৩. চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামপাড়ার সামনে সাহিত্যিক আবুল ফজলের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। আত্মীয়তাসূত্রে ছোটবেলায় ওই বাড়িতে অনেকবারই যাওয়া হয়েছে, পুরো বাড়িটাতে দারুণ একটা রুচির ছাপ ছিল, আর পুরনো বাড়ির মাতাল করা গন্ধুটুকু তো ছিলই। সেই বাড়ি আজ নানা জটিলতার খপ্পরে জবরদখল, বাইরে থেকে সেখানে এখন কোন বাড়ির অস্তিত্ব নেই বলেই ভ্রম হয়। এরকম কত স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি আমাদের চোখের সামনেই অবহেলায় পড়ে আছে, সংরক্ষণ দূরে থাক সামান্য পরিচিতিটুকুও এখন পাওয়া ভার।

লেখাটার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন পাণ্ডবদা।

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অদ্রোহ, চট্টগ্রামে এমন একটা ভ্রমণ কিন্তু আমাদের বকেয়া হয়ে রইল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

একটা জাতির পরিচয় তার কৃতি সন্তানদের প্রতি আচরণের দ্বারা এভাবে নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির নির্মাতার পরিচয় ধ্বংস করে যারা পকেট গরম করে তাদের কোন সাংস্কৃতিক পরিচয় অবশিষ্ট থাকেনা।

ঠিকই বলেছেন । দেখেশুনে মনে হয়, "সবকছু নষ্টদের দখলে যাবে..." এটাই বোধহয় নিয়তি আমাদের দেশের ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নষ্টরা সাময়িকভাবে দখল করতে পারবে হয়তো, তবে আমরা সচেতন হলে অনেক কিছুই উদ্ধার করতে পারবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

নষ্টদের সাময়িকভাবে বলে কিছু নাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার কিছুদিন আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে নষ্টদের সবসময় একসাথে থাকার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, একজন বলল 'হুক্কাহুয়া'… সবাই সমস্বরে জানতে চাইবে… 'কিয়া-হুয়া'।

অতিথি লেখক এর ছবি

কী আর বলব? দূরে বসে শুধু হা হুতাশ করি। খুব ভাল লিখেছেন। -রু

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার এখনকার চারপাশে যা আছে সেগুলো দেখে ফেলুন। তাতে আর কিছু না হোক আপনার লাভ হবে, উন্নতি হবে। অদূর ভবিষ্যতে যখন দেশে কাজ করার সুযোগ হবে তখন আপনিও এখানকার প্রেক্ষিতে নতুন এমন কিছু করে ফেলতে পারবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

পুরান ঢাকায় যতলোক কম যায় ততই ভাল। প্রকৃত সংবেদনশীল লোকের সংখ্যা কম, তাই রিস্কি। দরকারি বিষয় নিয়া লেখার জন্য ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নীড় সন্ধানী এর ছবি

দেশে সংরক্ষণাবশ্যক স্থাপনার কোন তালিকা কি সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ে আছে? যদ্দুর জানি এটা ওই মন্ত্রনালয়েরই দায়িত্ব। যদি সেরকম কোন তালিকা রাখার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে কর্তাদের মুখে দেশের ঐতিহ্য ইতিহাস বিষয়ক বড় বড় বুলি বেমানান। কারণ দেখা যাবে কর্তা যে পুরাকীর্তি আর ঐতিহ্য নিয়ে বক্তৃতা দিল, সেটায় ততদিনে মার্কেট বসে গেছে। এমনিতেই পর্যটন কর্পোরেশানের পোষ্টার ফোল্ডার দেখলে মনে হবে পাহাড়পুর আর রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু বাদে বাংলাদেশে দর্শনীয় কিছু নাই।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রণদীপম বসু এর ছবি

ঢাকার আর্মানিটোলার এই আর্মেনিয়ান চার্চটা কিন্তু এখনো সংরক্ষিত।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।