ম্যয় হুঁ খতরনাক!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২৪/১২/২০১৪ - ৫:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

একবার আমার শাশুড়ি অসুস্থ হওয়ায় দিশা আর বাবান মাসাধিককাল তাঁর কাছে ছিল। ঐ সময়টাতে টের পেয়েছি ঘোরতর সংসারী মানুষ কখনো বউবাচ্চাবিহীন অবস্থায় পড়লে তার অকূল সাগরে পড়ার মতো অনুভূতি হয়। তখন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হতো নাস্তা বানানোর দরকারটা কী! তাই না খেয়েই অফিসে চলে যেতাম। অফিস থেকে ফিরে কোন আড্ডায় যেতে, বই পড়তে, নেটে বসতে, গান শুনতে বা টিভি দেখতে ইচ্ছে করতো না। এমনকি রান্না করার বা খাবার ইচ্ছেও হতো না। তাই প্রথম চার-পাঁচ দিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে না খেয়েই সারা বাড়ি অন্ধকার করে শুয়ে পড়তাম। শুয়ে পড়লেই যে ঘুমানো যেতো তা নয়। বস্তুত ঐ মাসাধিককালে খুব কম রাতই আছে যে রাতে ঘুমাতে পেরেছি।

চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়াটা অসহ্যকর লাগলো। তখন শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখা শুরু করলাম। দেখা মানে হচ্ছে টিভি চালিয়ে দিয়ে রিমোট কনট্রোলটা হাতে নিয়ে ‘০’ নাম্বার চ্যানেল থেকে ‘১০০’ নাম্বার চ্যানেল পর্যন্ত ক্রমাগত ওঠানামা করা। মাঝে মাঝে একআধটা চ্যানেলে কয়েক মিনিটের জন্য থামা, তারপর আবার সিঁড়ি ওঠানামা করা।

২.

এই ওঠানামার মধ্যে লক্ষ করলাম বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোতে সৃজনশীল চিন্তার নির্মাতা, পরিচালক, প্রযোজকের অভাব আছে। তাই বাংলা চ্যানেলগুলো দেখা মোটামুটি স্নায়ুচাপ সহ্য করার মতো ব্যাপার। যা একটু দেখা যায় সেটা হচ্ছে সংবাদ। তাও দিনে একবার দেখলেই চলে। কারণ, সারা দিনে দফায় দফায় সম্প্রচারিত খবরগুলো বিশেষ হেরফের ছাড়া মোটামুটি এক, সেখানে ঘটনার বিশেষ পরিবর্তনের কথা জানা যায় না। এক কালে প্রায়ই মোবাইল ফোনের নিউজ সার্ভিসগুলো শুনতাম। তারপর এক সময় লক্ষ করলাম সেখানে সাত দিন আগের খবরও শোনানো হচ্ছে। আর খবর চলাকালে লাইন কেটে যাওয়ার নিয়মিত ব্যাপারটা তো ছিলই। অর্থের বিনিময়ে সেবা দেবার নামে এমন নির্লজ্জ প্রতারণার ব্যাপার মোবাইল ফোনগুলোতে হরহামেশা হয়ে থাকে বলে এসব নিয়ে আমরা বিশেষ কোন কথা বলি না। রেডিও, টিভি, ছাপানো পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকারা মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল যে তারা কোম্পানিগুলোর প্রতারণা নিয়ে কোন কথা বলার সাহস পায় না। তাছাড়া ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসগুলো সাধারণত তৃতীয় পক্ষ নামক নামগোত্রহীণ কোম্পানিগুলোকে দিয়ে করানো হয় বলে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো ঐ সব সার্ভিসের কোন দায় বহন করে না।

বাংলা মুভি চ্যানেলগুলোতে এমনসব চলচ্চিত্র দেখায় যেগুলো দেখলে নিম্নমানের প্রিন্টের জন্য চোখ, বাজে শব্দ ও গানের জন্য কান আর ভয়ঙ্কর সব গল্পের জন্য মাথার ওপর চাপ পড়ে। বাংলা মিউজিক চ্যানেলগুলো দেখলে মনে হয় কারো ‘গায়ে হলুদ’-এর অনুষ্ঠানে এসেছি। সেখানকার বেশিরভাগ গানের কথা, সুর আর চিত্রায়ণ ঐ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গাওয়া গানের মানের। অথচ আমাদের দেশে বহু ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, প্রতি বছর প্রচুর ভালো গান বের হয়। তাছাড়া ভালো বাংলা গানের ভাণ্ডার যে বিশাল সেগুলোর চিত্রায়ণ করে দেখালে টানা পাঁচ বছরেও একটা গান রিপিট করতে হবে না। তো সম্পদ থাকলেই তো হয় না, সেটা নেড়েচেড়ে খাবার মতো ঘিলু থাকতে হয়, নয়তো এমন ভিক্ষা করে বাঁচতে হয়।

৩.

ভারতীয় হিন্দী চ্যানেলগুলোর অবস্থা যে বাংলাদেশী বাংলা চ্যানেলগুলোর চেয়ে খুব ভালো তা নয়। সেখানে কিছু চ্যানেল সারাদিন ধরে সিরিয়াল আর রিয়ালিটি শো দেখায়, কিছু চ্যানেল সারা দিন ধরে ফিল্মী গান আর কিছু চ্যানেল সারা দিন ধরে হিন্দী চলচ্চিত্র দেখায়। হিন্দী মিউজিক চ্যানেল দেখলে এ’কথা বোঝা খুব কঠিন যে ভারতে ফিল্মী গানের বাইরে আর কোন গান আছে, বা ভারতীয়রা ফিল্মী গানের বাইরে অন্য কোন গান শোনেন। এদিক দিয়ে হিন্দী মুভি চ্যানেলগুলো বরং কিছুটা ভালো। তারা সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া মধ্য-সত্তর দশক থেকে শুরু করে চলতি বছরের বাণিজ্যিক মুভিগুলো দেখায়। মাঝে মাঝে কোন নির্মাতা, অভিনেতা বা থিমকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে মুভি দেখায়। তাতে বাণিজ্যিক ধারার বাইরের কিছু মুভিও দেখানো হয়। ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলো হিন্দী চ্যানেলগুলোর প্রতিরূপ মাত্র। তাই ওগুলো নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই।

যারা হিন্দী বা বাংলা সিরিয়ালগুলোর কাহিনী লিখে থাকেন, নির্মাণ করে থাকেন এবং সেগুলোতে অভিনয় করে থাকেন তাদের মেধা-যোগ্যতার খোঁজ করার আগে তাদের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষা করে দেখার দরকার আছে। এই আবর্জনা কেমন করে দিনের পর দিন নির্মিত হচ্ছে এবং লোকজন গিলে যাচ্ছে সেটা সমাজবিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে দেখা উচিত। একটা সাধারণ ধারণা হচ্ছে, সিরিয়ালগুলোর সিংহভাগ দর্শক নারী। এটা ধারণা করা যায় সিরিয়ালগুলোর উপস্থাপনা পদ্ধতি থেকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সামান্য সব বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহ, দাম্পত্য সম্পর্কে অবিশ্বাস, বিবাহবহির্ভূত শারিরীক-মানসিক সম্পর্ক, অসমবয়সী সম্পর্ক, একে অন্যের সম্পদ দখল — মোটামুটি এগুলো হচ্ছে সিরিয়ালগুলোর মূল উপজীব্য। স্পষ্টতই সমাজ-সংসারের মূল সমস্যাগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা, ভোগ্যপণ্যনির্ভর জীবনযাত্রার দিকে মানুষকে প্রলুদ্ধ করা, পণ্যের বিজ্ঞাপন — এমন সব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন আকার-আকৃতির সিরিয়াল আবিষ্কার করা হয়েছে।

বাজার অর্থনীতির দুনিয়াতে মানুষ বাজার ব্যবস্থার শোষণপ্রক্রিয়া, লুটপাট ও অমানবিকতার ব্যাপারে যেন সোচ্চার হতে না পারে এ’জন্য নিয়মিতভাবে নানা প্রকার ইনসেনটিভ ও উত্তেজনা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। রিয়ালিটি শোগুলো হচ্ছে অমন ইনসেনটিভ আর উত্তেজনা সরবরাহের জনপ্রিয় উপায়। এগুলোতে মানুষকে এমন ধারণা দেয়া হয় যে, এখানে অংশ নিয়ে যে কেউ রাতারাতি ‘সুপারস্টার’ বনে যেতে পারে। এবং কোন বিষয়ে ভালো করার জন্য নিয়মমাফিক অধ্যয়ণ, নিয়মিত চর্চ্চা, গবেষণা, পরিশ্রম, চিন্তাভাবনা ইত্যাদির প্রয়োজন নেই। এখানে বানোয়াট সুপারস্টারদের অর্থমূল্যের মানে সামান্য পুরস্কার দেয়া হয়, আরো পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় (যেগুলো পালিত হয়েছে কিনা তা কখনো জানা যায় না) এবং পরবর্তী সিজন আসতে না আসতে তাদের বিস্মৃতির অতলে পাঠানো হয়। নির্বোধ দর্শকেরা তাদের জন্য নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে মোবাইলে ভোট দেয়, সময়-কাজ নষ্ট করে টিভির সামনে বসে থেকে হাততালি দেয় এবং ভাবে একটা জুতমতো সুযোগ পেলে সে নিজেও ছোটখাটো একটা স্টার হয়ে যেতে পারে। এই ফাঁকে স্পনসরদের পণ্য তার জীবনযাপনে ঢুকে পড়ে এবং তাদের অন্যায়গুলো তার মগজের অ্যান্টেনায় আর ধরা পড়ে না।

৪.

মূল গল্পে ফেরত যাই। বাংলা, হিন্দী আর স্বল্পসংখ্যক ইংলিশ চ্যানেলে দৌড়াদৌড়ি করে হয়রান হয়ে আমি জানি না এমনসব ভাষার চ্যানেলগুলো দেখতে থাকি। কিন্তু এর মধ্যে উর্দ্দু চ্যানেলগুলো পাকিস্তানী বলে এড়িয়ে যাই। বাংলাদেশে এই চ্যানেলগুলো দেখায় কেন? আচ্ছা, পাকিস্তানে কি কোন বাংলাদেশী চ্যানেল দেখানো হয়? দর্শক থাকুক আর না থাকুক, বাংলাদেশী কেবল অপারেটরদের কোন্‌ ঠ্যাকা আছে যে তারা পাকিস্তানী চ্যানেলগুলো দেখায়?

চীনা, কোরিয়ান, জাপানি, জার্মান ভাষার চ্যানেলগুলো দিন দুই দেখে জুত না পেয়ে ক্ষ্যান্ত দেই। খেয়াল করে দেখলাম, এক কালে রুশ, ইতালিয় আর স্পেনিয় ভাষার যে চ্যানেলগুলো ছিল এখন সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

আমার না-জানা ভাষার চ্যানেলগুলোর মধ্যে একটা চ্যানেলে দেখি নামের জায়গায় একটা রশ্মিওয়ালা সূর্যের ছবির সাথে ইংলিশে টিভি লেখা। মনে মনে তাকে ‘সান টিভি’ বলে ডাকা শুরু করলাম। কথাবার্তা শুনে আর লোকজনদের দেখে বুঝলাম ভাষাটি কোন দ্রাবিড় ভাষা। টিভিতে দেখানো নানা লেখা দেখে একসময় বুঝলাম ভাষাটা তামিল। আমি তামিল ভাষা জানি না। কিন্তু ছাপানো হরফে লেখা দেখে তামিল, তেলুগু, মালইয়ালম আর কানাড়াকে বেশিরভাগ সময়ে আলাদা করতে পারি। যেমন ছাপানো হরফে লেখা দেখে ম্যান্ডারিন, ক্যান্টোনিজ, কোরিয় আর জাপানি ভাষা আলাদা করতে পারি।

কী মনে করে যেন ঐ তামিল সান টিভি টানা দেখা শুরু করলাম। এক ফোঁটা ভাষা বুঝি না, লেখা পড়তে পারি না, তবু জোম্বির মতো দেখে যাই। অন্য অনুষ্ঠান বিশেষ না বুঝলেও কোন চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল দেখালে তার কাহিনী কিছুটা বুঝতে পারি। এভাবে কয়েকটা তামিল চলচ্চিত্র দেখা হয়ে যায়। দক্ষিণী বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রগুলো কেমন হয় সেটা সবাই জানেন। সেখানে নায়ক অতি সচ্চরিত্রবান এক সুপারহিরো (প্রায়ই তারা পুলিশ অফিসার হয়ে থাকে); নায়িকা সুন্দরী, লুতুপুতুটাইপ, তার একমাত্র কাজ নায়ককে সিডিউস করা; ভিলেন দেখতে ভীতিকর এবং সর্বদোষযুক্ত। সেখানে ফর্মুলাবদ্ধ গল্প, ভয়ঙ্কর ভায়োলেন্স, উদ্ভট সৃজনশীল চিন্তার মারামারি বা অ্যাকশান, খুব মেলোডিয়াস গান এবং অদরকারী যৌনতা থাকে। কাহিনীতে সর্বদা ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ বা ডেভিড-গোলিয়াথের লড়াই থাকে এবং পরিণতিতে ন্যায়ের জয় ও অন্যায়ের বিনাশ থাকে। সুতরাং সান টিভিতে তামিল মুভি বুঝতে আমার বিশেষ কষ্ট হয় না।

৫.

কিছু দিনের মধ্যে আবিষ্কার করলাম হিন্দী মুভি চ্যানেলগুলো হরহামেশা দক্ষিণী চলচ্চিত্রগুলো হিন্দীতে ডাব্‌ করে দেখাচ্ছে। হিন্দীতে এই ভাষান্তরের সময় চলচ্চিত্রগুলোর মূল নাম পালটে দেয়া হয়। এই পালটে দেয়া নামগুলোতে একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন আছে। যেমন, ঔর এক ভিনাশক, ম্যয় হুঁ খতরনাক, আজ কা গুন্ডারাজ, আরিয়া এক দিওয়ানা, পুলিশওয়ালে দাবাং ইত্যাদি। তো চলচ্চিত্র শুরু হবার আগেই তার নাম দেখে চিনতে শুরু করলাম যে এটা হিন্দীতে ডাব্‌ করা দক্ষিণী চলচ্চিত্র কিনা।

অনেকদিন ধরেই হিন্দী বা ভারতীয় বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোর একটা বড় অংশ দক্ষিণী চলচ্চিত্রের সরাসরি প্রতিলিপি বা পুনর্নির্মাণ বা অনুপ্রাণিত। আর এখন দক্ষিণী চলচ্চিত্রগুলো সরাসরি হিন্দী-বাংলা-ইংলিশে ডাব করা হচ্ছে। এমন ডাব করা চলচ্চিত্রের ডিস্ক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, টেলিভিশন চ্যানেলেও দেখাচ্ছে। ফলে দর্শকরা মূল চলচ্চিত্রটাই দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এই ব্যাপারটা হিন্দী বা বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের বাণিজ্যিক ধারার জন্য সুখবর নয়।

দক্ষিণী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে নায়কের চরিত্রগুলো অতিমানবীয় শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। ইদানীং অতিমানবীয় শক্তি ও ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রসমৃদ্ধ নায়িকা এবং নায়িকা প্রধান চলচ্চিত্রও নির্মিত হচ্ছে। এই চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে। এমন একজন নায়িকা হচ্ছেন মালাশ্রী। তার ইদানীংকালে অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর কোনটা দেখলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। খোদ তার নামে নাকি চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছে। হিন্দী আর বাংলা চলচ্চিত্রে এই ধারার এক-আধটা চলচ্চিত্র থাকলেও এখনও এটা ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এই ধারাটার নাম কী হতে পারে?

হিন্দীতে ডাব্‌ করা বা ইংলিশে সাবটাইটেল করা দক্ষিণী চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে মনে একটা প্রশ্ন জাগে — মূলত নিরামিশাষী দক্ষিণ ভারতীয়দের নির্মিত চলচ্চিত্র এতো বেশি এবং এতো ভয়ঙ্কর রকমের ভায়োলেন্সে পূর্ণ কেনো? আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দক্ষিণ ভারতের অবস্থা উত্তর বা পশ্চিম ভারতের চেয়ে ভালো। তার পরেও তাদের মাথায় কেবল ভয়ঙ্কর ও এমন উদ্ভট রকমের ভায়োলেন্সের গল্প খেলা করে কেন?

৬.

মোটামুটি সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর আগে আর্যরা ভারতে প্রবেশের পর থেকে আজ অবধি অনার্যদের ওপর আর্যদের হামলা-হুমকি-ধমকি-শোষণ-শাসন চলছে। অনার্যদের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহন করলেও আর্যরা সেগুলো নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। কোন বিষয়ে অনার্যদের শ্রেষ্ঠত্ব না মেনে নেয়া আর্যরা তাদের রচনাতে, কথায়, অভিনয়ে অনার্যদের অসভ্য, অশিক্ষিত, মনুষ্যেতর বলে চিত্রিত করে গেছে। আর্যদের রচিত গল্পকথায় অনার্যরা রাক্ষস, দানব, অসুর, বানর, হনুমান, নিষাদ। একটা নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীর দৃশ্যমান-অদৃশ্য সব সম্পদ-পরিচয় যে এভাবে লুণ্ঠনের শিকার হতে পারে সে ভাবনাটা পীড়াদায়ক। তাই বঞ্চিত নিপীড়িত অনার্যদের কল্পনায় এক এক জন অতিমানবের উপস্থিতি স্বাভাবিক। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দক্ষিণ ভারতের লোক সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাই মুরুগান, আয়াপ্পান, থিরুমলের মতো সুপারহিরো এবং মীনাচ্চী, কান্নাগী, কোত্রাভাইয়ের মতো সুপারহিরোইনের উপস্থিতি দেখা যায়। অতিমানবের উপস্থিতিকে যৌক্তিক করে তোলার জন্য দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে সুপারহিরো আর ব্যাপক ভায়োলেন্সের আধিক্য স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, তাই বলে এমন উদ্ভট-হাস্যকর রকমের?

শিল্পসাহিত্যকর্মে কল্পনার সাথে বাস্তবতার পার্থক্যরেখা যখন মুছে যায় বা একে অন্যের ভেতরে যাওয়া আসা করে তখন তাকে আমরা magic realism বা জাদু বাস্তবতা বলে অভিহিত করি। কিন্তু সেখানে পাঠক-দর্শক সাধারণ বাস্তবতাকে বিস্মৃত হয় না। আলেখ্বো কার্পেন্তিয়ের যাকে বলেছেন lo real maravilloso তার বাংলা আমরা কী করতে পারি? ‘চমকপ্রদ বাস্তবতা’ নাকি ‘দুর্দান্ত বাস্তবতা’! lo real maravilloso নিশ্চিতভাবে তার লাতিন আমেরিকান চরিত্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য magic realism-এর সাথে পার্থক্যপূর্ণ। এই বিবেচনায় দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই ভাষাটিকে আমরা সম্ভবত lo real maravilloso sur de India বলতে পারি। এ’জন্য দক্ষিণ ভারতীয় চমকপ্রদ বাস্তবতা আমাদের মতো বাইরের দুনিয়ার মানুষের চোখে উদ্ভট বলে মনে হয়।

৭.

দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্রের ভাষায় এই চমকপ্রদ বাস্তবতার উপস্থিতির মূলটি স্বীকার করে নিলেও তার ব্যাপকত্ব ও বহুল উপস্থিতিতে একটু ভ্রু কোঁচকানো যেতে পারে। কপালের ভাঁজ আরো গভীর হয় যখন আমরা দেখতে পাই চলচ্চিত্রে ঐশ্বরিক চরিত্রে ক্রমাগত আবির্ভাবের দরুণ মারুধুর গোপালন রামাচন্দ্রন ওরফে এমজিআর অথবা নন্দমুরি তারকা রামা রাও ওরফে এনটিআর বাস্তব জীবনেও দেবতাতুল্য বলে বিবেচিত হন। ফলে তারা রাজনৈতিক জীবনে যেমন ধারাবাহিক জনপ্রিয়তা লাভ করেন, তেমন তাদের প্রয়াণে আত্মহত্যা করার মতো ভক্তেরও অভাব হয় না। একইভাবে চলচ্চিত্র থেকে অর্জিত দেবত্বে জয়ললিতা জয়রাম ওরফে আম্মা রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতি করে কারাদণ্ডাদেশ পেলে ভক্তরা আত্মহত্যা করে। এমনকি চলচ্চিত্রে শিবাজী রাও গায়কোয়াড় ওরফে রজনীকান্তের চরিত্র ব্যাপক মার খেলেও নাকি কোন রক্তপাত দেখানো যাবে না। কারণ, রজনীকান্ত নাকি দেবতাতুল্য!

চমকপ্রদ বাস্তবতার দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থের বার্ষিক লগ্নি, তার পৃথিবীজোড়া প্রসার তৈরি করার ব্যাপারটিতে নানামুখী প্রয়াস আমার কাছে গভীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ’সব চলচ্চিত্র সমাজে ভায়োলেন্স বাড়িয়ে দিতে পারে। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না। বরং এর ঠিক উলটোটা ঘটে। প্রতি নিয়ত নানা ক্ষমতাবান ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের হাতে বঞ্চনা, অত্যাচার, শোষণ ও লুণ্ঠনের শিকার সাধারণ মানুষ যেন দলগতভাবে ফুঁসে না ওঠে তার জন্য অসীম ক্ষমতাধর একক ব্যক্তির ধারণা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সংঘশক্তির চেষ্টা না করে একক ক্ষমতাধরের সাফল্য দেখালে দলগত বিদ্রোহের ধারণায় সন্দেহের বীজ বোনা যায়। এই চমকপ্রদ বাস্তবতায় বুঁদ মানুষ অত্যাচারিত বা বঞ্চিত হলে মনে মনে নিজেকে রূপালী পর্দার নাগার্জুন, সুরিয়া, মহেশ বাবু বা মালাশ্রীর মতো ভাববে। মনে মনে দুরাচার ও তার দলকে পিটিয়ে তুলোধুনো করবে। এবং বাস্তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে না। জনতার শক্তিকে নিবীর্য ও নিস্তেজ করার ক্ষেত্রে চমকপ্রদ বাস্তবতার দক্ষিণ ভারতীয় চলচিত্রের শক্তি রিয়ালিটি শো, টিভি সিরিয়াল থেকে অনেক বেশি। এটা ঠিক ঠিক জায়গাটিতে আঘাত করতে পারে বলে অধিক কার্যকর।

৮.

গোষ্ঠীতান্ত্রিক দুনিয়ায় দুর্বল গোষ্ঠীর সদস্য হলে শক্তিশালী গোষ্ঠীর হাতে প্রতিনিয়ত মার খাওয়াটা স্বাভাবিক। যখন আমরা দেখি,

শিশুখাদ্যে ভেজালকারীদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না
ঔষধে ভেজাল দিয়ে হাজারো মানুষকে মেরে ফেললেও কারো কিছু হয় না
ভবন ধ্বসে হাজারো মানুষ মরলেও কারো বিচার হয় না
আগুনে পুড়িয়ে বা জবাই করে শ্রমিক মারলেও অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে
গাড়ি চালিয়ে পঞ্চাশ জন মারলেও হত্যা মামলা হয় না
নদী, জলাভূমি, বাতাস দূষিত করে অঞ্চল ধ্বংস করলেও কারো দৃকপাত নেই
বন উজাড় করে ফেললেও সবাই চুপ করে থাকে
জনগণের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করলেও লুঠেরার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হতে কোথাও বাধে না
একের পর এক হত্যাকাণ্ড হতে থাকে কিন্তু হত্যাকারী ধরা পড়ে না
ধর্ষণে কেউ শতক পূর্ণ করলেও তার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সুশীলদের অভাব হয় না

তখন অক্ষম আমরাও মনে মনে এক একজন সুপারহিরো হয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠিকে তুলোধুনো করি। অভিকর্ষ বলকে কাচকলা দেখিয়ে আমরা উড়ে উড়ে এক একজনকে শায়েস্তা করতে থাকি। হাজারো জনের সম্মিলিত আক্রমণ বা ব্রাশ ফায়ারের মুখে আমরা অক্ষত থেকে বেধড়ক পিটাপিটি চালাতে থাকি। সংঘশক্তির কথা আমাদের মনে থাকে না। সম্মিলিত প্রতিরোধের কথা ভুলে যাই। আর মনে মনে এক একজন ভাবি, ম্যয় হুঁ খতরনাক!


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

হাততালি

বেশ ইন্টেরেস্টিং ব্যাখা আর বিশ্লেষণ। পরে কিছু পয়েন্টে আলোচনা করতে আসবো।

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কী বলবে বললে কিন্তু বললেনা!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অভিমন্যু . এর ছবি

ডাবিং এর অদ্ভুত নামের আছর এই দেশেও পড়েছে , শুনলাম ' দেশা দ্যা লিডার ' নামে একটা বাংলা ছিঃনেমা রিলিজ হচ্ছে। কথা হচ্ছে দেশী,দেশজ,দেশীয় ইত্যাদি শব্দ শুনেছি কিন্তু দেশা বলে কি আদৌ বাংলা কোন শব্দ আছে?

________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের রিমেক হচ্ছে অনেক বছর ধরে, কিন্তু সেখানে নামের এমন দুর্গতি হয়নি। আসলে মেধাবী মানুষের অভাব অন্য কিছু দিয়ে পূরণ হবার নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। বিশ্লেষণটা চমৎকার। আমার কেনো যেনো তামিল এই মাইরপিট ব্যাপক লাগে, এদের চিত্রায়নের ভঙ্গি, ক্যামেরার এঙ্গেল, প্যানিং আর স্পেশাল ইফেক্ট এর কারনে। তবে হ্যাঁ, দিন শেষে আমরা সবাই কিন্তু মনে মনে 'অয়ান ম্যান আর্মি' হতেই চাইছি এখন।

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হ্যাঁ, টেকনিক্যাল দিক দিয়ে তেলুগু মুভি অনেক উন্নতি করেছে।

পরিকল্পনাটা যাদের, তারা এটাই চায় - দিন শেষে সবাই নিজেকে 'ওয়ান ম্যান আর্মি' ভাবুক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

পুরোই একমত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

বিশ্লেষণ ভালো লেগেছে।

১) দেশে আসার পরে বিভিন্ন সময় জি বাংলার সিরিয়াল আর কিছু হিন্দী সিরিয়ালের ওপর চোখ আটকিয়েছি। মাঝখানে দেশের বাইরে থাকায় এই জিনিসটা একেবারে আলোচনার সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। আমি যাবার আগে একটা হিন্দী সিরিয়াল হতো, সেই সিরিয়াল এখনও বীরদর্পে চলছে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার মতো সেটা হলো এই ধরণের সিরিয়ালগুলোর কোনো বিবর্তন নেই, বছরের বপর বছর একই ভাবে চলে আসছে।

২) একাই একশ বা ম্যা হু খতরনাক টাইপের মুভি আর হলিউডের জেমস বন্ড, জ্যাকি চ্যান বা বলিউডের মূলধারার নায়ক প্রধান অধিকাংশ ছবিও কিন্তু সেই একই ব্যক্তিগত প্রতিরোধ আর অসম্ভব কল্পনার ক্ষেত্রে মাত্রার পার্থ্যক্য ছাড়া আর খুব বেশি পার্থক্য নেই। কিন্তু হলিউড, বলিউডে এই রকম অতিমানবীয় নায়কপ্রধাণ জাদুবাস্তবতার কাছাকাছি সিনেমা ছাড়াও সিনেমা তৈরি হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে এই ধরণের সিনেমা ছাড়া আর অন্য ধরণের ছবি তৈরির হার সম্ভবত অনেক অনেক কম (যদিও দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা জগৎ নিয়ে আমার দেখা বা জানার অংশ খুব কম)।

এটা গেলো পর্যবেক্ষণ।

আমার প্রশ্ন হলো এই যে ট্রেন্ড, এটা কি সচেতনভাবে তৈরি করা? নাকি বিভিন্ন জিনিসের মিথস্ক্রিয়ার ফলে এক এক এলাকায় রুচি সংস্কৃতি ইত্যাদি ভেদে এক এক ধরণের ট্রেন্ড তৈরি হয়ে গেছে? কলকাতার যে সিরিয়ালগুলো হয় সেগুলো মোটামুটিভাবে তার আরও কিছুদিন আগে শুরু হওয়া হিন্দী সিরিয়ালের গঠনপ্রণালী অনুসরণ করে বানানো হয়। কন্টেন্ট এবং মানের দিক দিয়েও তারা কাছাকাছি। এটা সত্য যে এই ধরণের সিরিয়ালগুলোতে অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের মত সমাজের অনেক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একটা কাল্পনিক বাস্তবতা তৈরি করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি সচেতন প্রয়াস? নাকি ভোক্তাকে ভোক্তার রুচির সাথে মিলিয়ে বিনা পরিশ্রমে পণ্য পরিবেশন?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। সিরিয়ালগুলোর মধ্যেও বিবর্তন ঘটেছে সেটা দশ বছর আগে আর পরের সিরিয়াল মিলালে বুঝবে।

২। বিদ্যমান ব্যবস্থা দুনিয়ার যে কোন জায়গায়ই বিদ্রোহ বা বিপ্লবের সম্ভাবনাকে রুখতে চায়। তাই যে কোন দেশে 'ম্যয় হুঁ খতরনাক' টাইপ মুভি দেখতে পাওয়াটা স্বাভাবিক।

প্রয়াসটা সচেতন। ভোক্তার কালেকটিভ রুচিটা ক্রিয়েটেড। ব্যক্তিগত রুচি ভিন্ন ব্যাপার। তবে কালেকটিভ রুচির প্যাটার্ন ব্যক্তিগত রুচির প্যাটার্নকে আস্তে আস্তে পালটে দেয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

(১) সিরিয়ালের দর্শক না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষক বলা যেতে পারে আমাকে, তাই সম্ভবত ধরতে পারিনি বিবর্তন। দশ বছর আগের সিরিয়াল এখন ইউটিউব ঘেঁটে বের করি দেঁতো হাসি

(২) পৃথিবীতে এখন মানুষের বিপ্লব করার মানসিকিতা সম্ভবত খুব ভালোভাবেই নষ্ট করে দেয়া হয়ছে, সেটা আমাদের বাম আর আমরা আরামপ্রিয় মধ্যবিত্তদের দেখলেই টের পাই।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

নীড় সন্ধানী এর ছবি

যারা হিন্দী বা বাংলা সিরিয়ালগুলোর কাহিনী লিখে থাকেন, নির্মাণ করে থাকেন এবং সেগুলোতে অভিনয় করে থাকেন তাদের মেধা-যোগ্যতার খোঁজ করার আগে তাদের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষা করে দেখার দরকার আছে। এই আবর্জনা কেমন করে দিনের পর দিন নির্মিত হচ্ছে এবং লোকজন গিলে যাচ্ছে সেটা সমাজবিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে দেখা উচিত।

তবে এই আবর্জনা যারা গিলছে তাদের মনস্তত্বটা আমাকে অবাক করে বেশী। শুধু নারী না, কতিপয় পুরুষও এতে ভয়ানক আসক্ত হয়ে পড়তে দেখেছি। তবে আর যাই হোক, এতে একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝেছি যে অধিকাংশ বাঙালীর আত্মা কিনে ফেলতে খুব বেশী কষ্ট করতে হয় না, বেশী পয়সাও লাগে না। 'অধিকাংশ' শব্দটা লিখতে হলো কেননা, আত্মীয় পরিচিত প্রতিবেশী মহলে আমি নিজেকে সংখ্যালঘু অবস্থানে আবিষ্কার করেছি এই আবর্জনা পছন্দ সংস্কৃতিতে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নির্মাতাদের লক্ষ্য শুধু নারীরা নয়, নারী-পুরুষ উভয়েই। তাই পুরুষদের আসক্তি অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটু বুদ্ধি খাটাতে পারলে আত্মা কেনাবেচা বিশেষ কঠিন কিছু নয়, বিনিপয়সায়ই কেনা যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাসুদ সজীব এর ছবি

যারা হিন্দী বা বাংলা সিরিয়ালগুলোর কাহিনী লিখে থাকেন, নির্মাণ করে থাকেন এবং সেগুলোতে অভিনয় করে থাকেন তাদের মেধা-যোগ্যতার খোঁজ করার আগে তাদের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষা করে দেখার দরকার আছে। এই আবর্জনা কেমন করে দিনের পর দিন নির্মিত হচ্ছে এবং লোকজন গিলে যাচ্ছে সেটা সমাজবিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা করে দেখা উচিত।

সহমত, এরপাশাপাশি এগুলোর অন্ধ দর্শকদের মনস্তাত্ত্বিক গবেষনা প্রয়োজন। কেন বাংলাদেশের বেশিভাগ গৃহিণী ক্ষেত্রবিশেষে গৃহকর্তাও এই অসুস্থ-অবাস্তব কাহিনীর জন্যে এত ব্যাকুল হয়ে উঠলো? এটা কি আমাদের সমাজের মানুষের মানসিক বিকাশের অসাড়তা প্রমাণ করে না?

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। একটু খোঁজ নিলে এর দুনিয়াব্যাপী বিশাল আগ্রাসন টের পাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবজান্তা এর ছবি

দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা কিন্তু অনেকটাই নিরবে বাংলাদেশের একশ্রেনীর দর্শকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। আমি কয়েক বছর আগেও জানতাম না যে, আমাদের দেশে এতো লোক মনোযোগের সাথে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা দেখে, খোঁজ রাখে। আমি অবশ্য শুনেছি, দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবটাই যে এমন গাঁজাখুরি, তেমন না। বেশ কিছু ভালো সিনেমাও সেখানে তৈরি হচ্ছে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক মনে হয়। বিচ্ছিন্ন হলেও, কিছু ভালো কাজ তো সব ইন্ডাস্ট্রিতেই হয়- এমনকি আমাদের দেশেও।

আপনার বিশ্লেষণটা ইন্টারেস্টিং। কিছুটা মিল পেলাম, অনেকদিন আগে পড়া একটা বিশ্লেষণের সাথে, যেখানে বলা হয়েছিলো, বাংলাদেশি সিনেমাতে অতিকায় (কিংবা অন্ততপক্ষে 'সুস্বাস্থ্যের' অধিকারি) নায়িকাদের কদরের একটা বড় কারণ, শীর্ণকায় মূল দর্শক শ্রেণি, যারা দারিদ্র্যহেতু অপুষ্টিতে ভুগছে। সত্যাসত্য জানি না, তবে বিশ্লেষণটা চমকপ্রদ মনে হয়েছিলো। আপনার বিশ্লেষণ অবশ্য সেই বিচারে আরো বেশি ঠিক মনে হয়, সত্যঘেঁষা মনে হয়। বাস্তবিক অর্থে, এটাই স্বাভাবিক। যখন কোনো কিছু জনপ্রিয়তা পায়, তা এজন্যেই পায় যে, সেটি কোনো না কোনোভাবে আমাদেরকে স্পর্শ করে।

ব্যাপারটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই দাবির সঙ্গে আমি জোরালোভাবে একমত না (কিংবা নিশ্চিত না বলা ভালো), তবে চলচ্চিত্রের এই ঘরানার জনপ্রিয়তার পিছনে মনস্তত্ব যে এমন কিছু, সেটা আমারও মনে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যদি দেশের ফুটপাথে হাঁটার সুযোগ পেতে তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের বইপড়া, গানশোনা আর মুভিদেখার হ্যাবিটে পরিবর্তনটা লক্ষ করতে পারতে। নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ভারতে ভালো মুভি তৈরি হয়, এবং প্রতি বছরই।

বাংলাদেশী মোটা নায়িকাদের ব্যাখ্যাটা আমরা সবাই শুনেছি। তবে সেটা আমার কাছে কখনোই গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি। এফডিসি'র পৃথুলারা যখন এদেশের পর্দা কাঁপাচ্ছে টলিগঞ্জের অপেক্ষাকৃত চিকনিচামেলিরা কিন্তু তখনই এদেশের দর্শকদের মনজুড়ে ছিল। মুম্বাইয়ের কথা আর নাইবা বললাম। ব্যাখ্যাকারীদের সবসময়ই প্রবণতা ছিল তাদের কনভিনিয়েন্ট জিনিস আমজনতাকে গেলানো। তো প্রযুক্তির কল্যাণে আমজনতা যখন সুযোগ পেলো তখন তারা ঐ জোর করে গেলানো বস্তুসব উগড়ে দিয়েছে।

দ্বিমত তো পোষণ করতেই পারো। আরেকটু ভাবো, হয়তো এতক্ষণ ধরে আমাদের চোখে না পড়া কোন পয়েন্ট বের করে ফেলতে পারবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ধ্রুব আলম এর ছবি

বিশ্লেষণগুলো ভালো লাগলো। অনেক চিন্তার খোরাক দিলেন চিন্তিত

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এভাবে ভাবি নি আগে। তবে, হিন্দি-বাংলা সিনেমায় অবশ্য আলৌকিক জিনিস বা কেরামতি বেশ পরিমাণে দেখা যেত এক সময়।

হিন্দি সিনেমায় অনেকবার দেখেছি দেবতা দেবমূর্তি থেকে বের হয়ে আসেন বা দৈববাণী দেন কিংবা প্রার্থনার বিপরীতে খুব দ্রুতই আশা পূরণ করেন।

বাংলা সিনেমায় নায়িকা ব‌হুবার পীরের মাজারে গিয়ে দোয়া-টোয়া করে নায়ককে সুস্থ্য করে ফেলে, দরবেশের তাবিজ-টাবিজ বা দোয়া নিয়ে কাহিনী এগিয়েছে এমন সিনেমাও এক সময় তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ মনে পড়ে, কোন একটা সিনেমায় ('গতি' বা 'খোঁজ') অনন্ত জলিলের প্রেয়সী বর্ষাকে বুলেটপ্রুফ কাঁচের ঘরে আটকা রাখা হয়েছে। সেটা খোলার জন্য আলমগীরের রেটিনা স্ক্যান করা দরকার, কিন্তু আলমগীর আত্মহত্যা করায় বুলেটপ্রুফ কাঁচের ঘর খোলার আর কোন ব্যবস্থা না পেয়ে, অনন্ত জলিল প্রার্থনা শুরু করেন এবং তাতে আশানুরূপ ফল হয় -বর্ষা মুক্তি পান।
(সিনেমার পরে অবশ্য অনেকক্ষণ ভেবেছি, এত ঝামেলা করে মারামারি, খুনোখুনি না করে শুরুতেই এই পন্থায় গেলে সমস্যা কী ছিল? চিন্তিত )

শুভেচ্ছা

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লিমিটেড পরিস্থিতিতে দৈবিক বা ঐশ্বরিক শক্তির ব্যবহার মোটামুটি সারা দুনিয়ায় আছে। কেবল এর বহিঃপ্রকাশটা ভিন্ন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

কি কমু! এই তামিল মিডিয়া আমারেও ছাড়েনাই। এইখানে দ্যাখো

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।