খটকা: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শেহাব এর ছবি
লিখেছেন শেহাব (তারিখ: শুক্র, ২৬/০৬/২০১৫ - ১২:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খ্যাতিমান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি চোখে পড়ল। যেহেতু ওনার লেখা ভাল লাগত তাই পড়ে ফেললাম। মোটামুটি অনেক কিছুই ভাল লেগেছে। কিন্তু, পড়ার সময় সামান্য কিছু খটকা লাগায় এই লেখা। এটি আলোকিত বাংলাদেশে ২০১৫ সালের ২৩শে জুন প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তৈমুর রেজা। যেসব প্রশ্ন-উত্তরে খটকা লেগেছে সেগুলো আমি উদ্ধৃত করে তার নিচে আমার মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছি।

লেখার লিংক

প্রথম খটকা

প্রশ্ন : আমি ঠিক যাত্রা শুরুর কথা বলি নাই। ওইটা নিয়ে আসলে তর্কও নাই। আমার প্রশ্নটা ছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন অবাঙালিদের জন্য একটি নিপীড়নযন্ত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

সিরাজুল : নিপীড়ন জিনিসটা আসলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই দিক থেকে দেখতে হবে। এটা একটা ভুল কনসেপ্ট তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশ একটা জাতিরাষ্ট্র। বাংলাদেশ কোনো জাতিরাষ্ট্র নয়। আজকের পৃথিবীতে জাতিরাষ্ট্র বলে কোনো রাষ্ট্র নেই। এখানে একটা জাতি প্রধান আছে বটে, কিন্তু অন্য জাতিগোষ্ঠীও আছে। রাষ্ট্র এবং জাতি এক না। একটা রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকতে পারে। রাষ্ট্র হচ্ছে একটা রাজনৈতিক প্রপঞ্চ, আর জাতি হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক বর্গ। বাংলাদেশকে আমরা জাতিরাষ্ট্র বলবো না। এখানে বাঙালি ছাড়াও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থাকে। আধুনিক বিশ্বে এখন এটাই সত্যি। আমেরিকানরা একসময় বলত এখানে সবাই আমেরিকান। এখন তাদের মানতে হচ্ছে যে, সকলেই অ্যামেরিকান না, নানা জাতি আছে তার মধ্যে। অ্যাংলো-স্যাক্সন ছাড়াও তো ওখানে স্প্যানিশ আছে, পর্তুগিজ আছে, বাঙালি আছে। তাই, জাতিরাষ্ট্র নয়, আমরা চেয়েছি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এটা জাতিরাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল না, যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।

আমার কাছে সবসময় মনে হয় জাতীয়তাবাদ প্রশ্নটি ১৯৭১ সাল বা তার পরের পাঁচ বছরেও পুরোপুরি মীমাংসিত হয়নি। এটি ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। কাগজে কলমে অনেক কিছু লেখা থাকলেও আমার ধারণা ১৯৭৫ সালে এটি বঙ্গবন্ধু বনাম মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মধ্যে সংসদের ভিতরে বাইরে একটি চলমান বিতর্ক হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ১৫ আগস্ট সেটি থমকে যায়। এই বিতর্ক আবার সেখান থেকে শুরু হয় যখন পার্বত্য শান্তিচুক্তি করা হয়। শাহবাগের সময় আরো বেশি আগায় এবং আশা করি এটি খুব শীগগির সুরাহা হবে। আমি বিনয়ের সাথে নিজের অন্য একটি লেখা থেকেই একটু উদ্ধৃতি দেই।

আমি কাদের মোল্লার মামলার শুনানির প্রশ্নোত্তর পর্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামার সাক্ষ্য থেকে জানতে পেরেছি, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে মিরপুরের আসন থেকে যিনি নির্বাচন করে গোলাম আযমকে হারিয়ে ছিলেন [৪], তিনি নিজেই ছিলেন একজন উর্দুভাষী। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী থেকে কেউ নির্বাচন করে জিতলে তার উর্দুভাষী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি– ঠিক যেমন চট্টগ্রাম থেকে কেউ নির্বাচন করলে তার চট্টগ্রামের স্থানীয় লোক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ– এটি সহজ বীজগণিত।

এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সেটি হল, তখন পর্যন্ত এই আন্দোলনকে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবেই ধরা হচ্ছিল। জ্ঞানের স্বল্পতা আর আলসেমির কারণে আমি জানি না সমতলের আদিবাসীরা (যেমন ধরুন গারো, হাজং) এনারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মূলধারার আন্দোলনে তখনও কতটুকু একাত্ম হয়েছিলেন। বাঙালির আত্ননিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের ইতিহাস আর সমতলের আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের ইতিহাস খুব সম্ভবত দুটি পৃথক ধারা।

সমতলের আদিবাসীদের বিখ্যাত টংক আন্দোলনের নেতা কমরেড মণি সিংহ কিন্তু কারাগার থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন [২]। একই ব্যাপার ঘটেছিল পাহাড়ের আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও। তাদের জননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচনে জিতেছিলেন [৩]।

এর অর্থ হল, মূলধারার আন্দোলনে তারা একই ছাদের নিচে থেকে থাকলে (আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে যদি না-ও হয়, সত্তরের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনগুলোতে তাদের মধ্যে কিছু না কিছু যোগাযোগ ছিল), বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরেও আন্দোলনের কিছু ব্যাপ্তি থাকার কথা। সেই মানুষগুলো ১৯৭০ এর নির্বাচন পর্যন্তও ছিলেন ভিন্ন রাজনৈতিক ধারায় এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে সবাই একধারায় মিশে গেলেন।

যেভাবে আমি ‘মিশে যাওয়ার’ কথা বলে দিলাম আদতে সেটি মোটেই সে রকম সহজ ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের যুদ্ধের সময় একই সমতলে আনতে যে উদারতা আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়, সেটি দুপক্ষ থেকে দেখানো হয়েছিল বলেই সেদিন তা সম্ভব হয়েছিল। আমার খুব ইচ্ছা একটি বই কেউ একজন লিখবেন শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের সময়কার রাজনৈতিক ডিলব্রেকিংগুলো নিয়ে। হয়তো কেউ ইতোমধ্যে লিখেছেন, কিন্তু আমি জানি না। যদি সে রকম বই কখনও পাই তাহলে আমি নিশ্চিত, আমাদের জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের আরও কিছু নতুন গুণের কথা জানব।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সালে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন আর শুধুমাত্র বাঙালিদের (নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কথা বলছি) আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল তখন এই ভূখণ্ডের সবার মুক্তিসংগ্রাম। জাতীয়তার এই ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে উঠে আসেনি, কিন্তু এখানে জনপ্রতিনিধিরা সবসময় ‘বাংলাদেশের জনগণ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ একটি সর্বদলীয় ব্যাপার ছিল, কাজেই সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বাইরেও একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপার ছিল।

কাজেই আমরা যদি এখানে ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করি তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, এখানে তার একটি নতুন অর্থ দাঁড় করাতে হবে। সেই অর্থটি কী? বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটি আছে তাতে বসবাসকারী সকল ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় হল সেই নতুন অর্থ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যদি ‘বাংলাদেশের জনগণ’ কথাটি ব্যবহার না করে ‘বাঙালি’ ব্যবহার করা হত এবং তারপরও যদি সমতল ও পাহাড়ের ভিন্নভাষী আদিবাসীরা সেই যুদ্ধে যোগ দিতেন, তার মানে হল ‘বাঙালি’ কথাটি তখন আর নৃতাত্ত্বিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে না, এর রাজনৈতিক অর্থও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘোষণাপত্রে সেটি ছিল না।

এখানে একটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। একটি জনগোষ্ঠীকে কী নামে ডাকা হবে সেটি কারা ঠিক করবে? সেটি ঠিক করবে শুধুমাত্র, শুধুমাত্র, শুধুমাত্র সেই জনগোষ্ঠী। আমরা যেমন অন্য ভাষার কিছু রাজনীতিবিদদের পরামর্শে আমাদের মায়ের ভাষা আরবি হরফে লেখা শুরু করতে রাজি হইনি; তেমনি অন্য একটি জনগোষ্ঠীকে কী নামে ডাকা হবে সেটি তারা ঠিক করবে, আমরা নই। গত সরকারের সময় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ কথাটি প্রচলিত করে পাহাড়ের আদিবাসীদের মন যেভাবে ছোট করে দেওয়া হয়েছে তার জন্য আমাদের কেউ কোনোদিন ক্ষমা করবে না।

আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদ’ কথাটি আমি পাচ্ছি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদে সৈয়দ নজরুল ইসলামের শোক প্রস্তাবে [১]। এখানে কিছুটা তুলে দিচ্ছি–

“মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনার অনুমতি নিয়ে পরিষদে আমি একটা প্রস্তাব গ্রহণের জন্য পেশ করছি:

ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙালিরা, সাবেক ইপিআর ও পুলিশ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ সশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিবনগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল তার সঙ্গে এই গণপরিষদ একাত্মতা প্রকাশ করছে।
স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এই পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এ ক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্ত প্রতীক ও আদর্শ, তথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।”

এই প্রস্তাব কিন্তু ধুম করে পাশ হয়ে যায়নি। গণপরিষদ সদস্য নূরজাহান মুরশেদ, আসহাব-উল হক, সাজেদা চৌধুরী, মহম্মদ আতাউল গণী ওসমানী, মো. ময়েজউদ্দিন এনারা এই প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সেগুলোর সুরাহা করা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ নিয়ে কেউ সেদিন প্রশ্ন তুলেননি। তবে সেদিন বঙ্গবন্ধুর একটি কথা আমি আগের বা পরের কথা ছাড়াই প্রথমে উল্লেখ করতে চাই।

“রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মচারিরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে।”

প্রিয় পাঠক, আপনার কী মনে হচ্ছে? এখানে ‘বাঙালি’ বলতে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র বাংলাভাষীদের কথা বলেছেন? সেদিনের পুরো কার্যবিবরণী পড়লে কিন্তু তা আর মনে হবে না। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বলা কথা থেকে আরও কিছু তুলে দিই।

“বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।

এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সঙ্গে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যাঁরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তাঁদের জন্য এই পরিষদ তাঁদের আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে এবং এই পরিষদকে তাঁদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে।

জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ত্রিশ লক্ষ ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসাবে নিশ্চয়ই তাঁদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখব। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়।

রক্ত দিয়েছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এ দেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে এ দেশের জনগণ, রক্ত দিয়েছে সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে ভূতপূর্ব ইপিআর, রক্ত দিয়েছে আনসাররা, মোজাহেদরা। রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারি কর্মচারিরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খানসেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশুসেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।

তাছাড়া এই দেশের জানা-অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যারা আমাদের এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।

… আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে।

স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যাঁরা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন, গণতন্ত্রকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাঁদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পেছনে কারা ছিলেন।

আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সে জন্য তাঁদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আর যেসব দল আমাকে সমর্থন করেছে তাঁদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।

আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হল সংবিধান তৈরি করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসব। শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়; দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে।”

বঙ্গবন্ধু যখন ‘বাঙালি’ কথাটি বলেছিলেন তখন যে নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরে একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও তাঁর মাথায় কাজ করেছিল, এটি আমাকে একটি ফেসবুকীয় আলাপচারিতায় প্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক অমি রহমান পিয়াল। গণপরিষদের ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিলের কার্যবিবরণীতে আমি সেটির কিছু ছায়া খুঁজে পেয়েছি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে আমাদের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানটিতে আমাদের এই চার মূলনীতিকে রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই সংবিধান কিন্তু প্রণয়ন করা হয়েছিল জনপ্রতিনিধিদের একটি সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে, ২০৯ দিন ধরে। এর মধ্যে গণপরিষদ সদস্যের বাইরেও যে কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল যার শেষ সময় ছিল ১৯৭২ সালের ৮ মে [৫]। শুধু তাই নয়, যেদিন সংসদে এই সংবিধান উত্থাপন করা হয় তারপরও টানা সাতদিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে এটি প্রকাশ করা হয়েছে যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে তাদের প্রতিনিধিরা কী করছে। সরকারি দল, বিরোধী দল সব দিক থেকেই প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তাদের কাজ ছিল দেশের মানুষের ইচ্ছাটুকু যেন সংবিধানে প্রতিফলিত হয় সেই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা। এর বাইরে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কারিগরি দিকটি দেখেছেন।

সব মিলিয়ে এই সংবিধানটি সম্ভাব্য সকল পরীক্ষার ধাপ পার হয়েই এই রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যখন সংসদে খসড়া দাখিল করে তখন সেটি নিয়ে ১৯ অক্টোবর জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আমি বিশেষভাবে আগ্রহী আওয়ামী লীগের বাইরে সেই সময়কার বিরোধী দলীয় সদস্য বা স্বতন্ত্র সদস্যমদের বক্তব্য জানতে [৫]।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন–

“…বাংলার মানুষ মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে অফুরন্ত আশার প্রতীক এই সংবিধান পেতে যাচ্ছে এবং এই সংবিধানের মাধ্যমে তারা কতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ করছে, সেটা এখানে আলোচনা হওয়া দরকার। তাছাড়া কিছু লোক এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যাতে সংবিধান পাস হতে না পারে, সংবিধান যাতে বানচাল হয়ে যায়, মানুষের আইন যাতে এদেশে টিকতে না পারে, সত্যিকার আইনের শাসন যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে।

… কোনো ষড়যন্ত্রে যাতে এই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া পিছিয়ে না যায়, আমি সে জন্য সজাগ আছি।

…সংবিধান মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে পাস হওয়ার আগে যাতে এদেশের মানুষ আলোচনা করতে পারে, তার জন্য পরিষদের নেতার কাছে আবেদন করছি।”

স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন–

“আজ যে সংবিধান আমরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাচ্ছি, সেই সংবিধানে যদি এমন একটা নীতি না থাকে, যে নীতির দ্বারা আমাদের দেশে যারা ঘুষখোর, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, তাদের যদি আমরা উচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে এই সংবিধানের কোনো অর্থ হয় না। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এ কথা ছিল না, ১৯৬২ সালের সংবিধানেও এ কথা ছিল না।

…যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর, তারা আমাদেরকে বলবে যে, যাঁরা এই সংবিধান প্রণয়ন করে গিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করে গিয়েছেন।

…আমরা এ সংবিধানকে সুন্দর করে গড়ে তুলি, যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে এই দাবি রেখে যেতে পারি যে, আমরা সুন্দর একটি সংবিধান রচনা করেছি।”

এই চার মূলনীতি কিন্তু কোনো দলের জনপ্রতিনিধির কাছ থেকেই আপত্তির সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু সংবিধানের অন্য একটি জায়গায় একটি মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ব্যাখ্যাটি তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছ থেকে। সেদিন ছিল ৩১ অক্টোবর [৬]। এ দিন থেকে সংবিধানের দফাওয়ারী পাঠ শুরু হয়েছিল [৫]। বাংলাদেশের অধিবাসীরা ‘বাঙালি’ হিসেবে পরিচিত হবেন এই ধারাটিতে ছিল তাঁর আপত্তি (৬ ও ৯ নং ধারা )।

স্পষ্টতই ‘বাঙালি’ শব্দটির অর্থ বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছে এক ছিল না। প্রথমজন ভেবেছিলেন এর মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় ঠিকঠাক প্রকাশ পায়, কিন্তু দ্বিতীয়জন তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন না। এটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ একই দলের মধ্যেই যেখানে সব ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারেন না, সেখানে দুই দলের দুই সদস্য কোনো বিষয়ে একমত না হতেই পারেন।

এর প্রথাগত উপায় আছে। ক্রমাগত আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের নিজেদের মধ্যে সেই বোঝার দূরত্ব কাটিয়ে উঠে একমত হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের জাতীয় সংসদ তো সে কারণেই তৈরি করা হয়েছে। প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যাদের পাঠাব তারা অধিবেশনের পর অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে যোগাযোগের দূরত্বগুলো যতদূর সম্ভব কাটিয়ে একমত হবেন। সেই অধিবেশনের খরচও করের মাধ্যমে আমরাই দিই।

এই দ্বিমত কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে শত্রুতে পরিণত করেনি। ১৯৭৩ সালেও মানবেন্দ্র নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন [৭]। তারপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন। এমনকি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগ দেন তিনি। এর অর্থ হল, প্রথম মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’ কথাটির অর্থ নিয়ে তাঁর আপত্তি থাকলেও খুব সম্ভবত সেটি নিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ কিংবা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সেই আলোচনা যদি পূর্ণতা পেত তাহলে হয়তো আমরা জাতীয়তাবাদের একটি সংশোধিত রূপ বা অর্থ পেতাম। কিছু একটা নিশ্চয়ই হত যেটি আমাদের আর ভিন্নভাষী আদিবাসীদের রাজনৈতিক পরিচয়কে সমানভাবে ধারণ করতে পারত। কিন্তু তার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হল। একসময় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ক্ষমতায় আরোহণ করলেন জিয়াউর রহমান এবং তিনি জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়াই সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের উপর কাঁচি চালিয়ে দিলেন।

আজকে বেঁচে থাকলে মামলায় হাজিরা দিতে দিতে তার জান শেষ হয়ে যেত (বর্তমান সরকার সব কাজ ঠিকঠাকমতো করলে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও একই পরিণতি হওয়ার কথা। এখনও যে সেটি হচ্ছে না তার জন্য আগামী প্রজন্ম আমাদেরকে সবসময় লজ্জা দিয়ে যাবে)।

সামরিক শাসক (টেকনিক্যালি চিন্তা করলে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক যার কোনো ম্যান্ডেট ছিল না) জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে ফরমান জারি করে বলে দেন, বাংলাদেশের জনগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন। আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মধ্যকার মতদ্বৈধতা যখন দূর হত, এ রকমই কিছু একটা পরিবর্তন সংসদে আসত। তাহলে জিয়াউর রহমানের কাজের সমস্যাটি কোথায়?

সমস্যাটি হল জাতীয়তার এই নতুন বোধটি মানুষের মধ্যে সঞ্চার করতে পারার ব্যর্থতা। জিয়াউর রহমান জনপ্রতিনিধি ছিলেন না, ক্ষমতালিপ্সু একজন জেনারেল ছিলেন যিনি প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে জানার পরেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে কয়েক বছর পর পর নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের মুখোমুখি হতে হত। তাই জনগণের প্রতি দুজনের দায়বদ্ধতা ছিল। এই মিথস্ক্রিয়াতে তাঁরা অন্যান্য সব এজেন্ডার পাশাপাশি জাতীয়তাবোধের নতুন ধারণার তাগিদটুকু জনগণের চিন্তায় ঢুকিয়ে দিতে পারতেন। একসময় মানুষই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দিত তাদের নতুন ধারণার প্রয়োজন আছে কিনা এবং থাকলে সেটি কী।

জিয়াউর রহমান প্রায় ঠিক কাজটি করে ফেললেও এর মধ্যে গণতন্ত্রের ফাঁকিটুকু রয়ে গিয়েছিল। এই পরিবর্তনটি জনগণ যেহেতু তাকে করতে বলেনি, এর বাস্তবায়নে এসে যোগাযোগের দূরত্বটি ঠিকই প্রকাশ পেয়ে গেল। কীভাবে পেল? আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পাহাড় ও সমতলের ভিন্নভাষী আদিবাসীদের গণ্য করে কিনা এই সমস্যা ছিল। এখন জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ হয়ে গেল আসলে গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদ।

বেশিরভাগ বাংলাদেশি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের আগে যতটুকু বাংলাদেশি ছিলেন ততটুকু রয়ে গেলেন। কেবল কিছু ‘সুযোগসন্ধানী বাংলাদেশি’ প্রশাসনের মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও বন দখল শুরু করল। এতদিন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কাছে তাও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান যখন অন্যান্য জায়গা থেকে সেটলার এনে পাহাড়িদের উপর চাপিয়ে দিলেন এবং নৃতাত্ত্বিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেন, তখন তারা সশস্ত্র সংগ্রামে চলে গেলেন।

২০১০ সালে আদালত রায় দিয়েছেন জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যাটি সংসদ অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিরা ঠিক করবেন, তবে সেখানে বাংলাদেশির পরিচয়, অর্থাৎ একটি সার্বিক রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। কীভাবে মাথায় রাখা হবে সেটি জনপ্রতিনিধিরা তাদের ভোটারদের ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে ঠিক করবেন [৮]। অর্থাৎ আমরা আবার বঙ্গবন্ধু ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই অসমাপ্ত বিতর্কে ফেরত গেছি। আশা করি এবার সেটি ঠিকমতো শেষ হবে।

আমার খটকা হল, সিরাজুুল ইসলাম চৌধুরী কেন ধরে নিলেন যে ১৯৭১ সালেই আমাদের জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায়ন শেষ হয়ে গিয়েছিল? কেন ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন না যে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি একটি স্বত:স্ফুর্ত বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল?

দ্বিতীয় খটকা

প্রশ্ন : সেরম একটা রাষ্ট্র হয়ত হতে পারত, কিন্তু আমরা এখন যে রাষ্ট্রটা পাচ্ছি...

সিরাজুল : সেটা হয় নাই, কারণ পুঁজিবাদের চরিত্রই হচ্ছে বৈষম্যমূলক, এবং সেখানে যাদের ক্ষমতা আছে তারা অন্যদের কন্ট্রোল করবে। এখানে মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা বেশি, তারা সংখ্যায় বেশি বলে। কাজেই তারা হিন্দুদের মাইনরিটি বলে ট্রিট করে, তাদের সম্পত্তি দখল করার চেষ্টা করে। আসলে রুলিং ক্লাসটাই কন্ট্রোল করছে সব কিছু। ইকনমিক টার্মস ছাড়া এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে এর সুবিধা হবে না।

১৯৭৫ সালে কৃত্রিম ও বেআইনীভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি নষ্ট করা হয়। এটি কোন স্বত:স্ফুর্ত সামাজিক বিবর্তন ছিল না। এটি ছিল একটি সামরিক অভ্যূত্থান। এটি সরাসরি একটি ফৌজদারী অপরাধের মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু এখন যখন এর জন্য পুঁজিবাদকে দায়ী করা হয়, যখন শ্রেণীসংগ্রামকে দায়ী করা হয় তখন এটি কী এক ধরণের ইতিহাস বিকৃতি নয়? আমেরিকা যখন সিআইএ'র মাধ্যমে বিভিন্ত দেশে অভ্যূত্থান ঘটায় তখন কি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সেটিকেও শ্রেণী সংগ্রাম বলবেন?

তৃতীয় খটকা

প্রশ্ন: অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনি নিজে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। এখনকার বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি পলিটিক্যাল আর্টিকুলেশনের ক্ষেত্রে আইডেনটিটি দিন-দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বা বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদ- সোজা কথায় তার যে রাজনৈতিক ভোকাবুলারি সেটা অনেক বেশি ডমিনেটেড হচ্ছে আইডেনটিটি পলিটিক্স দিয়ে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন এবং তার অ্যান্টি-থিসিস হিসাবে হেফাজতে ইসলামের উত্থানের মধ্যে আইডেনটিটি পলিটিক্সের রবরবা’র একটা চেহারা পাওয়া যাবে। ফলে, আত্মপরিচয় রাজনীতির মাঠে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে কীভাবে দেখেন আপনি?

সিরাজুল : শাহবাগ আন্দোলন পর্বে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির চেয়ে আমার কাছে বড় দিক মনে হয়েছে শ্রেণী পরিচয়। শ্রেণী-বিভাজনটাই সেখানে ছিল প্রধান ইস্যু। হেফাজতের সঙ্গে গণজাগরণের যে দূরত্ব সেটা আসলে শ্রেণীদূরত্ব। গ্রামে মাদ্রাসাগুলোতে যারা পড়ছে তারা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত। আমরা এখানে যারা পড়ছি তারা সুবিধাপ্রাপ্ত। এখানে দূরত্ব আছে। গণজাগরণ মঞ্চে তুমি কিন্তু শ্রমজীবীকে টানতে পারছ না। যে রিকশাঅলা তোমাকে ওখানে পৌছে দিয়ে যায় সে কিন্তু মঞ্চে যাচ্ছে না। রাস্তায় যেসব শ্রমিকরা আছে তারাও কিন্তু আসছে না। এমনকি তোমরা ভদ্রলোকরা যে সভা করছে সে তার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে যেতে পারে। যে ওটা বড়লোকদের ব্যাপার, নাচানাচি করতেছে, গান বাজনা করতেছে। শ্রেণীর সমস্যাটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা। শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে এগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না।

আপনারা মূল সাক্ষাৎকারের শুরুর দিকে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তাগুলো পড়লে দেখবেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভাষা আন্দোলনকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখেন। কিন্তু তিনি শাহবাগ আন্দোলনকে দেখেন একটি শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে। এর বিপরীতে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচীকে তিনি দেখেন অন্য একটি শ্রেণীর সংগ্রাম হিসেবে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মূলধারা কী একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না? রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে কমিটি সেখানে কি কৃষক-শ্রমিকদের প্রতিনিধি ছিল? সেটাও না হয় বাদ দিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রতিনিধি ছিল? এসব না থাকার পরও যদি ভাষা আন্দোলন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের কাছে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়ে থাকে তাহলে শাহবাগ আন্দোলনও তো একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আমি তো বলব শাহবাগ আন্দোলন হল প্রথম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। একাত্তরের 'তুমি কে? আমি কে? বাঙ্গালী! বাঙ্গালী!' শ্লোগান শাহবাগে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে 'তুমি কে! আমি কে! চাকমা! মারমা! বাঙ্গালী!। আচ্ছা এটি না হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সীমিত পর্যবেক্ষণ হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসকে শ্রেণী সংগ্রাম বলা কী ইতিহাস বিকৃতি নয়? আমারদেশ পত্রিকাটি সুপরিকল্পিতভাবে সারা দেশে বেছে বেছে শুক্রবারগুলোর আগে করে খবর ছড়াত যাতে করে মানুষকে উত্তেজিত করা যায় আর হেফাজতে ইসলাম বিএনপি-জামাতের কাছ থেকে সরাসরি টাকা খেয়ে ঢাকায় এসে তান্ডব করে আবার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা কোন ধরণের শ্রেণী সংগ্রাম?

চতুর্থ খটকা

প্রশ্ন: শ্রেণীটাকেই যদি প্রধান সমস্যা হিসেবে আমরা দেখি সেক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে কতগুলো নতুন প্রশ্ন তোলার দরকার হয়ে পড়বে।

সিরাজুল : বাঙালি জাতীয়তাবাদের পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। আমি এবিষয়ে বই লিখেছি, যার চতুর্থ সংস্করণ চলছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন ছিল ১৯৭১ সালে। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করল এবং একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু এর পরে তো আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র চাই না। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র এখন দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র তো চাই না। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই যেখানে বাঙালি-অবাঙালি সকলের সমান অধিকার থাকবে। বৈষম্যই হচ্ছে প্রধান শত্রু।

আমি এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করি। বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে ছিল বাঙ্গালী মুসলিম জাতীয়তাবাদ (বিএনপি যেটিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বলে চালানোর চেষ্টা করে)। দেশে পুঁজির বিস্ফোরক বিকাশ যদি হয় নব্বই দশক থেকে তাহলে সেই পুঁজিবাদের আঁতুড়ঘর কিন্তু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিল না। সেটি হল জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত ও এরশাদের সময়ে বিকশিত বাঙ্গালী মুসলিম জাতীয়তাবাদ। আগে যেটি বলেছি সেটি আবারও বলছি। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তার স্বাভাবিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭৫ সালে এই বিবর্তন থমকে যায়। ২০১৩ সালে এটি আবার স্বাভাবিক গতিতে বিবর্তিত হওয়া শুরু হয়েছে। তবে আমি স্বীকার করছি আমার উচিৎ ওনার বইটি পড়ে দেখা। অনেক সময় অল্প কথায় সবকিছু বুঝানো যায় না। ওনার বই পড়লে হয় আরো পরিষ্কার হবে আমার কাছে উনি কি বলতে চান। আরেকটি ব্যাপার হল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক বিকাশ হলেও পুঁজিবাদ আসত। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণী বিকাশের শুরুটি কিন্তু হয়েছে বাঙ্গালী মুসলিম জাতীয়তাবাদের কৃত্রিম স্বল্পস্থায়ী স্বর্ণযুগে।

পঞ্চম খটকা

প্রশ্ন : অর্থাৎ আপনি বলছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এখন আর প্রয়োজনীয় না?

সিরাজুল : বাঙালি জাতীয়তাবাদ আছে, কিন্তু তার এখন আর দেওয়ার কিছু নাই। আমার রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা কী? একটা হলো নদীর সমস্যা। আমাদের চুয়ান্নোটি অভিন্ন নদীর প্রবাহ যে শুকিয়ে আসছে সেটা নিয়ে কি জাতীয়তাবাদীরা কথা বলছে? হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কি তারা কথা বলছে? নরেন্দ্র মোদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দিতে বক্তৃতা দিয়ে গেলেন। পাকিস্তানের কেউ যদি উর্দুতে বক্তৃতা দিত আমরা মানতাম? অথচ মোদিকে আমরা হাততালি দিলাম। জাতীয়তাবাদের কথা বললে। জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান তো ভাষা।

আমি এটি লিখতে গিয়ে এই প্রথম মোদীর বক্তৃতা ইউটিউবে দেখলাম। আমি আশা করেছিলাম কেউ একজন হয়তো সাথে সাথে ইংরেজীতে বলছে এমন কিছু দেখব। কিন্তু তা তো দেখলাম না। এটি আসলেই অভদ্রতা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে একমত। তবে মোদীর হিন্দি বক্তৃতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীরা যেমন কথা বলেনি তেমনি ওনার নিজের যে পেশা শিক্ষকতা তার সংগঠন শিক্ষক সমিতিও কিন্তু প্রতিবাদ করে নি। সদস্য হিসেবে তিনিও আলাদা ভাবে তখন প্রতিবাদ করেছেন বলে শুনিনি। কেন কেউই প্রতিবাদ করল না বুঝলাম না। পত্রিকায় অবশ্য দেখেছি কিছু ছেলে মেয়ে গ্রেফতার হয়েছে। ওরাই মনে হয় প্রতিবাদ করেছে টুকটাক। অবশ্য আমার নিজের আরেকটা কৌতুহল আছে। এখন যে বাংলাদেশে যত চীনা প্রজেক্ট হয় (বিদ্যৃৎকেন্দ্র, সেতুু) সেখানে চীনারা কিন্তু নিজেদের ভাষাতেই সব ম্যানুয়েল লিখে রেখে যায়। পদ্মাসেতু নিয়ে যখন সাংবাদিকরা লিখে তখন দেখা যায় চীনা যারা কাজ করছে তারা নিজেদের ভাষাতেই সব কাজ করে। এসব নিয়ে কখনও ওনার কোন বক্তব্য শুনিনি। কে জানে অন্য কারো চোখে পড়েছে কিনা। বাংলাদেশে আগ্রাসন কেবল ভারত করে না। চোরাই মোবাইল সব কিন্তু চীন থেকেই আসে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা পাঠায় কিন্তু চীনের প্রশ্রয়ে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এসব বিষয়ে ওনার বক্তব্য কি। আমি খুব আশা করি যে ওনার এ নিয়ে বক্তব্য আছে কেবল আমার আলসেমির কারণেই চোখে পড়ছে না।

ষষ্ঠ খটকা

প্রশ্ন : আপনি দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন আড়িয়ল খাঁয় যখন কৃষকের জমি দখল করে বিমানবন্দর তৈরি করবে আপনি প্রতিবাদ করেছেন। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্দর-রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন। ওসমানী উদ্যান রক্ষা করেছেন আপনারাই। এরকম অনেক ঘটনার কথা বলা যাবে। এর নিরিখে জিজ্ঞেস করছি, এখন বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সেখানে বুদ্ধিজীবীর আসলে ভূমিকা কী বলে মনে করেন?

সিরাজুল : বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা তো এটাই যে সে মানুষের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এরকম হতাশাজনক অবস্থান আমি আগে কখনও দেখি নাই। সব বুদ্ধিজীবী দুই দলে বিভক্ত। একদল শত নাগরিক কমিটি বানাচ্ছে, আরেকদল সহস্র নাগরিক কমিটি বানাচ্ছে। মূল কাজ হচ্ছে, ক্ষমতার কাছে থাকা। জনগণের সমস্যাগুলো নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। নদীগুলো মরে যাচ্ছে, বেকারত্বের সমস্যা, কাজ নেই সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, জনসংখ্যার আধিক্য- এসব বিষয় নিয়ে কেউ বলছে?

আমি এখানে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে চাই। সংজ্ঞা অনুযায়ী তো বুদ্ধিজীবির কাজ হল নিজের পেশাগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাজের সেবা করা। একজন বুদ্ধিজীবি যার ইংরেজী সাহিত্যে ডিগ্রী আছে তিনি যখন আঁড়িয়ল বিলের জন্য আন্দোলন করেন তখন কিন্তু তিনি সেখানে বুদ্ধিজীবি হিসেবে কাজ করেন না একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কাজ করেন। যদি এমন হত যে তার ডিগ্রী অর্থনীতি, হাইড্রলজি, ইকলজি বা জিওলজিতে আর তিনি আঁড়িয়ল বিলের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তার পেশাগত দক্ষতা ব্যবহার করছেন তাহলে সেটি হল বুদ্ধিজীবিদের আন্দোলন। এই দুটি ব্যাপারের মধ্যে পার্থক্য আছে। এ প্রসংগে আমরা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসংগে কল্লোল মুস্তফার সাথে ড. আঞ্জুমান ইসলামের যে বিতর্ক হয়েছিল বিডিনিউজ২৪.কমের উপ-সম্পাদকীয় পাতায় সেটি স্মরণ করতে পারি। কল্লোল মুস্তফা এ ব্যাপারে অপেশাদার আর আঞ্জুমান ইসলাম পানিদূষণ বিশেষজ্ঞ। এ কারণে তথ্য আর বিশ্লেষণে না পেরে কল্লোল মুস্তফা দুর্ব্যবহারের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাজেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই চমৎকার অবদানগুলোকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে অবদান না বলে সচেতন নাগরিক হিসেবে অবদান বললে খুব সম্ভবত: নিখুত হবে। দুটির মধ্যে মানে ও ওজনে ফারাক আছে।

সপ্তম খটকা

প্রশ্ন : বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভেটেরান বুদ্ধিজীবীদের তো শুধুমাত্র সেকুলারিজম, মৌলবাদ এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে আগ্রহী দেখা যায় না।

সিরাজুল : বাংলাদেশ এখন সস্তা শ্রম উৎপাদনের কারখানা। তারা গার্মেন্টসে কাজ করবে, গৃহভৃত্যের কাজ করবে, এবং এরা সমুদ্রের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়বে, একদল চলে যাবে বিদেশে, রেমিট্যান্স পাঠাবে। সেই রেমিট্যান্স আমরা এখানে ভোগ করবো, বিদেশে পাঠাবো, সুইস ব্যাংকে আমাদের টাকা জমতে থাকবে। এই ভয়াবহ বিষয়গুলো নিয়ে তো বুদ্ধিজীবীরা কিছু বলছে না। তারা কেবল মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ নিয়ে আছেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম যদি শুধুমাত্র তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর নিয়ে পড়ে থাকতে পারেন তাহলে অন্য কিছু পণ্ডিত লোক শুধুমাত্র মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ নিয়ে পড়ে থাকলে সমস্যা কোথায়? আমি বলছি না কাজটি খুব ভাল। কিন্তু নিজে কাঁচের ঘরে বসে অন্যকে ঢিল মারা কি ঠিক?


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ যে ধর্মীয় ও বিদেশী সংস্কৃতির দ্বারা আক্রান্ত হয় এই বিষয়টা নয়া দিগন্তে এক সময়ের নিয়মিত লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চেপে যান কেন?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

"এক সময়ের" কেন? এখন কি আর লেখেন না?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হাসিব এর ছবি

আমি যদ্দুর জানি এখন লেখেন না। তবে আমি ভুল হতে পারি। নয়া দিগন্ত নিয়তিম পড়া হয় না।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

নিয়মিত তো আমারও পড়া হয়না।

ইনি এখন "নতুন দিগন্ত" নামে পাক্ষিক/দ্বিপাক্ষিক সম্পাদনা করেন বোধহয়। দুই দিগন্তের কোনও মাসতুতো সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

শেহাব এর ছবি

তিনি নয়া দিগন্তে লিখতেন এই ব্যাপারটি জানতাম না। এটি তো খুব খারাপ কাজ।

মন মাঝি এর ছবি

বাঙালি জাতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা আপনার কাছে কি এবং সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদ বলতে আপনি কি বুঝেন সেটা না জেনে আপনার লেখাটা বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

****************************************

শেহাব এর ছবি

বাঙালী জাতি বা বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল বাংলা ভাষা। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে যে জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে সেটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হওয়া উচিৎ।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে একটা বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। নীচে প্রথম খটকার আলোচনায় সাইদ আহমেদ এ ব্যাপারে খানিকটা ধারনা দিয়েছেন। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে যখন বাংলাদেশ বলে কোন অখণ্ড কোন অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল না, তখনও তো বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব ছিল। আবার ভবিষ্যতে যদি কোন কারনে এখনকার বাংলাদেশ রাস্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং ভিন্নতর নামীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে, তখন তো তাহলে আমাদের বাংলাদেশী জাতিস্বত্বার পরিবর্তন ঘটাতে হবে, দেশের নামের সাথে মিল রেখে নতুন একটা জাতীয়তা নির্ধারণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা জার্মান কিংবা ফ্রান্সের অধিবাসীদের জাতিস্বত্বার বিষয়টা লক্ষ করতে পারি। বিভিন্ন সময়ে রাস্ট্রীয় কাঠামো এবং সংগঠনে নানারকম পরিবর্তন সত্ত্বেও জার্মানদের জাতিগত পরিচয় ডয়েস, ফ্রেঞ্চদের ফ্রাঙ্কুইস। বিভিন্ন দেশে বসবাস করলেও আরবরা সকল সময় আরবই।

শেহাব এর ছবি

সেটা তো রেস। সে ক্ষেত্রে রেস সংক্রান্ত কোন কিছুই সংবিধানে থাকার তো দরকার নেই।

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

খটকা, ভ্রম বা ভুল লেখকের, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরও আছে। দুয়েকটা নিয়ে বলি।
প্রথম খটকা: সম্প্রসারণশীল জাতীয়তা?
জাতীয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভ্রান্তি ছিল, জিয়ার তো ছিলই।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বোকার মতোন ‘পরিবর্তনশীল নাগরিকত্ব’ আর ‘স্থায়ী জাতীয়তাকে’ গুলিয়ে ফেলে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যুক্তি অনুযায়ী একাত্তরের আগে জন্ম নেয়া এ অঞ্চলের লোকেরা জাতিতেই পাকিস্তানী, এবং আমেরিকায় বসবাসরত বর্তমান বাংলাদেশিরা আসলে জাতিতেই আমেরিকান হবার কথা! কিন্তু দেশ সৃষ্টি বা দেশান্তর নির্বিশেষেই আমার বাপ-দাদা ও আমি বাঙালী— একাত্তরের আগেও যা, অন্য দেশে গেলেও তা।
কিন্তু লেখক অবাঙালীদের যুক্ত করার জন্য বাঙালীর সংগা বা আওতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে অভিপ্রায় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাও ভ্রান্ত। আমি নিজের মতোন বাঙালীর সংগা ও আওতা পরিবর্ধন করে চাকমা, মারমা সবাইকে বাঙালী বললেই বা তারা তা মেনে নেবে কেন? বিদেশে বাঙালীদেরকে অনেক সময় ভারতীয় বলে ডাকা হয়। অখন্ড ভারতবর্ষের লোক এক জাত— এই পরিবর্ধিত সংগা মেনে আমি কি নিজেকে বাঙালী না ভেবে ভারতীয় ভাববো? মোটেই না। তেমনি চাকমাও বাঙালী হয়ে যায় না।

দ্বিতীয় খটকা: ইতিহাস বিকৃতি
এখানে ইতিহাস বিকৃতি খোজা সম্ভবত লেখকের আলসেমীর ফল। সামরিক অভ্যূত্থানতো ক্ষমতায়নের পন্থা মাত্র, এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিও ক্ষমতায় আসতে পারে। দিন শেষে বিষয়টা সংখ্যাগরিষ্টতা আর অর্থনীতিরই হিসেব। অনেক আগের লেখা, তবে কিছুটা ধারনা দিতে পারে: http://opinion.bdnews24.com/2010/10/22/socialism-debate/
রাজনীতির পট পরিবর্তন সত্ত্বেও কেন আওয়ামী লীগ এখোন আর বঙ্গবন্ধুর সময়ের ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্রে ফেরত যেতে পারে না, সেটা চিন্তুা করলেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য বুঝতে সুবিধা হবে।

তৃতীয় খটকা: শাহবাগ প্রথম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন!?
সংখ্যাগরিষ্টের চোখ দিয়ে সংখ্যালঘুর জাতীয়তাবাদ বুঝতে গেলে সমস্যা। “তুমি কে! আমি কে! চাকমা! মারমা! বাঙ্গালী!”- এটা বললেই কি তঞ্চগ্যা, ম্রো, খিয়াং, খুমীসহ বাকি সমস্ত জাতিস্বত্বাকে অর্ন্তভুক্ত করে ফেলা যায়?
তবে হেফাজত আর শাহবাগের শ্রেণী পার্থক্যটা নিয়ে আমি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর লেখক দুজনের সাথেই কিছুটা একমত। আন্দোলন সবসময় সব শ্রেণীর অংশগ্রহণে হয় না। এমনকি শ্রেণীসংগ্রামের নেতৃত্বই এসেছে বুর্জোয়া পরিবারের সন্তানদের হাত ধরে, তা সে নকশালই হোক আর আমাদের বাম-ঘরানার আন্দোলনই হোক। ভাষা আন্দোলনও একটি শহুরে আন্দোলন ছিল, কিন্তু তার মানে এই না যে তা শ্রেণী-পক্ষপাতদুষ্ট। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, সেই নব্বইয়ের অভ্যুত্থানও শহর কেন্দ্রীক ছিল।
কিন্তু শাহবাগে আধিক্য ছিল স্বত:স্ফুর্ত ভাবে যোগ দেয়া শিক্ষিত মধ্যবিত্তের, আর হেফাজত ছিল দারিদ্র আর ধর্মকে পুজিঁকরে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের অর্গানাইজড গ্যাদারিং (যার সাথে রাজনৈতিক সভারই মিল বেশি)। তবে এটাও ঠিক, শাহবাগ আর হেফাজতের মধ্যে শ্রেণী-ভেদ অবশ্যই ছিল।

চতুর্থ খটকা: বাঙালি রাষ্ট্র নাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র?
এখানে কেবল সিরাজুল ইসলামকেই উদ্ধৃত করবো-
“এটা একটা ভুল কনসেপ্ট তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশ একটা জাতিরাষ্ট্র। বাংলাদেশ কোনো জাতিরাষ্ট্র নয়। আজকের পৃথিবীতে জাতিরাষ্ট্র বলে কোনো রাষ্ট্র নেই। এখানে একটা জাতি প্রধান আছে বটে, কিন্তু অন্য জাতিগোষ্ঠীও আছে। রাষ্ট্র এবং জাতি এক না। …. জাতিরাষ্ট্র নয়, আমরা চেয়েছি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।“

পঞ্চম খটকা: মোদীর ভাষা?
কিন্তু ওখানে সবার হাতে বেতার-শ্রবণযন্ত্র দেয়া হয়েছে, যেটাতে তাৎক্ষণিক বাংলা ও ইরেজী অনুবাদের ব্যবস্থা ছিল। কাজেই আমি এখানে কোন সমস্যা দেখিনা। মোদী চায়নাতেও হিন্দিতেই বক্তব্য দিয়েছেন। যেই ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস স্থাপন করলাম, তার আলোকেই এটা ঠিক আছে। এর উল্টোটা চাওয়া ভন্ডামী হবে।

ষষ্ঠ ও সপ্তম খটকা: বুদ্ধিজীবি এবং বাঙালীত্ব
শত-সহস্র বুদ্ধিজীবির সুবিধাভোগী বিভাজন নতুন কিছুনা। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এটা ভালোই জানা থাকার কথা যে, আর্থ-সামাজিক সব উন্নয়নের জন্যই সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা আর মৌলবাদ রোধ দরকার। “এইটা করে তো ওইটা করে না কেন” টাইপ সমালোচনা সেই শাহবাগ সময় থেকেই দেখে আসছি। এগুলো ফালতু অজ্ঞতা-প্রসুত সমালোচনা। অনেকেই অনেক কিছু নিয়ে কাজ করছে, তিনি জানেন না মানে এই নয় যে তার অস্তিত্ত্ব নাই।

-----------
চর্যাপদ

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

জাতীয়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভ্রান্তি ছিল

ভ্রান্তিটি কি, সে বিষয়ে কিছু বলেন নি। একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

অবাঙালীদেরও বাঙালী হতে বলা।

-----------
চর্যাপদ

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বিষয়টা দেশকালের প্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে, তখন হয়ত আর ভ্রান্তি বলে মনে হবে না। আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগে এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গী এমন ইতিবাচক ছিল না, যেমনটা এখন হয়েছে। তখন এদেশে কেউ তাঁদের আদিবাসী বলে সম্মানিত(?) করত না, কিন্তু তাঁদের নিয়ে কেউ রমরমা ব্যবসাও ফেঁদে বসে নি। এখন আদিবাসী মানুষের জন্য দরদী মানুষ প্রচুর আছে, কিন্তু সেই সাথে আছে কিছু আদিবাসী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, যাদের ব্যবসায়ীক পণ্য হল আদিবাসী। ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক কারনে একদিকে তাঁরা যেমন ছিল বাঙ্গালী সমাজ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে বাঙ্গালীদের কাছে তাঁরা ছিল অসংস্কৃত, অমার্জিত এবং হীনতর মানুষ। সেই প্রেক্ষাপটে তাঁদের বাঙ্গালী সমাজে আত্মিকরনের প্রস্তাবনা তো আমার কাছে কোন দুর্বিনয় বা ভ্রান্তি বলে মনে হয় না, বরং ঔদার্য বলেই মনে হয়। যুগ যুগ ধরে এভাবে কত জাতির সম্মিলনে যে গড়ে উঠেছে আজকের এই বাঙ্গালী জাতি, তার হিসাব করাও এখন অসম্ভব।

মন মাঝি এর ছবি

১।

বাঙ্গালীদের কাছে তাঁরা ছিল অসংস্কৃত, অমার্জিত এবং হীনতর মানুষ। সেই প্রেক্ষাপটে তাঁদের বাঙ্গালী সমাজে আত্মিকরনের প্রস্তাবনা তো আমার কাছে কোন দুর্বিনয় বা ভ্রান্তি বলে মনে হয় না, বরং ঔদার্য বলেই মনে হয়।

ঠিকই বলেছেন। যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী, উপনিবেশবাদী, সাম্প্রদায়িক, হেজিমোনিস্ট, রেইসিস্ট, শভিনিস্ট, সুপ্রিমেসিস্ট, জিংগোইস্টরা অপর-দের, বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে দুর্বল জাতিসত্তাগুলি সম্পর্কে এভাবেই ভেবেছে এবং নিজেদের অমানবিক রেইসিজম, বর্ণবাদ, পরবিদ্বেষ ইত্যাদিকে ডিলিউশনাল নার্সিসিস্টিক আত্নপ্রসাদে ঔদার্য ভেবে ভুল করে এসেছে। বলাই বাহুল্য, তাদের এই ঔদার্যকে ভিক্টিম পপুলেশনের কাছে কিন্তু কখনই চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।

২।
দেশকালের প্রেক্ষিতে দেখলেও এই সচেতন ও পরিকল্পিত ক্যানিবালাইজেশনের পদ্ধতি ভ্রান্তি বলেই মনে হয়। "আজ থেকে ৪০ / ৫০ বছর আগে"-টা আসলে খুব একটা আগে নয়। যে প্রায়ান্ধকার ঐতিহাসিক কালে যুগ যুগ ধরে বহু ছোটবড় জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনে আজকের এই বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে, বিংশ শতাব্দীর ২য় ভাগে ২য় বিশ্বযুদ্ধ ও উপনিবেশোত্তর কালে চতুর্দিকে জাতি, জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদ, জাতি-পরিচয়, আত্নপরিচয়, স্বাধীণতা, স্বাধীণতা-সংগ্রাম ইত্যাদির রাজনীতিতে ও প্রবল ডামাডোলে সচেতন হয়ে ওঠা প্রখর আত্নসচেতনতার যুগে যে সেই যুগ আর নেই - এটা উপলব্ধি করতে না পারাটা ভ্রান্তিই বৈকি। অবশ্য এই ভ্রান্তিটা কার, বঙ্গবন্ধুর না আপনার, না উভয়েরই - আমি জানি না।

আর হ্যাঁ, অতীতে যেসব জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলনে আজকের বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে, সেসব জাতিগোষ্ঠী কতটা কোনো শাসকের পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট হুকুম, হুমকি বা জবরদস্তিতে আকস্মিকভাবে বাঙ্গালিত্বে আত্নবিসর্জন দিয়েছে আর কতটা অন্যবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক কম্পালশন, কনভিনিয়েন্স বা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারনে ধীরে ধীরে এমনিতেই মিশে গেছে - সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ আছে। কারন, সাধারণত এধরণের ক্ষেত্রে হুকুম, হুমকি বা জবরদস্তিতে উলটো ফল হওয়ার কথা - যেমনটা চাকমা / মারমাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। আত্নীকরণের (আত্নবিলোপ বা আত্নবিসর্জন বললেই বোধহয় যথার্থ হয়) বেশির ভাগ ঘটনাই বোধহয় অন্যবিধ কম্পালশন বা কনভিনিয়েন্সের ফসল।

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এটা উপলব্ধি করতে না পারাটা ভ্রান্তিই বৈকি। অবশ্য এই ভ্রান্তিটা কার, বঙ্গবন্ধুর না আপনার, না উভয়েরই - আমি জানি না।

যদি এটাকে ভ্রান্তি বলেই মনে করেন, তবে ভ্রান্তিটা বঙ্গবন্ধুর নয়, আমার তো হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সময়ের মানুষের মনন প্রকাশ পেয়েছে মাত্র, সে মানুষদের মাঝে আমিও আছি, আপনিও আছেন। আপনি ৪০/৫০ আগের সময়কে খুব বেশী আগের সময় বলে মনে করছেন না, ভাল কথা। আপনি কি এ ভূখণ্ডের এমন একজন বাঙ্গালী মানুষের কথা জানাতে পারবেন, যিনি অন্তত ৫০ বছর আগেও এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভুক্ত মানুষদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন? আপনি কঠিন কঠিন শব্দরাজির দ্বারা যাদের উদ্দেশ্যে নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন, তাদের মধ্যে একসময় আমরা সবাই ছিলাম।

বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠী জবরদস্তিমূলক আত্মবিসর্জনের ফল, নাকি স্বাভাবিক কম্পালসান, এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করুন, সমস্যা নেই। কিন্তু যতদূর জানি চাকমা/মারমাদের উপর জাতিস্বত্বা বিসর্জন দেয়ার জন্য কোন জবরদস্তি করা হয় নি।

হিমু এর ছবি

মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের তালুই যারা, তাদেরই একমাত্র এগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই।

arpon bhattacharjee এর ছবি

শেষের পয়েন্টটা নিয়ে আমারও প্রশ্ন ছিল।সব মানুষ এক বিষয় নিয়ে কাজ করবে এটা আশা করা যায় না।লেখাটা ভালো লেগেছে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আমি বরাবর জ্ঞানী বলেই জানি। কিন্তু তৃতীয় খটকাতে এসে যেটা পড়লাম সেটা তো তাঁর জ্ঞান আর পর্যবেক্ষণ শক্তির উপর পুরোপুরি সন্দেহে ঢেলে দিল। কোথায় শাহবাগ, কোথায় হেফাজত আর কোথায় শ্রেনী সংগ্রামের ইস্যু!! এই মন্তব্য খোদ হেফাজত সদস্য শুনলেও হেসে দেবে।

শাহবাগ নিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবির বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার সমস্যা আছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সেই দলে দেখতে হবে ভাবিনি। অবশ্য তিনি নয়াদিগন্তে কলাম লেখেন এটুকু জানলে ওনার কোন মতবাদ নিয়ে মাথাব্যথা থাকতো না। জ্ঞানী লোকদের ট্র্যাশ ক্যানে ফেলতে ফেলতে ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে দেখি!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অবস্থা হয়েছে নোয়াম চমস্কির মত; চমস্কি যেমন সবকিছুতেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছায়া দেখেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও তেমনই সবখানে শ্রেণীসংগ্রাম খুঁজে পান।

Emran

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

শেহাব ভাই সাধারণত তাঁর ব্লগে কোন মন্তব্যের পিঠে কোন মন্তব্য করেন না। সরাসরি তাঁর কোন বক্তব্য বা পর্যবেক্ষণ নিয়ে দ্বিমত বা আলোচনা করলেও না, কেন কা জানে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সকল বিষয়ের কার্যকরণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চান, সুতরাং সকল বিষয়ের মধ্যেই পুঁজিবাদ, শ্রেণী চরিত্র ইত্যকার বিষয়গুলো অবধারিতভাবে প্রবিষ্ট করিয়ে দেন। বিএনপি-জামাতের আর্থিক ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একদল ধান্দাবাজ ধর্ম ব্যবসায়ী তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদ্রাসা ছাত্রদের ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে শাহবাগের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল, এর মধ্যেও তিনি পুঁজিবাদ, শ্রেণী বৈষম্য ইত্যাদি আবিস্কার করে ফেললেন। এমন আরও অনেকেই আছেন- কবি ফরহাদ মজহার, কবি আল মাহমুদ, গণস্বাস্থ্যের ডাক্তার জাফরউল্লাহ, অধ্যাপক এমাজুদ্দিন আহমেদ, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রমুখ। সুতরাং এ বিষয়ে খুব বেশী কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না।

শেহাব এর ছবি

এটা আমার আলসেমি এবং আমি জানি এটা অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে। আমি এই বাজে অভ্যাসটি দূর করার চেষ্টা করছি।

এক লহমা এর ছবি

জ্ঞানী মানুষের সাক্ষাতকার নিয়েছে। সবাই আলোচনা করছেন তাই নিয়ে। ঠিক-ই আছে। আমার শুধু স্ক্রীনশটটা দেখলে মন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। এই পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে আমার লেখা চুরি করে যেত। প্রতিবাদ জানিয়েও কোন লাভ হয়নি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মন মাঝি এর ছবি

অধ্যাপক চৌধুরি হয়তো এটা বলতে চেয়েছেন যে, যা আরও অনেক রাষ্ট্রচিন্তকই সম্ভবত মনে করেন -- একটা পরাধীন জাতি বা রাষ্ট্র-গঠন প্রত্যাশী গোষ্ঠী বা সত্তারই "জাতীয়তাবাদ"-এর প্রয়োজন হয় - রাষ্ট্রগঠন বা নিদেনপক্ষে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের একটি কমন বা শেয়ার্‌ড লক্ষ্যের ছাতাতলে ঐক্যবদ্ধ, সংহত, উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য। তবে একবার তারা নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়ে গেলে তখন আর তাদের "জাতীয়তাবাদ"-এর প্রয়োজন খুব একটা থাকেনা। স্বাধীণ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদকে রিপ্লেস করে তার প্রয়োজন পূরণ করে গণতন্ত্র, সুশাসন, রুল অফ ল, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক উন্নতি, ইত্যাদি। একভাবে দেখলে জাতীয়তাবাদ যদি means বা পথ হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও সুশাসনযুক্ত স্বাধীণ রাষ্ট্র তার end বা গন্তব্য। একবার স্বাধীণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে "জাতীয়তাবাদ" নামক 'tool'-টা যুদ্ধ-টুদ্ধ জাতীয় পরিস্থিতি ছাড়া খুব একটা কাজে আসে না আর, বরং অতি বা অপ্রয়োজনীয় চর্চায় হিতে বিপরীত হতে পারে। তখন বেশি কচলালে এটা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে রেজিমেন্টেশনের পথে, কর্তৃত্ববাদী, সর্বাত্নকবাদী বা ইন্টিগ্রাল জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। জাতীয়তাবাদ তখন প্রায়ই ঐ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে অন্তর্নিহিত বা প্রকৃত আকাংখাগুলি - সিভিল লিবার্টিজ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি বা উন্নতি, সুশাসন, জনস্বার্থরক্ষা - ইত্যাদির চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বা সরাসরি অনিচ্ছাকে গোপন করার জন্য চমৎকার রেড হেরিং + মুগুর বা দুরমুজ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে। পোস্ট-কলোনিয়াল এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশেই বোধহয় আমরা এমনটা দেখেছি। স্বাধীন রাষ্ট্রে তাই ঐ রাষ্ট্রের ফাউন্ডিং প্রিন্সিপলগুলিকে, তার মূল আদর্শ বা আকাঙ্ক্ষার কন্সটিটুয়েন্ট বাস্তব অংশ বা উপাদানগুলিকে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে স্বনামে, স্পষ্টভাবে, আবির্ভূত ও চর্চিত হতে হয়। এর কোন বিকল্প নেই। আমাদের ক্ষেত্রে উল্লেখিত 'জাতীয়তাবাদ' বাদ দিলে - গণতন্ত্র, সুশাসন, সেকুলারিজম আর অর্থনৈতিক উন্নতির আকাঙ্ক্ষা সেই উক্ত ও অনুক্ত মূল আকাঙ্ক্ষা বা মূল আদর্শ। এগুলি আমাদের 'বাঙালিত্বের' সেরা রক্ষাকবচও বটে। আর প্রায় ১০০% বাংলাভাষীর দেশে এই সবগুলি নীতির একসাথে পরিপূর্ণ চর্চাতেও যদি আমাদের 'বাঙালিত্ব' রক্ষা না পায়, তাহলে আমার মনে হয় না পৃথিবীর কোন কিছু দিয়েই তা রক্ষা করা যাবে।

একটা কথা পরিষ্কার করা দরকার, "জাতীয়তাবাদ" বলতে আমি শুধু একটা জাতি বা গোষ্ঠীর নামকরণকে বুঝি না, জাতীয়তাবাদ তার থেকে অনেক বেশি কিছু। এটা একটা মতাদর্শিক আন্দোলন - অন্যান্য উপাদানসহ একটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটিভিত্তিক মতাদর্শের। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ও জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত বিখ্যাত গবেষক এন্থনি স্মিথ এক জায়গায় জাতীয়তাবাদ ও ‘জাতীয় পরিচয়’ কি বোঝাতে গিয়ে বলেন, “জাতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য নির্মাণে ব্যবহৃত প্যাটার্নের মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি, মীথ ও প্রথার রক্ষণাবেক্ষণ ও অব্যাহত পূনরুৎপদন, এবং ঐ বিশেষ ঐতিহ্য আর ঐসব মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি, মীথ ও প্রথার সাথে ব্যক্তির একাত্মবোধ জারি রাখা।” এটা স্রেফ একটা 'নামের' তুলনায় অনেক বিশাল একটা ব্যাপার। এইরকম বিশেষ প্যাটার্নের মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি / ইতিহাস, মীথ ও প্রথার রক্ষণাবেক্ষণ, অব্যাহত পূনরুৎপদন এবং তার সাথে ব্যক্তির একাত্মবোধ জারি রাখার প্রয়াসের পূর্ণ প্রস্তুতি ও আয়োজন ছাড়া শুধুমাত্র একটা শব্দ পরিবর্তণ দিয়ে কি 'জাতীয় পরিচয়' বদলানো যায়, নাকি 'জাতীয়তাবাদের' প্রসারণ ঘটানো যায়? নাকি চাকমা বা মারমারা 'বাংলাদেশি' নামটা ধারণ করার সাথে সাথে নিজেদেরটা বেমালুম বাদ দিয়ে বা ভুলে গিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি, বাঙালির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য নির্মাণে ব্যবহৃত প্যাটার্নের মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি / ইতিহাস , মীথ ও প্রথা - সব লক, স্টক এ্যান্ড ব্যারেল গলধকরণ করে ফেলতেন? নাকি সেটা ফেলানো যেত? নাকি আমরা তাঁদেরগুলি গলধকরণ করতাম নিজেদেরটা বাদ দিয়ে? নাকি ওদেরকে গ্রহণ করানোর জন্য 'বাংলাদেশি' নামের আড়ালে ৩য় ও অভিনব একটা সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটি, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐতিহ্য ও তার নির্মাণে ব্যবহৃত প্যাটার্নের মূল্যবোধ, প্রতীক, স্মৃতি / ইতিহাস , মীথ ও প্রথা উদ্ভাবন করতাম তখন আমরা? আমাদের সেরকম কোন ধারণা, ইচ্ছা বা প্রস্তুতি আদৌ ছিল কিনা সে প্রশ্ন দূর অস্ত, এটা কি আদৌ সম্ভবপর একটা ব্যাপার?

আমার মতে উপরের সবগুলি প্রশ্নেরই একটাই মাত্র উত্তর -- না!

আমার ধারণা আদিবাসীরা কখনই 'বাংলাদেশি' শব্দটার ছদ্মাবরণে এইরকম 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' গিলতেন না বা এর আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্যানিবালাইজিং প্রোগ্রাম, সুন্দরভাবে বললে 'আত্নীকরণের' প্রোগ্রাম মেনে নিতেন না।

তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াচ্ছে? আসলে বাঙালি / বাংলাদেশি যে বিতর্কের কথা আপনি বলছেন, সেটা স্বাজাত্য পরিচয়বোধের লেবেলিং (label) নিয়ে বিতর্কের রূপধারণ করে শেষ পর্যন্ত একটা 'শাব্দিক পরিবর্তনেই' পর্যবসিত হতো। এবং এতে "জাতীয়তাবাদের" কিছুই আসতো যেত না। ট্রাডিশনাল অর্থে যার যার জাতীয়তাবাদ তার তার কাছেই থাকত, 'বাংলাদেশিত্ব' বা অন্য যে কোন নামই দেয়া হোক না কেন, তা
কোন "জাতীয়তাবাদ"-এর রূপধারণ করত না। লারমারা যদি একটা মধ্যম বা সমঝোতামূলক অবস্থান মেনে নিতেনই, আমার বিশ্বাস তারা এটা নিশ্চিত করতেন যে ঐ অবস্থানে (পরিচয়ে) 'বাঙালিত্ব' বা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ'-এর কোন ব্যাগেজ যেন না থাকে। এটা হতো (তারা চাইতেন আরকি) একটা নাগরিকত্ববাদী Civic রাষ্ট্রচেতনার ফ্রেইমওয়ার্কের অধীনে - যেখানে তাঁদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়টা 'বাঙালিত্ব' বা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ'-এর এথনোলিঙ্গুইস্টিক আইডেন্টিটি ও ব্যাগেজের আওতামুক্ত হয়ে একটা সিভিক রাজনৈতিক লেবেল (label) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে শান্তিচুক্তি-পরবর্তী আদিবাসী রাজনীতিকে ধর্তব্যে আনলে মনে হয় এই ওভারআর্চিং লেবেলের অধীনে বা আওতায় তাদের (এবং বাঙালিসহ অন্যদেরও) এথনিক বা এথনোলিঙ্গুইস্টিক জাতিসত্তাগত পরিচয়ও (sub-national identity) একটা স্তর পর্যন্ত অফিশিয়ালি অটুট রাখতে চাইতেন তারা। কিম্বা ঐ সময় - সেটলারবন্যা-পূর্ব যুগে - এই চিন্তা সুনির্দিষ্টভাবে আসতো না হয়তো তাদের মাথায়। জানি না। তা যাই হোক, এই Civic রাষ্ট্রীয় পরিচয়টাকে আমি "জাতীয়তাবাদ" না বলে 'নাগরিকত্ববাদ'-এর বলেই অভিহিত করবো। এই নাগরিকত্ববাদের অধীনে তখন বাঙালিত্ব ও বাঙালি জাতীয়তাবাদও আইনত ও রাজনৈতিকভাবে (টেকনিকালি) একটা জাতিসত্তামূলক (sub-national) পরিচয়ের অধস্তন অবস্থান গ্রহণ করতো, "জাতীয়তাবাদী" নয়। অন্যান্য অনেক দেশে এরকম ক্ষেত্রে কোন একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্তার নামে দেশের বা নাগরিকত্বের নাম না রেখে নিরপেক্ষ নাম রাখা হয়েছে। যেমন - UK (ব্রিটিশ) বা India (ইন্ডিয়ান)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের পক্ষে এতটা অর্জন করা হয়তো সম্ভব হতো না, কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রীয়-পরিচয়ের ('জাতীয় পরিচয়'-এর বিকল্প নাম হিসেবে বলছি) ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের বদলে সে জায়গায় নাগরিকত্ববাদ ও তার ধারণাকে প্রবিষ্ট করানোর সর্বাত্নক চেষ্টা করতেন। এটাই হতো তাদের সমঝোতা, মিড্‌ল গ্রাউন্ড।

ধন্যবাদ।

****************************************

শেহাব এর ছবি

"আমার ধারণা আদিবাসীরা কখনই 'বাংলাদেশি' শব্দটার ছদ্মাবরণে এইরকম 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' গিলতেন না বা এর আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্যানিবালাইজিং প্রোগ্রাম, সুন্দরভাবে বললে 'আত্নীকরণের' প্রোগ্রাম মেনে নিতেন না।"

এই ধারণার ভিত্তি কি?

রানা মেহের এর ছবি

এই বাঙ্গালি-বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে একটা লেখা লিখতে পারেন কিন্তু।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

শেখ মুজিবের প্রতি খুব নির্মম ছিলেন এক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ডাকসু'র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। যার জীবন শুরু হয়েছে তমুদ্দিন মজলিশ দিয়ে। পরে চীনা। স্বাধীনতার পর ১৯৮৫ পর্যন্ত জাসদের প্রতি সমর্থন। ওসমানীকে রাস্ট্রপতি প্রার্থী করে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছেন। সেন্ট গ্রেগরিতে ডক কামালের সহপাঠী ছিলেন স্কুলে ।

১৯৭৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্হ "নিরাশ্রয় গৃহী" ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত "আরণ্যক দৃশ্যাবলী" তে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা আর উল্লেখ করলাম না। স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে ওনার লেখনী থমকে ছিল। যত আক্রমণ আর মিথ্যাচার শেখ মুজিবকে নিয়ে।

১৯৭১সালে মুজিবনগর সরকারের ডাকে সাড়া না দিয়ে স্যার ঢাবিতে নিয়মিত ক্লাস করাতেন। আপনারা কি সেই সিরাজ স্যারের কথা বলছেন?

রিপন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।