আয় বৃষ্টি ঝেপে

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৭/০৫/২০১৬ - ৫:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চৈত্রে বৃষ্টি হবার কথা না কিন্তু এবার তাই হলো। আর এখন বৈশাখ পার হতে চললেও বৃষ্টির দেখা নেই। রাজশাহীতে ব্যাপারটা বরাবর এরকমই হয়ে আসছে। দেখা যাবে আশেপাশে বৃষ্টিতে সয়লাব কিন্তু রাজশাহীতে একটা ফোটাও পড়বেনা। আবার জেলার চেয়েও এক কাঠি সরেশ শহরটা। প্রায়ই এমন হয়েছে রাজশাহী শহরের আশে পাশে দিব্যি বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু শহর খটখটে শুকনো। আবহাওয়াবিদদের জলবায়ুবিদ্যা কি বলে জানিনা কিন্তু মোটের উপর ব্যাপারটা এই। এই ক’দিন আগে আবার বৃষ্টির জন্য একটা বিশেষ নামাজের জামাত অবধি ডাকা হলো। এই নামাজের ভঙ্গী বড় অদ্ভুত। সাধারন নামাজে দু’হাত মোনাজাতের ভঙ্গীতে তোলা হয় যেন আঁজলা পেতে রাখা হয়েছে, দু’হাতের তালুই আকাশমুখী অথচ এই নামাজে হাতের তালু থাকবে মাটিমুখী। অর্থাৎ আঁজলা উল্টে পানি ঢেলে ফেলে দেবার মত ব্যাপারটা। তো এই নামাজ পড়ার পর দুই কি তিন দিনের মাথায় আচমকাই মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আসতে শুরু করলো চারদিক। বিকেল চারটার দিকেই ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী ঝড়। সেই ঝড়ে পদ্মার শুকনো চরের সব বালু এসে গোটা শহরটাকে পাউডার মাখিয়ে দিয়ে গেল। বোধহয় আরো গরমে যাতে শহরের ঘামাচি না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখানে সেখানে রাস্তার ধারে বিশাল কয়েকটা পুরনো গাছ উপড়ে পড়ে একটা কার আর একটা রিকশাকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে দিল। কিন্তু বৃষ্টি হলোনা। কেউ কেউ অবশ্য বলে ছিল ঝড় শুরুর প্রথম দিকে দু’এক ফোটা বৃষ্টি পড়েছিল, কিন্তু সে যথার্থ অর্থেই গুড়ে বালি। কেননা ঝড় শেষ হবার পর শ্রেফ বালিই পাওয়া গেল পানি নয়। গোটা ব্যাপারটা শুকনো রেখেই ঝড় এলো এবং গেলো, বৃষ্টির আবহ সঙ্গীতটা বাদ রেখেই।

তো এই অবস্থায় শহরের মানুষের মুখে ঘুরে ফিরে বৃষ্টির কথাই চলে আসে বার বার। বয়স্কদের স্মৃতি হাতড়ে খরার গল্প আর বৃষ্টির গল্প বেরিয়ে আসতে থাকে। ছেলেপুলেদের আড্ডাতেও সেই একই কথা বৃষ্টি কবে হবে। রাজশাহীতে বরাবরই আবহাওয়া চরমপন্থী। ঠাণ্ডা গরম দু’টোই সীমা ছাড়িয়ে যায়। কয়েক বছর যাবত গরমটা নিরেট পড়লেও ঠাণ্ডাটা ভালো মত পড়তে চাইছেনা। শীতটা দু’মাসের জায়গায় একমাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরমটা তাই সে অনুপাতে খাটো না হয়ে লম্বাই হয়ে গেছে।

আমাদের আড্ডাতেও তাই সেই বৃষ্টিরই গল্প। তোজাম্মেল ভাই একটা ক্লিনিকের ম্যানেজার দেশের বাড়ি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা। ছেলেবেলায় দেখেছেন অনেকদিন যাবত বৃষ্টি না হলে আশে পাশের গ্রামের মানুষ খোলা মাঠে সকাল দশটা সাড়ে দশটার কঠিন রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেত নামাজ পড়তে। যারা এই নামাজের জামাতে যেতেন তারা সবাই উল্টো করে কাপড় পরতেন এই সময়, পরনের কাপড়ের সেলাইয়ের দিক গুলো থাকতো বাইরের দিকে। মোনাজাতের সময় দু’হাত উল্টো করে মাটির দিকে ধরা হতো কিনা সে সংক্রান্ত কিছু তোজাম্মেল ভাইয়ের মনে নেই। একজনের স্মৃতি আরেক জনেরটা উস্কে দেয়। আর সেই সূত্রেই শাহীন স্মৃতিচারন শুরু করে। শাহীনদের পারিবারিক ব্যবসা আমের বাগান করা। বাড়ি গোমস্তাপুর উপজেলার রোহনপুরে। সময়টা ১৯৮০-৮১ সালের মত হবে, সে সময় একবার অনেক দিন বৃষ্টি না হওয়ায় রোহনপুরের দামাল ছেলেদের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডাল সংগ্রহ শুরু করে। এই চাল-ডাল নেবার সাথে সাথেই তারা এক একটা বাড়িতে ঢুকে টিনের চালের উপর উঠে বালতিতে করে পানি গড়িয়ে দেয় চালের উপর। সেই পানি যখন অঝোর ধারায় নিচে পড়ছে তখন দলের বাকি ছেলেরা সেই পানিতে লুটোপুটি শুরু করে আর সেই সঙ্গে চলতে থাকে “আল্লা ম্যাঘ দে, পানি দে” গান। পানি পড়ার জায়গাটা কাদা কাদা হয়ে গেলে সেই কাদাই সবাই গায়ে মাখতে থাকে। এরকম ভাবে কয়েকটা বাড়ি ঘুরে পানি ছিটিয়ে চাল-ডাল চাঁদা তুলে শেষটায় একটা বনভোজন করে তবেই এর সমাপ্তি। সে সময় ধারনা করা হতো এই আনুষ্ঠানিকতার ফলেই বৃষ্টি নামবে। রোহনপুরেরই আরেক বাসিন্দা আমাদের আড্ডার মনিমামাকে এই অনুষ্ঠানের কথা জিজ্ঞেস করলে জানান এই কাদায় হুটোপুটির সাথেই ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হতো। মূলত এক জোড়া ব্যাঙ নিয়ে তাদের বিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই এই পানি ছিটানো আর কাদা মাখামাখিটা ছিল। আমাদের আরেক বন্ধু মতিনের ছেলেবেলাটা কেটেছে ভারতে মুর্শিদাবাদে। সেখানকার রেজিনগর থানার কোন এক গ্রামে ছিল তার নানাবাড়ি। মতিনের স্মৃতিতেও দেখি ব্যাঙের বিয়ের এই ঘটনাই। তবে মতিনের মনে আছে সব আনুষ্ঠানিকতার শেষে ব্যাঙ জোড়াকে জোর করেই একটু মিষ্টি মুখ করে দেওয়া হতো, হাজার হলেও বিয়ে বলে কথা। আঙ্গুলের ডগায় একটু ক্ষীর বা পায়েস নিয়ে ব্যাঙের মুখে দিয়ে দেওয়াই ছিল মিষ্টিমুখ। এই ঘটনাও ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যেই ঘটতে দেখেছিল মতিন। রোহনপুরের মনিমামা বলেন আগে বৃষ্টি নামানোর জন্য ছেলেপুলেদের এই খেলা বা বৃষ্টি আকর্ষক অনুষ্ঠানটা প্রায়ই হতো, পরের দিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেই এই সবকে ধর্মবিরোধী বলে ভাবা শুরু হয় মূলতঃ বর্ষীয়ানদের পক্ষ থেকেই। তারপর থেকে বৃষ্টির প্রার্থনা করে নামাজেরই কেবল চল থাকে এই খেলা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বৃষ্টির জন্য এই ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া বা এই জাতীয় লোকজ আনুষ্ঠানিকতা বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই এক সময় প্রচলিত ছিল। কৃষি প্রধান দেশে বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব নিয়ে বেশি কথা খরচ না করলেও চলে। আর তাই যথা সময়ে বৃষ্টির জন্য যাদু-বিশ্বাস মূলক এই সমস্ত লোকজ অনুষ্ঠান বা রিচুয়াল গুলো এক সময় যথেষ্টই ছিল। এখনও ভারতের গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই ব্যাঙের বিয়ের কথা শোনা যায়। পৃথিবীর সর্বত্রই এ ধরনের রিচুয়াল গুলো যে প্রচলিত ছিল তা স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের গোল্ডেন বাও বইটা পড়লেই জানা যায়। খুব সম্প্রতি বইটার বাংলা অনুবাদও বেরিয়েছে। অনুবাদটা হাতে থাকলে এখন কাজে আসতো। কিন্তু বইটা এখনও সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। আমার কাছে যে ইংরেজি বইটা আছে তার সরনাপন্ন হওয়া ছাড়া এখন গতি নেই। আদিবাসী বা উপজাতীয় বলে পরিচিত সমাজ বা সম্প্রদায় গুলোয় যাদু শক্তি সম্পন্ন ওঝারা তাদের যাদু (?) দিয়েই তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন। গোল্ডেন বাও বইটা পঞ্চম অধ্যায়টির শিরোনাম দ্য ম্যাজিক্যাল কন্ট্রোল অব ওয়েদার। এই অধ্যায়েই বর্ণিত হয়েছে বৃষ্টি নামানোর বিভিন্ন রিচুয়ালের বর্ণনা। শুরুতেই জর্জ ফ্রেজার বলছেন,

Of the things which the public magician sets himself to do for the good of the tribe, one of the chief is to control the weather and especially to ensure an adequate fall of rain. Water is essential of life, and in most countries the supply of it depends upon showers. Without rain vegetation withers, animals and men languish and die. Hence in savage communities the rain maker is a very important personage; and often a special class of magicians exists for the purpose of regulating the heavenly water supply. The method by which they attempt to discharge the duties of their office are commonly, though not always, based on the principle of homeopathic or imitative magic. If they wish to make rain they simulate it by sprinkling water or mimicking clouds.

অনুকরনমূলক বা সাদৃশ্যমূলক যাদুবিশ্বাসের উৎপত্তি সম্ভবত আদিম যুগেই। সে সময়কার আদিম মানুষ যখন প্রকৃতিকে ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। প্রাকৃতিক ঘটনা সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞানটাও ভালো ভাবে অর্জিত হয়নি তখন সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই মানুষ এক ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার সম্পর্ক আবিস্কার করতে চাইতো। আর এ থেকেই সেই যাদুবিশ্বাসের উৎপত্তি ফ্রেজার যাকে বলেছেন হোমিওপ্যাথিক ম্যাজিক। বৃষ্টি আসলে ঘরের চাল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, হোমিওপ্যাথিক যাদুতে তাই ধারনা করা হয় ঘরের চাল দিয়ে অন্য উপায়ে পানি গড়িয়ে দিলেও বৃষ্টি চলে আসবে। রোহনপুরের বাচ্চাদের ঘরের টিনের চালে পানি ঢালার ঘটনার পেছনেও এই রকম হোমিওপ্যাথিক যাদু বিশ্বাসেরই পরিচয় পাওয়া যায়। মাটিতে পানি ঢেলে কাদা তৈরী করা সেই কাদায় লুটোপুটির ঘটনাও সেই একই সূত্র থেকেই এসেছে।

ফ্রেজারের বর্ণনায় পাচ্ছি, রাশিয়ার ডরপাটের কাছেই এক গ্রামে বৃষ্টি আবাহনের এক লোকজ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হতো এক সময়। তিন জন লোক একটা গাছে উঠে যেত। একজন কেটলী বা ধাতব কোন পাত্রে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে বজ্রপাতের আওয়াজের অনুকরন করতো, আরেক জন আগুনের ফুলকি সৃষ্টি করে বিদ্যুৎ চমকানোর অনুকরন করতো আর তৃতীয় জন একটা পানির পাত্রে গাছ থেকে ভেঙ্গে নেওয়া পাতা সমেত একটা ছোট শাখা ডুবিয়ে সেই পানি নিচে ছিটাতে থাকতো। বৃষ্টিপাতের এই অনুকরনের ফলেই সত্যিকারের বৃষ্টি এসে যাবে এই ছিল তাদের বিশ্বাস। পশ্চিম নিউগিনির হালমাহেরা দ্বীপেও আমরা দেখি এক ওঝা এভাবেই এক বিশেষ গাছের শাখা পানিতে ডুবিয়ে সেই পানি চারদিকে ছিটিয়ে বৃষ্টি আনবার প্রয়াস করছে। বৃষ্টির অভাবে ভুট্টার ক্ষেত শুকিয়ে যেতে থাকলে উত্তর আমেরিকার ওমাহা ইণ্ডিয়ানদেরও দেখি প্রায় এধরনের যাদুবিশ্বাস মূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। একটা পাত্রে পানি রেখে সেটাকে ঘিরে হতো নাচ। নাচতে নাচতেই কেউ একজন তা থেকে মুখে পানি নিয়ে চারদিকে ছিটাতে শুরু করতো। এভাবেই এক সময় পানির পাত্রটা পুরোই উল্টে মাটিতে ঢেলে ফেলা হতো, বাকি সবাই সেই পানি মাটি থেকেই পান করতো আর কাদা গায়ে-মুখে মাখতে শুরু করতো। সেন্ট্রাল এ্যানগোনিল্যাণ্ড জায়গাটা ঠিক কোথায় জানিনা তবে ফ্রেজার বলছেন এখানে একটা বৃষ্টির মন্দির আছে। ঠিক সময়ে বৃষ্টি না আসলে তারা এই মন্দিরে এসে একটা রিচুয়াল পালন করতো। তাদের নেতা সেখানে একটা জায়গার ঘাস কেটে পরিস্কার করা হতো তারপর একটা পাত্রে বিয়ার ঢেলে তা মাটিতে পুতে ফেলা হতো। দলের নেতাই এই কাজটা করতেন। এর পরই নেতাটি দেবতার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করতেন “প্রভু চৌটা, তুমি তোমার হৃদয়কে কঠিন করে ফেলেছো, আমাদের এখন কি হবে। আমরাতো ধ্বংস হতে বসেছি। তোমার প্রতি বিয়ার উৎসর্গ করা হয়েছে, তুমি তোমার সন্তানদের বৃষ্টি দাও।” এরপর সবাই বাকি বিয়ারটুকুতে চুমুক দেবে এমনকি ছোটরাও বাদ যাবেনা। তারপর গাছের শাখা নিয়ে সবাই নাচবে, সঙ্গে চলবে বৃষ্টির গান। বৃষ্টির মন্দির থেকে গ্রামে ফিরে তাদের হাতের বৃক্ষ শাখা পানিতে ভিজিয়ে সেই পানি চারদিক ছিটাতে থাকবে তারা। উত্তর অষ্ট্রেলিয়ার মারা ট্রাইবেও বৃষ্টির জন্য এধরনেরই লোকজ অনুষ্ঠান পালিত হতো। যিনি বৃষ্টি আনবেন এরকম যাদুশক্তি সম্পন্ন ওঝা একটা পুকুরের কাছে গিয়ে প্রথমে সুর করে কিছুক্ষণ যাদুমন্ত্র আউড়াতে থাকবে তারপর মুখে পানি নিয়ে চতুর্দিকে ছিটাতে থাকবে। তারপর পানি তুলে নিজের সমস্ত শরীর ভিজিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে চুপচাপ গ্রামে ফিরে আসবে। মারা ট্রাইবের বিশ্বাস এরপর বৃষ্টি আসতে দেরি হবেনা।

বাংলাদেশে আর ভারতে গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট শিশুদের ব্যাঙের বিয়ে দেবার সময় পানি ছিটানো আর সেই পানি মাটিতে ঢেলে কাদা করা আর সেই কাদায় হুটোপুটির ঘটনা গুলো ফ্রেজারের সংগৃহীত বৃষ্টি আহ্বানের ঘটনা গুলোর সাথে মিলে যায়। ব্যাঙের বিয়ে দেওয়াটাও বৃষ্টি আনার জন্যই। এক্ষেত্রে যা শিশুদের খেলা ফ্রেজারের বর্ণনায় দেখি তা পূর্ণবয়স্ক মানুষরা সামাজিক ভাবেই পালন করছেন। তবে এই মানুষ গুলো প্রায় ক্ষেত্রেই আদিবাসী, সভ্যতার স্পর্শ থেকে দূরে তাদের অবস্থান। সভ্যতার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবার দরুনই এদের জীবন ধারা ছিল আদিম ধরনের। তাদের আদিম সংস্কৃতি যখন সভ্য মানুষের গোচরে আসে তখন সভ্য মানুষটাও উপলব্ধী করে সভ্য হয়ে ওঠার আগে তাদের আদিম পূর্বপুরুষরাও এরকম সংস্কৃতিরই ধারক বাহক ছিলেন। এই সংস্কৃতি, অনুষ্ঠান অনেক সময় যুগের পর যুগ প্রজন্ম পরম্পরায় বাহিত হতে হতে আমাদের এখনকার ঐতিহ্যও হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ঠিক সেই আগের রূপে নয়, সময়ের স্রোতে অনেক খানি বদলে যাওয়া তবু সেই উপাদান গুলোকে এখনও চেনা যায়। এক সময়ের বৃষ্টি আনবার গুরু গম্ভীর যাদু অনুষ্ঠান শেষে ছোটদের ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। ছোটদের খেলা হলেও বড় দের প্রচ্ছন্ন সমর্থনই দেখিয়ে দেয় এই রিচুয়াল গুলোয় প্রাপ্তবয়স্কদেরও বিশ্বাস এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পূর্বপুরুষ থেকে যে সংস্কৃতি উত্তর পুরুষে প্রবাহিত হয়ে এসেছে তা ছেলেখেলায় পাল্টে গেলেও তার কার্যকারিতায় বিশ্বাস এখনও খানিকটা হলে সক্রিয় আছেই। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এইসব রিচুয়াল যখন একটা সম্প্রদায়ে বা সমাজে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের সাথে অনুষ্ঠিত হতে থাকে তখন মনের ভেতর এই সংস্কারই আসন গেঁড়ে বসে। আমরা দেখি সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যায় এক ধর্ম আরেক ধর্মকেও প্রতিস্থাপিত করে ফেলে কিন্তু রিচুয়াল গুলো থেকেই যায়। অনেক সময় নতুন ধর্মও তার প্রচারের স্বার্থে এই প্রাচীন রিচুয়াল গুলোকে আত্মস্থ করে ফেলে বা একটা সময় অবধি মেনে নিতে থাকে। ফলে এই রিচুয়াল গুলো সামান্য বা বিশেষ কোন পরিবর্তন ছাড়াই অনেক অনেক যুগ অবধি অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। ডায়নোসরের প্রস্তরীভূত হাড় যেমন ফসিল হয়ে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক সময়টার খবর দেয় তেমনি এই রিচুয়াল গুলোও অনেক সময়ই প্রাচীন ও আদিম সংস্কৃতির ফসিল হয়ে আমাদের সেই প্রাথমিক পর্বের মানব মনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

সার্বিয়ায় বাচ্চা মেয়েরা তাদের মধ্যে একজনকে ঘাস, লতা-পাতা, ফুল দিয়ে আপদামস্তক ঢেকে দিত। এমন করেই লতা পাতায় বাচ্চা মেয়েটা ঢাকা পড়তো যে তার চেহারা অবধি দেখা যেতনা। তাকে তখন ডাকা হতো ডডোলা বলে। সেই ডডোলাকে নিয়ে মেয়েরা গ্রামের এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি গিয়ে নাচতো। ডডোলা মাঝখানে দাঁড়িয়েই লাট্টুর মত ঘুরতে থাকতো আর তাকে ঘিরে বাকি মেয়েরা বৃত্তাকারে নাচতো। সঙ্গে চলতো ডডোলার বিশেষ গান। গান বা ছড়ার অনুবাদ আমার সাধ্যের বাইরে, ডডোলা গানের ভাবার্থ শুধু তুলে দিচ্ছি এখানে, “আমরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাই, আর আকাশ দিয়ে যায় মেঘ। আমরা ছুটতে শুরু করি, ছুটতে শুরু করে মেঘও। শেষে মেঘ আমাদের থেকে এগিয়ে যায় আর ভিজিয়ে দেয় আমাদের ক্ষেতের ফসল।” এক একটা বাড়িতে এই নাচ আর গান চলবার সময় সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী ডডোলার ওপর পানি ঢেলে দেয়। বৃষ্টি আনবার এরকম লোকজ অনুষ্ঠান ইয়োরোপের আনাচে কানাচে বিভিন্ন গ্রামে এক সময় অনুষ্ঠিত হতো। জেমস জর্জ ফ্রেজারের গোল্ডেন বাও বইটিতে এধরনের প্রচুর অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়া আছে। প্রায় অনুষ্ঠান গুলোতেই দেখা যায় গ্রামের কিশোর বা তরুণরা তাদের একজনকে সবুজ লতাপাতায় মাথা থেকে পা অবধি ঢেকে সাজিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার যেমন কেক বা ডিম এধরনের চাঁদা তোলে। আর গৃহকর্তা বা কর্ত্রী তাদের চাঁদা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সেই লাতা-পাতা ঢাকা তরুণের ওপর জল ছিটিয়ে দেয়। সব বাড়ি প্রদক্ষিণ শেষ হলে তরুণরা গ্রামের প্রান্তে গিয়ে কোন নদী, ঝর্ণা বা পুকুরে তাদের লতাপাতায় আচ্ছাদিত সঙ্গীকে ছুড়ে দেয়। সে তখন শরীর থেকে সেই লতা পাতা খুলে পানিতে ভাসিয়ে জল থেকে উঠে আসে। শেষে বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা খাদ্য সম্ভার দিয়ে চলে তরুণদের বনভোজন। ধারনা করা হয় এই আনুষ্ঠানিকতার ফলে বৃষ্টি ভালো হবে আর সেই সাথে গ্রামের শস্য উৎপাদন ভালো হবে, গবাদি পশুর পালেও বৃদ্ধি দেখা দেবে।

এই অনুষ্ঠান গুলোর সাথেই এবার তুলনা করা যাক আমাদের ব্যাঙের বিয়ে সংক্রান্ত লোকজ শিশুদের অনুষ্ঠানটির। এখানেও আমরা দেখি শিশুরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলে ও সেখানে পানি ছিটিয়ে, কাদা মেখে বৃষ্টির আবাহন আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। এই যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ আর প্রতিটি বাড়ির উঠোনে কাদা মাখামাখি এসবের মাধ্যমেই বোঝা যায় এটা একটা সামাজিক অনুষ্ঠানই ছিল এক সময়। গ্রামের সকল সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়াসেই তা স্পষ্ট। ইয়োরোপের ভূখণ্ডে যেমন তেমনি আমাদের ভূখণ্ডেও আমাদের যে আদিম পূর্বপুরুষরা ছিলেন তারা এই একই আদিম চিন্তাধারা থেকেই বৃষ্টি আহ্বানের যাদু অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। চিন্তা ধারার এই সাদৃশ্য এই জন্যই ঘটেছে কেননা আদিম যুগে যখন সভ্যতার উপাদান গুলো যথেষ্ট আবিস্কৃত বা উদ্ভাবন হয়নি তখন প্রায় সব মানব সমাজই প্রায় একই ধরনের পরিবেশেই বাস করতো। প্রকৃতি আর কিছু সরল জীবীকার হাতিয়ার এই নিয়েই ছিল তাদের জীবন-যাত্রা আর তাই তাদের সংস্কৃতিতে ও চিন্তা-চেতনায়ও দেখা যেত এই সাদৃশ্য।

তথ্যসূত্র :
The Golden Bough : A Study of Magic And Religion
James George Frazer. First Published in 1890.


মন্তব্য

মিতা চার্বাক এর ছবি

ভালো লাগলো চলুক

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ঈয়াসীন এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ ঈয়াসীনভাই

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

তথ্যাক্রান্ত হবার আগ পর্যন্ত লেখাটা দারুণ ছিল সোহেল ইমাম, প্রথম দুটো প্যারাগ্রাফ মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। একবার নাহয় সেরেফ নিজের কথাগুলোই লিখলেন.........
---মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

তথ্যটার জন্যই যে লেখা মোখলেসভাই। নিজের কথা লিখবো সে শক্তি বেশি নেই। ধন্যবাদ মোখলেসভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক বাহ: চমৎকার!

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ দারুণ! এই প্রথম রিকশাচিত্রের বাইরে লিখলেন কি? আরও লিখুন! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

গোল্ডেন বাউ কিনে বাসায় রেখে এসেছি দু'মাস আগে, পড়ে ফেলতে হবে।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার বইমেলার ছবিতেই বইটার অনুবাদ প্রথম দেখি। বইটা কোন প্রকাশনী থেকে বের করেছে, একটু জানানো যায়কি? অনেক অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বিপিএল থেকে বেরিয়েছে, শাহবাগের পাঠক সমাবেশে পাবেন।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সোহেল ইমাম এর ছবি

আবারো ধন্যবাদ, বইটা যোগাড় করে ফেলতে হবে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

পরাধীন এর ছবি

ভালো লিখেছেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ভালো লাগলো, রাজশাহী শহরটিতে কখনো যাওয়া হয়নি।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ। আমদের নিরিবিলি শান্তির শহরে স্বাগতম যে কোন সময়। তবে ইদানীং শান্তিটা বিঘ্নিত হচ্ছে, আগের মত নেই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।