দুটি প্রায়গল্প

সাঈদ আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন সাঈদ আহমেদ (তারিখ: সোম, ০৪/১০/২০১০ - ৮:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিচার
ছোট্ট অপুরও যে একটা মন আছে এবং সেই ছোট্ট মনটা যে এখন ভীষন খারাপ তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবা ডাকছেন। ছোট বোনটার উপর তাই ভীষণ রাগ হচ্ছে। এই রাইমাটা এমন পাজী। ঠিকই গিয়ে বাবাকে নালিশ করেছে। আচ্ছা, বড় ভাই হিসেবে না হয় ওকে একটা কিলই দিয়েছি, তাই বলে ভ্যাঁ করে কেদে-কেটে নালিশ করতে হবে কেন? 
 
অপুর বাবা নেজামত সাহেব পত্রিকা পড়ছিলেন। অপু তার কাছে গিয়ে দাড়ালো। রাইমাটা পাশেই বসে আছে, যেন কিছুই জানে না। শুধু মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকাচ্ছে ভাইয়ার দিকে।
 
: অপু! বাবার গম্ভীর গলা।
: জ্বী বাবা?
: তুমি রাইমাকে মেরেছো?
: আমি শুধু… এটুকু বলতেই বাবা থামিয়ে দেয় তাকে।
: তোমাকে বলেছি না, কাউকে মারা অন্যায়?
: জ্বী
: অন্যায় করলে কী হয়?
: শাস্তি হয়। কিন্তু আমিতো শুধু…
: কোন কিন্তু না বাবা… তোমাকে এটা শিখতে হবে, অন্যায় যত ছোটই হোক, তা অন্যায় এবং অন্যায় করলে তার বিচার হবে। ছোট আপুকে সরি বলো।
: সরি। অনেক কষ্টে অস্ফুটে উচ্চারন করে সে।
: আজ তোমার ভাগের চকলেটটা রাইমাকে দিয়ে দেবে। এটাই তোমার শাস্তি…
 
বাবার কথা শেষ হবার আগেই ক্রিং ক্রিং শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
 
: আচ্ছা, তোমরা যাও এখন, খেলা করো গিয়ে। বলেই নেজামত সাহেব ফোনটা ধরলেন।
মন খারাপ করে ফিরে যেতে উদ্যত হয় অপু। বাবাটা শুধু রাইমাকে ভালোবাসে। তাকে একটুকুও ভালোবাসে না। আর রাইমাটাও… কিছু হলেই খালি বিচার দেয়।
 
যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাড়ায় অপু। বাবা ফোনে তার ‘বিচার’ নিয়ে কী যেন বলছেন। বাবাটা যে কী, সবাইকে নিশ্চই জানিয়ে দিচ্ছে এখন! কথা ভেসে আসছে, অপু মনোযোগ দেয়। বড়দের কথায় কান দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু কৌতুহলও দমানো যাচ্ছে না।
 
: … গনহত্যার বিচার আবার কী? এইগুলা হইলো পলিটিক্স, বুঝলেন না? এত বছর পর এইসব বিচার-ফিচারের কোন দরকার আছে?...
 
বাবার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। তবে সম্ভবত তাকে নিয়ে কিছু বলছে না। খেলতে গিয়েও কী মনে করে কিছুক্ষন পর বাবার কাছে ফিরে আসে অপু।
নেজামত সাহেব ততক্ষনে ফোন রেখে দিয়েছেন। দলের ভেতর কিছু পাতি নেতা তৈরি হয়েছে। এরা ঝামেলা করছে। এদিকে কী সব পুরোন বিষয় তুলে জল ঘোলা করতে চাইছে সরকার। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। সামনে অনেক কাজ।
 
: বাবা
: হুম? পত্রিকায় চোখ রেখেই অন্যমনষ্ক হয়ে উত্তর দেন তিনি।
: গনহত্যা কী বাবা?
: কী বললে? নেজামত সাহেবের চেহারায় কাঠিন্য আর বিষ্ময় একসাথে ফুটে ওঠে।
: আমি আর রাইমা গনহত্যা গনহত্যা খেললে তো তুমি আমাদের বিচার করবে না, তাই না?
 
নেজামত সাহেবের কথা আটকে যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে অপু তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে। নেজামত সাহেব হাতের পত্রিকাটা নামিয়ে রাখেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় তিনটি লোকের আবক্ষ ছবি। তারাও যেন প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
 
 
 খুনি জামাই
 
নিবিষ্ট মনে চা বানাচ্ছিল বদিউল। হাটবার হলো তার চা স্টলের ব্যবসার দিন। দুই হাটুরেকে চা দিয়ে দোকানটা আবার একটু গোছানো শুরু করলো। টিনের সাইনটা বাকা হয়ে গিয়েছে, ওটা সোজা করে আরেকবার পড়লো সে-“বাকী দিতে বড় কষ্ট, বাকীতে বন্ধুত্ব নষ্ট”।. কোন লাভ হয়নাই এটা লাগিয়ে। তারপরও লোকে টাকা বাকী রেখে চা খেয়ে যায়।
 
: ওই বদিউল, কড়া লিকার দিয়ে একটা চা দে তো।
: জ্বে মাস্টারসাব।
 
মাস্টারসাবকে দেখে বদিউলের মনটা ভালো হয়ে গেল। তিনি এখন পত্রিকাটা নিয়ে বসবেন। লোকজন ভীড় করে তার কাছে খবর শুনতে আসবে। তিনি শুধু খবর পড়েই শোনান না, মজার মজার ব্যাখ্যাও দেন। বদিউল নিজেও মোটামুটি পড়তে জানে। কিন্তু মাস্টারসাবের কথায় কী যেন আছে! এতো দোকান থাকতে মাস্টারসাব যে তার দোকানেই খবরের জমায়াত বসান, এটা নিয়ে বদিউলের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যত শ্রোতা, তত বিক্রি। কোত্থেকে বুড়ি করিমন পাগলিও এসে হাজির। বুড়ি এমনিতে চুপচাপ থাকে, তবে মাঝে মাঝে মেয়ের কথা মনে করে পাড়া মাথায় তোলে।
 
মাস্টার সাব পত্রিকা পড়া শুরু করেছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অবশ্য খবর একটাই। মুনির-খুকুর বিচার। একই খবর প্রতিদিন, লোকজন তারপরও আগ্রহ নিয়ে শুনে।
 
: চিন্তা করছো ব্যাপারটা? স্বয়ং রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ট লোক, তারপরও বিচার না করে উপায় নাই। পাবলিক একাট্টা হয়ে এমুন খেপছে যে এখন আর কোন নড়ন-চড়ন নাই। আগে বিচার, তারপর কথা। এই হইলো পাবলিকের শক্তি। রাজা-বাদশাও কিছু করতে পারেনা…
 
বদিউলের হাতের চামচ চায়ের কাপে একটা ছোট্ট ঘূর্ণিঝড় তোলে। দুধ-চা-চিনির মিশ ঠিকমত না হলে চায়ের স্বাদ হয়না।
 
: কত লোকেই তো কত ভাবে মারা যায়। ঠিকমত বিচারও পায় না। কিন্তু এমন নিষ্পাপ একটা মেয়ে যদি জামাইর হাতে খুন হয়ে যায়, তখন পাবলিকের না ক্ষেইপা উপায় আছে? বিচার দেখবা হবেই হবে।
 
মাস্টারের কথা শুনতে শুনতে বদিউল নিজেই ভাবনার জগতে চলে যায়। অভ্যস্থ হাত চা পরিবেশন করে চলছে ঠিকই, কিন্তু মন চলে যায় রিমা-হত্যার ঘটনায়। আহারে মাইয়াডা।
 
হঠাৎ চিৎকারে বদিউলের সম্বিত ফেরে। করিমন পাগলি চিৎকার করে কাঁদছে আর গালমন্দ করছে সবাইকে। বদিউলের মনটা খারাপ হয়। জন্মের পর থেকেই সে দেখছে একে। বাড়িতে এলে মা সবসময় তাকে খাবার দিত। আর বদিউলকে বলতো যেন কখোনও এই পাগলিকে নিয়ে হাসাহাসি না করে। আদরের মেয়ের মৃত্যুতেই নাকি বেচারির এই অবস্থা। কিন্তু তবু এখন তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। নইলে সব কাস্টমার ভাগিয়ে দেবে। সপ্তাহের এই দিনটা অন্তত ব্যবসা ক্ষতিকরা ঠিকনা। উনুনের পাশ থেকে কাক তাড়ানোর লাঠিটা নিয়ে বের হয় বদিউল। মাস্টার পত্রিকা পড়া থামিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। পাগলিটা এই কিছুক্ষন আগেও ছিল মাস্টারসাবের মুগ্ধ শ্রতা। আর এখন চিৎকার করে চলছে-
 
: আমার মাইয়াডার যদি খুনি জামাই হইতো… আল্লাগো, মাইয়াডার যদি খুনি জামাই হইতো! চাইতি তোরা, তাইলে চাইতি আমার মাইয়ার খুনের বিচার?
 
বদিউল দাড়িয়ে যায়। মায়ের কাছে শোনা করিমন পাগলীর পাগল হয়ে যাবার কথা মনে করে সে। যুদ্ধের বছর করিমনের তের বছরের মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মতি রাজাকার। তিন মাস পর পাকিস্তানি ক্যাম্পের পাশের নর্দমায় পাওয়া যায় মেয়েটার ক্ষত-বিক্ষত লাশ। সেই থেকেই করিমন হয়ে যায় করিমন পাগলি। কী করবে বুঝতে পারে না সে। এদিকে পাগলিটা বলেই চলছে-
 
: একটা খুনের বিচার চাইতে পারলি তোরা, আর লাখে লাখে মাইয়াগুলারে নিয়া কী কষ্ট দিল, কষ্ট দিয়া মাইরা ফালাইলো, তার বিচার চাইবি না? এইটা কেমুন বিচার তোদের?
 


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বলার কোন ভাষা নেই। (গুড়ের ইমো দিতে পারি না মন খারাপ )
শুধু একটাই দাবি, "গণহত্যার বিচার চাই, এটা নিয়ে কোন পলিটিক্স চাই না"।

পাগল মন

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

সেইটাই .. ন্যায় বিচারের আবার রাজনীতি কি?

-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

দ্রোহী এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

তিরিশ লক্ষ স্বজন হত্যার বিচার চাই।


কাকস্য পরিবেদনা

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

যারা বলে, একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত সব মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করতে হবে, তাদের বলি-- আসুন একাত্তর থেকেই শুরু করি... বিসমিল্লায় গলদ রেখে তো আগানো যাবে না
-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

সহমত


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

অনবদ্য। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মইত্যা রাজাকারদের বিচার চাই।

অনন্ত

সাঈদ আহমেদ এর ছবি
ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এক অর্থে এগুলোতো গল্প - 'প্রায়গল্প' হতে যাবে কেনো?
আরেক অর্থে এগুলোতো গল্প নয়, সত্য ঘটনা - 'প্রায়গল্প' হতে যাবে কেনো?

কোনো প্রকার যুক্তি-কুযুক্তি-মানবতা-সময়কাল-হ্যানো-ত্যানো-সাপ-ব্যাঙ অজুহাতে পাকিস্তানী খুনীদের আর তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিচার করা ও শাস্তি দেয়া বন্ধ করা যাবেনা।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। প্রায়গল্প আসলে গুনগত কারনে... প্রথম (অপ)চেষ্টা কিনা!
-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

দুটোই ভালো লাগলো।

অ.ট. দুটোকে আলাদা আলাদা করে দিলে হতো। দুঃখজনক, কিন্তু সত্যি বারবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন আছে। আর বিচার সম্পন্ন হলেও মনে রাখার প্রয়োজন আছে। আচ্ছা, আবার আরো লিখুন না হয়...
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

অশেষ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

রানা মেহের এর ছবি

ম্যাসেজ হিসেবে ঠিক আছে, কিন্তু গল্প হিসেবে ভালো লাগেনি।
দুটো গল্পই প্রথম লাইন থেকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো তাদের পরিনতির দিকে।
গল্পে চমক থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবু এতোটা অনিবার্য গল্প পড়তে ভালো লাগেনা।
অন্যভাবে নেবেন না প্লিজ।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

সাঈদ আহমেদ এর ছবি

অন্যভাবে নেবার কিছু নেই... প্রবন্ধ লেখক প্রথম (প্রায়/অ)গল্প লিখতে গেলে এমন হবেই :)এটা একটা প্রবন্ধের 'বাই-প্রডাক্ট'.... মূল প্রবন্ধটা শিঘ্রই পোস্ট করবো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-----------
চর্যাপদ

-----------
চর্যাপদ

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

চলুক
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

যদিও মাঝে এসে বুঝতে পেরেছি, কিন্তু শেষমেশ ভালো লেগেছে!

বিশেষত এই লাইনটা:

আমি আর রাইমা গনহত্যা গনহত্যা খেললে তো তুমি আমাদের বিচার করবে না, তাই না?

আরও লিখুন! হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

অতিথি লেখক এর ছবি

মোটামুটি ভালোই লেগেছে।
সামনে আরো ভালো গল্প পড়ার প্রত্যাশা রইলো।

- শায়ের আমান,

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।