যুদ্ধশিশু

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৩/২০১৫ - ১০:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে সব গবেষণা বা পরিসংখ্যানে বোধহয় সবচেয়ে উপেক্ষিত থাকে আমাদের যুদ্ধশিশুরা- যাদের জন্ম হয়েছিলো একাত্তরের বিভীষিকার মধ্যে। আমি জানি না কোন পরিসংখ্যান আছে কিনা একাত্তরে এবং পরবর্তীতে কতজন শিশু যুদ্ধের কারণে নিহত হয়েছিলো। স্বাভাবিক সময়ে একটা শিশুর জন্মের সময় এবং পরে কত যত্ন-আত্তি, হাসপাতাল-ক্লিনিকে ছুটোছুটি করা লাগে। ছয় বছর আগে আমার মেয়ের যখন জন্ম হলো, তার আগের দিন রাতে হাসপাতালে চলে গিয়েছিলাম, ভোর পাঁচটায় ডাক্তার এলেন ঘুম থেকে উঠে। সকাল ন’টায় হলো জন্ম। এরপর দু’দিন হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরে এলো। তারপরও কতবার গেলাম ডাক্তারের কাছে- এই টীকা, ঐ টীকা আরো কত কিছু! একাত্তর সালের সেই নয় মাস এসব কোন সুবিধা কি তখন ছিলো?

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যখন গণহত্যা শুরু হলো আমার মা তখন প্রায় পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা। আম্মার কাছে শুনেছি খাটের নিচে লুকিয়ে মা-বাবা সারারাত মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনেছেন, দু’একটা গুলি নাকি আমাদের মালিবাগের বাসার টিনশেডের ছাদেও এসে পড়েছিলো। পরদিন সকালে কিছু সময়ের জন্য মনে হয় কারফিউ শিথিল করা হয়েছিলো। সেই সময় সবাই ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিলো। আমার বাবা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই চট্টগ্রামে। এই অবস্থায় আম্মাকে নিয়ে চট্টগ্রামে যাওয়া সম্ভব না। হঠাৎ এই সময় বাসায় এলেন আব্বার কলিগ মিজান সাহেব। ওনাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। যাবার আগে খোঁজ নিতে এসেছেন। মিজান সাহেব এসেই বললেন, আপনারা এখনই মুন্সীগঞ্জ চলেন, এখানে থাকলে আপনাদের মেরে ফেলবে। আব্বা একটু আমতা-আমতা করতে লাগলেন- কিন্তু বাইরে তো কোন গাড়ি-ঘোড়া নেই, আপনার ভাবীর পক্ষে এতদূর হেঁটে যাওয়া কী সম্ভব হবে! বাইরে আসলেই সব ফাঁকা, শুধু মানুষ পালাচ্ছে দিকবিদিকশূন্য হয়ে।

মিজান সাহেব করিৎকর্মা মানুষ। তিনি কোত্থেকে একটা খালি রিকশা যোগাড় করে আনলেন। তারপর আম্মাকে রিকশায় বসিয়ে ফেরিঘাট পর্যন্ত তিনি নিজেই রিকশা চালিয়ে নিয়ে গেলেন। আম্মা পরে আমাকে বলেছিলো, সেদিন মিজান যা করলো মানুষ তার আপন বোনের জন্যও কোনদিন করে না। মিজান সাহেব পরে যুদ্ধে গিয়ে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। আমার অনেক গর্ব যে এই লোকটাকে আমি চিনি। মুক্তিযোদ্ধারা যে কী বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন এই লোকটাকে না দেখলে বোঝা সম্ভব না।

ফেরি থেকে মুন্সীগঞ্জ যেতে যেতেই পথে মিজান সাহেব আরো লোক জুটিয়ে ফেললেন ওনাদের বাসায় আশ্রয় দেয়ার জন্য। সে এক বিশাল কাফেলা। পথে এক হিন্দু মহিলা জানালেন, দূরে কোথায় যেন আরো কয়টি হিন্দু পরিবারের আশ্রয় দরকার। কিন্তু তারা ভয় পাচ্ছে নিজে থেকে আসতে। তিনি গিয়ে যদি নিয়ে আসেন তবে ভালো হয়। মিজান সাহেব আব্বাকে কাফেলার দায়িত্ব দিয়ে বললেন, আপনি তো চেনেন আমাদের বাড়ি, বাকী পথটুকু সবাইকে নিয়ে যান, আমি ওদের নিয়ে আসি। আব্বা একদিন গুণে দেখেছিলেন প্রায় ১৫০ জন ওই সময় তাদের বাড়িতে আশ্রিত ছিলো।

মুন্সীগঞ্জ পালিয়েও অবশ্য আমার আম্মার বেশি সুবিধা হলো না। পাক আর্মি কিছুদিন পরপরই হানা দিতে লাগলো। যখন আর্মি রেইড হয়, তখন সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বনে-জঙ্গলে, পুকুর-ডোবায় যে যেখানে পারে লুকিয়ে থাকে। প্রসবের সময় যত ঘনিয়ে আসলো, আমার আম্মার পক্ষে এভাবে রেইডের সময় দৌড়াদৌড়ি করে লুকিয়ে থাকা ততই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। তখন ঠিক হলো মুন্সীগঞ্জের আরো ভেতরে জঙ্গলের মধ্যে মিজান সাহেবদের একটা পুরনো ঘর আছে, ওনাদের এক বৃদ্ধা খালা থাকেন সেখানে। এত ভেতরে জঙ্গলের মধ্যে আর্মি ঢোকার সম্ভাবনা খুব কম। ওখানে আম্মাকে রেখে আসা হবে।

আমার বোনের জন্ম হলো সেই জঙ্গলের মধ্যে। না, কোন ডাক্তার, কোন হাসপাতাল, কোন ওষুধ, পথ্যের বালাই ছিলো না। প্রতিকূল পরিবেশে জন্মের কারণে বোধহয় তার রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাও ঠিকমতো গড়ে উঠতে পারে নি। দেড় বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশেই একদিন সাধারণ ডায়রিয়া হয়ে আমার বোন মারা গেলো। আমার আম্মার খুব আফসোস ছিলো, ইস মেয়েটা যদি বেঁচে থাকতো। আমার বাবা এখনো বলে, কোলে নিলে বাচ্চা কেমন শান্ত থাকতো। আমাদের বাসায় একটা আমার বোনের একটা ছবি আছে। সেটা দেখতে একদম আমার মেয়ের মতোই লাগে।

আজ বাংলাদেশের জন্মদিন। দেখতে দেখতে কেমন করে চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেলো। বেঁচে থাকলে আজ চুয়াল্লিশ বছরেরই একটা বোন থাকতো আমার। প্রতি বছর বাংলাদেশের বয়স বাড়ে, আর আমিও সেই সাথে হিসাব করি বয়স বাড়ছে আমার বোনের- বেয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ...

And I know you are shining down on me from Heaven
Like so many friends we have lost along the way
And I know eventually we'll be together
One sweet day...


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আমাদের কতো হাজার ভাইবোনের বয়স যে বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে! আমরা হিসাবও রাখিনা!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

মন খারাপ

তিথীডোর এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

চরম উদাস এর ছবি

মন খারাপ
আমার বড় ভাইয়ের জন্ম ১৯৭১ এ। ২৭ এ মার্চ, ১৯৭১। কয়েকদিন বয়েসি ভাইকে নিয়ে মাকে খানাখন্দে ঢুকতে হয়েছে বারবার, পালাতে হয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বারবার।

নজমুল আলবাব এর ছবি

সময় করে একদিন বীর প্রতীক মিজানকে নিয়ে কিছু লিখুন। হয়তো আপনি ছাড়া তার কথা লিখার মতো আর কেউ নাই। আপনি না লিখলে তার কথা কেউ জানবে না কোনদিন।

সবজান্তা এর ছবি

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা পরিবারের (রাজাকার বাদে) কতো কষ্টের মধ্যে দিয়ে দেশটার জন্ম। অথচ মাত্র চুয়াল্লিশ বছরের মধ্যেই আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেলো অতীতের গোলমাল- যে অতীতকে পিছে ফেলে, মিলেমিশে দেশকে আগানোর কথা বলার মধ্যেই সবটুকু স্মার্টনেস!

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

চলুক মন্তব্য করবার ভাষা নেই।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

তাসনীম এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটা।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আয়নামতি এর ছবি

মন খারাপ

তানভীর এর ছবি

সবাইকে অনেক কৃতজ্ঞতা।

একটা ছোট ডিসক্লেইমার। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে 'যুদ্ধশিশু' শব্দটা এ পর্যন্ত শুধুমাত্র নির্যাতনের ফলে জন্ম নেয়া শিশুদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কেন তা আমার জানা নেই। বিশেষ করে 'যুদ্ধশিশু' নামের একটা চলচ্চিত্র এ ধরনের শিশুদের উদ্দেশ্য করে নির্মিত হয়েছিলো। কিন্তু শরণার্থী শিবির থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু হিসেবে জন্ম নেয়া প্রচুর শিশু এসময় চিকিৎসা ও পরিচর্যার অভাবে মারা গিয়েছে। এ লেখায় মূলত তাদের কথাই বোঝানো হয়েছে। মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে "War baby" উল্লেখ করা হয়েছে- "a person born or conceived during a war" এবং সর্বপ্রথম ১৯০১ সালে ব্যবহৃত হয়েছিলো বলে জানা যায়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

........................ মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুবোধ অবোধ এর ছবি
গৃহবাসী বাঊল এর ছবি

ল্যাবের কাজ ঠিকমত হচ্ছে না, উ্পরন্তু বেশ হোমসিক হয়ে আছি; সকাল থেকেই মনটা খারাপ। আপনার লেখাটা তাই চোখের কোণা আর্দ্র করল। আসলেই তো, এভাবে কখনো চিন্তা করিনি। বাংলাদেশে এই রকম হাজার হাজার পরিবার আছে যারা কারো না কারো বয়স গুনে যায়, বছরের পর বছর। বাবা-মার কাছে কেমন লাগে ওই বয়সের কাউকে দেখলে, বা ওই দিনটির কথা মনে হলে? বড় ভাই-বোনের কাছেই বা কেমন লাগে অনুজের অনুপস্থিতি বা সেই বয়সের কারো সান্নিধ্য? ছোটদের কাছেই বা কেমন লাগে, যখন তারা জানে যে তাদের বড় কেউ ছিল যে বেঁচে থাকলে আজকে এত বছরের হত? লেখাটা পড়ে খুব খারাপ লাগছে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

মনটা উচাটন হয়ে গেল। সেই সময়ের পরিস্থিতির কথা অনুমান করার চেষ্টা করলাম মন খারাপ

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

লেখাটা পড়ে লগিন করলাম।

কেনো করলাম, জানি না। হয়তো একটা নির্লিপ্ততা, হয়তো একটা এমন বোধ যার প্রকাশভঙ্গী আমার অজানা, হয়তো একটা সূক্ষ বেদনাবোধ- যার উৎস কোথায় সেটা অহংকারী আমি আমার নিজেকেই বলতে দিচ্ছি না। কিছু একটা হবে।

... অনেকদিন পরে লিখলেন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যুদ্ধ শিশুদের মায়েদের ত্যাগের কথা কেউ বলে না। তাদের কষ্টটাও কেউ বিশেষ বোঝে বলে মনে হয় না।

পোস্টটা মনে করিয়ে দিল এই ব্যাপারে আমার নিজের একটা লেখা বকেয়া আছে। শীঘ্রই বকেয়াটা শোধ করতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

মুক্তিদ্ধের সময় সাতকোটি লোকের নিশ্চয়ই কম করে হলেও সাতকোটি গল্প আছে। এই গল্পগুলো ঠিকভাবে লেখা হবার আগেই এই লোকগুলো হারিয়ে যাবেন। কোনো একটা দিন আমরা আবিষ্কার করব মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ্য সাক্ষী একজন মানুষও হয়ত আর অবশিষ্ট নেই। সব গল্পগুলো লিখে ফেলা যেতো!

বীর প্রতীক মিজান সাহেবের কথা আরও জানতে আগ্রহী তানভীর ভাই।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করে উঠল। আসলে যুদধ শিশুদের নিয়ে আরো লিখা সময়ের দাবি।ইতিহাসে তারা থাকবে না, কেমন কথা।
এনি মাসুদ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার ছোট মাসির জন্ম ভারতে,একাত্তরে। কতবার শুনেছি-গরুর গাড়ি আর পায়ে হেঁটে ভারতে যেতে আমার দিম্মা’র কত কষ্ট হয়েছে। সীমান্তে এক বাড়িতে জল খেতে চেয়েও পায়নি। বাড়িওয়ালাদের দোষ দিই না, তারা হয়তো নিজেরাই এসব নিয়ে অনেক ঝামেলায় থাকতো কিন্তু তৃষ্ণাকাতর অন্ত:স্বত্তা দিম্মা’র কত কষ্ট হয়েছিল সে সময়!

আপনার লেখা পড়ে ঘটনাটা মনে পড়ল-আপনার বোনের জন্য কিছু লেখার ভাষা নেই।

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শ্রদ্ধা

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রানা মেহের এর ছবি

আপনার দেড় বছরের বোনটাকে চোখের সামনে দেখলাম তানভীর ভাই।
কান্না পেয়ে গেল লেখাটা পড়ে।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তানিম এহসান এর ছবি

চোখ ভরে জল চলে এল আপিসের ভেতর! কোলাকুলি

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

"কালো বরফ" উপন্যাসের কথা মনে হল আপনার লেখাটি পড়ে।
দোয়েল পাখি দেখার দৃষ্টিই বদলে গিয়েছিল আমার, বইটি পড়ে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।