স্মরণীয় চলচ্চিত্র: আইখমান- একজন নৃশংস খুনির বিচার

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শুক্র, ১৩/০১/২০১২ - ১:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে বসে আছি কফির আড্ডায়, দেশ থেকে খবর আসল রাজাকার নেতা কারাগারে। এর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে আমাদের আজব রাজনীতিবিদদের কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি! মনে পড়ে গেল এই শহরেই গ্রেফতার হয়েছিল গা ঢাকা দিয়ে থাকা নাৎসি অপরাধী আইখমান। আর বুক ফুলিয়ে দেশের ক্ষতিসাধন করতে থাকা রাজাকারকে ফাটকে পুরতে আমাদের লাগল চার দশক ! সেই অনুভূতি থেকেই পোস্টটা দিলাম। নাৎসিদের মাথাদের যেহেতু বিচার হয়েছে, বাংলার মাটিতে রাজাকারদের বিচার হতেই হবে, হতেই হবে। জনতাই করবে সেই বিচার।

(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ—এখানে প্রিয় কিছু চলচ্চিত্রের গল্প বলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছি মাত্র, এটা কোন মুভি রিভিউ নয়, কারণ এমন চলচ্চিত্র নিয়ে রিভিউ লেখার জ্ঞান বা প্রজ্ঞা কোনটাই আমার নেই, এটি স্রেফ ধারা বিবরণী। কাজেই যাদের চলচ্চিত্রটি এখনো দেখা হয় নি, তারা আগে দেখে ফেললেই ভাল হয়, নতুবা সব ঘটনা জানলে হয়ত আগ্রহ কিছুটা কমে যাবে। এমন লেখার ব্যাপারে সকল ধরনের পরামর্শ স্বাগতম। লেখায় ব্যবহৃত আলোকচিত্রগুলো নেট থেকে সংগৃহীত )

এডলফ আইখমান, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড ফেরারি। নাৎসি বাহিনীর এক মহা ক্ষমতাশালী কর্মকর্তা হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কলমের এক খোঁচায় সে ঠেলে দিয়েছে গ্যাস চেম্বারের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে অমানুষিক মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে মারা যাবার জন্য, তাদের একমাত্র অপরাধ- তারা ছিল হিটলারের পাগলাটে স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা! বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলে এর গোয়েন্দা সংস্থা মোসাডের অন্যতম কাজ হয়ে দাড়ায় ইহুদী নিধনের হোতা প্রাক্তন নাৎসিদের খুজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করা আর সেই তালিকার প্রথমেই ছিল আইখমানের নাম।

FRANCIA-JUSTICIA/HISTORIA

অবশেষে ১৯৬০ সালে তার সন্ধান মেলে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে, ছদ্ম নামে ছদ্ম পরিচয়ে দিব্যি আসর জমিয়ে বসেছে সে। মোসাড এজেন্টরা তাকে গ্রেফতার করে ইসরায়েলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়, ততদিনে তাকে তৎক্ষনাৎ ফাঁসীতে ঝুলানো রীতিমত গণদাবীতে পরিণত হয়, কিন্তু ইসরায়েলী কতৃপক্ষ তার বিচারের ভার সে দেশের সিভিল কোর্টের উপর ছেড়ে দেয়। উল্লেখ্য ২য় বিশ্বযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জন্য মাত্র এই একজনকেই ইসরায়েলে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।

ব্রিটিশ পরিচালক রবার্ট ইয়ং-এর আইখমান চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইসরায়েলে কারাগার অবস্থানের সময়কালীন সেই সময়ের গূঢ় আবহ। চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র দুইজন, আইখমানের চরিত্রে অভিনয়কারী বিখ্যাত জার্মান অভিনেতা টমাস ক্রেফতমান এবং তার ইন্তারোগেটর তরুণ ইসরায়েলী ক্যাপ্টেন আভনের লেস, যার ভূমিকায় ছিলেন আমেরিকান অভিনেতা ট্রয় গ্যারিটি।

Eichmann (2007)

প্রথম থেকেই দেখানো হয় জেরার মুখে আইখমান তার অপরাধের সপক্ষে কি কি যুক্তি তুলে ধরে। তাদের কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে আসে মানব জাতির ইতিহাসের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ের কিছু ধামাচাপা দেয়া ঘটনা। প্রত্যক্ষ ভাবে কয়েক লক্ষ ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর দায়ী ছিল আইখমান। কিন্তু আত্নপক্ষ সমর্থন করে আইখমান জানায় সে ছিল কেবল মাত্র হুকুমের তাবেদার , হিটলার ও উপরের কর্মকর্তাদের পাঠানো আদেশ কেবলমাত্র পালন করে গেছে একনিষ্ঠভাবে।

এক পর্যায়ে সাড়া জাগানো এই বিচারে ক্যাপ্টেন আভনের লেস ঠিকই প্রমাণ হাজির করে শুধুমাত্র হাঙ্গেরিতেই মাত্র দেড় বছরে সাড়ে চার লক্ষ ইহুদী নাগরিককে (শিশু, বৃদ্ধ- বৃদ্ধা সহ) মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ছিল সে, যা ছিল নাৎসিদের তথাকথিত ইহুদী সমস্যার শেষ সমাধান অর্থাৎ তাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার মহা পরিকল্পনার এক অংশ। কিন্তু ১৯৪৫ সালে হিটলারের ডান হাত হ্যাইনরিখ হিমলার এই হত্যাযজ্ঞ অজ্ঞাত কোন কারণে থামানোর আদেশ পাঠালেও আইখমান সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে তার পৈশাচিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। অফিসিয়াল নির্দেশ পাশ কাটিয়ে সে তার ব্যক্তিগত খেয়াল খুশী মত পাগলাটে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায় সোভিয়েত বাহিনীর হাঙ্গেরি বিজয় পর্যন্ত, তার পরপরই সে আত্নগোপন করে।

101705-large

এদিকে বিচারকার্যের আড়ালে চলতে থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল কুটিল খেলা। ১৯৬২ সালের তৎকালীন পশ্চিম জার্মান সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল সাবেক নাৎসি, জার্মান সরকারের ভয় ছিল আইখমানের বিচার যে ভাবে বিশ্বের নজর কেড়েছে হয়ত পরবর্তীতে সেই হোমরা-চোমড়াদের বিচারের দাবী উঠতে পারে। তারা গোপনে ইসরায়েলের সাথে এই বিষয় নিয়ে মতৈক্যে আসে যে সরকারে থাকা নাৎসিদের বিচারের ব্যপারে ইসরায়েলের আদালত উচ্যবাচ্য করবে না।

2009_eichmann_006

এদিকে ফুঁসে ওঠে ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ, স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষত তখনো তাদের মনে টাটকা, অনেকের শরীরেই নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অত্যাচারের অমোচনীয় চিহ্ন। একের পর এক বিক্ষোভে যোগ দেয় তারা, পিকেটিঙয়ে জড়িয়ে পড়ে নিজ দেশের পুলিস বাহিনীর সাথেই। ক্রোধোমত্ত জনতার একটাই দাবী- আইখমানের ফাঁসী চাই।
অবশেষে আদালতে ১৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় আইখমানকে, যার অন্যতম ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ। চলতে থাকে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, আত্নপক্ষ সমর্থন।
ক্যাপ্টেন আভনের লেসও চারপাশের নানা প্রতিকূলতা শর্তেও সুষ্ঠু বিচারের দাবীতে অনড় থাকেন। ইন্টারোগেশনের এক পর্যায়ে সে জিজ্ঞেস করে, নাৎসিরা জিপসিদের খুন করেছিল কেন, কোন অপরাধে, কোন যুক্তিতে? নির্লিপ্ত ভাবে ঘোড়েল আইখমান উত্তর দেয়, এমনিতেই, কারো কারো মনে হয়েছিল জিপসিরা হিটলারের স্বপ্নের জার্মানির জন্য আবর্জনা, তাদের নির্মূল করাটাই যুক্তিযুক্ত। ক্যাপ্টেন লেস হতবাক হয়ে কোন মতে জিজ্ঞেস করেন, কেবল মাত্র কারো মনে হবার কারণে তোমরা পাঁচ লক্ষ জিপসির তরতাজা প্রাণ কেড়ে নিলে!! এতটা নিষ্ঠুর মানুষের চিন্তাও হতে পারে কি করে!

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইখমান দাবী করে যায় সে কোন সময়ই অ্যান্টি-সেমিটিক অর্থাৎ ইহুদী বিদ্বেষী ছিল না, কেবল মাত্র থার্ড রাইখের শত্রু হিসেবে যারা চিহ্নিত ছিল তাদের বিরুদ্ধে সে রাষ্ট্রের জন্যই এমন খড়গহস্ত হয়েছিল। অথচ, তার নানা অতীত কর্মকাণ্ডে পরিষ্কার বোঝা যায় ব্যক্তিগত কারনেও সে বিদ্বেষী ছিল এই সম্প্রদায়ের উপর আর সেই কারণেই তাদের নির্মূলের পরিকল্পনায় সে ছিল এত উৎসাহী ও তৎপর। বিশেষ করে তার কারণেই বেশ কয়েক লক্ষ শিশু হত্যা হয়েছিল।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, অকাট্য প্রমাণ ও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বেঁচে আসে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আদালতে বিচারে ফাঁসির রায় হয় আইখমানের, সেই রায় কার্যকর করা হয় ১৯৬২ সালে ৩১ মে।

mid-Eichmann_trial_news_story.ogg

২০০৭ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি প্রথমে ব্রাজিলে মুক্তি পায়, পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে তা ২০০৯ সালে প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রের শেষ মুহূর্তে আসল ক্যাপ্টেন আভনের লেসের কণ্ঠ ভেসে আসে পর্দায়, আইখমানের বিচার নিয়ে বক্তব্য পেশ করেন তিনি।

এই সিনেমার মূল আকর্ষণ আইখমানের ভূমিকায় অভিনয়কারী টমাস ক্রেফতমানের অসাধারণ অভিনয়, একজন ঠাণ্ডা মাথার জাত খুনির মত শীতল ক্ষুরধার চাহনী, নির্লিপ্ত কণ্ঠ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাব পর্দায় হয়ত ক্ষণিকের জন্যও আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে মনুষ্যত্বে কলঙ্ক এঁকে দেয়া এই হীনমণ্য জীবগুলোর কথা।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

চমৎকার! চলুক

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

চলুক যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই।

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

লাবণ্যাপ্রভা এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

জালিস এর ছবি

আমি ও যে কবে ঘুরতে যামু মন খারাপ

খালি ঘুরতে থাকেন । শুভকামনা রইল কোলাকুলি

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

তাপস শর্মা এর ছবি

বিচার হোক......... প্রতিবাদ হোক......

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

অতিথি লেখক  এর ছবি

আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই ..................খুব ভালো লাগলো ...........

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

অকুতোভয় বিপ্লবী এর ছবি

তিরিশ লক্ষ স্বজন হারানো মানুষের চোখের পানি তো শুকিয়ে যায়নি, সম্ভ্রম হারানো দু'লক্ষ নির্যাতিতা নারীর কান্না তো আজও শুনতে পাওয়া যায়, তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কেন হবে না? চল্লিশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার জন্যই? চল্লিশ বছরে কি ইতিহাস মুছে গেছে?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।

------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

চরম উদাস এর ছবি

চমৎকার চলুক

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

BABA ZAFOR এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

বিচার হতেই হবে --

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

বিচার হতেই হবে --

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

উচ্ছলা এর ছবি

আনস্মার্ট, আইলসা লোকজন সবসময় কাজ না করার জন্য বাহানা বের করে, ছুতানাতা খোঁজে।

বাংলাদেশ সরকারের মত এরকম পোতাইন্যা, বেকুব জিনিস দুনিয়াতে দুটো নেই। রাজাকারগুলোকে কিভাবে দুধ-কলা দিয়ে পুষে যাচ্ছে গত চল্লিশ বছর ধরে ! ছিঃ

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দারুণ।
আমি অনেক আগে একটি লেখা লিখেছিলাম আইখম্যান প্রসঙ্গে!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

তারেক অণু এর ছবি

পড়েছিলাম আপনের লেখাটা।
বিচার হতেই হবে---

অমিত এর ছবি

"কলমের এক খোঁচায় সে ঠেলে দিয়েছে গ্যাস চেম্বারের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে অমানুষিক মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে মারা যাবার জন্য, "

গ্যাস চেম্বারে কিন্তু পুড়িয়ে মারা হত না।আগে মেরে ফেলা হত সায়ানাইড(zyklon B) অথবা কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস দিয়ে। এরপর দেহ পুড়িয়ে ফেলা হত।

লেখায় চলুক

তারেক অণু এর ছবি

ঠিক! গুলিয়ে গিয়েছে লেখায়, ধন্যবাদ।

অমিত এর ছবি

একই মন্তব্য দুইবার আসায় ঘ্যাচাং

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

ফারুক হাসান এর ছবি

পুরো সিনেমাটা দেখা যাবে এখানে-

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

ন এর ছবি

চলুক বিচার হবেই...

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

নীহার এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

বিচার হতেই হবে---

পঞ্চক এর ছবি

ডাউনলোড দিলাম

তারেক অণু এর ছবি
সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

প্রিয় একটা মুভি।
চলুক

তারেক অণু এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।