চুম্বন

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০৪/২০০৮ - ১০:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এভাবে বিদেয় করে দেয়া হলো! খুব রাগ হলো মালতীর। হোক না সে আধপাগলী, কারো ক্ষতি তো কখনো করেনি। যে বাচ্চাকে এত আদরে রাখে সারাদিন, তাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবারও অধিকার নেই! একটু নাহয় দেরীই হলো! ফিরে তো এসেছে। সেজন্যে এভাবে চাকুরী ছাড়িয়ে দেবে? তাকে নাকি আদর করে বেটি! বড়লোকের আদরের এই ধরণ! সে ই বা ছেড়ে দেবে কেন? ফ্রীজ খুলে আস্ত এক মুরগী নিয়ে এসেছে কাপড়ের আড়ালে।

নিজের ডেরায় ফিরে মালতী মুরগীটাকে তার তক্তাপোষের নীচে একটি ভাঙ্গা মাটির হাড়িতে বসিয়ে দিল। প্রতিদিন একটি করে ডিম পাড়বে, সে ডিমেই চালিয়ে দেবে খাওয়া দাওয়া। ঘরে অল্প কিছু চাল তো আছে! তারপর দেখা যাক কপালে কি হয়! আপাতত: কিছু গালাগালি ঝেড়ে পোড়া কপালে কয়েকটি চাপড় মেরে ঘুমোতে গেল মালতী।

প্রতিদিন তো দুরের কথা, তিনদিনেও কোন ডিম পাড়লো না মুরগী। ভয়ংকর রেগে গেল মালতী। শাস্তি হিসেবে একটি একটি দড়িতে বেঁধে রেখে দিল দরজার বাইরে। যদি কোন মোরগের সাথে ফষ্টিনষ্টি হয়ে যায়, তাহলে হয়তো ডিমও পাড়তে পারে। কিন্তু মুরগীপঁচা গন্ধে আশে পাশের ডেরার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। যে ই কিছু বলতে এলো, এতোদিনের আধপাগলী মালতীকে পুরো পাগল অবস্থায় দেখে পিছিয়ে গেল ভয়ে। পাশের ডেরার গোবেচারা লোকমান মাঝে মাঝে খোঁজ নিত মালতীর। মাঝে সাজে এটা সেটা জোগাড়যন্ত্রে সাহায্যও করতো। সেও কিছু বলতে এসে বলার সাহস না পেয়ে ফিরে গেল।

একসময় বিরক্ত হয়ে এটাকে কাঁচাবাজারের মুরগী বিক্রেতা রমজান মিয়ার কাছেই বিক্রি করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল মালতী। মুরগী ডিম দেয়না- বন্ধ্যা, তাকে রেখে কি লাভ? বরং মুরগীর দামে কিছু সস্তা শাকসবজী কিনলে বেশীদিন চলতে পারবে। বড়লোকেরা মুরগী কিনে অনেক সময় চামড়াটি রেখে যায়। সে চামড়া তাকে খুব সস্তায় দেয় রমজান মিয়া। আর সুযোগ বুঝে মাঝে মাঝে গায়েও হাত দিয়েছে। যদিও ভাল লাগেনি, তারপরও বাড়ী ফেরার পর একধরণের শিরশিরে অনুভুতি হয়েছে ভেতরে। সে অনুভুতিটা কিন্তু ততটা খারাপ লাগে নি।

একটু দুরে থাকে মধ্যবয়স্ক রিক্সাচালক রশিদ। একসময় কবি রশিদ হিসেবে শহরে বেশ নামডাকই হয় তার। ছেড়া কাগজে কবিতা লিখেছে-

“জীবন যখন মধুর ভাবি
ক্ষুধা তখন কথা বলে,
রিকশা চলার তালে তালে,
শরীরটা মোর নুয়ে পড়ে।“

এটা লিখেই বিদগ্ধ মহলের নজরে পড়ে রশিদ। পত্রিকাতেও ছবি সহ বেশ বড়সড় সাক্ষাতকার ছাপানো হয়। অশিক্ষিত কবিকে শিক্ষিত করার পরিকল্পনায় স্কুলেও ভর্তি করা হয় তাকে। এমনকি তাবৎ রিক্সাচালকের মাঝেই কবি প্রতিভা খোঁজার হিড়িক পড়ে শহরে। হিড়িক যতো দ্রুত পড়ে, মিইয়ে যায় তারচেয়ে তাড়াতাড়ি। তাই কিছুদিন পরই কবি রশিদ আবার রিক্সাচালক রশিদে পরিণত হলো। কিন্তু শহরের লোক ভুলে গেলেও বস্তির লোক আজও সে কাহিনী ভুলতে পারে নি। এই বস্তিতে এখনও বেশ সন্মানই করা হয়।

দু’দিন পর রশিদ এলো মালতীর ডেরায়। বস্তির নানা দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হবার পরও এই পঁচা মুরগীর দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিতে হলো। দেখলো ঘরের ভেতরে মেঝেতে গুম মেরে আছে মালতী। চেহারায় রাজ্যের রাগ এসে আষাঢ়ের মেঘের মতো ভর করেছে। একটু ভয় পেলেও পিছিয়ে গেলো না রশিদ। দরজার বাইরে থেকেই মালতীর দিকে সাবধানে তাকিয়ে বললো,

- মুরগিডা এইখানে বানছ কেন্ বইন? গন্দ ছাড়তাছে।
- আমার মুরগী দরজাত বানমু না চান্দে বানমু, তোমার কি?
- মইরা গেছে, তুমি কইলে ময়লার লগে ফালাইয়া দিতাম!
- আমার সোন্দর মুরগীটা ময়লার লগে ফালাইবা, এইডা কেমন কতা? তোমরা কি পাগল অইছ?

বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মালতী। দরজা থেকে একটু সরে দাড়ালো রশিদ। মুরগীটাকে ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক থেকে পরখ করলো মালতী। গন্ধও বুঝি লাগলো নাকে।

- এইডা ত দেহি সত্য সত্যই মইরা গেছে? একটা ডিম না পাইড়াই মইরা গেল?
- হ বইন। গন্দ বারাইছে। দেই ফালাইয়া?
- না, আমার মুরগী ময়লাত ফালামু না!
- তয় কি করবা বইন?
- মানুষ মরলে জানাজা পড়ায়, কবর দেয়। এই মুরগীর লাগি ও জানাজা পড়ামু, কবর দিমু।
- মুরগীর জানাজা কেডা পড়াইব বইন! খালি কবরই দেও।
- না, জানাজা পড়ামু। তুমি পড়াইবা জানাজা।

দু’টো ব্যাপারে রশিদের কোন সন্দেহ রইল না। এক, মালতী এখন পুরো পাগল। দুই, জানাজা পড়ানোই এই পাগলীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ। তাই তাতেই রাজী হলো সে।

ডেকে আনা হলো লোকমানকে। করিমনের ছোট ছেলেটা ডাংগুটি খেলছিল একটু দুরে। তাকেও আনা হলো। মুরগীটাকে সামনে রেখে জানাজা পড়াতে পড়াতে কোন না কোন কারণে রশিদের পুরোনো কবি প্রতিভা জেগে উঠলো আবার। মোনাজাতের সময় মুরগী জন্ম, জীবন, মরণ নিয়ে বেশ হৃদয়গ্রাহী একটি বক্তৃতাও দিয়ে ফেললো। সে বক্তৃতায় এতই আবেগ, তাতে দ্রবিভুত হয়ে জ্ঞান হারালো মালতী।

মাথায় পানি ঢালা হলো অনেক। তবু জ্ঞান ফিরলো না মালতীর। ডাক্তার আনবে, সে পয়সা কোথায়? মুখে মুখ লাগিয়ে করে ফু দিয়ে শ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে, ভাবলো রশিদ। করিমনের ছেলেকে খুঁজলো। কিন্তু সে ততক্ষনে পালিয়েছে। লোকমানকেই বলে কয়ে রাজী করানো হলো।

কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা ভয়ে এদিক ওদিক তাকালো লোকমান। তারপর ঝুকে পড়লো মালতীর মুখের উপর। আবার মুখ তুলে রশিদের দিকে তাকালো। রশিদের ইশারায় মুখ লাগালো মালতীর মুখে। কিছুক্ষনের মাঝেই সুস্থ হয়ে এদিক ওদিক তাকালো মালতী। চেহারা আচ্ছন্ন এক ভাব। গভীর এক সুখানুভুতিতে যেন ভরে আছে ভেতরটা। লজ্জিত মুখে একবার লোকমানের, আরেকবার রশিদের দিকে তাকিয়ে একটি কাগজে সাবধানে মুরগীটি ফেলে এলো ভাগাড়ে।

লোকমান আর মালতীর মিলন হয়েছিল কি না, সে কথা এ গল্পের বিষয়বস্তু নয়। তবে সেই বস্তিতেই যে একটি গরীব পরিবার তাদের তক্তাপোষের নীচে মুরগীর খোয়াড় সাজিয়েছে, সেটা লোকমুখে এখনও শোনা যায়। বস্তির অধিবাসীরা নাকি সেখান থেকেই ডিম কেনে ন্যায্যদামে।


মন্তব্য

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আরেকটা অদ্ভুত গল্প!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

সত্যিই অদ্ভুত !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

শাহীন হাসান এর ছবি

খুব ভাল-লিখেছেন তীরন্দাজ।
গল্পের চোয়াল বেশ শক্ত মনে হলো।
বাচনভঙ্গি সরল, টেনে নিয়ে যায় ডিমের ভেতরের
লাল-কুসুমের মধ্যে ....
সেখানেই লুকিয়ে আছে মূল বিষয়বস্তু :
দুর্ধর্ষ দুর্ভিক্ষ!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ শাহীন। 'দুর্ধর্ষ দুর্ভিক্ষ!' তো বটেই!

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

স্বপ্নাহত এর ছবি

তীরন্দাজের লক্ষ্যভেদ করার নিপুণতা দেখে বড় হিংসে হয়!!

---------------------------

থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ! আপনারও খুব নিপুণ লেখনী সপ্নাহত।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

খেকশিয়াল এর ছবি

তীরন্দাজ, তীরখানা বড়ই আজব ভাবে আকিয়ে-বাকিয়ে এক সুন্দর অদ্ভুত নিশানাতে লাগলো, অন্যরকম একদমই, দারুন লাগল !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। খুশী হলাম খুব!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ফারুক হাসান এর ছবি

দারুণ, দারুণ, দারুণ!
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রায় পুরোটা বাস্তব হলেও কিঞ্চিত পরাবাস্তব।
চির আমি

তীরন্দাজ এর ছবি

গল্পের বিষয়বস্তু সেই বাস্তব, যে বাস্তব নিয়ে আমরা একেবারেই ভাবতে চাইনা। তাই রূপকের অবলম্বন নিতে হলো।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বাস্তব হোক আর পরাবস্তব- লেখাটা মনকাড়া এবং সময়োপযোগী তো বটেই।
তীরুদাকে ধন্যবাদ
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ ধুসর!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

ফকির ইলিয়াস এর ছবি

শিল্পিত শব্দাবলি ।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ!!!

----------
স্পর্শ

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

খুব ভালো লাগলো তীরু'দা! হাসি

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

অদ্ভুত একটা গল্প পড়লাম------- চমৎকার!
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।