অতীতের সাথে পত্রালাপ (ছয়) – খৎনা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/১২/২০১২ - ৩:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত, খৎনার কাজটি কী করে হল, তার বিশদ বর্ণনা দিতে চাই না আর। এটুকুই বলতে পরি যে, আমার তেইশ বছর বয়েসে আমার জন্যে এর চাইতে অসম্মানজনক ঘটনা আজ অবধি ঘটেনি। এর মানসিক ও শারীরিক কষ্টের জের কাটাতে সপ্তাহ দুয়েক ঘরেই শুয়ে বসে কাটাতে হয়। দবির খুব দেখাশোনা করে আমার, গোলাপজান এসে রান্না করে দিয়ে যায়। এই বয়েসে খৎনার কথা শুনে মৌলবি সাহেব বেশ অবাক হয়েছিলেন। তবে দবির যে কারণ দর্শায়, সেটি শুনে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। দবিরের ভাষ্য, আমি সোহেল, তার ভাতিজা খৎনা হবার আগেই অল্প বয়েসে সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলাম, এখন সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছি।

প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর আগে যে দেশ জন্ম হয়েছিল আমার, সে দেশটির নাম এখন বাংলাদেশ। জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ হল, এদেশে রাজার রাজত্বের স্থায়িত্ব সময়ের বাঁধনে সীমাবদ্ধ। প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন করে রাজা নির্বাচন করা হয় জনগণের ভোটে। সেই সাথে রাজার মন্ত্রী পরিষদও নির্বাচিত হয়। এই পাঁচ বছরে রাজা, তার পরিষদ-বর্গরা ও তাদের তোষামোদকারীরা দেশের সাধারণ মানুষদেরকে যত্রতত্র শোষণ করার অধিকার রাখে। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও সম্পদের পরিমাণ সেভাবেই হুহু করে বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রশাসনে গণতান্ত্রিক রাজবিরোধী দলও থাকে এক বিশেষ ভূমিকায়। তাদের কাজ হল, বাইরে বাইরে হলেও রাজার প্রতিটি কাজে বাগড়া দেয়া ও প্রতিক্ষেত্রে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। এসব বিশৃঙ্খলার আড়ালে শোষনকর্ম চালানো অনেক বেশি সুবিধাজনক। পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন হয়। বেশিরভাগ সময়েই বিরোধী দলেরাই একজন রাজার আসনে বসে। তারপর সেই আগের নিয়মেরই পুনরাবৃত্তি।

একেকটি রাজার একেকটি দলের আলাদা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কেউ জাতি-পন্থি, কেউ প্রগতিপন্থি, কেউ ধর্ম-পন্থি, কেউবা সমাজপন্থী। কোনো কোনো সময় একদল আরেক দলের সাথে মিলে রাজত্ব পায়, কোনো কোনো সময় কয়েকটি দল মিলেমিশে বিরোধীদল সেজে অরাজকতা সৃষ্টির দায়িত্ব গ্রহণ করে। কোন দল কোন দলের সাথে মেলে, তাতে তাদের রাজনৈতিক পন্থার কোনো প্রভাব নেই, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধাই অর্জনই সবচাইতে বড়ো উদ্দেশ্য। দবির বলে, আমাকে যে খৎনা দিতে হয়েছে, তাতে যেন দুঃখ না পাই। আমাকে সান্ত্বনা দিতে বলে, এদেশের প্রতিটি মানুষ নানা ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একাধিকবার খৎনা দিয়ে চলেছে। আমি তার কথার পুরোটা বুঝতে পারিনি।

সে রাতেই এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখি। সে স্বপ্নের কথা বলার আগে, আমরা যেখানে আছি, তার বর্ণনা দিতে চাই তোমাকে। এ জায়গা রাজধানী ঢাকা থেকে কিছুটা বাইরে। আধা শহর, আধা গ্রামের মতো একটি এলাকা। এই এলাকাতেও একজন প্রগতিশীল সরকারী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে। এখানকার বাজারে একদিন লোকটিকে চাক্ষুষ দেখারও সুযোগ হয়েছে। চারপাশের মোসাহেবের ভিড়ে তার চলার আর বলার কী ভঙ্গি! মনে হয় এই উপশহর নয়, পুরো পৃথিবীর রাজত্বই তার হাতে। একে ধমকায়, ওকে চড় মারে, কাউকে অশ্রাব্য গালিগালাজ। আমাদের বাড়ির নীচেই রাস্তার সামনে একটি দোকান। দবির আর আমি মাঝে মাঝে সে দোকানে কেনাকাটাও করি। দোকানী শান্ত চরিত্রের একটু মোল্লা প্রকৃতির মানুষ। অনেকবারই দেখেছি বিভিন্ন দলের চাঁদাবাজেরা আসে, কম বেশী চাঁদা আদার করে যায় দোকানীর কাছ থেকে। এবার আমার স্বপ্নের কথায় আসছি। স্বপ্নে দেখি দোকানী কোনো কারণে চাঁদা না দিতে পারায় সেই প্রতিনিধি দলবল নিয়ে দোকানীর উপর চড়াও। শাস্তি হিসেবে খৎনা হবে দোকানীর। খৎনার কাজটি করবে ধর্ম-পন্থি দলের এক মওলানা, যদিও সেই প্রতিনিধির সাথে মওলানার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। মওলানার হাতে চকচকে রক্তাক্ত বিশাল ছুরি। আরও কিছু লোকের খৎনা শেষ করে দোকানীর কাছে এসেছে। দেখে ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। পুরো ঘামে ভেজা শরীর। স্বপ্ন হলেও এটি সত্য যে, এ দেশের বাস্তব চেহারা আমার এর চাইতে খুব আলাদা নয়।

দবির আমাকে নিয়ে এদেশের রাজধানী ঢাকায় যাবে বলে জানিয়েছে। সেখানে নাকি আরও অনেক মানুষ, আরও অনেক বড়ো বড়ো দালানকোঠা আর গাড়ির ভিড়। এখানে যে রকম দেখছি, তার চাইতে আরও বেশী কী হতে পারে? শুনে ভয়ই হচ্ছে। দবিরকে দেখেও মাঝে মাঝে অবাক হই। এখনকার সমাজে এই পেশার এক মানুষের এতটা ভালো মন-মানস কি করে থাকতে পারে? বেশ ভালো ভালো লোকের সাথে তার পরিচয়। তাদের কথা যখন বলে, অবাক হয়ে শুনি। ঢাকায় এমনি একজনের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছে সে। হিমু নামের এই লোকের নাকি অদ্ভুত কর্মকাণ্ড। সমাজে যে সব অনাচার চলছে, তার বিরুদ্ধ স্রোতে তিনি নাকি দিনরাত খালিপায়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ান। পরনে সবসময় হলুদ পাঞ্জাবি। সে পাঞ্জাবির কোনো পকেট থাকে না, কারণ পকেট থাকলেই নাকি টাকা থাকতে হয়। তবে দবির বলে, অনেক অলৌকিক ক্ষমতা নাকি হিমুর। তার এতই নামডাক যে, এদেশের এক বিখ্যাত সাহিত্যিক অনেক বই লিখছেন তাকে নিয়ে। দবিরের কাছে শুনে খুব আকর্ষণ বোধ করছি হিমুর প্রতি। তাছাড়া সুযোগ হলে এই সাহিত্যিক ভদ্রলোকের সাথেও দেখা করার ভীষণ আগ্রহ আমার। তবে এদের সাথে দেখা করার আগে নিজেকে তৈরি করা জরুরী।

এরই মাঝে দবির একজন গৃহশিক্ষক রাখে আমার জন্যে। এখনকার ভাষা আর পারিপার্শ্বিক জীবনযাত্রা আর রাজনৈতিক ধরনধারণই আমাকে আকৃষ্ট করে। আমাদের আলোচনাও সে দিকেই বেশী সীমাবদ্ধ থাকে বেশী। ধর্ম নিয়েও কথা হয়। বেশ ভালো এই শিক্ষক ভদ্রলোক ও দবিরের ভালো লোক চেনার যে কথা আগে বলেছি, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। উনি নিজের ক্ষমতানুযায়ী আমাকে শেখানোর চেষ্টা করেন, কোনো প্রশ্নেই অবাক হতে দেখিনা। তবে আমার গণিত বিষয়ক ক্ষমতা আড়ালে রেখে অন্যান্য বিষয়েই আলাপ বেশি করি, যাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ না ঘটে।

এই দেশটি ও তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক কথা বলেছেন আমার এই শিক্ষক। এই কাহিনী একদিকে এতটা বীরত্ব ও সন্মানের ও অন্যদিকে এত বেশি হৃদয়স্পর্শী, বলতে গিয়ে জল আসে তার চোখে। তার বর্নণার সাথে আমি এখনকার লোকের চালচলন কোনো সামঞ্জস্য না খুঁজে পেয়ে আমি আনেকটাই হতাশ। তবে এই ইতিহাস এতো বিস্তারিত আর আমার এই ভ্রমণের জন্যে অর্থবহ যে, পরে চিঠিতেই সব শুরু করতে চাই।

আমার সুন্দর অতীত তোমাকে ছেড়ে এসেছি। সেখানে ভালো থেকো রতিকান্ত।

ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার

চলবে ...

অতীতের সাথে পত্রালাপ (এক) - অবতরণ
অতীতের সাথে পত্রালাপ (দুই) – দবির মিয়া
অতীতের সাথে পত্রালাপ (তিন) – পথ আর ঘর
অতীতের সাথে পত্রালাপ (চার) – গাণিতিক সময়
অতীতের সাথে পত্রালাপ (পাঁচ) – দূরদর্শন


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

পড়ছি ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।