শেষ প্রশ্ন

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৭/২০০৯ - ৮:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আইজাক আসিমভের "শেষ প্রশ্ন" গল্পটি পড়ে অবাক হয়ে গেলাম! অবাক মানে, একেবারে তাব্ধা!। আশ্চর্য সুন্দর কল্পবিজ্ঞান। ভাবলাম অনেকেই হয়তো পড়েছেন কিন্তু কেউ কেউ যদি না পড়ে থাকেন? তাছাড়া নিজের ভাষায় পড়তে তো ইচ্ছা করে। তাই অনুবাদ করতে বসে গেলাম। সুধীগণ নিজগুণে ক্ষমা করবেন যদি এই দুর্বল কলমে ভালো না আসে, তবে যথাসাধ্য যত্নে কাজটুকু করার চেষ্টা ছিলো। আজকে ১ ও ২।

1

শেষ প্রশ্নটি প্রথম করা হয়েছিল একুশে মে, ২০৬১। মানবসভ্যতা তখন মাত্র সাতদিন হয় আলোতে প্রবেশ করেছে। প্রশ্নটা করা হয়েছিল একটা বাজি ধরাধরির ফল হিসাবে। ঘটনা এইভাবে ঘটে:

অ্যালেক্জান্ডার অ্যাডেল আর বার্ট্রাম লুপভ মাল্টিভ্যাকের দুই বিশ্বস্ত কর্মী। কোনো মানুষ যতদূর ভালো করে জানতে পারে তারা ততদূর ভালো করেই জানতো কয়েক মাইল জুড়ে ছড়ানো দৈত্যাকার কম্পুটার মালটিভ্যাকের ঠান্ডা, মসৃণ, আলোজ্বলানেভা অংশগুলোর আড়ালে কী কী আছে। অন্তত তাদের একটা পরিষ্কার ধারণা ছিলো এর ওভারঅল প্ল্যান,সার্কিট-এইসব বিষয়ে। আসলে টেকনোলজি এত এগিয়ে গেছে আর এত জটিল হয়ে গেছে ততদিনে যে একজন মানুষের পক্ষে ব্যাপারটা পুরোটা বোঝা আর সম্ভবই নয়।

মাল্টিভ্যাক ছিলো নিজের যন্ত্রাংশ নিজে অ্যাসেম্বল করতে সক্ষম আর স্বয়ংসংশোধক। একে এরকম করেই তৈরী করা হয়েছিল, কারণ মানুষ যথেষ্ট দ্রুত আর যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে এতবড় যন্ত্র সামলাতে পারতো না। অ্যাডেল আর লুপভ মাল্টিভ্যাককে অপারেট করতো বাইরে থেকে, খুবই উপর-উপর। তারা তথ্য প্রবেশ করাতো, প্রশ্ন ঠিক জায়গামতন দিতো, উত্তর তর্জমা করতো। মাল্টিভ্যাক যা করতো তার ক্রেডিট ওরা আর ওদের মতন আরো কর্মীরাই পেতো। নইলে কে আর পাবে? সাধারণ মানুষের কাছে ওরাই ছিলো হিরো!

দশকের পর দশক ধরে মাল্টিভ্যাক স্পেসশিপ ডিজাইন করতে আর গ্রহ উপগ্রহের গতিপথ জানাতে সাহায্য করে গেছে। মাল্টিভ্যাক থাকায় মানুষের চাঁদে, মঙ্গলে, শুক্রে যেতে খুবই সুবিধে হয়েছিলো। কিন্তু তারপরে পৃথিবীর সীমিত সম্পদে টান পড়লো, আর এত সোজা হলো না ব্যাপার। দীর্ঘ মহাকাশ-অভিযানের বিপুল খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়লো। যদিও কয়লা তেল ইউরেনিয়াম ইত্যাদি ক্রমশ বেশী বেশী এফিশিয়েন্সির সঙ্গেই ব্যবহৃত হচ্ছিল শক্তি উৎপাদনে, কিন্তু এসবই সীমিত যে! কিন্তু কেউ জানতো না, খুব ধীরে ধীরে মাল্টিভ্যাক গভীর এই শক্তিসমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দিকে এগিয়ে চলেছিল। অবশেষে ১৪ই মে ২০৬১, মাল্টিভ্যাক সমাধান করে ফেললো। সূর্যের শক্তিকে বশ করে শক্তিসমস্যা মিটিয়ে ফেললো মাল্টিভ্যাক।

সূর্যের শক্তি এসে গেলো হাতের মুঠায়, এ শক্তি সংরক্ষণ ও ব্যবহারোপযোগী করা আর গোটা পৃথিবীগ্রহব্যাপী মানুষের সবরকম ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া, সবই করলো মাল্টিভ্যাক। কয়লা, তেল, ইউরেনিয়াম ফিসন ইত্যাদির ব্যবহারের প্রয়োজন আর রইলো না, সরাসরি সবাই যুক্ত হয়ে গেল এক মাইল ব্যাসের এক পাওয়ার স্টেশানের সঙ্গে, যেটা পৃথিবী ঘিরে ঘুরছে পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের যা দূরত্ব তার অর্ধেক দূরত্ব রেখে। গোটা গ্রহের সমস্ত শক্তিচাহিদা মিটতে লাগলো সূর্যের শক্তিতে।

এত বড় একটা ব্যাপার! শক্তিসমস্যার চিরকালীন সমাধান। মাত্র সাতদিনে কি ভরসাফূর্তি-উৎসব ফুরায়? অ্যাডেল আর লুপভের তো নানা সংবর্ধনা-পুরস্কার-পার্টি-নেমন্তন্ন-বক্তৃতার চক্করে পড়ে একেবারে মাথা বোঁবোঁ করে ঘোরার অবস্থা! কোনোরকমে একুশ তারিখে এইসবের খপ্পর থেকে বেরিয়ে ওরা দু'জনে মাটির তলার চেম্বারে চলে গেল। অন্তত এখানে কেউ খুঁজতে আসবে না।

মাল্টিভ্যাকের বিরাট শরীরের কিছুটা অংশ এখানে এই মাটির তলার চেম্বারে দৃশ্যমান, এখন আলো জ্বলানেভা নেই টার্মিনালে, তথ্য প্রবেশও করানো হচ্ছে না, প্রচুর পরিশ্রমের পরে মাল্টিভ্যাকও সাময়িক বিশ্রাম করছে। অ্যাডেল আর লুপভের কোনো ইচ্ছে ছিলো না সেই বিশ্রাম বিঘ্নিত করার। ওরা দুই বন্ধু ও সহকর্মী নিরিবিলিতে দুটো প্রাণের কথা কইতে আর একটু পান করতে এসেছিলো মাত্র। একটামাত্র সুরার বোতল আর দু'খান গেলাস আর বরফ এনেছিলো ওরা।

"ভাবো কি অবাক ব্যাপার!" অ্যাডেল বললো। ওর চওড়া মুখে কিছু কুঁচকানো বয়সের রেখা, নিজের গেলাসের পানীয় সে আস্তে আস্তে নাড়ছিল কাঁচের সরু রড দিয়ে আর দেখছিলো বরফের খন্ডগুলো কেমন গলে মিশে যাচ্ছে। "ভাবো তো বার্ট, যত চাই তত শক্তি এখন আমরা পেতে পারি। ফ্রী। কি চমৎকার! নয়? ভাবো, এত শক্তি, গোটা পৃথিবীকে মুহূর্তে গলিয়ে দিতে পারে, বাষ্প করে দিতে পারে, কিন্তু তাতেও সামান্যই কমবে শক্তি। চিরকাল, চিরকালের জন্য আমরা পেয়ে গেছি অফুরন্ত শক্তিউৎস।"

লুপভ নিজের মাথাটাকে পাশের দিকে হেলালো। তর্কবিতর্ক করতে শুরু করার আগে এ তার পুরানো স্টাইল। সে এখন একচোট তর্ক করতে চাইছিল অ্যাডেলের সঙ্গে, হয়তো বরফের বাস্কেট আর গ্লাসগুলো বয়ে আনতে ওর মেজাজ একটু চটে গেছিল, নয়তো এমনিই অ্যাডেলের কথায় ভুল ধরতে ওর ভালো লাগে বলে। " চিরকাল? ন্যাহ, অ্যালেক্স। চিরকাল না। " সে বললো।

"প্রায় চিরকাল। যতদিন না সূর্য নিভে যায়। "

"সেটা কি চিরকাল? "

"আচ্ছা, ঠিকাছে, ঠিকাছে। শত শত কোটি বছর। কুড়ি বিলিয়ন বছর। এবারে খুশী? "

লুপভ নিজের আঙুলগুলো মাথার পাতলা হয়ে আসা চুলের মধ্যে আলতো করে চালাতে থাকে, সে প্রায়ই এরকম করে। হয়তো নিজেকে আশ্বস্ত করতে চায় এখনো কিছ চুল আছে, আহা এখনো কিছু আছে। তারপরে মৃদু চুমুক দেয় পানীয়ের গেলাসে, বলে, "কুড়ি বিলিয়ন বছর খুব বড় সময়, কিন্তু চিরকাল তো না।"

"চিরকাল না, কিন্তু আমাদের সময় পার হয়ে যাবে।" অ্যাডেল একটু পরিহাসের সুরে বলে।

"সে তো কয়লা তেল ইউরেনিয়াম দিয়ে চালালেও আমাদের সময় পার হয়ে যেত!"

"ঠিক আছে। মানছি। কিন্তু এখন তো স্পেসশিপকে সোলার স্টেশানে কানেক্ট করে দিয়ে প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়ে প্লুটো পার হয়ে চলে যেতে পারবো আমরা। যতবার খুশী আসা যাওয়া করতে পারবো। আগে কি তা পারা যেতো ঐ তোমার কয়লা তেল ইউরেনিয়ামের যুগে? বিশ্বাস না হয় মাল্টিভ্যাককে জিগগেস করো।"

"আমি জানি পারতাম না, এর জন্য মাল্টিভ্যাককে জিজ্ঞাসা করতে হবে না।"

"তাহলে মাল্টিভ্যাকের কৃতিত্ব খাটো করে কথা বলা বন্ধ করো বার্ট। আমাদের জন্য মাল্টিভ্যাক যা করেছে, তা যুগান্তকারী। " খুব তেতে উঠে বললো অ্যাডেল।

"আরে আমি কখন বললাম করে নি? আমি শুধু বলছি সূর্য চিরকাল জ্বলবে না, একসময় ওর জ্বালানী ফুরিয়ে যাবে। এইটুকুই শুধু বলছি। আমরা দুহাজার কোটি বছর নির্বিঘ্নে শক্তি পাবো, তারপরে?" লুপভ তার অল্পকাঁপা তর্জনী সামনের দিকে অ্যাডেলের দিকে নির্দেশ করে, বলে,"বোলো না তখন আরেকটা তারার সঙ্গে কানেক্ট করে দেবো।"

খানিকটা সময় নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলে না। অ্যাডেল নিজের গেলাস মুখে তোলে আর নামায়। লুপভের চোখ বুজে আসে। তারা বিশ্রাম করে।

হঠাৎ লুপভের চোখ খুলে যায়, সে বলে, "অ্যালেক্স তুমি ভাবছো আরেকটা তারার সঙ্গে আমাদের পাওয়ার স্টেশন জুড়ে দেবে যখন আমাদের সূর্য নিভে যাবে। ভাবছো না?"

"আমি কিছু ভাবছি না।" অ্যাডেল বলে।

"অবশ্যই ভাবছো। তুমি লজিকে খুব দুর্বল। সেটাই তোমার প্রধান সমস্যা। তুমি সেই গল্পের লোকটার মতন, বৃষ্টি এসেছে দেখে দৌড়ে যে বাগানে ঢুকে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়েছিলো। সে একটুও দুশ্চিন্তায় পড়েনি, সে ভেবেছিল একটা গাছ যখন পুরো ভিজে যাবে তখন সে দৌড়ে আরেকটা গাছের তলায় যাবে। হা হা হা। যেন বাকী গাছগুলো শুকনো থাকবে।"

"আচ্ছা, বুঝেছি বার্ট। এত চিৎকার করতে হবে না তোমার। আমাদের সূর্য যখন নিভে যাবে বাকী তারাগুলোও ততদিনে নিভে যাবে।"

"ঠিক তাই। " লুপভ আস্তে আস্তে বলে। " সবকিছুর সৃষ্টি সেই মহাজাগতিক বিস্ফোরণ না কি বলে, সেই বিস্ফোরণে। সবকিছু নিভে যাবে যখন সব তারা নিভে যাবে জ্বালানী শেষ করে। কিছু কিছু তারা খুব বড়, তারা ঝটপট জ্বালানি শেষ করে, দৈত্যাকার তারাগুলো মাত্র কয়েক কোটি বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সূর্য মাঝারি ভরের, সে আস্তে আস্তে জ্বালানি খরচ করে। কুড়ি বিলিয়ন বছর সে জ্বলবে। আরো ছোটো বামন তারাগুলো হয়তো কয়েকশো বিলিয়ন বছর টিঁকবে। কিন্তু তারপরে? ট্রিলিয়ন বছর পরে? সব অন্ধকার! এনট্রপি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তাকে কখনোই উলটোবাগে ঘোরানো যায় না। এনট্রপিকে সর্বোচ্চে পৌঁছাতে হবে, সেটাই মহাবিশ্বের অনতিক্রম্য নিয়ম। "

"আমি জানি এনট্রপির নিয়মের কথা।" অ্যাডেল বলতে চেষ্টা করে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে।

"জানোই তো। "

"তুমি যা জানো তা আমিও জানি বার্ট।"

"তাহলে তো জানোই। জানোই যে সবকিছুই একদিন নিভে যাবে। সব তারা, সব শক্তি উৎস। কোনো উৎসই চিরদিনের নয়। "

"ঠিক আছে। কে বলেছে যে নিভবে না?"

"তুমি। তুমি বলেছ গবেট অ্যালেক্স। বলেছ আমরা পেয়ে গেছি শক্তি চিরকালের জন্য। বলেছ চিরকালের জন্য। বলো নি?"

অ্যাডেল এইবার প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করে, বলে," হয়তো কোনোদিন, হয়তো দূর ভবিষ্যতে আমরা বানাতে পারবো তেমন শক্তিউৎস যা ফুরাবে না।"

"কখনো না।" লুপভ কঠোর গলায় বলে।

"কেন নয়, বার্ট? এখনকার কথা বলছি না, ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নতি হবে অনেক, তখন। আমাদের হাতে তো আছেই কুড়ি বিলিয়ন বছর।"

"কখনো পারবো না। কেউ কোনোদিন পারবে না।"

"বার্ট, মাল্টিভ্যাককে জিগ্গেস করো।"

"তোমার ইচ্ছে হলে তুমি জিগ্গেস করো গবেট। আমি জানি। পাঁচ ডলার বাজি। যাও, জিগ্গেস করো মাল্টিভ্যাককে।

অ্যাডেলের তখন নেশা ধরে এসেছে। সে এগিয়ে গেল। তখনও খুব মারাত্মক নেশা না, সে কীবোর্ডে টাইপ করতে লাগলো নির্দিষ্ট সিম্বলগুলো, ঠিকভাবেই। প্রশ্নটা দাঁড়ালো এরকম: মানবজাতি কি কোনোদিন কোনো শক্তিখরচ না করে, জ্বালানি ফুরিয়ে নিভে যাওয়া সূর্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবে তার জ্বলন্ত যৌবনে? সরলতর ভাবে বললে প্রশ্নটা ছিলো: মহাবিশ্বের মোট এনট্রপি কি ব্যাপক আকারে কমানো সম্ভব?

মাল্টিভ্যাক প্রশ্ন গ্রহণ করে চুপ করে গেল। একেবারে নীরব। জ্বলানেভা আলোগুলোও থেমে গেছে, ক্লিক ক্লিক শব্দও থেমে গেছে।

অনেকক্ষণ পরে, যখন ভীত সন্ত্রস্ত এই দু'জন আর পারছে না টেনশন নিতে, তখন মাল্টিভ্যাক সক্রিয় হয়ে উঠলো। উত্তর লিখে দিল মাল্টিভ্যাক, "তথ্য অপ্রতুল, এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবার মতন তথ্য এখনো অপ্রতুল।"

"বাজি খতম।" লুপভ ফিসফিস করে বলে। তারা দু'জনে সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়।

পরদিন তারা জেগে ওঠে মাথাব্যথা আর মুখে তেতো-তেতো ভাব নিয়ে, আগের রাতের সেই প্রশ্নের কথা বেমালুম ভুলে যায়।

জেরোড, জেরোডিন আর জেরোডেট ১ এবং জেরোডেট ২ তাকিয়েছিলো ভিজিপ্লেটের নক্ষত্রঠাসাঠাসি চলমান ছবির দিকে। তারা হাইপারস্পেসের মধ্য দিয়ে এসেছে বলে ব্যপারটা তাৎক্ষণিক, কোনো সময় ব্যয় না করেই তারা এসে গেছে তাদের গন্তব্যে। তারা-ঠাসাঠাসি চলচ্চিত্র হারিয়ে গিয়ে এবারে ভিজিপ্লেটের মাঝামাঝি স্থির হলো উজ্জ্বল গোল থালার মতন তাদের গন্তব্য তারাটি।

" ঐ যে এক্স-২৩", জেরোড বলে।

"ওর গ্রহজগতেই আমরা যাচ্ছি।" জেরোডের গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর বেশ প্রকট, সে তার হাত দু'খানা পিঠের দিকে দিয়ে এক হাত দিয়ে আরেক হাত শক্ত করে ধরে আছে, এত জোরে যে আঙুলগুলো সাদাটে দেখায়।

ছোট্টো দুই মেয়ে জেরোডেট ১ আর জেরোডেট ২ এইবারই প্রথম হাইপারস্পেসে ভ্রমণ করলো, তারা বেশ উত্তেজিত। প্রথমবারের মতন তারা পেয়েছে সেই মাথাগোলানো গা-গোলানো সেই অভিজ্ঞতা, সেই যে একটা মুহূর্ত যখন মনে হয় শরীরের ভিতরের সবকিছু বাইরে আর বাইরের সবকিছু শরীরের ভিতরে।

সেই সময়টা কেটে গেছে, বাচ্চা দু'জন এখন খুশীতে লাফালাফি করছে আর একজন আরেকজনকে তাড়া করছে তাদের মায়ের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে। "আমরা এক্স-২৩ এ এসে গেছি, এসে গেছি, এসে গেছি....." তারা চিৎকার করে বলে সমস্বরে ।

" এই শশশ, চুপ, সোনামণিরা, চুপ ", জেরোডিন মেয়েদের থামায়, জেরোডের দিকে ফিরে বলে, " তুমি ঠিক বলছো তো জেরোড?"

" একদম ঠিক, মানুষের ভুল হতে পারে কিন্তু মাইক্রোভ্যাকের ভুল হয় না।"

তারা দুজনেই তাকায় তাদের হাইপারস্পেসশিপের ছাদ বরাবার চলে যাওয়া সরু ধাতব অংশটির দিকে, ছাদের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে অন্যপ্রান্তে এসে হারিয়ে গেছে। ওরা শুধু জানে ওটার নাম মাইক্রোভ্যাক, কিভাবে ওটা কাজ করে তার প্রায় কিছুই জানে না। ঐ মাইক্রোভ্যাকই তো এই হাইপারস্পেসশিপের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে, হাইপারস্পেসে ভ্রমণের সমীকরণ সমাধান করা আর হিসেবগুলো গণনা করা-সবই করে মাইক্রোভ্যাক। ওর শক্তির সরবরাহ আসে সাব-গ্যালাকটিক পাওয়ারস্টেশন থেকে। জেরোড আর তার পরিবারকে শুধু হাইপারযানের আরামদায়ক ঘরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না।

ভিজিপ্লেটের দিকে চেয়ে জেরোডিনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে হঠাৎ, সে খুব অপ্রস্তুত হয়ে চোখ মুছতে থাকে। জেরোড বলে," কি হলো?"

জেরোডিন চোখ মুছতে মুছতে বলে," কিজানি কেন এমন হয়। পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছি ভাবলেই পৃথিবীর জন্য মনকেমন করে।"

"কেন? কিসের জন্য? সেখানে কি আছে আমাদের? " জেরোডের গলা শুকনো আর অনাবশ্যক কঠিন। "এক্স-২৩ এ আমরা সবকিছু পাবো। তাছাড়া আমরাই তো প্রথম না, ওখানে এখন লাখ লাখ লোক। ইতিমধ্যেই এত লোক ওখানে বসতি করে ফেলেছে, বুঝলে? এই হারে চললে আমাদের নাতিপুতিদের আবার বেরোতে হবে নতুন নক্ষত্রের গ্রহজগতে বসতি করতে কারণ ততদিনে এক্স-২৩ একেবারে ভরে যাবে।"

একটুক্ষণ চুপ করে থাকে সে, তারপরে আস্তে আস্তে বলে, "জেরোডিন, দ্যাখো আমাদের ভাগ্য কত ভালো, মাইক্রোভ্যাক আমাদের এই আন্ত:-নাক্ষত্রিক ভ্রমণের সব হিসাব করে দিয়েছে। নইলে যে হারে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, এইরকম না হলে কি হতো ভাবতে পারো?"

জেরোডিন ফিসফিস করে বলে, " জানি,আমরা গোটা মানবজাতি শেষ হয়ে যেতাম। আমাদের বাঁচিয়েছে মাইক্রোভ্যাক।"

"তবে? ভাগ্যকে ধনবাদ দাও জেরোডিন।"

ছোট্টো জেরোডেট-১ জেরোডের কাছে এসে লাফাতে লাফাতে বলে, "আমাদের মাইক্রোভ্যাক সব্বার সেরা। তাই না বাবা? "

জেরোডেট১ এর ঝুঁটিতে হালকা নাড়া দিয়ে জেরোড হেসে বলে, "হ্যাঁ, সোনামণি।"

নিজস্ব একটা মাইক্রোভ্যাক থাকা যে কি আরামের অনুভূতি সে জেরোড জানে। তার বাবার আমলে এইসব ছিল বিরাট, মাইলমাইল ছড়ানো দৈত্যাকার যন্ত্র। মাটির তলার টানেলে রাখা থাকতো সে জিনিস। গোটা পৃথিবীতে একটাই ছিল, প্রত্যেক গ্রহের জন্য একটা করে। এক হাজার বছর ধরে এদের সাইজ শুধু বাড়তেই থাকছিলো, তারপরে হঠাৎ এলো যাকে বলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ট্রানজিস্টরের জায়গায় এলো আণবিক ভালভ, আকার গেল অনেক কমে, এখন তো তা মাইক্রোভ্যাক, স্পেসশিপেই হেসেখেলে ধরে যায়।

জেরোড বেশ একটা আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগে যখন সে ভাবে তার এই ছোটো ব্যক্তিগত মাইক্রোভ্যাক সেই বিরাট মাইল মাইল টানেলে রাখা যন্ত্রের তুলনায় কত বেশী জটিল! সেই প্রাচীন মাল্টিভ্যাক যা কিনা সূর্যের শক্তিকে বশ করেছিলো প্রথম তার থেকে কত জটিল! আর তারপরে সেই যন্ত্র যা কিনা প্রথম হাইপারস্পেসে ভ্রমণের জটিল সমীকরণ সমাধান করেছিলো, তার থেকে কত জটিল!

জেরোডিন নিজের মনের জটিল অলিগলিতে হারিয়ে গেছিল, সে নিজের মনে মনে কথা বলার মতন বললো, "কত তারা, কত গ্রহ! আমাদের মতন কত পরিবার এভাবে হয়তো যাবে সেসব গ্রহে ভবিষতে! চিরকাল যাবে, নতুন নতুন গ্রহে।"

জেরোড হেসে বলে, " চিরকাল না। একসময় সব থেমে যাবে। তবে কিনা বহু বিলিয়ন বছরের আগে না। তারাগুলোকে একসময় তো নিভে যেতে হবেই, এনট্রপি তো বাড়তেই থাকে কেবল, কমে না। তাই একসময় সব তারাই নিভে যাবে।"

জেরোডেট২ কাছিয়ে আসে, জিজ্ঞাসা করে, "বাবা, এনট্রপি কি?"

জেরোড বলে, "সোনামণি, এনট্রপি হলো..... ইয়ে এনট্রপি হলো গিয়ে একটা কথা যা কিনা বোঝায় সবকিছু একদিন পুরানো হয়ে যায়, তারপরে আর চলে না। এই যে যেমন তোমার কথাবলা রোবট, নতুনবেলা চলে, কথা বলে-তারপরে পুরানো হয়ে যায় আর একসময় আর চলে না।"

"নতুন পাওয়ার-ইউনিট ভরে দিলে আবার তো চলে কথাবলা রোবট !"

" হ্যাঁ তো! ঠিক। আমার সোনামণির বুদ্ধি আছে! কিন্তু আমাদের এই বিরাট জগতের পাওয়ার-ইউনিটগুলো কি? ঐ তারারা। যখন ওগুলো নিভে যাবে, আমাদের আর পাওয়ার-ইউনিট কোথায় তখন?"

এই অবধি শুনে জেরোডেট১ কেঁদে ফেলে, চিৎকার করে বলে, " বাবা, ওদের নিভতে দিও না, নিভতে দিও না। তারাদের নিভে যেতে দিও না।"

জেরোডিন রেগে যায়, "দ্যাখো তো কি করলে!" মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চোখ মোছাতে মোছাতে বলে, "ইশ, কাঁদে না সোনা।"

তারপরে জেরোডের দিকে ফিরে বলে, " তোমার কি আক্কেলবুদ্ধি হবে না? কি দরকার ছিলো ঐসব এনট্রপি ফেনট্রপি নিয়ে বলার? এতটুকু টুকু বাচ্চা, এখনই কি ওরা পন্ডিত হবে? "

জেরোড থতমত খেয়ে গেছে, কোনোক্রমে বলে, " আরে আমি কিকরে জানবো বাচ্চারা ভয় পেয়ে যাবে?"

জেরোডেট১ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, " মাইক্রোভ্যাককে জিজ্ঞাসা করো বাবা, ওকে জিজ্ঞাসা করো কেমন করে নিভে যাওয়া তারা আবার জ্বালানো যায়।"

জেরোডিন বলে, " হ্যাঁ, শিগগীর। উফ এ দেখি আরেকজনও কাঁদতে শুরু করেছে। আয় মামণি, কোলে আয়, কাঁদে না, এই দ্যাখ তোদের বাবা এখুনি মাইক্রোভ্যাককে জিগ্গেস করবে। "

জেরোড তাড়াতাড়ি বলে, "এই যে মামণিরা, এক্ষুনি জিগ্গেস করছি মাইক্রোভ্যাককে। কাঁদে না সোনারা, দ্যাখ ঠিক ও বলে দেবে আমাদের।"

জেরোড মাইক্রোভ্যাককে প্রশ্নটা জিগ্গেস করে, তাড়াতাড়ি সঙ্গে জুড়ে দেয়, "উত্তর ছাপিয়ে দাও। "

উত্তর ছাপানো পাতলা সেলুফিল্মের ফালিটা হাতে নিয়ে জেরোড আনন্দিত গলায় বলে, " দ্যাখো মিষ্টিমণিরা, আমি কী বলেছিলাম? মাইক্রোভ্যাক বলেছে সে সবকিছু ঠিক করে দেবে। যখন সময় আসবে সে সব ঠিক করে দেবে।"

জেরোডিন মেয়েদের বলে,"এখন শুতে চলো সোনারা। ঘুমের সময় হলো। কাল আমরা আমাদের নতুন বাড়ীতে যাবো, কত মজা হবে। চলো এখন শুতে চলো।"

জেরোড পাতলা ফিল্মটাকে নষ্ট করার আগে আরেকবার চোখ বুলায়, তাতে লেখা ছিলো, "তথ্য অপ্রতুল, এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবার মতন তথ্য এখনো অপ্রতুল।"

কাধ ঝাঁকিয়ে সে ফিল্মটা ট্র্যাশক্যানে ছুঁড়ে দেয়, ভিজিপ্লেটে তখন এক্স-২৩ আরো বড়, আরো স্পষ্ট। কাল তারা নতুন গ্রহে পৌঁছাবে, নতুন জীবন, নতুন দিন তাদের সামনে।

(চলবে)


মন্তব্য

ভুতুম এর ছবি

এই গল্পটা আমারও খুব পছন্দের। বাংলায় পড়তে ভালোই লাগছে, লিখে ফেলুন বাকিটাও।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
পরের, ৩,৪,৫,৬ আসবে কদিন বাদেই।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

পুরোটা শেষ হতেই পড়বো দেঁতো হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

আহা, তাইলে তো আর দেওয়াই হবে না! দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মূলত পাঠক এর ছবি

চমৎকার লাগছে। কয় এপিসোড চলবে?

তুলিরেখা এর ছবি

৩,৪,৫,৬ ব্যস। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জি.এম.তানিম এর ছবি

গোগ্রাসে পড়লাম...

তারপরে?
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

তুলিরেখা এর ছবি

তারপরেরটুক আসছে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ছায়ামূর্তি [অতিথি] এর ছবি

চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

স্বপ্নহারা এর ছবি

টেনশনে পড়ে গেলাম...আসিমভের এই গল্পটা পড়া হয়নি...তাই তাড়াতাড়ি বাকিটুকু ছাড়েন। অনুবাদ চমৎকার হচ্ছে!
----------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
সময় পেলেই বাকীটুকু তুলে দেবো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আগে শেষ হোক, তারপর! দেঁতো হাসি
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

তুলিরেখা এর ছবি

তা বললে তো আর শেষ হবে না। দেঁতো হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

খেকশিয়াল এর ছবি

শেষ করেন একসাথে পড়ুম

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

তুলিরেখা এর ছবি

কেমুন হইতাছে না কইলে বাকিটা অনুবাদ করমু ক্যামবে? চিন্তিত
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ে এর ছবি

অসাধারাণ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।