প্রতিলিপি (১)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ০৮/০১/২০১০ - ২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গিবান চুপ করে বসে ছিলো চেয়ারে। ঘরে অদ্ভুত নরম লাল আলো, এ ঘরে কেবল এই আলো জ্বলার ব্যবস্থাই আছে, অন্য যেকোনো আলো নিষেধ এ ঘরে। গিবান তাকিয়ে ছিলো সামনের বিশাল স্বচ্ছ জারের ভেতরের অস্বচ্ছ রঙীন তরলের ভেতরে ভাসা জীবটির দিকে। জীবটি মানুষ, সম্পুর্ণ, পূর্ণবয়স্ক ও জীবন্ত। দেখা যাচ্ছে না ভালো করে ওর মুখ, কিন্তু গিবান জানে আয়নায় যে মুখটা দেখতে পায় সে, ঠিক সেটাই।

গিবানের ক্লোন ঐ জারের ভেতরে। আড়াই বছর আগে ওকে যখন রোপন করা হয়, তখন অদ্ভুত্ যে শিরশিরানি ছিলো শিরদাঁড়া বেয়ে, অনিশ্চয়তার ভয় ছিলো, অসফল হবার আশংকা ছিলো, সেই ভয় এখন আর নেই। এখন একটা অন্যরকমের অনুভূতি, একটা অধৈর্য অস্থিরতা, একটা আশ্চর্য ঈর্ষাও।

সময় হয়ে এসেছে,এইবারে গিবানের প্রতিলিপি উঠে দাঁড়াবে, পৃথিবীর আলো বাতাসে চোখ মেলে বেরিয়ে আসবে, সবল নিশ্চিত পায়ে হাঁটবে, দৃঢ় সতেজ গলায় কথা বলবে। ওর স্মৃতি পুরোপুরি গিবানের স্মৃতির প্রতিলিপি। অস্ফুট শৈশব থেকে ক্লোন রোপণের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ গিবানের সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতি ম্যাপ করে দেওয়া হয়েছে এই ক্লোনের মাথার মধ্যে।

রঙীন ঘন তরলের পর্দার আড়ালে ডুবে থাকা ক্লোনমুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে গিবান। সে ক্লোন নিয়ে অবসেসড, বহুকাল ধরে। খুব ছোটো থেকেই। একটি যমজ ভাই ছিলো গিবানের, জীলন। গিবানের আইডেন্টিকাল টুইন। পাঁচ বছর বয়সে ফ্লুতে মারা যায়।

পাঁচ বছরের গিবানের কি কোনো অভাববোধ হয়েছিলো সেই ভাইটির জন্য? মনে হয় না, সে তো দিব্যি ছিলো বাবামায়ের আদরে, নতুন আসা ছোটো বোনটিকে নিয়ে খেলাধূলায়। তবে বাবা ক্রমশই বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকেন কাজে, ব্যবসায় ও টুরে। তাই বাবাকে বেশী পাওয়া হয়নি ওদের দুইভাই বোনের। কিন্তু মা কখনো সেকথা বুঝতে দেননি ওদের। মায়ের আদরে, সতর্কযত্নে, নিটোল পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে ওরা দুটিতে।

বোন নীথাকে খুবই ভালোবাসত গিবান, ছোট্টো বোনটি খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছড়ে ফেলেছিলো, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছিলো। গিবান ধরে ধরে বাড়ী নিয়ে এসেছিলো, মা যখন ওর ক্ষততে ডেটল দিচ্ছিলেন, তখন ও দৌড়ে মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে মলম কিনে এনেছিলো। বোনটি যখন ভাইবোন উৎসবের সাদা লাল সবুজ রঙ দিয়ে গিবানের কপালে গালে ফুললতাপাতা আঁকতো, ওর কপালের মধ্যেটা কেমন শিরশির করতো। সেও এঁকে দিতো ছোট্টো নীথার কপালে গালে চিবুকে, বোনটা খিলখিল করে হাসতো।

কিন্তু তবু এইসবের বাইরে গিবানের যে একলা মন, সেইখানে সে ঐ চলে যাওয়া ভাইটির জন্য কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়তো। কেমন হতো সে যদি বেঁচে থাকতো? সে কি সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায় তখন আয়নার মধ্যের কিশোরটির মতন দেখতে হতো? আর ওর মন? ওর স্মৃতি ওর হৃদয়? সেও কি গিবানের মতনই হতো?

ওর মনে পড়তো খুব ছোটোবেলা, চার বছর বয়সে, যখন সপ্তাহান্তগুলোতে মাবাবা আর ওরা দুটিতে বেড়াতে বেরিয়ে পড়তো এদিক ওদিক, কাছে দূরে। সমুদ্রের তীরেই বেশী যেতো, সূর্যস্নান ভালোবাসতো মা, তাই বাবাও ওখানেই নিয়ে যেতো। মাবাবা যখন রঙীন ছাতায় মাথাটুকু ঢেকে উদার সূর্যালোকে পড়ে থাকতো, বাবা বই পড়তো, মা মাঝে মাঝে বই পড়তো, মাঝে মাঝে লেস বুনতো, ওরা দুটিতে বালির উপরে খেলা করতো।

ঢেউ সরে গেলে বালির উপরে কেমন সুন্দর প্যাটার্ন দেখা যায়! আর কত রকমের ঝিনুক! কত রঙা ঝিনুক! কতবার জ্যান্ত শঙ্খ দেখেছে ওরা! চলে বেড়াচ্ছে! কী অবাক করা ব্যাপার! দুইজনে মস্ত চোখ মেলে দেখতো ওদের, আনন্দে চিত্কার করে ডাকতো মাকে, দ্যাখো দ্যাখো মা, কি রকম চলছে! জ্যান্ত শংখ! মা বই বা বোনা রেখে ওদের কাছে আসতেন, কত ঝিনুক মা কুড়িয়ে দিয়েছে!

একবার ওরা বেড়াতে গেল বাবার দেশে, সে অনেক দূরে, প্লেনে চেপে গেলো, ছোট্টো ছোট্টো দুটি ফুটফুটে একরকম দেখতে বাচ্চা দেখে সবাই কেমন খুশী সেখানে! এক বৃদ্ধা ছিলেন, ঠাকুমা নাকি তিনি গিবানের, তিনি গিবান আর জীলনকে কোলে নিয়ে কেমন কাঁদছিলেন! গিবান অবাক হয়ে দেখছিলো ওর গালে কত কুঁচকানো বলিরেখা! সেই বলিরেখার উপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। উনি কি সব বলছিলেন, কিছুই গিবান বুঝতে পারেনি! জীলনও হয়তো পারেনি। তবে ওঁর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়েছিলো দুইভাই। টুকি টুকি টুকি। ঈশ,কী স্পষ্ট সেসবকথা মনে আছে এখনো!

সম্পূর্ণপ্রায় ক্লোনটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে চমকে উঠলো গিবান! রঙীন তরলের মধ্যে প্রভূত কম্পন, ভেতরের দেওয়ালে হাত চেপে ধরেছে গিবানের ক্লোন,সে এক্ষুণি বেরিয়ে আসতে চায়। গিবান লাফিয়ে উঠলো, টেকনিকাল ডিরেকটারদের এখনি ডাকা দরকার, এক্ষুণি।

বাইরে চমকে উঠলো বিদ্যুত্ফলা, কড়কড় করে উঠলো বাজ, বছরের সবচেয়ে ভয়ানক ঝড়বাদল এসে পড়েছিলো মরুভূমিতে, ভাবনায় ডুবে থাকায় সেদিকে খেয়াল ছিলো না গিবানের। আচমকা সমস্ত ল্যাব কমপ্লেক্স ডুবে গেল পিচের মতন ঘন অন্ধকারে, বিদ্যুতের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে।

বাইরে আকাশটা তখন বেগুনী রঙের, থেকে থেকে ধারালো উজ্জ্বল বিদ্যুতের ফলায় ছিঁড়ে যাচ্ছে অন্ধকার। ঘরের জানালার কাঁচ ফেটে ভেঙে পড়লো বজ্রপাতে, আছড়ে পড়লো ভাঙা গাছের ডাল, চড়াৎ করে ভেঙে গেলো আরো কাঁচ, ক্ষণপ্রভা আলোয় দেখা গেলো তোড়ে ছাঁটবৃষ্টির জল ঢুকছে সেই ফাঁকা দিয়ে, গিবান হতচেতন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে, ওর হাতে লিঙ্কটা জ্বলছে নিভছে। অজ্ঞান হবার আগে সে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছিলো।

একটা শক্ত ডাল মারাত্মক বেগে ঢুকে গেলো ঘরে, সোজা আঘাত করলো কাঁচের জারটিতে, সেটি ভেঙে তরল গড়িয়ে গেলো মেঝে জুড়ে। চকিত আলো অন্ধকারে উঠে দাঁড়ালো নতুন গিবান, সর্বাঙ্গ থেকে চটচটে তরল গড়াচ্ছে, ঝাঁ চকচকে নগ্ন, সুগঠিত পূর্ণবয়স্ক মানুষ একটি, অদ্ভুতভাবে টলছে, টলোমলো পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভাঙা জানলায়, বৃষ্টির ছাঁটে দুইহাত পেতে দিচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে চিটচিটে জন্মতরল।

খুব নিশ্চিত পায়ে সে অচেতন গিবানের দেহ ডিঙিয়ে দরোজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুলে ফেল্লো। কেন এত অন্ধকার, সেটা তার বোধগম্য হচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো, আলো তো থাকার কথা ছিলো! অদ্ভুৎ বিরক্ত লাগছিলো তার!

অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে একতলায় নেমে সোজা বাইরে বেরিয়ে এলো সে, অবিরল বৃষ্টি ধারা অপেক্ষারত প্রিয়তমের মতন ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর অনাবৃত শরীরে, ধুয়ে ধুয়ে সাফ করে দিলো একেবারে।

(আপাতত চা আর বিস্কুট খেতে যাই হো হো হো


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সায়েন্স ফিকশন কেন যেন খণ্ডে পড়তে ইচ্ছা করে না মন খারাপ । প্লিজ প্লিজ।



হাঁটুপানির জলদস্যু বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

তুলিরেখা এর ছবি

কিন্তু.... কিন্তু এ যে বিরাট কাহিনি! একসাথে দিলে সব জ্যাম হয়ে যাবে! মন খারাপ
আচ্ছা আরো কিছু জুড়ে দিবো নাহয় পরে এডিট করে।

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ওডিন এর ছবি

রেগে টং এইসব কি হচ্ছে!
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

তুলিরেখা এর ছবি

কেন ওডিন? কী হচ্ছে? চিন্তিত
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ওডিন এর ছবি

এইসব চা-কফি খাওয়া! অ্যাঁ
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

তুলিরেখা এর ছবি

চা-কফি না তো! চা-বিস্কুট। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সিরাত এর ছবি

আমরা সায়েন্স ফিকশনে নিউট্রাল ধরনের নাম দেই, পশ্চিমে বেশিরভাগ সায়েন্স ফিকশনে কিন্তু মোটামুটি পশ্চিমা/প্রায় পশ্চিমা নাম দেয়া হয়।

এটা কেন? ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স? চরিত্রটির নাম কেন সিরাত হল না?

সিরাত হতেই হবে!!

তুলিরেখা এর ছবি

ভেবেছিলাম নাম দেবো অর্চিষ্মান। টাইপাতে গিয়ে আঙুল ভেঙে যাবে। মন খারাপ
পশ্চিমা গল্পেও বেশ অনেকসময় আনকমন নাম থাকে, এম কিউ, জেরোডিন এরকম সব নাম! হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

খেকশিয়াল এর ছবি

পরের পর্ব দেন শিজ্ঞির!

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

তুলিরেখা এর ছবি

দিমু গো পন্ডিত, দিমু। একটু রইয়াসইয়া খিয়াল কইরা। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

স্বপ্নহারা এর ছবি

অপেক্ষায় নাজির
আপ্নের লেখা এত কাব্যিক কেন? মুগ্ধ হয়ে যাই!

-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
আশা করি শীঘ্রই দিতে পারবো ২য় অংশ।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

তুলিরেখাপু, এটা কত সালের কাহিনী?

গিবান ধরে ধরে বাড়ী নিয়ে এসেছিলো, মা যখন ওর ক্ষততে ডেটল দিচ্ছিলেন, তখন ও দৌড়ে মোড়ের ওষুধের দোকান থেকে মলম কিনে এনেছিলো

বাহ, ডেটলতো মনে হয় দীর্ঘায়ু লাভ করলো। রেকিট বেনকাইজার কে অভিনন্দন।

---- মনজুর এলাহী ----

তুলিরেখা এর ছবি

ডেটল থাকবেই। ভবিষ্যতের লোকেরাও পড়ে হাতপা ছড়ে কি আর যাবে না? চিন্তিত
বোরোলীনকে প্রোমোট করতে পারলে বেশ হতো, লোকাল থেকে গ্লোবাল হয়ে যেতো। হাসি

-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।