ত্রিস্রোতা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৬/২০১৩ - ৩:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

ট্রেনটা আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে আনছে, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো নীলা। কাঁধের ব্যাগটা কাঁধেই ঝোলানো আর পাশেই চাকা লাগানো ট্রাভেল ব্যাগ। এখানে ট্রেন বেশীক্ষণ থামে না, নীলা জেনেছে আসার আগেই। এখন ট্রেনটা থামতেই লাফ দিয়ে নেমে ককিয়ে উঠলো নীলা। পেটের সেই ব্যথাটা। ধুত্তেরি ছাই, মনেও থাকে না।

ডানহাত দিয়ে চেপে ব্যথাটা সামলাতে সামলাতে ট্রাভেল ব্যাগটায় টান দিলো। ট্রেন ততক্ষণে হুইসিল দিয়ে দিয়েছে, ব্যাগটা থুপ্‌ করে পড়লো প্ল্যাটফর্মে। নীলা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বসে পড়লো লাগেজব্যাগের উপরে, উফ্‌, তবু তো সে সবসমেত নামতে পেরেছে!

সন্ধ্যে নেমে আসছে নির্জন প্ল্যাটফর্মে, এখানে সে ছাড়া আর কেউ নামে নি। কোনো জনমানব দেখা যায় না কোনোদিকে, গুমটিঘরটা ও বন্ধ। হয়তো ওদিকে গুমটি পেরিয়ে দোকানপাট কি বাজারমতন কিছু আছে, এখান থেকে দেখা যায় না। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো বৃষ্টি হয়ে গেছে, প্ল্যাটফর্ম ভেজা আর পিচ্ছিল। এই এলাকা জনবিরল সে জানতো, কিন্তু এতটা?

কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দূরে চলে যাচ্ছে ট্রেন, এখানে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলে না, বিদ্যুতের লাইন নেই, কয়লার ট্রেন। আকাশে আলো ফুরিয়ে আসছে, একা নীলা বসে আছে এখানে,ব্যথাটা চিড়িক চিড়িক করে উঠছে। ক্লান্ত নীলার মনে হচ্ছে ওর সমস্ত জীবনটার উপরে সন্ধ্যে নেমে আসছে। আলো কমে আসছে।

চব্বিশ বছর বয়সে সে সমস্ত অতীতজীবন অস্বীকার করে নতুন করে সব শুরু করতে এসেছে এখানে, এই বহুদূরের অচেনা মফস্বলশহরে। ম্লান একটা হাসি ফুটে ওঠে নীলার ঠোঁটে-শুরু না শেষ?

ব্যথাটা কমে এসেছে, কিন্তু এখনো আছে। তবু নীলা উঠে দাঁড়ায়, এখন রিকশার খোঁজ করতে হবে, কেজানে কতদূরে হবে ওর গন্তব্য ঠিকানা। রিকশাই বা পাওয়া যাবে কিনা কেজানে!

ঝোলা ব্যাগটার পকেট থেকে এক টুকরো চিরকুট বের করে নীলা, এইখানেই ঠিকানাটা লেখা। লাগেজব্যাগ টানতে টানতে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গুমটীর দিকে যেতে যেতে প্রতি পদক্ষেপে ক্লান্তি আর আরো ক্লান্তি। কান্না পায় নীলার কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে কান্নার দমক সামলায়। মানুষের কি শূন্যতার অনুভূতি সত্যি করে হয় না? সব হারিয়ে ফেলে এসেছে নীলা কিন্তু বিষাদ, দুঃখ, কান্না এসব তো পিছু ছাড়ে না! স্মৃতির অত্যাচার তো শেষ হয় না!

এর মধ্যেও মনে পড়ে কত কী! শ্যামলী কী করছে এখন? আর মণিদীপা? ওরা নিশ্চয় জানতে পেরেছে এতক্ষণে! ওরা কি নীলার জন্য দুঃখ করছে? ওরা কি নীলার জন্য কেউ কিছু বলতে পারবে? শ্যামলী আঠেরো পেরিয়ে উনিশে-সে সাবালিকা,কিন্তু তাও কতটুকু বলতে পারবে? এখনো সে কলেজছাত্রী মাত্র! আর সতেরো বছরের মণিদীপা তো এখনো সাবালিকাই হয় নি!

কেউ কিছু বলবে না, পারলেও বলবে না-নীলা ডিস্কার্ডেড। কোনো সেকেন্ড চান্স তাকে দেওয়া সম্ভব হবে না কারুর পক্ষে।একদিকে ভালোই, তারও কোনো দায় রইলো না।স্বাধীন সে নিজের অদৃষ্ট নিয়ে ভেসে যাবে পৃথিবীর পথে।

ঐ তো দেখা যায় আলো, মিটমিটে কিছু আলো-হ্যারিকেন লন্ঠন নাকি? দোকান পাট আছে আর দোকান পাট থাকলে রিকশাটিকশা কি আর...ভাবনায় ছেদ পড়ে নীলার, ক্রিং ক্রিং ক্রিং! সাইকেল চালিয়ে এই পথেই আসছে একজন লোক।

কাছে এসে সাইকেল আস্তে করে লোকটি জিগায়-"দিদি, আফনে কি এই টেরেনে আইলেন? যাইবেন কই? নবকন্ঠ ইস্কুলের সেক্রেটারির বাড়ীত্‌? "

নীলা তাকায় ভালো করে, মধ্যবয়সী লোকটির কথায় গ্রাম্য টান। পোষাক পরিচ্ছদ বলতে ফতুয়া আর পাজামা। তেলচাপ্টি মাথার চুল। কিন্তু কথাগুলো শুনে নীলা অবাক, সে সত্যি নবকন্ঠ ইস্কুলের সেক্রেটারির বাড়ীতেই যাচ্ছে! আজকে তো এছাড়া উপায়ও কিছু নেই, হোটেল নামক কোনো জিনিসের নামই হয়তো কেউ শোনেনি এদিকে।

ইস্কুলে পড়ানো শুরু করলে নিশ্চয় থাকার জায়গা একটা ব্যবস্থা কিছু হবে। স্কুল যখন আছে, একটা ছোটোখাটো লাগোয়া শিক্ষিকা-আবাস কি আশা করা অনুচিত? নীলার সন্দেহ হয় তবু। তবে সে নাহয় পরে বোঝা যাবে, ভাড়াটাড়া কিছু মিলবে নিশ্চয়।

নীলা বলে,"হ্যাঁ, সেখানেই যাচ্ছি।"

সাইকেল-আরোহী লোকটি আগেই সাইকেল থামিয়ে একপা মাটিতে রেখে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়েছিলো, এখন সাইকেল দাঁড় করিয়ে বললো,"আমারে সেক্রেটারিমশয় পাঠাইলেন। দেরি হইয়া গেছে এট্টু, মাফ কইরা দ্যান। ভোলা রিকশা নিয়া দাঁড়াইয়া আছে ঐ মোড়ে, বেশী দূর না। এইটুক আইতে পারবেন?"

নীলা সম্মতি জানিয়ে এগোতে থাকে, লোকটি নীলার ব্যাগটা তার সাইকেলের সীটে বসি্য়ে সাইকেল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসে। নীলার ছোটোবেলা গাঁ-মফস্বলেই কেটেছে, পরে হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকে শহরের সঙ্গে চেনাচেনি। কলেজপর্বও কেটেছে শহরেই।এই ছোটোখাটো চেহারার গ্রাম্য লোকটিকে ভালোই লাগছিলো নীলার, কিছু সহজাত অনুভূতি থাকে, যা দিয়ে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী চেনা যায়। শহরে সেই সহজাত যন্ত্র কাজ করেনি-অন্তত নীলার ক্ষেত্রে। এত মুখোশ, এত মেকি জিনিস সেখানে, মানুষ চেনা দুষ্কর! কিংবা সে হয়তো বিশ্বাস করতেই চেয়েছিল শুধু, বিচার বিশ্লেষণ করতে চায় নি।

ক্রমাগত জেগে উঠতে থাকা নাছোড় স্মৃতি জোর করে মুছতে এগোতে থাকে নীলা। এসে গেছে সেই মোড় যার কথা বলছিলো লোকটি। হ্যাঁ, এই তো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাচালক নেমে দাঁড়ায়-কালো লম্বা লোকটি, সাদা গেঞ্জী আর নীল লুঙ্গি পরা। নিশ্চয় এর নামই ভোলা।

সাইকেলওলা লোক ওকে কিছু বলে, নীলা ততক্ষণে রিকশার কাছে, উঠে পড়ে। সীটে বসে ভাবে তাহলে এতক্ষণে একটা যাবার জায়গার খোঁজ আর যানবাহন মিলে গেলো। নইলে কোথায় কিকরে খুঁজতো এই আঁধার সন্ধ্যেবেলা অচেনা জায়গায়? এত সন্ধ্যে হয়ে যাবার কথা ছিলো না কিন্তু ট্রেনে অনেক লেট করলো। সাইকেলওলা লোকটি নীলার লাগেজ ব্যাগটা রাখে নীলার পা্যের পাশে। হেসে বলে, "দিদি, আসি তাইলে এইবার। "

রিকশা চলছে, একদম ছোটোবেলা থেকে অনেকটা সময় পর্যন্ত রিকশা ছিলো বলতে গেলে নীলার চড়া একমাত্র যানবাহন। তারপরে শহরে যাওয়া, সেখানে বাস ট্যাক্সি চড়ায় সড়গড় হয়ে গেলো। বাড়ী ফেরার সময় রেলস্টেশন থেকে বাড়ী যেতে তবু রিকশাই ছিলো আরো অনেকদিন। এখন সেখানেও অটোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় অল্প ঝাঁকুনি লাগে, নীলা সামলে বসে, পেটের ব্যথাটা এখন অনেকটা কম। হয়তো ক'দিনের মধ্যে কমেই যাবে, সেরে গেলেই ভালো। নইলে আবার ডাক্তার হ্যানো ত্যানো...

দোকানবাজার ছাড়িয়ে এসেছে, এখন রাস্তার দুধারে খোলা জমি-ধানক্ষেত মনে হচ্ছে-জমির কিছু কিছু অংশ ন্যাড়া, শুধু ধানগাছের গোড়াগুলো রয়ে গেছে, ধান কেটে নিয়ে গেছে, কিছু কিছু অংশে এখনো কাটা হয় নি, হেমন্ত হাওয়া সেখানে ঝিং ঝিং করে বয়ে যাচ্ছে পাকা ধানের গোছার উপর দিয়ে। একটা আশ্চর্য গন্ধ পাকাধানের। বহুযুগের ওপার থেকে যেন আসছে নীলার কাছে।

সেই ছোট্টোবেলা মামাবাড়ীতে গেছিলো একবার, সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে গেছিলো মামা, সেই মাটির রাস্তা, চারিপাশে বাঁশঝাড়, ধানক্ষেত,বৈদ্যুতিক আলোর কোনো বালাই সেখানে নেই, টিমটিমে কেরোসিনের কুপিতে আলো জ্বলছে, আলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশী তাতে...দিদাকে মনে পড়ে,সাদা থান পরা বৃদ্ধা এক,পরে জেনেছিলো যত বৃদ্ধা মনে হতো তত বৃদ্ধা আসলে দিদা ছিলো না, নীলা যেতো ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেলে।তখন মণিদীপা জন্মায় নি শ্যামলী তখন ছোট্টো...ওরা একটু বড়ো যখন হলো তখন দিদা আর নেই, মামারা তখন টাউনে চলে এসেছে, টাউনের বাড়ীঘর অন্যরকম। শ্যামলী-মণিদীপারা সেই দূর পাড়াগাঁয়ের মাটিলেপা ঘরবাড়ী কখনো আর দেখতেই পায় নি!

এতক্ষণ টের পায় নি, এখন হাওয়ার শিরশিরে শীতভাব টের পেলো, আঁচলটা জড়িয়ে বসলো নীলা। এখনো আসল শীত আসে নি, পৌষ মাঘে কিরকম শীত পড়ে কেজানে এ অঞ্চলে। খুব বেশী শীত আজকাল কি আর কোথাও পড়ে? সব অঞ্চলই তো গরম হয়ে উঠছে দিন দিন-বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি না কে যেন!

রিকশা আস্তে হয়, তারপরে থামে। এসে গেছে। ক্রিং ক্রিং শুনে তিনজন বেরিয়ে এসেছে-মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক-ইনি সম্ভবত সেক্রেটারি বলাইবাবু,সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে অল্প ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা-খুব সম্ভব বলাইবাবুর স্ত্রী আর ফ্রক পরা একা ছোট্টো মেয়ে।

নীলা নামলো, ভদ্রলোক এগিয়ে এসে মালপত্র নামাতে সাহায্য করলেন।নীলা ব্যাগ থেকে চিঠি বার করে,ওর নিয়োগপত্র। উনি চিঠিটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে হেসে বলেন, " আসুন।আজকের মতন আমাদের বাড়ীতেই অতিথি থাকতে হবে। একটু কষ্ট হবে। কাল থেকে টিচার্স কোয়ার্টারে থাকতে পারবেন। জায়গাও ভালো, স্কুলের প্রায় লাগোয়া। বাড়ীর পিছনের বাগানে গেলেই চমকে উঠবেন-পাশেই নদী।" কথা শেষ করে ভদ্রলোক হাসেন।

চমৎকার! নীলাও হেসে ওঠে।

(চলমান)


মন্তব্য

সুমাদ্রী এর ছবি

চলুক! চলুক

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Joltorongo এর ছবি

চলুক। চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক! চলুক
- একলহমা

তুলিরেখা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মরুদ্যান এর ছবি

আহা এত ছোট পর্ব কেন? হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

তুলিরেখা এর ছবি

গল্প তো। পর্ব আর কত বড় হবে? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অন্যকেউ এর ছবি

চমৎকার! পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ। পরের পর্ব আসছে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

খন্দকার আলমগীর হোসেন এর ছবি

জমে উঠল কিন্তু। তাকিয়ে রইলাম।

____________________________________________________________________
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
পরের পর্ব কিছুদিনের মধ্যেই দিতে পারবো আশা করছি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নজমুল আলবাব এর ছবি

এটা উপন্যাস হবে?
অপেক্ষায় থাকলাম

তুলিরেখা এর ছবি

উপন্যাস হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না এখনো। দেখা যাক কী হয় শেষ অবধি।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।