উৎসপৃথিবী(২)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ০৭/১২/২০১৩ - ২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্নান সেরে হাল্কা গোলাপী নরম ড্রেসিং গাউন পরে বেরিয়ে আসে অদীনা, মাথায় ভেজা চুল শুকনো তোয়ালেতে জড়িয়ে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে তখন টোস্ট এগপোচ চা কফি এইসব সাজাচ্ছে হিন্দোল। সেদিকে চেয়ে একটু হেসে নিজের ঘরে চলে যায় অদীনা। হেয়ার-ড্রায়ার চালিয়ে দিয়ে চুল শুকনো করতে করতে সে গুণগুণ করে কী একটা গানের কলি। অদীনা কোনোদিন গান শেখেনি বটে, কিন্তু তবু কেন জানি প্রতি সকালেই একটা না একটা গানের সুর তাকে অধিকার করে।

সে পোশাক টোশাক সব পরে চুল টুল আঁচড়ে মুখে ক্রিম মেখে ডাইনিং রুমে এলে হিন্দোল ওর দিকে চেয়ে হাসে, বলে "আজকে তোমাকে অনেক ফ্রেশ দেখাচ্ছে অদীন। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?"

হেসে "হ্যাঁ " বলে অদীনা, চেয়ারে বসে এগপোচের প্লেট নেয়, থ্যাংকু দিয়ে খেতে শুরু করে। বেশ খিদে পায় আজকাল ওর। আগে তো খিদেই পেত না বিশেষ, তবু খেয়ে নিতে হতো নিয়মিত সময়ে। এখন সত্যি সত্যি খিদে পায়, সকালে দুপুরে বিকেলে রাত্রে। ডক্টর হপকিন্স শুনে খুব খুশি হয়েছেন। অদীনা জানে হিন্দোল ও মনে মনে খুব খুশি, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না, খুব চাপা স্বভাবের ছেলে হিন্দোল।

অদীনার মাঝে মাঝে ভিতরটা উথলে উথলে ওঠে। সে ভাবে, এইভাবে যত্ন করছে হিন্দোল, এইভাবে নিঃশর্তে ভালোবাসছে, এত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যোগ্য কি সে? কে তুমি অলক্ষ্য ঈশ্বর, এই পার্থিব কন্যার জন্য পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছ এমন আশ্চর্য অলৌকিক ঐশ্বর্য? এত কোমল বৃক্ষছায়া, এত শীতল, স্নিগ্ধ ঝর্ণাজল? সে কোথায় যেন শুনেছিল প্রার্থনা সঙ্গীত, "আমার হৃদয় বনহরিণী, তুমি তাকে নিয়ে যাও শীতল স্রোতের কাছে, তৃষ্ণার্ত তাকে তৃপ্ত করো সেই জলে। আমাকে নিয়ে যাও কচি ঘাসে ভরা সবুজ উপত্যকায়, সেখানে বিশ্রাম নিয়ে আমি ক্লান্তি দূর করি। তুমি আছো বলেই ভয় নেই, যখন আঁধারে বেরিয়ে আসে হিংস্র পশুরা, তখনো ভয় নেই, তুমি আমার সঙ্গে আছো বলে। তোমার ভালোবাসা ভরে দিল এই মাটির কলস, কানায় কানায়।" কোথায় শুনেছিল অদীনা? কোন্‌ অচিন একতারাওয়ালির গলায়?

সোনালি পাড়ওয়ালা সাদা চিনেমাটির কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দেয় হিন্দোল। অদীনা আহ বলে ওঠে আরামের একটা চুমুক দিয়ে। খুব ভালো লাগছে তার। ক'দিন হলো পৃথিবীটাকে ভারী ভালো লাগছে অদীনার, সামান্য সামান্য প্রতিদিনের চেনা জিনিসগুলোকেই অসামান্য লাগছে। এককাপ চা, একটা ওমলেট, চাট্টি সাদা ভাত আর একটুখানি সব্জিভাজা-মনকে ভরিয়ে দিচ্ছে। ফুলদানিতে লম্বা সবুজ পাতা আর কোমল উজ্জ্বল নীল কয়েকটি ফুল-এইসব টুকরো টুকরো জিনিস মনকে ভরিয়ে তুলছে কানায় কানায়।

এতকাল যেন স্বেচ্ছানির্বাসনের গুহায় ঘুমিয়ে রয়েছিল অদীনা, এতদিনে জেগে উঠেছে সকালের নতুন আলোয়। এখন ওর সত্যি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে অনে-এ-এক দিন, ইচ্ছে করছে বাগান ভরে গাছ লাগাতে, সে দেখবে তাদের বেড়ে ওঠা, দেখবে ফুলেফলে তাদের ভরে যেতে, দেখবে তাদের ডালে উড়ে এসে বসছে কত বিচিত্রবর্ণ পাখি। হিন্দোল আর ও গার্ডেন চেয়ারে বসে দেখবে শিশুরা খেলা করছে সবুজ ঘাসের উপরে।

হিন্দোল আপিসে বেরিয়ে গেলে অদীনা চুপচাপ ছবি আঁকে সাদা কাগজে। বেশিরভাগই ল্যান্ডস্কেপ আঁকে সে। আজ আঁকছে সন্ধ্যার রাঙা আভায় ভরে থাকা একটা নদী, পাড়ে ছোট্টো একটা কুটির, তালগাছ, আমগাছ, আতাগাছ। ছোটোবেলার ছড়া মনে পড়ে, "আতাগাছে তোতাপাখি/ ডালিমগাছে মৌ।"

এক জীবনে কোথা থেকে কোথায় চলে এলো সে, তবু পথ তো শেষ হয় না! পথ কি কোনোদিন শেষ হয় আসলে? সব পথই তো অনন্তের দিকে চলে গেছে।

কেন সে এসেছে, কীসের জন্য সে জন্মেছিল আর কোথায় কাদের মধ্যে সে আছে? হঠাৎ সেই তীব্র অতৃপ্তি ফিরে আসে মনে, মুখে নিমপাতার মতন তেতো স্বাদ। রঙতুলি সব গুটিয়ে ফেলে অদীনা। হচ্ছে না, হচ্ছে না, বড় ক্লান্তি লাগে। বুকের ভিতরের কষ্টিপাথরে নিজের কাজগুলোকে ঘষা দিয়ে দিয়ে সে দ্যাখে, এসব কিছুই কি সে করতে চায়? ভালো করে পরখ করে দ্যাখে একটু কোনো সোনালি দাগ কি পড়লো কোনোটার থেকে?

শোবার ঘরে এসে সে আস্তে আস্তে বিছানায় গা ঢেলে দেয়, আজকে এখনই একবার সেই রিল্যাক্সেশন টেকনিক অভ্যাস করে নিলে কেমন হয়? হিন্দোল তো ফিরবে সেই বিকেল পাঁচটার পরে। এসে ওকে ডিনারে নিয়ে যাবে চাইনিজ বাফেতে। আজকে তাই ঘরে আর লাঞ্চও খাবে না অদীনা। এখন অনেক সময় আছে ওর হাতে।

বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকায় অদীনা, সোনালিরুপালি নকশাকাটা খুব বাহারী একটা ফ্যান সেখানে ঝুলছে, ডোমপরানো আলো চারখানা তার উপরে। সেখান থেকে ঝুলছে দুখানা ধাতব শিকল, একটা তানলে আলো জ্বলে, একটা টানলে পাখা। খুব কমই ব্যবহার হয় এই দুটো, এমনি ঘরে যে আলো আছে, দেওয়ালের গায়ে, সেইতেই কাজ চলে সব সময়। তবু এই বাহারী ফ্যান আর ডোমপরানো আলো খুলে ফেলা হয় নি, রয়েই গেছে, ডেকোরেশনের মতন।

সেইদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফ্যালে অদীনা, পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মন তুলে নিতে থাকে একে একে, সব পেরিয়ে মাথা পর্যন্ত এসে গেলে দেহ শিথিল হয়ে যায়, বাতাসে ভাসার মতন হাল্কা লাগে এখন। আহা, এইবার ঘুম, এইবার স্বপ্ন। এসো রোহিতাশ্ব, এসো।

*******

অচেতন রোহিতাশ্বের দিকে এগিয়ে আসে মেয়েটি, নীচু হয়ে পরখ করে দেখে। জল দেবার কথা হয়তো মনে হয় ওর, সে চারদিকে চোখ ফেলে দেখে। ঐ তো কাঠের বেদীর উপরে পিতলের কলসী, নিশ্চয়ই জল আছে কলসে। পাশে কাঁসার একটি ভারী গেলাসও উপুড় করা! বাহ,ঐ গেলাসে জল নিয়েই ছেটানো যাবে।

জলের স্পর্শে আস্তে আস্তে চেতনা ফেরে রোহিতের, তালপাতার পাখায় মেয়েটি হাওয়া করছিলো। চোখ মেলে রোহিতাশ্ব আস্তে আস্তে ওঠেন, বসেন, এবারে আর চমকান না, ভয় পান না, কিন্তু কথাও বলতে পারেন না, বাক্যহীন হয়ে বসে থাকেন, মেয়েটি নীরবে পাখার বাতাস করে যায়। রাত্রি বয়ে যেতে থাকে।

রোহিতাশ্বের সবকিছু স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগে, হয়তো এ মেয়েটিও স্বপ্ন, হয়তো এখনই মিলিয়ে যাবে শরতের মেঘের মতন এই মেয়েটি। সদানীরার মুখের সঙ্গে এর মুখের কোথায় যেন খুব মিল! মনটা শান্ত জলের মতন স্থির হয়ে আসে রোহিতাশ্বের, মনে হয় সত্য হোক বা স্বপ্ন, মেয়েটি থাকুক আরো কিছুক্ষণ। কিন্তু মেয়েটি হাসে, বলে, "আমার তো এইবারে যেতে হবে রোহিতাশ্ব। কিন্তু আমি কালকে রাত্রে আবার আসবো। আপনি ভয় পাবেন না তো? "

নীরব রোহিত আস্তে আস্তে মাথা কাত করেন সম্মতি বোঝাতে যে আগামীকাল তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন। পাখা রেখে দিয়ে মেয়েটি আস্তে আস্তে বাইরে যায়, মাঠের পায়ে চলা পথটির উপর ওর চলন্ত অবয়ব আস্তে আস্তে ছোটো হয়ে আসে, বাতায়নলগ্ন রোহিতাশ্বের উৎকন্ঠ চোখের সামনে কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায় আগন্তুক যুবতী, চোখ কচলে আবার তাকান রোহিত, এই ছিলো আর তো নেই! চোখের ভুল? সত্যি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন রোহিতাশ্ব? ঘুম হয়নি ঠিকমতো তো সত্যিই, এতরাত জেগে জেগে কদিন লেখার কাজ করছেন, তাহলে কি সত্যি ভুল দেখছেন? জাগ্রৎস্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়েছে ক্লান্ত মস্তিষ্ক?

ঘুমাতে হবে, ঘুমানো দরকার ভেবে মাটিতে শীতলপাটি বিছিয়ে এক ফুঁয়ে প্রদীপ নিভিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যান রোহিতাশ্ব।

*******

ফোনটা বাজছে, ঘুম ভেঙে যায় অদীনার। ফোনটা ধরে কানে লাগায় অদীনা,"হ্যালো।"

ওপাশ থেকে বহুকাল ভুলে যাওয়া গলা,"অদীনা, আমি সায়ন্তনী বলছি। চিনতে পারছিস আমায়? ইস্কুলে অতগুলো বছর একসঙ্গে, চিনতে পারছিস?"

অদীনার মনে পড়ে। সে অবাক গলায় বলে,"সায়ন্তনী? কতকাল পরে রে! অবাক কান্ড! তা তুই কেমন আছিস? কোথা থেকেই বা বলছিস?"

"আরে তোর ভাইয়ের থেকে তোর ফোন নাম্বার পেলাম। তোর ভাই তো এখন আমাদের শহরে! হঠাৎ ফোন করে খুব চমকে দিয়েছি, না?"

"তা সত্যি, চমকে দিয়েছিস সত্যিই। আমি ভাবিই নি তোর ফোন পাবো কোনোদিন! কেমন আছিস? "

অদীনার মনটা ছলছল করে, সেই কঠিন রুক্ষ কিশোরীবেলার দিনগুলিতে এই সায়ন্তনীই ছিলো একমাত্র প্রকৃত বন্ধু অদীনার, ওর কাছেই কিছুটা হলেও মনকে খুলে ধরতে পারতো অদীনা। অন্য আর কারু সঙ্গে এত কাছের বন্ধুত্ব ছিলো না ওর।

সায়ন্তনী খুব ভালো গান গাইতো, ক্লাসিকাল শিখতো আর খুব ভালো রবীন্দ্রগানও গাইতো। অদীনা গান গাইতে পারতো না, ওকে গানের স্কুলে যেতে দেয় নি বাড়ীর থেকে, সায়ন্তনীর গান শুনে ওর কিছুটা সাধ পূরণ হতো। মধু খুব মন ঢেলে ওকে গান শোনাতো, ও জানতো গাইতে পারেনা বলে অদীনার মনে খুব কষ্ট। কেউ তা জানে না, কাউকে কোনোদিন বলে নি অদীনা,বললেও কেউ বুঝবে না এই ভয়ে। সায়ন্তনীকেও বলে নি, ও এমনিই বুঝে নিতো। খুব সংবেদনশীল আর সূক্ষ্ম অনুভূতির মেয়ে ছিলো সায়ন্তনী।

অদীনার এখনো মনে পড়ে, শরতের সন্ধ্যা, মহালয়ার আগের সন্ধ্যা। আকাশ স্বচ্ছ কালো, চাঁদ নেই, ফুটফুট করছে তারা, ছায়াপথের হাল্কা ওড়নায় চুমকি চুমকি তারা জ্বলজ্বল। সেই আশ্চর্য নক্ষত্রের রাতে ছাদে মাদুর পেতে বসে তারা দুটি কিশোরী, সায়ন্তনীর কোমল মিষ্টি কিশোরী গলায় কী সুর! ও গাইছিলো,"মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।..." এই গানটা বিশেষ প্রিয় ছিলো অদীনার, তাই সায়ন্তনী এই গানটাই বেশী গাইতো। এটা শেষ হলে ও গেয়েছিলো,"আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান..."

সায়ন্তনীকে আকাশে দিকনির্দেশ করে অদীনা সেদিন চিনিয়েছিলো রাজহংসমন্ডল, সিগনাস। তার পুচ্ছের উজ্জ্বল তারাটি, ডেনেব, বাংলা নামটি ছায়াগ্নি। ছায়াপথের উত্তর প্রান্তে এই রাজহংসমন্ডল। দক্ষিণে তাকালো ওরা, ধনুরাশি চেনালো অদীনা, পাশেই বৃশ্চিকরাশি, তাতে জ্বলজ্বলে কমলা জ্যেষ্ঠা তারা, ধনুরাশির মধ্য দিয়ে দেখা ছায়াপথের কেন্দ্রটি, সেদিকে ঝাপসা আলোয় যেন তারার চূর্ণ ছড়ানো। মুগ্ধ হয়ে আকাশে তাকিয়েছিলো সায়ন্তনী,তারপরে চোখ ফিরিয়ে অদীনার দিকে চেয়ে ছিলো।

সব মনে পড়ছে অদীনার। এক এক করে সব মনে পড়ছে। কিছুই কি হারায় না? সবই রয়ে যায় কোথাও না কোথাও? অলক্ষ্য ক্যামেরায় তোলা গুপ্ত চিত্রমালা হয়ে? শুধু যে দেখতে চায়,কেবলমাত্র সে ই দেখতে পায়? অদীনা তো চায় না দেখতে, ভালো ভালো ছবির সঙ্গে ওখানে যে অনেক কঠিন কষ্টের ছবিও রয়ে গেছে, সেইসব বন্ধ ঘরের তালা খুলে ফেলতে তো সে চায় না, ঐসব বন্ধ ঘরের সামনে যেতেই যে তার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে কষ্টে! তবু কেন বার বার ফিরে আসে সব? ঐ হেমন্তগোধূলির ম্লান বিষন্ন আলো, ঐ ছায়া-ছায়া বারান্দা, ঐ ম্লানমুখ দুঃখী শিশুটি, ওর আহত অবাক দৃষ্টি, ঐ শীত শীত হাওয়ায় ঝরে ঝরে পড়তে থাকা সাদা সাদা নরম ফুল! সব আজ কত দূরের, বিগত জন্ম যেন! তবু কেন ফিরে আসে? কেন এমনভাবে ফিরে আসে? এত রক্ত ঝরায়? কেন? নিষ্করুণ মুহূর্তমালা কী তীব্র উদাসীন! স্মৃতি এত অত্যাচারী কেন? মনে যদি পরেই বেছে বেছে ভালো ছবিগুলো মনে পড়ে না কেন? হায় অদীনা, তোর মন এত দীনহীনা কেন?

"কী হলো অদীনা, চুপ হয়ে গেলি যে!" ফোনে সায়ন্তনী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে,"তোকে কি অসময়ে ফোন করে বিরক্ত করলাম? ব্যস্ত ছিলি, নারে? "

"না, না, সায়ন্তনী, কীসব বলছিস? আসলে পুরানো কথা ভাবছিলাম, তুই আমায় গান শোনাতিস, মনে পড়ে?"

"হ্যাঁ মনে পড়বে না? আর তুই আমায় তারা চেনাতিস।" ফোনের দুজনে দুপ্রান্তে হেসে ওঠে, মাঝখানে টলমল করে ওঠে মহাসমুদ্র, নদীসমূহ আর মহাদেশীয় বিস্তার। আর কি কোনোদিন সায়ন্তনীর সঙ্গে দেখা হবে? কথা বলতে বলতে অদীনা ভাবে।

অনেকক্ষণ কথা বলে তারপরে কথা সেদিনের মতন থামলো,কত তুচ্ছ ছোটোখাটো কথা উঠলো পড়লো, যা তখন এতটুকু গুরুত্বপূর্ন মনে হয় নি! দেশ্কালের দূরত্বে তা কত না রঙীন, কত না উজ্জ্বল!

হিন্দোল ফিরলো সাড়ে পাঁচটায়, অদীনা তৈরী হয়েই ছিলো। হিন্দোল হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই ওকে নিয়ে চললো চাইনিজ-বাফেতে। প্রায়ই ওরা এই চাইনিজ রেস্তরাঁতে খায় সন্ধ্যায়। হেসে ওয়েটার মেয়েটি অভ্যর্থনা করে,নরম প্রাচ্যদেশীয় মুখে হসিটা ভরী মিষ্টি লাগে। এটি ছোটো একটি বাফে, পারিবারিক। বেশী ভীড় নেই, পরিবেশটি খুব শান্ত। অদীনা এখানে আসতেই ভালোবাসে। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে টেবিলটিতে নিয়ে যত্ন করে বসিয়ে ওদের ঠান্ডা পানীয় দিয়ে যায় ওয়েট্রেস।

বাফেতে কত রকমের সুন্দর সুন্দর চাইনিজ খাবার,চিকেনের আর চিংড়ির দুখানা পদ আর একটু ফ্রায়েড রাইস নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে অদীনা নিজের জায়গায় এসে বসে। অ্যাকোয়ারিয়ামটির মধ্যে লাল সোনালী মাছেরা আর হরেক সবুজ লতাপাতা, কৃত্রিম পাহাড় ইত্যাদি,জলবুদ্বুদ উঠছে আর উঠছে। দেয়ালে চাইনিজ উপকথার বাড়ীঘর, বাগান, গাছপালা, নৌকা, পাখি, রাজকুমারীর দল আঁকা। ভারী সুন্দর সব।

খেতে খেতে আস্তে আস্তে কথা বলে হিন্দোল, অদীনা আস্তে আস্তে জবাব দিয়ে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত হাত থেকে ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে, বুকের মধ্যে ব্যথা করে অদীনার। কেজানে কেন! ওকে সুখী করতে হিন্দোল এত করছে, আর ও শুধু মনের মধ্যে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেবলই মনে হয় কী যেন করার ছিলো! কে যেন ডেকেছিলো ওকে! কী যেন করা হচ্ছে না? আবছা আবছা এমন মনে পড়ে কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, কী সেই আরব্ধ কাজ যা তার তনুমনপ্রাণহৃদয় এমন করে ভরে দেবে যে আর এতটুকু শূন্যতা কোথাও থাকবে না, এতটুকু সময়ের ফাঁক থাকবে না, যেখানে বসে উতলা হাওয়ার বাদল দিনের কথা মনে পড়ে বা দখিন হাওয়ায় আকুল ভুলে যাওয়া বসন্তদিন মনে পড়ে।

বাড়ী ফিরে অনেকক্ষণ অদীনা হিন্দোল একসাথে। টিভিতে ভালো একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছিলো মিশরের পিরামিডের উপরে। দেখতে দেখতে রাত বাড়ে। ক্লান্ত অদীনা ক্লান্ত হিন্দোলকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে এসে পড়ে।

*******

রোহিতাশ্ব আজ আগন্তুক যুবতীকে দেখে এতটুকু বিচলিত হন নি, তিনি প্রস্তুত ছিলেন, উন্মুখ ছিলেন দেখা হবার জন্য। রোহিতাশ্ব আর আগন্তুক যুবতী মুখোমুখি দুখানা কুশাসনে বসে গল্প করেন, মাঝখানে জ্বলে শান্ত প্রদীপশিখাটি। রোহিতাশ্ব জানতে পারেন যুবতীর নাম নীরা, সে এসেছে অন্য সময়ের পৃথিবী থেকে। অন্য সময়ের পৃথিবী কথাটা অত্যন্ত অদ্ভুত শোনালেও এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্বপ্নজাত মুহূর্তের মতন আশ্চর্য এই দেখাশোনা বন্ধ করে দিতে চান না রোহিতাশ্ব, তাই এই বিষয়ে কিছুই প্রশ্ন করেন না।

নীরা কথাটার সঙ্গে সদানীরার এত মিল, সদানীরাকে জনান্তিকে মাঝে মাঝে নীরা বলেই তো ডাকতেন রোহিত! রোহিতের মনে হয় তার তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও সদানীরাকে ফিরে পাবার আকাংখা এই স্বপ্নসম্ভবাকে সৃষ্টি করেছে, অন্য সময় বা অন্য জগৎ যা বলছে মেয়েটি, তা হয়তো এই স্বপ্নজগৎ। মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন হয়ে কথা বলে যান রোহিতাশ্ব, সদানীরার কথা, শ্রুতি স্মৃতির কথা, ভেষজগ্রন্থের কথা, কালান্তক মহামারীর কাহিনি, সেই মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাহিনি---এইসব বলতে বলতেই তীব্র আকুল আত্মগ্লানিতে ভরে যায় রোহিতাশ্বের মন, ভেঙে পড়েন বলতে বলতে। নীরাকে বলেন, নিজে চিকিৎসক হয়েও সদানীরাকে আরোগ্য করতে পারেন নি বলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না। নীরা সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু রোহিতাশ্ব বিমর্ষ হয়ে থাকেন।

নীরা রোহিতের হাত ধরে বাতায়নের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, "রোহিতাশ্ব, বাইরে যাবেন? আকাশের নীচে দাঁড়ালে মন অনেক হাল্কা লাগে, দুঃখ চলে যায়। যাবেন?"

রোহিত মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাথা নাড়েন, নীরা তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। আকাশভরা তারা ফুটফুট করছে, বিশাল এ দিগন্তকিনারে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত নক্ষত্রালোকে অলৌকিক তরুণীর আশ্চর্য উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে রোহিতের মনটা আশায় একুল ওকুল ভরে টলটল করতে থাকে।মনে হয় ঊর্ধের ঐ ঈশ্বর যদি করুণা করে এই স্বপ্নমানবীকে বাস্তব করে দেন! যদি এই নীরা সদানীরা হয়ে রোহিতের আর্ত শুষ্ক দগ্ধ জীবনকে প্লাবিত করে!

অদ্ভুত গলায় নীরা এইসময় বলে ওঠে,"রোহিতাশ্ব, আমি ভবিষ্যতের মানুষ। আমার কাছে যা অতীত ইতিহাস, আপনার কাছে তা এখনো ঘটেনি। আপনি এই আশ্চর্য ঘটনার সুযোগ নিতে চান না? জানতে চান না কী ঘটবে ভবিষ্যতে?"

রোহিত অবাক কিছুক্ষণ। চুপ করে চেয়ে থাকেন নীরার মুখের দিকে।কী বলবেন ভেবে পান না। উদগ্র আগ্রহী গলায় নীরা বলে,"বলুন রোহিতাশ্ব। জানতে চান না কেমন করে নানা যুদ্ধ-হত্যা-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ একদিন ঊর্ধের ঐ শূন্যলোক বিজয় করবে? তারা থেকে তারায় ছুটে যাবে শূন্যযানে? জানতে চান না? ঐ চাঁদ,যা আকাশে দেখে মুগ্ধ হন,সেই চাঁদে একদিন গিয়ে দাঁড়াবে এই পৃথিবীর মানুষ? জানতে চান না সমুদ্রের জলের তলা দিয়ে চলবে মানুষের জাহাজ? জানতে চান না মুহূর্তে যোগাযোগ হবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে? বলুন, জানতে চান আপনি রোহিত?"

অবাক রোহিত ক্ষীণ দুর্বল গলায় আস্তে আস্তে আস্তে বলেন,"এইটুকু জীবন আমার, সামান্য, ক্ষণায়ুশাসিত। ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, ভাগ্যবিপর্যয়ে ন্যুব্জ। নিকট অতীত আর নিকট ভবিষ্যতে মোড়া বর্তমানের চলিষ্ণু পল অনুপল শুধু ধরতে পারি এই আর্ত হৃদয়ে। এর বাইরে মহাপৃথিবী আর মহাসময়কে ধরতে পারি এমন শক্তি কোথায় আমার?"

নীরার গলায় অচেনা সম্ভ্রম ফুটে ওঠে, বলে "আপনি কবি। এমন সুন্দর করে কথা বলেন! আপনিই যোগ্যতম ভবিষ্যতের ঘটনাবলী লিখনে। বলুন, আপনি লিখবেন?"

রোহিতাশ্ব ভাবেন, কী অদ্ভুৎ! তিনি যোগ্যতম মহাসময়ের পদচিহ্ন আঁকতে? এই তিনি এই সামান্য মানব, যার নিজেরই হৃদয় ভেঙে গেছে একটিমাত্র প্রিয়জনের অকাল বিদায়ে? এ তার নিজের স্বপ্ন নয় তো কি? স্বপ্নে ছাড়া এরকম কেউ সত্যি শুনতে পায় নাকি?

কিন্তু আপত্তিও করেন না, নীরার সঙ্গে ঘরে ফিরে আসেন, কুশাসানে বসে ভুর্জপত্র খুলে হংসপালকের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে তুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকান রোহিতাশ্ব, বলেন, "বলুন দেবী, কী লিখবো?"

(চলবে)

এখানে আগের পর্ব


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়তে ভালো লাগছিল, আগের পর্বটাও দেখে এলাম।
সময় থেকে সময়ে ঝাঁপাঝাঁপি নিয়ে লেখা একটা কঠিন জিনিস।
যদিও সব কিছু বুঝতে পারিনি, তবুও সবকিছু ‌ম্যাজিক ম্যাজিক লাগছিল।

শুভেচ্ছা হাসি

[মেঘলা মানুষ]

তুলিরেখা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, মেঘলা মানুষ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।