থাবা বাবা আর আমি

ইয়ামেন এর ছবি
লিখেছেন ইয়ামেন [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ৩০/১২/২০১৫ - ১০:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাজীব হায়দারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। এমনকি তার কোন লেখাও আমার কখনও পড়া হয়নি তার মৃত্যুর আগে। কিন্তু একটা অপরিচিত মানুষ কারো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদহারন আমার কাছে এই রাজীব হায়দার।
ফেব্রুয়ারি মাস, ২০১৩। শাহবাগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ফুঁসে উঠছে। পার্ডুতে পিএইচডি স্টুডেন্ট তখন আমি। ছয় মাস পরেই আমার ডিফেন্স, কিন্তু রিসার্চের কাজ ফেলে মন সারাক্ষন পড়ে আছে শাহবাগের জনস্রোতে, আর চোখ বাংলাদেশের সব নিউজ পোর্টাল আর ফেসবুক/টুইটারে। জীবনে প্রথম টুইটার একাউন্ট খুলেছিলাম সেই সময়টাতেই। শাহবাগের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পার্ডুর বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা ইভেন্টের আয়োজন করেছি। ফেসবুকে মানুষের শাহবাগকে সমর্থন দেয়া পোস্টের ছড়াছড়ি, সব দেখে মনে হতো বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে অনেক আশা করার আছে। গর্বে বুক ফুলে যেতো, আর মনে ভীষণ আক্ষেপ, কেন আমি এখন দেশে নেই, যদি একটিবার শাহবাগে গিয়ে গলা ফাটিয়ে 'জয় বাংলা' স্লোগানটা দিতে পারতাম আম্মার সেই বিশাল ছবিটার নীচে দাঁড়িয়ে...
১৫ই ফেব্রুয়ারি সব হিসেব ওলটপালট করে দিল। সকালে যথারীতি ল্যাবে গিয়ে ব্রাউজারের এক ট্যাবে ফেসবুক খুলতেই দেখলাম খবরটাঃ 'শাহবাগ আক্টিভিস্ট নিহত'। এই প্রথম রাজীব হায়দারের নাম শুনলাম। পড়লাম ব্লগে নাকি লিখত 'থাবা বাবা' নামে, এবং শাহবাগের সাথে প্রথম থেকেই জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে। রাজীবের ছবিটা দেখে অসম্ভব কষ্ট লেগেছিল। যাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই, তারা যে কি রকম মরিয়া হয়ে উঠেছে, তারা কত ভয়ঙ্কর তার হাতেনাতে প্রমান পেলাম। ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম আমি, সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে কঠিন বাস্তবে ফিরে এলাম একটা প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে। কিন্তু আসল ধাক্কাটা তখনও অপেক্ষা করছিল আমার জন্য।
থাবা বাবা নিহত হবার পরপর ফেসবুক আর টুইটার ভেসে গেছিল প্রতিবাদের বন্যায়। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই চিত্রটি পুরো উল্টো করে দিল যখন কিছু লেখা শেয়ার হতে শুরু করলো। লেখাগুলো যে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ইসলাম এবং নবীজী (সাঃ)কে নিয়ে চরম অবমাননাকর। দাবী করা হলো এসব নাকি রাজীবেরই লেখা (যদিও এ নিয়ে সন্দেহ এখনও আছে, কারন লেখাগুলো ওয়েবপেজে আপলোড করা হয়েছিল রাজীবকে হত্যা করার পরে)। সে একজন নাস্তিক ছিল, ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিখত, এসব খবর ফলাও করে প্রচার হতে লাগলো।
ফেসবুকে যেসব মানুষদের এর একদিন আগেও দেখেছিলাম শাহবাগ নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিতে, টুইটারে দেখেছিলাম রাজীব হায়দারের হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে, তারা চোখের সামনে ভোল পাল্টে ফেললো। হঠাৎ করে শাহবাগ হয়ে গেল একটা 'নাস্তিকদের আড্ডাখানা', এবং রাজীব হায়দার হয়ে গেল 'নাস্তিক ব্লগার, ইসলাম ধর্মের অবমাননা করার জন্য নাকি মৃত্যু যার অবশ্যই প্রাপ্য ছিল'। 'দেখেন যুদ্ধাপরাধের বিচার আমিও চাই, কিন্তু নাস্তিকদেরও তো এমন সব লেখা উচিৎ না, তাহলে তো থাবা বাবার মত এমন পরিনতি হতেই পারে' আজুহাতের সাথে প্রথম পরিচিতি হলো। এখনও মনে আছে একজন কাছের বন্ধুর ফেসবুকে কমেন্টটা, যে কিনা তার তিন চারদিন আগে শাহবাগে গিয়ে জয় বাংলা ক্যাপশন দিয়ে সেলফি তুলে এসেছিলঃ 'দেখ দোস্ত, আমার প্রথম পরিচয় আমি মুসলমান, একজন যুদ্ধাপরাধীর চেয়ে একজন নাস্তিকের মৃত্যু কামনা করা আমার জন্য আরও জরুরি' (বলাই বাহুল্য তার সাথে আর তর্কে যাইনি, চুপ করে ফেসবুক বন্ধু তালিকা থেকে ব্লক করে দিয়েছিলাম। জীবনে আর তার সাথে কথাও বলি নাই)।
প্রথম প্রথম খুব অবাক হয়েছিলাম। রাজীব হায়দারই যেসব নোংরা পোস্টগুলো শেয়ার হচ্ছিল সেগুলো লিখেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে, অকাট্য প্রমান ছাড়া একজন মৃত মানুষকে এভাবে কলুষিত করা কোন সহিহ মুসলমানের মতো কাজ? তার চেয়েও বড় কথা, যদি সে এসব লিখেও থাকতো, তাহলেও বা কি এসে যায়? একজন মানুষের ধর্ম নিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে পারে। আমার তার লেখা পছন্দ না হতে পারে, আমি এখন সেই লেখার প্রতিউত্তরে আরেকটা লেখা লিখতে পারি, বা তার লেখা এড়িয়ে চলতে পারি। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে একটা মানুষের মৃত্যুকে হালাল করে ফেলা, এসব কি? একজন মানুষের সাথে ধর্ম নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু সেই মানুষকে মেরে ফেললে বিতর্কের অবসান সেখানেই, যে কোপ মেরেছে সে সেই বিতর্ক হেরে গেছে।
এই কথাগুলো শুরুর দিকে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। এই ব্লগটা লেখার সময় আমার সেসময়কার ফেসবুক পোস্টগুলো দেখছিলাম, কতটা নাইভ ছিলাম আমি! কোরআন শরিফের রেফারেন্স দিয়ে পর্যন্ত মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করতাম কেন একজন মানুষকে কাফির বা নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে তার মৃত্যু হালাল করা যায় না...অবশ্য বেশীরভাগ মানুষকেই বুঝাতে পারিনি। তাই দেখতে থাকলাম যাদেরকে জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখিনি, যাকে নিয়মিত বারে গিয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতে দেখেছি, যেই মেয়েকে জানি স্কুলজীবন থেকে একাধিক শয্যাসঙ্গীর সান্নিধ্যে কাটিয়েছে, তাদেরও দেখলাম রাজীব হায়দার এবং শাহবাগের বিষয়ে এখন সুন্দর টুপি/হিজাব পড়ে ফেলতে। বাঙালী যে কি পরিমান হুজুগে মাতা এবং হিপোক্রেট একটা জাতি এর একটার পর একটা নজির দেখতে লাগলাম তারপর আশেপাশে। আর এসব ভন্ডদের সাথে প্রকৃত জামাতি ছাগুদের তখন অনলাইনে চলছে মহোৎসব! দেশবিদেশে তাদের নির্লজ্জ আস্ফালন, শাহবাগ এবং পুরো যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে নিয়ে কটাক্ষ, বিদেশী গণমাধ্যমে শাহবাগকে নিয়ে ভুল এবং ভ্রান্তিতে ভরা প্রতিবেদন (এখনও মনে আছে হাফিংটন পোস্টে একটা খবরের শিরোনামে শাহবাগকে 'এন্টি-ইস্লামিস্ট মুভমেন্ট' বলে সম্বোধন করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধের বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে চেপে)। সেসব দিনগুলো খুবই হতাশাজনক ছিল। বলতে গেলে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম আশেপাশের চেনা মানুষগুলোর নতুন রূপ দেখে। একটা সময় ভেবেছিলাম ফেসবুক/টুইটার সব বন্ধ করে দিবো, সব চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত পারিনি বন্ধ করতে। শাহবাগের প্রাক্বালে আমি খুবই সরল ছিলাম। আসলে শাহবাগের গণজোয়ার দেখে ভুলে গিয়েছিলাম বাস্তবতার কথা। যেই দেশে ধর্মের নামে একাত্তরে তিরিশ লাখ মানুষ নিধন করা হয়েছিল, বাংলা ভাইয়ের মত ধর্মান্ধ জঙ্গি এক সময় ত্রাস সৃষ্টি করেছিল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়, রমনার বটমূল থেকে উদিচির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমাবাজি হয়েছিল, হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির শিকার হতে হয়েছিল রাজীব হায়দারেরও প্রায় এক দশক আগে, শাহবাগ সেই দেশের আসল চিত্র না। তাই এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রতিবাদ করতে হবে, কলম চলতে হবে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, বাঙালী জাতির যাবতীয় হিপক্রিসির বিরুদ্ধে। তাই অনলাইন আর ছাড়া হলো না। বরং রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পর ক্রমশ আরও বেশী জড়িয়ে গেলাম এর মধ্যে। তা হোক ফেসবুকে, টুইটারে, কিংবা ব্লগোস্ফিয়ারে।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম শেষের শুরুটাও তা দিয়েই করিঃ রাজীব হায়দারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। এমনকি তার কোন লেখাও আমার কখনও পড়া হয়নি তার মৃত্যুর আগে। কিন্তু একটা অপরিচিত মানুষ কারো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদহারন আমার কাছে এই রাজীব হায়দার। তার জন্য আমি মানুষ চিনতে শিখেছি। তার জন্য যখন অভি-দা, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত, নিলয়, দীপন-দা চাপাতির শিকার হয়, টুটুল ভাই, রণ-দা, তারেককে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে হয়, তখন দেশের তামাম 'সহিহ মুমিন'দের প্রতিক্রিয়া দেখে আর বিচলিত হই না। তার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় করে বাংলাদেশে ব্লগার/এক্টিভিস্টদের বাহাত্তরের সংবিধান মেনে চলা রাজাকার-মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হয়, তাদের প্রবাসী কাউন্টারপার্টদের দেশে বেড়াতে গেলে চোরের মত লুকিয়ে যেতে হয়, হাল ছেড়ে দেই না। তার জন্যই যখন ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ দেখি, আরো বেশী করে এই কালো আইনের সমালোচনা করি। সব নষ্টের অধিকারে চলে গেলেও যতটুকু পারি তা দিয়ে সোচ্চার থেকেই যাবো।
আর কয়েক ঘন্টা পরে বাংলাদেশে ৩১শে ডিসেম্বরের সকাল হবে। রাজীব হায়দারের হত্যা মামলায় আসামীদের রায়ের দিন। যেই নরকের কীটগুলো এই হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসির রায় শুনানো হবে, সেই আশায় আছি। পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলের চেয়েও এই মামলার সঠিক নিষ্পত্তি আমার কাছে অনেক বেশী জরুরি। থাবা বাবার হত্যাকারীদের (যারা হাজতে আছে) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আমার দেশ আরেকবার দায়মুক্তির দিকে পা বাড়াক। যেই দায়মুক্তির অপেক্ষায় অভি-দা থেকে দীপন-দা, আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে। যেই দায়মুক্তির লাইন হয়তো আরও বড় হয়ে যাবে দিনের সাথে, যাতে হয়তো আপনি, আমি অথবা আমাদের আরও কোন প্রিয়জনকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হবে কোনদিন।
যেখানেই আছো, ভালো থেকো থাবা বাবা। ভালো থেকো। আর আমাদের ক্ষমা করো।

ছবি: 
05/08/2014 - 3:08অপরাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শ্রদ্ধা

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

শ্রদ্ধা

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

"When you play with gentlemen, you play like a gentle man. But when you play with bastards, make sure you play like a bigger bastard. Otherwise you will lose"

লেখক ভাই, বঙ্গবনধু এই উক্তি কোথায় করেছিলেন একটু বলবেন? বঙ্গবনধুর মুখে bastard কথাটা খুবই বেমানান। দয়া করে সঠিক রেফারেন্সটা দিলে উপকৃ্ত হতাম।

সাজ্জাদূর রহমান

ইয়ামেন এর ছবি

বাংলাদেশ - এ লিগাসি অফ ব্লাড, এন্থনি মাস্কারেনহাস।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

তাসনীম এর ছবি

শ্রদ্ধা

আশা করছি বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অতিথি লেখক এর ছবি

শ্রদ্ধা

থাবা বাবার হত্যাকারীদের (যারা হাজতে আছে) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আমার দেশ আরেকবার দায়মুক্তির দিকে পা বাড়াক।

দেবদ্যুতি

গৌতম হালদার এর ছবি

"​তুমি" নাস্তিক, তাই বলিয়া আমি মানুষ হইবো না কেন?​

Nushin Rezvi এর ছবি

ইয়ামেন ভাই, আমি আপনার লেখার অনেক দিন ধরে ফলোয়ার। একটা বিশয়ে আপনার মতামত কামনা করছি।

ব্লগার রা ধরমানুভুতি তে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করেছে, তা তো অস্বীকার করা যায় না। যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাদের ও কি বিচার করা উচিত না?

অতিথি লেখক এর ছবি

যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাদের ও কি বিচার করা উচিত না?

আপনি কার লেখার কতদিন ধরে ফলোয়ার এই সব ধানাই পানাই বাদ দিয়ে চেষ্টা করে দেখুন বিবেক নামক জিনিশটা খুঁজে পান কিনা। তাহলে এই ধরনের বালখিল্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আর দরকার হবে না।
- আতোকেন

ইয়ামেন এর ছবি

আমার মতামত আতোকেন দিয়ে দিয়েছেন৷

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।