এই ছবি, ওই ছবি

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি
লিখেছেন অনিন্দ্য রহমান (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৯/২০০৯ - ১১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছবি (ফটোগ্রাফ) বুঝি না। যেভাবে বোদ্ধারা বোঝেন। তবু ছবি নিয়ে লিখতে বসা, কারণ ছবি আমাকে ভাবাচ্ছে।

একটা ছবিতে একটা মুহুর্ত স্থির হয়ে থাকে। আর এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা ঐকিক নিয়মে প্রমাণ করা যায়। প্রমাণটা অবশ্য যারা ঐকিক নিয়মে সন্তুষ্ট তারা যেমন করবেন, যারা কোয়ান্টাম মেকানিক্স পর্যন্ত যেতে পারেন, তারাও করবেন। আমি ঐকিক নিয়মে আসি।

ধরুণ এক সেকেন্ডের দৃশ্যের গুরুত্ব ‘ক’। মানে চব্বিশ ফ্রেমের গুরুত্ব ‘ক’। এক ফ্রেমের গুরুত্ব ‘চব্বিশ ভাগের এক ক’। মানে চলা দৃশ্য যেটা এক সেকেন্ড ধরে ঘটলে আপনি এক সেকেন্ড ধরেই দেখবেন, সেখানে এক ফ্রেমের গুরুত্ব ‘ক’ই থাকবে। এখন আপনি পুরো এক সেকেন্ড ধরে এক ছবি দেখলে, মানে এক ফ্রেম দেখলে ঘটনা কী হবে? এক ফ্রেমের গুরুত্ব এক ফ্রেমে হয় ‘চব্বিশ ভাগের এক ক’। এক ফ্রেমের ওজন চব্বিশ ফ্রেমে হয় পুরো ‘ক’। তাই চলা ছবিতে এক ফ্রেমের চেয়ে না-চলা ছবির ওজন চব্বিশগুন বেশি।

সন্দেহ, অংকটায় কোথাও গোলমাল হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমি যা বলতে চাই সেটা অন্যের কথা দিয়ে বলি।

গদার বলেছেন অন্যভাবে - “ফটোগ্রাফি [ফটোগ্রাফ নয়] সত্য। সিনেমা সেকেন্ডপ্রতি চব্বিশগুন সত্য”। গদারের কথায় যদি যাই, তবে সিনেমা কেবল কোয়ান্টিটির জোরে হলেও স্থির ছবির চেয়ে ওজনদার। কিন্তু ঐ যে কোয়ান্টিটির জোর, এই কথার মধ্যেই নিহিত আছে, থামা ছবির মধ্যে চলা ছবির চেয়ে বেশি কোয়ালিটি আছে। এই কোয়ালিটিটাই ওজন। গুরুত্ব। যাক, কী বলছি কে জানে।

ছবি নিয়ে লিখতে বসলাম, কারণ সম্প্রতি একটা ছবি-প্রদর্শনী হয়েছে। এখনো হচ্ছে বোধ হয়। ঢাকার দৃক গ্যালারির বিশ বছরের পুরে যাওয়া উপলক্ষে ভারতীয় আলোকচিত্রী রঘুরাইয়ের প্রদর্শনী। দৃকের উল্টোদিকেই - বেঙ্গল গ্যালরিতে। রঘু রাইয়ের ছবি দেখে কী বলব। আমি চিন্তিত। চিন্তাটা ঢোকালেন তিনিই। প্রদর্শনী কক্ষের শুরুতেই মুখবন্ধ। রঘু রাইয়ের লেখা । বলছেন -

“ বলা হয়ে থাকে, একটা ভালো ফটোগ্রাফ হাজারো কথার সমান। কিন্তু হাজার কথা তো ব্যাপক কোলাহলেরই জন্ম দেবে। একটু নিরবতা হলে কেমন হয়? স্পেসে [দেশে] একটি আপোষহীন মুহুর্তের মতো?”

রাই-এক কথাটা মনে ধরে। ভালে ছবিকে কেন হাজার কথা হতে হবে। একটা ছবি একটা কথাই বলুক না, বলার মতো করে।

রঘু রাই সম্পর্কে দুটো তথ্য। এক, ইনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার। দুই, ইনি শুধু ফটোগ্রাফারই নন ফটোজার্নালিস্ট। কাজ করেছে বড় বড় পত্রিকায়, কখনো প্রধান ফটোগ্রাফার হিসেবে কখনো ফটো এডিটর হিসেবে।

ফটোজার্নালিস্ট মুহুর্তকে সাজানোগোছানোর সময় কদাচিৎ পান। তাই বলে রঘু রাইয়ের ছবি আগোছালো নয়। কিন্তু রঘু রাইয়ের ছবিতে আছে আপাতত অযাচিত কুকুর, একদম লেন্সের সামনে এসে দাঁড়ানো, ফ্রেমের অর্ধেকটা ঢেকে দিয়ে, সাবজেক্টকে কোনোমতে বাঁচিয়ে। রঘু রাইয়ের ছবিতে সাবজেক্ট প্রায়শই ব্যাকগ্রাউন্ডে। কখনো সাবজেক্ট ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার শরীরটা আছে, মাথাটা বাইরে। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় না। সব ছবি যে এমন তা না। কিন্তু এই বিষয়গুলো ঘটে। কেন ঘটে তার যুক্তি রঘু রাইয়ের নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমার উপলব্ধি ভিন্ন।

রঘু রাই একজন তৃতীয় বিশ্বে কথক। একথা মানতেই হবে। মার্কিন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমসন তৃতীয় বিশ্বের ন্যারেটিভ সম্পর্কে বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বের ন্যারেটররা ন্যাশনাল ফ্রেমের বাইরে দেখেন না। তাদের যাবতীয় গল্প নেশনকে ঘিরে। যে-গল্পে মানুষ কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। তৃতীয় বিশ্বের উপন্যাস জেমসনের মতে ন্যাশনাল অ্যালেগরি। মানে চরিত্র তার নিজের কথা বলে না, বলে তার রাষ্ট্রের কথা (স্টেট আর নেশন এক না, তবু আপাতত একই অর্থে ধরছি)। রঘু রাইয়ের অনেক ছবিতেই সাবজেক্ট লেপ্টে আছে তার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে। এই ব্যাকগ্রাউন্ডটাই হলো তার নেশন। আর্থরাজনীতি, রাষ্ট্র। ইতিহাস। একা সাবজেক্ট কোনো সাবজেক্টই না।

পরিশিষ্ট :

কিন্তু এর উল্টোটাই বরং দেখেছি বহু পাশ্চাত্য ফটোগ্রাফারের ছবিতে। এবং সেই মতের দেশি ফটোগ্রাফারদেরও অনেকের কাজে। আমি আর আমার এক বন্ধু গত দৃক আয়োজিত ছবিমেলা -৫ দেখতে গিয়েছিলাম। অসাধারণ সব ছবি দেখেছিও। কিন্তু তৃতীয় বিশ্ব মানসিকতা নিয়ে ছবি দেখতে গিয়ে অনেক ছবির সঙ্গেই আবার সংযোগ জুড়তে পারিনি।

কত কত ছবি। কত কত দেশের। এরা কী বলে? আমরা যা বলি ওরা তা বলে না - বন্ধু উত্তর দেয়। আমরা আর ওরা? প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্ব - এগুলো এখন আর ব্যবহার হয় নাকি!

হুম, দ্বিতীয় বিশ্ব বলেও একটা ছিল। সেটা কোনদিন হারিয়ে গেল? আমার তো মনে পড়ে না। একানব্বইয়ের অগাস্টে, যেদিন ইয়েলিৎসিন ট্যাংকের উপর উঠে দাঁড়ালো, সে কি দেখতে পেয়েছিল জানি না, আমি দেখছিলাম বারান্দায় শুকাতে দেয়া বিছানার চাদরটা দুলছে। দ্বিতীয় বিশ্ব মিলিয়ে গেছে জেট পাউডারের গন্ধমাখা শৈশবের সাথে সাথে।

বন্ধুর কথাটা নিয়ে ভাবি। শিল্পকলার গ্যালারিতে ছবিমেলা দেখছি তখন। ফ্রেডরিখ জেমসন বলেন, সে মনে করায়, তৃতীয় বিশ্বের গল্পগুলো সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যক্তিমানুষ নয় সামগ্র জাতির (/রাষ্ট্র?) কথা বলে। ওটাই তাদের স্বভাব। আমরা ব্যক্তির মধ্যে রাষ্ট্রকে খুঁজে ফিরি। আর ওরা নাকি ব্যক্তিকে নিয়েই মেতে থাকতে পারে। একা মানুষ, একলা মানুষ। এর বাইরে দরকার পড়ে না। তাই ওদের ছবিগুলো জলের মত ঘুরে ঘুরে একা। তৃতীয় বিশ্বের দর্শকের চাহিদা ভিন্ন। সেও খুঁজে ফেরে তার চড়কের মেলার বিকিকিনি হট্টগোলে হারিয়ে যাওয়া জনক-জননী, রাষ্ট্রকে। তাই চাঁদের আলোয় নাটবল্টুর ছবিতে - আমাকে যতই বোঝাও না কেন - আমি কিছু খুঁজে পাই না। আমার দাবি - প্রতিটি ছবিতেই ভেসে উঠুক আমার হারিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র।

দৃকের একটা ডকুমেন্টশন ইউনিট দর্শক জরিপের অংশ হিসেবে আমার সঙ্গে কথা বলে। তাদের প্রশ্নপত্রে একটা প্রশ্ন আছে। স্বাধীনতা কী? স্বাধীনতা এবারের ছবিমেলার থিম। আমি বলেছি - স্বাধীনতা নিজেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করবার অধিকার।

কিন্তু এ-কাজ সহজ নয় মোটে। আমরা কখনই আমদের মতো নই। আমরা স্রেফ ওদের সাপেক্ষে আমাদের মতো। আমরা ওদের বানানো মানুষ। মাঝে মাঝে ওরা বলে না, করেই দেখিয়ে দেয় আমাদের কেমন বনতে হবে। এই করে দেখানোয় অংশ নেয় ওদের চলচ্চিত্র থেকে গনমাধ্যম, টুয়েন্টিয়াথ সেঞ্চুরি ফক্স থেক সিএনএন - সবকিছু। এমনই এক সিনেমা নিয়ে খুব মাতামাতি হচ্ছিল তখন । নাম - আমরা অনেকেই জেনে থাকব - স্লামডগ মিলিয়নেয়ার।

স্লামডগ! পাগড়ি সামহাল জাট্টা! আমরা বস্তির বাচ্চাদের কখনো বস্তির কুকুর বলি না। হ্যা, আমরা দেশি বুর্জোয়া। নোংরা মানুষের গা ঘেষি না। কিন্তু কুকুর বলি কি? কুকুর তো ওরা আমাদের বলত।

তো এইভাবেই ছবির মধ্যে সত্য-মিথ্যা তালগোল পাকিয়ে থাকে ? ছবিবোদ্ধারা ভালো বলতে পারবেন।


মন্তব্য

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

পড়লাম। চিন্তার বিষয়। আসলেই ছবির বোদ্ধারা এর ভালো মন্তব্য করতে পারবেন। লেখা উত্তম হইছে।

হিমু এর ছবি
অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

লেখাটা খুবই ভালো লাগল।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আপনাদের অনেক ধন্যবাদ . . . হাসি
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রেজুয়ান মারুফ এর ছবি

খুবই গোছানো লেখা। ভালো লাগলো। আবারো পড়তে হবে।

-------------------------------------------------
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কাব্য নিয়ে ঘুরি।

আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কব্য নিয়ে ঘুরি।

শিরোনামহীন [অতিথি] এর ছবি

স্বাধীনতা নিজেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করবার অধিকার।

সুন্দর বলেছেন। লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দারুণ লাগলো পোস্টটা...

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

থ্যাঙ্কু!


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভাই, এরকম লেখা বছরে একটা পড়লেও শান্তি লাগে... অসাধারণ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

লেখা খুব ভাল হয়েছে। তবে ব্যক্তি আর রাষ্ট্র নিয়ে দ্বন্দ্বের ব্যপারটা অনেক দুরুহ। কোনটা আছে কোনটা গেছে আর কোনটা চাই আর কিভাবে চাই বলা কঠিন।

মেহদী হাসান খান এর ছবি

অসামান্য একটা লেখা। আরো আসুক।

মূলত পাঠক এর ছবি

এমন লেখা বহুদিন পড়ি নি, দুর্দান্ত লাগলো!

শিক্ষানবিস এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম। দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই থাকুক শিল্পের প্রতি মমত্ববোধ থেকে আমরা সবাই একত্রিত হতে পারি।

গদার এর উক্তিটা নিয়ে খুব ভাবলাম। চলচ্চিত্রর কোয়ান্টিটি আর স্থিরচিত্রের কোয়ালিটি নিয়ে মনে হয় ফরাসি নুভেল ভাগ এর চলচ্চিত্রকাররা অনেক ভেবেছিলেন। গদার কখনও ফ্রিজ শট ব্যবহার করেছেন কি-না জানি না, কিন্তু ফ্রঁসোয়া ত্রুফো-র কাজে ফ্রিজ শট দেখে আমি দ্বিতীয়বারের মত সিনেমার প্রেমে পড়েছিলাম। স্মরণীয় মুহূর্ত বা একটি মুহূর্তের গুরুত্ব বহুগুণ বারিয়ে দেয়ার জন্য এমন ফ্রিজ শট কিন্তু সিনেমায় অনেক ব্যবহৃত হয়েছে। "ফোর হান্ড্রেড ব্লোস" এর শেষ দৃশ্যে ক্যামেরার দিকে তাকানো অবস্থায় কিশোরটির মুখ ফ্রিজ হয়ে যায়, ইতিহাসের প্রথম সার্থক ফ্রিজ শট যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে ধাক্কা দেয়া। এরপরে একেক জন একেক ভাবে ফ্রিজ ফ্রেম শট ব্যবহার করেছেন। তিনটা সিনেমার কথা খুব মনে পড়ছে:
- ফ্রাংক কাপরা তার "ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ" এ বেশ কয়েক জায়গায় ফ্রিজ শট জুড়ে দিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল চরিত্র এবং পরিবেশের সাথে সিনেমার দেবদূতের পরিচয় করিয়ে দেয়া, আমাদের সাথেও চরিত্রগুলোর পরিচয় বৃদ্ধি করা। আমরা মাঝেমধ্যেই বলি, মুহূর্তটা ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখার মতো, কাপরা এই বাঁধিয়ে রাখার কাজটাই করেছেন।
- মার্টিন স্করসেজি তার "গুডফেলাস" এ অসংখ্য ফ্রিজ ফ্রেম ব্যবহার করেছেন। তার লক্ষ্য মনে হয় ছিল বিশাল কোন ন্যারেটিভ লাফ দেয়া, প্রোটাগনিস্ট এর কথা দিয়ে যা করা সম্ভব না সেটাই স্থিরচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা।
- সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা-র প্রসঙ্গ আমাদের সবারই জানা। শেষের ফ্রিজ শট তো চারুলতার পুরো বক্তব্যকে পরিষ্কার করেছে।

তৃতীয় বিশ্বের আর্ট নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই পাশ্চাত্যের মত না। কিন্তু পটভূমিতে দেশ-জাতি রেখে সাবজেক্ট হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার থিম আমার খুব একটা ভাল লাগে না। মনে হয়, যে শিল্পকর্মে দেশ ছাড়িয়ে ব্যক্তিই মুখ্য হয়ে উঠেছে সেটাই বেশি মহান, অন্তত এখন পর্যন্ত। তারপরও রঘু রাই এর ছবি দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ব্যাকগ্রাউন্ড আর সাবজেক্ট এর যে সম্পর্কের কথা বলেছেন এমন করে তো জীবনে ভাবতেও পারিনি। রঘু রাই এর ছবি না দেখলে হয়তো ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝতেও পারব না। আপাতত আপনার দেয়া ছবিটার দিকেই তাকিয়ে থাকি।

স্লামডগ মিলিয়নার সম্পর্কে আমার তিনটা কথাই বলার আছে- বিশ্রী, কুৎসিত এবং কুরুচিপূর্ণ। সিনেমাটোগ্রাফির কথা বলে এটাকে মহিমান্বিত করার কোন অর্থ নেই। আমি বিস্মিত হয়েছি, যে ড্যানি বয়েল ট্রেইনস্পটিং এর মত ফাটাফাটি সিনেমা বানাতে পারে তার হাত দিয়ে কিভাবে স্লামডগের প্রসব ঘটে! (যদিও সিনেমা দুইটার থিমে মিল আছে) এডওয়ার্ড সাইদ এর পুরো জীবনটা চলে যাওয়ার পর, এই একবিংশ শতকে এসে কিভাবে অস্কার জয়ী ব্লকবাস্টার সিনেমাতে এত গোঁড়া ওরিয়েন্টালিজম এর প্রকাশ ঘটে সেটা ভেবে পাই না। তবে আমাদের সৌভাগ্য, জীবনে এত তীব্রভাবে ঘৃণা করার মত একটা জিনিস পেয়েছি।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আপনার দীর্ঘ মন্তব্য আমার পোস্টটির গুরুত্ব অনেকখানি বাড়িয়ে দিল। আপনি ৩ টি প্রসঙ্গে বলেছেন।

প্রথমত, ফ্রিজ শট নিয়ে আপনার রেফারেন্সগুলো অনেকগুলো প্রিয় ছবির কথা মনে করিয়ে দিল। বিশেষ করে ৪০০ ব্লোজ। ত্রুফোর পরের দিককার ছবিতে এমন শট অনেক এসেছে সত্য। কিন্তু ঐ ছবির তাৎপর্যটাই আলাদা। ওটা ইতিহাস রচনা করেছে। গদারের বিষয়ে যেটা বলতে পারি সেটা হল, গদার ফ্রিজ শটই নয় পাশপাশি স্লোমোশন এমন কি ব্ল্যাক ফ্রেমেরও অসামান্য প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তার ছবিতে। স্লোমোশন বলে তার একটা ছবিই আছে। সেটিকে এই 'ছবিতে সময় বনাম গুরুত্ব' প্রসঙ্গটির একটি আকর টেকস্ট মনে করতে পারি আমরা। এলোজ দ্য লামোর ছবিতে এসেছে হঠাৎ হঠাৎ ব্ল্যাক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। এগুলো আমাকে নিউওয়েভের ভক্তকূলের মতো আমাকেও ভীষণভাবে ভাবিয়েছে। এ নিয়ে লিখতেও চাই। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছি না। আপনার মন্তব্য আমার ভাবনাগুলোকে আবারো উস্কে দিল। হাসি

দ্বিতীয়ত, আর্টের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষ ও রাষ্ট্রকাঠামোর সম্পর্ক নিয়ে আপনার ভিন্নমত আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করছি। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র থেকে ব্যক্তিসর্বস্বতায় ডুবে যাওয়ার পথটি পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটিতে খুব সুগম। আর্ট সে চোরাবালিতে না ডুবে গেলেই হল। (যদি সেটাকে আদৌ চোরাবালি মনে করেন)

তৃতীয়ত, স্লামডগ মিলিয়নার সম্পর্কে আমারও তিনটা কথাই বলার আছে- বিশ্রী, কুৎসিত এবং কুরুচিপূর্ণ।

ধন্যবাদ।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শিক্ষানবিস এর ছবি

গদার বেশি দেখতে হবে বুঝতে পারছি। আসলে আমি গদারের একটা সিনেমাই দেখেছি- Band of Outsiders, এতে মৌন মুহূর্তটার কথা মাঝেমাঝেই খুব মনে হয়।

জিফরান খালেদ এর ছবি

আপনার লিখাটি বেশ। যদিও দেখবার চোখে একটা সুনির্দিষ্ট মতাদর্শিক প্রবণতা আছে; সেটা বেশ অনুভব করলাম। সেটা থাকা না থাকা দোষ-গুণের কিছু নয়।

পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটির কথা দেখে ড্যানিয়েল বেলের কথা মনে পড়ে গেলো। আপনি কি রঘুরাই-এর ছবির ক্ষেত্রেও এই 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য' ও 'ব্যক্তিসর্বস্বতা'-র পার্থক্য-সমেত যে অন্বয়, সেটা আরোপ করছেন? নাকি, শুধু পাশ্চাত্যের ওপর?

কল-উত্তর যুগ এসে পড়েছে তাহলে? এ-ব্যাপারে আরেকটু জানার আগ্রহ রইলো।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

সামগ্রিক ভাবে যেকোনো কিছুর ওপর যেকোনো কিছু 'আরোপ' করা অন্যায়। পাশ্চাত্যের সবাই ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক, কিংবা প্রাচ্যের সবাই সাপ নিয়ে খেলে ... স্টিরিওটাইপিং, মিসরিপ্রেজেন্টেশন তো বটেই, পলিটিকাল সেন্সে তার চেয়েও খতর্নাক। তবে তৃতীয় বিশ্ব কোনো জিওগ্রাফিকার ক্যাটাগরি না। এটা একটা নির্দিষ্ট নেশনহুডের নাম। আমি তাই বলতে চেয়েছিলাম। ঐ থার্ড ওয়ার্ল্ড নেশনহুডের ভেতরে যারা থাকবেন, তাদের দেখার, পড়ার দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে একধরণের মিল থাকবে। রঘু রাইয়ের মধ্যে এই মিলটা পাওয়া যায়। আপনার কথার সূত্রে ড্যানিয়েল বেল সম্পর্কে ঘেঁটে দেখলাম। গুছিয়ে উঠতে পারলে, আর সাহস দিলে, কল-উত্তর (শব্দটা ভালো লাগল) যুগ সম্পর্কে লিখব। অনেক ধন্যবাদ ...
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

জিফরান খালেদ এর ছবি

হাহা... কিন্তু আরোপ করা ছাড়া আসলে ডিড্যাকটিক কোনো বাক্য গঠনো মনে হয় না সম্ভব।

তৃতীয় বিশ্বের 'দেখবার চোখ' সম্পর্কে যে প্রস্তাবিত অনুসিদ্ধান্ত, আমি সেটাকে 'ফার ফ্রম ট্রুথ' বলেই ভাবি। কিন্তু, আপনি হয়তো একটা মনো-অর্থ-রাষ্ট্রিক প্রিটেক্সট ব্যবহার করছেন প্রবণতা চিহ্নিত করবার জন্যে। পোস্ট ইন্ড্রাস্টিয়াল সোসাইটির কন্সেপটটাই ড্যানিয়েল বেলকে সমাজবিজ্ঞানে খ্যতনামা করে তোলে। তার 'The coming of Post Industrial Society' সোশ্যাল ফোরকাস্টিঙ্গের অবশ্যপাঠ্য বই, যদিও অনেকখানি রক্ষণশীল ঘরাণার। শুরুতে খুব বেদসুলভ গুরুত্ব পেলেও আস্তে আস্তে এটার কাউন্টার-ফোরকাস্টিংগুলো প্রাধান্য লাভ করে।

তৃতীয় বিশ্ব একটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা বলেই আমার মনে হয়। মানে, টার্মটার কথা বলছি। আমি এই ধরণের টার্মের প্রয়োগ বা বিকাশের ক্ষেত্রে দেরিদার মতানুসারী।

আপনার লিখার অপেক্ষায় থাকলাম।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আমি কিন্তু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করি। মানে এর অস্তিত্ব এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। আমার কাছে লেখা মাত্রই রাজনৈতিক।(আর রাজনৈতিক বললে অর্থনৈতিকটা লাগে না)। তাই জেনেবুঝে প্রোপাগান্ডার প্রয়োগও ঘটাই, এমন তো হতেই পারে।

তবে, তৃতীয় বিশ্বের কনসেপ্টে আমি খুব একটা আস্থাশীল না। কারণ তৃতীয় বিশ্ব বলে একটা গোটা বস্তু কখনই ছিল না। আর হবেও না। কিন্তু এটা একটা নেশনহুডের নাম। ন্যাশনালিজম না।

আবার, এটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সত্য ছিল। ন্যাম, কিংবা প্যান আফ্রিকান মুভমেন্ট, তারো আগের নেগ্রিটুড - এগুলোর মধ্যে আন্ডারলাইনড ছিল। আমি হয়ত সেই আবার সেই আন্ডারলাইনেও বিশ্বাস করি ?

টেক্সট তো আত্মঘাতী। দেরিদা মানলে। আবারো ধন্যবাদ।
_______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

জিফরান খালেদ এর ছবি

আচ্ছা ... আমি বোধহয় আপনার প্রবণতার মতাদর্শিকতার জায়গাটা ধরতে পেরেছিলাম; এটা অনেক কিছুতে সাহায্য করে তো বটেই।

দেরিদার তো কাজের অনেকগুলো প্রায়োগিক ক্ষেত্র আছে ... অর্থবিজ্ঞানও তার একটা মনে হয়।

তবে, ৯/১১ এর পরপর একটা সাক্ষাতকারেই তিনি বিশদভাবে কিছু টার্ম নিয়ে আলোচনা করেন, সেগুলোর সাব্জুগেটিভ মোটিভ নিয়ে। টেক্সট আর টার্ম-এর উদ্দেশ্য-ক্ষেত্র এবং সম্ভাবনার জায়গাগুলো এক নয় বলেই মনে হয়। যদিও অনেকেই টার্ম টেক্সটে অংশ বলে এই ফাঁকটা দেখতে চান না।

যাক, প্রসঙ্গচ্যুতি হয়ে গেছি অনেক। ভাল থাকুন, আরো আরো উন্নত লিখার অপেক্ষায় থাকলাম।

বর্ষা [অতিথি] এর ছবি

অনিন্দ্য তোমার ভাবনাগুলো বেশ লেগেছে। এভাবে চিন্তা করিনি কখনো। বেশ ভাল লাগলো।

তামীম এর ছবি

অসাধারন!!!

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আপনাদের ভালো লাগায় ভালো লাগছে। যারা রঘু রাইয়ে ছবি দেখতে চান তারা ঘুরে আসতে পারেন এই সাইটে। এখানে ফটোগ্রাফারস -> রঘু রাই। বিশেষ করে তার calcutta এবং india notes এই দুটো বই দেখতে পারেন। আমার চিন্তার সাথে মিল পেতেও পারেন, নাও পেতে পারেন।
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

উজানগাঁ এর ছবি

আপনার লেখাটা পড়া হতো না। ছবিবিষয়ক লেখাগুলো আমি এড়িয়েই চলি বলতে গেলে। আজকে সকালে এক বন্ধুর সাথে আলাপকালে সে জানাল আপনার এই লেখাটি রঘুরাইকে নিয়ে। ২০০৬/০৭ এর দিকে আমি রঘু রাইয়ের একটি প্রদর্শনী দেখেছিলাম। নাম ছিল Exposure: Portrait Of A Corporate Crime। সেই থেকে মুগ্ধতা।

রঘু রাইয়ের ছবিতে সাবজেক্ট প্রায়শই ব্যাকগ্রাউন্ডে। কখনো সাবজেক্ট ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার শরীরটা আছে, মাথাটা বাইরে। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় না।

পুরোপুরি না হলেও একমত। সাবজেক্ট ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আগের প্রদর্শনীতে [Exposure: Portrait Of A Corporate Crime] চোখে পড়েনি। তবে ব্যকগ্রাউন্ডে গল্প বলার রীতিটা রঘুর অনেক পুরনো। আগের ছবিগুলোতে চোখ বুলালে সেটা নজরে আসে। তবে আপনার বর্ণনার সাথে বেশি যায় যার ছবি তিনি হলেন মার্টিন পার। মার্টিনকে নিয়ে না হয় অন্য আরএকদিন কথা বলা যাবে, অন্যকোনোলেখায়।

আপনার লেখাটা ভাবিয়েছে। ভাল থাকবেন।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

পার সম্পর্কে আপনার কথাটা ঠিক। ফ্রেমিংয়ের বিষয়ে যেটি লিখেছি সেটি তার বিষয়ে বেশি সত্য। রাই এবং পার দুজনই কিন্তু ফটোজার্নালিস্ট। আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
______________________________________________
to be or not to be - that was never a question (jean-luc godard)


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

এভাবে ভাবিনি কখনও, ভাল লাগলো লেখাটা।

---------------------------------------------
আয়েশ করে আলসেমীতে ২৩ বছর পার, ভাল্লাগেনা আর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

মৃত্তিকা এর ছবি

"ভালে ছবিকে কেন হাজার কথা হতে হবে। একটা ছবি একটা কথাই বলুক না, বলার মতো করে।"

"হুম, দ্বিতীয় বিশ্ব বলেও একটা ছিল। সেটা কোনদিন হারিয়ে গেল? আমার তো মনে পড়ে না। একানব্বইয়ের অগাস্টে, যেদিন ইয়েলিৎসিন ট্যাংকের উপর উঠে দাঁড়ালো, সে কি দেখতে পেয়েছিল জানি না, আমি দেখছিলাম বারান্দায় শুকাতে দেয়া বিছানার চাদরটা দুলছে। দ্বিতীয় বিশ্ব মিলিয়ে গেছে জেট পাউডারের গন্ধমাখা শৈশবের সাথে সাথে।"

"স্বাধীনতা নিজেকে নিজের মতো করে নির্মাণ করবার অধিকার। "

-ভালো লাগলো পোস্টটা।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

শাবাশ! চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

স্পর্শ এর ছবি

ঘুরতে ঘুরতে এই লেখাটা পেয়ে গেলাম।
ভালো লাগলো খুব। সব কিছুই...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

আমার পোস্টের মন্তব্য থেকে এসে এই লেখায় থামলাম।
ভালো লাগলো পড়ে।

আপনার না বলা অনেক কথা আছে। তারা একসাথে এসে লেখায় ভর করে। এসব কথা লিখে লিখে শেষ করে দিতে হবে। তারপর লিখতে বসলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিজেই সম্পাদিত হয়ে ধরা দেবে মূল কথাগুলো।

অনেক অনেক লিখুন।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।