একজন আনন্দিত ব্যক্তির দুঃখিত কাহিনী – ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/০৩/২০০৮ - ১২:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি যে শুধু মারই খেতাম তা কিন্তু নয়। আমার বাবার আবার একটু মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। তিনি প্রায়ই হাল্কা মদ্যপানের পর আমার ঘরে এসে আমার পাশে বসতেন। আমি ভয়ে ভয়ে ঘুমিয়ে থাকার ভান করে মটকা মেরে পরে থাকতাম। একেতো শরীর অদ্ভুত গন্ধ আসছে, তার উপর কেমন যেন বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ। সে সময়ের একটি ছোট শিশুতো ভয় পাবেই। কিন্তু বাবা এসে বেশিরভাগ সময়ই কিছু বলতেননা, শুধুই আমার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, “আমি তোকে বৃথাই বেশী শাসন করি। তুই যদি ভুল পথে যাস, তাহলে আমার গর্বটা আমি করতে পারবনা। আমার মূল পরিকল্পনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু তাই বলে তোর মত শিশুকে আঘাত করাটাও ঠিক না। কিন্তু কি করব বল, রাগটা যে সামলাতে পারিনা। তুই বড় হ, তোকে সব বলব।” এতটুকু বলে তিনি চলে যেতেন নিজের ঘরে। তার কিছুক্ষণ পরেই আসতেন আমার মা। তিনিও প্রায় একই কথা বলতেন।তবে তিনি আমার মাথায় একটা চুমু খেতেন। আমি প্রথম দিকে এসব কথার কোনই অর্থ খুঁজে পেতাম না। পরে ধীরে ধীরে যত বড় হতে লাগলাম, ততই মনে হতে লাগল যে হয়তো আমাকে নিয়ে আমার বাবা-মার অনেক আশা-প্রত্যাশা আছে, এবং তাদের অনেক স্বপ্ন যে আমি হয়তো একদিন বড় হয়ে বিশাল কিছু করে দেখাব। তাই আমি মন দিয়ে পড়াশোনা এবং খেলাধুলা করতে লাগলাম। আমাকে আমাদের স্কুলের best student হতেই হবে এবং সেই উপাধির অধিকারী হতেই হবে। কিন্তু তবুও আমার বাবা-মার ধারণা জন্মাল যে তাদের ছেলে এখানে থাকা ঠিক না। তাই তারা আমাকে দার্জিলিং এর সেন্ট পল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

আমার এক নতুন জীবন শুরু হলো দার্জিলিং এর সেন্ট পল স্কুলে। খুবই routin বাঁধা নিয়ম সেখানে। আমি ইংরেজিতে একটু দুর্বল ছিলাম, কিন্তু আমাদের স্কুলের rule ছিল যে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথা নিষেধ। তাই বাধ্য হয়ে খুব উলটাপালটা ইংরেজি বলতাম, আর বাকি সহপাঠীরা এই নিয়ে বেশ হাসাহাসি করত। আমি খুবই লজ্জা পেতাম। এমন সময় আমারই আরেক সহপাঠী বন্যা (ছদ্মনাম) আমাকে বুঝিয়ে বলল যে, ভয় বা লজ্জা পেয়ে কোনই লাভ হবেনা, তার চেয়ে নিজের মত বলে যেতে থাকলে এক সময় গিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তার কথা অনুযায়ী কাজ করতে থাকলাম এবং তা বেশ কাজে লাগল, যার ফলশ্রুতিতে আমি অল্প কিছু দিনেই সবার মাঝের একজন হয়ে গেলাম এবং কিছু বন্ধুও হয়ে গেল। এভাবে কেটে গেল আমার একটি দীর্ঘ বছর দার্জিলিঙ্গের মনোরম পরিবেশে। কিন্তু ছুটির সময় বাড়ি ফেরার পথে আমার সবচাইতে ভাল বন্ধুটি পা পিছলে পাহাড় থেকে পরে গিয়ে মারা গেল। আমি আর কারও না, বন্যার কথা বলছি। বলতে পার আমার প্রথম ভালবাসা। সে ভালবাসা ছিল এক পবিত্র ভালোবাসা। আজকের দিনের ভালোবাসার মত নয় যে প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়ে যাবে, কিংবা শুধু বাহ্যিক রূপ দেখেই মুগ্ধ, এ ছিল এক অজানা আকর্ষন। সে যেমন আমাকে খুব ভাল বুঝতে পারত, তেমনি আমিও তাকে খুব ভালভাবে বুঝতে পারতাম। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার তা বুঝি সহ্য হলো না। তাই বন্যার মত এমন একজন অসাধারণ মেয়েকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়ে গেলেন। আমার এখনও মনে আছে, আমি খবর শোনা মাত্রই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিলাম, এবং অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে দিয়েছিলাম। হঠাৎ করে মনে হয়েছিল যেন আমার সুন্দর পৃথিবীটা কেউ নষ্ট করে দিল। এ যেন .... একটি অতি যত্নের ফুলবাগান হঠাৎ করে মুরুভূমিতে পরিণত হলো। আমার জীবনে প্রথম যার কাছ থেকে পূর্ণাংগরূপে ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছিলাম, তা যেন হঠাৎ করে কোন নিষ্ঠুর নির্দয় এসে আমার ছোট্ট হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে কেড়ে নিয়ে গেল। আমার বাবা-মা কেউই আমাকে নিতে আসেননি। এসেছিলেন আমাদের কোম্পানির এক কর্মচারি। তিনি বললেন, “বাবা, কান্নাকাটি করে লাভ নাই। তার চাইতে চলেন আমরা গিয়া দোয়া-দরূদ পড়ি। তাহলে তেনার কাজে লাগবে, আর উনি শান্তি পাবেন।” এই বলে তিনি অনেকটা জোর করেই আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন। বাসা পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তাই আমি কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছিলাম। এমনকি immigration officer আমার কান্নার কারণ শুনে দুঃখ পেয়েছিলেন। “আহারে বেচারা” বলে আমায় তার সমবেদনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু একটি দুখী হৃদয়ের মর্ম শুধু আরেকটি দুখী হৃদয়ই বুঝতে পারে। আমিই জানি আমার কি দুঃখ ছিল, এবং আজও আছে।

বাসায় ফিরে এসে দুইদিন আমি শুধু ঘুমালাম। এই দুইদিনে আমি আমার বাবা-মার আদৌ দেখা পেলামনা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তাঁরা দুইজন এখন দুই দেশে আছেন। বাবা তার business এর জন্য সিঙ্গাপুরে, আর মা shopping এর জন্য ভারতে গিয়েছেন। মায়ের ভারত যাবার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। কারণ, তিনি যদি ভারতেই আছেন, তবে আমায় নিতে তিনি নিজে কেন গেলেননা। আমি হাজার ভেবেও তখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলামনা। যাই হোক, ভাবলাম ফিরে এলে পরেই নাহয় জিজ্ঞেস করা যাবে যে কেন তিনি আমাকে নিতে নিজে যাননি। কিন্তু কবে ফিরবেন সেটাতো বলে যাননি। তাই কি আর করা, আপন মনেই খেলাধুলা, খাওয়া আর ঘুম নিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। বন্যা আমাকে একটা ডায়রি দিয়েছিল। ভাবলাম আমার যেহেতু কোন কিছুই করার নেই, তাই একটু লেখালেখির অভ্যাস করি, একটু ডায়রি লিখে। ভাবার সাথে সাথেই ডায়রিটা বের করে বসে পড়েছিলাম কিছু লিখব ভেবে, কিন্তু বন্যার কথা ভাবতে ভাবতে আর কিছুই লেখা হয়ে উঠলনা। তাছাড়া এটাও মনে হতে লাগল যে, যদি আমি এই ডায়রিতে কিছু লিখি তাহলে একদিন এর page শেষ হয়ে যাবে, আর আমার বন্যার স্মৃতিটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এখানে না লিখে অন্য কোন কাগজে লিখে এটার ভেতরে রেখে দেব। সেদিন থেকে শুরু করে বহুদিন পর্যন্ত ডায়রি লেখা আমার একটি দৈনন্দিন কাজ ছিল। যাই হোক আবশেষে মা ফিরে এলেন আর আমিও ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেই ফেললাম যে তিনি যদি shopping এর জন্য India গিয়েই থাকেন, তবে আমায় নিতে কেন দার্জিলিং যাননি।

(দুঃখিত, একটু সময়স্বল্পতায় ভুগছি। শীঘ্রই বাকি অংশ তুলে ধরব।)

আজমীর


মন্তব্য

রায়হান আবীর এর ছবি

অপেক্ষায় থাকলাম...
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

অতিথি লেখক এর ছবি

waiting.....

-নিরিবিলি

হিমু এর ছবি

প্রত্যেকটা লেখাই দেখছি এই সময়স্বল্পতা দিয়ে শেষ হচ্ছে। কপালে দুকখু আছে জনাব। পুরা লেখা ছাড়েন একটা।


হাঁটুপানির জলদস্যু

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত!

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখিত। কিন্তু কি করব বলুন, প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সময়স্বল্পতা। তবে কথা দিচ্ছি যে, এখন থেকে যখনি সময় পাব, লেখার চেষ্টা করব।

(কিন্তু, আমার লেখাগুলাতো তেমন ভালনা, আর মানুষের কাস থিক্কা শোনা কথা, তাই সময় সময় আইলাসামি লাগে দেইখাও লিখিনা আরকি। তয় আপনেরা যখন কইলেন, তখন এসব boring লেখা, যেগুলা নাকি পরে পইড়া আমি নিজেই চিন্তা করি যে কি আউল ফাউল লিখতাসি, পড়লে পরেতো public গাইল্লাবে, লিখা যামুনে।)

আজমীর

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো।
এরপর...?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বাড়ি ফেরার পথে আমার সবচাইতে ভাল বন্ধুটি পা পিছলে পাহাড় থেকে পরে গিয়ে মারা গেল

হেঁটে আসার পায়ের পথে ধুলো
সেই ধুলোর নিচে পড়ে থাকে কিছু নাম

ঝড়- বন্যা জলোচ্ছ্বাস
কোনো কিছুতেই মুছে যায় না মনের দেয়ালে লেগে থাকা কিছু কালো কালো দাগ
অথবা সাদা সাদা নাম

ইফতেখার নূর এর ছবি

চমতকার লিখছেন, চালিয়ে যান মন খুলে......অপেক্ষায় থাকলাম...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।