শ্রী চন্ডীদাস ভট্টাচার্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৯/০৪/২০০৯ - ১:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছাতক বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়। ক্লাস আটতক তিনি পড়াতে আসেননা। নয়য়ে উঠলেই ইংরেজীর প্রথম ক্লাসে দেরী করে গেলে তোমার কোনো শাস্তি হবেনা। বরং প্রথমেই জানিয়ে দেয়া হবে ইচ্ছেমত অনুমতি না নিয়েই ঢোকা যাবে ক্লাসে। তিন বছর এমন করে কেউ বলেননি আমাদের। উর্ধ্বশ্বাসে ক্লাসে পেৌছে দুসেকেন্ডের দেরীতে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ম ছিল। সেই প্রথম শ্রী চন্ডিদাস ভট্টাচার্য, আপনাকে চেনা। আর ছোট বেলায় প্রথম ‘বড় হয়ে গেছি’র বোধ।
স্কুলের পাঠাগার তার দায়িত্বে। কোন বই বাড়িতে নিতে চাও? সাদা শার্টের বুক পকেটের কালির ছোপের ভেতর থেকে একটা কলম বের হবে আস্তে। রুমালে ঠোঁটের পানরস মুছে নাম লিখে বইটা বের করবেন অযশ্র আলমিরার একটা থেকে। দুবার না খুঁজেই। সাহস করে নিহার রঞ্জন চাইলে ভারি কাঁচের চশমা পা-মাথা মাপবে। নিহার রঞ্জন মিলবে। সঙ্গে আরেকখানি ধরিয়ে দেবেন নিচ্শয়। ‘বিনয়-বাদল-দিনেশ’ অথবা ‘আমাদের প্রিয় সুভাষ’। এবং তোমাকে শুনতে হবে ‘তোর নিহার পড়, আমার পছন্দে এই বইটা পড়বি’। এমন আল্লাদ পেয়ে যদি ভাব মেরে দেই একটা-দুটো তো বছর শেষে তোমার মাথায় হাত। ঠিকই জরিমানা। নয়ত ফেরত দাও বই।
অফিস রুমের পাশ দিয়ে কোন পরিচিত ছাত্র গেলেই তার দিকে আঙুল ইশারায় ডাকা হবে। ‘তোর কাছে চার টাকা আছেনা? এক কাপ চা, একটা পান আর একটা স্টার সিগারেট’। তখন তোমার আমার মতই খারাপ লাগবে। শিক্ষক এভাবে চায় কোন ছাত্রের কাছে? যদি তুমি হও আমার মতো চালাক-চতুর তবে আর তিনদিন তাঁর সামনে পরনা। আর নয়ত এনে দাও চা। তখন কাপ কীভাবে প্লেটের ওপর উপুর করে নিয়ে আসতে হয়, কীভাবে এক ঝটকায় উপুর করা কাপ সোজা করা যায় একটুও চা না ফেলে তা তুমি শিখে নিতে পারবে।
টিউশনিতে তাঁর মন নেই। বাস করেন কালিবাড়িতে। দেবোত্তর সম্পত্তি, ভাড়া দেয়ার দরকার হয়না। বিনিময়ে মাঝে মধ্যে মন্দিরের পুজোটা করে দিতে হয়। আর বছর বছর দূর্গা পুজোয় চন্ডীপাঠ বাধা। শ্রী চন্ডীদাস ভট্টাচার্য, আপনার মতো শুদ্ধ করে নাকি আর কেউ চন্ডীপাঠ জানেনা পুরো এলাকায়। আপনার চন্ডী আর অরুন জেঠোর গীতাপাঠের প্রশংসা শুনেছি জেলা শহরে গিয়েও। কিন্তু তাতে কী। পুত্র-কন্যার পড়ার খরচ আর স্ত্রীর হাতে বাজারের টাকাত দিতে হবে ঠিকই। তাই বোধহয় একদিন ডেকে পাঠানো হয়। ‘তোরা বাড়িতে আমার কাছে পড়তে আসিস।‘
বাড়ি ফিরে বাবাকে বলতেই এক ধমক। যেলোক ছাত্রের টাকায় চা খায় তার কাছে প্রাইভেট পড়া, অসম্ভব। ক্লাস ছাড়া তাঁর সামনে আর যাইনা। লজ্জায় নয়, আবার যদি ডাকেন সেই ভয়ে।
বাবলী তাঁর কন্যার নাম। আমাদের সমবয়সী। মেয়েদের স্কুলে পড়ে। শ্রেণী এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়ার দরুন সখ্যতাটা পুরোনো। কালীবাড়ির পুজো দেখতে গেলে বাবলীর সঙ্গে একটুখানি কথা হতই। অনেক বছর পরের এক দূর্গা পূজোয় পুজো কমিটির সচিব আমি। সেই সময় নবমীর সন্ধ্যায় আরতীর মঞ্চের এককোনায় বাবলী বলে পিতার অসামর্থে অন্ন সংকটের কথা। ততদিনে পার্থদা পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। বাবলীদের আর মেৌলিক অধিকার পুরণের সমস্যা নেই। তাই বোধহয় হেসেহেসেই বলতে পারে সেইসব সময়ের কথা। আমিও প্রত্যত্তুরে হাসি। আর মনেমনে পুরোনো ভয়ের বদলে লজ্জিত হই।

সংস্কৃত শেখার স্কুল হয়েছে কালীবাড়ির বারান্দায়। পিতা উদ্যোক্তাদের একজন। উদ্যেক্তার পুত্র যেহেতু, যেতেই হবে ধর্মভাষা শিথতে। ততদিনে আমার ডানা গজিয়েছে। কিছুতেই খটমট সংস্কৃত শিথবনা। পিতার মান বাঁচাতে বোন টুলে পড়তে যায়। ক্লাস শেষ হতে বেলা গড়িয়ে গেলে আড্ডায় সাময়িক বিরতি দিয়ে হলেও বোনকে বাড়ি পেৌছে দিতে হয়। একদিন কালী মন্দিরের বারান্দার এককোনে দাঁড়িয়ে শুনি তার উচ্চারণের ক্লাস। আক্ষেপও শুনতে হয় কিঞ্চিত।–
‘সংস্কৃত শিখতে হলে গুরুমুখি বিদ্যা প্রয়োজন, আইলাম আর গেলাম করে ধর্মভাষা শেথা যায়না।‌‌‌‌‌‌‌‌’ আপনার খুব ইচ্ছে ছিল- ছেলে মেয়েরা টুলে আসবে তিন বছরের জন্য। দিনরাত তারা আপনার পাশে থেকে শিখবে। সে আর হয়না। আজকালকার যুগে কে মেলাবে পায়ের সঙ্গে পা! পা মাড়ানোর যুগে পায়ে পা মেলাতে গেলেই বিপদ। একদিন তাই ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে তুমুল তর্ক। গুরুমুখি বিদ্যার প্রচলন ইচ্ছা সেখানেই সাঙ্গ। খুড়িয়ে চলা সেই টুল থেকে বছর তিনেক পর দু’জন মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে যায় শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজে। বোনের কারনে আমাকেও যেতে হয়। ঝকঝকে ব্লু বার্ড স্কুলের পাশে জরাজীর্ণ সংস্কৃত কলেজ। আপনার খুব বিমর্ষ দেথেছি সেদিন। আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ‘তুই হলি ব্লুবার্ড স্কুল আর আমি শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ’। সেই প্রথম আপনার পাশে দাঁড়াতে আমার লজ্জা করছিল গুরু।
রেজাল্ট বের হলে ছাতক কালীবাড়ি টুলের দু’জনই পাশ করেন। আপনার কী উচ্ছ্বাস সেদিন। নামাবলি গায়ে জড়িয়ে সান্ধ্য আরাধনায় মঙ্গল কামনা করেন টুলটির। টুলের আজ আর অস্তিস্থ নেই শ্রী চন্ডীদাস ভট্টাচার্য। দুহাজার নয়য়ের পঁচিশ মার্চ আপনি ইহধাম ত্যাগের চারবছর আগেই টুলের ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবস্থাপকরা আর টাকা খরচ করতে রাজি নন। আর আপনার সঙ্গে টাকার দু:সম্পর্কতো পুরোনো।

স্বর্গীয় শ্রী চন্ডিদাস ভট্টাচার্য, স্বর্গবাসী হবার মাসতিনেক আগে আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। বাড়ির ছোট্ট নিজের ঘরটিতে পুরো দুঘন্টা আপনার জীবনের কথা শুনেছি আমি। আপনার জীবনী ছাপানোর অনুরোধও। শেষদিনে আপনি আমাকে good listener বলে প্রশংসা করেছিলেন। আপনার ধারনা ছিল জাতীয় পত্রিকার সহ-সম্পাদকের অনেক ক্ষমতা। সে চাইলেই যেকোনভাবে একটা বই প্রকাশ পেতে পারে। বই নাহোক অন্তত পত্রিকায় ধারাবাহিক ছাপানো যায় অনায়াসেই। আপনার ভুল আমি ভাঙ্গাইনি গুরু। বরং আশ্বাসের হাসি দিয়ে বের হয়ে এসেছি। তবে পা ছুয়ে প্রণাম করতে ভুলিনি। আপনি বুঝেছিলেন আমার মনে তখন কি ছিল? আমার শেষ শ্রদ্ধা-ভালবাসার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেয়া যায়না গুরু?

arjun.manna@gmail.com


মন্তব্য

পলাশ দত্ত এর ছবি

মন্তব্যে এই লেখা পোষাবে না। একটা রেটিং দিলাম শুধু।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

রানা মেহের এর ছবি

এতো মন খারাপ করা লেখা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

সুমন সুপান্থ এর ছবি

মনে হচ্ছিলো পড়ছিলাম, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই জীবনের যতো মধুর ভুলগুলি ! প্রিয় শিক্ষককে ফেলে ওপারে চলে যাচ্ছেন শ্যামল, তার বিরহে বাক্যগুলো যেন আনত, কান্নাজর্জর !

কি বলবো, তুই-ই তো বলে দিলি মান্না, সারসত্য -ঝকঝকে ব্লু বার্ড স্কুলের পাশে জরাজীর্ণ সংস্কৃত কলেজ
যেন ড. আবু মোহাম্মদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর, কিংবা এমনতরো দীর্ঘ নাম ও পদবীর ঝকঝকে এক অধ্যাপকের পাশে বড্ড বেমানান শ্রী চন্ডিদাস ভট্টাচার্য !!!

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

মূলত পাঠক এর ছবি

কিছু বানান ভুল দেখে মন একটু খচখচ করলেও লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। আরো লিখুন।

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

আমারও খুব খচখচ করে। এটা খুব জ্বালাচ্ছে পাঠক। সমাধান করতে হবে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মিথ্যে হাসি দিয়ে মাঝে মাঝে আশাবাদী করতে হয় কিছু মানুষকে...

দুর্দান্ত লেখা

০২

অনেক জায়গায় খ এর বদলে থ হয়ে গেছে
একটু খেয়াল করো

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

আসলেই বাজে। খ কেন থ হয় কেজানে! চেষ্ঠা করব লীলেন ভাই।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

খুব মন খারাপ করা একটা লেখা। আপনি গুরুর ভুল না ভাঙিয়ে ভালোই করেছেন।

নজমুল আলবাব এর ছবি

মন খারাপ করা লেখা।

------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

তারেক এর ছবি

খারাপ লাগছে... ভীষণ মন খারাপ হল এটা পড়ে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

অনেক খারাপ লাগাতে পেরেছেন মান্না। মানে, অনেক ভালো হয়েছে আপনার এই দুরভিসন্ধিমূলক কাজটি। মন খারাপ হাসি
অনেক ডাগর ডাগর মোচড় পেলাম পেটে আর মনে।
চালিয়ে যান এই অভিসন্ধি। আপনার লেখা নিয়মিত দেখতে চাই।
আপনি মনে হচ্ছে সিলেটের সেই মান্না-ই, যাকে আমিও চিনি। আপনার কী মনে হয় শুনি। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

জ্বি ভাই, মনে হচ্ছে আমি ই সেই অধম

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

দেঁতো হাসি
লেখেন নিয়মিত- আবার বললাম।
আর, অবশ্যই ভালো থাকেন। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

পরিবর্তনশীল এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটা। সত্যি। মানে মন খারাপ হলো।
হয়তো কোন কারণ নাই- তবুও মনে হলো আমার প্রিয় লেখকের গদ্য পড়ছি।
আমার প্রিয় লেখক মানে- কালকূট।
চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

মন্তবে্যর জন্য ধন্যবাদ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

কি অদ্ভুত, না? মন খারাপ

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

খুব অদ্ভুত, খুব

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

এতো শক্তিশালী লেখা কদাচিত পড়া হয়।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

অর্জুন মান্না [অতিথি] এর ছবি

আরেফিন,
অনেক ধন্যবাদ।

আদনান [অতিথি] এর ছবি

আমিও ছাতক হাইস্কুলেরই ছাত্রছিলাম এই ১ বছর আগ পর্যন্ত। এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। চন্ডি স্যার আমি এ স্কুলে আসার একবছর আগেই রিটায়ার্ড হন। তাকে সরাসরি না পেলেও তার কথা অনেক শুনেছি। আপনার কাছ থেকে আরও জানতে পারলাম। ধন্যবাদ পোষ্টটির জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।