ঢং ঢং ঢং...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৯/০৮/২০০৯ - ৫:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢং ঢং ঢং... পিতলের ঘন্টায় দারোয়ানের হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। সে কি মধুর শব্দ...আহ! শেষ পিরিয়ডে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে বসে ছিল পিনপতন নীরবতায়, কান পেতে ছিল...কখন ঘন্টা বাজে! তারপর সে মধুর ঘন্টাটা বাজতেই হুড়োহুড়ি করে ছুটে বের হলো তারা। কানে তালা লেগে যাচ্ছে ঢং ঢং আওয়াজে... ভিড়ের মধ্যেই চারপাশের ধাক্কায় অন্ধের মতো এগুতে লাগলো শায়লা... ... তারপর আর কি! যা হবার তাই হলো, চৌকাঠে পা ঠেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আর তখুনি ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলো।

ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। ফ্যান ঘুরছে না...কখন লোডশেডিং শুরু হয়েছে কে জানে! বাস্তবে ফিরে আসতে একটা মুহূর্ত সময় প্রয়োজন ছিল হয়তো...তবু ইশকুল-বেলার স্বপ্ন থেকে ফিরে আসতে শায়লার যেন কয়েকটা যুগ লেগে গেল। বিছানাটা ঘুমঘোরের হুটোপুটিতে এলোমেলো, তা-ই দেখে একটু বিরক্ত হলো ও , কিছুটা হতাশও। স্বপ্নটা কমসে কম শেষ তো হতে পারতো! একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস... তারপরে হঠাৎ করেই খেয়াল করলো শায়লা...ঢং ঢং ঢং ঘন্টা এখনো বেজে যাচ্ছে। আশ্চর্য! আওয়াজটা মাথার ভেতর কি পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিল নাকি?! নাকি ওর ঘুমের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটেনি?

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো শায়লা, তারপর খুঁজতে লাগলো শব্দটা ঠিক কোথা থেকে আসছে। স্বপ্ন যে সে দেখছে না এটা নিশ্চিত...তার জানালাটার ধারেই ওয়াসার খাল, বাতাস সে খালের সৌজন্যে পুতিগন্ধময় ঢাকার এক ঝলক বয়ে আনে ঘরে, জানালাটা খোলা পেলেই। এই যেমন এখন! স্বপ্নে ঘ্রাণ পাওয়া যায় না...নাহ! বাস্তবেই আছে ও, নিশ্চিত। খুব সম্ভবত বারান্দা দিয়ে শব্দটা আসছে। আলতো পায়ে হেঁটে এলো বারান্দায়। যা ভেবেছিল ঠিক তাই...শব্দটা এখান থেকেই আসছিল। পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া, উঠেছে এক সপ্তাহ হবে। বাড়িটাই নতুন বানানো, বেশ সুন্দর দেখতে...শুধু বারান্দাটাই কেমন যেন! সাদা মার্বেলের মেঝেটা অবশ্য সুন্দর, দেখলেই শীত-শীত লাগে শায়লার। এলুমিনিয়াম কোটিং লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা বারান্দা, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ছড়ানো; যেন এক বিশাল গারদ। সে তুলনায় তাদের বারান্দাটা বেশ। কোমর পর্যন্ত লোহার বেড়া, তার উপরের এই খানিকটা মুক্তি যেন বারান্দাবাসিনীকে পুরো আকাশটার মালিক করে দেয়।

ক্লান্ত পায়ে বারান্দার শেষ মাথায় এগিয়ে এল শায়লা, নতুন বাড়িটার বারান্দায় একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। চার কি পাঁচ বছর হবে বয়স। রুক্ষ এলোমেলো চুল, পরনে সবুজ ফ্রক। গায়ের রংটা বেশ খোলতা। হাতে কাঠের কিছু একটা, কোনো আসবাব থেকে ভেঙ্গে পড়া টুকরা হবে হয়তো। ঠিক বোঝা গেল না। সেটা দিয়েই গ্রিলে ঢং ঢং করে আওয়াজ করে চলছে। ও যেন তার নিজের বাদ্য বাজানোর প্রতিভায় মুগ্ধ। তবে মুগ্ধ হতে পারলো না শায়লা। সদ্য ভাঙ্গা কাঁচা ঘুমটার জন্য মেজাজটা বেশ খিচড়ে আছে।
এই। এই মেয়ে। এই মেয়ে।
মেয়েটা একটু থামলো ডাক শুনে, শায়লার দিকে তাকাতেই শায়লা চোখ পাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
এতো আওয়াজ করছো কেন? পেয়েছোটা কি?
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে কি যেন একটা বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর আবার ঢং ঢং বাজাতেই লাগলো। আড়চোখে একটু একটু করে শায়লাকে দেখতেও লাগলো। শায়লা একটু অবাক হলো। কত্তোবড়ো বেয়াদব, মনে মনে ভাবলো। তারপর আবার ডাকতে শুরু করলো।
এই পিচ্চি এই! কি হচ্ছে, হ্যা? তোমার আম্মুকে ডাকবো? ডাকবো তোমার আম্মুকে?
শায়লার কথা শুরু হতেই ঢং ঢং থামালো মেয়েটা। প্রশ্ন শেষ হতেই যেন শুনতেই পায় নি এমন ভাব করে আবার ঢং ঢং করতেই লাগলো। হতাশ চোখে ঐ বারান্দার দরজার দিকে তাকালো শায়লা। ভেতর থেকে বন্ধ। হাজার ডাকলেও ভেতরের কারো হয়তো কানে যাবে না। এই ঢং ঢং ঢং ই যখন কানে যায় না...তার ডাক আর কিইবা কানে যাবে।

কিছুক্ষণ ভাবলো শায়লা কি করা যায়। গ্রীষ্মের ঝিম ধরা বিরক্তিকর দুপুর। হাতে কোনো কাজ নেই। এই আওয়াজে ঘুমানোও যাবে না। বাচ্চা মেয়েটা যেন শায়লার ধমকে ক্ষেপে গিয়েই আরো জোরে শব্দ করতে লাগলো। হতাশ চোখে শায়লা তাকিয়ে রইলো। তারপর মেঝেতে বসে পড়লো, হাঁটু দুটো গুটিয়ে বুকের কাছে এনে কি যেন ভাবতে লাগলো। আর চুপচাপ ঢং ঢং আওয়াজ শুনতে লাগলো। এবার মেয়েটা একটু দ্বিধায় পড়লো, বাজাবে কিনা বুঝতে পারছে না। শায়লার আচরণে একটু অবাক হয়েছে। কৌতুহলী দুটো বড় বড় চোখ মেলে তাই সে ফাঁকে ফাঁকে শায়লাকে দেখে নিতে লাগলো। অনিয়মিত হয়ে এল ঢং ঢং আওয়াজ।
আমাদের স্কুলে একটা পিতলের ঘন্টা ছিল।
মেয়েটার উদ্দেশ্যে কথা ছুড়ে দিল শায়লা।
চকচকে একটা পিতলের ঘন্টা। রোদ পড়লে সূর্যের মতো মনে হতো। তোমাদের স্কুলে এরকম ঘণ্টা আছে?
মেয়েটা আওয়াজ থামিয়ে তাকিয়ে রইলো শায়লার দিকে, কিন্তু কিছুই বললো না। শায়লা অবশ্য তাতে থামলো না, শায়লাকে কথায় পেয়ে বসেছে...
ঘণ্টায় ঘন্টায় দারোয়ান সে ঘন্টাটা হাতুড়ি দিয়ে পেটাতো। মিষ্টি একটা ঢং ঢং আওয়াজ ছড়িয়ে পড়তো তখন। মাঝে মাঝে আমাদেরও খুব ইচ্ছে হতো ঘণ্টাটা একটু বাজাই। অনেক উঁচু একটা বাঁশের ডগায় বাঁধা থাকতো ঘন্টাটা। আমরা লাফ দিতাম, হাত বাড়াতাম, নাগাল পেতাম না। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ানো হাত লেগে পিতলের ঘন্টাটা দেয়ালে বাড়ি খেত। টুং করে একটা শব্দ হতো, তখন মনে হতো যেন আরেকটাবার স্কুল ছুটি হলো!
আনমনেই একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো শায়লার ঠোঁটে...সেই কবে স্কুল ফেলে এসেছে, ইশকুল-বেলা এখনো তাকে ফেলে যায়নি। ছোট্ট মেয়েটা আজ ওর স্মৃতির আর্গল খুলে দিল।
তুমি স্কুলে যাও না?
মেয়েটা একটু ভাবলো নিজ মনে, তারপরে ডানে-বামে অল্প একটু মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল, না!
শায়লা হাসলো, স্কুল অবশ্য এমন মজার কিছু না। সব স্কুলেই দুয়েকটা ভয়ংকর টিচার থাকে। বেত হাতে ভীষণ ভয়ংকর! হা হা হা...তাদের ক্লাশে ঘন্টাটা যেন বাজতেই চাইতো না।
গ্রিলের ফাঁকে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট মেয়েটা শায়লাকে দেখতে লাগলো, ছেলেবেলার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন শায়লার মুখে তীব্র খুশির ঝলক।

ঠাস! চড়ের তীব্র শব্দে চমকে উঠলো শায়লা। স্থুলাঙ্গী এক মহিলা পাশের বারান্দায় উপস্থিত, সামনে ছোট্ট মেয়েটা দাঁড়ানো। তার সদ্য চড় খাওয়া গালে লাল আভা...নীরবে কাঁদতে লাগলো দাঁড়িয়ে। উচ্চকন্ঠে বলতে লাগলো মহিলা, “বারান্দায় কি? হ্যা? এই তোর ঘর মুছা চলতচছে নাকি?? সারাদিন ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা ঘোরাঘুরি! আজকে তোর খাওয়া বন্ধ...” ঘরে ফিরে যাবে, এমন সময় মহিলা যেন শায়লার উপস্থিতি খেয়াল করলেন। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগলেন, আর বলবেন না ভাবী, আজকালকার কাজের মেয়েগুলা এতো ফাজিল! আপনাকে আবার বিরক্ত করে নাই তো?

শায়লা মফস্বলের মেয়ে...ভুলেই গিয়েছিল এ ঝকমারি শহরে এখনো দাসব্যবসা চলে!

হাঁটুতে মুখ গুজে বসে রইলো শায়লা...ঢং ঢং শোনা যাচ্ছে আবার। সেই সে পিতলের ঘন্টায় বুড়ো দারোয়ানের হাতুড়ির বাড়ি, আবার হুড়োহুড়ি...নাহ এবার কিছুতেই হোঁচট খাওয়া যাবে না!

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...
মেইলঃ


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

স্বাগতম... ভালো লাগলো গল্পটা... আরো লিখুন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

চেষ্টা করি টুকটাক লেখতে... এখানে এসে লেখতে লোভ লাগে খুব।

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...
মেইলঃ

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বেশ লাগল গল্পটা। তবে প্রশ্ন থেকে গেল। কাজের মেয়েটা ঢং ঢং ঢং শব্দ করেই যাচ্ছিল, যে আওয়াজে পাশের বাড়ির একজনের ঘুম ভেঙে গেল, বিরক্ত হয়ে গেল সে, আর ওই বাড়ির কেউ কিছুই বলল না? এতক্ষণ ওকে শব্দ করতে দিলো? তারচেয়েও বড়ো কথা, কাজের মেয়েটা এমন আচরণ করার সাহসই বা পেল কোত্থেকে?

সচলায়তনে স্বাগতম। নিয়মিত লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

হতাশ চোখে ঐ বারান্দার দরজার দিকে তাকালো শায়লা। ভেতর থেকে বন্ধ। হাজার ডাকলেও ভেতরের কারো হয়তো কানে যাবে না। এই ঢং ঢং ঢং ই যখন কানে যায় না...তার ডাক আর কিইবা কানে যাবে।

এখানে হালকা একটু ইঙ্গিত রাখছিলাম, দরজা বন্ধ, ভেতরের মানুষের কানে তাই যায় নাই। তবে লাগোয়া বাসার বারান্দার দরজা খোলা থাকলে বেডরুমে শব্দ যেতে পারে।

আর শৈশবের একটা স্বভাবজাত চাঞ্চল্য থাকে... শাসনের বেড়া মানে না এমন। কাজের মেয়ের এতো সাহস কেন--শৈশব এরকম যুক্তিবাদী হলে শৈশবে শাসনের ছোঁয়া পড়তো না।

মনোযোগ ধরে রেখে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ওহ্, ইঙ্গিতটুকু মিস হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, গল্প পড়ে ভালো লেগেছে। আরো লিখুন। নিয়মিত লিখুন।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- মেয়েটার ঘর মোছার কথা। কিন্তু তাকে বারান্দায় রেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ কেনো?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

একটা কথা বলা হয়নি, শায়লার স্মৃতিচারণের অংশটুকু দুর্দান্ত লাগল।

কবিরুল ইসলাম এর ছবি

বেশ সমাজ সচেতন গল্প। ভালো লেগেছে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ভালো থিমের গল্প। আরো লিখুন মেঘ।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

অতিথি লেখক এর ছবি

উৎসাহের জন্য কৃতজ্ঞ।

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...
মেইলঃ

কাকতাড়ুয়া [অতিথি] এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ইমো কেম্নে দেন?

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...
মেইলঃ

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লাগলো পড়ে

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ।

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...
মেইলঃ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, উৎসাহের জন্য

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনি অনেক ভালো লিখতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে। শুধু নিয়মিত লিখতে হবে। (বিনামূল্যে উপদেশে দিতে সবাই সিদ্ধ হস্ত, আমিও)

অতিথি লেখক এর ছবি

বিনামূল্যের উপদেশ দেন ক্যান? দিলে বেশি দামেরটাই দেন খাইছে

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ভালো গল্প হয়েছে।
লেখা চলতেই থাকুক হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

যখন সদস্য ছিলাম না, তখন ঘামের গল্পটা পড়েছিলাম...বেশ দারুণ লেগেছিল পনার লেখা। আমার এক ভাই, সে সাধারণত বড় লেখা দেখলেই পালাতো। সেও পর্যন্ত একটানে পড়ে ফেলল!

সদস্যনামঃ সূর্যবন্দী মেঘ...

অতিথি লেখক এর ছবি

'ঢং ঢং ঢং' গল্প বলার ঢং টা বেশ পছন্দ হয়েছে।
আরো গল্প আসবে আশা করছি......

#ওসিরিস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।