অন্য পৃথিবীতে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০২/১১/২০০৯ - ৭:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পশ্চিম আফ্রিকায় পদার্পণের সাড়ে ৩ মাস পেরিয়ে গেল। দিন তারিখ দ্রুত বদলাচ্ছে । পঞ্জিকার পাতা ওল্টাতে মনে থাকে না। প্রতিদিন দিনপঞ্জিতে প্রবাসজীবনের টুকিটাকি নিয়ে অন্তত ২-১ লাইন লেখার পরিকল্পনা থাকলেও মাসে একবারও লেখা হয় কি হয় না। কোন কোন রাতে হঠাৎ আবিষ্কার করি আজ পূর্নিমা। টিক দিয়ে রাখা ওয়েবপেজে দ্বিতীয়বার ঢোকা হয় না। অন্তর্জালের অপব্যবহার করে নামিয়ে নেয়া গানগুলোও বেশিরভাগ সময়ই পড়ে থাকে। সময় ধারণার চাইতেও দ্রুত যায়, বিশেষ করে আমার মত অলসদের জন্য।

এসেছি পশ্চিম আফ্রিকার এক কোনায় পড়ে থাকা দেশ আইভরী কোস্ট। উদ্দেশ্য, জাতিসংঘের ঘাড়ে বসে বছরদুয়েক অর্থনৈতিকভাবে নিশ্চিন্ত থাকা; উপলক্ষ, গৃহযুদ্ধ পরবর্তীকালীন শান্তি মিশন। জাতিসংঘ জাতিতে নপুংসক হলেও গায়ে গতরে বেশ বড়সড়, তার ঘাড়ে ওঠা এ অধমের একার কম্ম নয়। ঘাড়ে ওঠার জন্য মইটা ধার নিয়েছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। বলে রাখি, আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কাঁধ পর্যন্ত চুল রাখা অস্থিমজ্জায় বেসামরিক এক তরুণ। তো তারা হঠাৎ এই আমাকে বিদেশ বিভূঁয়ে নিয়োগ দিলেন কেন? কারণ আইভরী কোস্ট একটি সাবেক ফরাসী উপনিবেশ। আইভরিয়ানরা তাদের ফরাসী প্রভুদের চাপে নিজেদের হরেক গোষ্ঠীর হরেক রকমের ভাষা প্রায় বিসর্জন দিয়ে এখন এক ভাষা এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি দুনিয়াদারির ভাষা ইংরেজিও তাদের জিহ্বাশূল (ভাগ্যিস!)। আমার কাজ স্বদেশের সেনাবাহিনীর হয়ে দোভাষীগিরি করা। যেতে হতে পারতো কংগো, সেটাও সাবেক উপনিবেশ এবং সেখানে গেলে নাকি ট্যাঁকে সারাক্ষণ একটা পিস্তল গুঁজে চলাফেরা করতে হত, সাথে থাকতো দেশে কথা বলার জন্য মিনিটপ্রতি ৫ ইউএস ডলারের ধাক্কা। এখানে পকেটে ক্যামেরাযুক্ত মুঠোফোন থাকে। দ্রুতগতির অন্তর্জালের বদৌলতে ঢাকার প্রিয় মানুষদের শুধু ছোঁয়াটাই বাকি থাকে, আর টরেন্ট ব্যস্ত থাকে মুভি নামাতে।

ইদানিং বাবার সাথে আমার দূরালাপন একটা সাধারণ প্রশ্নের চারপাশে ঘুরপাক খায় - 'আজকের দিনে তোমার কি অর্জন হল?' (বাংলা ভাষার এই ব্যাপারটা আমার অসাধারণ লাগে। বিষয়ের গুরুত্ব বোঝাতে সম্বোধন 'তুই' থেকে 'তুমি'তে চলে আসে)। আমার প্রতিক্রিয়া (অবশ্যই মনে মনে) প্রত্যেকবার একই হয় - 'ধরণী দ্বিধা হও'। বাবার ধারণা, এরকম আত্মজিজ্ঞাসামূলক চিন্তা তার ছেলের মনে কখনই আসবে না। প্রশ্নটা আমি যে নিজেকে কালেভদ্রেও করিনা তা না। কিন্তু ইনকামিং হিসেবে ব্যাপারটা হজম করা বেশ দুরূহ। তাছাড়া অর্জন মাপামাপির ব্যাপারটা দৈনিক হিসেবে করাটা কতটা যৌক্তিক তা আমার মতে প্রশ্নসাপেক্ষ। আমি মানি আমার অনুর্বর ঘিলুতে মাঝে মধ্যে ঘুটা দেয়া বাবা হিসেবে তাঁর কর্তব্য। কিন্তু এ তরুণের অপ্রতুল ধৈর্য্যের কথা তাঁর জানা। এও জানা যে অর্জনের ধারণাটা ঠিকঠাক মত এখনও তার পুত্রধনের মনে গেড়ে বসে নি। জীবনের বাস্তবতার দীক্ষা এখনো তার কাছে ঐচ্ছিক বিষয়। তারপরও প্রশ্নটা করে হয়তো টোকা দিয়ে দেখতে চান কলসিটা আদৌ কিছুটা ভরল কিনা। যথারীতি আশাহত হন। অতএব এ কথা সে কথার পর আমার হতাশ পিতা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটান - "তোর মা'র সাথে কথা বল"।

আফ্রিকা বলতে আমাদের কল্পনায় যা ভেসে ওঠে, আইভরি কোস্টের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ও প্রধান সমুদ্রবন্দর আবিদজানে নেমে ব্যাপারটা আদতে তেমন কিছু মনে হয় নি। বরং ঢাকার কথা চিন্তা করে মনটা খারাপ হয়েছিল। ইউরোপ বা মার্কিন মুলুকে যাওয়া হয়নি। কিন্তু বুঝতে সময় লাগে নি, একেই সম্ভবত আধুনিক নগর বলে। কয়েক পরতের প্রশস্ত রাস্তা আর ফ্লাইওভার সারা শহর জুড়ে সাজানো। লাল আলো দেখে থামার যে একটা ব্যাপার আছে, এটা বোধহয় আমরা ঢাকাবাসীরা প্রায় ভুলতে বসেছি। এখানে ট্রাফিক পুলিশ কালেভদ্রে চোখে পড়ে। রাতে শহরের চেহারা আরো খোলতাই হয়। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে একটা লেগুন বের হয়ে শহরটাকে চিরে ফেলেছে। লেগুনে আবর্জনা নেই তা নয়, তবে ঢাকার গুলশান সংলগ্ন বিলের তুলনায় অনেক কম। লেগুনে মানুষ পারাপারকারী পরিচ্ছন্ন ফেরি চলাচল করছে সবসময়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দিষ্ট স্থান থেকে তারা মানুষ তোলে নামমাত্র মূল্যের টিকেটের বিনিময়ে। নীরব জনগণ সেখানে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করে।

হয়তো এই নীরবতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের। নাগরিক বৈশিষ্ট্যগুলো শুধু বাইরের চিত্র, শোষণ আর লুটের সুবিধার্থে ফরাসীদের বানানো। যখন দেখি শহরের এক বিশাল অংশ জুড়ে ফরাসী সেনানিবাস, আমার বেয়াড়া ঢাকার সাথে আবিদজানের তুলনায় একটুও মন খারাপ হয় না আর, যতই হোক তা আফ্রিকার প্যারিস।

রাহিন হায়দার


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সচলে স্বাগতম জানাই আপনাকে। নিয়মিত লিখুন, সম্ভব হলে সচিত্র।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

রাহিন হায়দার এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ! দেয়ার মত চিত্র থাকলে অবশ্যই দেব। আর আপনার লেখার হাতকে প্রচন্ড হিংসা করি!

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আইভরী কোস্টের লোকজনের ব্যাপারে আমার বেশ ভালো কিছু ধারণা আছে। বেশ খোলামেলা আর বন্ধুবৎসল মনে হয়েছে তাদের তুলনামূলক ভাবে।

লিখুন আরও তাদের ব্যাপারে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

রাহিন হায়দার এর ছবি

আমারও ঠিক একই ধারণা হয়েছে তাদের ব্যাপারে। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য!

শাহান এর ছবি

তুমিও হাসি

চমৎকার লাগলো লেখাটা। হ্যাগার্ড ভদ্রলোকের বই পড়ে পড়ে আফ্রিকা দেখার খুব ইচ্ছা। জানি না কোনদিন হবে কিনা।

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধন্যবাদ শাহান ভাই!

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

স্বাগতম! আরো লিখুন ভিনদেশি বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে!
.....................................................................................

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও! চেষ্টা করব আরো লেখার।

মৃত্তিকা এর ছবি

আচম্‌কা শেষ করে দিলেন ভাই? নাকি চলবে আরও? ভালো লেগেছে, লেখার ধরণটা।

রাহিন হায়দার এর ছবি

উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ! আরো লেখার চেষ্টা করব।

নিবিড় এর ছবি

ভাল লাগছে পড়তে। আশা করি এখন থেকে নিয়মিত দেখা পাব আপনার সচলের পাতায় চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

রাহিন হায়দার এর ছবি

আমারও ভাল লাগল আপনার কমেন্ট পড়ে। আশা করি অলসতা ঝেড়ে ফেলে লিখতে পারব। ওটাই প্রধান শত্রু।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সচলায়তনের সুবাদে কত মানুষের কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ হচ্ছে। আপনাকে স্বাগত জানাই। নিয়মিত লিখুন, সপ্তাহে অন্তত একটা, সচিত্র।

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধন্যবাদ। চিত্রের ব্যাপারে চেষ্টা থাকবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সাবলীল...আরো লিখুন ছবি সহ , অপেহ্মা রইলো ! *তিথীডোর

রাহিন হায়দার এর ছবি

চেষ্টা থাকবে! ধন্যবাদ আপনাকে।

ভ্রম এর ছবি

সুন্দর লেখা। আশা করছি আপনার আরো লেখা পড়ার সুযোগ পাবো।

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধন্যবাদ!

মূলত পাঠক এর ছবি

সচলে স্বাগতম! ভালো লাগলো আপনার লেখার হাত। আরো লিখুন।

রাহিন হায়দার এর ছবি

উৎসাহিত হলাম! ধন্যবাদ।

অবাঞ্ছিত এর ছবি

স্বাগতম। নিয়মিত লিখুন হাসি
__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

__________________________
ঈশ্বর সরে দাঁড়াও।
উপাসনার অতিক্রান্ত লগ্নে
তোমার লাল স্বর্গের মেঘেরা
আজ শুকনো নীল...

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও!

নীলআমার [অতিথি] এর ছবি

ভীষন ভাল লাগল, চমৎকার লিখেছেন, শুভ কামনা রইল।
নীলআমার

**না  এর ছবি

মন্তব্য নিস্প্রয়োজন! হাসি

রাহিন হায়দার এর ছবি

তা তো বটেই! তোর জন্যই সচলে দেয়া হল লেখাটা দেঁতো হাসি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

জানেমান, উহাকে গুতানো অব্যহত রাখ! বংশীবাদক লিখে ভালো! দেঁতো হাসি

----------------------------
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মেতৎ চলিষ্যতি।।

- ললিতবিস্তর

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চলুক চলুক
স্বাগতম বস। আরো আসুক।

______________________________________________________

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

...অসমাপ্ত [অতিথি] এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন। আশা করি নিয়মিত লিখবেন।

নীল ভুত এর ছবি

আমার পরিচত সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুস। : -P । এই লেখক আমার বড় ভাই হ্য় ।।
রাহিন ভাই, খুব মজা লাগসে পড়ে খাইছে

রায়হান আবীর এর ছবি

দুঃখিত। এই লেখাটা মিস করে গিয়েছিলাম।


পুচ্ছে বেঁধেছি গুচ্ছ রজনীগন্ধা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।