যে মামাটা বেঁধে রেখেছিলো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০১/২০১০ - ১১:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার পাঁচ মামা| বড় মামার ট্যালেন্ট অসাধারণ ছিলো বলে শুনেছি| নানার মতো তিনিও জেলার ছিলেন একসময়| মেজো মামা আর ননী (সেজোর পরেরজন) মামা ডাক্তার| মেজ মামা লম্বা একটা সময় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এ কাজ করেছেন| আর ননী মামা জীবনের একটা বড় অংশ সৌদি আরবে ডাক্তারি করেছেন | ছোট মামা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এখন কানাডা প্রবাসী | আমার সবগুলা মামা অসাধারণ ধরনের ভালো মানুষ| বাবা-মারা যেরকম ছেলেপেলে চাইতে পারে, তাঁরা এক এক জন সেই রকমের রোল মডেল| কিন্তু আজকের গল্প আমার সেজো মামা কে নিয়ে| তিনি একসময় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়েছেন| স্বাস্থ্যগত কারণে শেষ করা হয়নি বলে জানি | আমার জানামতে উনি business administration নিয়ে কাজ করতেন| সেজো মামার সাথে আমার ছোটবেলার স্মৃতি খুবই কম| যেটুকু আছে সেটার জন্য বহুদিন উনি আমার ফেভারিট ছিলেন না| আজকে সেই গল্পই বলবো|

আমার নানা তখন শেষ শয্যায়| আমার মা, খালা, মামারা সবাই নানাবাড়িতে| সাথে আমরাও, মানে সব কাজিনরা| মায়ের এতগুলা ভাই বোনের স্বাভাবিক কারণেই অনেকগুলো ছেলেপেলে| আর যত পিচ্চি, আমাদের ততই মজা| আমরা তখন সাতজন খালাতো ভাই ছিলাম| মামাতো ভাইদের মধ্যে কে কে ছিলো সব মনে পরছেনা তবে বড় মামার ছেলে ইমরান আর রায়হান এবং মেয়ে পরী ছিলেন মনে আছে| ইমরান ভাই হচ্ছেন স্বভাবে লক্ষী ছেলে| বয়সে বড়, গম্ভীর, বুদ্ধিমান, এবং শান্ত স্বভাবের| গুরুজনদের খুব মানতেন| রায়হান ভাই ছিলেন যাকে বলে দুষ্টুমিতে ভরপুর| এমন ছেলেদের বাবা-মারা বলেন চঞ্চল আর পড়শীরা বলে বদপুলা| স্বাভাবিক কারণেই রায়হান ভাইকে আমারা পিচ্চিরা খুব পছন্দ করতাম এবং নেতা মানতাম| ফাঁদ পেতে পাখি ধরা, গাছে উঠে কামরাঙ্গা, পেয়ারা, আর কাঁঠাল পাড়া, বৃষ্টির মধ্যে টিনের ছাদে উঠে বসে থাকা, এসবই ছিলো তাঁর দৈনন্দিন কাজ| সুতা দিয়ে পাখি ধরার ফাঁদ আর পেঁপে পাতার ডাল দিয়ে খেলনা চিনির কল বানাতে তাঁর জুড়ি ছিলো না| গাছ বাইতে পারতেন খুব ভালো| ঘন্টাখানেকের মধ্যে একগাছ কাঁঠাল পেড়ে ফেলা তাঁর জন্য কোনো ঘটনা ছিলো না|

তো রায়হান ভাই এর নেতৃত্বে (অবশ্যই আমরা বাকিরাও খুব লক্ষী ছিলাম না) আমরা পিচ্চি বানর বাহিনী নানাবাড়ি মাথায় তুললাম| মাঝে মধ্যে এক এক জন গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে আসি নানার ঘরে কি হচ্ছে| মেজো মামা আর ননী মামা তাঁদের সারাজীবনের সঞ্চিত জ্ঞান ঢেলে চেষ্টা করছেন নানার কষ্ট কমাতে (ডাক্তাররা মানুষকে বাঁচাতে পারে এটা আমি এখনো মানি না)| বাকিরা তাঁদেরকে সাহায্য করছেন|

বেশি চিল্লাচিল্লি করেও বকা না খাওয়াটা হিসেবের মধ্যে ছিলনা| তাই ব্যস্ত মা, খালা, মামারা কেউ আমাদের কিছু বলছেনা, এটা খুবই অদ্ভুত লাগছিলো| অনেকক্ষণ যাওয়ার পড়ে কেউ কিছু বলবেনা এটা একরকম নিশ্চিত হওয়ার পরে আমাদের শোরগোল ভয়াবহ আকার ধারণ করলো| এর মধ্যে সেজো মামা কয়েকবার ইমরান ভাইকে দিয়ে আমাদের চুপ করার আদেশ পাঠিয়েছেন| সেজো মামাকে একটু রাশভারী মনে হত| মাথায় বিশাল বাবরি চুল রাখতেন| সরাসরি আমাদের বাচ্চাদের সাথে খুব বেশি কথা বলতেন না| তাই ইমরান ভাই ছিলেন তাঁর দূত| তবে সচরাচর ছোটদের ফালতু কাজে নাক গলাতেন না, কাজেই ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিলো না|

অবস্থা যখন খুব গুরুতর, তখন একদিন দুপুরে খাওয়ার পরে আমাদের কে কিছু একটা বলার জন্য একটা রুমে ডাকা হলো| আমরা লক্ষীপানা মুখ করে হাজির হলাম| কিন্তু কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই পেছনে দরজা বন্ধ করে আমাদের সবগুলোকে বেঁধে ফেলা হলো| তার পরে দরজাটা বাইরে থেকে তালা মেরে রেখে দেয়া হলো| ততক্ষণে আমরা কিঞ্চিত হতভম্ব এবং অনেকটাই ভিত| দরজা দিয়ে উঁকি মেরে ক্রমাগত দেখছি| কেউ পাশ গেলেই আমরা করুন কন্ঠে আমাদের দুর্গতি প্রকাশ করে ছেড়ে দেয়ার আবেদন জানাচ্ছি| কিন্তু কেউ সেজো মামার আদেশ অমান্য করে আমাদের সাহায্য করার সাহস পায়না| একসময় ইমরান ভাই এসে আমাদের স্যরি বললেন আগাম না জানানোর জন্য| কিন্তু তালা খুলতে মোটেই রাজি হলেন না| যতদুর মনে পরে নরম স্বভাবের পরী অপু একসময় চাবি চুরি করে এনে আমাদের মুক্ত করেন|

এই ঘটনার পরে বহুদিন পর্যন্ত সেজো মামাকে কঠিন ভয় পেতাম| নানা-নানীর মৃত্যুর পরে মামাদের সাথে যোগাযোগ একটু কমে যায়| তার মূল কারণ বছর শেষে নানাবাড়ি যাওয়াটা বন্ধ হয়ে যায়| বাড়িটা একসময় ভাড়া দেয়া হয় এবং আমাদের যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়| কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত আমি আমার মার কাছে সেজো মামার ব্যাপারে কিছু বোঝাতে চাইলে বলতাম "ওই যে, যে মামা আমাদের বেঁধে রেখেছিলো"| আম্মু বহুবার আমাকে বুঝিয়েছেন যে, দোষ তো আমাদেরই ছিলো| আমিও অস্বীকার করিনা, দোষ তো আমাদেরই ছিলো| কিন্তু আমিওতো ভুল বলছি না, উনিই তো বেঁধে রেখেছিলেন|

ক্লাস নাইনের দিকে আমরা ঢাকা চলে যাই| তখন থেকে আবার মামাদের সাথে দেখা সাক্ষাত বাড়ে এবং তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি আমার সেজো মামা আমার মোস্ট ফেভারিট হয়ে গেছেন| তার মূল কারণ, বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমাদের প্রায়-পিচ্চিদের কথা সিরিয়াসলি নেন| আমাদের সাথে বড়দের মতো কথা বলেন যেনো আমরা তাঁর সমকক্ষ| আমাদের সাথে সবকিছু নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেন| তাঁর সাথে বন্ধুর মতো কথা বলা যায়| সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, তিনি সহজে রাগ করেন না| আমার আজকের এই লেখা আমার সেজো মামাকে উত্সর্গ করলাম| অনেকদিন তাঁর উপরে মিছে অভিমান করে থেকেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিই আমার মোস্ট ফেভারিট|

-আতিউর
atiurrs from the gmail.com


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সচলে অভিনন্দন
মামাদের নিয়ে আমারও কাহিনী বেশ ভয়ানক ছিল
কিন্তু একসময় আবিষ্কার করলাম মামারাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছেন

অতিথি লেখক এর ছবি

মনে হচ্ছে আপনার জীবনেও মামাদের নিয়ে মজার কাহিনী আছে, সময় করে লিখে ফেলেন|
-আতিউর

atiurrs from the gmail.com

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ| দেখি যদি সব মামারা একাট্টা হয়ে আমাকে প্রবাসেই ধোলাই দিতে না আসে|
-আতিউর

atiurrs from the gmail.com

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

হাসি ভালু লাগলো, আরও আসুক!

---------------------------
ওলো সুজন আমার ঘরে তবু আইলোনা
এ পোড়া মনের জ্বলন কেন বুঝলোনা!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ|
-আতিউর

atiurrs from the gmail.com

তানবীরা এর ছবি

আমি জানতাম না এধরনের কাহিনী অন্যদেরও আছে। মামাকাহিনীর দ্বিতীয়পর্ব পড়তে চাই
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

চিন্তাযুক্ত আছি, আমার আত্মীয় কেউ আবার পড়ে ফেলে কি না, হা, হা|
-আতিউর

atiurrs from the gmail.com

অনন্ত [অতিথি] এর ছবি

মামাদের নিয়ে সবারই মজার কাহিনী থাকে। পড়ে পুরাতন কথা মনে পড়ল। ভাল লিখেছেন।

===অনন্ত===

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ। অনেক দিন ভেবেছি এই গল্পটা লিখবো। সময় হয়ে ওঠেনি।

-আতিউর

তাসনীম এর ছবি

মামা কাহিনী ভালো লেগেছে, চলতে থাকুক।

--------------------------------------
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অতিথি লেখক এর ছবি

সুবা হো গায়ি মামু...
লেখা ভালো হয়েছে। কিন্তু ইংরেজী শব্দগুলোর ব্যবহার বেশী চোখে লাগছে।

---- মনজুর এলাহী ----

তুলিরেখা এর ছবি

মামা শুনলেই আমার এই মজার ছড়াটা মনে পড়ে

আট মামায় নাকি বাবার আট শালায়-
ভর্তি করে দিলো আমায় হরিঘোষের পাঠশালায়।

হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ঝাক্কাস
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।