ব্রাজিলে ফাইনম্যান-২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/১০/২০১০ - ৯:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম কে না শুনেছে। তার মত মজার পদার্থবিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার সিওরলি ইউ আর জোকিং, মি. ফাইনম্যান বইটা তো রীতিমতো একটা ক্লাসিক! ঐ বইটার কিছু অংশ (মূল Part 4: From Cornell to Caltech, With a Touch of Brazil/ O Americano, Outra Vez!) "নাই কাজ তো খই ভাজ" প্রকল্পের অধীনে অনুদিত হল।]

[সতর্কীকরণ: অনুবাদ কার্যে ব্যাপকভাবে অনুবাদকের স্বাধীনতা ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই মূল বইটি পড়া লোকজন একটু ধাক্কা মতন খেতে পারেন। আগেই সাবধান কইরা দিলাম হাসি ]

১. পর্তুগীজপরায়ণ ফাইনম্যান

রিও পৌঁছুনোর পর সিজার লাতিসের সাথে আমার সাক্ষাৎ হল। ন্যাশনাল টিভি নেটওয়ার্ক আমাদের সাক্ষাতের কিছু ছবি তুলতে আগ্রহী ছিল, তাই তারা কাজ শুরু করে দিল, তবে শব্দ ধারণ করা হচ্ছিল না। ক্যামেরাম্যান আমাদের বলল, “আপনারা কথা বলার ভঙ্গি করুন, পারলে কিছু একটা নিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকুন।”
তো লাতিস আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “এর মধ্যে কোন মেয়ে-টেয়ে জুটিয়ে ফেলেছেন নাকি?”
ওই রাতে ব্রাজিলের টিভি দর্শকরা দেখতে পেল ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক যুক্তরাষ্ট্র হতে আসা ভিজিটিং প্রফেসরকে স্বাগত জানাচ্ছেন, কিন্তু তারা সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেনি যে তাদের কথপোকথনের বিষয় ছিল শয্যাসঙ্গী খুঁজে পাওয়া বিষয়ক!

ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পৌঁছুনোর পর আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হল কোন সময়ে আমি আমার লেকচার দেব, সকালে না বিকেলে।
লাতিস বললেন, “ছাত্ররা ক্লাসের জন্যে বিকেলের সময়টা পছন্দ করে।”
“তাহলে আমি বিকেলেই ক্লাস নেব।”
“কিন্তু বিকেল বেলাতেই সৈকত সবচে’ মনোরম লাগে। এক কাজ করুন, আপনি ক্লাসগুলো সকালেই নিন, তাহলে বিকেলটাতে মজাসে সৈকত উপভোগ করতে পারবেন।”
এভাবে আমি ব্রাজিলে এসে ভিন্নভাবে জীবনটাকে দেখতে শিখলাম। প্রথমত, ওরা আমার মত তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকে না। দ্বিতীয়ত, কোনটা তোমার জন্যে ভালো তা বিবেচনা কর, অহেতুক অন্যের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে অত মাথা ঘামাবার দরকারটা কী? তাই আমি ব্রাজিলিয়ান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকালে ক্লাস নিতে শুরু করলাম এবং বিকেলে সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়াতাম। এই শিক্ষাটা যদি আমার আগে হত তবে আমি স্প্যানিশ না শিখে পর্তুগীজটাই প্রথম থেকে শিখতাম।
প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম আমার লেকচারগুলো ইংরেজিতেই দেব। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম যখন ছাত্ররা আমাকে পর্তুগীজে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করছে তখন আমি তা ভালোভাবে বুঝতে পারছি না, যদিও আমি পর্তুগীজ কিছুটা হলেও জানতাম। “বাড়ছে”, না “কমছে”, নাকি “বাড়ছে না”, বা “কমছে না” অথবা “ধীরে ধীরে কমছে”—ছাত্ররা এর কোনটা বোঝাতে চাইছে তা আমি পরিস্কার বুঝতে পারতাম না। কিন্তু যখন তারা কষ্টেসৃষ্টে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করত, তখন তাদের বিদঘুটে উচ্চারণ আর ব্যাকরণবিপর্যস্তবাক্যবিন্যাস সত্ত্বেও তা আমি ঠিকই আন্দাজ করতে পারতাম। তাই আমি বুঝতে পারলাম যদি আমি তাদের কিছু বোঝাতে যাই, তবে তা পর্তুগীজে করাটাই ভালো হবে, তা সে যত খারাপ পর্তুগীজেই হোক না কেন। তাহলে আমার কথা ঠিকই তাদের কর্ণের মধ্য দিয়ে মর্মে পৌঁছুবে।

আমার প্রথমবার ব্রাজিল ভ্রমণ ছ’ সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। সেবার আমি ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডিনামিক্সের ওপর আমার সাম্প্রতিক কাজ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। ঠিক করলাম বক্তৃতাখানা পর্তুগীজেই দেব। সেন্টারে আমার দু’জন ছাত্র বলল তারা এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে। আমার বদখত পর্তুগীজে একটা বক্তব্যের একটা খসড়া তৈরি করে ফেললাম। আমি নিজেই লিখলাম, কারণ জানতাম যে ভাষণটা যদি অন্য কেউ লিখে দেয় তবে সেখানে এমন অনেক শব্দ থাকবে যা আমি ভালোভাবে উচ্চারণই করতে পারব না। তাই বক্তব্য আমিই লিখলাম, আর আমার ছাত্রদুটি ব্যাকরণগত ত্রুটি দূর করে ও কিছু শব্দ মেরামত করে লেখাটাকে জাতে তুলল। এর ফলে যেটা হল যে আমি লেখাটা সহজেই পড়তে পারছিলাম এবং কী বলছি তা কমবেশি ধারণা করতে পারছিলাম। আর আমার ইংরেজি অভ্যস্ত জিভকে পর্তুগীজ ভাষাটি শুদ্ধভাবে উচ্চারণের জন্যে সঙ্গত করে নেবার জন্যে বেশ পরিশ্রম করতে হল, যেমন: “de” উচ্চারণ করতে হবে “deh” এবং “day”—এর মাঝামাঝি কিছু একটা, এমনি নানান হ্যাপা।
তো আমি ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের সভায় যোগ দিলাম। সেখানে প্রথম বক্তা, যিনি ছিলেন একজন কেমিস্ট, উঠে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখলেন। আমি বুঝতে পারলাম না কাহিনিটা কী—উনি কি ভদ্রতা করছিলেন নাকি? অবশ্যি উচ্চারণের করুণ দশার কারণে তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। ধারণা করলাম অন্যরা হয়তো তার কথা বুঝতে পারছে, হয়তো তাদের বাচনভঙ্গি একই রকম, কে জানে? পরের জন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন, এবং তিনিও ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন!
আমার পালা আসলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমি দুঃখিত; আমি বুঝতে পারিনি যে ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর আনুষ্ঠানিক ভাষা ইংরেজি, তাই আমি ইংরেজিতে আমার বক্তৃতা তৈরি করিনি। অনুগ্রহ করে আমায় মার্জনা করবেন, আমার বক্তব্য আমি পর্তুগীজে রাখতে যাচ্ছি।”
এই বলে আমি আমার বক্তৃতাটা পড়লাম, সবাই বেশ প্রশংসাও করল।
পরের বক্তা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “যুক্তরাষ্ট্র হতে আগত আমার সহকর্মীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমি পর্তুগীজেই আমার বক্তব্য রাখব।” এভাবে আমার জানা মতে আমি ব্রাজিলিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর ভাষারীতিটাই বদলে দিয়েছিলাম।
কিছু বছর পর আমার সাথে ব্রাজিলের এক লোকের দেখা হয় যিনি ঐদিন আমার ভাষণের শুরুর দিককার কথাগুলো হবহু উদ্ধৃত করেছিলেন। আমার বক্তব্য তাহলে তাদের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল বৈকি।
তবে যতই ভাষণ দিয়ে বেড়াই না কেন, পর্তুগীজ আমার কাছে বেশ কঠিন একটি ভাষা ছিল, এবং আমি সারাক্ষণই সংবাদপত্র পড়ে বা বিভিন্নভাবে এর চর্চা চালিয়ে যেতাম। আর আমার লেকচারগুলোও আমি পর্তুগীজেই দিতে থাকলাম—যার নাম আমি দিয়েছিলাম “ফাইনম্যানের পর্তুগীজ”, কারণ আমি জানতাম তা সত্যিকারের পর্তুগীজ নয়। কেবল আমার পর্তুগীজই আমি ভালোভাবে বুঝতাম, কিন্তু রাস্তাঘাটে লোকজনের মুখে শোনা পর্তুগীজ আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত!

২. লেখাপড়া করার ব্রাজিলীয় তরিকা

ব্রাজিলে আমার একবার প্রকৌশল স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসের লেকচার শোনার অভিজ্ঞতা হল। বাংলাতে রূপান্তরিত করলে সে বক্তৃতা এরকমটি শোনায়: “দুইটি বস্তু.......সমতুল্য বিবেচনা করা যাইতে পারে.....যদি সমান টর্ক প্রযুক্ত হইয়া.....তাহাদের ওপর সমান ত্বরণ......সৃষ্টি করে”। ছাত্ররা সব বসে বসে মনোযোগ সহকারে শ্রুতলিপি লিখছিল, আর অধ্যাপক সাহেব যখন বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করলেন তখন তারা মিলিয়ে দেখছিল সব ঠিকঠাকভাবে লেখা হয়েছে কিনা। তারপর তারা পরের বাক্য তুলল, তার পরেরটা আর এভাবেই চলতে লাগল। কেবলমাত্র আমিই বুঝতে পেরেছিলাম অধ্যাপক সাহেব সমান জড়তার ভ্রামক বিশিষ্ট দুটি বস্তুর কথা বলছিলেন, কিন্তু তার ঐ দুর্বোধ্য সংজ্ঞা থেকে এ জিনিস উদ্ধার করা দুরূহ ছিল বৈকি।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি এভাবে তারা কী শিখছে। অধ্যাপক সাহেব ঘ্যানঘ্যান করে পড়াচ্ছেন জড়তার ভ্রামক কী, কিন্তু সেখানে বাস্তব কোন উদাহরণ নেই। বলা হচ্ছে না যে দরজার বাইরের দিকে ভারি কোন ওজন লাগালে সেটা খুলতে কী পরিমাণ কসরত হবে, আর যদি কব্জার কাছে ওজন লাগিয়ে দেয়া হয় তবে তার কোন প্রভাবই পড়বে না!
ক্লাস শেষ হবার পর আমি এক ছাত্রকে পাকড়াও করলাম: “এই যে ভায়া, তোমরা যে এভাবে অন্ধের মতন ক্লাসনোট তুলছ, এগুলো দিয়ে হবেটা কী?”
“কী যে বলেন স্যার! ক্লাসনোট না তুললে উপায় আছে”, ছাত্রের উত্তর, “পরীক্ষায় তো এখান থেকেই প্রশ্ন আসবে।”
“ওহ, তাই নাকি। তা বেশ বেশ। তো তোমাদের সে পরীক্ষাটা কী রকম ব্যাপার?”
“সে ভারি সহজ স্যার। আমি তো এখনই একটা প্রশ্ন বলে দিতে পারি।” সে তার নোটবইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কখন দুইটি বস্তুকে সমতুল্য বিবেচনা করা যাইতে পারে?” আর এর উত্তর হল, “দুটি বস্তুকে সমান বিবেচনা করা যাইতে পারে যদি তাহাদের ওপর সমান টর্ক প্রযুক্ত হইলে সমান ত্বরণ সৃষ্টি হয়।” তাহলে বুঝতেই পারছেন, তারা পরীক্ষা পাশের জন্যে চমৎকার বন্দোবস্ত করেছে, এবং এসব কিছু “শিখছে”ও বটে, কিন্তু তার কিছুই জানছে না, কেবলমাত্র যতখানি মুখস্থ করা হয়েছে তাই তাদের সম্বল।
অতঃপর আমার প্রকৌশল স্কুলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের ভর্তি পরীক্ষা দেখার সৌভাগ্য হল। পরীক্ষাটা হত মৌখিক, আর আমার সেখানে উপস্থিত থাকার অনুমোদন মিলেছিল। সেখানে এক ছাত্রকে আমার বেজায় মনে ধরল: সে ব্যাটা সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর বলে দিল! পরীক্ষকরা জিজ্ঞেস করলেন ডায়াম্যাগনেটিজম কী বস্তু, সে তার নিঁখুত সংজ্ঞা গড়গড় করে ঝেড়ে দিল, তারপর তাকে শুধানো হল, “আলো যখন একটি নির্দিষ্ট বস্তুর তৈরি নির্দিষ্ট পুরুত্বের ও নির্দিষ্ট প্রতিসরণাঙ্ক N বিশিষ্ট পাতের মধ্য দিয়ে যায়, তখন তার ফলাফল কী হয়?”
আলো স্যার আপতিত রশ্মির সমান্তরালে কিছুটা সরে গিয়ে বের হয়ে আসে স্যার।
“কতটুকু সরে যায় বলতে পারো?”
“আমাকে একটু হিসেব করে দেখতে হবে স্যার।” তো সে হিসেব করে বের করল প্রতিফলিত রশ্মি কতখানি সরে যাবে। সে ছিল একটু বেশিরকমেরই ভালো, আর তাতেই আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হল।
পরীক্ষা শেষ হলে পরে আমি তার কাছে গিয়ে বললাম যে আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হতে আসা অধ্যাপক, এবং আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই যা কোনভাবেই তার পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করবে না। আমি প্রশ্ন শুরু করলাম, “ডায়াম্যাগনেটিক বস্তুর কোন উদাহরণ বলতে পারবে?”
“না,” ছাত্রের সংক্ষিপ্ত জবাব।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, “যদি এই বইটি গ্লাসের তৈরি হত, এবং এর মধ্য দিয়ে আমি যদি টেবিলে রাখা কোন বস্তুর দিকে তাকাই, তাহলে গ্লাসটা কাত করলে বিম্বের অবস্থা কেমন হবে?”
“বিম্ব স্যার ঘুরে যাবে, যে কোণে বইটা ঘোরানো হয়েছে তার দ্বিগুণ কোণে।”
আমি বললাম, “তুমি ব্যাপারটা আয়নার সাথে ঘুলিয়ে ফেলনি ত?”
“না স্যার!”
পরীক্ষার সময় সে বলেছিল আলো সমান্তরালভাবে সরে যাবে, ফলে বিম্বও একপাশে সরে যাবে, কিন্তু কোন কোণে ঘুরবে না। সে এমনকি কতখানি সরবে তাও হিসেব করে বের করেছিল, কিন্তু সে এটা বোঝে না যে কাঁচের টুকরো নির্দিষ্ট প্রতিসরণাঙ্কের একটা সমান্তরাল প্রতিসারক তল, আর তার হিসেব আমার প্রশ্নের বেলায় খাটে।

প্রকৌশল স্কুলে আমি পদার্থবিজ্ঞানে গাণিতিক পদ্ধতির ব্যবহারের ওপর একটি কোর্স পড়িয়েছিলাম, যেখানে আমি তাদের শেখাতে চেষ্টা করেছিলাম কেমন করে ‘ঠ্যাক খেয়ে খেয়ে শেখা’ পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। এ ব্যাপারটা সাধারণত শেখানো হয় না, তাই আমি পাটীগণিতের সাধারণ কিছু সমস্যা সমাধান করিয়ে ব্যাপারটা বোঝাতে শুরু করি। কিন্তু আশি জনের মধ্যে মাত্র আটজন ছাত্র প্রথম বাড়ির কাজ জমা দেয়ায় আমি কিছুটা বিস্মিত হই। বাধ্য হয়ে আমাকে কেবল শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে সমস্যা সমাধানে সত্যিকারভাবে মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে একখানা বক্তৃতা ঝাড়তে হয়।
ক্লাস শেষ হলে পরে কয়েকজন ছাত্রের এক প্রতিনিধি দল আমার সাথে দেখা করে। তারা আমাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলল তার সারমর্ম দাঁড়ায় এমন: তাদের কতখানি পড়া আছে তা আমি জানি না, তারা সমস্যা সমাধান ছাড়াই পড়ালেখা করে অভ্যস্ত, তারা এর মধ্যেই পাটীগণিত করতে শিখেছে, এসব বাচ্চাদের জিনিসপত্র পড়ে কী লাভ, ইত্যাদি। তবে আমি ক্লাসে ঠিকই আমার মত করে পড়িয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু দিনে দিনে যতই জটিল বা উচ্চতর বিষয় পড়াতাম না কেন, ছাত্রদের দিয়ে অঙ্ক-টঙ্ক কিছুতেই সমাধান করানো যেত না। আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম আসল ব্যাপারটা কী: ঐ সমস্যাগুলোর সমাধান করা তাদের মুরোদে কুলোত না!
আর তাদের দিয়ে কখনোই আরেকটা জিনিস করানো যেত না, তা হল প্রশ্ন করা। অবশেষে একদিন এক ছাত্র আমাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করল: “যদি আমি ক্লাসের মাঝে কোন প্রশ্ন করি, তাহলে পরে সবাই বলবে, ‘তুই ব্যাটা ক্লাসে মাঝে শুধু শুধু আমাদের সময় নষ্ট করছিলিস কেন র‌্যা? আমরা সবাই এখানে একটা পানির মতন সোজা ব্যাপার বুঝছিলাম আর তুই মাঝখানে স্যারকে প্রশ্ন করে বাগড়া দিলি’।”
ব্যাপারটা ছিল এক ধরণের স্বার্থপরতা, যখন কেউই কিছু বুঝতে পারছে না তখন তারা আর কেউ প্রশ্ন করলে ভাব নেয় যে তাদের কাছে এর সবই জলবত তরলং। তারা ভান করে সব কিছু বুঝতে পারছে, তখন কেউ যদি এক মুহূর্তের জন্যেও স্বীকার করে সে কিছু একটা বোঝেনি এবং এ নিয়ে প্রশ্ন করে সেক্ষেত্রে অন্যরা তার দিকে বিদ্রূপপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেন এর কোন কিছুতেই কোন অস্পষ্টতা থাকতে পারে না, প্রশ্ন করে ঐ ব্যাটা কেবল তাদের মূল্যবান সময়ের শ্রাদ্ধ ঘটাচ্ছে।

________________________________________________
চতুর্বর্গ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সিরিজটা দারুণ লাগছে

বইখাতা এর ছবি

দারুণ মজার। লেখাপড়া করার ব্রাজিলীয় তরিকার সাথে বাংলাদেশী তরিকার ব্যাপক মিল আছে!

অতিথি লেখক এর ছবি

সেইরকম মিল। ভাবছি ব্রাজিল যাব পড়ালেখা করতে, মানিয়ে নিতে তাহলে কোন সমস্যাই হবে না। আর ব্রাজিলের সমুদ্রসৈকত তো আছেই, ও কথা ভাবতেই....
________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। জানিয়ে গেলাম...

_________________________________________

সেরিওজা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সুহান ভাই, আশা করি আরও কয়েক পর্ব পর্যন্ত আপনার এই আগ্রহ (ধৈর্য্য হলেও চলবে) বজায় থাকবে হাসি
________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'।

অদ্রোহ এর ছবি

অনুবাদ উমদা হয়েছে বৈকি, খই ভাজা দেখি ভালই চলছে, অ্যাঁ হাসি...

--------------------------------------------

আজি দুঃখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী
তোমার অভয় বাজে হৃদয় মাঝে হৃদয় হরণী।

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি ভাই। খই ভাইজ্যা সব ধান শেষ কইরা ফালামু ঠিক্কর্সি। দোয়া রাইখেন দেঁতো হাসি
________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'

নিবিড় এর ছবি

ক্লাসের বর্ণনার অংশে এসে মনে হচ্ছিল এইটা তো আমাদের ক্লাসের গল্প কিন্তু ব্যাটা ফাইনম্যান জানল কেমনে খাইছে


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

অতিথি লেখক এর ছবি

সেকি নিবির্ভাই, এই গল্প তো আমার ক্লাসেও কমন পইড়া গ্যাসে। ফাইনম্যান ব্যাটা এইসব কেম্নে জানল, বড়োই রহস্যজনক ব্যাপার চিন্তিত , তাই না?
________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আচ্ছা ব্রাজিল কি বাংলাদেশের কোনো জেলার নাম? নয়তো পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতি আর শিক্ষার্থীদের আচরণ এতো পরিচিত লাগছে কেন?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

অতীতের ব্রাজিল-বর্তমানের বাংলাদেশে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সামনের পর্বে আরো কিছু মিলের মালা গাঁথা হইবেক...

________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'

আনাম এর ছবি

চলুক চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

কী চলবে ভাই? আপনের বামহাত না কি? খাইছে
________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'।

রায়হান আবীর এর ছবি

ট্রায়াল এণ্ড এরর এর বাংলা ঠ্যাক খেয়ে শিখা। আপনি নিজেও তো ফাইনম্যান লেভেলের জোকার। অনুবাদ চলতেই থাকুক ... সুপার হচ্ছে, আর বইটার বিষয়বস্তুও তো দারুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ছাগু নালায়েকের ফার্স্ট নেম ধইরা আমারে ডাক্লেন মন খারাপ ? কেম্নে কী??

________________________________________________
চতুর্বর্গ
- - - - -
ভাবছ ঘুরছি তোমার পিছে, জপছি তোমার নাম?
খেয়ে দেয়েও ভাই আমার আছে করার অনেক 'কাম'।

রায়হান আবীর এর ছবি

ওহ থুক্কু! সাধুবাদ দিতে গিয়া গালি দিয়া ফেলছি দেঁতো হাসি

আপনি হইলেন "রসিক" ...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হো হো হো

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সাইফ তাহসিন এর ছবি

অনুবাদ পড়ে পাণ্ডবদার সাথে একমত
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

তৌফিক হাসান [অতিথি] এর ছবি

২য় পর্বও ভাল লাগল। সত্যি বলতে কি আগের পর্বের চেয়েও বেশি ভাল লাগল এই পর্বটা। অনুবাদ খুব ভাল হইসে। চালিয়ে যান।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।