যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি
লিখেছেন সুমিমা ইয়াসমিন [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৪/০৫/২০১১ - ২:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুনিয়ার ডিভোর্সের খবরটা শুনে আমি বেশ একটা ধাক্কা খাই। প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা ঠাট্টা। ঠাট্টা বটে, নিয়তির নির্মম ঠাট্টা! মুনিয়ার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো বাড়ির গেটের কাছে। বিকেলে আমি বাসা থেকে বেরুতাম অফিসের উদ্দেশ্যে আর মুনিয়া তখন অফিস থেকে ফিরতো বাসায়। টুকটাক কথা হতো। প্রতিবেশীসুলভ কুশল বিনিময়। যদিও আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, কিন্তু আমাদের প্রথম পরিচয় হয় এপার্টমেন্টের লিফটে। মুনিয়া তার স্বামী-সন্তান-পরিবার নিয়ে থাকতো আমাদের ওপরের তলায়। হাসিখুশি মেয়েটির প্রাণোচ্ছ্বলতা আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমাদের আলাপ-পরিচয়টা টুকটাক কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। একই এপার্টমেন্টে থেকেও কেউ কারো বাসায় যাবার সময় আমাদের হয় না। ইট-কাঠ-কংক্রিটের এই শহরে আমরা ক্রমশ নিরেট নিরস মানুষে পরিণত হচ্ছি। আমরা নিজের মাঝে নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে রাখি। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক মেলামেশার ঐতিহ্য!

সেদিন বিকেলে আমি অফিসে বসে কাজ করছিলাম। তখনই ফোনটা এল। মোবাইল ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার রিসিভ করতেই পরিচিত কন্ঠে মুনিয়ার কথা শুনি। খুব বিষন্ন কন্ঠে বললো, আমি চলে এসেছি মায়ের বাসায়। আমি কথাটার অর্থ বুঝে উঠতে পারি না। সপ্তাহখানেক আগে আমি মুনিয়ার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। ওর ফুটফুটে সুন্দর ছেলেটাকে দেখলাম, যার বয়স ছয়। ওর শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে পরিচয় হলো। হাজব্যান্ড কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললো, বিদেশে চাকরি করে। কথায় কথায় প্রেমের বিয়ে কি না জানতে চাইলে বললো, চার বছরের প্রেম, তারপর বিয়ে। এখন সাত বছরের সংসার।

সেই প্রথম মুনিয়ার সাথে আমার অনেক গল্প হলো। স্বভাবসুলভ হাসিখুশি ভঙ্গিতেই কথা বলছিল সে।
এই কদিনের মধ্যে কী এমন হলো যে মুনিয়া আজ বলছে, সে চলে গেছে! আমি বিষয়টা বুঝে উঠতে পারি না। বললাম, কী হয়েছে, ঠিক করে বলো তো? কদিন আগেই তো তোমার বাসায় গেলাম আমি। তখন তো সব ঠিকঠাক...।
মুনিয়া বললো, তুমি যখন বাসায় গিয়েছিলে, তখনই তো আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তখন আর তোমাকে কিছু বলি নি শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে। কিছুদিন আগে হঠাৎ খবর পাই, আমার হাজব্যান্ড আবার বিয়ে করেছে। তোমাকে বলেছিলাম, ও বিদেশে থাকে। হুম বিদেশেই চাকরি করছিল সে। সেখানে থাকতে কখন যে এক মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আমি জানতেই পারি নি! কয়েকমাস আগে দেশে ফিরে সে আলাদা সংসার শুরু করেছে ওই মেয়ের সাথে। পরে আমি খবর পেয়ে তার নতুন সংসার দেখে এসে বিষয়টা বিশ্বাস করেছি। আমার শ্বশুর শাশুড়ি অবশ্য ছেলের এই অন্যায় মেনে নেয় নি। তারা ছেলেকে ত্যাগ করেছেন, বাড়িতে জায়গা দেন নি। কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে! তারপরও আমি চেয়েছিলাম, সে আবার ফিরে আসুক আমার কাছে। কিন্তু সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ফিরবে না আমার কাছে। এতদিন শুধুমাত্র শ্বশুর-শাশুড়ির ইচ্ছায় তাদের ওখানে ছিলাম। তারা চাইছিলেন, আমাকে আর আমার ছেলেকে তাদের কাছে রেখে দিতে। কিন্তু আমি কেন থাকবো, কিসের অধিকারে থাকবো? যার সাথে আমার সম্পর্ক, সেটাই তো ভেঙে গেল। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে এলাম মায়ের বাসায়।

মুনিয়ার কথা শুনতে শুনতে তীব্র এক বিষন্নতা পেয়ে বসে আমাকে। আমি মুনিয়াকে বলি, তুমি শিক্ষিত একটা মেয়ে হয়ে কেন এর প্রতিবাদ করলে না? কেন তুমি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিলে না?
মুনিয়া বললো, অনেকেই আমাকে মামলা করতে বলেছিল। মামলা আমি করতেই পারতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে করলো না। মনে হচ্ছিল তাতে আমি আরো ছোট হতাম। কী হবে এসব করে? আমার জীবনটা কী আর কখনো আগের মত হবে! হবে না, আমি জানি। মামলা করলে বরং কোর্টে গিয়ে জেরার মুখে অনেক আজেবাজে কথা শুনতে বা বলতে হতো। আমি তা চাই নি। এমনিতেই অনেক অশান্তি আমার মনে। অশান্তি আর বাড়াতে চাই না। আমি চাকরি করি, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে চলতে পারবো। আমার সব চিন্তা আমার ছেলেকে নিয়ে। যে আমাকে ছেড়ে গেছে, তার কাছ থেকে টাকা আদায়ের বা জোর করে অধিকার আদায়ের কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমার কথা বাদ দিলাম, ছেলেটার কথাও তো সে একবার ভাবলো না!

মুনিয়া শিক্ষিত মেয়ে হয়েও আইনের আশ্রয় নিল না। এটা কী ঠিক হলো? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসিকতা কি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে না? শিক্ষিত সমাজে কোনো পুরুষ অন্যায় করে সহজে পার পেয়ে যায়। নারী নির্যাতনের যত মামলা হয়, তার বেশিরভাগ দরিদ্র অশিক্ষিত নারীদের। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষিত নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কম নয়। এইসব ক্ষেত্রে অশিক্ষিত নারী সহজে প্রতিবাদ করে, আর শিক্ষিত নারী সম্মানবোধের কথা চিন্তা করে চুপচাপ হজম করে যায়। বঞ্চিত বা নির্যাতিত দরিদ্র অশিক্ষিত নারী মামলা করে লড়ে যেতে সংকোচ বোধ করে না। তারা তথাকথিত সামাজিক সম্মানহানী কিংবা আত্মসম্মানবোধ বিসর্জনের ভয় করে না। আর এখন অনেক সামাজিক সংগঠন কাজ করছে দরিদ্র নারীদের আইনি সহায়তা দিতে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী এইসব সুবিধা থেকে দূরে। এই সুযোগে কিছু শিক্ষিত পুরুষ অন্যায় করে অবলীলায় পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের তো হারানোর কিছু নেই। মুনিয়ার মত শিক্ষিত একটা মেয়ে সংসার হারিয়েও চুপ করে থাকে, হারাতে চায় না আত্মসম্মান বোধ।

অফিসের কাজ সেরে আমি বাসায় ফিরি। কোনো কিছুতে মন বসে না। মুনিয়ার কথা ভাবতে থাকি। চার বছরের প্রেম, সাত বছরের সংসার--এগার বছরের বন্ধন এভাবে ছিঁড়ে যাওয়া কীভাবে সহ্য হয়! এগার বছর কাছাকাছি থেকেও একটা মানুষ আপন হয় না! তাহলে বন্ধনটা কিসে দৃঢ় হয়--কতদিনে স্থাপিত হয় বিশ্বাসের পূর্ণ মাত্রা--কতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের ভালোবাসা হয়!


মন্তব্য

ঘুম কুমার এর ছবি

কতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের ভালোবাসা হয়!

লেখাটা মন ছুঁয়ে গেছে। চলুক

-ঘুমকুমার

অপছন্দনীয় এর ছবি

মামলা করলে বরং কোর্টে গিয়ে জেরার মুখে অনেক আজেবাজে কথা শুনতে বা বলতে হতো।

এইসব ক্ষেত্রে অশিক্ষিত নারী সহজে প্রতিবাদ করে, আর শিক্ষিত নারী সম্মানবোধের কথা চিন্তা করে চুপচাপ হজম করে যায়। বঞ্চিত বা নির্যাতিত দরিদ্র অশিক্ষিত নারী মামলা করে লড়ে যেতে সংকোচ বোধ করে না। তারা তথাকথিত সামাজিক সম্মানহানী কিংবা আত্মসম্মানবোধ বিসর্জনের ভয় করে না। আর এখন অনেক সামাজিক সংগঠন কাজ করছে দরিদ্র নারীদের আইনি সহায়তা দিতে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী এইসব সুবিধা থেকে দূরে। এই সুযোগে কিছু শিক্ষিত পুরুষ অন্যায় করে অবলীলায় পার পেয়ে যাচ্ছে।

ঠিক। তবে আইনী সহায়তার আগে দরকার মননশীলতার পরিবর্তন। প্রচলিত আইনেরও পরিবর্তন প্রয়োজন, এক সাথে একাধিক বিয়ে চৌদ্দশ বছর আগে দরকার ছিলো কিনা জানি না, তবে এখন লুচ্চামো ছাড়া আর কোন কাজে এটার কোন দরকার আছে কি?

নিজের জীবন থেকেই এই ব্যাপারের অভিজ্ঞতা আছে আমার। আমি নিজে আইনের সহায়তা নেইনি আমার মায়ের কারণে, দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে বুড়ো আঙুলটা উলটো করে দেখিয়ে চলার শক্তি আমার নিজের থাকলেও এই ক্ষেত্রে তাকে রক্ষা করতে পারতাম না আমি। প্রত্যাশিত রীতিমতে আমি যে নিজের জীবনের এই ঘটনা লুকিয়ে চলি না সেটা নিয়েও অনেকে কথা শোনাতে এসেছে এ পর্যন্ত। আর ঈশ্বরের দয়ায় উপদেশ খয়রাত করার মানুষের কোন অভাব আমাদের কোন কালেই নেই।

আইনের রাস্তায়ও কি খুব বেশি কিছু করার আছে বাংলাদেশে? পারিবারিক আইনে তো ধর্মীয় মূল্যবোধের সমর্থনে 'অনুমতি সাপেক্ষে' দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ, অনুমতি যে সাক্ষী রেখে নিতে হবে এটাও কোথাও বলা নেই, কাজেই ঠাট্টাচ্ছলে কেউ অনুমতি নিলেও সেটা অনুমতি হবে না এমন কোন কথা নেই। আইয়ুব খানের সেই ৬১ না কোন আমলের নিয়ম মেনে একটা কাউন্সিলের কথা বলা আছে, সেটাও বাধ্যতামূলক নয়। আইনের সাহায্য নিয়েও আসলে খুব বেশি কিছু করার সাধ্য ছিলো না আমার।

রানা মেহের এর ছবি

আপনি নিয়মিত লেখেন না করন সুমিমা?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

কৌস্তুভ এর ছবি

সহমত। শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত দুধরনের মহিলাকেই এই সমাজের সঙ্কোচটা কাটিয়ে উঠতে হবে? কিসের সমাজ? যে সমাজ এই কাজ করার জন্য ছেলেটিকে কোনো নিন্দা করে না, মহিলাটিকে কোনো সহযোগিতা করে না, কিসের পরোয়া সেই সমাজের?

আয়নামতি1 এর ছবি

মন খারাপ মন খারাপ

তিথীডোর এর ছবি

তাহলে বন্ধনটা কিসে দৃঢ় হয়--কতদিনে স্থাপিত হয় বিশ্বাসের পূর্ণ মাত্রা--কতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের ভালোবাসা হয়!

চলুক
''ভালবাসা আসলেতে পিটুইটারির খেলা, আমরা বোকারা বলি প্রেম।''
চোখের সামনে দেখা এমন এক ঘটনা নিয়ে একটা পোস্ট লিখেছিলাম:-- শহরবন্দী মেঘ আর জলপাই সবুজ স্কুটার ..

নিয়মিত লেখা চাই। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হুমম...

hanzala এর ছবি

ভালো লাগলো।

মৌরী এর ছবি

সত্যিই "কতটা ভালোবাসলে ভালোবাসা হয়"!!!!

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

ভাল লাগল লেখাটা।

বন্ধনটা কিসে দৃঢ় হয়--কতদিনে স্থাপিত হয় বিশ্বাসের পূর্ণ মাত্রা--কতটা ভালোবাসলে সত্যিকারের ভালোবাসা হয়!

ভালবাসা আসলেই কি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে নাকি একধরণের অভ্যস্ততার কারণে মানুষ শেষ পর্যন্ত অভিনয় চালিয়ে যায় বুঝতে পারি না।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

রক্তের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক যখন ছিন্ন হয়, সময় তখন সত্যি থমকে থাকে। তখন দরকার অদম্য মনের জোর, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য। খুব খুব ভালো লেগেছে আপনার লেখ। আশা করি আরো লেখা পাবো ভবিষ্যতে।

নজমুল আলবাব এর ছবি

এইসব লেখা পড়া যায়, বুঝাও যায়, কিন্তু বলার কিছু থাকে না।

আপনি নিয়মিত লিখছেন না কেনো?

sumima yasmin এর ছবি

সবাইকে ধন্যবাদ

নাশতারান এর ছবি

মুনিয়া অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। স্বামী দীর্ঘদিন ধরে দূরে আছেন, সেখানে অন্য কাউকে ভালো লেগে গেছে। মুনিয়ার মতো শিক্ষিত আত্মমর্যাদাসম্পণ্ণ মেয়ের সতীন মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কাজেই বিবাহবিচ্ছেদ এখানে অবধারিত। মানসিক ক্ষয়ক্ষতিটুকুই অপূরণীয়। তবে একইভাবে মুনিয়া যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে নিত, তাতে বিবাহবিচ্ছেদেই সব চুকেবুকে যেত না। এর গঞ্জনা মুনিয়া আর তার সন্তানকে বয়ে বেড়াতে হতো। "স্বামী ছেড়ে গেছে" বলে এখনো নিশ্চয়ই গঞ্জনা সইতে হয় মুনিয়াকে। আমাদের সমাজে অপরাধ যে-ই করুক না কেন, কাঠগড়ায় মেয়েটাকেই দাঁড় করানো হয়।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

কদিন আগে মুনিয়ার বিয়ে হয়েছে প্রবাসী এক পাত্রের সাথে, পারিবারিক পছন্দে। ডিভোর্সের পর মুনিয়াকে যত যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা সত্যি অসহনীয়। পারিবারিক-সামাজিক গঞ্জনা তো আছেই, তার ওপর মুনিয়ার একাকীত্বের সুযোগ নিতে চাইতো অনেকেই নোংরাভাবে। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় বিয়ের কথা যখন চিন্তা করলো, দেখা গেল মুনিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হলেও তার ছেলেকে গ্রহণ করতে রাজি হয় না পাত্রপক্ষ। অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল, যিনি মুনিয়ার সন্তানকে সাদরে গ্রহণ করতে রাজি হলেন। মুনিয়া বলছিল, যদি বিয়ে না করে থাকা সম্ভব হতো, আমি কখনোই দ্বিতিয়বার বিয়ের কথা চিন্তা করতাম না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।