চান্দেরনগর ও দাক্ষিণাত্য - ২

সত্যপীর এর ছবি
লিখেছেন সত্যপীর (তারিখ: সোম, ২৬/১২/২০১১ - ৩:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব এখানে
...........................
ভারতে ফরাসী উপনিবেশ নিয়ে ১৮৯৩ সালে জর্জ ব্রুস মালেসন লিখিত "History of the French in India, from the founding of Pondichery in 1674 to the capture of that place in 1761"প্রকাশিত হয়। ইংরেজ সরকারী অফিসারের লিখা ফরাসী উপনিবেশের গল্প কতখানি সত্যি সে বিতর্কে যাচ্ছি না, দেখি পড়ে ভদ্রলোক কি বলতে চায়। নিচের লেখাটি বইয়ের একাদশ পরিচ্ছেদের ভাবানুবাদের শেষাংশ।
...........................

ক্লাইভ চান্দেরনগর প্রধান রেনের কাছে পত্রপাঠ দূত চেয়ে পাঠালেন সন্ধিপত্রের মুসাবিদা করার জন্যে। ফরাসী দূতের দল এলো, সন্ধির দলিলও লিখা হল, কিন্তু ক্লাইভ আর ওয়াটসন সই না করে একটু সময় নিলেন। একথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে ক্লাইভ ফরাসীদের সন্ধিপ্রস্তাবে রাজী হয় যাতে তারা নবাবের সাথে মিলে ইংরেজ খেদানোর ধান্দা না করে, কিন্তু এদিকে চৌঠা ফেব্রুয়ারী কোলকাতার কাছে নবাব বাহিনীকে পিটিয়ে তক্তা বানানোর পরে তার মাথায় আবার দুষ্টবুদ্ধি চাড়া দিয়ে ওঠে। নবাব যদি আর বিরক্ত না করে তাহলে ফরাসী সন্ধিতে সই করার গুষ্টি কিলিয়ে চান্দেরনগর গুঁড়িয়ে দিলেই তো হয়!

ক্লাইভ বোকা নয়, ইংরেজ একা চান্দেরনগর দখল করার সামর্থ্য রাখে কিনা তা নিয়ে তার সংশয় ছিলো। কোলকাতায় ফরাসী দুতদের কোপ্তা কালিয়া খাওয়ায় ব্যস্ত রেখে সে নবাবের কাছে খবরে পাঠালো যে সে তাদের সাথে চান্দেরনগর আক্রমন করতে রাজী কিনা।

নবাব রাজী হলেননা। সুতরাং মনের ইচ্ছা মনেই রেখে ক্লাইভ চুক্তি সই করতে গেলেন। এক নতুন সমস্যা দেখা দিল এবার, ওয়াটসন চুক্তির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। ইংরেজ ভারতের শাসকের সাথে জাতীয় চুক্তি করতে হবে ফরাসী ভারতের শাসকের, তারা বাস করে পন্ডিচেরিতে। চান্দেরনগর পন্ডিচেরীর অধীনস্থ মিউনিসিপ্যালিটি বই কিছু নয়, তারা প্রটোকলে ইংরেজের সাথে সন্ধি প্রস্তাব দিতে পারেনা। ক্লাইভ অতোটা তলিয়ে দেখেনি, চিন্তায় পড়ে সন্ধিতে সই করবে না চান্দেরনগর আক্রমন করবে ঠিক ধরতে পারছিলো না সে।

সমস্যার সমাধান আপনি এসে হাজির হলো, সম্পূর্ন অন্যদিক থেকে। নবাবের কাছে খবর এলো আহমেদ শা আবদালী দিল্লী দখল করে নিয়েছেন। আফগানী সৈন্য বাংলায় ঢুকবে এই ভয়ে নবাব ক্লাইভকে মাসে এক লাখ রুপী দেয়ার প্রস্তাব করলেন আফগান ঠেকিয়ে রাখার সাহায্যের বিনিময়ে। দুদিন বাদে ক্লাইভের কাছে খবর আসলো তিনটে ইংরেজ জাহাজে করে তিন কোম্পানী পদাতিক আর এক কোম্পানী গোলন্দাজ বাহিনী আসছে। নবাব টাকা নিয়ে রেডি আবার রিইনফোর্সমেন্ট ও হাজির, এইবার ক্লাইভকে ঠেকায় কেডা?

এদিকে রেনে সাহেব কয়দিন আগে দূতের মুখে ইংরেজদের সন্ধিপত্রে সই করতে রাজি হওয়ার খবর শুনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, সেই অপদার্থ দূতের দলই আবার যখন ইংরেজদের চান্দেরনগর আক্রমন করার খবর নিয়ে আসলো তখন তার বিস্ময়ের অবধি রইল না। দ্রুত রেনে পন্ডিচেরিতে সাহায্যের আবেদন পাঠিয়ে রণসজ্জায় মন দিলেন। শহরের মূল দূর্গ, ফোর্ট দ্য'অরলিয়ঁ, ঠিক নদীর কূলে সকল সীমান্ত থেকে সমান দূরত্বে স্থাপিত। দূর্গের ভেতরে উঁচু সমতলে অবস্থিত গীর্জা সরিয়ে সেখানে ছয়টি কামানের গোলন্দাজ ইউনিট বসানো হল। বাইরে খাড়া নেমে যাওয়া খাদ তৈরির কাজ চলছিলো আগে থেকেই, খাদ পেরিয়ে বসানো ছিলো আরও কয়টি কামান ইউনিট। আগেই যেমন বলেছি, গ্যারিসনে ১৪৬ ইয়োরোপীয় আর ৩০০ নেটিভ সৈনিক মজুত ছিলো, আরও শতিনেক ইয়োরোপীয় সৈন্য যোগাড় করা হল স্থানীয় লোকজন আর নাবিক থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যাপ্টেন দ্য ভ্যঁ, ফরাসী একটি জাহাজের কমান্ডার। দ্য ভ্যঁ দূর্গের বহির্ভাগের স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন।

কিন্তু শুধু দূর্গের কামান তাক করে রেনে মুড়ি ভাজছিলেননা, দূর্গের অদূরে হুগলী নদীর কথাও তার মাথায় ছিলো। ভারী মালবাহী জাহাজ নিয়ে সেখানে ঢোকা খুব সহজ ছিলো না, শুধু দেড়শ গজ দুরে একটা নির্দিষ্ট চ্যানেল দিয়ে নৌচলাচল হত। রেনে অর্ডার দিয়ে কয়টা জাহাজ ডুবিয়ে দিল সেই চ্যানেলে, ভারী জাহাজ পার হবার চেষ্টা দিলে যেনো তলায় ফাটল ধরে যায়। তেরেনো নামের এক গোলন্দাজ অফিসার এর তদারকীতে ছিলো।

৭০০ ইয়োরোপীয় আর ১৫০০ নেটিভ সৈন্য নিয়ে ইংরেজ হাওড়া থেকে যাত্রা করে, পেছনে চললো ১৫০ গোলন্দাজ সেনাবোঝাই ওয়াটসনের জাহাজ। ১৪ তারিখ ক্লাইভ পশ্চিম আর দক্ষিন চান্দেরনগর সীমান্তের কামান এড়িয়ে উত্তরে উঁচু রাস্তার পাশে অবস্থা নেয়। ছয়দিন পরে ২০ তারিখ ওয়াটসনের জাহাজ চ্যানেলের কাছে হাজির হল, কিন্তু তার জাহাজে ফাটল ধরেনি। ফরাসী গোলন্দাজ অফিসার তেরেনো রেনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজের সাথে হাত মিলায়, আর বলে দেয় ঠিক কিভাবে নদী পেরুলে জাহাজ অক্ষত থাকবে

জল ও স্থল দুই দিকেই কড়া আক্রমন চালিয়ে ফরাসীদের কাবু করে আনে ইংরেজ, তারা বাইরের কামান ছেড়ে সকলেই দূর্গের ভেতরে অবস্থান নেয়। কমান্ডার দ্য ভঁ'র অধীনে বেসামরিক লোকেরা ক্লাইভের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারছিলনা, অল্পসময় পরেই বোঝা যাচ্ছিল বৃথা চেষ্টা। রেনে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করল। কিছু সৈন্য পালিয়ে কাসিমবাজার চলে গিয়ে ল সাহেবের সাথে যোগ দেয়, ল নিজেও আত্মসমর্পণ না করে ভাগলপুর যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ল সাহেব দূর্বল ধরনের লোক ছিল, পরবর্তীতে ফরাসী ভারতের হয়ে লড়বার বদলে নেটিভ প্রিন্সদের হয়ে কাজ করে। পলাশীর যুদ্ধের সময় সে ভাগলপুরেই ছিল, যুদ্ধের সময় বা তার পর সিরাজউদ্দৌলা কে সাহায্য করার কথা সে ভাবেনি।

চান্দেরনগরের পতন ফরাসী ভারতের আধিপত্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ করে আনে। ক্লাইভ চান্দেরনগর গুঁড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু দ্যুপ্লে থাকলে তিনি নবাবের সাথে মিলে উল্টে ক্লাইভকেই শিক্ষা দিতেন। খুবই দুঃখজনক যে ফরাসী ভারতের এত বড় একটা দূর্যোগে পন্ডিচেরির অপদার্থ শাসকেরা চান্দেরনগর রক্ষার কোন উদ্যোগই নিলনা। ক্লাইভ ভারতের সবচাইতে ধনবান রাজ্য বাংলা দখল করে নিল, কোলকাতা থেকে এলাহাবাদ তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ রইলো না।
(শেষ)

সত্যপীর
eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%22%3e%6d%69%72%31%37%38%40%79%61%68%6f%6f%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))
.....................
ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুন লাকা মিনালে উলা
অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে ভবিষ্যত।

পাদটীকা

  • ১. মহান আফগান সম্রাট আহমেদ শা দুররানি, অনেকের মতে বর্তমান আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা
  • ২. তেরেনো এই কাজের জন্য অঢেল টাকা পেয়েছিলো যা পরে ফ্রান্সে তার পিতাকে পাঠায়। পিতা ছেলের কীর্তির কথা জানতে পেরে ঘৃণাভরে সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করে চিঠি পাঠায়। এই চিঠি তেরেনোর কাছে যাবার পর সে মনের দুঃখে নিজের ঘরে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

- ভালো লাগল। আরও লিখতে থাকুন।

ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুন লাকা মিনালে উলা

- এর মানে বুঝলাম না ? এর কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে - এই পোস্ট এর সাথে... ? উপরের লেখার সাথে তো কোন ভাবেই সম্পৃক্ত মনে হল না !!

 সত্যপীর এর ছবি

কোন প্রাসংগীকতা নেই, আরবী কোটেশনটা (মানে পরের লাইনেই দেয়া আছে) সিগনেচার বানাব ভাবছি। সবাই লিখার নিচে সুন্দর সুন্দর সিগনেচার দেয় আমারো দিতে মন চাইলো!

পড়বার জন্যে ধন্যবাদ।

তাপস শর্মা এর ছবি

ও আচ্ছা, সিগনেচার। হে হে ভালো কথা।

তয় কথা অইল আপনার সিগনেচার আপনি ভালো বুঝবেন। কিন্তু আমার একটু কেমন জানি লাগতেছে তাই একটু শেয়ার করে যাই। ভাইজান আমাগো বাংলা সাহিত্য কত সমৃদ্ধ , তাই না, অইখান থেইক্কা কোন লাইন খুইজা পাইলেন না ভাইডি। যে অত্ত দূরের অরাবি ভাষার থেকে ধার নিতে হল। ভাইয়া বুঝি খুব অরাবি ভালু পান। আহা, আমার বাঙলা ভাষা। শামসুর স্মরণে এলো - বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

সত্যপীর এর ছবি

নাহ ধুর আরবী ভাষার বুঝি কচু। লাইনটা সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে থেকে নেওয়া, ইতিহাস রিলেটেড তাই পাঞ্চ করলাম। সত্যপীর নামটাও আলী সাহেবের ছদ্মনাম।

বাংলা সাহিত্য আপনি আমি তো অনেক পড়লাম, মাঝে মধ্যে বাকি পাবলিক কি বলতে চায় সেটা দেখাও মন্দ না।

বেশি মন খারাপ কইরেন না ভাইডি, আমি ছুড মানুষ আমার সইসাবুদে কিবা আসে যায়!

তাপস শর্মা এর ছবি

এমা কি যে কন ভাইজান আমার মন খারাপ - এই কথা আপনারে কে কইল হে হে । হিপোক্রেট না অইয়া আমি তো আমার কিউরিসিটির জন্যই আপনারে প্রশ্ন করলাম। তাই বলে কি মন খারাপ করতে হবে ? আর ভাই আপনার সিগনেচার আপনি যা খুশি দেন তাতে আমার কি হে হে ...

আপনি অনেক পড়েছেন হে হে , আমি অনেক কম পড়েছি... অনেক অনেক বাকি আছে, পড়ছি, দেখি...হে হে । সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে - আমি পড়ি নাই । তাই উহা যে ঐ বিখ্যাত লাইনটা যে ইতিহাসের অংশ তা আমার মতো হতচ্ছাড়ার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় নাই। এমন একটা ঐতিহাসিক অরাবি লাইন যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে এতটা সমৃদ্ধি, গুণ, পরাক্রম এবং শক্তিদান করেছে তা আমার জানা ছিলনা। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে...

উপরেই তো বললেন অনেক বাংলা সাহিত্য আপনি অনেক পড়েছেন, ভাইজান এর পরও নিজেকে ছোড বলেন ক্যান ?

সত্যপীর এর ছবি

কিউরিওসিটি খুব ভালো জিনিষ, কৌতূহলের অপর নাম বুদ্ধিমত্তা।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

তারেক অণু এর ছবি

চান্দেরনগরই তো চন্দননগর, তাই না ! ফরাসিরা বলে স্যান্ডন নাগর।

সত্যপীর এর ছবি

ঠিক তাই। প্রথম পর্বে সেটা উল্লেখ করেছি দেখে এখানে আর লিখিনি।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
শাব্দিক এর ছবি

কোলকাতায় ফরাসী দুতদের কোপ্তা কালিয়া খাওয়ায় ব্যস্ত রেখে সে নবাবের কাছে খবরে পাঠালো যে সে তাদের সাথে চান্দেরনগর আক্রমন করতে রাজী কিনা।
নবাব রাজী হলেননা। সুতরাং মনের ইচ্ছা মনেই রেখে ক্লাইভ চুক্তি সই করতে গেলেন।

কি ডেঞ্জারাস লোকরে বাবা!

ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুন লাকা মিনালে উলা

নিশ্চয় !

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।