সঙ্গীত, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও একটি ভাবনা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০২/২০১২ - ১:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিনোদনের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল সঙ্গীত। একটা সময় সমাজের কতগুলো নির্দিষ্ট শ্রেণীতে সীমিত ভাবে আবদ্ধ থাকলেও প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান সময়ে সঙ্গীত হয়ে উঠেছে সব বয়সী সব শ্রেণীর মানুষের বিনোদনের প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। সঙ্গীতের গঠন, যন্ত্রব্যবহার, প্রকাশ ও উপস্থাপনরীতি দেশ, কাল এবং ভাষা ভেদে ভিন্ন হলেও সঙ্গীতের ভাব ও আবেগ মানুষের হৃদয়কোণে অনুপ্রবেশ করতে পারে খুব সহজেই। আর তাই শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত (প্রথাগত শিক্ষারীতি অনুযায়ী যাদেরকে অশিক্ষিত বলে আখ্যান দেয়া হয় !!) সব শ্রেণীর মানুষের সব সময়ের প্রাণের ভাষা এবং নিত্য বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হল সঙ্গীত। কবি'র কাব্যের ঝঙ্কার, লেখকের সুতীক্ষ্ণ লেখনী কিংবা শিল্পীর তুলির আঁচর যেখানে দাগ কাটতে পারে না, শুধুই প্রতিধ্বনিত হয়ে নির্বাক চেয়ে থাকে; সেখানে সঙ্গীতই একমাত্র রাজ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সুরের ঝঙ্কারে দাগ কেটে যায় দুর্গম হৃদয়কোণে।

আজকাল ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ছোট্ট অবসরে অন্যসব বিনোদন মাধ্যমের চেয়ে একমাত্র সঙ্গীতই দখল করে আছে ঈর্ষণীয় স্থান। এর প্রমাণ মেলে ঘর থেকে বের হলেই। চায়ের টঙ থেকে শুরু করে ব্যস্ত রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে কিংবা রিক্সায় অজস্র কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে নানা বয়সী নানা মানুষের কানে হেডফোনে ক্রমাগতই বেজে চলছে এই সঙ্গীত। কেউ কেউ আবার নিজে একা একা গান শুনে আনন্দ পাবার চেয়ে অন্যদের গান শুনিয়ে আনন্দ পান বেশী। আর তাই মাঝে মাঝে ব্যস্ত বাসে, ট্রেনে কিংবা চায়ের আড্ডায় লাউড-স্পিকারে গান শুনতে দেখা যায় কাউকে কাউকে।

প্রস্তরযুগের এ.এম রেডিও বিলুপ্তির ফলে এবং বর্তমান সময়ে এফ.এম রেডিও-র ক্রমবর্ধমান বিকাশ সঙ্গীতকে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌছে দিচ্ছে এক নিমিষেই। বর্তমান সময়ের প্রায় সব মোবাইল ফোনেই এফ.এম রিসিভার থাকায় প্রায় প্রতিটি এফ.এম রেডিও চ্যানেল তৈরী করেছে সঙ্গীত ভক্ত এক বিশাল শ্রোতা গোষ্ঠী এবং বিনোদন জগতে এর প্রকট প্রভাব সর্বত্রই দৃশ্যমান (উচ্চারণগত ভাষা বিভ্রাট সহ নানা অভিযোগ থাকলেও এফ.এম রেডিও সঙ্গীত পিপাসু অগণিত শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে)।

সঙ্গীতের এই জয়-জয়কারে এফ.এম রেডিও-র পাশাপাশি টেলিকম কোম্পানী এবং স্যাটেলাইট টিভির ভূমিকা ও অবদান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বীকার্য। প্রতিদিন পেপারে টেলিকম কোম্পানীর অজস্র বিজ্ঞাপনের মাঝে রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন কিংবা কলার টিউনের বিজ্ঞাপন সঙ্গীত জোয়ারের কিছুটা স্বাক্ষর বহন করে। এছাড়াও সাম্প্রতিককালে মুঠোফোনে অডিও সিডি রিলিজ শুরু হয়েছে (যদিও এই ইভেন্টটিতে শ্রোতা হিসেবে আমার যথাযথা অনীহা কিন্তু শিল্পীদেরও হয়ত এছাড়া আর করার কিছুই নেই ! ! !) সেই সাথে স্যাটেলাইট টিভি গুলোতে সঙ্গীতের লাইভ প্রোগ্রামগুলোও এনেছে ভিন্ন মাত্রার গতি (অবশ্য কতগুলো লাইভ মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত তা প্রশ্নবিদ্ধ)।

অন্যদিকে, এক একটি অ্যালবাম তৈরীতে থাকে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও যন্ত্রশিল্পীদের অনেক প্রত্যাশা ও যত্নের ছোঁয়া। সেই সাথে দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষার কষ্টে লালিত অনেক স্বপ্ন। শুধু তাই নয়, প্রায় সব শিল্পীই সঙ্গীতকে বেছে নেন একমাত্র জীবিকা হিসেবে। অ্যালবাম তৈরী হয়, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসে সেই অ্যালবাম বাজারজাত করেন। অ্যালবাম তৈরী থেকে শুরু করে সারা দেশের প্রায় প্রতিটি সিডির দোকানগুলোতে পৌছাতে খরচ হয় প্রচুর অর্থ। অথচ সেই অ্যালবাম প্রকাশের সাথে সাথেই চলে আসে ইন্টারনেটে। বাংলা মিউজিকের সব সাইটেই অ্যালবাম প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাওয়া যায় সেইসব অ্যালবাম। কোটি কোটি শ্রোতাদের ভিড়ে গুটিকয়েক(!!) ছাড়া কেউ অডিও সিডি কেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। অনেক সময় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মূলধন তোলাটাই কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠে। এটি যেমন অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় তেমনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও অনেক শিল্পীদের অ্যালবাম বাজারজাত করতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন।

একটি অ্যালবাম তৈরীতে গীত রচনা থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত সিডিটি সারাদেশে শ্রোতাদের হাতের নাগালে পৌছে দেয়া পর্যন্ত যেই বিশাল অংকের অর্থ খরচ হয়, সেটা শিল্পীর নিজের পক্ষে করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তাই অ্যালবামটি শ্রোতাদের কাছে পৌছে দিতে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প কিছুই নেই। এখন যদি এমনটি ঘটতেই থাকে যে, অ্যালবাম বাজারজাত করে মুনাফা-তো দূরের কথা, মূলধন উঠে আসা-টাই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায় তবে সঙ্গীতের জোয়ার অচিরেই থেমে গিয়ে সেখানে গুণপোকাদের সঙ্গীতে রাজ্যের স্থবিরতা নেমে আসবে সঙ্গীতের ভুবনে।

হয়ত অনেকেই প্রশ্ন করবেনঃ তাহলে শত শত অ্যালবাম কিনে শোনা কি সম্ভব?

আমি বলব, অবশ্যই না। আপনার একার পক্ষে সকল শিল্পীদের অ্যালবাম কিনে শোনা একেবারের অসম্ভব (আপনি যদি সমর্থ হয়ে থাকেন তবুও হয়ত আপনি সব কটি অ্যালবাম কিনবেন না)। তাছাড়া সব শিল্পীদের গান আপনার কাছে ভাল লাগবে এমনটি ভাবারও কোন কারণ নেই।

তবে আমি মনে করি, যেহেতু আপনি সঙ্গীত পিয়াসী একজন মানুষ এবং নিয়মিত গান শোনেন, তাই ধরেই নিচ্ছি গুটিকয়েক শিল্পী আছেন যাদেরকে আপনি খুবই পছন্দ করেন। যাদের গান আপনার চিত্তকে বিনোদিত করে নিত্য নিয়ত। আপনি শুধু তাদের সিডিগুলোই কিনুন। মাঝে মাঝে একটি দুটি বিশেষ গান আপনার মনকে ছুঁয়ে গেলে, চেষ্টা করুন ঐ অ্যালবামটি কিনে অরিজিনাল রিপ (Original Rip/Best Sound Quality) শুনতে। আমি নিশ্চিত হাইয়েস্ট বিট রেট (Highest Bit Rate) এ রিপ করে নিলে চমৎকার সাউন্ড কোয়ালিটি আপনার মুগ্ধতা বাড়িয়ে দেবে দ্বিগুন। তাড়াছা ওয়েবসাইটে যেসব গান পাওয়া যায় তাদের প্রায় ৯০% ভাগই অতি নিম্ন মানের সাউন্ড কোয়ালিটি (Low Bit Rate) সম্পন্ন। তাই প্রতিটি গানেই যন্ত্রসঙ্গীতের যে অতি সূক্ষ্ণ কারুকার্য থাকে তা নিম্ন মানের সাউন্ড কোয়ালিটির জন্য অপ্রকাশ্যই থেকে যায়।

এছাড়াও সিডি কিনলে আপনার প্রিয় শিল্পীর চমৎকার সব গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম জানার মাধ্যমে শিল্পীর পাশাপাশি গীতিকার ও সুরকারের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়। প্রতিটি গান তৈরীতে শিল্পীর পাশাপাশি গীতিকার ও সুরকারের অবদান অনস্বীকার্য।

অডিও ক্যাসেটের যুগে যারা গান শুনতো তাদের প্রায় সবাই ক্যাসেট কিনে শুনতো। ক্যাসেটের ফিতায় লেগে থাকতো অসীম ভালবাসার প্রলেপ। ক্যাসেটের কাভারজুড়ে থাকতো ভালবাসার গাঁথুনি। প্রতিটি অ্যালবামের পেছনে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রশিল্পীদের খোঁজ কম বেশী সবাই রাখত। শিল্পীর পাশাপাশি গীতিকার ও সুরকারকে চেনার মাধ্যমে তাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শিত হত। সময়ের বিবর্তন এবং আধুনিক প্রযুক্তির উচ্চ ব্যবহার সঙ্গীতকে সহজলভ্য বিনোদনে পরিণত করেছে ঠিকই কিন্তু সঠিক মূল্যায়ন, ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে প্রতিভাবান জনপ্রিয় অনেক শিল্পীই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন।

এফ.এম রেডিও, স্যাটেলাইট টিভি, টেলিকম কোম্পানী, কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সহ অন্যন্য প্রযুক্তিপণ্য সঙ্গীতের অগ্রগতিকে ত্বরাণিত করেছে ঠিকই কিন্তু সঙ্গীত শিল্পীদের প্রতি শ্রোতাদের দায়বদ্ধতা, কর্তব্য ও করণীয় অন্যান্য দায়িত্ববোধের সচেতনতা তৈরীতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

মোখলেছুর রহমান সজল


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

ব্যক্তিগত ভাবনা শেয়ার করছি -

আমরা অনেকেই মুখে কপি রাইটের কথা বলি, পাইরেসি বন্ধের কথা বলি, কিন্তু নেট থেকে গান দেদারসে ডাউনলোড করি। দেশের অডিও শিল্পের অবস্থা কিন্তু সত্যিই খারাপ। দেশি শিল্পীদের কন্সার্ট ছাড়া অন্য কোন উপায়ে টাকা অর্জন করা খুব কঠিন। আর নামডাক না থাকলে ভাল কনসার্টে ডাক পাওয়া কঠিন। অগত্যা বড়লোকের গায়ে হলুদ বা এই জাতীয় অনুষ্ঠান করা ছাড়া অনেকের উপায় থাকে না।

কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। কনসার্টে, গায়ে হলুদে, সব ধরনের গান তো আর চলে না। একটু ধুম ধাড়াক্কা গান, ক্ষেত্র বিশেষে হিন্দি গান গাইতে হয়। সৃজনশিলতার সুযোগ কম। ইন্ডাস্ট্রি সাপোর্ট না পেলে শিল্পী জন্মানো কঠিন। এই কথাট শিল্পের যে কোন মাধ্যমের জন্যই সত্যি। চিত্রকলা প্রসঙ্গে দেখুন - অনেক চিত্রশিল্পীদের প্রায় না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছিল। বর্তমানে কমার্শিয়াল কাজের চাহিদা বেড়েছে, গ্রাফিক্স থুক্কু ভিজ্যুয়াল আর্টিস্টদের অবস্থা আগের চেয়ে ভাল।ত

কিন্তু সংগীতশিল্পীদের অবস্থা খুবই করুণ। ঢাকার বাইরে গেলে তা আরো স্পষ্ট। বংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল কখনোই ছিল না (শায়েস্তা খাঁ এর মিথ নিয়ে আকবর আলী খানের লেখা পড়ুন)। কিন্তু ভাদাইম্যা পোলাপানের অভাব হয় নাই। পেটে খিদা নিয়ে গান করার মত কঠিন কাজটাই জেলে, মাঝি, কৃষক, গাড়িয়াল, বাউল করে গিয়েছেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু এভাবে তো সবসময় চলতে পারে না।


সমাধান বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা:

স্বল্প মেয়াদী:

# পাইরেসি বন্ধে আসুন এক সাথে কাজ করি। আমি নিজে দেশি বাংলা পাইরেটেড সিডি কেনা বন্ধ করেছি। বন্ধ মানে বন্ধ - একদম লৌহকঠিন প্রতিজ্ঞা যাকে বলে। অরিজিনাল সিডি কিনতে প্রায় ৮০-১০০ টাকার মত লাগে। পাইরেটেড কপির চেয়ে হয়ত প্রায় ৫০ টাকা বেশি। কিন্তু সান্ত্বনা এই যে, অরিজিনাল সিডি বিক্রি হলে শিল্পী হয়ত কিছুটা লাভবান হবেন।

# বিদেশে থাকি। বাংলা গান শুনতে মন চায়। বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে গান ডাউনলোড করি। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে। নিজেকে চোর চোর মনে হয়। চোরই তো। এজন্য ডাউনলোড কমায় দিচ্ছি। এরপর আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিব। ইউটিউবে ভাল গান শুনলে আমরা যখন শেয়ার দেই, তখন দুই-এক লাইন লিখে অ্যালবাম কেনারও অনুরোধ জানাই।

# প্রিয়জনকে গানের সিডি উপহার দিন। হলমার্ক, আর্চিস এর কার্ডের থেকে গানের সিডি ভাল গিফট। দুইটারই দাম প্রায় এক।

# রেডিওতে বাংলা জনপ্রিয় গানের পাশাপাশি নিরীক্ষামূলক কাজ প্রচার করার আহবান জানাই। ফেইসবুকে কমিউনিটি রেডিওগুলোর কাজ শেয়ার দেই।

# গানের আসরে নামী শিল্পীর চেয়ে উঠতি শিল্পীদের দিকে নজর দিন। উঠতি প্রতিভাবান শিল্পিরা সময়মত আসবে, টাল-বাহানা কম করবে, জান দিয়ে চেষ্টা করবে ভাল পারফর্ম করার (ইন্সেন্টিভ বেশি)

দীর্ঘমেয়াদী:

# সরকার থেকে ই-কমার্স: পে প্যাল, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সহজ করা হোক। ব্যক্তিগত সাইটে বা কমিউনিটি সাইটে তখন অল্প পয়সায় অনলাইন ভার্সন ডাউনলোড করার সুযোগ থাকবে। সবাই না হলেও অনেকেই ভাল কোয়ালিটির জন্য পয়সা খরচ করবেন।

# কঠোর মনোভাব। কর্পোরেট কালচার, ভোগবাদী সংস্কৃতিকে দুইবেলা গালি দেওয়ার আগে নিজের consumption pattern নিয়ে সচেতন হই। ৫০-৬০ হাজার টাকার ক্যামেরা কিনতে পারি আর ১০০ টাকা দিয়ে সিডি কিনতে পারি না - আজিব!!

# শিল্পীদের নিজস্ব কমিউনিটির মধ্যে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। ঘুরে-ফিরে কয়েকজন লোকই দেখি চলচ্চিত্রের মিউজিক স্কোর করে! প্লে-ব্যাক, গ্রাফিক্স, সিনেমাটোগ্রফার, কোরিওগ্রফার সবাই মিলেঝুলে কাজ করা দরকার। গান-বাজনা নিয়ে কমিউনিটি সাইট, কমিউনিটি রেডিও, ভিডিও ব্লগ করা দরকার।

----

বেশ কিছুদিন আগে ফেইসবুকে এই বিষয়ে একটা নোট লিখেছিলাম। এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ঈষৎ পরিবর্তন করে মন্তব্য আকারে দিলাম।

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনার ব্যক্তিগত ও সুচিন্তিত ভাবনা শেয়ার করার জন্য।

আপনার মতামত গুলোর সাথে আমি নিজেও একমত।

একক ভাবে ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়ে পাইরেসি ঠেকানো যাবে এমনটি কখনোই সম্ভব নয়। শ্রোতাদের সচেতন করতে হবে। সেজন্য শিল্পী, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ও সরকার প্রশাসনসহ সচেতন শ্রোতাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। সিডি কিনে গান শোনার মানসিকতা তৈরী করতে হবে।

আমি মনে করি এফএম রেডিও, স্যাটেলাইট টিভি, টেলিকম কোম্পানীগুলোও পাইরেসির ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরীতে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে সঙ্গীত শিল্পীদের অবস্থা খুবই খারাপ। পাইরেসি বন্ধ না হলে এবং শ্রোতাদের ওরিজিনাল সিডি কিনে শোনার সদিচ্ছা তৈরী না হলে অচিরেই এর ভয়াবহতা সঙ্গীত ভুবনে স্থবিরতা এনে দেবে।

বেশ কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় বিনোদন পেইজে দেখেছিলাম, বাপ্পা দা (বাপ্পা মজুমদার - দলছুট) অ্যালবাম তৈরী করে বসে আছেন কিন্তু কোন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নেই সেই অ্যালবাম বাজারজাত করার জন্য। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।

হাসান এর ছবি

গানের সিডি বা ভাইনাল যে বইয়ের মতো সংগ্রহে রাখার জিনিষ এটা বিদেশে আসার আগে আমার মাথাতেই আসে নি। একটা অ্যালবামের সাথে তার প্রচ্ছদ, লাইনার নোটস, গানের কথা এমনকি প্রডাকশন টিমের নামধামও অনেক সময় মজার তথ্য দিতে পারে।

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ হাসান ভাই।

সহমতঃ

একটা অ্যালবামের সাথে তার প্রচ্ছদ, লাইনার নোটস, গানের কথা এমনকি প্রডাকশন টিমের নামধামও অনেক সময় মজার তথ্য দিতে পারে।

যখন ক্যাসেট কিনে গান শুনতাম তখন অতি যত্নে সাজিয়ে রাখা ক্যাসেটগুলোর দিকে তাকিয়ে বিভোরতায় মুগ্ধ হতাম। প্রচুর ক্যাসেট কিনতাম। ক্যাসেটের ফিতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্যাসেটের কাভার হাতে নিয়ে গান শুনতাম। কি যে আনন্দের সেই সব দিনগুলো। কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে পুরোনো ক্যাসেটের ধুলোবালি সরিয়ে প্রায় দুইশত ক্যাসেট উদ্ধার করতে পেরেছি। মাক্সিমামই হারিয়ে গেছে অযত্নে ও অবহেলায় - - -

অন্ত আফ্রাদ এর ছবি

অনেক অ্যালবামেরই সবগুলো গান শ্রোতাদের ভালো লাগে না। দেখা যায়, একটা অ্যালবামের একটা অথবা দুইটা গান শ্রোতাদের ভালো লাগছে। একটা গান শোনার জন্য অনেকেই পুরো গানের সিডিটা কিনতে চান না। আগে যখন ক্যাসেটে গান শুনতাম তখন একটা ক্যাসেটে কি কি গান আছে শোনার আগে জানতামই না। কেনার পর জানতাম কি কি গান আছে, কোন গানটা সবচে' ভালো। আর এখন সবাই আগে এফ এম এ গানটা শোনে, পরে ভালো লাগলে নেট থেকে ডাউনলোড করে।

একটা অ্যালবামের সবগুলো গানই একজনের মনে ধরবে,এইরকমটা আশা করাও অন্যায়। একজনের যেই গানটা ভালো লেগেছে,অন্যের সেই গানটা ভালো নাও লাগতে পারে। এই কারনেই একটা অ্যালবামে সব রকমের গানই থাকে। তাই একটা গান শোনার জন্য অনেকেই পুরো গানের সিডিটা কিনতে চান না।

আপনার লেখাটি ভালো লেগেছে। লেখা পড়ে কেউ সিডি কিনুক আর না কিনুক, সবাই অন্তত জানতে পারবে একটা অ্যালবাম তৈরির পেছনে কতো কষ্ট আর ভালবাসা লুকায়িত থাকে।

চলুক। চলুক

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ অন্ত আফ্রাদ।

আমি বলেছিঃ শ্রোতারা যেন অন্তত প্রিয় শিল্পীদের সিডি কিনে Original Sound Quality শুনেন। এতে করে যেমন শ্রোতার মুগ্ধতা বাড়বে তেমনি প্রিয় শিল্পীরাও কিছু পৃষ্ঠপোষকতা পাবে শ্রোতাদের মাধ্যমে।

শ্রোতা যদি সমর্থ হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই অরিজিনাল সিডি কিনে গান শোনা উচিত। এর মাধ্যমে শিল্পীর প্রতি শ্রোতা হিসেবে আপনার-আমার কর্তব্যও পালিত হবে।

সব ধাঁচের মিউজিক একজন শ্রোতার ভাল লাগবে কিংবা সব শিল্পীকেই একজন শ্রোতা নিজের অতি প্রিয় তালিকায় ঠায় দেবেন এমনটি আমি ভাবিনা, কোন সুস্থ মস্তিষ্ক ভাববে সেটাও আমি বিশ্বাস করি না। তার মানে অতি অল্প সংখ্যক শিল্পীই হয়ত একজন শ্রোতার প্রিয় তালিকায় উঠে আসবে। সেই অতি প্রিয় শিল্পীরাও প্রতি বছরেই অ্যালবাম প্রকাশ করেন না। আর একান্তই করলেও বছরে নিশ্চয়ই একটির বেশী নয়। তবে কেন অন্তত সেই প্রিয় শিল্পীর অরিজিনাল সিডি কিনে Original Sound Quality-র গান না শুনে ওয়েবসাইট থেকে Converted Low Bit Rate এর গান শুনে নিজের পকেটের ৫০ টাকা সঞ্চয় করবেন।

একটি অ্যালবামের সবকটি গানই ভাল লাগবে শ্রোতা হিসেবে আমি সেটা মনে করি না। হয়ত একটা সময় অ্যালবামের ১২টি গানই অনন্য ও চমৎকার শ্রুতি মধুর হত। কিন্তু বর্তমান সময়েও হবে না এমনটি মনে করারও অবশ্য কোন কারণ নেই (যদিও মানহীন এবং সৃজনশীল নয় এমন গানের অহেতুক ছড়াছড়ি চারিদিকে)। তাছাড়া একটি অ্যালবামে একটি গানও যদি অতি পছন্দের তালিকায় পৌছে যায় তবে কেন ৫০ টাকা খরচ করে সেই প্রিয় গানটি Highest Bit Rate এ রিপ করে Original Sound Quality শোনার মত লোভনীয় একটি সুযোগ শ্রোতা হিসেবে আপনি হাতছাড়া করবেন।

কত টাকা কত দিকে নিজের অজান্তেই খরচ করে ফেলেন অনেকেই। সেই সব অহেতুক খরচের কিছুটা বাঁচিয়ে ৫০ টাকা খরচ করে প্রিয় শিল্পী কিংবা প্রিয় একটি গানের জন্য পুরো একটি অ্যালবাম কেনা কি খুবই অসম্ভব কিংবা কষ্ট সাধ্য ? ? !

সব শিল্পীর সব সিডি কিনতে বলছি না, অন্তত নিজের প্রিয় শিল্পী কিংবা প্রিয় গানের সিডিটি কিনুন।

অন্ত আফ্রাদ এর ছবি

সেই অতি প্রিয় শিল্পীরাও প্রতি বছরেই অ্যালবাম প্রকাশ করেন না। আর একান্তই করলেও বছরে নিশ্চয়ই একটির বেশী নয়।

চলুক

হয়ত একটা সময় অ্যালবামের ১২টি গানই অনন্য ও চমৎকার শ্রুতি মধুর হত।

চলুক

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অন্ত আফ্রাদ।
ভাল থাকুন।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

অধিকাংশ প্রযোজনাপ্রতিষ্ঠানগুলো্ই বদ। ওরা নিজেদের প্রোডাক্ট বের করে পাশাপাশি অন্যের প্রোডাক্টের পাইরেটেড ভার্সন বের করে থাকে। অডিও প্রোডাকশন হাউসগুলোর নিজস্ব শোরুমগুলোতে যান, আমার কথার সত্যতা দেখতে পাবেন।

কিছুদিন আগে মিউজিশিয়ানদের একটা এ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছে। আমার পরামর্শ থাকবে যে মিউজিশিয়ানরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন সাথে নিয়ে গিয়ে এইসব শোরুম রেইড করুক। আর পাইরেটেড সিডি প্রকাশকদের মাজায় দড়ি বেঁধে টিভি ক্যামেরার সামনে হাজির করা হোক।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

ধন্যবাদ রাতঃস্মরণীয় ভাইয়া।
পোষ্টে আবারও আপনাকে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি।

১৯৯৮-'৯৯ এর দিকে জনপ্রিয় শিল্পীদের বেস্ট অব নামে অ্যালবাম ছাড়তে দেখেছি সাউন্ডটেক-কে। যদিও বেস্ট অব অ্যালবামে শিল্পীর জনপ্রিয় সব গানই সাউন্ডটেকের প্রযোজনায় ছিল না। সঙ্গীতা থেকেও এমন বেস্ট অব অ্যালবাম বের হয়েছিল। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ও সক্রিয় থেকেছে সেই আদিকাল হতেই। তবুও আমি মনেকরি শিল্পীরা একজোট হয়ে অন্তত নিজের প্রাপ্যটুকু আদায় করে নিতে সক্ষম হত। কিন্তু তা হয়নি বিচ্ছিন্নতার কারণে।

শিল্পীদের রয়্যালটির জন্য শিল্পীদেরকেই সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রোতাগোষ্ঠীও এতে ভূমিকা রাখতে পারত। তবে যেখানে শ্রোতাদের অডিও সিডি কিনে শিল্পীদের প্রাপ্য সন্মানীটুকু দেবার মত সচেতনতা নেই, সেখানে আরও একধাপ এগিয়ে শিল্পীদের স্বার্থ রক্ষায় সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে গিয়ে বাস্তবিক অর্থে অবদান রাখার কোন সম্ভাবনা নেই (তবে পূর্ণমাত্রার সচেতন শ্রোতা সংশ্লিষ্ট থেকে আমার মত আধা সচেতন মানুষগুলোকে পূর্ণ সচেতন হতে সহায়তা করতে পারে)।

সোলস, অর্থহীন, নেমেসিস এর সর্বশেষ অ্যালবামগুলোতে তাদের নিজেদের ব্যান্ডের নামে অডিও স্বত্বের উল্লেখ দেখেছি। যদিও এর আগে অ্যালবামের গানের স্বত্ব থাকত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নামে এবং শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হত। দেরীতে হলেও শুভবোধের জয় এসেছে।

বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশান (বামবা) ব্যান্ড মিউজিকের প্রসারে অবদান রাখলেও ব্যান্ড শিল্পীদের স্বার্থ রক্ষার্থে তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় নি। কেন এত আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েও দেশের শক্তিমান ব্যান্ডগুলোকে (সেইসব টপ ব্যান্ড যাদের ছাড়া একটি অ্যালবামের এক লক্ষ কপির দশ হাজারও বিক্রি হত না) সাথে নিয়ে ব্যান্ডগুলোর দুর্দান্ত দাপটের সময়েও বামবা কিছু করে উঠতে পারে নি? এই ব্যর্থতার দায়ভার বামবাকে মেনে নিতে হবে।

আমি মনে করি, বামবা যতটা সক্রিয় থেকে সঙ্গীতে ব্যান্ডের অবদানকে ত্বরান্বিত করার কথা ছিল, ততটা বামবা সক্রিয় থাকতে পারেনি, সক্রিয় থাকতে পারছে না (অবশ্যই বামবার ঐতিহাসিক কিছু কাজ রয়েছে, তবুও ........)

সর্বোপরি সঙ্গীতাঙ্গনে সুস্থধারা ফিরিয়ে আনতে শিল্পীগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করার পাশাপাশি সচেতন শ্রোতা গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্পীদেরকে তাদের ন্যায্যটুকু বুঝিয়ে দিলেও অডিও সিডি কিনে শোনার মত শ্রোতা না থাকলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।