এই দূরপরবাসে. . .

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৪/০৫/২০১২ - ৯:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বারান্দায় দাড়াতেই অলিভিয়ার চোখে চোখ পড়লো, একটু হাসি দিয়ে অন্যদিকে আমি তাকালাম। অলিভিয়া সুন্দর করে সিগারেট টানে,ফুসফুসে নিকোটিনের ধোয়াগুলো নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ছেড়ে দেয়,ওর এই শৈল্পিক সিগারেট টানার ভঙ্গি দেখে তখন মনেহয় সৃষ্টিকর্তা এই মেয়েটার জন্যই হয়তো সিগারেট নামক বস্তুটির উপাদান দিয়েছিল পৃথিবীতে!

চিন্তাগুলো অলিভিয়া থেকে সিগারেটকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে,বেশ বুঝতে পারছিলাম আমি । এই ভেবে পকেটে হাত দিয়ে মনে পড়লো গত ২সপ্তাহ ধরে আমি সিগারেট খাই না ।'খাই না' এই শব্দটা মাথায় আসতেই সিগারেটের তেষ্টা আরো একটু বেড়ে গেলো আমার!

বারান্দার দরজা লাগিয়ে রুমে ঢুকলাম । বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ৬ডিগ্রি সেলসিয়াস, তীব্র কুয়াশার সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি একদম স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া । জার্মানিতে চলে আসার পর এই বিচ্ছিরি আবহাওয়া গা সওয়া হয়ে গেছে আমার । বাংলাদেশের আবহাওয়া আজকাল ভীষন মিস্ করি এই বিরক্তিকর আবহাওয়া দেখতে দেখতে ।

ফোনটা তুলে নিয়ে কল দিতে যাব, মনে পড়লো ফোনের কার্ড নেই । চাকরি নেই, এ মাসে একটা জব খুব দরকার অথচ ব্যাংকে আছে মাত্র ৩০,০০০ ইউরো । যে কারণে আমার মত চেইনস্মোকারের গত ২সপ্তাহে সিগারেট খাওয়া বন্ধ ।
বিয়ারের গ্লাসটায় চুমুক দিতে দিতে ল্যাপি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম হঠাত্‍ তিন্নির ছবিটায় চোখে পড়লো । মেয়েটার চোখ অস্বাভাবিক সুন্দর কলেজের প্রথম দিন এই মেয়ের চোখ দেখে আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । ২টা বছর পর ওকে বলতে যাওয়ার আগে তিন্নির বিয়ে হয়ে গেলো, আর বলা হয়নি এই মেয়েকে আমি কতটা চাই!
তিন্নির কথা মনে পড়াতে বেশ খারাপ লাগতে শুরু করলো । ফেবুতে লগিন করে নটিফিকেশন চেক করতে লাগলাম বিষন্নতা দূর করার জন্য । ৭বছরের আগের কথা ভেবে আর কিইবা হবে!

"মনে পড়ে যায় কখনো পুরোনো তোমাকে
প্রতিটি কষ্ট মাখা দিনের ফাঁকে
হয়তো বদলে গেছো, হয়ে গেছো অচেনা তুমি
তবুও তোমাকেই ফিরে পেতে চাই দূরের আমি"

শীতের সাথে বিষন্নতা জেঁকে বসলো স্ট্যাটাসটা দেয়ার পর । ভালো লাগছে না আর কিছু,ইচ্ছে করছে চলে যাই । প্লেন ভাড়া থাকলে চলে যেতাম, মাকে মনে পড়ছে ।

আমার কেনো জানি হু হু করে কান্না চলে আসলো, এতবড় হয়ে যাওয়ার পরেও । মাকে দেখিনা কতদিন! আম্মু আগে আমার রুমে আসলে কত বিরক্ত হতাম, আজকাল মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে । কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । আজ কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাইনা, সেই গাঁজরের হালুয়া ।

আমার চোখ ভিজে আসতে থাকে । আম্মু তার সব গহনা বেঁচে টাকা দিয়ে এই ভিনদেশে পাঠালো, আজ মনে হয় কি এমন ক্ষতিটা হয়ে যেতো বাংলাদেশে থেকে গেলে! জায়নামাযে যে ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের জল পড়ে মার চোখ থেকে তা আমার জন্য, এতটা নিঃস্বার্থভাবে ক্যানো ভালোবাসে?

ছোটবোনটার কথা মনে পড়ে, দিনরাত আব্দার করতো এটা দে ওটা দে । ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার পর আমাকে দেখতে চাইছিলো, যেতে পারিনি । বোনটা সাড়ে ৩হাত মাটির নিচে চলে গেলো আমাকে না দেখে!

এই শহর আর ভালো লাগেনা, স্যাতস্যাতে আবহাওয়া, বাংলায় কথা না বলতে পারার কষ্ট, মায়ের হাতের রান্না এগুলো ছাড়া জীবনটা থেমে থাকে আমার । কেউ আর বলেনা, কোথায় বাবাটা আমার?

আমার যখন সবকিছু কনফার্ম হয়ে গেলো চলে আসার, বন্ধুরা দেখা করা বন্ধ করে দিলো । যাওয়ার আগের রাতে সজীব এসে, জড়ায় ধরে বলে, শালা ***** এতটা পাথর হলি যে আমাদের রেখে সাদা চামড়ার দেশে চলে যাবি?

চোখ মুছে বারান্দায় দাড়ালাম, গানটা ছেড়ে এসেছি ল্যাপটপে । চারিদিকে কুয়াশা । আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত্‍কার করে বলতে ইচ্ছে করলো,

মিসিং য়্যু মা, মিসিং য়্যু অল!

"এই দূর পরবাসে তারা গুনি আকাশে আকাশে
কাটে নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলো,
মাঝে মাঝে স্বপ্নের বেশে স্মৃতিরা এসে
আমাকে করে যায় বড় বেশি এলোমেলো ।

মনে পড়ে যায় বন্ধুদের আড্ডামুখর প্রহর
তুমুল উল্লাসে ভরা প্রিয় শহর,
সেখানে হয়তো সবাই ব্যস্ত মেলেনা সময়
তবু সেখানেই ফিরে যেতে চায় ফেরারী হৃদয় ।

এই একাকী জীবন ভালো লাগেনা আমার
প্রতিটি দিনের শেষে, প্রতিটি রাতের শেষে ।"

[আমার দূরপরবাসে থাকা মানুষ গুলোর জন্য অনেক বেশি খারাপ লাগে, । আমি ঠিক তুলে আনতে পারিনি গল্প পুরো ব্যাপারটা, চোখে পানি এসে পড়ছিলো । আমরা আমাদের কাছের মানুষগুলোর আশেপাশে থাকি,গলার রগ ফুলিয়ে মায়ের সাথে চিত্‍কার করি কিন্তু কখনো ভাবিনা এদের ছাড়া জীবনটা কিভাবে থেমে থাকে ।
প্রতিটা মুহূর্তে এরা তাদের পরিবার,বন্ধু, প্রেমিকা,স্মৃতিময় শহর ছেড়ে বহুদূরে থেকে যায় । নিজেকে রান্না করে খেতে হয়, একা একা ঈদ করতে হয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার কেউ থাকেনা । এরা তাদের কাছের মানুষগুলোকে রেখে এতটা দূরে থাকে! চাইলেও পহেলা বৈশাখে,বইমেলা অথবা বন্ধুদের গেটটুগেদার থাকতে পারেনা । শুধু নিজের কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখে বলে 'Best of Luck' ।

এই ছোট অখাদ্য গল্পটা তাদের উত্‍সর্গ করছি ।
আমরা হয়তো আপনাদের কষ্ট ছুয়ে দেখতে পারবোনা তবুও আমরা আছি, অসম্ভব মমতা নিয়ে কেউ না কেউ অবশ্যই আছে ।]

- দূর্বা জাহান

eval(unescape('%64%6f%63%75%6d%65%6e%74%2e%77%72%69%74%65%28%27%3c%61%20%68%72%65%66%3d%22%6d%61%69%6c%74%6f%3a%64%75%72%62%61%2e%67%68%61%73%68%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%22%3e%64%75%72%62%61%2e%67%68%61%73%68%40%67%6d%61%69%6c%2e%63%6f%6d%3c%2f%61%3e%27%29%3b'))


মন্তব্য

সৌরভ কবীর  এর ছবি

মন ছুঁয়ে যাবার মতো লেখা। চলুক

দূর্বা জাহান এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে হাসি

রংতুলি এর ছবি

চোখে পানি এসে গেলো যে, এটা কি লিখলেন! মন খারাপ

দূর্বা জাহান এর ছবি

থ্যাংকস, আসলে আমি আবেগটুকু কতটুকু তুলে আনতে পেরেছি জানিনা তবে আপনার ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ ।

সেলিম রেজা এর ছবি

লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো

ইয়াসির এর ছবি

আরেকটু সময় নিলে সম্ভবতঃ শেষ করতে পারতেন। যতটুকু লিখেছেন স্পর্শ করেছে চলুক

অমি_বন্যা এর ছবি

আমিও পরিবার ছেড়ে এই মুহূর্তে অনেক দূরে তাই আপনার প্রতিটি আবেগ , অনুভূতি আপনার মতো আমাকেও স্পর্শ করছে। অনেক ভালো লাগলো আপনার লেখা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখেছেন, চোখে পানি চলে আসার মত। মন খারাপ
কিন্তু ব্যাংকে ৩০,০০০ ইউরো থাকলে তো সিগারেট খাওয়া আর প্লেন ভাড়া নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা না। চোখ টিপি

কালো কাক এর ছবি

৩০,০০০ টাকা মনে করতে হবে হয়তো খাইছে

ছোট্ট গল্পটা ভালো লাগ্লো

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

৩০,০০০ ইউরো থাকলে আমি বসে বসে খাইতাম। সারাজীবন চাকুরি করেও এখানে ৩০,০০০ ইউরো জমাতে পারবো বলে বিশ্বাস হয় না।

বন্দনা এর ছবি

সবারি বুঝি মাঝেমধ্যে এই অসহ্য লাগা অনুভূতি হয়, আমার ও হয়, আপনার কষ্টটা আমার যেন তাই খুব চেনা। ভালো থাকবেন এই প্রত্যাশা রইলো।

শাহেদ  এর ছবি

দারুন লিখেছেন।একদম মনের কথা চলুক

শফকত  এর ছবি

এই সব লেখার কোন মানে হয়!? ধুর! দিলেনতো চোখে মেঘ জমিয়ে ।
-- শফকত

জুঁই মনি দাশ এর ছবি

যেখানে যুক্তি মুক্তি দেয় না অনুভবই সেখানে শেষ কথা। একাকিত্ব মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ, আমরা কি আসলে বুঝতে এই কস্টগুলো........

অচল এর ছবি

যেখানে যুক্তি মুক্তি দেয় না অনুভবই সেখানে শেষ কথা।

অসাধারণ অসাধারণ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
লেখা (গুড়)

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

চলুক

Amit এর ছবি

চলুক

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তিথীডোর এর ছবি

...এ পরবাসে রবে কে....? মন খারাপ

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেখা

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে কিন্তু ওই ৩০,০০০ ইউরো ........................।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।