লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইসঃ বিরোধের সাগরে একটি দ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১১/০৮/২০১৩ - ২:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকদিন একটা উপন্যাস টানা পড়ে শেষ করলাম- উইলিয়াম গোল্ডিং এর 'Lord of the Flies'। পড়তে পড়তে প্রথমত যেটা অনুভব করলাম সেটা হল সামাজিক বিজ্ঞানের (আরো বিশেষ করে বললে নৃবিজ্ঞানের) দীর্ঘ চার বছরের প্রশিক্ষণ আমার সাহিত্যপাঠের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধরণকে অনেকটাই পালটে দিয়েছে, হয়ত বলা যায় সমৃদ্ধও করেছে। আগে যখন পড়তাম তখন কেবল শব্দের খেলা, লেখার শৈলী, চরিত্রের নিরিখে গদ্যের মাহাত্ম্য অবলোকন করতাম, তারও আগে স্রেফ নাম না জানা অনুভূতির আলোড়নের উপভোগই ছিল সম্বল (এবং সেটাই বোধয় শ্রেয়তর ছিল)। তবে এবার অভিজ্ঞতাটা ছিল অন্যরকম।

কাহিনীটা আগে বলে নিই- অজানা এক দ্বীপে ঝড়ে উড়োজাহাজ ভেঙে আটকা পড়ে এক ঝাঁক ছেলে। কেন কোথায় তাদের গন্তব্য ছিল, এ নিয়ে বইয়ের কোথাও কিছু বলা নেই, উপন্যাসকে যা শুরু থেকেই এক অদ্ভুত ব্যাঞ্জনা প্রদান করে। র‍্যালফের শামুক গোছের (কঞ্চ) শিঙার ফুঁকায় হাজির হয় এসে সব ছেলের দল, তিন-চার বছরের শিশু থেকে (যাদের Littluns বলে সম্বোধন করা হয়) ১৩/১৪ বছরের কিশোর পর্যন্ত (Bigguns)। র‍্যালফ ও পিগির কথায় সংঘবদ্ধ হয় ছেলের দল- তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় আশ্রয়স্থল তৈরী আর দ্বীপ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আগুনের ধোয়ায় সিগন্যাল তৈরী। র‍্যালফকে নির্বাচন করা হয় নেতা, শিঙার মালিক হিসেবে আর জ্যাককে শিকারী-সর্দার। প্রত্যন্ত দ্বীপে বয়স্কদের শাসনবিহীন নিসর্গে প্রথমে নিজেদের আবিষ্কার করে ছেলেরা। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু এক অশুভ মোড় নিতে থাকে... র‍্যালফ ও জ্যাকের মধ্যে দেখা দেয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব- বরাহ-শিকারের স্বপ্নে বিভোর জ্যাক ভুলে যায় সভ্যতায় ফেরার আকাঙ্খা। এদিকে পিগি ও র‍্যালফ চায় বাড়ি ফিরতে, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় এক অজানা তৃতীয় শক্তি- The Beast. কিন্তু ছেলেরা জানে না, অন্ধকারের এই অজানা জীব লুকিয়ে আছে তাদের মাঝেই... ইংরেজি সাহিত্য ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত গোল্ডিং বইয়ে খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন- সভ্যতা/ বন্যতা, মানুষ/ পশু, আলো/ আঁধার- এই বৈপরিত্য গুলো। বইতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় সভ্যতার ঠুনকো খোলস, গল্প যতই পরিণতির দিকে ঠেলতে থাকে ততই মনে জাঁক হয়ে বসে এক ঘোর অমানিশা-- এই বুঝি সকল নিয়ম গুলো আপন মহিমা হারিয়ে ধুলিস্যাত হল, মনুষ্যত্ব ভুলে একে অন্যের ওপর মাংস-লিপ্সু জন্তুর মত চড়াও হল ছেলেগুলো। গল্পের অন্তিম ম্যাসেজ যেন হয়ে দাঁড়ায় সেই সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট, যার অভাবে মানুষ পতিত হয় পশুর শ্রেণীতে। কিন্তু এর মাঝেই বড় হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা-সম্পর্ক, যার টানাপোড়েনে তলিয়ে যায় যুক্তি ও বাস্তবজ্ঞান। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলায় ভুলুন্ঠিত হয় তথাকথিত সভ্যতা ও মানবতার বাণী।

বইটিতে নৃবিজ্ঞানীদের জন্য চিন্তার খোরাক আছে সন্দেহ নেই। উপন্যাসে 'বন্যতা'কে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা নৃবিজ্ঞানী মাত্রেই শিশুসুলভ মনে হবে, তবে বইটা শিশুদের নিয়েই বটে! বন্যতা (Savegery) প্রত্যয়টা ব্যবহার হয়েছে একেবারেই সংকীর্ণ অর্থে- Tribal হওয়া মানে যেন গায়ে রঙ মেখে সং সেজে আগুন জ্বালিয়ে হল্লা করা, একটা রিচুয়াল পালন করা। Tribal হওয়া মানে কোন নিয়ম না মানা, বরাহ শিকারের পরে উল্লাসে ফেটে পড়া, যুক্তি-চিন্তা-বহির্ভূত জীবন যাপন করা। তবে যেহেতু এই প্রপঞ্চগুলো ঘটে শিশুদেরই মধ্য দিয়ে এগুলো হয়ে পড়ে যেন দ্বি-পরত বিশিষ্ট। সভ্যতা ও বন্যতা নিয়ে যে প্রচলিত ধারণা সে অনুযায়ীই পরিচালিত হয় ছেলেগুলো, সুতরাং তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক করে তোলার চেষ্টাও এখানে প্রত্যক্ষ নয়।

'অন্যতা'র ধারণাও এখানে সুস্পষ্ট, জ্যাক Tribe গঠন করলে একা হয়ে যায় র‍্যালফের গ্যাং। দু' দলের সংঘর্ষে মূর্ত হয়ে ওঠে মাঝের দূরত্ব- একে অপরকে 'অন্য' হিসেবে আবিষ্কার করলে নির্দ্বিধায় নামিয়ে দেয় ক্রোধের বর্শা, ভুলে যায় ক'দিন আগেও একই নারকেলের জল পান করেছে একসাথে। আরো আছে দিন/রাত্রি, পার্থিব/অপার্থিব জগতের দ্বিবিভাজন- প্রথমটি সবসময়ই দ্বিতীয়টির অপেক্ষা শ্রেয়তর। রাত্রির অন্ধকারে চলতশক্তি হারায় আতংকে মুমূর্ষু র‍্যালফ, রাতের অন্ধকার অজানা দানবের থেকে স্বস্তিদায়ক মনে হয় রজারের হাতের দুই-মাথা তীক্ষ্ণ বর্শাও।

মানুষ ও সমাজকে নতুন করে (কিংবা পুরনো ধাঁচেই নতুন করে ভাবায়) চেনায় নোবেল-বিজয়ী লেখকের এই সুপরিচিত উপন্যাস "Lord of the flies"। আর যাই হোক, বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা টান-টান উত্তেজনা বিরাজমান, এ কথা না বললেই নয়। সেই tension টা খুব ভাল ভাবেই ধরে রেখেছেন গোল্ডিং, থ্রিলার হিসেবে তাই একে পাঁচ তারা দেয়া যায়। সেই সাথে অসাধারণ ভাষা-শৈলী, যা গোল্ডিং এর একেবারে নিজস্ব বলে মনে হল, একে যথার্থ সাহিত্যকর্মে রূপ দেয়। বইটার উপর এ পর্যন্ত দুটো মুভিও হয়েছে, ১৯৬৩ এর এডাপ্টেশনটার রেটিং বেশি ভাল। আশা করি কাল দেখে আশটা পুরোপুরিই মেটানো যাব!

------------------------

বই : লর্ড অব দ্য ফ্লাইস লেখক : উইলিয়াম গোল্ডিং
প্রকাশকাল : ১৯৫৪


সচলে প্রকাশিত টুকিটাকি
[এক] নজরুল ও রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম
[দুই] ছবি
[তিন] কিংশুক-কথন
[চার] মানুষ, কিংবা
[পাঁচ] পোকা ---------- --

ফারাবী

----------


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

টুম্পা, তোর লেখার ধরণের জন্যেই রিভিওটা নিছক বই-আলোচনা না হয়ে রিভিউ এবং এনালিটিকাল দুটোই হয়ে উঠেছে। নৃতত্ত্বের বিশেষ কোন ব্যাখ্যা থাকলে আরও বেশী করে লিখতে পারতি। তাছাড়া ঐ সো কলড 'আদিবাসী' তকমা নিয়ে যা বললি তাতে কোন সন্দেহ নেই, কম বেশী সবার মধ্যেই ঐ 'জাতি'ভাব দেখিয়ে নাক সিটকানোর মনোবৃত্তি থেকেই যায়, লেখকও তার থেকে মুক্ত নন বলেই মনে হয়। সব মিলিয়ে লেখাটা ভালো হয়েছে

০২

কত সময় বাদে সচলে লিখলি? নিয়মিত লিখলে কি হয় শুনি? আশা করি এখন থেকে নিয়মিত লিখবি। এত্ত এত্ত সিনেমা দেখিস সেগুলি নিয়েই লিখ না অন্তত

বাই দ্য ওয়ে, তুই একদিন বাদে দেখবি মুভিটা, আমি আজই দেখে নিলাম দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

১। আসলেও রিভিউ লিখতে গিয়ে এনালিটিক্যাল হয়ে গেল লেখাটা। পড়তে পড়তে যে কথাগুলো বার বার মনে হচ্ছিল সে গুলোই বলতে গিয়ে এই দাঁড়াল। সব দুষ একাডেমিক পড়াশুনার! ছাই-ছাতার বাইনারি অপসিশন পড়তে পড়তে এখন সব জায়গায় এই সবই দেখি। তবে লেখক এসব সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন বলেই বিশ্বাস, এ জন্যই সাহস করে কথাগুলো বলা। লেখকের এই বইটা কিন্তু তার এক নৃবিজ্ঞানী বন্ধুর চেষ্টাতেই ছাপা হয়েছিল।

০২

নিয়মিত কোন কিছু করাই বোধয় ধাতে নেই আমার। তবে সচলের সাথে আছি, তোমাদের সাথে আছি, থাকব। সিনেমা নিয়ে লেখা যে যে-সে লোকের কাজ নয়, সে ত তুমিই বলেছিলে দাদা। কখনো নিজেকে যোগ্য মনে হল লিখব এবং এখানে দেব অবশ্যি। এখন আপাতত বেসিক কিছু পড়াশোনা চালাচ্ছি।

এরই মধ্যে দেখেও ফেলছ! কস্কি মমিন!

অতিথি লেখক এর ছবি

মুভিটা আমিও দেখেছি অনেক আগে, উপন্যাসটা পড়া হয় নি। তবে আপনার রিভিউ পড়ে মনে হয়েছে উপন্যাসটা পড়ে ফেলা উচিত।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

অতিথি লেখক এর ছবি

বইটা পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল এটা থেকে একটা দারুণ মুভি করা যাবে, হয়েছেও তাই। পড়ে ফেলুন, ১৫০ পৃষ্টার বই মাত্র। মন্তব্যের জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------
ফারাবী

বিষের বাঁশী এর ছবি

চমৎকার রিভিউ! এরকম কাছাকাছি রকমের একটি গল্প সম্ভবত: স্কুললাইফে র্যাপিড রিডার-এ পড়েছিলাম। র্যালফ, জ‌্যাক, মার্টিন এই চরিত্রগুলো ছিল সেটাটেও, রুটি গাছ থেকে রুটি খেত।।।

হিমু এর ছবি

সেটা কোরাল আইল্যাণ্ড, রবার্ট মাইকেল ব্যালানটাইনের। কোরাল আইল্যাণ্ডকে উল্টে দিয়েই গোল্ডিং লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ লিখেছিলেন, সে কারণে চরিত্রগুলোর নামে সাদৃশ্য রয়ে গেছে।

ওডিন এর ছবি

বাহ। এই ব্যপারটা তো জানতাম না। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও জানা ছিল না। এটাও দেখতে হয় তাহলে হাসি

হিমুদাকে তথ্যসমৃদ্ধ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

র‍্যাপিড রিডার পাঠ্য ছিল বটে, কিন্তু এমন কোন গল্পের কথা ত মনে পড়ছে না।

ওডিন এর ছবি

মুভিটা দেখি নাই, কিন্তু বইটা অনেকবার পড়েছি। আমার প্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটা।

আমি এই উপন্যাসটাকে সাধারন থ্রিলার বলতে রাজি না। এইটা আমাদের গল্প, মানুষের গল্প। আসলে আমাদের, হোমো সেপিয়েন্সদের মূল চেতনা, সত্বা যাই বলেন, সেইটা হলো নৃশংসতা। ডারুখুড়ো যেইটা ভদ্রতা করে বলেন নাই, সেইটা হলো আমরা যে এই দুনিয়াতে কর্তৃত্ব করতে পেরেছি, এর কারন আমরা সবচে বুদ্ধিমান বা প্রতিকূল পরিবেশে আমরা সবচে ভাল অভিযোজন করতে পারি, সেইটা না। আমরা এই দুনিয়াটাকে দখল করতে পেরেছি কারণ যেই জঙ্গল থেকে আমরা উঠে এসেছি, সেইখানে আমাদের থেকে বড় নির্দয় আর নির্মম খুনি আর কেউ ছিলো না। গত বিশ হাজার বছরের ইতিহাস সেইটা প্রমাণ করে। আমরা আসলে সভ্যতার মুখোশ পরে আছি। কোনভাবে এই মুখোশটা সরে গেলেই আমাদের ভেতরের সেই হিংস্র সত্বাটা বের হয়ে পড়ে।

রিভিউ ভালো লাগলো। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মুভিটা স্ক্রল করে যেটুকু দেখলাম তাতে মনে হল না মূল বইয়ের ভাব-গাম্ভীর্য কিছু হলেও আনতে পেরেছে। বাচ্চাদের মুভি বানিয়ে রেখেছে মনে হল।

হ্যাঁ 'হিউম্যান নেচার' নিয়েও এখানে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভাল ভাবেই ফুটে উঠছে। মানুষের তৈরি নিয়ম-কানুন-নীতি গুলোই যেন তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে ঘুমের পাতলা পর্দায় ঢেকে রাখে। রজার যখন লুকিয়ে ছোট একটা বাচ্চার দিকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে সবার, বিশেষ করে র‍্যালফের অগোচরে, তখনও এই মেসেজটাই পাওয়া যায়। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে পশুই, সভ্যতাটা শুধু একটা উন্নত মানের ভেক যা আমাদের নিজেদের পরস্পরকে ছিড়ে খাওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখে মাত্র। মুখোশটা সরে পড়তে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না।

ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা মন্তব্য করার জন্য হাসি

কী কমু এর ছবি

'লর্ড অভ দ্য ফ্লাইজ' নামটি নেওয়া হয়েছে বাইবেলে বর্ণিত দানব বীলজেবাব-এর (গ্রীক শব্দ) অনুবাদ হিশেবে। বীলজেবাব কখনও খোদ শয়তান, আবার কখনও শয়তানের ডান হাত। গোটা উপন্যাসটি নির্মিত হয়েছে মানুষের অন্তর্গত পশুত্বকে চিহ্নিত ক'রে, ওডিনের মন্তব্যে যা পুরোপুরি ধরা পড়েছে। অসাধারণ উপন্যাস। এই গোল্ডিংই কিন্তু এক প্রাতঃভ্রমণে জেমস লাভলককে 'Gaia' নামটি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। লাভলকের Gaia সিরিজের বইগুলো প'ড়ে দেখতে পারেন প্রকৃতিপ্রেমিকেরা (নৈসর্গিক দৃশ্যপ্রেমী নন, প্রকৃতির প্রেমী), জগত, প্রকৃতি, মানুষের অস্তিত্ব ইত্যাদি প্রচলিত ধারণাগুলো আমূল বদলে দেবে।

চমৎকার বিশ্লেষণ।

অতিথি লেখক এর ছবি

কী কমু ভাই ত ভালই কয়েছেন খাইছে

'গেইয়া' পড়া হয়নি, পড়ে দেখব অবশ্যই। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ কোলাকুলি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।