গ্রীক মিথলজি ২৫ (এপোলোর গল্পকথাঃ এক মহান সুরস্রষ্টার ডেলফির মন্দির)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১২/১১/২০১৩ - ৫:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে গ্রীক”- বলা হয়ে থাকে যে দেবতাকে, গ্রীকরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এবং অকৃত্রিমভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করতো সেই দেবতাকেই- ফিবাস এপোলো, যিনি এক সুদর্শন দেবতা, মহান সুরস্রষ্টা – সোনালী বীণা বাজিয়ে মাতিয়ে তুলতেন অলিম্পাস পর্বত। তিনি ছিলেন রূপালী ধনুকের প্রভু, ধনুর্বিদ্যার দেবতা, সুনিপুণ তীরন্দাজ, নিরাময়ের দেবতা – মানুষকে যিনি শিখিয়েছিলেন নিরাময়বিদ্যা। এইসব চমৎকার বিদ্যার অধিকারী হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন আলোর দেবতা, সত্যের দেবতা।

এপোলো হচ্ছেন জিউস এবং লেটোর সন্তান, শিকারী দেবী আর্টেমিসের জময ভাই। ডেলোসে জন্মগ্রহন করেছিলেন বলে তাকে ‘ডেলিয়ান’ নামেও ডাকা হয়। পাইথন নামক ড্রাগন হত্যা করায় “পাইথিয়ান” নামেও ডাকা হয়। তাকে “লাইসিয়ান” নামেও ডাকা হয়, লাইসিয়ানের অনেক অর্থ আছে – নেকড়ে দেবতা, আলোর দেবতা, লাইসিয়ার দেবতা। হোমারের “ইলিয়াড” এ তাকে অভিহিত করা হয় “স্মিন্থিয়ান” নামে, যার অর্থ মুষিক-দেবতা। তাকে সূর্য-দেবতাও বলা হয়, তার নাম “ফিবাস” এর অর্থ দ্যুতিময় বা উজ্জ্বল, যদিও সূর্য-দেবতা ছিলেন টাইটান হাইপেরিয়নের সন্তান হেলিওস।

এপোলোর মা লেটোকে -কে প্রচন্ড ঈর্ষা করতেন হেরা। তাই যখন এপোলো এবং আর্টেমিসের জন্মের সময় হলো, হেরা লেটোকে প্রসবের জন্য কোনো জায়গা দিচ্ছিলেন না, পরন্তু প্যারনাসাস পাহাড়ের এক গুহা থেকে পাইথন নামের এক সাপকে লেটোকে হত্যার জন্য নিয়োজিত করেন। কিন্তু শেষে জিউসের হস্তক্ষেপে ভাসমান দ্বীপ ডেলোসে লেটো জময বোন আর্টেমিসের পরে এপোলোকে জন্ম দেন। এপোলো জন্ম নিয়েই পাইথন হতে মা লেটোকে রক্ষার জন্য কামার দেবতা হেফাস্টাসকে অনুরোধ করেন একটি বিশেষ ধরনের তীর এবং ধনুক বানিয়ে দিতে। অন্য এক মিথে আছে, এপোলোর জন্মের পরেই জিউস নিজেই এপোলোকে রুপালী রংয়ের তীর এবং ধনুক দেন, যা তিনি আগে থেকেই হেফাস্টাস এবং সাইক্লোপসদের দিয়ে তৈরী করে রেখেছিলেন। এপোলোর বয়স যখন মাত্র চারদিন, সেই বিশেষ তীর ধনুক নিয়ে এপোলো সেই পাইথন সাপকে হত্যা করেছিলেন। প্রায় একইভাবে টিটাইউস নামের এক দৈত্যের কবল থেকেও লেটোকে বাঁচিয়েছিলেন এপোলো, এই যাত্রায় অবশ্য তার সঙ্গী ছিলেন বোন আর্টেমিস। আর্টেমিসের সাথে এপোলোর খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। জিউস বয়সে কিছুটা বড় হওয়ার সুবাদে আর্টেমিসকে দিয়েছিলেন সোনালী রংয়ের তীর এবং ধনুক। দুই ভাই-বোন জিউসের দেওয়া তীর- ধনুক নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই একসাথে শিকার করতেন। এপোলোর একটি সোনালী তলোয়ারও ছিলো, তাকে বলা হতো ধনুর্বিদ্যার দেবতা।

তবে গ্রীক মিথলজিতে এপোলোর সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো দৈববানীর দেবতা হিসেবে। পারন্যাসাস পাহাড়ের নিচে ডেলফিতে অবস্থিত ছিলো এক মন্দির, যা পরিচিত ছিলো ডেলফির মন্দির নামে। এই মন্দিরেই যাজিকার মাধ্যমে এপোলো মানুষের জন্য দৈববানী প্রকাশ করতেন। এই ডেলফির দৈববানীর ঐতিহাসিক এক গুরুত্ব আছে এবং এখনও অনেককিছু রয়ে গেছে রহস্যের আঁধারে। ঐতিহাসিকভাবে ডেলফির দৈববানী খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল প্রায় ১৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে।


প্রাচীন গ্রিসের ধর্মীয় মন্দিরগুলোর অবস্থান, ডেলফির মন্দিরসহ

মজার ব্যাপার হলো, ডেলফির এই দৈববানীর অস্তিত্ব ছিলো এপোলোর জন্মেরও আগে থেকে। ডিওডোরাসের মতানুযায়ী, ডেলফিতে প্রথম দৈববানী করেন এক রাখাল। তার ছিল একপাল ছাগল। পাহাড়ের পাদদেশে তাজা ঘাস খাওয়াতে প্রতিদিনই ছাগলের পাল নিয়ে যেতেন তিনি। এভাবেই চলছিল সবকিছু। এরইমধ্যে একদিন দুপুরে ঘটল বিচিত্র এক ঘটনা। একটি বিশেষ জায়গার ঘাস খেয়ে কিছু ছাগল অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল। প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেননি সেই রাখাল। এগিয়ে এসে জায়গাটি ভালো করে পরখ করতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে চওড়া এক ফাটল খুঁজে পেলেন তিনি। ভাবতে ভাবতেই বেশ চওড়া ফাটলটির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষন পর তার মধ্যেও দেখা দিল অস্বাভাবিকতা। একসময় তাকে খুঁজতে অন্য রাখালরা সেখানে এসে পৌঁছালেন। সঙ্গীদের দেখে তাদের ভবিষ্যৎ বলতে শুরু করলেন সেই রাখাল। এই কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সব জায়গায়। এই কথা শুনে যারাই সেখানে এলেন, সেই ফাটলে প্রবেশ করলেন এবং ভবিষ্যত বলা শুরু করলেন। এতে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে ঠিক করা হলো, শুধুমাত্র একজনই এই ফাটলের ভিতর প্রবেশ করে ভবিষ্যতবানী করতে পারবেন। সিদ্ধান্ত হলো, সেই একজন হবে একজন নারী এবং যাতে ফাটলের মধ্যে পড়ে না যান, সেজন্য ফাটলের উপর এক তেপায়া আসন বসানো হবে, সেটি ছিলো তিনটি ধাতব পায়াসহ এক গামলা।

পরবর্তীতে দেখা যায়, মা গায়া অর্থাৎ পৃথিবী ডেলফিতে পারন্যাসাস পাহাড়ের গুহায় পাইথন নামে এক ভয়ংকর সাপকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই পাইথনকেই দেবী হেরা এপোলোর মা লেটোকে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাই এপোলো জন্ম নিয়ে মাত্র চারদিন বয়সেই বিশেষভাবে তৈরী এক তীর এবং ধনুক নিয়ে ডেলফিতে আসেন এবং সাপটিকে হত্যা করেন। এভাবেই পাইথনকে হত্যার মাধ্যমেই ডেলফির দৈববানীটি গায়ার কাছে থেকে এপোলো নিয়ে নেন। এপোলো দৈববানীটি নিয়ে নেওয়ার পর সেখানে সেই ফাটলের উপর এক মন্দির তৈরি করেন।


ডেলফির এপোলোর মন্দির

(পাইথন সাপটিকে হত্যা করার পর এটিকে স্বরনীয় করে রাখার জন্য এপোলো এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন, যাকে বলা হতো পাইথনিয়ান গেমস, যা প্রতি চার বছর পর পর হতো। সেই প্রতিযোগিতায় দৌড়, চ্যারিয়ট খেলাসহ সংগীত, সাহিত্য এবং নাট্যকলারও প্রতিযোগিতা হতো।)

এই মন্দিরে এপোলোর পূজা করা হতো। মনে করা হতো, ডেলফিই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল। গ্রীসের বাইরে থেকেও মানুষ আসতেন এখানে তীর্থযাত্রায়। তারা আসতেন এপোলোর জন্য প্রচুর উপহার নিয়ে এবং ভবিষ্যত ও অতীত নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইতেন। ডেলফির মন্দিরের যাজিকাদের বলা হতো ‘পাইথিয়া’। পাইথিয়াদের মাধ্যমেই মানুষেরা ভবিষ্যতবানী জেনে নিতেন। যিনি ভবিষ্যতবানী করতেন, তিনি কথা বলার আগে মূর্ছা যেতেন। সেই অবস্থাতেই দৈববানী বলতেন। বলা হতো, যাজিকার মুখ দিয়ে এপোলোই কথা বলতেন।

মিথ অনুযায়ী, সেখানে এপোলোর পাঁচটি মন্দির ছিলো, তারমধ্যে মাত্র দুইটির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব আছে। প্রথম মন্দিরটি ছিলো লরেল গাছের শাখা দিয়ে তৈরী একটি কুঁড়েঘর, দ্বিতীয়টি তৈরী করা হয়েছিলো মোম এবং পালক দিয়ে। তৃতীয় মন্দিরটি তৈরী করা হয়েছিলো তামা দিয়ে এবং সেটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছিলো। চতুর্থ মন্দিরটি ট্রফোনিয়স এবং এগামেডেস নামের দুইজন ব্যক্তি তৈরী করেছিলেন, সেটি ৫৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো। পঞ্চমটিও ৩৭৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো এবং এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় লেগেছিলো পুনরায় তৈরী করতে, কিন্তু ততদিনে পাইথিয়া দৈববানী করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

সে যাই হোক, প্রথা অনুসারে প্রথম দিকের পাইথিয়ারা হতেন কুমারী, কিন্তু একবার কোনো জিজ্ঞাসাকারী এক পাইথিয়ার প্রেমে পড়েন এবং প্রলুদ্ধ করেন। এরপর থেকেই পাইথিয়া হতেন পঞ্চাশোর্ধ বিবাহিতা নারী। আর একবার যখন তারা পাইথিয়া হিসেবে নির্বাচিত হতেন, তখন সমস্ত কাজ তাদের ছেড়ে দিতে হতো, শুধুমাত্র দৈববানী করা ছাড়া।

প্রথম দিকে দৈববানী বছরে শুধুমাত্র একদিন জানা যেতো- সেটা ছিলো গ্রীক মাস বাইসিয়সের সপ্তম দিনে- যেদিন ছিলো এপোলোর জন্মদিন। পরবর্তীতে এটি পরিণত হয়েছিলো প্রতি মাসের সপ্তম দিনে, শুধুমাত্র শীতকালের তিনমাস ছাড়া। কারণ এই সময়টিতে এপোলো ডেলফিতে থাকতেন না। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক ডেলফির মন্দির সম্পর্কে বলেন, প্রথমদিকে মন্দিরের পাইথিয়া ছিলেন একজন। কিন্তু খুব অল্প দিনেই মন্দিরের প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকে। সাহায্যপ্রত্যাশী লোকজনের চাপ বাড়ার পর আরও দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুইজন পাইথিয়া পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করতেন এবং বাকী একজন সবসময় তৈরী থাকতেন, যদি অন্য দুইজনের কেউ অবকাশে যেতে চাইতেন।

যারাই মন্দিরের দৈববানীর জন্য আসতেন, তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। প্রথমে তাকে মন্দিরের বাইরে বেদিতে পবিত্র খাদ্যবস্তু উৎসর্গ করতে হতো। এরপরে মন্দিরে প্রবেশ করে তাকে মেষ বা ছাগল বলি দিতে হতো যার একটি অংশ পেতো মন্দিরের সেবকরা। তারপর মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র জায়গায় গিয়ে তিনি আসন লাভ করতেন এবং পাইথিয়াকে প্রশ্ন করতেন। অন্যদিকে পাইথিয়া প্রশ্নকারীর থেকে পৃথক কোনো কক্ষে বা আরো নীচে ভূগর্ভস্থ কোনো কক্ষে বসে থাকতেন। সেই কক্ষে থাকতো এপোলোর বীনা (লায়ার) ও বর্ম, একটি অর্ধবৃত্তাকার বেদির উপরে সংরক্ষিত ওমফালোস, (এটি সেই পাথর, যেটি ক্রোনাসকে তার স্ত্রী রিয়া জিউস হিসেবে দিয়েছিলেন, এবং ক্রোনাস গিলে ফেলেছিলেন। পরে জিউস ক্রোনাসকে বমিকারক উপাদান খাওয়ালে ক্রোনাস পাথরটি উদ্গারন করেন। টাইটান যুদ্ধের পর জিউসই পাথরটিকে ডেলফিতে স্থাপন করেন।) এবং এপোলোর নিজের স্বর্নমূর্তি। অবশ্য এর পূর্বে পাইথিয়াকেও বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে দিয়ে আসতে হতো।


পাইথিয়া বসে আছেন ফাটলের উপর রাখা একটি তেপায়া আসনে (শিল্পী- জন কল্লিয়ের, ১৮৯১ সাল)

পাইথিয়া সম্মোহিত ভঙ্গিতে প্রশ্নকারীর জবাব দিতেন, অনেকটা উন্মত্ততার ঘোরে অসংলগ্নভাবে উচ্চারণ করে (নিকটে থাকা অন্য কোন সেবক বা যাজক সঠিকভাবে প্রশ্নকারীকে বুঝিয়ে দিতেন)। বলা হয়ে থাকে, মন্দিরের নিচে পাহাড়ের সেই ফাটল থেকে উত্থিত বাষ্পের কারণেই উন্মত্ত হয়ে যেতেন পাইথিয়া। পাহাড়ের ফাটল থেকে উত্থিত বাষ্পের ব্যাপারটি নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতেও এখনো বিতর্ক আছে। প্রথম দিকের বিশ্লেষকরা মনে করতেন, মন্দিরের নিচে পাহাড়ের কোনো ফাটল ছিলো না বা সেখান থেকে কোনো বাষ্প বের হতো না, যদিও প্রাচীন নথিগুলোতে ফাটল বা বাষ্পের কথা লেখা ছিলো। কিন্তু বর্তমানকালের বিশ্লেষকরা বলেছেন, ডেলফির মন্দিরের ঠিক নিচেই দুটি সুস্পষ্ট বিচ্যুতিরেখা আছে, যা একটি অন্যটিকে ছেদ করেছে। একটিকে বলা হয় ডেলফিক বিচ্যুতিরেখা, অন্যটি কেরনা বিচ্যুতিরেখা। ডেলফিক বিচ্যুতিরেখাটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং কেরনা বিচ্যুতিরেখাটি উত্তর থেকে দক্ষিনে চলে গিয়েছে। মন্দিরের নিকটবর্তী একটি ঝর্নার হাইড্রোকার্বন গ্যাস পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেটিতে ইথিলিন আছে যা মিষ্টিগন্ধের। এই ইথিলিন যদি দুই বিচ্যুতিরেখার ছেদ থেকে উত্থিত হয়ে বদ্ধ কক্ষে আবদ্ধ হয়, তাহলে এক ধরনের উন্মত্ত বা সম্মোহিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। বর্তমান যুগে এই গ্যাসের ঘনত্ব কমে যাবার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, যে ভূকম্পীয় ক্রিয়া ছেদ থেকে গ্যাসকে উত্থিত করতো, সেই ক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে আরো বিশ্বাস করা হয়ে থাকে, ৩৭৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সংঘটিত এক ভূমিকম্পের ফলে (সেই সময়ে মন্দিরটি প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়) দুইটি বিচ্যুতিরেখার ছেদ স্থানটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে গ্যাস আর উত্থিত হতে পারেনি।

ডেলফিতে সর্বশেষ দৈববানী করা হয়েছিলো ৩৬২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। বলা হয়ে থাকে, এরপরই মন্দিরটির পাইথিয়া তার দৈববানীর ক্ষমতা হারান। বর্তমানে বিশ্বাস করা হয়, পাইথিয়া তার দৈববানীর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন, কারণ সম্মোহিত হয়ে ভবিষ্যতবানী করার জন্য যতটুকু গ্যাসের প্রয়োজন ছিলো, ততটুকু গ্যাসের অস্তিত্ব না থাকায়।

ডেলফির মন্দিরে পূজা সম্পর্কে এক মজার ব্যাপার হচ্ছে, এপোলো আরেক দেবতা ডায়োনিসাসের সাথে এর অংশীদারিত্ব ভাগ করতেন। শীতকালে যখন তিনমাসের জন্য এপোলো ডেলফি ছেড়ে উত্তরের হাইপারবোরিয়ানদের দেশে চলে যেতেন, তখন এখানে থাকতেন ডায়োনিসাস এবং মন্দিরে আসতেন দেবতা ডায়োনিসাসের অনুসারীরা।

ডেলফির দৈববানী এপোলোর অধিকারে আসা নিয়ে আরেকটি মিথ প্রচলিত আছে। জন্মের পর অনেক পথ ঘুরে এপোলো ক্রিসা নামক এক জায়গায় আসেন। সেখানে এক ড্রাগনকে হত্যা করে মন্দির স্থাপন করেন। এরপর থেকে ঐ স্থানের নাম হয় ‘পাইথো’, কারণ সূর্যের আলো ঐ ড্রাগনটিকে পচিয়ে দিয়েছিলো। গ্রীক ভাষায় ‘পাইথো’ শব্দের অর্থ ‘আমি পচিয়েছি’।

(ড্রাগনটিকে হত্যা করার জন্য জিউস এপোলোকে নয় বছরের জন্য থেসালীতে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। তাই ডেলফিতে প্রতি নয় বছর পর পর একটি উৎসব হতো, যে উৎসবে খোলা জায়গায় একটি ঘর তৈরী করা হতো, একজন সুঠাম যুবক এপোলো সাজতেন এবং প্রহরীরা মশাল দিয়ে ঘরটি জ্বালিয়ে দিতেন- এইভাবেই উৎসবের ডেলফির অংশটি শেষ হতো। এরপর সবাই যুবকটিকে নিয়ে উত্তর থেসালীর একটি উপত্যকায় নিয়ে যেতেন এবং শুদ্ধিকরণ শেষে লরেল পাতার মুকুট পরে আবার ডেলফিতে ফিরে আসতেন।)

সে যাই হোক, ‘পাইথো’-তে মন্দির তৈরীর পর এপোলো উপযুক্ত পুরোহিত খুঁজতে লাগলেন। একদিন দেখলেন এক জাহাজে করে কিছু ক্রেটান অধিবাসী (ক্রীটস দ্বীপের অধিবাসী) পাইলোসের দিকে যাচ্ছেন। তখন এপোলো ডলফিনের রুপ ধারণ করে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং জাহাজের উপরে উঠেন। জাহাজের নাবিকেরা প্রথমে ডলফিনরুপী এপোলোকে সাগরে নিক্ষেপ করতে চাইলেও, পারলেন না। ইতোমধ্যে নাবিকেরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন এবং জাহাজ চলে এলো ‘পাইথো’-তে। সেখানে তখন এপোলো নিজের আসল রুপ ধারণ করেন, নিজের পরিচয় দিয়ে নাবিকদেরকে তার মন্দিরের সেবক নিয়োগ করলেন এবং তাকে পূজা করতে বললেন। এপোলো যেহেতু ডলফিন রুপে তাদের জাহাজে উঠে তাদেরকে ‘পাইথো’-তে নিয়ে এসেছিলেন, তাই তাদেরকে ‘ডলফিনিওস’ নাম দিয়েছিলেন, কালক্রমে এই ‘ডলফিনিওস’ শব্দের কারণেই জায়গাটির নাম হয় ‘পাইথো’ থেকে ‘ডেলফি”।

ডেলফির মন্দিরে সাথে বিখ্যাত গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দি গ্রেটের একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। সম্রাট আলেকজান্ডার একবার ডেলফির মন্দিরে এসে তার ভবিষ্যৎ জানতে চেয়েছিলেন। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে বিরক্ত হয়ে তখনকার পাইথিয়া বলেছিলেন, “এখন ভবিষ্যৎ বলার উপযুক্ত সময় নয়, আপনি চলে যান”। আলেকজান্ডার এ কথা শুনে প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে উঠলেন , “সম্রাটের জন্য কোনো সময়-অসময় নেই। এখনই বল আমার ভাগ্যে কী আছে?” অবশেষে আলেকজান্ডার বলপ্রয়োগ করলে পাইথিয়া দৈববানী করলেন, “অনেক বড় বীর হিসেবে পৃথিবী আপনাকে মনে রাখবে, শত্রুরাও আপনার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কিন্তু আপনার মৃত্যু হবে অল্প বয়সেই এবং সেটা হবে বিদেশের মাটিতে, শোচনীয় অবস্থায়”। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাইথিয়ার এই ভবিষ্যতবানী হুবুহু মিলে গিয়েছিলো!


ডেলফির এপোলোর মন্দিরের অবশিষ্ট কিছু স্তম্ভ

এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ

সৃষ্টিতত্ত্বঃ
পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন
পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম
পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান
পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান
পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও
পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস
পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন

দেবতাদের গল্পঃ
পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম
পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব
পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব
পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ আফ্রোদিতি, হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি
পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী
পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
পর্ব-২০: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ লেমনসের নারী এবং অন্যান্য
পর্ব-২১: লেটোঃ এপোলো এবং আর্টেমিসের মায়ের কাহিনী
পর্ব-২২: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ একটাওনের মন্দভাগ্য
পর্ব-২৩: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ এলোয়াডি, আলফিউস ও আরেথুসা এবং ক্যালিষ্টোর কাহিনী
পর্ব-২৪: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ অরিয়ন

ভালোবাসার গল্পঃ
পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া
পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি
পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার
পর্ব-১৭: বোসিস এবং ফিলোমোন
পর্ব-১৮: কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব
পর্ব-১৯: কিউপিড এবং সাইকী- শেষ পর্ব

লেখকঃ

এস এম নিয়াজ মাওলা

ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট


মন্তব্য

পদব্রজী এর ছবি

এই সিরিজটি অসম্ভব ভাল্লাগে---একটা অন্য জগতে ঢুকে পরি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আর অনেক দেরীতে উত্তর লেখার জন্য দুঃখিত হাসি
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

ইন্টারেস্টিং সিরিজ, লিখতে থাকুন। বই আকারে প্রকাশ করতে পারেন আরেকটু ডিটেলস এ গিয়ে।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১২, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ শব্দ পথিক আর অনেক দেরীতে উত্তর লেখার জন্য দুঃখিত হাসি
ইচ্ছে আছে, বই আকারে বের করার, তবে এবার নয়, দেখা যাক কী হয়।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

ওয়াইফাই ক্যানসার এর ছবি

খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়ের উপরে চরম ইনফরমেটিভ একটা লেখা।

তিন বৃদ্ধা পাইথিয়ার কথা জানা ছিল না। এটা পড়ার পর ডিজনির হারকিউলিস সিরিজে দেখা তিন ফেইটস (Fates) বুড়ির কথা মনে পড়ে গেল। তারাও তিনজন বুড়ি, কিন্তু তাদের একটা মাত্র চোখ, সেই চোখ দিয়ে তারা অতীর বর্তমান ভবিষ্যত সব দেখতে পায়। আর তারা থ্রেডস অভ লাইফ কন্ট্রোল করে। তারা কোন মানুষের জীবনের সুতা কেটে দিলে সেই মানুষ মরে যায় আর তার আত্মা আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে যায়। এই ফেইটস বুড়িরা কি আলাদা কোন গ্রীক পৌরাণিক চরিত্র ছিল নাকি তিন পাইথিয়া থেকে ইনস্পায়ার্ড হয়ে হারকিউলিস সিরিজে এডপ্ট করেছে জানতে ইচ্ছা করছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমেই অনেক দেরীতে উত্তর লেখার জন্য দুঃখিত হাসি
আপনি যে তিন ফেইটসের বর্ননা দিয়েছেন, তারা ফেইটস নয়- গ্রেইয়ী বোন। আর পাইথিয়ার মানবী, ফেইটস- দেবী। গ্রেইয়ো বোনেরাও অনেকটা সেইরকম- তাদের বর্ননা বেশী আছে পারসিউসের মেডুসা বধের কাহিনীতে।

ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

এক লহমা এর ছবি

চমৎকার চলছে নিয়াজভাই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ একলহমা ভাইয়া আর আর অনেক দেরীতে উত্তর লেখার জন্য দুঃখিত হাসি

ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

তারেক অণু এর ছবি

ডেলফির মন্দিরের রহস্য কিন্তু মোটামুটি জানা হয়ে গেছে-

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অণু ভাইয়া।
কেমন আছেন আপনি? দেশে আছেন তো এখনো?

-নিয়াজ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।