গ্রীক মিথলজি ৪ (মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ৩১/০৭/২০১৩ - ৩:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টাইটান ক্রোনাসের সময় মানবজাতির সোনালী যুগ ছিলো। টাইটান যুদ্ধে ক্রোনাসের পরাজয়ের সাথে সাথে সেই যুগের সমাপ্তি ঘটে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন জিউস। জিউস তখনো তার ক্ষমতাকে পুরোপুরি নিষ্কন্টক করতে পারেননি। তাকে টাইটান যুদ্ধের পর আরো দুটি যুদ্ধে জড়াতে হয়- জায়ান্টদের সাথে এবং টাইফুনের সাথে। সেই দুটি যুদ্ধের আগে জিউসের ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে মানবজাতির সৃষ্টি। আসলে সোনালী যুগের অবসানের পর পৃথিবীতে অনেকদিন যাবত কেউ বসবাস করছিলো না। না কোন মানব, না কোন পশু-পাখি। তাই জিউসের ইচ্ছে হলো মানব তৈরী করার এবং সেইসাথে সূচনা হলো গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অধ্যায়ের, যে অধ্যায়ের নায়ক হচ্ছেন টাইটান প্রমিথিউস আর পার্শ্বচরিত্ররা হচ্ছেন পান্ডোরা, এপিমেথিয়াস এবং স্বয়ং জিউস।

টাইটানদের সাথে যুদ্ধ জয়ের পর জিউস সিদ্ধান্ত নিলেন পশু পাখি এবং মানুষ তৈরী করার এবং এই কাজে তিনি দায়িত্ব দিলেন দুই টাইটান ভাই প্রমিথিউস ও এপিমেথিয়াসকে, যারা টাইটান যুদ্ধে জিউসকে সাহায্য করেছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রমিথিউস ছিলেন বুদ্ধিমান, তিনি ভবিষ্যতে কি হবে, সেটা আগেই বুঝতে পারতেন। কিন্তু এপিমেথিয়াস ছিলেন আবেগপ্রবণ, তিনি অতীতে কি হয়েছিলো সেটা নিয়েই ভাবতেন শুধু। মানুষ এবং পশু পাখি তৈরীর জন্য জিউস এই দুই ভাইকে কিছু উপকরণ উপহার দিলেন, যেমন- ধারালো নখ, দাঁত, খোলস, প্রখর দৃষ্টি শক্তি, ঘ্রাণশক্তি, ইত্যাদি। এপিমেথিয়াস দ্রুত অনেক পশু পাখি তৈরী করে ফেললেন যারা বনে বাস করবে, নদীতে ও সাগরে সাঁতার কাটবে, আকাশে উড়বে এবং জিউস যে উপহারগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো সব শেষ করে ফেললেন।

যখন তাঁর ভাই বোকার মতো খুব একটা চিন্তা ভাবনা না করেই পশু পাখি তৈরী করছিলেন, তখন প্রমিথিউস অনেক চিন্তা ভাবনা করে, অসম্ভব যত্নে, প্রচন্ড আবেগ দিয়ে এক দলা মাটি নিয়ে মানুষ তৈরী করতে লাগলেন। প্রমিথিউস মানুষকে দেবতাদের মতো আকৃতি দিলেন, মানুষকে সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা দিলেন আর দিলেন আকাশের দিকে তাকানোর সামর্থ্য। দেবী এথেনা দিলেন মানবীয় গুণাবলী। কোনো কোনো মিথে আছে, এপিমেথিয়াস মানুষ তৈরী করেছেন এবং প্রমিথিউস তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। যেই মানুষকে তৈরী করে থাকুক না কেনো, মানুষকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মহৎ করে তৈরী করা হয়েছিলো এবং দেয়া হয়েছিলো দেবতাদের আদল।


প্রমিথিউস দেখছেন এথেনা তাঁর সৃষ্টিকে মানবীয় গুণাবলীতে শোভিত করছেন (ক্রিস্টিয়ান গ্রীপেনকেরল, ১৮৭৭ সাল)

যা হোক, মানুষ তৈরী করার পর প্রমিথিউস দেখলেন, তাঁর ভাই জিউসের দেওয়া সব উপহার অন্যান্য পশু পাখিকে দিয়ে শেষ করে ফেলেছেন, এবং মানুষকে দেবার জন্য অবশিষ্ট আর কিছু নেই। যেখানে, অন্যান্য পশু পাখি শক্তিমত্তা, দ্রুততা, শক্ত খোলস, গরম পালকসহ অনেক কিছুই পেয়েছে, সেখানে মানুষ ছিলো নগ্ন, ছিলো দুর্বল, ছিলো অনিরাপদ।

প্রমিথিউস প্রচন্ড দুখবোধ নিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে দেখতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবীতে কতটা অসহায় অবস্থায়, কতটা যন্ত্রনা নিয়ে মানুষ জাতি বসবাস করছিলো। তিনি আবেগপ্রবন হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে এমন একটি জিনিস উপহার দিতে চাইলেন যা মানুষকে করে তুলবে দুর্দান্ত, সব সৃষ্টির মাঝে অনন্যসাধারণ।

“যদি তারা আগুন পেতো!” চিন্তা করলেন প্রমিথিউস, “অন্ততপক্ষে তারা নিজেদের উষ্ণ রাখতে পারতো, নিজেদের খাবার রান্না করে খেতে পারতো এবং আগুনের সাহায্যে তারা কিছু জিনিস তৈরী করা শিখে নিজেদের জন্য বাড়ি বানিয়ে সেখানে বসবাস করতে পারতো! আগুন ছাড়া তারা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না!”

এই চিন্তা করেই প্রমিথিউস জিউসের কাছে গেলেন এবং মানুষের জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চাইলেন। সেই সময়ে আগুন শুধু স্বর্গের দেবতাদেরই বস্তু ছিলো।

“এক স্ফুলিঙ্গ কণা আগুনও দেওয়া যাবে না!” বজ্র কন্ঠে জবাব দিলেন জিউস, “যদি মানুষকে আগুন দেওয়া হয়, তাহলে সে শক্তিশালী হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে আমাদের মতো জ্ঞানী এবং কিছুদিন পরে দেখা যাবে তারা আমাদের অমান্য করছে। তাদেরকে এই অবস্থাতেই থাকতে দাও, যাতে তারা সবসময়ের জন্য দরিদ্র আর অজ্ঞ থাকে, তাহলেই তারা সবসময় আমাদের মান্য করবে”।

প্রমিথিউস নিরুত্তর রইলেন, কিন্তু তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন তিনি কি করবেন! তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলেন মানুষ জাতির প্রতি তাঁর মমতা, তিনি আশা ছাড়লেন না। কিন্তু তিনি সর্বশক্তিমান জিউসের সঙ্গ ছাড়লেন চিরদিনের জন্য।

তিনি যখন সমুদ্রের তীর দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন এক নলখাগড়া দেখতে পেলেন, কেউ কেউ বলেন, মৌরি গাছের একটি বৃন্ত পেলেন। সেটাকে ভেঙ্গে দেখলেন, এর ভিতরটা সরু ফাঁপা, সেখানে আছে শুকনো, নরম মজ্জা যা ধীরে ধীরে জ্বলবে এবং এতে অনেকক্ষন ধরে আগুন রাখা যাবে। তিনি এরকম একটি নলখাগড়া নিয়ে সূর্য দেবতার বাসস্থানের দিকে হাঁটা শুরু করলেন।

“মানবজাতিকেই আগুন পেতে হবে সেই স্বেচ্ছাচারীর পরিবর্তে, যে বাস করে পাহাড় চূড়ায়,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন প্রমিথিউস। খুব ভোরবেলায়, যখন সূর্যদেব তাঁর সেই দিনের যাত্রা শুরু করবেন, তখন প্রমিথিউস সূর্যদেবের প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছালেন। তিনি সূর্য দেবের রথ থেকে এক স্ফুলিঙ্গ আগুন সেই নলখাগড়ার মধ্যে লুকিয়ে দ্রুত পৃথিবীতে ফিরে আসলেন।


কোনো কোনো মিথে দেখা যায়, জিউস যখন তাঁর প্রেমিক গাইনেমেডের সাথে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করছিলেন (তুলি- ক্রিস্টিয়ান গ্রীপেনকেরল)

কেউ কেউ বলে থাকেন, দেবী হেরার সাহায্য নিয়ে প্রমিথিউস অলিম্পাস পাহাড়ে দেবতাদের বাসস্থান থেকে আগুন চুরি করে আনেন। আবার কোনো কোনো মিথে দেখা যায়, আগুন আগে পৃথিবীতেই ছিলো, মানুষ আগুনের ব্যবহার জানতো, কিন্তু জিউস সেটা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এবং প্রমিথিউস আবার তা ফিরিয়ে এনেছেন। এইসব মিথে বর্ণিত আছে, জিউস একবার মানুষকে বললেন দেবতাদের উদ্দেশ্যে খাবারের একটি অংশ উৎসর্গ করতে। মানববন্ধু প্রমিথিউস মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি খাবারের দুটি প্রস্ত তৈরী করেন। একটি ছিলো বাইরের দিকে সাড়ম্বরপূর্ণ, কিন্তু ভিতরে ষাড়ের হাড় এবং চর্বি ছাড়া কিছুই নেই। অন্য খাবারটি দেখতে ছিলো অপছন্দনীয়, কিন্তু ভিতরে ছিলো ষাড়ের মাংশ। জিউস প্রলুদ্ধ হয়ে যেটি দেখতে সুন্দর সেটি নিলেন। সেই থেকে মানবজাতি দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাড়সর্বস্ব চর্বি উৎসর্গ করতো, আর নিজেদের জন্য মাংশ রেখে দিতো। জিউস খুবই ক্ষুদ্ধ হলেন, তিনি মানুষের কাছ হতে আগুন কেড়ে নিলেন। প্রমিথিউস সেটা চুরি করে এনে আবার মানুষকে ফিরিয়ে দিলেন।

তিনি শীতে কাবুপ্রায় কিছু মানুষকে গুহা থেকে ডাকলেন, আগুন জ্বালালেন, তাদেরকে শিখালেন কীভাবে আগুনের সাহায্যে নিজেদেরকে উষ্ণ রাখবে, কীভাবে আগুনের সাহায্যে অন্যান্য জিনিস তৈরী করবে। প্রমিথিউস আগুন দিয়ে মানবজাতিকে শেখালেন কীভাবে রান্না করতে হয়, কীভাবে পশুর মতো জীবন পরিহার করে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকা যায়। তারা গুহা ছেড়ে খোলা জায়গায় থাকা শুরু করলেন, জীবন হয়ে উঠলো আনন্দময় এবং প্রাচুর্যময়।

প্রমিথিউস ধীরে ধীরে মানুষকে অনেক কিছুই শেখালেন। তিনি দেখালেন কীভাবে পাথর এবং কাঠ দিয়ে বাড়ি তৈরী করতে হয়, শেখালেন কীভাবে ভেড়া এবং গরুকে পোষ মানাতে হয়, কীভাবে ভূমিকর্ষণ করে শস্য বুনতে হয়, কীভাবে শীতে, ঝড়ে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। মানবজাতির উন্নতি দেখে প্রমিথিউস উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, তিনি আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এক নতুন সোনালী যুগ অতি শিঘ্রই আসবে, যা হবে আগের চেয়ে উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধশালী”।

হয়তোবা সবকিছুই প্রমিথিউসের ইচ্ছামতোই ঘটতো, যদি না একদিন অলিম্পাস পাহাড় থেকে জিউস উঁকি দিয়ে নীচে পৃথিবীর দিকে না তাকাতেন! তিনি তাকিয়ে দেখেন, আগুন জ্বলছে, মানুষ বাড়িতে বাস করছে, গোবাদি পশু পাহাড়ে চড়ছে, আর মাঠে অবারিত শস্যক্ষেত। জিউস এসব দেখে চমকে উঠলেন, তিনি হুংকার দিয়ে জানতে চাইলেন, কে মানবজাতিকে আগুন দিয়েছে। কোনো এক দেবতা বলে উঠলেন, “প্রমিথিউস”

জিউস প্রমিথিউসের উপর দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষুদ্ধ হলেন। তিনি মানবজাতি এবং প্রমিথিউস- দুইকেই শাস্তি দিতে মনস্থির করলেন। তিনি জানেন, প্রমিথিউসকে শস্তি দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। তাই প্রমিথিউসকে শাস্তি দেওয়ার আগে তিনি খুবই অভিনব পন্থায় মানবকে শাস্তি দিতে চাইলেন। জিউস স্বগতোক্তি করলেন, “ঠিকাছে, মানুষ আগুন ব্যবহার করুক। কিন্তু আমি মানুষকে এখন যা দিবো, তার জন্য সে দশগুণ কষ্ট ভোগ করবে!”

প্রথমে জিউস তাঁর পুত্র এবং দেবতাদের কামার হেফাস্টিয়াসকে আদেশ দিলেন এমন এক মানুষ তৈরী করতে যা দেখে প্রতিটি মানবের হৃদয় তাকে পাওয়ার আকাঙ্খায় পেয়ে বসবে। মাটির পিন্ড দিয়ে হেফাস্টিয়াস তৈরী করলেন পৃথিবীর প্রথম মানবী। এরপর সেই মানবীকে হেফাস্টিয়াস সকল দেবতা পরিবেষ্টিত জিউসের সামনে উপস্থিত করলেন। হেসিয়ডের থিওগোনীতে এর চেয়ে সেই মানবী সম্পর্কে বেশি কিছু লেখা নেই, এমনকি নামটিও পর্যন্ত নেই। কিন্তু হেসিয়ড তাঁর ‘ওয়ার্কস এন্ড ডেইজ’- এ আবার মানবী সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, মানবীকে জিউসের সামনে নিয়ে এলে জিউস সবাইকে আদেশ দিলেন- এই মানবীর মধ্যে সব ভালো ভালো জিনিস দিতে। জ্ঞানের দেবী এথেনা তাকে সুঁই সুতার ব্যবহার এবং বয়ন করা শেখালেন, সৌন্দর্য্য এবং প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি তাকে দিলেন অতুলনীয় রুপ, হার্মিস দিলেন বিনয়াবনত মন ও কৌতুহলী স্বভাব, আরো দিলেন মিষ্টি কন্ঠস্বর। এথেনা তখন তাকে রুপালী গাউনে আবৃত করলেন, ক্যারিস নামের দেবীরা তাকে অলংকারে সুশোভিত করলেন, আর হোরাই নামের দেবীরা তার মাথায় পরিয়ে দিলেন ফুলের মুকুট। সবশেষে হার্মিস মানবীটির নাম দিলেন ‘পান্ডোরা’- মানে ‘সব উপহার দেওয়া হয়েছে’। পান্ডোরাকে এমনভাবে তৈরী করা হলো, পৃথিবীর কেউ দেখে তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না।

পান্ডোরাকে দেবতারা যা দিয়েছিলেন, তার ভিতরে কৌতুহলী স্বভাবটিই ছিলো মানবজাতির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। দেবতারা পান্ডোরাকে সমস্ত মানবীয় গুণাবলী ছাড়াও আরেকটি জিনিস দিলেন, সেটি হচ্ছে একটি মুখবন্ধ জার, (ষোড়শ শতকে সাহিত্যিকদের লেখনীতে কীভাবে যেনো জার হয়ে গেলো বাক্স! সেই থেকে বলা হতে লাগলো ‘পান্ডোরার বাক্স’, অথচ হেসিয়ড লিখেছিলেন ‘পান্ডোরার পিথস বা জার’!) যার ভিতরে ছিলো দুর্বহ পরিশ্রম ও জরা-ব্যাধিসমূহ যা মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে, ছিলো রোগ, অন্যান্য অসংখ্য যন্ত্রনা, ক্লিষ্টসমূহ, লোভ লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্লেগ, দুর্ভিক্ষ আর ছিলো আশা! কেউ কেউ বলেন দেবী এথেনা বিদায় মূহূর্তে পান্ডোরাকে নিষেধ করেছিলেন, সে যেনো জারের বন্ধ মুখ কখনো না খুলে!


১৬২৬ সালে শিল্পী নিকোলাস রেগ্নিয়ের জারসহ (বাক্স নয়) পান্ডোরাকে সঠিক ভাবেই চিত্রিত করেছিলেন

এরপর পান্ডোরাকে নিয়ে পৃথিবীর যে জায়গায় প্রমিথিউস এবং এপিমেথিয়াস বসবাস করছিলেন, সেদিকে এলেন জিউসের বার্তাবাহক হার্মিস। হার্মিসের সাথে প্রথমে এপিমেথিয়াসের দেখা হলো। হার্মিস বললেন, “এপিমেথিয়াস, তোমার জন্য জিউস উপহার পাঠিয়েছেন। তুমি এই মানবীকে বিয়ে করো”। প্রমিথিউস পূর্বেই এপিমেথিয়াসকে সাবধান করেছিলেন জিউস থেকে কোন কিছু গ্রহন না করতে, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জিউস এতো সহজে তাদেরকে ছেড়ে দিবেন না! কিন্তু পান্ডোরাকে দেখে এপিমেথিয়াস প্রমিথিউসের নিষেধ বাণী ভুলে গেলেন। পান্ডোরাকে নিয়ে তিনি ঘরে এলেন, এবং বিয়ে করলেন।

নতুন জীবনে পান্ডোরা খুব সুখী ছিলেন। এমনকি প্রমিথিউসও তার সৌন্দর্য্য দেখে এপিমেথিয়াসের বিয়ে করাকে মেনে নিয়েছিলেন। সুখী জীবন পান্ডোরার ভালো লাগলো না! তিনি সারাক্ষণ জারের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আর চিন্তা করতেন কি আছে এর ভিতরে। ভাবতে লাগলেন, নিশ্চয়ই এর ভিতরে মূল্যবান অলংকার আছে। আর এই জার যদি সে ব্যবহারই করতে না পারে, তাহলে জিউস শুধু শুধু দিলেন কেনো? এথেনা নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে এই জারের মুখ খুলতে মানা করেছেন! এথেনা তো সুন্দরী নয়, তাই সে অলংকারগুলো পান্ডোরাকে দেখতে দিতে চায় না! কী হবে একবার খুললে! কেউ দেখবে না!

অবশেষে প্রবল কৌতুহলের কাছে সতর্কবাণী পরাস্ত হলো।

পান্ডোরা জারের ঢাকনাটি সামান্য পরিমাণে খুললেন, শুধুমাত্র ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখার জন্য যতটুকু খোলা দরকার। এরই মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ আর খচমচে আওয়াজ শুরু হলো, খুব দ্রুত ঢাকনা বন্ধ করে দেবার আগেই সেখান থেকে অজস্র মৃত্যুরুপ অস্থিচর্মসার ভয়ংকর জীব বের হয়ে গেলো, যেসব আগে কখনো পৃথিবীর কেউ দেখেনি! যা ছিলো আসলে সেইসব লোভ লালসা, প্লেগ, জরা-ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, রোগ ইত্যাদি- এরা বের হয়েই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো আর খুঁজে বেড়াতে লাগলো মানবজাতিকে, দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেবার জন্য। এভাবেই জিউস মানবজাতির উপর প্রতিশোধ নিলেন।


পান্ডোরা জারের মুখটি খুলে ফেললেন, পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরলো যত খারাপ জিনিস

জারের ঢাকনাটি দ্রুত বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ভিতরে একটি জিনিস আটকে গেলো, সেটি হলো ‘আশা’। হেসিয়ড অবশ্য তাঁর ‘ওয়ার্কস এন্ড ডেইজ’-এ লিখেননি ‘আশা’ কেনো জারের ভিতরে থেকে গেলো! তিনি অবশ্য শেষ করেছিলেন এই লিখে যে, “মরণশীলরা বুঝতে পারলো যে জিউসের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব নয় বা তাঁকে কখনো ধোঁকা দেওয়ায় সম্ভব নয়!” (যদিও জিউসকে বেশ ক’বারই ধোঁকা দেওয়া হয়েছে!)

আগের পর্বগুলোঃ

প্রথম পর্বঃ বিশ্ব- ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি, ইউরেনাসের পতন
দ্বিতীয় পর্বঃ টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম
তৃতীয় পর্বঃ প্রথম টাইটান যুদ্ধ ও জিউসের উত্থান

লেখকঃ

এস এম নিয়াজ মাওলা


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার নাম জান হলো না!

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

সাথে থাকার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।

-নিয়াজ

আন্দোলন মিঠুন এর ছবি

হাততালি +

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা।।।
হ্যাঁ, আজকে নাম লিখতে ভুলি নাই!

-নিয়াজ

বেচারাথেরিয়াম এর ছবি

হাততালি
আজকে দেখি নাম লিখতে ভুলেন নাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, একলহমা ভাইয়া।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

আয়নামতি এর ছবি

প্যাণ্ডোরার বাক্স খোলার পাপক্ষয় হয় বুঝি রাসমণির গয়নার বাক্সে বন্দী মনের উড়াল দিয়ে!
ঘোড়ার ডিমের সব দেবতা। পেটভর্তি খালি হিংসা আর হিংসা রেগে টং
তবে কী জানেন? জারের চেয়ে বাক্সই জবরদস্ত হয়েছে। বাক্স গয়না থাকে। থাকে হীরে, জহরত!
জারে থাকেটা কি? ঝোলা গুড় দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা------
ভালো বলেছেন আপনি। আমার কাছেও পান্ডোরার জারের চেয়ে পান্ডোরার বাক্সই সুন্দর লাগে। আর এটাই ঠিক ঘোড়ার ডিমের সব দেবতা।
ভালো থাকুন, খু-উ-ব।

-নিয়াজ

তুলিরেখা এর ছবি

জারে ঝোলা গুড় থাকে, ভালো সুরাও থাকে।
আসটেরিক্সের একটা গল্পে ক্লিওপ্যাট্রা সীজারের উপরে রেগে গিয়ে কেবলই দুম দুম করে জার ভেঙে ফেলতো! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরানো দিনের গুপ্তধনও কিন্তু জারে থাকে, বাক্সে নয়!

-নিয়াজ

তুলিরেখা এর ছবি

দুই ভাইরে এই সুন্দরীর জন্য লড়াইয়া দিলে কাজ হইত! নিজেরাই লইড়া লইড়া নিজেদের সাবাড় করলো, প্যান্ডরা আলগোছে লড়াই দেইখা হাততালি দিয়া শো শেষে ফেরত গেল। হাসি
ঝামেলা খতম, ঐ বাক্স খুলতেও হইতো না, ও যেখানকার জিনিস সেখানেই ফেরত যাইত।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো বলেছেন। আসলে জিউসের মনে হয় বুদ্ধি কম ছিলো, ওর অনেক কাজেই বুদ্ধিমত্তার অভাব রয়েছে!

অটঃ
আমি কোনো ইমোটিকনস দিতে পারছি না, কেনো সেটাও বুঝতে পারছি না। আমাকে কী একটু সাহায্য করা যাবে?

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রমিথিউস এইডা একটা কাম করলো! এক ট্যাকা দিয়া প্রজাপতি ম্যাচ কিনলে ৪০ কাঠি দিয়া না হইলেও ৩০ বার আগুন জ্বালানো যাইতো! এতো কষ্ট করলো! ফু: এই দেবতা- মাথায় তো বেরেন ছিল না খালি গুবর। (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিস্ট)

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা------
জিউসের মাথায় আসলেই গোবর ছিলো!

-নিয়াজ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চলুক
খুবই প্রিয় আমার গ্রিক মিথ
আরেকবার ঝালাই হচ্ছে....

অতিথি লেখক এর ছবি

মাহবুব লীনেন ভাইয়া!
আপনার মন্তব্য আমাকে আরো উৎসাহ যোগাবে।
ভালো থাকুন, খুব।

-নিয়াজ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

দিন দিন আরো ভালো হচ্ছে।

ভাই আপনি তো দেখি তারেকাণুর মত স্পীডে লেখা দিচ্ছেন, চমৎকার।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হিজিবিজবিজ ভাইয়া!

অটঃ
আপনার আসল নামটা কি জানতে পারি, যদি আপত্তি না থাকে! ভালো থাকুন ভাইয়া, সবসময়ের জন্য।

-নিয়াজ

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক চলুক। মন দিয়ে পড়ছি।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারা উৎসাহ দিচ্ছেন বলেই লেখার সাহস পাচ্ছি।
ধন্যাবাদ ত্রিমাত্রিক কবি ভাইয়া।

-নিয়াজ

মালাকাইেটর ঝাপী এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মালাইকাটের ঝাপী।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

অণু ভাইয়া- কেমন আছেন আপনি? ভালো থাকুন অবিরত।

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

-------------------
সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে সুবোধ অবোধ।

-নিয়াজ

সাকিন উল আলম ইভান  এর ছবি

অবশেষে সেই প্রতিক্ষীত প্যান্ডোরার বাক্স তাহলে এসেই পড়লো ।

পরের টা পড়তে যাচ্ছি ।

দারুন ভাইয়া।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-নিয়াজ

রাত-প্রহরী এর ছবি

আর মাত্র একটা মন খারাপ

-----------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

আসবে, আরো আসবে, অপেক্ষা করুন।

-নিয়াজ

অয়ন   এর ছবি

দারুন হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

-নিয়াজ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।