পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখাটা কি জরুরী? (প্রথম পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২২/১২/২০১৩ - ১০:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাম্প্রতিককালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকর হবার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে এই ঘটনার ব্যাপারে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ও গৃহীত হয়। পাকিস্তান সরকারের এই নজীরবিহীন পদক্ষেপ বাংলাদেশে সর্বস্তরে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকভাবে এই সময়ে নানা আলোচনায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের ডাক এসেছে। এর আগে বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সময়ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক এসেছিল। সাময়িকভাবে সেই ডাকে কিছুটা সাড়া পড়লেও আখেরে বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্যে সেই ডাকের কোন ছাপ পড়েনি।

বস্তুত ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হলেও বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের ব্যবসায়ের তার বিশেষ কোন ছাপ পড়ার কথা নয়। এর কারণগুলো সহজ — (ক) ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ট্রেড পার্টনার। ২০১২-২০১৩ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানীর পরিমাণ ৩৭,৮৬৮ কোটি টাকা যা বাংলাদেশের মোট আমদানীর ১৬.৩০%। সুতরাং চাইলেও রাতারাতি ভারতীয় পণ্য বর্জন করা সম্ভব নয়। ( খ) বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে ভারতের সাথে সীমান্ত যার দৈর্ঘ্য ৩,৯০৯ কিলোমিটার। সুতরাং চাইলেও ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আসা বন্ধ করা সম্ভব না। (গ) একটি পণ্য কোন বাজারে দুই ভাবে তার শেয়ার তৈরি করতে পারে — পুশ (Push) মানে নানা কায়দা করে ক্রেতাকে গছিয়ে দেয়া এবং পুল (Pull) মানে বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করা যাতে ক্রেতা নিজেই দোকানে গিয়ে পণ্যের নাম ধরে চাইবে। ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে তার পণ্যের পুশ এবং পুল দুটোই তৈরি করা সহজ। সুতরাং বাংলাদেশী ক্রেতা ভারতীয় পণ্য চাইতেই পারে।

কিন্তু এই কথাগুলো পাকিস্তানী পণ্যের ক্ষেত্রে বা পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একইভাবে সত্য নয়। কীভাবে? উত্তর হচ্ছে — (ক) পাকিস্তান বাংলাদেশের ১৭-তম ট্রেড পার্টনার। ২০১২-২০১৩ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানীর পরিমাণ ৩,৯১৩.৭০ কোটি টাকা যা বাংলাদেশের মোট আমদানীর ১.৭০%। সুতরাং একটু চেষ্টা করলে দরকারী জিনিসটি পাকিস্তান থেকে আমদানীর বদলে অন্য কোন দেশ থেকে আমদানী করে চলা সম্ভব। (খ) বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের কোন সীমান্ত নেই। সুতরাং এখানে বর্ডার ট্রেড বা চোরাচালানের কোন উপায় নেই। (গ) বাংলাদেশে পাকিস্তানী পণ্যের পুল তৈরি করাটা সহজে ঠেকানো সম্ভব, পুশ করাটাও বন্ধ করা সম্ভব।

বুঝলাম, ভারতীয় পণ্য ঠেকানোর চেয়ে পাকিস্তানী পণ্য ঠেকানো সহজ। কিন্তু পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের ডাক দিলেই কি বাংলাদেশে পাকিস্তানী পণ্যের কেনা-বেচা বন্ধ হয়ে যাবে? না, তা হবে না। প্রথমত, একটা প্রচারণা যত বিস্তৃতই হোক সেটা একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছায় না। আসলে একটা বড় অংশ মানুষের কাছে সেটা একেবারেই পৌঁছায় না। তাছাড়া এধরনের আহ্বানের আবেদন সবার কাছে সমান হয় না। তাই পাকিস্তানী পণ্য বর্জনের ডাক দিলেও সেটা সফল হবার সম্ভাবনা খুব কম। আমদানীকারকরা যদি পাকিস্তানী পণ্য আমদানী বন্ধ করে দেন তাহলে বাংলাদেশের বাজারে পাকিস্তানী পণ্য পাওয়া যাবে না। যদি বাংলাদেশে পাকিস্তানী পণ্য একেবারেই না আসে কেবল তাহলেই পাকিস্তানী পণ্যের ব্যবহার বন্ধ হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ীগণ পাকিস্তানের পণ্য আমদানী বন্ধ করবেন কেন? এটা কি শুধুই একটা আবেগী আবেদন? একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে যে, পাকিস্তানের পণ্য আমদানী বন্ধ করার জন্য আবেগের চেয়ে যৌক্তিক কারণের পরিমাণ বেশি। এই আলোচনায় আমরা প্রথমে দেখবো সেই যৌক্তিক কারণগুলো কী কী, তারপরে দেখবো পাকিস্তানী পণ্য আমদানী কী করে বন্ধ করা যেতে পারে এবং পাকিস্তানী পণ্য আমদানী না করেও কী করে বিকল্প উৎস থেকে আমদানী করে বা যোগাড় করে আমরা নির্বিঘ্নে চলতে পারি।

কেন পাকিস্তানী পণ্য আমদানী করবো না

ডেইলী টেলিগ্রাফের ২০০৯ সালের ৮ই জুলাইয়ে প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারী ইসলামাবাদে প্রাক্তন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেন, এখন সময় এসেছে জঙ্গীদের ব্যাপারে সত্য কথা বলবার। আসুন আমরা নিজেদের নিকট সৎ হই এবং বাস্তবতাকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করি। আজ যাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী বলছি, ৯/১১-এর আগে এবং আমাদেরকে তাড়া করার আগে তারাই আমাদের কাছে বীর ছিলো। এই সন্ত্রাসীদলগুলোকে সরকারের দুর্বলতাজনিত কারণে উচ্ছেদ করা হয়নি — ব্যাপারটা এমন নয়, বরং এটা ছিল নীতির অংশ। তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া ও বেড়ে উঠতে দেয়া হয়েছে। এটা কৌশলগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করা হয়েছে।

আসিফ আলী জারদারী স্বীকার করার বহু আগে থেকে সারা দুনিয়া জানে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন, অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আফগানিস্থানে তারা তালিবানদের উত্থান ঘটিয়েছে এবং ভারতে নিয়মিত ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর এতো উদাহরণ আছে যে সেগুলোর উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। শুধুমাত্র আফগানিস্থান বা ভারত নয়, পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশেও বিস্তৃত। এই পর্যন্ত বাংলাদেশে জেএমবি বা হুজি’র মতো যে সব জঙ্গী ইসলামী দলের সদস্য নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে তাদের সবার কাছ থেকে জানা গেছে যে তারা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এমনকি ২০০৬ সালে ভারত দাবি করে যে, ভারতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় আটককৃতদের মধ্যে পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশী সন্ত্রাসীও আছে। তাছাড়া সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলোকে পাকিস্তানের অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দেবার বিষয়টিও সর্বজনবিদিত। সুতরাং পাকিস্তান যে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিস্তৃতি বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত সেটা স্পষ্ট।

কাদের মোল্লার ঘটনায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান, তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খান নিয়াজী, দলগতভাবে জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তান পার্লামেন্ট যা কিছু বলেছে বা প্রস্তাব পাশ করেছে তাতে কয়েকটি ব্যাপার স্পষ্টঃ

১. পাকিস্তান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু আগ্রহীই না, তারা এবিষয়ে নাক গলানো বা সম্ভব হলে আরো বেশি কিছু করতে আগ্রহী।

২. পাকিস্তান ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের স্মৃতি ভুলতে অক্ষম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের সহযোগী হিসাবে যারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যুদ্ধাপরাধ, মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে পাকিস্তান সরকার আজো তাদের পক্ষেই আছে। এই পক্ষে থাকাটা শুধু নৈতিক সমর্থন নয়।

৩. বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের চাপে নিজেদের নাম পাল্টালেও তারা প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তানের একটি এক্সটেনশন মাত্র। বাংলাদেশে জামায়াতের ব্যাপারে পাকিস্তানের সার্বিক সহযোগিতা আগের মতোই অব্যাহত আছে।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর জামায়াত নিষিদ্ধ হলে পাকিস্তান সরকার গোলাম আজমসহ অনেক বাঙালী যুদ্ধাপরাধীকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পাকিস্তান ঐ সময়ে আত্মগোপন করে থাকা জামায়াত-পিডিপি-নেজামে ইসলাম-মুসলিম লীগের সদস্যদের তো বটেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)-এর মাধ্যমে চীনপন্থী কমিউনিস্টদেরকেও অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য লজিস্টিকস দিয়ে গেছে (দেখুন Zulfi Bhutto of Pakistan : His Life and Times, Stanley Wolpert)। ১৯৭৪ সালেও আবদুল হকদের দলের নামে পূর্ব পাকিস্তান ছিলো এবং ঐ বছরের ১৬ই ডিসেম্বর তারা ভূট্টোর কাছে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চেয়ে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে। সুতরাং বলা যায় পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে জড়িত।

সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ রাজনীতি করার অনুমতি পেলে তাদের পুনর্গঠনের সময় পাকিস্তান ধাপে ধাপে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছে। বিশেষত, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীদের যে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ দেয় তার হাতেনাতে ফল ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানিয়েছেন, “আশির দশক থেকে ধাপে ধাপে প্রায় সাত হাজার জামায়াত নেতা ও জঙ্গিকে আইএসআই আফগানিস্তানে পাঠায় তালিবানের কাছে প্রশিক্ষণের জন্য”।

আশ্রয়-প্রশ্রয়, অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান জামায়াতসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলামী সন্ত্রাসী দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই গত এক বছরের বেশি সময়জুড়ে সারা দেশে জামায়াত-শিবির যে ভয়াবহ সন্ত্রাস, হত্যা, জখম, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তার নৈতিক দায় পাকিস্তানের ওপরও বর্তায়।

২০১০ সালে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১,৫২৪ কোটি টাকা। এই পরিমাণটাকে মোটামুটি অপরিবর্তিত আছে ধরলে বলা যায় প্রতি বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানকে বাড়তি দেড় হাজার কোটি টাকা করে দিয়ে যাচ্ছে আর পাকিস্তান বাংলাদেশে সন্ত্রাস রফতানী করে যাচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের টাকাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানী করা বন্ধ করলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই বাড়তি দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যবহার হওয়া বন্ধ হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে বলা হতো, জাপানে রফতানী করা কয়লা আর লোহা বোমা হয়ে ফেরত এসেছে। একইভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাথে করা বাণিজ্য থেকে সৃষ্ট পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশবিরোধী সন্ত্রাস হয়ে ফিরে আসছে।

পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশে জামায়াতসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী দলকে অর্থসাহায্য করার একটা সহজ উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে আমদানী-রফতানী বাণিজ্য চালানো। সেটা কীভাবে হয় তা দেখা যাক।

১. বাংলাদেশ থেকে রফতানীর মাধ্যমেঃ ধরা যাক, পাকিস্তানী মদদপুষ্ট একটা দল বাংলাদেশে একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুললো যার নাম — পাকমনপিয়ারু ট্রেডিং (পিটি)। এখন এই পিটি বাংলাদেশ থেকে যে পণ্য পাকিস্তানে রফতানী করবে তার প্রোফর্মা ইনভয়েসে তার মূল্যমান প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি উল্লেখ করবে। ফলে পাকিস্তানী আমদানীকারক ঋণপত্রের মাধ্যমে পিটি-কে প্রকৃতমূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ পাঠাতে পারবে। পিটি এই বাড়তি অর্থটা সন্ত্রাস লালনে ব্যয় করতে পারবে।

২. বাংলাদেশে আমদানীর মাধ্যমেঃ ধরা যাক প্রাগুক্ত পিটি পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানী করবে। এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানী কোম্পানীটি পণ্যের দাম প্রকৃত দামের চেয়ে কম উল্লেখ করবে। ফলে একই মূল্যে পিটি প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি পণ্য পাবে। এই বেশি পণ্যটা বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে পিটি সেটা সন্ত্রাস লালনে ব্যয় করবে।

এই দুটো হচ্ছে বৈধ উপায়ে সন্ত্রাসের ফান্ড পাঠানোর উপায়। পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য বন্ধ হলে এই উপায়গুলো রুদ্ধ হবে। বৈধ উপায়ে বাংলাদেশে ফান্ড পাঠানোর আরেকটি উপায় হচ্ছে এফডিআই বা সরাসরি বিনিয়োগ। সরাসরি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার বেশ উদার এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এইক্ষেত্রে নিয়মকানুনও বেশ শিথিল। ফলে, এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে আসলে কত টাকা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা হলো আর সেখান থেকে কত টাকা সন্ত্রাস লালনে ব্যয় হয়ে গেল সেটা বের করা অসম্ভব। এটা তো গেল ফ্যাক্টরি-ইন্ডাস্ট্রি-শোরুম দেবার ব্যাপার, এর বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচুর পাকিস্তানী আছে যারা স্রেফ ট্রেডিং হাউস চালায় প্রাগুক্ত পিটি’র মতো। অনেক ক্ষেত্রে আমদানীকারক ও রফতানীকারক একই ব্যক্তি/কোম্পানী/গ্রুপ হয়ে থাকে। এই ট্রেডিং হাউসগুলোর স্থানীয় স্টাফ সাধারণত জেনেভা ক্যাম্প থেকে আগত হয়ে থাকে, উদ্যোক্তারাও ভালো বাংলা বলতে পারে। ফলে তাদের অরিজিন নির্ণয় করা দুষ্কর। এমন বর্ণচোরা বলে এসব ট্রেডিং হাউসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা আরো কঠিন। বাংলাদেশে পাকিস্তানী এফডিআই এবং পাকিস্তানী নাগরিকদের বাংলাদেশে ট্রেডিং করা বন্ধ করা গেলে এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে সন্ত্রাসের ফান্ডিং ও স্থানীয় ট্রেনিং বন্ধ করা সম্ভব।

প্রশ্ন করতে পারেন, পাকিস্তানী সব এফডিআই বা ট্রেডিং হাউস তো এই দোষে দুষ্ট নয়। তাহলে কিছু ‘ব্ল্যাক শিপ’-এর দায়ভার বাকিদের ওপর চাপানো হবে কেন? বাংলাদেশই বা এখানে বিদেশী বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবে কেন? উত্তরটা হচ্ছে, আমাদেরকে অপরচুনিটি কস্ট হিসেব করতে হবে। কথিত ব্ল্যাক শিপদের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি, উন্নয়ন, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, জননিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে যে সমূহ ক্ষতি করছে তার পরিমাণ পাকিস্তানে রফতানী থেকে প্রাপ্ত প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা আর এফডিআই-এর কথিত ১৬,০০০ কোটি টাকার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। তাছাড়া এসব বাণিজ্যে নানা প্রকার শুল্ক-কর প্রত্যাহার বা হ্রাসকরণের ফলে সরকারের সরাসরি রাজস্ব ক্ষতি এবং ১,৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি হিসাবে আনলে মোট অপরচুনিটি কস্ট ঐ ১৮,৫০০ কোটি টাকার চেয়ে অনেক বেশি হয়। অর্থাৎ, পাকিস্তানী বিনিয়োগ বা পাকিস্তানের সাথে ট্রেড কোনটাই আমাদের জন্য লাভজনক নয়।

তাহলে কেন আমরা নিজেদেরকে, নিজের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-পরিচয়কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে পাকিস্তানের সাথে এমন অলাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবো? মাসুদ রানা’র একটা পর্বে রানা’র এমন একটা সংলাপ ছিলো, “সোহানার একটা চুলের মূল্য জ্যাক লেমনের প্রাণের চাইতে বেশি”। আমরাও বলতে চাই, “আমার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-পরিচয় অথবা বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনের মূল্য ১৮,৫০০ কোটি টাকার চেয়ে বেশি”।

(বাকি আলোচনা পরের পর্বে)

ইফতেখার আলী


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

চলুক

পরের পর্বের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

মডারেটরদের প্রতি অনুরোধঃ

একটা তথ্যগত ভুল হয়ে গেছে। এফডিআই-এর পরিমাণ ২৪,০০০ নয়, ১৬,০০০ কোটি টাকা হবে। তাই ২৬,৫০০ সংখ্যাটিও ১৮,৫০০ হবে। দয়া করে ঠিক করে দিন।

ইফতেখার আলী

দীনহিন এর ছবি

অসম্ভব যুক্তি-বেষ্টিত লেখা। ক্ষুরধার। সময়োপযোগী।

একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে যে, পাকিস্তানের পণ্য আমদানি বন্ধ করার জন্য আবেগের চেয়ে যৌক্তিক কারণের পরিমাণ বেশি।

খুব ভাল বলেছেন।

১৯৭৪ সালেও আবদুল হকদের দলের নামে পূর্ব পাকিস্তান ছিলো এবং ঐ বছরের ১৬ই ডিসেম্বর তারা ভূট্টোর কাছে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চেয়ে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে।

কি করে সম্ভব হল? স্বাধীন বাংলাদেশে?

এই পরিমাণটাকে মোটামুটি অপরিবর্তিত আছে ধরলে বলা যায় প্রতি বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানকে বাড়তি দেড় হাজার কোটি টাকা করে দিয়ে যাচ্ছে আর পাকিস্তান বাংলাদেশে সন্ত্রাস রফতানি করে যাচ্ছে।

সুতরাং টার্মস অব ট্রেড শুধু ভারসাম্যহীনই নয়, চরম ক্ষতিকর।

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হাসিব এর ছবি

আমি একটা জিনিস জানতে আগ্রহী। শুনতে পাই ঢাকা শহরের মেয়েদের পোশাকের সিংহভাগ নাকি পাকিস্তানি কাপড় বা সেখান থেকে আনা এরকম। এই তথ্যটা কতোটা সত্যি? বিকল্প হিসেবে ইন্ডিয়ার পোশাক বিক্রির সিংহভাগে নেই কেন? এটা কি হতে পারে যে পাকিস্তান থেকে আমদানী করা এই পোশাকগুলো কোন অনানুষ্ঠিক ব্যবস্থায় আনা? অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় আনা হলে সেটা ড্যাটাতে ধরা পড়বে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো পরের পর্বে পেয়ে যাবেন, আশা করি।

ইফতেখার আলী

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

মাসুদ সজীব

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাকি আলোচনার অপেক্ষায়... চলুক

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা! চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ লেখা, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। চলুক

শব্দ পথিক

এক লহমা এর ছবি

সময়োপযোগী লেখা, দামী লেখা। গোছান লেখা।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অমি_বন্যা এর ছবি

এক কথায় অসাধারণ। অনেক তহ্যবহুল আর যুক্তি দিয়ে লেখা। দারুণ।

পরের পর্বের অপেক্ষায়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নাদেরালীর বাবা উত্তরাধিকার সুত্রে একটা কুকুর পেয়েছিল নাদেরের দাদার কাছ থেকে। নাদেরের বাবা মারা যাবার পর নাদেরই কুকুরটার মালিক হলো। কুকুরটার কাজকর্মে নাদের খুব বিরক্ত। বয়সাক্রান্ত ঘেয়ো কুকুরটা সারাদিন নালা নর্দমার ময়লার স্তুপে ঘুরে বেড়ায়, সেই ময়লা এনে বারান্দায় ঝাড়ে। সারাদিন বারান্দা ঝাড়ু দিতে দিতে তার হাত ব্যথা। বিরক্ত হলেও পূর্বপুরুষের উপর সম্মান করে কুকুরটার সব নষ্টামি সহ্য করে নিচ্ছিল সে। কিন্তু যেদিন কুকুরটা একটা খোলা পায়খানার গর্তে নেমে সেই ময়লা সহ নাফিসের বাসার ড্রইংরুমের কার্পেটের উপর এসে বসে পড়লো তখন আর সহ্য হলো না। পূর্বপুরুষের মায়ার গুষ্টি কিলাই বলে হাতের চ্যালাকাঠ দিয়ে কুকুরটাকে তাড়া করে ভাগিয়ে দিল।

পাকিস্তানের মতো একটা কুজাতের সাথে সম্পর্ক রাখাটা আমার কাছে নাদেরালীর ঘেয়ো কুকুরের সাথে সম্পর্ক রাখার মতো। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা একেকজন নাদেরালী হলেও, আমাদের সরকার কি নাদেরালীর চ্যালাকাঠ হাতে নিতে পারবে?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তানিম এহসান এর ছবি

প্রতি বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানকে বাড়তি দেড় হাজার কোটি টাকা করে দিয়ে যাচ্ছে আর পাকিস্তান বাংলাদেশে সন্ত্রাস রফতানী করে যাচ্ছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের টাকাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঙালী এইটা বুঝতে পারলে ভালই হইতো।

পরের পর্ব আসুক।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

স্যাম এর ছবি

চলুক চলুক

তানজিরুল আজিম  এর ছবি

কোন কোন পণ্য পাকিস্তান থেকে আসে, এবং কোন কোন সেক্টরে ঘাটতি আছে সে ব্যাপারে জানা যাবে কি? আমার মনে হয় পাকিস্তানের সাথে এসব সেক্টরে ব্যাবসাপাতি গুটিয়ে নেয়া খুব সম্ভব।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

চলুক

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ!!! হাততালি

সুবোধ অবোধ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।