অরগ্যানিক ইলেক্ট্রনিক্সঃ ভবিষ্যতের পরশ পাথর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৮/০৫/২০১৪ - ১২:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডিসক্লেইমারঃ মলিকিউল-এটম এর বাংলা 'অনু-তারেকানু' লিখবো কিনা কিংবা এমরফাস শব্দটির সঠিক বংগানুবাদ 'জগাখিচুরি' আর ক্রিস্টালাইন শব্দটির বংগানুবাদ 'লাইনে-আসা-সুশীল' হবে কিনা এসব নিয়ে বিস্তর ভেবেছি, কোন কুলকিনারা করতে পারি নি। তাই অনেক শব্দের বংগানুবাদ করিনি, যেগুলো যেভাবে করেছি সেগুলো ভাল নাও হতে পারে। সেজন্যে দুঃখিত। পরামর্শের দুয়ার খোলাই রইলো।
সকাল ৬টা পঁচিশ, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০৩৬।

ঘুম ভাঙ্গলে কেমন একটা সুখের অনূভুতি হয়। চোখ মেলে প্রথমেই চোখ যায় শিলিং এ জ্বলজ্বল করা এই এত্তবড় এলার্মটার দিকে; লাল আলোর এই বড় বড় সময়-দিন-তারিখ গুলো যখন শিলিং-এ ভেসে ওঠে, কেমন একটা ধোঁয়াটে আচ্ছন্নতা ভর করে চোখে। আর শব্দটা নিঝুম কোন এক বনের গহীনের ঝরণার কলকল শব্দে বয়েচলা স্রোতের; সাথে অনেকগুলো ভোরের পাখির ডাক। এমনি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে তাই ভালই লাগে। অবশ্য বেশিক্ষণ এভাবে এমন করে থাকা যায় না, উঠে পরতে হয়। উঠে বসা না পর্যন্ত আবার এটা বন্ধ হয় না বরং মিনিট পনের পরে শব্দ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হয় যে না উঠে আর পারা যায় না। তখন লেখাগুলো মিলিয়ে যায় শিলিং থেকে। এরপর যেটা শুনি সেটা আমার মেয়ের কন্ঠঃ 'সুপ্রভাত বাবা'। বাথরুমের আয়নায় উঁকি দিলেই একটা সুপ্রভাতের ইমোটিকন ভেসে আসে আর সাথে এই মিষ্টি স্বরটা। আজকের দিনের জরুরী বেশ কিছু কাজকর্মের সময়-ক্ষণও মনে করিয়ে দেয় আয়নাটি, সাথে আজকের দিনের আবহাওয়া বা সংবাদ শিরোনাম। আয়নাটাতে আঙ্গুলের স্পর্শে অবশ্য আমি পাতা উল্টে খেলার পাতাটায়ও চোখ বুলিয়ে নিই একবার। চোখের ইশাড়াতেও করা যায় এখন এসব। আমি পারি না; আমার মেয়ে বকে আমাকে। বলে, বাবা, তুমি বড্ড সেকেলে, আঙ্গুলের স্পর্শের সেই আমল কি আছে এখনও! আমি হাসি। কি আর বলবো ওকে, সেই এক সময় ছিল যখন বাসায় টেলিফোনই ছিল একমাত্র যোগাযোগ; তারপর এল মোবাইল আর এরপর সেই মোবাইলে কি-প্যাড, টাচ-স্ক্রিন, ভয়েস নেভিগেটর কত কি সব যে এল একে একে! আর আজ এই রেটিনা নেভিগেশন। আমি বন্ধ করে রেখেছি অপশনটা। আমার মেয়ে কেমন করে যেন পারে সব। আসলেই, আমি বড্ড সেকেলে।

আবার এই যেমন এই কলটা। এটার গায়েও পানির তাপমাত্রাটা জ্বলজ্বল করে; দরকার হলে এর টাচস্ক্রিনে উপরে-নিচে চেপে ইচ্ছেমত তাপমাত্রাটা বাড়িয়ে-কমিয়ে নেয়া যায়। আমার মনে পরে, এইতো বছর পনের-বিশই হবে বড়জোড়, তখন কলের সাথে ছিল দুটো হাতল, ঠান্ডা আর গরম পানির জন্যে; হাতল দুটো উপর-নিচ করেকরে আর বারবার পানি ছুঁয়ে তাপমাত্রাটা সহণীয় করে নিতে হত, আর এখন!

এখন সবই পাল্টে গেছে কেমন। ফ্রিজটার দেয়ালটা ভিতরে কোনটা কতটুকু আছে তার হিসেব দেখাচ্ছে নিয়মিত; আমার দেখতেও হয় না। কিছু একটা শেষ হতে হতেই আমার মোবাইলে রিমাইন্ডার চলে আসে, 'ইয়েস' টিপে দিলেই সুপারশপ থেকে সপ্তাহান্তে সেগুলো দিয়ে যায় বাসাতে। গাড়ির সামনের কাঁচটা কিংবা ডায়নিং টেবিলটা বা জানালার কাঁচগুলো সবই এখন 'স্মার্ট'। ঐদিন পিকনিকে তো আস্ত একটা ৪০ ইঞ্চি টিভি পেপারের মত রোল করে নিয়ে এসেছিল অন্তু। অবাক হইনি তেমন, এখন এমনসব প্যাঁচানো 'ফ্লেক্সিব্যাল ইলেক্ট্রনিক্স' হরহামেশাই দেখছি। সোলার পাওয়ার্ড, ওয়াই-ফাই কানেক্টেড এইসব ডিভাইসগুলো। সিলিকন যুগ শেষই হয়ে গেল তাহলে!

নিশ্চয় ভাবছেন, গাড়ির কিংবা জানালার কাঁচ, ডায়নিং টেবিল বা ফ্রিজের দেয়াল, শিলিং বা কল- এগুলোর কোনটাই তো 'মনিটর/স্ক্রিন' না, এগুলোর কোনটা দিয়েই তো আর মনিটর/স্ক্রিন বানানো যায় না। তাহলে ২০৩৬ সালের এই গাঁজাখুড়ি গল্পের মানে কি? আর ৪০ ইঞ্চি আস্ত একটা টিভি/মনিটর পেপারের মত রোল করে প্যাঁচিয়ে হাতে নিয়ে নেয়া! এটা তো কোন সাই-ফাই মুভিতেও দেখি নি! আসলেই গাঁজাখুড়ি মনে হচ্ছে? তাহলে এবার লাইনে আসি।

আপনি তো জানেন যে কোন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বানাতে হলে সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ-পরিবাহিতা (কন্ডাক্টিভিটি)। কাগজ, কাঁচ, কাঠ, দেয়াল বা ফ্রিজের দেয়াল- এগুলো সবই বিদ্যুৎ অপরিবাহি (ইন্সুলেটর)। এগুলো দিয়ে তাহলে অন্তত আর যাই হোক, কোন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বানানো সম্ভব না। কিন্তু যদি এদেরকে বিদ্যুৎ পরিবাহি বা বিদ্যুৎ উপ-পরিবাহি (কন্ডাক্টর বা সেমিকন্ডাক্টর) বানানো যায়, তাহলে? তাহলে হয়ত হত কিন্তু আপনি ঠিকই ধরেছেন; সেটাও আসলে সম্ভব না। কিন্তু উপায় একটা তো বের করতেই হবে, নাহলে যে গল্পটা এখানেই শেষ! আচ্ছা ধরুন, যদি এমন 'একটা কিছু' তৈরী করা যায় যেটা অনেকটা 'রং' এর মত; তরল ঠিকই কিন্তু বিদ্যুৎ পরিবাহি বা বিদ্যুৎ উপ-পরিবাহি (সেমিকন্ডাক্টিং বা কন্ডাক্টিং) আর স্বচ্ছ (ট্রান্সপারেন্ট)। এখন সেই 'রং'টার একটা প্রলেপ যদি দেয়া যায় এইসব কাঠ/কাঁচের উপর তাহলে কিন্তু কাঠ কাঠই থাকলো আর ঐ প্রলেপ দেয়া আস্তরটা হয়ে গেল, ধরে নিন, বিদ্যুৎ উপ-পরিবাহি, মানে সেমিকন্ডাক্টর। যদি আসলেই এমন কিছু হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আমরা সেটা দিয়ে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বানানোর ব্যাপারটা চিন্তা করতে পারি, কি বলেন? আশাকরি, এবার আর গল্পটাকে গাঁজাখুড়ি মনে হচ্ছে না। এই 'রং'টাই আমাদের এই গল্পের প্রাণ-ভোমড়া। এই সেই পরশ পাথর যা আসছে ভবিষ্যতে রাজত্ব করতে যাচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স দুনিয়াতে আর পাল্টে দিতে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাত্রা, এমন কি শুরুও হয়ে গিয়েছে এর পথচলা।

গল্পটা তাহলে একদমই গোড়া থেকে শুরু করা যাক।

যেকোন বস্তু, হোক তা কঠিন তরল বা বায়বীয়, বিদ্যুৎ পরিবাহিতার দিক থেকে হতে পারে কন্ডাক্টর, সেমিকন্ডাক্টর বা ইন্স্যুলেটর। এখানে তাপ পরিবাহিতার কথা বলছি না, সে ভিন্ন গল্প। এখানে কেবল বিদ্যুৎ (আসলে ইলেক্ট্রন) পরিবাহিতার কথা বলছি। যদিও এরা একেবারে যাকে বলে মাসতুতো ভাই, তারপরও আমাদের প্রত্যেকের মতই গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্নই। কোন একটি বস্তুর এই পরিবাহিতার (কন্ডাক্টিভিটি) মাত্রাটা পরিবর্তন হতে পারে পারিপার্শিকতার পরিবর্তনে; যেমন তাপমাত্রা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের অতি পরিচিত সিলিকনের কথা, এটি একটি সেমিকন্ডাক্টর। সেমিকন্ডাক্টরের ধর্ম অনুযায়ী, তাপমাত্রা বাড়ালে সিলিকনের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বাড়ে। আবার এই সিলিকনের সাথে অক্সিজেনের মিল-মহব্বতে তৈরী সিলিকন-অক্সাইড কিন্তু একটি ইন্স্যুলেটর; তাপমাত্রার পরিবর্তনে এর পরিবাহিতার কোনই পরিবর্তন হয় না। যাই হোক, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (রুম টেম্পারেচার, ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সিলিকনের এই আধা-আধি পরিবাহিতার আসলে তেমন কোন উপযোগীতা নেই। এই তাপমাত্রায় লোহা বা তামা এর চেয়ে অনেক-অনেক বেশি পরিবাহী, আমাদের বাসার সব বৈদ্যুতিক তারগুলো বা ল্যাপটপের চার্জার যেমন আর কি। কিন্তু একটা বিশেষ উপায়ে এই প্রায় শত ভাগ খাঁটি সিলিকনের পরিবাহিতা স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই অনেক বেশি বাড়ানো যায়; মানে কিনা, এতে ইলেকট্রনের স্রোত বাড়ানো যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ইচ্ছেমত। এই পদ্ধতিটাকে বলে ডোপিং; আদতে এটি খাঁটি সিলিকনের সাথে সামান্য একটু ভেজাল মেশানোর পদ্ধতি। এর মাধ্যমে অল্পেকটু ভেজাল মিশিয়ে সিলিকনের কোন অঞ্চলকে 'ইলেক্ট্রনপূর্ণ' আর কোন অঞ্চলকে 'ইলেক্ট্রনশুন্য' করা যায়; কি ভেজাল মেশানো হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে এই 'ইলেক্ট্রনপূর্ণ' বা 'ইলেক্ট্রনশুন্য' অঞ্চল তৈরী হয়। এখন ধরুন, এই দুটো ইলেক্ট্রনপূর্ণ' আর 'ইলেক্ট্রনশুন্য' অঞ্চল পাশাপাশি রাখা হয় তাহলে তো 'পূর্ণ' থেকে 'শুন্য'তে ইলেক্ট্রন যাওয়ার কথা। বলতে চাচ্ছি এই যে, যেখানে অনেক বেশি ইলেক্ট্রন আছে সেখান থেকে ইলেক্ট্রন স্রোত যেখানে ইলেক্ট্রন নেই বা ঘাঁটতি আছে সেদিকটাতে হওয়ার কথা, সেন্স তো তাই বলে; পানি যেমন গড়িয়ে যায় আর কি। পানির স্রোতের এই গড়ানোটা উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গার দিকে হয়; উচ্চতার পার্থক্যের কারণে পানি উপর থেকে গড়িয়ে নিচে পরে। তেমনই ইকেক্ট্রনের গড়ানোটা, মানে ইলেক্ট্রন স্রোতের পরিবাহিতা ইলেকট্রনপূর্ণ আর শুন্য-এই দুই অঞ্চলের ভোল্টেজ পার্থক্যের কারণে হয়; যতক্ষণ এই ভোল্টেজ পার্থক্য বজায় থাকে ততক্ষণ এই পরিবাহিতা চলতে থাকে। দুই অঞ্চলের এই ভোল্টেজ পার্থক্য যত বেশি, পরিবাহিতাও তত বেশি।

এই ভোল্টেজ পার্থক্যটা আসলে আর কিছুই না, বৈদ্যুতিক শক্তির পার্থক্য। উদাহরণ হিসেবে আমরা নিত্তদিনের ব্যবহার্য 'পেন্সিল' ব্যাটারির কথা চিন্তা করতে পারি। পিচ্চির খেলনাটাতে ব্যাটারির দু'মাথা (পজেটিভ আর নেগেটিভ প্রান্ত) তারের দু'মাথায় লাগিয়ে দিলে এটা দিব্বি প্যাঁপো করে আর লাল-নীল বাতি জ্বালিয়ে যায়। মানে কিনা, ব্যাটারিটার মধ্যে থাকা ক্যামিক্যালগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে শক্তি উৎপন্ন করে আর তারের মাধ্যমে সেই রাসায়নিক শক্তিটা বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত হয়ে খেলনাটার ভিতরের বৈদ্যুতিক কম্পনেন্টগুলোর মধ্যে ভোল্টেজ পার্থক্য তৈরী করে চলে। কিন্তু যখন আর কোন ক্যামিক্যাল রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য অবশিষ্ট থাকে না, তখন আর কোন শক্তিও উৎপন্ন হয় না তাই কোন ভোল্টেজ পার্থক্যও তৈরী হয় না আর সেজন্যেই প্যাঁপো করাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন শুরু হয় পিচ্চির কান্না, সেকি কান্না। তখন শীতের রাত, প্রায় ১১টা ছুঁইছুঁই। এই কান্না থামানোর একটাই উপায়, ব্যাটারি কিনে আনা। মেয়েটার কান্নাটা যে আমার আবার একদমই সহ্য হয় না! বড় মায়া! তাই বাধ্য হয়ে চাদরটা পেঁচিয়ে বের হতে হয়। যাক, সে অন্য গল্প। ঐদিকে না যাই, লাইনে আসি।

এতক্ষণে ভালই বুঝতে পারছেন যে, এই ভোল্টেজ আর ডোপিং এর মাধ্যমে যেহেতু ইলেকট্রনগুলোকে বশীকরণ করাই যাচ্ছে, তাহলে তো এবার এদেরকে অনেকভাবে কাজে লাগানো যায়, কি বলেন! এই মহার্ঘ্য পেলে ঐসব মানুষগুলো, ঐ যে যারা এলোমেলো চুলের, পাগলা-পাগলা দেখতে, কেমন যেন যা দেখে সেদিকেই অবাক হয়ে তাকায়, সব সময় কি যেন কি ভাবে, একটু কেমন যেন ভোলা-ভালা, বোকা-সোকা, যাদেরকে আমরা বিজ্ঞানী বলি আর কি, তারা তো আর ছেড়ে দেবে না! তারা তাই ইচ্ছেমত বিভিন্ন রকম পূর্ণ আর শুন্য সিলিকন বানালো, বিভিন্ন ভাবে তাদেরকে জোড়াতালি দিল, বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন মাত্রার ইলেক্ট্রন পরিবাহিতা সৃষ্টি করলো এদিক থেকে ওদিকে আর ওদিক থেকে সেদিকে। এই নিয়ন্ত্রিত পরিবাহিতার মাধ্যমে তারা নকশা করল এমনভাবে যে যখন ইলেক্ট্রন এদিক দিয়ে যাবে তখন হবে ১ আর না গেলে হবে ০, এই ০ আর ১ দিয়ে বানানো সেই নকশার মাধ্যমে তারা ইলেক্ট্রনগুলো কে আরও চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো। আবার ঐ নকশাগুলো বিভিন্ন ভাবে জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করল এমন সব কাঠামো যেখানে এক একটা চাবি টিপলে ইলেক্ট্রনগুলো এক একটা নির্দিষ্ট ০/১ এর নকশা অনুযায়ী চলে; আর ওই নির্দিষ্ট ০/১ এর নকশাগুলোকে বইয়ের পৃষ্ঠায় ছাপানো অক্ষরের মত স্মৃতিতেও রেখে দেয়ার ব্যাবস্থা করলো তারা যাতে করে যখন খুশি ওই নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা থেকে ঐ নির্দিষ্ট নকশাটা নিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এভাবে এই নিয়ন্ত্রিত পরিবাহিতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অন্য সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রও নিয়ন্ত্রণ করে ফেললো। আর এসবে দক্ষতাও বাড়তে থাকলো তাদের দিন-কে-দিন। এক পর্যায়ে এই নকশাগুলোকে তারহীন পদ্ধতিতেই এক কাঠামো থেকে অন্য কাঠামোতে পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেললো। আর এরপরে এই তারহীন পদ্ধতির মাধ্যমে দূরের বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলোকেও নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করে ফেললো। এভাবেই এগুলো দিয়ে ঐ পাগলা মানুষগুলো করে ফেললো অনেক-অনেক-অনেক কিছু আর গোটা পৃথিবীটার চেহারাটাই দিল বদলে। খুব বেশি দিন নয় কিন্তু- এই ধরুন ত্রিশের দশক থেকে বর্তমান-একশ বছরেরও কম সময়। আর কি অভাবনীয় পরিবর্তন! আমি আসলে ট্রাঞ্জিসটর, ডায়োড, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল টেলিকমিনিকেশন আর এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রযুক্তির কথাই বলছি।

এবার একটু দম নিন। আর এই ফাঁকে মন থেকে বিনীত শ্রদ্ধার সাথে ধন্যবাদ দিন এইসব পাগলাটে চেনা-অচেনা, জানা-নাজানা মানুষগুলোকে, যারা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললো। জ্ঞানের এই শাখাতেই নয় কেবল, বরং সব শাখার মানুষগুলোকেই ধন্যবাদ দিন। ঐ পাগলাটে, ক্ষ্যাপা মানুষগুলোর উত্তরসূরীরা, যারা চেষ্টা করে চলেছে এখনও, ধন্যবাদ দিন তাদেরও। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আর মেধায় পরশ পাথর তৈরী করে যাচ্ছেন তারা, সোনা ফলিয়ে যাচ্ছেন আপনার আমার জন্যে। এই যুগে, এই সময় বেঁচে আছি আমি আপনি- কি যে সৌভাগ্য আমাদের!

যাক, এই সেই সিলিকন, সেই সেমিকন্ডাক্টর যার মাধ্যমে আমরা পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীটার চেহারাটাই বদলে দিলাম। এখন পরের প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন, কেন সিলিকন? অন্য কোন বস্তু দিয়ে কি এমন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? কেন? কেন নয়? আর সেই সাথে আমাদের গল্পের যে আসল প্রাণ-ভোমড়াটা, সেই বিশেষ 'রং'টা, সেই পরশ পাথর, সেটাকে কি করেই বা সম্ভব করে তুলবো? এসব ব্যাপারস্যাপার বুঝতে হলে আমাদের আবার একটু সিলিকনের ভিতরে ঢুকতে হবে, অনু-পরমানু-তারেকানু-কোয়ান্টাম নিয়ে কপকচানি চালাতে হবে। শুনতে যতই তারেকানু-কোয়ান্টামের মত ভারী শোনাক না কেন, কথা দিচ্ছি, আমরা খুব সহজেই ঐসব পার হয়ে যাব। তবে আজ নয়; যদি মডুদের কড়া চোখ রাঙ্গানো শেষে এটা চলে আসে আপনার কাছে তবে বাকি গল্প আমরা আগামী পর্বে করবো। এজন্যে আপনাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবো, আশাকরি ক্ষমা করবেন।

যেতে যেতে আরেকটি কথা বলে যাই। নিজের কথা, স্কুলদিনগুলোর কথা। তখন সপ্তাহে একদিন বিজ্ঞানপাতা আসতো পেপারে। আমি খুব যত্ন করে কেটে রেখে দিতাম, পড়তাম। সেখানে এটা-ওটা অনেক কিছু নিয়ে লেখা থাকতো; সব যে বুঝতাম না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু খুব অবাক বিষ্ময় নিয়ে পড়তাম, বুঝতে চাইতাম বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিকগুলোর কথা, হতে চাইতাম তাদেরই মত একজন। আর এরমধ্যে মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞান বইটা হাতে আসতেই এইম-ইন-লাইফ ঠিক হয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগে নি-পদার্থবিজ্ঞানী। আমাদের মত দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিবিএ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাটা আর সেই অনুযায়ী লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে যুদ্ধ করাটা যে কি-সেটা আমার মত যারা সেই যুদ্ধটা করে চলেছে তারাই জানে। সচলে এটাই প্রথম লেখা আর উদ্দেশ্যটা অনার্যদা কিংবা অন্য যারা বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন তাদের থেকে ভিন্ন কিছু নয় আশাকরি। যারা পড়ছেন তারা জানুন, অন্যকে পড়তে বলুন, অবাক হোন আপনি কি সৌভাগ্যবান সেটা ভেবে, ঐসব মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন এবং কেউ অনুপ্রেরণা পেয়ে এই পথে আসতে চাইলে তাকে অবশ্যই যথাসম্ভব উৎসাহ দিন।

আজ এ পর্যন্তই। ধন্যবাদ।
-স্বপ্নচারীর স্বপ্ন


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সিলিকন যুগ শেষই হয়ে গেল তাহলে!

-এত সহজে সিলিকন জায়ান্টরা ছেড়ে দেবে না। আপনি নিজে কি অরগানিক পলিমার লাইনে জড়িত না কি? তা হলে এই বিষয়টার উপর আপনার একটা বিশেষ Soft Corner থাকবে। আর তা না হলে, আপনার সাথে এটা নিয়ে আলোচনায় বসতে পারি -আপনার থেকে কিছু শিখতে পারি। এটা আমার পছন্দের একটা টপিক। সৌভাগ্যবশত, অরগানিক ইলেকট্রনিক্স লাইনে আমার বেশ কিছুদিন 'কাজের চেষ্টা' করতে হয়েছিল। (এবং দুর্ভাগ্যবশত সবকিছু মোটামুটি শিকেয় তুলে রাখতে হচ্ছে এখন ওঁয়া ওঁয়া )

আপনার বিজ্ঞান নিয়ে সহজ ভাষায় লেখার চমৎকার প্রতিভা আছে, আপনার উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়েছি -এটা বলতেই হবে।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমেই ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। আর দুঃখিত দেরী করে জবাব দেয়ার জন্য।

ঠিকই ধরেছেন, আমি একেবারেই পলিমার এর লোক; তবে পদার্থবিজ্ঞানের দিক থেকে, বুঝতেই পারছেন হাসি একটু খোলাখুলি বললে, আমি সিন্থেটিক কেমিস্ট/অরগ্যানিক কেমিস্ট নই, ঐ দিকটা আমার না। আমার কাজটা মূলত তার পরের ধাপ; সিন্থেসাইজড পলিমার এর মধ্যকার কন্ডাকটিভিটির তেলেসমাতি আর তা দিয়ে বানানো ডিভাইস এর পদার্থবিজ্ঞান (পলিমার মরফোলজি এন্ড ডিভাইস ফিজিক্স) হাসি ছোট অনুগুচ্ছও (স্মল মলিকিউল) কিন্তু এই শাখার আরেকটি উপশাখা-যদিও ঐটা আমার ক্ষেত্র না।

এসব কিছু আপনি নিশ্চয় জানেন। কেন চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে একটু যদি বলতেন! আর কোথাই বা গেলেন!

আর আমার ব্যক্তিগত 'বিশেষ সফট কর্নার' দিয়ে তো কিছু যাবে আসবে না আর ঐ সিলিকন জায়ান্টরা অবশ্যই তাদের এতদিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা মাল্টি-বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি সহজে ছেড়ে দেবে না-তাতো জানাই। অরগ্যানিক ইলেক্ট্রনিক্স আসলে তো একদমই নতুন সিলিকনের তুলনায়-বছর ১৫/২০ ও হয়নি এর পথচলা; আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমানের অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্সের অবস্থান সিলিকন যুগের ৭০-এর দশক এর সাথে তুলনা করতে পছন্দ করি। সে অনুযায়ী, বছর ত্রিশ-চল্লিশ পরে এটা সিলিকনকে রিপ্লেস করবে-এটাকে ব্যক্তিগতভাবে উত্যুক্তি নয় বলেই মনে করি। এরইমধ্যে, স্মল মলিকিউল বেজড ডিভাইস কিন্তু বাজারে পাল্লা দিচ্ছে! জানেন নিশ্চয়, স্যামসাং এর সব মোবাইলগুলো কিন্তু AMOLED (Active Matrix Organic Light Emitting Diode); যদিও ডিভাইস-বেসটা অবশ্যই সিলিকন কিন্তু জায়ান্টরা এদিকে ঝুঁকছে দিন-কে-দিন। নিকন, মিটসুবিশি, স্যামসাং (এবং আরও অনেকে) প্রচুর টাকা ঢালছে এদিকটার গবেষণায়। আর এর কারণ কেবল ডিসপ্লে ডিভাইসই নয় বরং এর অন্যতম দিকটা হচ্ছে রিনিউবল এনার্জির/অল্টারনেটিভ এনার্জির। লিখবো আশাকরি এসব পর্বে পর্বে। সাথে থাকবেন নিশ্চয়।

আর ঐ যে বললেন, আমার কাছ থেকে শিখবেন, শুনে অনেক ধন্য হলাম। বান্দা কিন্তু আসলে অল্পবিদ্যার, আর ওই জন্য হয়ত খালি কলসীর মত একটু বেশিই বাঁজছি; খুব বেশি আশা করে পরে ঠকলে সুশীল উপাধি দিয়া বইসেন না আবার দেঁতো হাসি

মেঘলা মানুষ এর ছবি

জেনে ভালো লাগলো যে আপনি আর আমি বেশ কাছাকাছি লাইনের মানুষ (ছিলাম) হাসি

সে অনুযায়ী, বছর ত্রিশ-চল্লিশ পরে এটা সিলিকনকে রিপ্লেস করবে-এটাকে ব্যক্তিগতভাবে উত্যুক্তি নয় বলেই মনে করি।

-এটার সাথে বিনীতভাবে দ্বিমত পোষণ করছি।

১। ডিসপ্লে টেকনলজিতে তে পলিমার (পুরো নামটা লিখছি না, আপনি বুঝতেই পারছেন কি বোঝাতে চাইছি) শক্ত অবস্থানে আসবে; এর কন্ট্রাস্ট রেশিওর বড়তি সুবিধা, নমনীয়তা এসবের গুণে।

২। RFID শিল্পেও পলিমার কাজে দেবে বলে আমার মনে হয়।
[পাঠকের জন্য, RFID চিপ হল খুব সাধারণ একটা চিপ, যেটা আপনাদের দেখা অনেক আইডি কার্ডেও থাকে, এগুলোতে ব্যাটারি থাকে না, কিন্তু স্ক্যানারের কাছে আনলে সেটা স্ক্যানার থেকে খানিকটা শক্তি নিয়ে নিজের পরিচয়টা স্ক্যানারকে জানায়]

৩। কিন্তু, পলিমার এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে লজিকের দুনিয়ায়। আপনি সিলিকনকে রিপ্লেস করার জন্য শুধু ডিসপ্লে টেকনলজির দিকে তাকালেই হবে না, সিলিকনের অনেক বড় একটা বাজার হল লজিকের দুনিয়াটা। প্রসেসর আর মেমরির বাজারে ঢোকা পলিমারের জন্য আজও কল্পকাহিনীতেই সীমাবদ্ধ।

৪। " রিনিউবল এনার্জির/অল্টারনেটিভ এনার্জির" কথা উল্লেখ করেছেন আপনি। এটা সত্য যে, সিলিকনের আরেকটা বড় বাজার হল সৌরকোষের(Solar Cell) মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন । পলিমার দিয়ে হয়ত কিছু ফ্যান্সি জিনিসপত্র বানানো যাবে, যেমন কোথাও তাবু খটালাম, তাবুর উপরে থাকা পলিমারের বানানো সৌরকোষ আমার জন্য তাবুর ভেতরে ল্যাপটপ চার্জ দেবার ব‌্যবস্থা করবে, রাতে আলো জ্বালানোর জন্য ব্যাটারি চার্জ করবে। বড় আকারে কাজে না আসলে, এটা কি খুব একটা বড় বাজার হবে? পলিমারের বানানো সৌরকোষের স্থায়িত্ব তেমন বেশি না হওয়ায় এটা একবার ব্যবহারযোগ্য (disposable) জিনিসের বাজার থেকে এর বাইরে বেড়িয়ে আসা কঠিন। বড় আকারের সৌরখামার (Solar Farm) করা না হয় বাদই দিলাম, বাসার ছাদে বসানোর মত বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত পণ্যও আজ অবধি পলিমার দিয়েহয় নি। (@লেখক: নতুন কিছু কি হয়েছে?)

সৌরকোষ উৎপাদনের একটা বড় সমস্যা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি। ধরুন, আপনারা ১০০ জন বন্ধু মিলে একটা জিনিসকে ২০টি দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, কাজেই একেকটি দড়ি ধরে আছেন ৫ জন। কোন দড়ির এই পাঁচজনের দু'জন যদি দড়িটা কম টানে, তাহলে বাকি ৩ জনের চেষ্টার কোন মূল্যই থাকে না। তেমনিভাবে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সৌরকোষগুলো একসাথে কাজ করে, এখানে যদি কোন কোষ কাজ ঠিকমত না করে, তবে গোটা জিনিসটার পার্ফর্মেন্স এই খারাপ কোষটার মত হয়ে যাবে। একটা শিকলের সবচেয়ে দুর্বল জোড়াটাই ঐ শিকলের সর্বোচ্চ শক্তি (A chain is as strong as its weakest link),ঐ একটা জোড়া খারাপ হলে, বাকি জোড়া যতই শক্তিশালি হোক না কেন তা কোন কাজেই আসবে না।

পলিমার দিয়ে সৌরকোষ বানানো হচ্ছে, প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে, ভালো ফলাফলও আসছে, কিন্তু একই সাথে বানানো সৌরকোষগুলোের মাঝে সামঞ্জস্য (Uniformity) থাকছে না তেমন। ৫ টা সৌরকোষ দিয়ে হয়ত বানালে চলছে মোটামুটি, কিন্তু যখন আরও বেশি সৌরকোষকে একজায়গায় রেখে কাজ করানোর চেষ্টা হচ্ছে, তখনও দু'একটা বেয়াড়া সৌরকোষের কারণে বাকিদের অর্জন মাঠে মারা যায়।

৫। পলিমার এর ভেতরে ইলেক্ট্রনের চলাচলের গতি (Mobility খুব একটা ভালো না। এটা নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে সত্য, কিন্তু অগ্রগতি কি আশানুরূপ?

আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমানের অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্সের অবস্থান সিলিকন যুগের ৭০-এর দশক এর সাথে তুলনা করতে পছন্দ করি।

-এখানেও বিনীতভাবে কিছু কথা বলতে চাই। একথা আমি মানি যে, সময় দিতে হবে। একই সাথে সীমাব্ধতাটাও জানা দরকার আমাদের। সময় এবং গবেষণায় অর্থ দিলেই সবকিছু থেকে সিলিকনের মত সমান ফল বেরিয়ে আসবে না। ৭০ দশকের পরে ৮০ দশকে সিলিকন যে উন্নতি দেখিয়েছিল, সেরকম উন্নতি কি এক দশক পরে পলিমার দেখাতে পারবে? একটা স্থূল উদাহরণ দিই, ৮০ এর দশকের ঢাকা শহরের আকার যদি বর্তমানের কুষ্টিয়ার সমান হয়, তাহলে কি এটা বলা যায় ৫০ বছর পরে কুষ্টিয়া ঢাকার মত হয়ে উঠবে?

পলিমার সম্ভাবনাময়, তবে এর সম্ভাবনার সীমাও আমাদের জানতে হবে। আমি বলছি না যে সিলিকনই চূড়ান্ত জিনিস, বিকল্প আসবে অনেক জায়গায়তে যেমনটা এসেছে ডিসপ্লে শিল্পে।

@লেখক: পলিমার নিয়ে (এবং একাডেমিক অসাধুতা নিয়ে) সচলে একটা লেখা এসেছিল ফেব্রুয়ারি ২০১২ তে। না পড়ে থাকলে পড়ে দেখতে পারেন, কাহিনী হয়ত জানেন। আগ্রহী নতুন পাঠকদেরও পড়তে পরামর্শ দিচ্ছি, লেখাটা সুপাঠ্য ছিল। একাডেমিক পাবলিশিং )

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন লিখেছেন! অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাথে তো এই লিখে লিখে হবে বলে মনে হচ্ছে না, একসাথে বসে একটু চা-কফি হত, আর তার সাথে দুনিয়া উদ্ধারে লেগে যেতাম আমরা-তা'লেই না জমত!

যাই হোক, শুরুতেই বলি, আপনি কেন আমাদের এই অরগ্যানিক শাখা ছেড়ে চলে গেলেন আর কই বা গেলেন জানালেন না কিন্তু! কেবল আগ্রহের বসেই জানতে চাচ্ছি, জানাতে না চাইলে থাক।

বেল-কলঙ্ক আর ঐ ব্যাটা শুন, মনে হয় এই অরগ্যানিক ইলেক্ট্রনিক্স জগতটার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে রইলো। যা ক্ষতি করার করে দিয়েছে; এখন তাই কমিউনিটির সবাই ই এর ভবিষ্যত নিয়ে সামান্য ভাবতেও দ্বিধায় ভোগে।

সৌরকোষের সাথে শেকলের এনালজিটা দিয়ে মনে হয় সিরিজ সার্কিট বোঝাতে চাইলেন, নাকি?

যাক আসল কথায় আসি। খুব ভাল practical উদাহরণ দিয়েছেন, সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। দারুন! আমি আপনার সাথে বিনীতভাবে দ্বিমত পোষণ করছি বেশ কয়েকটা জায়গাতে আর আমি আমার অবস্থান আরেকটু ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

সিলিকনের আজকের এই মজবুত অবস্থানের কারণগুলো একটু মনে করি। ত্রিশের দশক থেকে শুরু হওয়া তত্বীয় কোয়ান্টাম বিদ্যা আর তার ব্যাখার জন্য উচ্চতর (তম?) গণিতের আবির্ভাব- এই কারণেই পঞ্চাশ/ষাটের দশকে সলিড এস্টেট ফিজিক্সের পথচলা শুরু। এটি মজবুত হল যখন আর কাগজে কলমে না, সত্যিকারার্থেই অনু-পরমানুর ভিতরে ঢুকে দেখার কৌশল আয়ত্বে আসলো (ক্রিস্টালওগ্রাফি, ষাটের দশকের শেষের দিকে)। আবার, ইতমধ্যে তত্বীয় আর পারীক্ষাগারের (lab-based) ডায়োড-ট্রানজিস্টার ইত্যাদি বাস্তব দুনিয়াতে আসলো তখনই যখন ম্যাস-স্কেকে ক্রিস্টালাইজড সিলিকন তৈরী করার জ্ঞান আয়ত্বে আসলো। এরপরই সত্তরের দশক থেকে সিলিকনের উর্ধমূখিতা। ৭০ থেকে ৮০ তে সিলিকনের উন্নতির কারণ তাই তার পেছনের ৩০ থেকে ৭০- চল্লিশ বছরের ঘাম। ঐ সময়টা সিলিকনের উন্নতি জ্ঞানের অনেকগুলো শাখার মিলিত ফল! সংক্ষেপে, ঐ সময়টা এর উন্নতি দেখা গেছে এই জন্য যে, ১) ততদিনে দারুন এক তত্বীয় জ্ঞানের ভিত্তি পেয়েছে সেমিকন্ডাংটিং/ সলিড এস্টেট ফিজিক্স, ২) পরীক্ষাগারে সিলিকন-বেজড গবেষণাগুলো দারুন ফলাফল দেখিয়েছে সফল পুনঃউৎপাদনে (successful reproduciblity) আর ৩) ততদিনে ইন্ডাস্ট্রি-স্কেলে ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও কৌশল ( engineering & technology) আয়ত্বে চলে এসেছে।

এবার আসি, অরগ্যানিক ইলেকট্রনিক্স কোথায়। এর ইতিহাসও আপনার অজানা নয়। valance band আর conduction band এর দুনিয়াতে ~1.5 eV পার্থক্য করতে পারলেই তো কেল্লা ফতে! সেই থেকে শুরু; আশির দশকের শেষের দিকে মনে হয়। এই প্লাস্টিক ইলেক্টিট্রিসিটির নোবেল আসলো ২০০০ এ। ৯০-এর শেষের দিকটাতে এটি আসলে অনেকের জন্য আকর্ষনীয় হয়ে উঠে। ১৪'তে এটি সে অর্থে তরুন হাসি অবশ্যই মানছি, সিলিকনের তরুন বয়সে সিলিকন ফাটিয়ে দিয়েছিল! এ এখনও কিছুই করতে পারলো না (?) হাসি আসলে, ঐ ~1.5 eV পার্থক্য করতে গিয়ে দেখা গেল এতো অসাধ্যি! একে তো কোনমতেই লাইনে আনা যাচ্ছে না! আর তাই ঐ সলিড স্টেটের তত্ত্বগুলো আর কাজে আসলো না। নতুন তত্বের দরকার। বেশ কয়েকটা মডেল যদিও আছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন একক তত্ব এটা ব্যাখ্যা করতে পারছে না। এটা একটা দিক। কম্পিউটার মডেলিং করা এই তত্বীয় জ্ঞানের আরেকটা দিক। এরপর সেটাকে যথাসম্ভব ভেজালমুক্ত করে পরীক্ষাগারে বানানো-অরগ্যানিক সিনস্থেসাইজিং-সেটা আরেকটা দিক। কিভাবে অনু-পরমানুগুলো 'বিন্যস্ত' আছে সেটা ঐ monomer এর ভিতরে ঢুকে দেখা এবং বোঝা আরেকটা বড় দিক। এই nano-scale এর বিন্যস্ততা বাহ্যিক কি কারণে পরিবর্তন হয় সেটা বোঝা আবার আরেকটা দিক। mesoscale laboratory processing (spin coating etc) একটা বড় দিক। এত কিছুর পর হচ্ছে এ দিয়ে তৈরী ডিভাইস ও তার ফিজিক্স; যেমন, সৌরকোষের জোড়াতালি, efficiency; ট্রাঞ্জিসটরের mobility,reliability; logic gate, memory ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তারও পরে mass-scale production এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, কৌশল ও প্রযুক্তি আয়ত্বকরণ। তাই practically speaking, দিল্লী আসলেই বহু দূর!

উপরের প্রত্যেকটা দিক বিবেচনায় সিলিকন এমন দারুনভাবে উৎড়ে গেছে যে তার সাথে এই পলিমার/অরগ্যানিক বস্তুগুলোর পাল্লা দেয়াটা যে কি-তা এর সাথে জড়িতরাই জানি! কি বলেন! হাসি (আমি কেন ৭০' এর দশকের সাথে তুলনা করছিলাম আশাকরি বুঝতে পারছেন।) কিন্তু এর সম্ভবনার সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে আমনার সাথে দ্বিমত করছি। সিলিকনকে পলিমার/স্মল মলিকিউল গোটা ৪০ বছর পরে রিপ্লেস করবে-এই ভবিষ্যতবানীর এদিক-ওদিক হতেই পারে, পুরোপুরি করবে কিনা কিংবা কোন কোন সেক্টরে করার সম্ভবনা বেশি সেটা আপনি ভালই তুলে ধরেছেন। কিন্তু একেবারে করতে হলে, অবশ্যই ০/১ এর খেলা দেখাতে হবে পলিমার/স্মল মলিকিউলকে-তাতে কতদিন লাগতে পারে সে ব্যাপারে তর্কও হতে পারে। কিন্তু এর সম্ভবনার সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে বলতে চাইঃ এই মুহূর্তে উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন দিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে এটা এখনই বলা যাচ্ছে না যে সীমাটা কোথায়! এ দিয়ে আদৌ কতদূর যাওয়া সম্ভব! হাসি

ব্যক্তিগতভাবে আমি ওমন সীমা পছন্দও করব না। বছর ৮০ আগেও কে জানতো, আইন্সটাইনের general relativity এর সেই prediction, মানে কিনা gravitational lensing, সেটাই একদিন হবে extraterrestrial planet/exo-planet খোঁজার অন্যতম শক্ত হাতিয়ার। হাসি

ধন্যবাদ।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

হুম, সামনা সামনি আলোচনা করতে পারলে ভালো হত।

সে যাই হোক, ভবিষ্যতে অনেক কিছুই হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সেটা আপনি-আমি অনুমান করতে নাও পারি। একটা বড় 'বিস্ফোরক উদ্ভাবন' (Breakthrough) যে কেন ক্ষেত্রেরই পুরো চেহারা পাল্টে দিতে পারে। হয়ত, কয়েক বছরের মধ্যেই কেউ একজন সাংঘাতিক রকমের ভালো উদ্ভাবন নিয়ে সামনে চলে আসতে পারে।

"সৌরকোষের সাথে শেকলের এনালজিটা দিয়ে মনে হয় সিরিজ সার্কিট বোঝাতে চাইলেন, নাকি?"
- ঠিক তাই, ভাবলাম উদাহরণ নিয়ে আসলে হয়ত পাঠকের সুবিধা হবে।

এবার পলিমার থেকে পালিয়ে যাওয়ার গল্পটা বলি।
"আমি সিন্থেটিক কেমিস্ট/অরগ্যানিক কেমিস্ট নই, ঐ দিকটা আমার না। আমার কাজটা মূলত তার পরের ধাপ; সিন্থেসাইজড পলিমার এর মধ্যকার কন্ডাকটিভিটির তেলেসমাতি আর তা দিয়ে বানানো ডিভাইস এর পদার্থবিজ্ঞান " -আমার বর্ণনাটাও হুবহু এক ছিল। তবে, দুর্ভাগ্যবশত যেসব জৈব রসায়নবিদদের (অরগ্যানিক কেমিস্ট) সাথে কাজ করতাম, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল: আমরা নতুন কোন পলিমার বানাতে পারছি না, পুরোনোগুলো (যেগুলো বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়) উপর আমরা একটা 'ম্যাজিক লেয়ার' দিয়ে কেল্লাফতে করে ফেলব। তাদের প্রথম পছন্দ ছিল PEDOT যেটা আপনি জানেন এসব কাজের জন্য অতিরিক্ত রকমের বেশি পরিবাহী! (এবং আমার ভাষায় অনুপযোগী, PEDOT তো আসলে ধাতুর পরিবর্তে ব্যভার করা ) তাদের প্রধান মনযোগ ছিল অন্যান্য প্রকল্পে। কাজেই তাদের আজ করব, কাল করব -এসব এ বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তখন। কয়েকবার অবশ্য গোল্ড প্লেটেড স্লাইডের উপর তারা পলিমার ফিল্ম বানিয়ে দিয়েছিল, তবে আসক্তি (Adhesion) না থাকার কারণে ওগুলো আলাদা (De-laminate) হয়ে গিয়েছিল। ডিভাইস হাতে না থাকায় এর 'ডিভাইস এর পদার্থবিজ্ঞান' নিয়ে কোন কাজ করার সুযোগই ছিল না। তারপর, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে ... ... এক্ষেত্রে দোষটা পলিমারের না, ওদের ঔদাসীন‌্যই আমাকে বিরক্ত করে ফেলেছিল। আর, ওরা অন্য কাজে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকায়, এদিকটায় অগ্রগতি শূন্যই ছিল।

ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

এদিকটা ছেড়ে চলে যাওয়ার বিস্তারিত শুনে খারাপ লাগছে, দুঃখিত।

অরগ্যানিক কেমিস্টদের উপর আমাদের নির্ভরতা এদিকটার গবেষণায় একটা বিশেষ দুর্বল দিক। তাদেরও দোষ দেই না আসলে, ভেজালমুক্ত পলিমার/মনোমার পরীক্ষাগারে সিন্থেসিস করাটা তো চাট্টিখানি কথা নয়!

একটা অভিজ্ঞতা লিখি এই ব্যাপারে, আপনার এদিকটা ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখ কিছুটা হলেও কমতে পারে এটা জেনে যে, আপনি একা নন এইরকম দুর্ভাগ্যের মন খারাপ

আমার এক সহকর্মী প্রায় পাঁচ/ছ মাস একটা নতুন সিন্টেথেসাইজড ফ্লুরিনেটেড স্মল মলিকিউল নিয়ে কাজ করছে; ওর কোলাবরেটর ক্যামিস্টের বানানো। কিন্তু কিছুতেই স্পিন-কোটিং করে (বা অন্য উপায়ও চেষ্টা করেছে) একটিভ লেয়ার তৈরী করতে পারছে না। এতদিন পরে এসে জানতে পারছে যে, সাইড চেইনের অক্সিজেন এবং/অথবা ফ্লুরিন হয়ত মনমারটাকে প্যাঁচিয়ে থাকে, তাই খুব লো কন্সেন্ট্রেশনে সলিউশন তৈরী করা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সাবস্ট্রেটের উপর (কাঁচ, সিলিকন) ডি-ওয়েটিং এর কারণে লেয়ার হচ্ছেই না। ছ'মাস মাঠে মারা যাওয়ার অবস্থা এখন। হাল ছাড়ে নি যদিও এখনও, তবে অনেক হতাশ।

ভাল থাকুন।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আপনার সহকর্মীর ঘটনা শুনে অতীতটাই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল!
আশা করছি, ওর পলিমার শীগগিরই 'ওয়েট' হয়ে যাবে কোন একদিন।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

এটম = অনু , মলেকিউল = অনুগুচ্ছ, এমরফাস = নির্দিষ্ট আকৃতি/গঠনহীন, ক্রিস্টালাইন = কেলাশিত (এটা আমার বানানো নয়। কোন এক বইতে পড়েছিলাম) কেমন হয়?

সোহেল লেহস

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

মলেকিউল = অনুগুচ্ছ নাকি পরমাণু?

____________________________

এক লহমা এর ছবি

একটু ঘেঁটে গেছে। সোহেলের মন্তব্যে আমার মন্তব্য দেখো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

পরামর্শের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

আসলে, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাংলা ব্যবহারের দোহাই দিয়ে একটা লেখাকে আরোও কঠিন না করাই বরং ভাল। আমি বলছি না বিজ্ঞান শব্দটাকে সায়েন্স লিখতে কিন্তু আমি চেয়ারকে চেয়ার আর সোফাকে সোফা লিখতে (এবং শুনতে) পছন্দ করি। কেননা, কেদারা বা আরাম-কেদারা বলে আলোচ্চ্য বিষয়টা থেকে মনোযোগ সরিয়ে শব্দ আর তার অর্থ নিয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাবে-এটা যেন কিছু একটা পড়তে বসে শব্দকোষ নিয়ে লেগে থাকা। শব্দকোষ না বলে ডিকশনারি বললে মনে হয় এই মাত্র যে অনেকে একটা কেমন ধাক্কা খেল, সেটা খেত না হাসি আবার ট্রাক শব্দটির বাংলা 'চার-চাকা বিশিষ্ট ভারী যান' লেখাটাও কেমন যেন; তারচেয়ে বরং বোঝা এবং বোঝানোর সুবিধার্থে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাকই লেখা পছন্দ করব। আর সেটা অনু-পরমানুর মত বহুল ব্যবহৃত শব্দ না হলে, যেমন এমরফাস শব্দটি, সেটাকে স্ফটিকাকৃতি লিখে, একটু বুঝিয়ে দিয়ে মূল প্রসঙ্গে থাকাটাই পছন্দ করব। এর সাথে অবশ্যই দ্বিমত থাকতে পারে কারো কারো। সেজন্যে পরামর্শ আর আলোচনার দুয়ার হা-করেই খোলা হাসি

আর বিশেষ ধন্যবাদ সবাইকে এমন উৎসাহ দেয়ার জন্য।

হিমু এর ছবি

বাংলা শব্দগুলো "বহুল ব্যবহৃত" হয় না এই কারণেই। সবাই বাংলা পরিভাষা বাদ দিয়ে "সহজ" করার জন্যে ইংরেজি শব্দগুলো ব্যবহার করতে থাকে। যেন বাংলা শব্দগুলোকে বহুল ব্যবহার করার দায় পাড়ার মানুষের। পাড়ার আবুল কুদ্দুস সোলায়মান এসে শব্দগুলোকে বহুল ব্যবহার করে চিবিয়ে নরম করে দিয়ে যাবে, যেভাবে বুড়ো মানুষের পান আরেকজন চিবিয়ে দেয়, তারপর একেকজন সেটা ব্যবহার করবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন কিছুই আশা করেছিলাম, বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে হিম্ভাই হাসি লিখতে বসে এর দায় এড়াতে পারি না অবশ্যই, তাই শুরুতেই ঐটুকু বলে নিয়েছি। তাতে পাপমোচন হই নি জানি। আমি ভাষাতত্ত্বের ভ-ও জানি না তবে বাংলা ভাষার বিদেশি শব্দকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতার কারণে কিনা, নাকি ইংরেজী ব্যবহার করে 'ফুটানি' দেখানোর কারণে, নাকি আমি নিজে এ বিষয়গলো ইংরেজীতে অধ্যয়ন করেছি সে কারণে ঠিক বলতে পারছি না, তবে লিখতে বসে বাংলা ভাষা রক্ষা আর আলোচ্চ্য বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্য শব্দের ব্যবহার-এ দুয়ের মাঝে হেলতে-দুলতে হয়, বিশেষ করে এই আমার মত অ-লেখকের। এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় যদি একটু বাতলে দিতেন!

হিমু এর ছবি

তাহলে আসুন চিন্তা করে দেখি, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি (জৈব ইলেকট্রনকৌশল) কেন প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত শিশুদের জন্য সহজপাচ্য ভাষায় বর্ণনা করতে হবে? এ তো খুব স্বাভাবিক যে এই কৌশলের বর্ণনা করতে গিয়ে আপনাকে বিশেষ বস্তু, বিশেষ প্রক্রিয়া, বিশেষ ভৌত তত্ত্বের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দ কি খুব সহজ কিছু? ইংরেজি ভাষাভাষীরা কি সেগুলো রোজ রোজ পড়ে, বলে, লেখে? যদি তা না করে, তাহলে কেন বাংলায় সেগুলোকে এক ঢোঁকে গিলে ফেলার মতো সহজ হতে হবে?

পাঠক তো নান্নি বাচ্চা না। আপনি তাকে লোকমা বেঁধে মুখে তুলে খাইয়ে দেবেন কেন? পাঠককেও আপনার কষ্ট শুরুর দিকটায় ভাগ করে নিতে হবে। যখন আপনি এই জটিল বিষয় নিয়ে মোটামুটি হাজার দশেক শব্দ লিখে ফেলবেন, তখন দেখবেন প্রথম দিককার "কঠিন" শব্দগুলো শেষের দিকে এসে পুনরাবৃত্তির কারণে "সহজ" মনে হবে।

অ্যামরফাস "সহজ", আর অনিয়তাকার "কঠিন", লেখকের এই বিবেচনাই পাঠককে আলসেমির দিকে ঠেলে দেয়।

উদ্ধার পাওয়ার পথ একটাই, আপনি বাংলায় লিখতে থাকুন। যে শব্দটায় আটকে যাবেন, পাঠককেও তার দায় নিতে হবে। একা একজন ঠেলবে, বাকিরা আরাম করে বসে থাকবে, তা হবে না।

এক লহমা এর ছবি

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

চলুক
সর্বাংশে একমত। তবে কিছু কিছু বাংলা যেমন অক্সিজেনের বাংলা "অম্লজান" আর কার্বন ডাই অক্সাইডের বাংলা "অঙ্গার-দ্বি-অম্লজ" নিয়ে আমার আপত্তি আছে।

____________________________

হিমু এর ছবি

একটা জিনিস আমি ঠিক বুঝি না। কেন সবাই এই অম্লজান, যবক্ষারজান গোছের শব্দগুলোকেই বাংলা পরিভাষার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ধরে? কেন বলে না যে অ্যাকসিলারেশনের একটা মিষ্টি বাংলা করা হয়েছে ত্বরণ, ডিসিলারেশনের চমৎকার বাংলা করা হয়েছে মন্দন, ইত্যাদি ইত্যাদি?

পৃথ্বী এর ছবি

আমার কাছে অম্লযান কিংবা উদযান(Nitrogen) মোটেই বিদঘুটে লাগে না। ছোটবেলা থেকে আমরা যদি অক্সিজেনের পাশাপাশি অম্লযানও ব্যবহার করে আসতাম, তাহলে হয়ত এখন এগুলোকে দুর্বোধ্যতার উদাহরণ হিসেবে উত্থাপন করা লাগত না।

আমি মনে করি শব্দের শ্রুতিমধুরতা কিংবা বোধগম্যতা প্রভৃতি সংবেদী ব্যাপারগুলা আবাদ করতে হয়, এগুলা স্থির ও "পরম" কিছু না যে এগুলো কখনওই বদলানো যাবে না। আমরা যদি বিদেশী শব্দের সমার্থক বাংলা শব্দ প্রণয়ন ও প্রচলন করি, তবে ভবিষ্যতে হয়ত বিদেশী পরিভাষাগুলোকে বাংলায় রুপান্তরিত করার জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

হিমু এর ছবি

(যান নয়, জান, জন্ম দেয় যে) উদজান নাইট্রোজেন নয়, হাইড্রোজেন।

জার্মানরা যেহেতু রসায়নশাস্ত্রের গুরুস্থানীয়, তারা মৌলিক পদার্থগুলোর লাতিনায়িত নামগুলো সব গ্রহণ করেনি, অক্সিজেনের বদলে জাউয়ারষ্টফ (এটার বাংলা করলে অম্লজানই দাঁড়ায়, অর্থাৎ অম্ল তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় মৌল), হাইড্রোজেনের বদলে ভাসারষ্টফ (উদজান, অর্থাৎ পানি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় মৌল), নাইট্রোজেনের বদলে ষ্টিকষ্টফ (অগ্নিশিখা নির্বাপন করে যে মৌল), কার্বনের বদলে কোওলেনষ্টফ (কয়লায় থাকে যে মৌল) ব্যবহার করে।

নাইট্রোজেনের বদলে ক্ষারজান (গ্রীক ভাষায় নাইট্রন হচ্ছে ক্ষার, যা ক্ষারের জন্ম দেয় তা-ই নাইট্রোজেন, বাংলায় এটাকে যবক্ষারজান কেন করা হয়েছিলো আমি জানি না) যদি বহুলব্যবহৃত হতো, তাহলে এটাকে বাংলা পরিভাষা নিয়ে ব্যঙ্গ করার কাজে ব্যবহৃত হতো না। নাইট্রোজেন শব্দটা ক্ষারজানের চেয়ে কোনো অংশে কম কষ্টোচ্চার্য নয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

লাফাং মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

এক লহমা এর ছবি

মলিকিউল = অণু, এটম = পরমাণু

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাইদ এর ছবি

এটম এর বাংলা পরমাণু

অতিথি লেখক এর ছবি

ক্রিস্টালাইন = স্ফটিকাকৃতি?

সোহেল লেহস

অতিথি লেখক এর ছবি

ছোট বেলায় বিক্ঞানের প্রতি একটা দূর্বলতা ছিল, ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে বিক্ঞান নিয়ে কাজ করব। কিন্তু দৃষ্টি শক্তি হারানোর ফলে তা আর সম্ভব হয়ে উঠে নাই। লেখাপড়া করতে হয়েছে মানবিক বিভাগ নিয়ে। অথচ সেই দূর্বলতা আজও রয়ে গেছে। কিন্তু বিক্ঞানের সেই কঠিন কঠিন ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়। কেউ যে সেই সব কঠিন ভাষাগুলোকে এত সহজে লিখতে পারে তা ধারণার বাহিরে ছিল। অসাধারণ! পরবর্তি লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

অতিথি লেখক এর ছবি

দৃষ্টিশক্তি হারানোর কথা শুনে দুঃখিত হলাম। অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার এদিকটার প্রতি দূর্বলতা এখনও আছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। আপনার এই দূর্বলতা আজীবন থাকুক আর কাছের সবার মধ্যে এমন দূর্বলতাটা ছড়িয়ে দিন-সেটাই কাম্য হাসি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ডিসক্লেইমার পড়ে খ‌্যা খ্যা করে হাসলাম। পুরো লেখাটা পড়া হয়নি এখনো। পড়ে পরে মন্তব্য করবো। আগেই এটা লিখলাম আপনার "উইটি" ডিসক্লেইমারের জন্য। লেখার প্রতি প্রত্যাশা বেড়ে গেলো।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ হাসি লেখা পড়ে কি মন্তব্য করবেন সেই অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু প্রফেসরসাব ! হাসি

এক লহমা এর ছবি

সচলায়তনে স্বাগতম। লেখা ভাল লেগেছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। সাথে থাকুন হাসি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সচলায়তনে স্বাগতম। বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলায় লেখা এমনিতেই ভালো লাগে, ইলেক্ট্রনিক্স হলে তো আরো!! আর সহজ ভাষায় আপনার বলার ক্ষমতাও চমৎকার। হাততালি

তবে, অতি সরলীকরণ করতে গিয়েই কিনা জানি না, মাঝখানে লেখা ধোঁয়াশার মত লেগেছে - ঐ ইলেক্ট্রনিক্সের বিবর্তনের জায়গাটা। আমার জানা জিনিস, তাও মর্ম উদ্ধার করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়েছি। একটু খিয়াল কইরা, কেমন?

কিছু টাইপো ছিল - শিলিং -> সিলিং, ইশাড়া গাঁজাখুড়ি প্রাণ-ভোমড়া - সব গুলোতে র, ড় হয়ে গেছে।

লেখা চলুক।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। আসলে ঐ ঠিক ধরেছেন, একটু ধোঁয়াশাই হয়েছে হয়ত। আসলে ইচ্ছেকরেই একটানে ৮০ বছর পার করে দিয়েছি; ঐ প্যারার প্রত্যেকটা শব্দ এক একটা আস্ত পিএইচডির বিষয় কিনা! হাসি লেখতে যেয়ে তাই আর থামিনি। খেয়াল রাখবো ভবিষ্যতে।

টাইপো ধরিয়ে দেয়ার জন্ন্যও ধন্যবাদ। লেখা কি এখন পরিমার্জন করা যাবে? তাহলে ঐ টাইপোগুলো ঠিক করে দিতাম।

স্পর্শ এর ছবি

শিলিং মানে কি ছাদ বোঝাচ্ছেন? ছাদ তো সহজ সুন্দর একটা বাংলা শব্দ।
সাধারণ পাঠকের জন্য লেখায়, পরিবাহিতা, অপরিবাহী এসব শব্দের পাশে আবার ইংরেজী নামটা লিখে দেবার আসলে দরকার নেই। বাংলা নামগুলোই অর্থবহ।

লিখতে থাকুন। পরের লেখা আরো গোছানো হবে আশাকরি।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। পরের লেখাগুলো আরও গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করব। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার ঝরঝরে লেখা। আর কমেন্টগুলোও সেরকম।

শব্দের ব্যবহার নিয়ে আমার মতামতও আপনার মতই। বিজ্ঞান নিয়ে যেকোনো লেখার প্রথম শর্তই হচ্ছে explanation গুলো যেন সহজবোধ্য হয়। নয়তো অনেক ভালো লেখাও 'অলস' পাঠক মাঝপথে গিয়ে ছেড়ে দেবে। বা জোর করে বাংলা শব্দ খুজতে গিয়ে যদি লেখার ফ্লো চলে যায়, তাহলে আম ছালা দুটোই যাবে।
হিমুভাইয়ের কথায় যুক্তি আছে। শুধু সহজবোধ্যতার জন্য বাংলা শব্দ ছেড়ে ইংরেজি ব্যবহার করা উচিত নয়, কিন্তু আমার মনে হয় বিজ্ঞানের লেখায় অন্তত এ ব্যাপারে ছাড় দেয়া উচিত।

কেন?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিজ্ঞানে প্রত্যেকটা ফিল্ডেই নতুন কিছু বের করতে গেলে একটা নতুন টার্ম কয়েন করতে হয়। সাধারণত যে দেশের বিজ্ঞানীরা জিনিসটা আবিষ্কার করেন শব্দটা সেদেশের ভাষা থেকেই তৈরী হয়। অন্যান্য দেশের মানুষ সেটাকে 'নর্ম' মেনে নিয়ে ব্যবহার করে। ক্ষেত্রবিশেষে ভাষানুবাদ করা হয়ে থাকে, কিন্তু সেটা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। মোবাইল ফোনের বাংলা 'মুঠোফোন', কিন্তু কজনই বা 'মুঠোফোন' বলে?

এখন দেখুন,
অনু পরমানু নিয়েই আমাদের গুলিয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এর বাংলা কবে করা হবে? [ইলেকট্রন = তরিৎ কনিকা?] ইলেকট্রন প্রোটন তো তাও বেশ কমন জিনিস। Crystalline মানে আপনি "স্ফতিকাকৃতির" লিখলেন, আরেকজন লিখল "স্ফটিকাকার" - এরকম দশ বারোটা অসামঞ্জস্য থাকলে কিছুক্ষণ পরে অবিজ্ঞানী পাঠক কেন, বিজ্ঞানীরাও বুঝতে পারবে না কে কি বলছেন। আপনি না হয় উতরে গেলেন। আরেকজন বায়োলজিস্ট যদি Homo erectus, লিখতে গিয়ে "খাড়া মানব" লিখে ফেলে, পাঠক কোথায় যাবে?
এত তাও সহজ শব্দ। Bremsstrahlung এর তো এখনো ইংরেজিও বের হয়নি, বাংলা কবে হবে?

তাহলে উপায় কি? বাংগালি বিজ্ঞানীরা কি হুবহু ইংরেজি কপি মারতে থাকবেন ? আমি বলব - হ্যা। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন কন্সেপ্টটা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। নতুন বাংলা শব্দ কারা বানাবে? যখন একটা শব্দ বড় স্কেলে ব্যবহার করা হবে, তখন সেটা এমনিতেই দৈনিক সংবাদপত্র, সাহিত্য, কল্পবিজ্ঞানে স্থান করে নেবে। তখন প্রচলিত বাংলার সাথে খাপ না খেলে কোনো লেখক নিশ্চই বেশ ঝরঝরে একটা নাম দিয়েই দেবেন শব্দটার। Bougainvillea তখন বউ-নিয়ে-ভাগলো বা বাগান্ভালিয়া না হয়ে হবে বাগান-বিলাস।

আর যদি আমরা কিছু আবিষ্কার করি? তখন অবশ্যই সেই আবিষ্কারের নাম হবে বাংলা। আর সেটাও আশা করি ইংরেজ বাবারা দাঁত কিড়মির করতে করতে উচ্চারণ করবে।

বিশাল প্যাচাল পারলাম। সারাংশ, আপনি আপনার মত লিখেন। এমর্ফাস হোক এমর্ফাস, crystalline হোক ক্রিস্টালাইন। মানুষ পড়ে বুঝুক। তারপর হিমু ভাইয়ের সাইন্স ফিকশনে যখন কোনো পাগল বিজ্ঞানী তার মৃত্যু-কিরণ বানাবে, তখন সেটায় একটা "স্ফটিকাকৃতির" লেন্স, আর একটা "অনিয়ত" absorbing layer থাকবে। পাঠক কন্টেক্স্ট থেকে বুঝে শব্দটাকে আয়ত্ত করবে, আর ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা ক্রিস্টালাইনকে লিখবে "স্ফটিকাকৃতির".

-অভিমন্যু সোহম।

P.s. অলরেডি আছে এমন বাংলা শব্দগুলো, যেগুলো সবাই নাও বুঝতে পারে [ইলেকট্রন আসক্তি, ইত্যাদি ] এগুলো সুপার্স্ক্রিপ্ট দিয়ে নিচে এপেন্ডিক্স বানিয়ে লিস্ট করে দিলে মন্দ হয় না।

হিমু এর ছবি

ব্রেমজষ্ট্রাআলুঙের বাংলা কিন্তু চাইলেই মন্দনবিকিরণ বলা যায়। আমরা যেটা করি, তা হচ্ছে বাংলা বিকল্পের প্রচার আর প্রসার না করে ইংরেজি বা ভিনভাষার শব্দ সমানে ব্যবহার করতে থাকি। এরপর একটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর বলি, এটার বাংলাটা খটমটে শোনাচ্ছে, পাঠককে বোঝানোর জন্য তাই ই্ংরেজিটা লিখছি।

নতুন ধারণা পাঠকের কাছে যদি ইংরেজি শব্দবাহিত হয়ে গ্রহণযোগ্য হয়, বাংলা শব্দটা তখন তার কাছে "কঠিন" মনে হবে। তাই নতুন ধারণা পাঠককে বোঝানোর সময়ই বাংলা শব্দটা তাকে চিনিয়ে দিতে হবে। আমি যখন ত্বরণ ব্যাপারটা বুঝতে শিখি, তখন ত্বরণ শব্দটা দিয়েই ধারণাটা বুঝে নিয়েছি। যদি ত্বরণ শব্দটা আমাকে চেনানো না হতো, তাহলে হয়তো আমি অ্যাকসিলারেশনের বাংলা ত্বরণ দেখলে বলতাম এটা বেশি "কঠিন", বা "বিদঘুটে"। অ্যাকসিলারেশন শব্দটা ব্যবহার করে ধারণাটা পাঠকের মনে গেঁথে যাওয়ার পর ত্বরণকে বাহুল্য বলে মনে হওয়ার সম্ভাবনাই কি বেশি নয়?

অতিথি লেখক এর ছবি

হিমু ভাই,
প্রথমেই ধন্যবাদ ভাষাটাকে না আক্রমন করে যুক্তিটাকে আক্রমন করার জন্য।
মন্দনবিকিরণ শব্দটা আপনিই মনে হয় 'কয়েন' করলেন। আর এটাই আমার মূল কথা। একজন সাহিত্যিক হিসেবে আপনার যে ভোকাবুলারি থাকবে, আপনি একদম ঝট করে একটা যুতসই বাংলা শব্দ খুঁজে নিতে পারবেন, ইংরেজি শব্দটা ছড়িয়ে যাওয়ার আগে। ব্লগের যুগে একটা অপ্রচলিত ইংরেজি শব্দকে ভালো একটা বাংলা শব্দ দিয়ে রিপ্লেস করা কি খুব কঠিন হবে?
ত্বরণ শব্দটা নিয়ে একটা স্বীকারোক্তি। আমি প্রথম শব্দটা পরেছিলাম সম্ভবত "ক্রুগো" বইটায়। তখন মানে ধরে নিয়েছিলাম 'কিরণ' জাতীয় কিছু হবে। পরে যখন দেখলাম এক্সিলারেশন এর বাংলা শব্দটা এত সুন্দর, আর শব্দের পরে শব্দ দিযে কি চমত্কার ভাবে একটা গল্প বলা যায়... কী আর বলব?
আর ইংরেজির ব্যাপারে যা বললেন, আমি নিজেই সে রোগের রোগী। লিখতে গেলেও টেরও পাই না ইংরেজি শব্দগুলো কিভাবে বাক্যে ঢুকে যায় ।
আপনার কমেন্টটা পড়ে চিন্তা করে দেখলাম, বাংলা ভাষার একটা মূল শক্তি হচ্ছে নানা ধরনের শব্দকে নিজের করে নেয়া। কিন্তু যদি ইংরেজির 'সহজতার' কারণে 'গতি' হয়ে যায় 'ফ্লো', তা হলে লেখকের আর ভাষার, দুয়েরই ক্ষতি বই লাভ হবে না। তাই বলে তো বা লিখে বসে থাকব না। লিখব, ভুল হবে, আর ধরার জন্য তো আপনারা আছেনই।
-অভিমন্যু সোহম।

এক লহমা এর ছবি

আহা রে, বিজ্ঞান লিখতে হবে, আবার বাংলাতেও লিখতে হবে, এত পোষায়! ভাবেন, এইটুকু একটা মন্তব্য লিখতেই কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে! আমরা যে হতভাগারা বাংলাতেই লেখাপড়া করেছি তারা কত কথা বাংলাতেই পড়তে, লিখতে এমন কি বুঝতেও শিখে ফেলেছিলাম! হায় হায়!
কপি = নকল, অনুকরণ, নকল করা, অনুকরণ করা
মলিকিউল = অণু
এটম = পরমাণু
এক্সপ্লানেশন = ব্যাখ্যা
ফ্লো = গতি, প্রবাহ
ফিল্ড = বিষয়, ক্ষেত্র, জমি, মাঠ
কমন = জানা, সাধারণ
বায়োলজিস্ট = জীববিজ্ঞানী
আর প্যাচাল না পারি। বরং একটা সহজ সমাধানে আসি। বিজ্ঞানের লেখায় কথায় কথায় এইরকম নেমস আসবে, ফ্লো আসবে, আইডিয়া আসবে, নর্ম মেনে চলতে হবে, কনসেপ্ট-এর পর কনসেপ্ট। কয়কটা বাংলা ক্রিয়াপদের ঝামেলায় না গিয়ে ইংরেজীতেই সমস্তটা লিখে ফেলে সচলায়তনের ইংরেজী বিভাগে দিয়ে দিয়েন। বাংলায় শুধু একটা ঘোষণা দিয়ে দিয়েন যে ইংরেজী বিভাগে সাইন্স নিয়ে একটা লেখা দেওয়া হয়েছে। এই রে, ঘোষণা কথাটা আবার কমন পড়লনা বোধ হয়। ‘অলস' পাঠক মাঝপথে ছেড়ে দিলে আমার সমস্ত লেখালেখিই যে ফিল্ডে ডেড হয়ে যাবে!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

কি আর বলব ভাই, বাংলায় পড়াশোনা করিনি তো, বাংলা ভাষার মাঝে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পাই। সুন্দর কিছু না থাকলে সেটা নষ্ট করার মধ্যেও তো আনন্দ আছে, তাই না ?

আর সত্যি কথা বলতে কি, আসলেই একটা মন্তব্য লিখতেই কাহিল হয়ে গেছিলাম। বাংলা টাইপিংএ অনভ্যাসের ফল।
আমার লেখায় না হয় ইংরেজির এপিডেমিক হয়ে গেছে। আপনার লেখা কি সম্পূর্ন ইংরেজি মুক্ত? আপনি তো বাংলায় পড়াশুনা করেছেন। আপনার বলা বা লেখায় ইংরেজি ঢোকে না এ কথা হলফ করে বলতে পারবেন? আপনার কমেন্ট, আপনার ব্লগ, আপনার ওয়েবসাইট?

'অলস পাঠক' আমি নিজে। আর বিজ্ঞানের লেখা যাতে সহজপাঠ্য হয় বিজ্ঞান লেখকের তা দায়িত্ব। কখনো কোনো কিছু যদি পরে বাধা সৃষ্টি করে (হোক সেটা কোনো শব্দ বা নতুন কনসেপ্ট), পাঠকের আগ্রহ এমনিতেই কমে যাবে। আপনার ভাষার দক্ষতার কারণে হয়ত আপনার একে কোনো সমস্যা মনে হচ্ছে না। কিন্তু আরেকজন বিজ্ঞান লেখকের কিন্তু ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।

"Someone told me that each equation I included in the book would halve the sales. I therefore resolved not to have any equations at all. In the end, however, I did put in one equation, Einstein's famous equation, E = mc^2. I hope that this will not scare off half of my potential readers." – Stephen Hawking.

উনিও মনে হয়ে 'ফিল্ডে ডেড' হওয়া নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন।

বিজ্ঞানের লেখাও যেকোনো গল্প বা কবিতার চেযে কম ঝরঝরে না হলে চলবে না। আর যেকোনো লেখকেরই লেখার সময় 'ফ্লো' থাকা জরুরি, এটা আপনাকে নিশ্চই বলে দিতে হবে না। ভাষা যাতে কোনো লেখকের প্রথম কনসার্ন না থাকে, এটাই আমার মূল কথা। লেখাটা বের হবার পর ভাষা ঠিক করে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকে।

সুপার্স্ক্রিপ্টের কথা তুলেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তা লাগবে না। কেউ ভুলেও বাংলার জায়গায় ইংরেজি লিখলে আপনি হারেরেরে করে নিচে এসে একটা ছোট্ট এপেন্ডিকস লাগিয়ে দিয়ে যাবেন। অগ্রিম ধন্যবাদ সেজন্য।

-অভিমন্যু সোহম।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসি

লেখা আর মন্তব্যগুলো ভাল লেগেছে জেনেও ভাল লাগলো। সাথে থাকবেন আশাকরি।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বিজ্ঞানের লেখা দেখলেই ভাল লাগে... হাততালি লিখতে থাকুন

আস্তে আস্তে বাংলা প্রতিশব্দগুলো ব্যাবহার করতে থাকুন, দেখতে দেখতে নিশ্চয় একদিন অভ্যস্ত হবে সবাই... কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে গেলে এমন একটা দিন আসবে যেদিন বিজ্ঞান মানেই ইংরেজী বুঝবে সবাই... সত্যেন বসু খুব সহজ ভাবে একটা কথা বলেছিলেনঃ "যারা বলেন যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নতুবা বিজ্ঞান বোঝেন না"

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।