টিকাদান কার্যক্রম: বাংলাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বনাম বিশ্ব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৮/০৮/২০১৪ - ৪:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৯৯ সালের এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সম্মেলনে এই অঞ্চলে টিকাদান কর্মসূচির উপর একটি নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ বাদে এই অঞ্চলের দেশগুলো হল ভুটান, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও পূর্ব তিমুর।

১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংককের বৈঠকে তারা নীতিমালার প্রাথমিক মানদণ্ডগুলো নির্ধারণ করে।

২০০১ সালের ৩-৪ এপ্রিল জাকার্তায় আরও সম্প্রসারিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাদের মতে আঞ্চলিক টিকাদান নীতিমালা হওয়া উচিত সর্বাঙ্গীণ, সেই অঞ্চলের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। সে বছরের অক্টোবরের সম্মেলনে একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হয়। এতে টিকা উৎপাদন, সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। ২০০২ এর ডিসেম্বরে তারা খসড়া তৈরি করে স্থানীয় পরিচালকের কাছে উপস্থাপন করেন।


ছবিঃ ২০০১ সালে সারা বিশ্ব এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রোগের চিত্র

এখানে তিনটি মৌলিক নীতির উপর এই নীতিমালা প্রতিষ্ঠিতঃ
১। টার্গেট বয়সসীমার সবাইকে জাতি, ধর্ম-বর্ণ-অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে।
২। টিকাদানের ফলে ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত উন্নতি হয়। তাই দেশগুলোর সরকারকে তাদের নাগরিকদের জন্য মানসম্পন্ন টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
৩। এই অঞ্চলের দেশগুলো যাতে টিকাদান কর্মসূচিতে স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে উঠে সে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য আরও তিনটি মূলনীতি যোগ করা হয়েছেঃ
১। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে নিজস্ব টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে হবে।
২। দেশগুলোর প্রয়োজনীয়তা এবং বাস্তবতা অনুসারে ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।
৩। টাস্ক ফোর্স মাঝে মাঝেই এই নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখবে।

এই নীতিমালার ছয়টি উদ্দেশ্য ঠিক করা হয়ঃ
১। আঞ্চলিক টিকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য সমন্বিত উদ্যোগগ্রহণ। এর ভিতর রয়েছে বর্তমানে টিকা উৎপাদন ক্ষমতা নিরীক্ষণ এবং টিকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য রোগের ভয়াবহতা নিরূপণ।
২। দেশগুলোতে টিকা প্রচলনের জন্য ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ।
৩। সদস্য দেশগুলোকে সহযোগিতা করা যাতে প্রচলিত এবং নতুন টিকার বিষয়ে তারা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারে।
৪। বহুমাত্রিক স্বাস্থ্য গবেষণা ফোরাম, গবেষণা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইম্যুনাইজেশন (গাভি)র অর্থায়নে গবেষণা পরিচালনা করার জন্য সহায়তা প্রদান এবং এই ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি খাতের ভিতর সমন্বয় সাধন।
৫। আঞ্চলিক টিকাদান কর্মসূচিতে গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য সহায়তা করা
৬। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিগুলোকে সমর্থন দেওয়া।

এই জন্য ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ঃ
১। সমাজে টিকা দ্বারা নিরাময়যোগ্য রোগের পরিমাণঃ এই অঞ্চলের টিকা দ্বারা নিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্তদের পরিমাণ নির্ণয় করে এই বিষয়ে গবেষণা এবং নতুন টিকা উৎপাদন করা।

২। টিকা নিয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নঃ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই অঞ্চলের সরকার এবং গবেষণা সংস্থাগুলোর সহায়তা নিতে হবে এবং যেখানে প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।

৩। টিকা নির্ধারণঃ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে কি কি টিকা অন্তর্ভুক্ত করা হবে তা নির্ধারণ করা এবং টিকাদানের রুটিন তৈরি করা।

৪। টিকার মান নিয়ন্ত্রণঃ টিকার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়া।

৫। টিকা উৎপাদন, সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তাঃ এই অঞ্চলে চাহিদানুযায়ী যথেষ্ট টিকার উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৬। টিকা সংক্রান্ত অর্থায়নঃ এই জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য নিশ্চিত করা।

টিকা উৎপাদন এবং ব্যবহারের জন্য নিচের ছক অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত হয়।

বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। এখানে ১ লাখ ৪০ হাজার টিকাদান কেন্দ্র রয়েছে। ৪৫০০০ মাঠকর্মী এবং ২১০০০ তত্ত্বাবধায়ক কাজ করছেন।

১৯৯০ সালে ওরাল পোলিও টিকার তৃতীয় ডোজের প্রাপ্তি হার ছিল ৬৯%, বিসিজির হার ছিল ৮৬%, ডিপিটির হার ছিল ৬৯% এবং হামের টিকার হার ছিল ৬৫%।
২০০৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী বিসিজির প্রাপ্তি হার ৯৯%, ওরাল পোলিও টিকার তৃতীয় ডোজের প্রাপ্তি হার ৯৩%, হামের ৮৩%।

বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য হার ৭৫.২%। অর্থাৎ টার্গেট জনগোষ্ঠীর ৭৫.২% টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এসেছে যেখানে পাকিস্তানে এই হার ৫০ শতাংশ। ২০০৯ সালে ডিপিটির হার ছিল ৯৩% যা উন্নত দেশগুলো যেমন অস্ট্রেলিয়া (৯২%), কানাডা (৮০%), ডেনমার্ক (৮৯%) অপেক্ষা অনেক বেশি।

২০০৬ সালে ক্যাচ আপ ক্যাম্পেইনের আওতায় নয় মাস থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত সাড়ে তিন কোটি শিশুকে হামের টিকা দেয়া হয়। ২০১০ সালে টিকা দেয়া হয়েছিল এক কোটি ৮০ লাখ শিশুকে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশে টিকার সংরক্ষণ ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে দুই হাজার ৯৭৯ জন রুবেলায় আক্রান্ত হয়। রুবেলা নিয়ে কোনো শিশু যাতে জন্ম না নেয়, সে জন্য ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে সরকার বিনা মূল্যে রুবেলা টিকা দিতে শুরু করে।
২০১৬ সালের মধ্যে হাম ও রুবেলা টিকার হার জাতীয় পর্যায়ে ৯৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
২০১৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারতের নয়া দিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে এই ‘পোলিওমুক্ত সনদ’ দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে এ সংস্থার ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে চারটিই ‘পোলিওমুক্ত’ সনদ পেল।
ডব্লিউএইচওর আফ্রিকা ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবগুলো দেশ যদি টানা তিন বছর পোলিওমুক্ত থাকতে পারে, তাহলে পুরো বিশ্বকেই ‘পোলিওমুক্ত’ ঘোষণা করা সম্ভব হবে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এখানো পোলিওর প্রকোপ রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জন্যও এ দুটি দেশ ঝুঁকি তৈরি করছে।
পোলিও টিকা খাওয়ানোর কর্মসূচি সফলভাবে পরিচালিত হওয়ার কারণেই এই মাইলফলকে পৌঁছাতে পেরেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৬ সালে ১৮ জনের দেহে পোলিও ভাইরাস সনাক্ত করা হয়। সে সময় বলা হয়েছিল, ভারত থেকে এ ভাইরাস বাংলাদেশে এসেছে।
তার আগে বাংলাদেশে ২০০০ সালে একজন, ১৯৯৯ সালে ২৯ জন, ১৯৯৭ সালে পাঁচজন এবং ১৯৯৬ সালে ১৬ জনের দেহে এ ভাইরাস সনাক্ত করা হয়।

টিকাদান কর্মসূচির ফলে শিশুমৃত্যুর হারও অনেক কমে গেছে। উপরের ছক দেখলেই তা প্রমাণ হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি সফল হয়েছে। কর্মসূচির সাফল্য বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো খুবই মজবুত। এমন অবকাঠামো শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নয়, উন্নত দেশেও সচরাচর দেখা যায় না।

এই টিকাদান কর্মসূচির উত্তরাত্তর সাফল্য আসুক এটাই হোক সবার কামনা।

সূত্রঃ
১। Regional Vaccine Policy for South-East Asia Region. World Health Organization:2003
২। Success Stories of EPI Programme in Bangladesh. Dr. Md. Tajul Islam A. Bari.Program Manager. EPI & Surveillance, DGHS
৩। Bangladesh vaccine capacity doubled: bdnews24.com: 2013-09-15
৪। EPI programme: An excellent success for prevention of communicable diseases in Bangladesh:Md. Darul Islam, Hossain Sahid Kamrul Alam, Md. Rafiqul Islam, Dhaka Shishu (Children) Hospital Journal.
৫। নতুন বার্তা

একাকী মানব

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

লেখা ভালো হয়েছে। তবে এই লেখাটিকে আরোও ভালো করা সম্ভব। কিছু পরামর্শ দেই।

১। টেবিলটা বাংলায় হলে ভালো হয়। টেবিলে SEAR নামে একটি শব্দ দেখছি। এর মানে কী? টেবিলের নিচে ক্রস রেফারিন্স করলে আমরা বুঝতে পারতাম টেবিলটি আপনার উল্লেখিত কোন সূত্র থেকে নেয়া। এটা করলে যে এই বিষয়ে পড়ালেখা করতে চায় সে একটু সহজে তার জিনিসপত্র খুঁজে নিতে পারবে।

২। একটা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা হলে ভালো। এর সূত্রটাও বাদ পড়েছে।

৩। প্রাপ্তি হার, ডিপিটি, ডিপিজি, U5MR, IMR, NMR এগুলো কী বস্তু?

৪। আপনার হেডলাইনের সাথে পোস্টের মিল সামান্য। একটা টেবিল ও একটা লাইনে এই তুলনাটা টেনেছেন আপনি। নীতিমালা জাতীয় জিনিস লেখায় না ঢুকিয়ে আরো একটু অন্যভাবে পোস্টটা সাজানো যেত।

এই বিষয়ে আরো লিখবেন আশা করছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।