পৃথিবীতে কেন এতো প্রাণী?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৮/১২/২০১৪ - ৯:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[The Magic of Reality by Richard Dawkins এর তৃতীয় অধ্যায় Why are there are so many animals? এর প্রথম অংশের অনুবাদ]

বিভিন্ন প্রাণি কেন দেখতে ঐরকমই এ সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী (Myth) প্রচলিত আছে। যেমন, কেন চিতাবাঘের গায়ে দাগ আছে বা কেন খরগোসের সাদা লেজ আছে। তবে কেন অগণিত ধরণের ও প্রকৃতির জীব দেখতে পাওয়া যায়, এ সম্বন্ধে খুব বেশি কাহিনী প্রচলিত নেই। কেন পৃথিবীতে এতো ধরণের ভাষা প্রচলিত, এ সম্বন্ধে চমৎকার একটা মিথ হচ্ছে ইহুদীদের ‘টাওয়ার অব বেবেল’ এর কাহিনীটি। এই মিথ অনুসারে,একসময় পৃথিবীর সকল মানুষ একই ভাষায় কথা বলতো। তাই সবাই খুব সহজে একসাথে কাজ করতে পারতো। সকল মানুষ মিলে একটা টাওয়ার তৈরী করে এবং তারা মনে করেছিলো টাওয়ারটা আকাশে পৌঁছে যাবে। ঈশ্বর এটা লক্ষ্য করেন এবং সবাই সবার কথা বুঝতে পারছে এই বিষয়টাকে তিনি খুব ভালোভাবে নিলেননা। সবাই যদি সবার কথা বুঝতে পারে এবং একসাথে কাজ করতে থাকে, কে জানে পরবর্তীতে কী হবে? তিনি এমন ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে মানুষ একে অন্যের ভাষা বুঝতে না পারে। এই কারণেই পৃথিবীতে এখন এতো ধরণের ভাষা এবং মানুষ যখন অন্য কোন গোষ্ঠী বা দেশে মানুষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে তখন তা অর্থহীন শব্দের মতো মনে হয়।

আমি প্রাণি বৈচিত্র নিয়ে এরকম একটি কাহিনী খুজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। অবশ্য একটু পরেই আমরা দেখবো ভাষার বিবর্তন ও প্রাণির বিবর্তনের মধ্যে দারুন একটা মিল রয়েছে। কিন্তু কেন এতো বিশাল সংখ্যক জীব প্রকৃতিতে বিদ্যমান এ সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কোন কাহিনী পাওয়া যায় না। এটা একটা অবাক করার বিষয়, কারণ দেখা যায় প্রকৃতিতে যে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী বিদ্যমান এ সম্বন্ধে আদিবাসীরা ওয়াকিবহাল। ১৯২০ সালে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট মেয়ার নিউগিনির উচ্চভূমির পাখিদের উপর একটা জরিপ চালিয়েছিলেন। তিনি ১৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি চিহ্নিত করেন এবং তারপর অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন স্থানীয় পাপুয়ান আদিবাসীরা এর মধ্যে ১৩৬ টিকেই ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে।

আবার পৌরাণিক কাহিনীতে ফিরে আসি। উত্তর আমেরিকার হপি (Hopi) আদিবাসীদের একজন দেবীর নাম মাকড়সা দেবী (Spider Woman)। তাদের সৃষ্টির কাহিনী অনুযায়ী, মাকড়সা দেবী সূর্যদেব তাওয়া (Tawa)-র সঙ্গে একসাথে প্রথম জাদু সঙ্গীত গান। এর ফলেই পৃথবী এবং প্রাণের সৃষ্টি হয়। এরপরে মাকড়সা দেবী সুর্যদেবের চিন্তার সুতা দিয়ে মাছ, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেন।

উত্তর আমেরিকার পুয়েবলো (Pueblo) ও নাভাজো (Navajo) আদিবাসীদের কাহিনী অনেকটা বিবর্তনের মতো। এই কাহিনী অনুসারে, গাছ যেমন বিভিন্ন পর্যায়ে আস্তে আস্তে বড় হয়, প্রাণও একই ভাবে পৃথিবীতে অস্তিত্বলাভ করে। পোকামাকড়েরা বাস করতো প্রথম বা লাল পৃথিবীতে। একসময় তারা বেয়ে বেয়ে দ্বিতীয় বা নীল পৃথিবীতে চলে আসলো। দ্বিতীয় পৃথিবীতে বাস করতো পাখিরা। পোকামাকড় চলে আসায় একসময় দ্বিতীয় পৃথিবীতে জায়গার অভাব দেখা দিলো। ফলে পাখি আর পোকামকড়েরা তৃতীয় বা হলুদ পৃথিবীতে আসা শুরু করলো, যেখানে মানুষ ও অন্যান্য স্থন্যপায়ীরা বসবাস করতো। সময়ের সাথে সাথে একসময় তৃতীয় পৃথিবীতেও জায়গা আর খাবারের অভাব দেখা দিলো। তখন মানুষ, পোকামাকড়, পাখি সবাই দিবারাত্রির সাদা-কালো বা চতুর্থ পৃথিবীতে উঠে আসলো। চতুর্থ পৃথিবীতে ঈশ্বর ‘বুদ্ধিমান’ মানুষদের তৈরী করেছিলেন যারা কৃষিকাজ জানতো। এই বুদ্ধিমান মানুষরা নতুন আগন্তুকদের কৃষিকাজ শেখালো এবং সবাই মিলে চতুর্থ পৃথিবীতে থাকতে লাগলো।

ইহুদীদের সৃষ্টিতত্ত্ব জীবের বৈচিত্র সম্বন্ধে বলে, কিন্তু কেন এর কোন ব্যাখ্যা দেয় না। আসলে তাদের পবিত্র গ্রন্থে দুই ধরণের সৃষ্টিতত্ত্ব আছে। প্রথমটা অনুযায়ী, ঈশ্বর সবকিছু ছয়দিনে তৈরী করেন। পঞ্চম দিনে তিনি মাছ, তিমি, অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী এবং পাখি তৈরী করেন। ষষ্ঠ দিনে মানুষসহ অন্যান্য স্থলচর প্রাণী তৈরী করেন। এই কাহিনী প্রাণী বৈচিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে। যেমন, ‘God created great whales, and every living creature that moveth, which the waters brought forth abundantly after their kind, and every winged fowl after his kind,’ and made every ‘beast of the earth’ and ‘everything that creepeth upon the earth after his kind’. কিন্তু কেন এরকম বৈচিত্রতা? এর উত্তর দেয়া নেই।

দ্বিতীয় কাহিনী অনুযায়ী, ঈশ্বর মনে করেন তার সৃষ্ট প্রথম মানুষের আসলে কিছু সঙ্গী দরকার। আদম- প্রথম মানব- কে একা তৈরী করা হয় এবং তাকে অসাধারণ সুন্দর একটি বাগানে থাকতে দেয়া হয়। এরপরই ঈশ্বর অনুভব করেন ‘It is not good that man should be alone’ ‘He therefore formed every beast of the field and every fowl of the air; and brought them unto Adam to see what he would call them’.

প্রাচীন হিব্র“ভাষীরা যতটুকু ভেবেছিলো আদমের কাজ নিশ্চিতভাবে তারচেয়ে কঠিন ছিলো। এখন পর্যন্ত মোটামুটি ২ মিলিয়ন প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে। যত প্রজাতির এখনো নামকরণ করা হয়নি তার অতি সামান্য অংশ এটি।

দুটি প্রাণি একই প্রজাতির না ভিন্ন প্রজাতির তা আমরা কিভাবে বুঝবো? যৌন প্রজননের উপর ভিত্তি করে আমরা প্রজাতির সংজ্ঞায়ন করতে পারি। যে সকল প্রাণি নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে পারে না, তারা ভিন্ন প্রজাতির। অবশ্য ঘোড়া ও গাধার মতো কিছু প্রান্তিক প্রাণি আছে, যারা পর¯পরের সাথে মিলিত হয় এবং সন্তানও (খচ্চর) উৎপন্ন করে। কিন্তু এই সন্তানেরা হয় বন্ধ্যা- অর্থাৎ তারা সন্তান উৎপন্ন করতে পারে না। এ কারণে আমরা ঘোড়া ও গাধাকে ভিন্ন প্রজাতিতে রাখি। ঘোড়া ও কুকুর নিশ্চিতভাবে ভিন্ন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত কারণ তারা নিজেদের মধ্যে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেনা, যদি করেও কোন সন্তান উৎপাদন করতে পারে না, এমনকি বন্ধ্যা সন্তানও নয়। কিন্তু ¯স্প্যানিয়েল ও পুডল একই প্রজাতি, কারণ তারা নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে পারে এবং এর ফলে যে কুকুর ছানা উৎপন্ন হয়, তা উর্বর।

একটি প্রাণি বা উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নামে দুইটি ল্যাটিন শব্দ থাকে, যা সাধারণত ইটালিক ফন্টে লেখা হয়। প্রথম শব্দটা গণ (Genus), আর দ্বিতীয় শব্দটা হচ্ছে প্রজাতি (Species)। যেমন, Homo sapiens (বুদ্ধিমান মানুষ), Elephas maximus (খুব বড় হাতি)। প্রতিটি প্রজাতি তার গণের সদস্য। Homo একটি গণ, Elephas ও তাই। সিংহ হচ্ছে Panthera leo Panthera এই গণের মধ্যে আরো অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে Panthera tigris (বাঘ), Panthera pardus (লিওপার্ড বা প্যান্থার) এবং Panthera onca (জাগুয়ার)। আমাদের গণের একমাত্র জীবিত প্রজাতিটি হচ্ছে Homo sapiens । অবশ্য জীবাশ্ম থেকে আমরা আরো কিছু নাম পাই যেমন Homo erectus এবং Homo habilis । অন্যান্য মানুষের মতো দেখতে জীবাশ্মগুলো Homo থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ভিন্ন, এজন্য তাদের ভিন্ন গণে স্থান দেয়া হয়েছে। যেমন, Australopithecus africanus এবং Australopithecus afarensis

(এর সাথে অস্ট্রেলিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। Australo অর্থ ‘দক্ষিণের’ একই শব্দ থেকে অস্ট্রেলিয়ার নামও এসেছে)।

প্রতিটি গণ একটি গোত্রের (Family) অন্তর্ভুক্ত, যা সাধারণত সাধারণ রোমান হরফে লেখা হয়। বিড়ালরা (সিংহ, লিওপার্ড, চিতা, লিঙ্কস এবং অনেক ছোট ছোট বিড়াল) Felidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি গোত্র একটি বর্গের (Order) অন্তর্ভুক্ত। বিড়াল, কুকুর, ভাল্লুক, হায়েনা- এরা Carnivora বর্গের বিভিন্ন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বানর, এপ (মানুষসহ) ও লেমুররা Primate বর্গের বিভিন্ন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এবং প্রতিটি বর্গ একটি শ্রেণির (Class) সদস্য। সকল স্থন্যপায়ী Mammalia শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

এই শ্রেণিবিন্যাসের বিবরণ পড়ার সময় নিশ্চয় তোমার মাথায় একটা গাছের মতো ছবি ভেসে উঠেছে। এটাই হচ্ছে পরিবার বৃক্ষ (Family tree)- এমন একটা গাছ যার অনেক শাখা, প্রতিটি শাখা আবার প্রশাখায় বিভক্ত, প্রতিটি প্রশাখা আবার অনেক ছোট ছোট প্রপ্রশাখায় বিভক্ত। প্রতিটা ডালের প্রান্তে আছে প্রজাতি। অন্যান্য বিন্যাসগুলো- শ্রেনি, বর্গ, গোত্র, গণ- হচ্ছে গাছের শাখা-প্রশাখা। পুরো গাছটা হচ্ছে এই জগতের সকল প্রাণের সমষ্টি।

একবার চিন্তা করো কেন গাছটার এতো ডাল। শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। যদি যথেষ্ট পরিমাণ ডাল দেয়া হয়, তাহলে প্রশাখার পরিমাণ বিশাল হতে পারে। এটাই বিবর্তনে ঘটে। Origin of Species বইয়ে চার্লস ডারউইনের আঁকা এরকম একটা ছবি আছে- বইটার একমাত্র ছবি। ঐ পৃষ্টার উপরে একটা রহস্যময় কথা লিখা আছে- - I think. তোমার কী মনে হয় তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন? হয়তো তিনি কোন বাক্য লিখছিলেন, এই সময় তাঁর কোন ছেলে এসে তার সাথে কথা বলা শুরু করে, এবং তিনি আর কখনোই ঐ বাক্যটি শেষ করেননি। হয়তোবা তাঁর কাছে লেখার চেয়ে ছবি দিয়েই বুঝানোটা সহজ মনে হয়েছে। আমরা আর কখনোই তা জানতে পারবো না। ঐ পৃষ্ঠায় আরো কিছু লেখা আছে, কিন্তু তার অর্থ উদ্ধার করা যায়নি। একজন মহান বিজ্ঞানীর লেখা পড়া একটি আশাদায়ক ব্যাপার, কিন্তু কখনোই তা প্রকাশ পাবে না, তা একটি নিরাশার ব্যাপার অবশ্যই।

প্রাণিরা কিভাবে বিভক্ত হয়, তা পুরোপুরি এই ছবিটার মতো নয়, কিন্তু মূল ব্যাপারটার ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যায়। মনে করি, খুব প্রাচীন একটা প্রজাতি দুইটি প্রজাতিতে ভাগ হয়ে গেলো। তারপর সেই দুইটি প্রজাতি আবার চারটি প্রজাতিতে ভাগ হয়ে গেলো এবং এভাবে চলতে থাকলে ১৬, ৩২, ৬৪, ১২৮, ২৫৬, ৫১২... দেখা যাচ্ছে, এভাবে যদি আমরা দ্বিগুণ করতে থাকি, মিলিয়ন সংখ্যক প্রজাতীতে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এটা খুব সহজেই হয়তো তুমি বুঝতে পারছো, কিন্তু কেন একটা প্রজাতি ভাগ হবে? ভাষা যেভাবে ভাগ হয়, প্রজাতির ভাগও প্রায় একই। তাই চলো আমরা আগে একটু ভাষা কিভাবে ভাগ হয় সেই ব্যাপারে আলোচনা করি।
[চলবে]

- এ হাসনাত
_______________________
১. প্রথম দুই অধ্যায় অনুবাদ না করে কেন তৃতীয় অধ্যায়ে লাফ দিলাম তার ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। প্রথম দুই অধ্যায়ের অনুবাদ অনেক আগে প্রিয় ইকবাল নাওয়েদ মুক্তমনায় করেছিলেন। এজন্য আর আমার নিজের করা প্রথম দুই অধ্যায়ের অনুবাদ প্রকাশ করলাম না।

২. সকল ছবি একই বই থেকে প্রাপ্ত।

৩. সচলে আমার অন্যান্য লেখাঃ
আমার নজরুল কাহন
মহান শাবি ভ্রমণ
মেডিকেল লাইফ সাক্স
ঢাকা-সিলেট বাস ভ্রমণ এবং আমার স্বজাতি ভাবনা
মৃত্যু

৪. ফেসবুক


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।