উইলবার আর অরভিলের ঘাঁটিতে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৯/০১/২০১৫ - ৬:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আউটার ব্যাংকস হচ্ছে নর্থ ক্যারোলিনার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা ঘিরে আটলান্টিকের বুকে ২০০ মাইল দীর্ঘ এক দ্বীপমালা। আকাশ থেকে দ্বীপগুলো একসাথে দেখতে চিকন একটা আঁকাবাঁকা রেখার মত। এর দ্বীপগুলো হচ্ছে বোডি, রোয়ানোক, হ্যাটেরাস এবং ওক্রাকোক। মূল ভূখন্ডের উপকূলের সমান্তরালে থাকা এই দ্বীপের পথ ধরে চলতে থাকলে একে একে করলা, কিটি হক, কিল ডেভিল হিলস, অ্যাভোন ইত্যাদি ছোট ছোট শহর পড়বে। আর, দীর্ঘ এ পথের দু'পাশে থাকবে শান্ত, নীল সমুদ্র। জায়গাটা এত নিরিবিলি যে হয়ত গাংচিলের দল ছাড়া কারো সাথে আপনার দেখা হবে না।

আউটার ব্যাংকসে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছিল অনেকদিন ধরে। বিরতি ছাড়া আউটার ব্যাংকসে যেতে সময় লাগার কথা প্রায় আট ঘণ্টা। তাই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম আমরা সাত জনের একটি দল। যাত্রাপথে বিরতি নিয়ে, কোনরকম নাকে-মুখে চারটি গুঁজেই আবার পথচলা। তাড়া ছিল সূর্যাস্তের আগেই গন্তব্যে পৌঁছানোর। চলতে চলতে হঠাৎ একসময় রাস্তার দু'পাশে সমুদ্র দেখা গেলো। পথ যেন পানির নিচে চলে যেতে চাইছে!

অ্যাভোন(Avon)-এ আমাদের হোটেল বুকিং দেয়া ছিল, তাই আমরা ছুটলাম অ্যাভোনের পথে। মনে-প্রাণে চাইছিলাম যেন সূর্যাস্তের আগেই আমরা অ্যাভোন বিচে পৌঁছাতে পারি। পথের দু'পাশে কখনও পানি, কখনও অচেনা দ্বীপের ধূ ধূ বালুকা -এভাবেই এগিয়ে চললাম যতটা দ্রুত পারা যায়। কয়েক দল গাংচিল উড়ে উড়ে স্বাগত জানাল তাদের দ্বীপে। এদিকে সূর্য প্রায় অস্তমিত। পূর্বদিকে সমুদ্র, তাই সুর্যাস্ত দেখার উপায় নেই মন খারাপ

হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হোটেলে ব্যাগ রেখেই আমরা হাঁটতে বের হলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। ছোটখাটো সাজানো গোছানো শহর, সারাটা দ্বীপ জুড়েই এক লেনের চিকন রাস্তা, আর রাস্তার দুপাশের সাইড ওয়াকের ধার ঘেঁষে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল। মার্কিনিরা বলে আউটার ব্যাংকস এর সৈকত নাকি মারাত্মক 'ওয়াইল্ড' । রাতের সৈকত কতটুকু বন্য তা দেখতে আমরা সবাই একসাথে ছুটে গেলাম।

জীবনে বহুবার সমুদ্রে গেলেও রাতের সমুদ্র আমার অপরিচিত। রাতের বেলায় কেন যেন অচেনা আর ভয়ংকর লাগলো সমুদ্রের রূপ। চারিদিকে সমুদ্রের গর্জনের পাশাপাশি কুকুর ডাকাডাকিও শুনতে পেলাম। এর সৈকত প্রচন্ড ঢালু, কয়েক ফুট সামনেই গভীরতা অনেক বেড়ে যাচ্ছিল।এখানকার সমুদ্র সৈকতটা অনেক বেশি ঢালু মনে হল। তাই কেউ আর পানিতে বেশিদূর যাবার সাহস করলাম না। এখানকার মশা বেশ বড় বড় আর অসম্ভব কামড়াতেও পারে এরা। মশার হাত থেকে বাঁচতে আমরা সাগরে পা ভিজিয়ে বসলাম। নাহ! কোথাও শান্তি নেই, ঢেউ এর সাথে সাথে কী যেন ভেসে এসে পায়ে আঁচড় দিতে লাগল। বেশি পাত্তা দিলাম না, ভাবলাম ঝিনুক-টিনুক হবে আর কি ইয়ে, মানে... জেটি থেকে আসা আবছা আলোতে দেখলাম বালি নিচে দিয়ে কী যেন গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেল, ততক্ষণে দুইপা আঁচড়ে ফেলেছে বুনো কাঁকড়ার দল! এখানে প্রচুর মাছ ধরা হয় ট্রলারে, কিছুটা আঁশটে গন্ধও আছে বাতাসে। হাড়েহাড়ে টের পেলাম সাধে কি এর নাম জংলি সৈকত রাখা হয়েছিল?

পরেরদিন সকালে সূর্যোদয়ের পর আবার বেরিয়ে পরলাম

আউটার ব্যাংকসে দেখার আছে অনেক কিছুই। পরদিন সকালে আমরা গেলাম কিল ডেভিল হিলসে অবস্থিত রাইট ব্রাদার্স ন্যাশনাল মনুমেন্ট দেখতে যেখানে বিশ্বের সর্বোপ্রথম বিমান ওড়ানো হয়েছিল।

ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ের রাইট ব্রাদার্সের মেমোরিয়ালে আমি! সত্যি? কল্পনার জগতকে বাস্তবে ছুঁয়ে আমি বিস্মিত হয়ে যাই, নিজের ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলি নিজেকে আরেকবার। উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট -এ নাম দু'টো শুনেছি ছোটবেলা থেকে, আজ আমি তাদের স্মৃতিমাখা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। ওঁদের ১৯০৩ সালের উড্ডয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা আছে মোমোরিয়ালের বিশাল এলাকায়। কে প্রথম উড়েছিল সেটা নিয়েও ঢের বিতর্ক আছে। স্মিথসোনিয়ানদের সাথে রাইট ভাইদের কিছুটা রেষারেষি হয়েছিল, এমনকি ‌প্যাটেন্ট নিয়ে কিছুটা গোলমালও হয়েছিল। আবার রাইট ভাইদের প্রথম উড়োজাহাজটার কোন অংশ কোথায় -সেটা নিয়ে কিছু বিতর্কও আছে, যাই হোক এখানে যা আছে সেগুলোই দেখি।

মিনিয়েচার মডেল

প্রথম উড়োজাহাজটির রেপলিকা

অনেক অংশই ছিল কাপড়ের তৈরি, তাই সেলাই করার জন্য যে মেশিনটা ব্যাব‌হার করা হয়েছিল সেটা অবশ্য আছে

কিছু কলকব্জা


আচ্ছা মনে কি একটা প্রশ্ন আসছে না, দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় কেন এই আউটার ব্যাংকস-ই বেছে নিলেন?--এই প্রশ্নের জবাব পাবেন নিচের ছবিটিতে
"আপনারা যদি এখানে আসবেন বলে ঠিক করেন, তবে আমি খুশি মনে, আপনাদের সুবিধা আর সাফল্যের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাব। আমাদের মাঝে আপনারা সত্যিই অতিথিপরায়ন অনেক লোকের দেখা পাবেন।"‌ ‌ আরও শুনলাম, এখানকার বালি নরম, তাই অবতরণের জন্য এরকম জায়গা কিছুটা সুবিধার। আরেকটা কারণ নাকি এখানকার নিয়মিত গতির বায়ুপ্রবাহ। তার উপর জায়গাটা লোকালয় থেকে বেশ দূরে, দুই ভাইয়ের পাগলামি নিয়ে হাসা হাসি করার কেউ থাকার কথা না আশেপাশে।

রাইট ভাইয়েরা খরচাপাতি চালানোর জন্য সাইকেল সারাই করতেন

(এটা দেয়ালে সাঁটানো ছবি থেকে তোলা। ১৯০৩ সালের দিকে আমার জন্মও হয়নি)

দুই ভাই সংবাদপত্রও বের করতেন। তাদের বের করা পত্রিকা

২০০১ সালের নর্থ ক্যারোলাইনার ২৫ পয়সায় এঁদের স্মরণ করা হয়েছিল।


(ছবি উইকি থেকে)

জাদুঘরে ঢোকার সময় যে টিকিট দেয়া হয় সেটা দেখিয়ে আগামী ৭ দিন আবার ঢোকা যায়। তবে, আমাদের আবার ফেরার কারণ নেই। দেখাদেখি শেষ করে দ্বীপের বাকি আকর্ষণগুলো খুঁজতে বেরুলাম আমরা।

আটলান্টিকের বুকে জেগে ওঠা এই দ্বীপে ঘটেছে দুই হাজারেরও বেশি জাহাজের করুন পরিনতি । দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, অগভীর পানি আর প্রবল স্রোতকেই এর কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়ে থাকে। তাই আউটার ব্যাংকসকে আটলান্টিকের কবরস্থানও বলা হয়ে থাকে।

এছাড়াও এই দ্বীপে আছে বেশ কয়েকটি বাতিঘর। বাতিঘরগুলো বেশ উঁচু। নিজের পায়ের উপর ভরসা রেখে এর শীর্ষে উঠতে চাইলে সঙ্গে পানি ও খাবার মজুদ রাখতে বলা আছে, নইলে নামার সময় পানিশুণ্যতায় আপনি অসুস্থ হয়েও পড়তে পারেন। বাতিঘরের ভেতরটা ভ্যাপসা গরম, তবে একবার উঠে পড়তে পারলে জয়ের আনন্দে নাকি কষ্টটা ভুলে যাবেন। আর, বাতিঘরের উপর থেকে সমুদ্র দেখার মজাই নাকি আলাদা! দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা যে বাতিঘরটায় গিয়েছিলাম, সেটা সংস্কারের জন্য‌ বন্ধ ছিল সেদিন ওঁয়া ওঁয়া

গাড়ির তেল নিতে একজায়গায় থামা হল। সেখানকার লোকেরা 'ভাব -ভালোবাসা' একদম পছন্দ করে না, তাই তারা সবাইকে প্রেম করতে নিষেধ করে দিচ্ছে শয়তানী হাসি

ফিরতি পথ এবার আমাদের তুলে দিল আকাশের দিকে

-জলপ্রপাত

বি. দ্র.: ছবিগুলো বছর দুয়েক আগের, তাকচাদা (point and shoot) ক্যামেরায় তোলা। কিছু ছবি তুলে দিয়ে, পোস্টপ্রসেস করে, আর লেখা শুধরে দিয়ে, ফরম‌্যাটিং করে সাহায্য করেছে মেঘলা মানুষ

লেখাটা বাংলাদেশের প্লেনস্পটার ফয়সাল আকরাম ইথারকে উৎসর্গ করলাম আমরা হাসি


মন্তব্য

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
-জলপ্রপাত

শাব্দিক এর ছবি

কোন এক শ্রেনীর "আমার বই"তে সম্ভবত রাইট ব্রাদার্স এর গল্প ছিল। ছবিসহ আপনার বিস্তারিত পড়ে ভাল লাগল।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম। ধন্যবাদ দেঁতো হাসি
"আমার বই" নামটা সুন্দর ছিল, এখন আর প্রবন্ধটা পাঠ্যবইতে আছে কিনা, জানা নেই চিন্তিত

আয়নামতি এর ছবি

জলপ্রপাতের লেখা প্রথম পড়লেম। বেশ লাগলো হে! ছবিতে লেখাতে দারুণ যাকে বলে চলুক
১৯০৩ আমি জন্মালেও রাইট ভ্রাতাগণের সাথে কেন দেখা হলো না বুঝলেম না চিন্তিত
দেখা হলে কেমন ভোঁ ভোঁ ঘুরতে পারতেম। যাক পড়েই আফসোস ভুললেম। সেজন্য জল'কে বিশাল ধন্যবাদ!
ইয়ে আপুনি, সামান্য কয়েকটা টাইপো থেকে গেছে , ব্যাবহার> ব্যবহার, অতিথিপরায়ন>অতিথিপরায়ণ, পরিনতি>পরিণতি
করুন>করুণ, পানিশুণ্য>পানিশূন্য
লেখালিখি চলুক। জল আর মেঘের জন্য শুভকামনা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন‌্যবাদ, আয়নাদি।
১৯০৩ থেকে ২০১৫ -আপানার বয়স তো খুব বেশি হয়নি তবে, মোটে ১১২ তে পড়লেন এবার খাইছে

বানান ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, ( অতিথি বলে শোধরাতে পারছি না)। এর পরেরবার, আরও বেশি সাবধান থাকব।
-জলপ্রপাত

এক লহমা এর ছবি

লেখায়-ছবিতে সুন্দর পোস্ট।
ওই ছবির প্রেম-এ যতই কাটাকুটি দেখাক, এ পোস্ট আপনাদের দু'জনের প্রেম-এর চমৎকার নিদর্শন।
পরের পোস্টের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রেমের নিদর্শন হিসেবে ম্যানহোলের ঢাকনা খারাপ না খাইছে
ধন্যবাদ, উৎসাহদায়ী মন্তব্যের জন্য। হাসি
-জলপ্রপাত

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আহা, নাসির আলী'র "আকাশ যারা করলো জয়" বইটার কথা মনে করিয়ে দিলেন, চমৎকার বর্ণনা, লিখতে থাকুন হাত খুলে। হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জলপ্রপাত এর ছবি

ছোটবেলায় এই দুই ভাইয়ের আকাশ জয়ের গল্প পড়ে খুবই অবাক হতাম। লেখার উৎসাহ দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অসাধারণ!

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

জলপ্রপাত এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

গগন শিরীষ  এর ছবি

প্রথম বার যখন তাদের বিমানটি মাটি ছেড়ে শুন্যে উঠে গেল,ঠিক কি পরিমাণ আনন্দ যে হয়েছিল সেটা যদি একবার অনুভব করতে পারতাম!

জলপ্রপাত এর ছবি

আনন্দের সাথে টেনশনও ছিল কিছুটা, ওঠার পরে ঠিকঠাকমত নামার ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয়ই তাঁদের টেনশন ছিল। শুনেছি, অবতরণ করতে গিয়ে প্রোটোটাইপ 'ফ্লায়ার' নামের উরুক্কু বাহনের অনেকটাই ভেঙে ফেলেছিলেন তাঁরা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।