মেরিল স্প্যাশ এর ‘সুন্দর মানে কি ফর্সা’ বিজ্ঞাপনটা মনে ধরেছিল। তবে তিশাকে এমন মেকাপ দিয়ে ধবধবে সাদা না দেখিয়ে ওর স্বাভাবিক শ্যামলা রঙ দেখালে আরো ভালো লাগতো।
আমার বড় একটা দুঃখ হচ্ছে নিজের গায়ের রঙ ফর্সার দিকে। ফলে ঐ ফেয়ার এন্ড লাভলি জাতীয় যাবতীয় ফর্সাকারী পদার্থ আমাকে কতখানি বিরক্ত করে, শরীরে ঠিক কতোটা আগুণ ধরিয়ে দেয় সেটা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারিনা। একবার ইউনি পড়ুয়া বন্ধুকে খুব করে রাগ ঝাড়ার পর ও বলেছিলো তুই বড়বড় কথা বলতে পারবি, তুইতো আর কালো না। আমি কথা বাড়াইনি, কোথায় যেনো ওর ব্যাথাটা বুকে বেজেছিল।
আগে ভাবতাম এই ‘ফর্সা-কালো’ জিনিসটা শুধু বিয়ের ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে আলোচনায় আসে, মেয়েদের অপমান করে। আসলে তা না। আমার বাচ্চারা এখন স্কুলে যায় এবং বর্ণবাদের এক বীভৎস চেহারা আমার জানা হয়েছে গত দুইবছরে।
বাচ্চাদের স্কুলের ফাংশানে গেলে দেখি দেখতে ভালো একটা বাচ্চাকে শাড়ি টাড়ি পরিয়ে স্টেজে কখনো বউ, কখনো অন্য কিছু সাজিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। অন্য বাচ্চাগুলো নিজেদের তুচ্ছ ভাবে...
নাচের ক্লাসে বেছে বেছে ‘দেখতে ভালো’ বাচ্চাদের লীড-রোল দেয়া হয়, সে মুদ্রা ঠিক জানুক আর না জানুক। আমার চেনা ছয়বছরের ‘তন্দ্রা’ নাচতে ভালোবাসে, তার মা’কে খোদ নাচের টিচার বলেছেন ‘আসলে যারা দেখতে ভালো (মানে ফর্সা আরকি!) তারা নাচ শিখলেই ভালো, বড়বড় চোখে চোখের এক্সপ্রেশন ভালো আসে, চম্পক আঙ্গুলিতে হাতের মুদ্রা, ফর্সা পায়ে আলতা...’।
কালো-কুলোরা গান শিখুক। কালোদের মনে অনেক দুঃখ, গানে সেই দুঃখ চমৎকার ফুটে উঠে!
আমার পরিচিত আরেকটা বাচ্চা চট্টগ্রামের বিখ্যাত এক স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে কারণ কয়েকজন শিক্ষিকা ফর্সা-সুন্দর-নাদুসনুদুস এই বাচ্চাকে দেখে বলেছেন –‘এতো সুন্দর একটা মেয়েকে আমরা এমনিই নেবো, ওর ভর্তি পরীক্ষা লাগবেনা’...
আমি নিজে কর্মজীবী মা হিসেবে প্রতিদিন হাজার সমস্যা মোকাবেলা করছি অনেকবছর ধরে। অনেক কে বুঝাতে চেয়েছি ডে-কেয়ার সেন্টার করেন। তখন এক আপু যিনি একটা ডে-কেয়ার চালান আমাকে বলেছেন আয়া থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার প্রবণতা থাকে ফর্সা-মোটাসোটা শিশুগুলোকে যত্ন করার। অন্য শিশুগুলো সমান মনোযোগ ও যত্ন পায়না। ফর্সা শিশুদের প্রিন্স, প্রিন্সেস ইত্যাদি নামে ডেকে আহ্লাদ করা হয়, শুকনা বাচ্চাটা নাম পায় 'কাঠি', চশমা পরাটা নাম পায় 'কানা'।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যদি জিজ্ঞেস করি ওহে খুবতো জ্বালাময়ী লেখা ফেঁদে বসেছো- শপিং সেন্টারে, অন্য পাবলিক প্লেসে কোন বাচ্চাগুলোকে দেখে একটু চুল নেড়ে দিয়েছো, হেসেছো বা হ্যালো বলেছো?
সৎ উত্তর হবে সেই শিশুগুলো সবাই ছিল ফর্সা, সুন্দর।
আমি ভণ্ড নাকে খত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি কোনো শিশুকে চেহারা, গায়ের রঙ, স্বাস্থ্য এইসব দিয়ে তার প্রাপ্য মনোযোগ, যত্ন ও অধিকার নির্ধারণ করবোনা। আচ্ছা আপনারা যারা এই লেখাটা পড়ছেন তাদের কাছে এই প্রতিজ্ঞাটা আশা করতে পারি?
মন্তব্য
আপনি যে সমস্যাটা নিয়ে লিখেছেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশেষ করে শিশুরা যখন এর ভুক্তভোগী। এরকম পরিস্থিতিতে শিশুদের মনে নানারকম কমপ্লেক্সের জন্ম নিতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের উচিত একে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগতভাবে মোকাবেলা করা।
তবে একটা কথা, এটাকে "বর্ণবাদ" বলে না। বর্ণবাদ ইংরেজি "Racism" শব্দটা্র একটা প্রতিষ্ঠিত বঙ্গানুবাদ বা প্রতিশব্দ। এই Racism বা বর্ণবাদ ভিন্ন জিনিস। আপনি যে সমস্যাটা উত্থাপন করেছেন তাকে আমরা একধরণের সামাজিক "bias" (১, ২) বা "partiality" বলতে পারি। সহজ বাংলায় বললে - পক্ষপাতদুষ্টতা।
****************************************
বর্ণবাদ = Racism, ধরে সংজ্ঞায়ণের পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্র বিতর্ক প্রায়ই চোখে পড়ে। এর কারণ আমার মনে হয় ভুল প্রতিশব্দ বেছে নেয়া। Racism = জাতিবিদ্বেষ বললে কি ঠিক হয় না? জাপানীরা কোরীয়দের সাথে শুধুমাত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের পার্থক্যের দরুন যে অসঙ্গত আচরণ করেছিল সেটা জাতিগত বিদ্বেষ। সেখানে গায়ের বর্ণ কোন ব্যাপার ছিল না। আবার জাতি নির্বিশেষে একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি জাতি নির্বিশেষে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা একজন বাদামী চামড়ার ব্যক্তির সাথে শুধুমাত্র বর্ণ বিবেচনায় অসঙ্গত আচরণ করলে তাকে কি বর্ণবিদ্বেষ বলাটাই ঠিক হয় না? এই বিবেচনায় আলোচ্য বিষয়টি এক প্রকার বর্ণবাদই বটে। একে 'পক্ষপাতদুষ্টতা' বললে এর বিশিষ্টতা পরিষ্কার হয় না, এর নোংরামীটাও হালকা করে বলা হয়ে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বর্ণবাদের বর্ণ সম্ভবত গায়ের বর্ণ না, Caste। চতুর্বর্ণ যেমন।
Race = জাতি (নৃতাত্ত্বিক অর্থে) আর Caste = গোত্র হলে ঠিক হয় না? Caste = বর্ণ আমরা হরহামেশা ব্যবহার করি। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ বনাম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাপারটা তো আর Caste দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাহলে কী করা?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রেসিজম কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও থাকতে পারে (বলকান অঞ্চলে যেমন), কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যেও থাকতে পারে (হুটু-টুটসি)। সমাজে ব্যক্তির সমাজকর্তৃক আরোপিত অবস্থান হিসাবে বর্ণকে দেখলে মনে হয় ব্যাপারটা সহজ হবে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দেখছি হিন্দুশাস্ত্রমতে Caste কিন্তু আসলে বর্ণও না গোত্রও না! 'বর্ণ' হচ্ছে Varnaই - একদম ঋগবেদ যার আদিপ্রেরণা। আর শাস্ত্রমতে 'জাতি'-কেই নাকি আসলে Caste বলা হয়। উইকির বর্ণনা অনুযায়ী বর্ণপ্রথায় -
গোত্র = In Hindu society, the term gotra means clan।
জটিল!
****************************************
১। আমার মতে Racism-এর বাংলা হিসেবে 'বর্ণবাদ' আপাতদৃষ্টিতে একটু বিভ্রান্তিকর মনে হলেও, বিদ্যমান বিকল্পগুলির প্রেক্ষিতে আসলে খুব একটা ভুল নয়, বরং আসল অর্থের সবচেয়ে কাছাকাছি। তাছাড়া একবার এটা Racism-এর বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার ফলে বাংলা শব্দটা এমনিতেই মূল ইংরেজি শব্দটার সব অর্থ ও অর্থের সীমাবদ্ধতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনহেরিট করে ফেলে। ফলে তখন আর এর অন্যকোন অর্থ আছে বলা যায় না। তাছাড়া আমার জানামতে এটা একটা পারিভাষিক শব্দও বটে। অর্থের দিক থেকে পারিভাষিক শব্দকে সবসময় প্রচলিত বোধগম্যতা বা আপাত-অর্থের আক্ষরিক বা হুবহু প্রতিফলন করতে হয় না।
(ক) Racism-এর Race আসলে বাংলায় যে অর্থে সাধারণত 'জাতি' শব্দটা ব্যবহৃত হয় ঠিক সেই অর্থ বহন করে না; আবার বর্ণবাদের 'বর্ণ'-ও আসলে মনে হয় বাংলায় যে অর্থে সাধারণত আলাদাভাবে 'বর্ণ' শব্দটা ব্যবহৃত হয় - অর্থাৎ স্রেফ "রঙ" অর্থে - ঠিক সেই অর্থ বহন করে না।
(খ) আমি যদ্দুর বুঝি (অভিধান না দেখে বলছি) - দুয়েকটা মাইনর অর্থ বাদ দিলে বাংলায় সাধারণত আমরা চট করে 'জাতি' বলতে দু'টি অর্থ বুঝি - নেশন (nation) এবং এথনিসিটি (ethnicity) বা এথনিক গ্রুপ (ethnic group। এথনিক গ্রুপ-কে বাংলায় বোধহয় 'নৃগোষ্ঠী' বা 'নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী'-ও বলা হয়। প্রথমটা একটা রাজনৈতিক কন্সট্রাক্ট, দ্বিতীয়টা সামাজিক / সাংস্কৃতিক। এথনিসিটি বলতে কোন অঞ্চলের কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, আচার, প্রথা, ইত্যাদির একটা রূপের সাব্জেক্টিভ, কৃত্রিম, সাংস্কৃতিক নির্মান (কন্সট্রাক্ট) ও আইডেন্টিটি-পার্সেপশনকে বোঝায় - যার মধ্যে দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অন্যতম উপদান হিসেবে কোন নির্দিষ্ট এথনিক গ্রুপের সদস্যরা গ্রহণ করলেও করতে পারেন, আবার নাও পারেন। এটা অনিবার্য বা অপরিহার্য কিছু না। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন আর এথনিসিটিকে মানুষ বা সমাজের কোন সর্বজনীন, মৌলিক, অন্তর্গত, অবিচ্ছেদ্য, স্থায়ী বা অপরিবর্তণীয় বিষয় বা বৈশিষ্ট্য মনে করেন না।
'নেশান' কি তা বিস্তারিত বলার অপেক্ষাই রাখে না, তারপরও আমার এই লেখায় সেটা আলোচনা করেছি। এক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাকাঙ্খা।
পক্ষান্তরে বর্তমান প্রসঙ্গে Race হচ্ছে বহুরকম ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শিক (আইডিওলজিকাল) বাতিল-মালভর্তি ব্যাগ-ব্যাগেজসহ বায়োলজির ভিত্তিতে (শুরুতে বহুউৎসবাদ, পরে বিভিন্ন শারীরিক বা ফেনোটিপিকাল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, বর্তমানে জেনেটিক্সের) মানবজাতির মৌলচরিত্র বা মৌলিক গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য বা বৈচিত্র্য-নির্দেশকারী প্রাকৃতিক বিভাজন ও শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত একটা ছদ্মবৈজ্ঞানিক কৃত্রিম কন্সট্রাক্ট। এর কেন্দ্রে রয়েছে বায়োলজি ও তার প্রভাব ও অর্থ সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা হয়তো ভ্রান্ত। আর এর ফলশ্রুতিতেই উদ্ভব ঘটে বিভিন্ন তথাকথিত Race-এর মধ্যে ভালোমন্দ, উচ্চনীচ-ভেদকারী বা বৈষম্যসৃষ্টিকারী মতবাদ Racism-এর। বলাই বাহুল্য, গাত্রবর্ণ Race ও Racism-এর সমার্থক নয়, এর অন্যতম একটা ক্ষুদ্র optional উপাদান বা লক্ষণ মাত্র।
এর থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে - Race 'জাতি' না, কারন 'জাতি' বলতে আমরা যা বুঝি - এটা সেই এথনিসিটিও (নৃতাত্ত্বিক পরিচয়) না, নেশানও না। এথনিসিটির কেন্দ্রে আছে সংস্কৃতি ও আইডেন্টিটি-পার্সেপশন, নেশানের কেন্দ্রে রাষ্ট্র, আর শেষেরটার অর্থাৎ Race-এর কেন্দ্রে বায়োলজি। তাছাড়া আরেকটা পার্থক্য চোখে পড়ল এই মুহূর্তে - Race সমগ্র মানবজাতির শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত একটা তত্ত্ব, কিন্তু এথনিসিটি / জাতি বা নেশানের মধ্যে সমগ্র মানবজাতির শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত কোন ধারণা অবধারিতভাবে অন্তর্নিহিত নেই। Race-এর ধারণা ছাড়াই জাতি বা এথনিসিটির দিব্যি চলে যায়। তাই ক্ষেত্রবিশেষে এরা কখনও ওভারল্যাপ করলেও, এই তিনটা আসলে অত্যন্ত ভিন্ন জিনিস।
সুতরাং আমি অন্তত যদ্দুর বুঝতে পারছি, Race যেহেতু জাতি না, Racism-এর বাংলাও সেহেতু "জাতিবিদ্বেষ" বা "জাতিগত বিদ্বেষ" বললে ঠিক হয় না। তবে আমার মতে "জাতিগত বিদ্বেষ"-এর ইংরেজি হিসেবে xenophobia শব্দটা হয়তো ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
৩।
জাতি বলতে আপনি বোধহয় এথনিসিটি বুঝিয়েছেন, তাই না? যাহোক, এথনিসিটি নির্বিশেষে একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা একজন বাদামী চামড়ার ব্যক্তির সাথে শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ বিবেচনায় আসলে অসঙ্গত আচরণ করেন না। আপাতদৃষ্টে সেরকম মনে হলেও, আমার ধারণা আসলে তিনি অসঙ্গত আচরণটি করেন উপরে বলা Race-এর সংজ্ঞার আওতাতেই। এর পেছনে রয়েছে রেইসিজমের বিরাট ইতিহাস, আইডিওলজি, আর শ্বেতাঙ্গ রেশিয়াল শ্রেষ্ঠত্ববাদ, শ্বেত-প্রভুত্ব, শাসন-শোষণ-উপনিবেশবাদ-বৈষম্য ইত্যাদি সম্পর্কে ঐ ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক - সাংস্কৃতিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যাথার্থ্য ও ন্যায্যতাবোধের প্রভাব। শরীরের বেশিরভাগ ডুবে থাকা ভাসমান হিমশৈলের মতো এই ইতিহাস-আইডিওলজি-রাজনীতি তার চেতনে বা অবচেতনে লুকিয়ে থাকে, দেখা যায় শুধু ঐ হিমশৈলের পানির উপরে দৃশ্যমান চূঁড়া-টুকুর মতো "বর্ণ বিবেচনার" বাহ্যিক অংশটুকু। কিন্তু কথা হুলো, আইসবার্গ বাদ দিয়ে শুধু টিপ অফ দ্য আইসবার্গ তো আর হয় না!
মোদ্দা কথা হলো, এটাকে (শ্বেতাঙ্গের অসঙ্গত আচরণ) আমি Racism অর্থে বর্ণবাদ বা বর্ণবিদ্বেষই বলবো, তবে তা শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ বিবেচনার কারনে নয়, বরং উপরে (ও নীচে) বলা Race ও Racism-এর সংজ্ঞার সাথে মিলে যায় বলেই বলবো।
অবশ্য শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ বিবেচনা-ভিত্তিক বায়াস বা বৈষম্যও হতে পারে। তবে আমার মতে তা বাদামি আর কালো বা অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যেই বেশি সম্ভব, কারন ঐতিহাসিকভাবে Race-এর পাশ্চাত্য সংজ্ঞাটা বা তার সংশ্লিষ্ট বিশেষ ইতিহাস-আইডিওলজি-রাজনীতির ব্যাগেজ তাদেরকে সম্ভবত এতটা ভারাক্রান্ত করেনি। কালো - বাদামি ইত্যাদিদের মধ্যে পাশ্চাত্য অর্থে রেশিয়াল কন্টেক্সট-মুক্ত শুধুমাত্র গাত্রবর্ণ বিবেচনা-ভিত্তিক সামাজিক প্রেজুডিস বা বৈষম্যকে আমরা "কালারিজম" (colorism) বলতে পারি হয়তো।
৪। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিন্তু Racism-কে 'বর্ণবাদ' কেন বলবো?
(ক) কারন এটাই এর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গানুবাদ। কোন টার্মিনোলজিকাল অনুবাদ একবার ব্যাপকভাবে প্রচলিত, গৃহিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেটা আর বদলানোর দরকার পড়ে না এবং তা উচিতও না, এমনকি অনুবাদের L2 অর্থাৎ টার্গেট ভাষায় এর যদি অন্যরকম অর্থের সম্ভাবণা অনুভূত হয়ও। কারন অনুদিত টার্মটা অন্য সব অনুদিত টার্মের মতই ধীরে ধীরে মূল শব্দটার অর্থ ইনহেরিট করতে থাকে এবং তার নিজস্ব কোন অর্থ বা সম্ভাব্য অর্থ থাকলে সেটা হারাতে থাকে। এই প্রক্রিয়াটা চলতে দেয়া উচিৎ, কারন তা নাহলে যতবারই কোন বিদেশী টার্ম অনুবাদ করা হবে ততবারই ব্যবহারকারীদের কোন না কোন অংশের এই অনুবাদে দ্বিমত পাওয়া যাবেই - এবং তখন প্রতিবার দ্বিমতের সাথেই ঐ অনুবাদটা বদলে ফেলতে হবে। এভাবে চললে কোনদিনও কোন টার্মের অনুবাদকেই আর প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না এবং লেখালেখি ও অনুবাদের জগতে নৈরাজ্য দেখা দেবে। এর চেয়ে 'জুতা আবিষ্কারের' মত মানুষকে ইতিমধ্যে গৃহিত ও প্রতিষ্ঠিত অনুবাদের সোর্স (L1) শব্দটার অর্থের ব্যাপারে সচেতন করাই বরং অনেক বাস্তবসম্মত - এমনিতেও যা আসলে করা লাগবে অনুবাদের পূর্ণ অর্থ বোঝাতে।
(খ) বর্ণবাদের 'বর্ণ' অংশটা বোধহয় হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা (caste system) থেকে এসেছে। এর কারন বোধহয় বর্ণপ্রথার (caste system) সাথে Racism-এর কিছু জায়গায় মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ মিল আছে, যা জাতি বা অন্যকিছুর সাথে নেই। এর মধ্যে আছে - জন্মগতভাবে মানুষের অপরিবর্তণীয়* শ্রেণীকরণ, তাদের জন্মগত মৌলিক বৈশিষ্ট্য আর উচ্চনীচ ভেদাভেদের ধারণা। (* এই মিলটা অবশ্য ১০০% না, তবে যথেষ্ট)। এটা অবশ্য আমার অব্জার্ভেশন, কতটা সঠিক জ্ঞানী ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন।
এজন্যেই আমার মনে হয়, Racism-এর সাথে বাংলায় সম্ভাব্য অনুবাদ হিসেবে বিদ্যমান ক্যান্ডিডেট শব্দগুলির মধ্যে "বর্ণবাদ"-টাই কনসেপচুয়ালি সবচেয়ে এবং আসলে একমাত্র নিকটবর্তী শব্দ। এজন্যেই Racism-এর অনুবাদ হিসেবে আমার কাছে "বর্ণবাদ"-টাই সঠিক মনে হয়।
৫।
কোন কিছুকে হাল্কা বা ভারি করে দেখানোর চেয়ে তাকে আমি অব্জেক্টিভলি সঠিক মাত্রায় শুধুমাত্র প্রাপ্য গুরুত্বের সাথেই দেখতে বেশি আগ্রহী। কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে সমস্যাটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, বোঝা ও সংজ্ঞায়িত করা যেমন প্রয়োজন - তেমনি তার গুরুত্বের মাত্রা নির্ধারণ করাও সমান জরুরী। ভুলভাবে চিহ্নিত, বোঝা বা সংজ্ঞায়িত সমস্যার সমাধান যেমন ভুল এবং পরিণামে ক্ষতিকর হতে পারে, তেমনি সমস্যার গুরুত্ব নির্ধারণ বা মাত্রাভেদ করতে না পারাটাও ওভার, আণ্ডার, বা ভ্রান্ত রিয়্যাকশনের কারন হতে পারে - যা পরিনামে কাঙ্খিত ফলাফল আনতে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে অনাকাঙ্খিত ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। এই পোস্টটা ছাড়াও আমি বাঙালিদের বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে সচলায়তনে প্রকাশিত হয়েছে এমন বেশ অনেকগুলি পোস্ট আবার পড়ে দেখলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই Racism বা বর্ণবাদের নামে (এটা Racism-এর বাংলা জেনেই) যে সমস্যাগুলি নিয়ে এসব পোস্টে আলোচনা হয়েছে (কাউকে আড়ালে 'কাউল্লা' বলা, চিঙ্কু বলা, বিয়ের ক্ষেত্রে ফর্সা পাত্রপাত্রী খোঁজা বা কালোদের সমান প্রায়োরিটি না দেয়া থেকে শুরু করে বাঙালিদের নানারকম ক্ষুদ্রমনা আচরণ) - তার অধিকাংশই আসলে "বর্ণবাদ" বা Racism না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি আসলে Prejudice, Bias (পক্ষপাতদুষ্টতা) এবং অল্পকিছু ক্ষেত্রে Discrimination। কিন্তু Racism বা বর্ণবাদ না। এই শব্দ বা টার্মগুলির মধ্যে অর্থগত পার্থক্য কিন্তু অত্যন্ত critical ও গুরুতর এবং এর প্রত্যেকটাই স্বতন্ত্র সমাধানের দাবি রাখে। একটার ক্ষেত্রে আরেকটার সমাধান তেমন কাজে লাগবে না, বরং উলটো ফল ফলতেও পারে। এই পোস্টের লেখিকা যে উদাহরণগুলি দিয়েছেন, তার মধ্যে কোনোটা Bias (পক্ষপাতদুষ্টতা) আবার কোনোটা Discrimination। কিন্তু কোনটাই Racism না। এটা আরেকটা বড় আলোচনা, কিন্তু আমার এই কমেন্টটা মূল পোস্ট থেকে বারো হাত কাকুড়ের চব্বিশ হাত বিচির মতো এত বড় হয়ে গেছে যে এখানে লেখা আর বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। অথচ আলাদা একটা পোস্ট দেয়ার জন্য গোছানো নিটোল একটা লেখা তৈরি করার ধৈর্য্য বা মনোযোগও পাচ্ছি না! উইকি থেকে তাই Racism-এর একটা চমৎকার ও সতর্ক মনোযোগের সাথে অনুধাবনযোগ্য সংজ্ঞা উদ্ধৃত করে শেষ করি হিমালয় মন্তব্যটা --
****************************************
১. পোস্ট আলোচনার ভিত্তি, তবে পোস্টের শব্দ সংখ্যার চেয়ে আলোচনার শব্দ সংখ্যা কম হতে এমন কোন কথা নেই। আলোচনা যখন যতটুকু করা দাবি রাখে তখন ততটুকু করাই উচিত।
২. আপনার আগের পোস্টটি যে কারণেই হোক, আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। লিঙ্ক দেবার জন্য ধন্যবাদ।
৩. একটা খটকা কিন্তু আমার মনে থেকেই যাচ্ছে। ভারতবর্ষে (জাতি নির্বিশেষে) পার্টিকুলারলি গায়ের রঙের গাঢ়ত্বের পার্থক্যের দরুণ যে বৈষম্যমূলক আচরণ সেটাকে একটা জুতসই শব্দে কীভাবে প্রকাশ করা যায়?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার নিজের কানে শোনা একটি ঘটনা বলি, দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা একজন মেয়ে চিকিৎসক আমাকে একবার বলছিলেন, তার ছাত্রী জীবনে সবগুলি বৃত্তি পেয়েছিলেন। নাইনে ওঠার সময় তারই গার্লস স্কুলের এক টিচার বলেন এই কোন মেয়েটা ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছে? ঐ যে কালো করে দেখতে মেয়েটা?
ভাবুন তো একবার
পাণ্ডবদার সাথে যোগ করি; মাঝে মাঝে মনে হয় বর্ণবাদ শব্দটা মনে হয় ঠিক না। হয়ত শ্রেণিবিভাজন মূল কথাটার বেশি অর্থ প্রকাশ করে; যদিও শব্দটা বেশ খটমটো আর অপ্রচলিত
শ্রেণী ব্যাপারটা তো হরেক রকমের। অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি। একেবারে হার্ডকোর গায়ের রঙের ব্যাপারটাকে যদি শ্রেণিবিভাজন বলেন তাহলে সেটা বিভ্রান্তিকর হয়ে যায় না?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
গায়ের রঙ বিশাল একটা ফ্যাক্টর আমাদের দেশে। দুঃখজনকভাবে শিশুবেলা থেকেই এই বিষয়টা আমাদের মাঝে চালু হয়ে যায়।
আপনার লেখাটা অনেককে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই নিষ্ঠুরতা আমরা প্রায়ই করি। গান গাইতে গেলেও একই ব্যাপার।
সুন্দর বাচ্চাগুলোকে বসানো হয় মাঝখানে, যেখানে সাধারণত সবাই তাকায়। সুন্দর বাচ্চাদের আদর বেশি এই জিনিসটা পরিবারের মধ্যেও ঘটে। তাও ভালো কিছু লোক সচেতন হচ্ছেন। ধন্যবাদ এই বিষয়ে লেখার জন্য।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আমি নিজে ছোট বেলায় এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। আমি খানিকটা বোকা হওয়াতে, তখন খুব একটা ধরতে পারিনি বিষয় গুলো। আমার ব্যাক্তিগত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যে বাচ্চাটি এ ধরনের আচরনের শিকার হচ্ছে, তাদের পাশাপাশি যে বাচ্চাটি প্রিভিলেজ পাচ্ছে তার জন্যও বিষয়টি ক্ষতিকর, এ সব বাচ্চার মধ্যে, ব্যক্তিত্ব হীনতা, আত্মমর্যাদা বোধ হীনতা সহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
অনন্যা
নতুন মন্তব্য করুন