রোগ /অপরাধ/রোগী/ অপরাধী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৭/০৩/২০১৬ - ১০:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সকালে ঘুম ভেঙ্গেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি, যেন ফাইনালে উঠা বাংলাদেশকে নিয়ে চিৎকার করতে পারি। টেলিভিশন ছেড়ে ,ওমা একি, বৃষ্টির কারণে ম্যাচ প্যাচে পড়ে আছে। টেলিভিশন চালু রেখে ভাবলাম, খেলার খবর দেখার ফাঁকে রান্নাটা সেরে ফেলি। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার ছেলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমি রান্না ঘর থেকে এসে আবার খেলার চ্যানেল নিয়ে আসি। আর আমার ছেলে "শেইপ" বলে বলে নাঁকা কান্না করছে। কি করি? মা খেলা দেখবে ,ছেলে 'শেইপ" দেখবে। সমাধান হিসেবে তাকে হাতের মোবাইলে ইউটিউব থেকে 'শেইপ" ভিডিও চালু করে দিলাম। সেও খুশি, আমিও স্বস্তি নিয়ে রান্নায় মন দিলাম।

মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। বর্তমান -অতীতে বিচরণ করে এক সাথে। পিঁয়াজ কাটতে কাটতে মনে মনে ভাবছিলাম 'গত কয়েকদিনে "খুনী মা" দের ' খবর গুলো নিয়ে।মনে প্রশ্ন আসছিল,এরা কি হত্যা করছে? এমন কি তাদের বাধ্য করছে, নাড়ী ছেড়ে ধনকে চিরতরে বিদায় দিতে, মা যেখানে নিজের জীবন বিনিময়ে সন্তানের জীবন প্রার্থনা করে , সেখানে কি কারণে মমতা হার মেনে যাচ্ছে ?। 'মা' তো এমন হতে পারে না। হচ্ছে যখন, তা কেন হচ্ছে? ব্যাক্তি কতটুকু দায়ী, সমাজ কতটুকু দায়ী, রাষ্ট্র কতটুকু দায়ী? এই সব প্রশ্নের উত্তর , কয়েক বছর আগের (যখন কারো মেয়ে,কারো বোন, কারো স্ত্রী পরিচয় ছাপিয়ে কারো 'মা' হয়েছি), সময়ের কিছু প্রশ্নের ভিতরে লুকিয়ে ছিল।

আমার মনে পড়ে ,আমার ছেলে যখন প্রিম্যাচ্যুরিটির কারণে ইনকিউবেটরে ছিল। আমার তখন সারাটা দিন হাসপাতালে তার সাথে সাথে থাকতে ইচ্ছা করত। থাকতামও ।মনে হতো হয়তো আমি শারিরীকভাবে কোন জায়গায় অক্ষম, তাই এমন হয়েছে।কিংবা কি কারণে হয়েছে ,কি এমন আমি করেছি, আমার ছেলের ভবিষ্যত কেমন হবে নানা বিষয় মাথায় ঘুর ঘুর করত। তার উপর দেশের বাইরে ছিলাম, অনেক মন খারাপ থাকত। এই ভেবে যে , সবাই সন্তান কোলে নিয়ে হাসে আর আমি সন্তানকে কোলেই নিতে পারছি না।সে মেশিনের ভেতর নানা ধরণের তার-যন্ত্র দিয়ে ঢাকা। তখন একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার ( যাদেরকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার মত মায়েদের জন্য নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন) প্রায় আমাকে সময় দিতে আসত। নানা বিষয় নিয়ে কথা বলত। আমার কেমন লাগছে ,কি করতে ইচ্ছা করছে ।এই ধরণের যেসব শিশু সার্ভাইব করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন করছে,তাদের ছবি দেখানো সহ আমার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিত , জানা না থাকলে চিকিৎসককের মাধ্যমে সেই বিষয় অবগত করানো সহ নানাভাবে সাহস যোগাতে চেষ্টা করত,ফোনে কথা বলত,খবরা-খবর নিতো। যা আমাকে মানসিকভাবে অনেক শক্তি যুগিয়ে ছিল।

মনে পড়ে, নিয়মিত ফলোয়াপ, চেক আপে নার্স-ডাক্তার সামনে কম্পিউটার নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেঃ কেমন আছেন /বাচ্চা কেমন / আপনার কি বাচ্চাকে মারতে ইচ্ছা করে/ আপনার কি সুইসাইড করতে ইচ্ছা হয়/ আপনার স্বামী আপনাকে সময় দেই / সে কি বাচ্চা কেয়ারে সাহায্য করে/ কোন শারিরীক,মানসিক চাপ,আঘাত দেই কি? প্রথমে দিন এমন প্রশ্ন শুনে মনে হয়ে ছিল 'ওদের বুঝি মাথায় সমস্যা আছে'। গাইনি চেক আপে কি সব ওলোট পালোট কথা জানতে চাইছে। কেন তারা এই সব জানতে চাইছে? সে সময় জীবনে প্রথম শুনি যে মা বাচ্চা জন্ম দেই, গর্ভবতী সময়কালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে হরমোন গত কিছু পরিবর্তনের কারণে সেই মায়ের নানা মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয় । যেটাকে মুড সুয়িং বা বেবি ব্লুজ বলা হয়। এর ফলে বাচ্চাকে অসহ্য মনে হওয়া থেকে শুরু করে আত্মহত্যা -হত্যা পর্যন্ত হতে পারে। হরমোন গত এই পরিবর্তন সবার ক্ষেত্রে হতে পারে। এটি কখনো চৌদ্দ দিন স্থায়ী হয় আবার তার বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে।
আমাদের দেশে সরকারী কিংবা বেসরকারী হাসঅপাতালে এই ধরণে কোন ব্যবস্থা দেখেনি। মনোঃ চিকিৎসক কি নেই,আছে। এর জন্য আলাদা কোন হাসপাতাল বানাতে হবে তাও না।দামী কোন টীকা লাগবে তাও না। মূল হল ব্যবস্থাপনার ভেতরে মা-শিশুর ভবিষ্যত নিরাপত্তার জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা নেই। থাকলে এমন নির্মম ঘটনার জন্ম হতো না হয়তো। তাই ভাবছি রাষ্ট্রের দায় কতটুকু?

প্রাইভেট পর্যায়ে যারা চেম্বার করেন ,তাদের মধ্যে বেবি ব্লুজ নিয়ে কোন প্রশ্ন দেখিনি ( বোন, ভাবী,মামীদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)। আবার পরিবার বা সমাজ পর্যায়ে এই নিয়ে কোন জ্ঞান নেই বললে চলে। বেবি ব্লুজে আক্রান্ত একজন মা যখন পরিবারে কাউকে বলবে "আমার কাছে আমার বাচ্চা ভাল লাগছে না' কে এটাকে গুরুত্ব সহকারে নিবে? বরং হেসে হেসে উড়িয়ে দিবে, চিকিৎসা তো দূরের কথা। তাছাড়া এই জাতীয় অনুভূতিকে কয়জনে রোগ ভাবে? পাশে থাকা ,সাহস দেওয়া তো প্রশ্নেই আসে না। তাই ভাবছি সমাজের দায় কতটুকু ?

আক্রান্ত ব্যক্তি ভাববে "এসব কি হচ্ছে" 'কাকে বলব' 'কিভাবে বলব' ।এভাবে অনুভূতিটা তথা হরমোন পরিবর্তনের ধাপ গুলো নিয়ে বসবাস করতে করতে হয়তো দূর্ঘটনার দিন ঘনিয়ে আসে।তাই ভাবছি ব্যক্তি কতটুকু দায়ী? কলেজ জীবনে মনোবিজ্ঞানে পড়ে ছিলাম আবেগ, অনুভূতি,দুঃখ ,হাসি ,কান্না সব কিছু দেহের অভ্যন্তরের বিভিন্ন গ্রন্থি সমূহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কাউকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করা আর কাউকে ঘৃণা করা, আনন্দ পাওয়া,বিষাদ লাগা সব কিছু হরমোন নিঃসরণ ও এর মাত্রার উপর নির্ভর করে। ব্যক্তি নিজে কিছু করে না। ব্যক্তি তার শরীরের হাতে বাঁধা। কিংবা বলা যায় সে সব করতে বাধ্য।

বনশ্রীতে ঘটে যাওয়া ভাই-বোনের হত্যাকান্ড, প্রথমে বিষক্রিয়া,পরে পরকীয়ার কাঁধে চড়া,তারপরে মায়ের স্বীকারোক্তি 'দুশ্চিন্তা থেকে হত্যা'। এরপর কিশোরগঞ্জে মায়ের হাতে দেড়বছরের শিশুখুন,এর জন্য মায়ের মানসিক ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করা। সব যেন 'মা-মাতৃত্ব-সন্তান' জগতে সৃষ্ট এক ধরণের 'গর্তের' ইঙ্গিত করছে। যেখানে আরো অনেক মায়ের পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্যান্সার মৃত্যু ঘটাবে জেনেও মানুষ হাজার রকম চেষ্টা করে বাঁচার। কিন্তু কোনটি মানসিক সমস্যা, কোনটি কখন হয়ে থাকে, এর জন্য কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে কিংবা কারো মানসিক সমস্যা হয়েছে, হচ্ছে জেনেও তা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করার তেমন তৎপরতা থাকে না। তাই দুটি হত্যাকান্ডের মূল হোতা 'দুশ্চিন্তা' এবং 'ভারসাম্যহীনতা ' ( যা সম্পূর্ণ মানসিক সমস্যা এবং চিকিৎসায় আরোগ্য রোগ) পিছনে থেকে 'মা' কে খুণী বানিয়ে ছেড়ে যায়। (ব্যাক্তি গত মতামত)। আমাদের দেশে গড় হারে চিন্তা করার প্রবনতা বেশি। তাই শরীরের অভ্যন্তরের পরিবর্তণ থেকে মানসিক সমস্যা এবং সেখান থেকে গুরুতর হয়ে 'রোগের পর্যায়ে' গেলেও ,এই রোগের রোগীকে ' রোগী' না ভেবে, এককথায় পাগল ভাবা হয়। এতে করে বিষয়টি অনেক হালকা হয়ে যায়। সুদুর প্রসারী যাত্রায় সমাজের জন্য এই সমস্যা তথা 'মাতৃ আতংক' আরো প্রকট হয়। যা অগোচরে থেকে গেছে বলেই হয়তো শিশু আজ মায়ের কোলে নিরাপদ না।

যে মা সন্তানকে চল্লিশ সপ্তাহ শত কষ্ট সহ্য করে নিজের ভেতর ধারণ করে। অবর্ণণীয় ব্যাথা সহ্য করে সন্তানের মুখ দেখার জন্য ,সে মা কেন আজ হত্যাকারী? হত্যাকান্ড যদি বাহ্যিক কারো দ্বারা হতো তাহলে বিষয়টি 'হত্যা-অপরাধ-বিচার' এই ভাবে দেখলে হিসেব চুকে যায়। কিন্তু স্বয়ং মা যখন খুনী হয়ে উঠে ,তখন গড় বাধা তালে হিসেব চুকালে। আপাতভাবে মিমাংসা হলেও সমাধান হবে না । বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, প্রামাণ্যচিত্রে, নাটকে ,মিনা কার্টুনে মেয়েদের শিক্ষা , সন্তান সম্ভবা মায়ের পুষ্টিকর খাবার , জন্মের পর পর বুকের দুধ দেওয়া, জন্ম বিরতি পিল,পিরিয়ডকালীন প্যাড ইত্যাদি দেখানো হয়,আমরা দেখি। জানি। কিন্তু মুড সুয়িং এর মত নিরব ঘাতক সমস্যা জানানো হয় না, জানা হয় না।

মিম,মিম, মিম' আমার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটায় আমার ছেলে। মুড়িকে সে মিম বলে। আমি তাকে মিম দিলাম । সে খুশি হয়ে ফিক করে একটা হাসি দিয়ে দিল।এমন হাজারো হাসির হাজারো মুহুর্ত পৃথিবীতে মনে হয় একমাত্র মা-ই মনে রাখতে পারে। মা-মাতৃত্ব-সন্তান নিরাপদ থাকুক, মানসিক সমস্যা ও মনোরোগ চিহ্নিত ও চিকিৎসা হোক, অপরাধের বিচার হোক।
এ্যানি মাসুদ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখেছেন। এই দিকটাই আমার মনে হয় আমাদের আরো অনেক ভাবার আছে। মনোরোগের চিকিৎসার প্রয়োজন এখন খুব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে আর সে সম্পর্কে সচেতনতাও।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক এর ছবি

পরিস্থিতি যা দাড়িয়েছে,তাতে এখনই সচেতন না হলে আরো বিপদ আসলে অস্বাভাবিক হবে না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।