উপনিবেশিকতার জ্ঞান সৃষ্টি ও জাতিগত পরিচয় দানের রাজনীতি : পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে হুমায়ুন আজাদ পাঠ; হরিপূর্ণ ত্রিপুরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/০৯/২০১৬ - ৮:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সর্বপ্রথমে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমার এই নিদিষ্ট বিষয়ে কেন আগ্রহ তার ভূমিকা পাঠকের সুবিধার জন্য দেওয়া দরকার বলে মনে করছি ৷ হুমায়ুন আজাদের 'পার্বত্য চট্টগ্রাম:সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা' নামক ছোট্ট বইটি সম্ভবত অবশ্যপাঠ্য ও প্রিয় বই বিশেষত তাদের কাছে-যারা ব্লগ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন- অফলাইন মাধ্যমে হিল ট্র্যাকসের পাহাড়ী/আদিবাসীদের (সরকার ও অনেক বাংগালীর মতে উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী)অধিকারের আন্দোলনের বিরুদ্ধে, তাদের সমাজ কাঠামোর সমালোচনায় অন্যদিকে সেখানে বাংগালী বসতিকরণ- সেনাশাসনের পক্ষে লেখালেখি করে থাকেন ৷ যারা বাংলাদেশে একমাত্র বাংগালী জাতি ও বাংগালী জাতীয়তাবাদে(সেক্যুলার কিংবা মুসলিম বাংগালী জাতীয়তাবাদ) যে মতবাদে বিশ্বাস করেন না কেন হিলট্র্যাকস্ প্রসঙ্গ আলোচনায় তারাও হুমায়ুন আজাদের রেফারেন্স টানেন ৷

বইটি আমি পড়েছি অনেক বৎসর আগে, সুতরাং কি লেখা আছে সবগুলো মনে নেই ৷ তাই হন্য হয়ে খোঁজছিলাম আমার স্মৃতিকে একটু ঝালাই করার জন্য ৷ সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার সীমাহীন আগ্রহ কিভাবে দেশের অন্যতম প্রধান একজন প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধী লেখকের বই প্রতিক্রিয়াশীল লোকজনদের (অবশ্য এটা আমার একান্ত মন্তব্য ৷ আমাকেওতো কেউ কেউ এ ধরণের লেখার জন্য বলতে পারে অতি প্রতিক্রিয়াশীল একজন লোক!) প্রিয় হতে পারে ? বইটি প্রগতিশীল অনেকেরও নিশ্চয় পছন্দের যদি তার স্বার্থ হিলট্র্যাকসে থাকে অথবা বইটি কারোর যদি হিলট্র্যাকস্ বিষয়ে পড়া প্রথম হয় এবং তিনি যদি ক্রিটিক্যাল না হন ৷ উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বামপন্থি রাজনীতি করা যদি প্রগতিশীলতার অনেক সূচকের একটা সূচক হয় তাহলে একজন তুখোড় বামপন্থিকে চিনি যিনি হুমায়ুন আজাদের হিল ট্র্যাকস্ সম্পর্কিত ঐ লেখা/বিশ্লষণকে হিল ট্র্যাকসের একজন অধিবাসী বাংগালী হিসেবে থাকার ও বিভিন্ন বই পড়ার অভিজ্ঞতায় সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করেন ৷

কিছু কারণে আমার পক্ষে হার্ডকপি বই সংগ্রহ করে পড়া দুষ্কর ৷ তাই ভরসা ইন্টারনেটে ফ্রি PDF বই খোঁজা, যদিও বিষয়টি আইনি ও নৈতিকতার পরিপন্থী ৷ অনেকদিন নেটে খোঁজাখোঁজির পর liberationwarbangladesh নামক ওয়েবসাইটে আমি আমার অতি কাংখিত বইটি পেলাম ৷ সেজন্য ঐ ওয়েবসাইটের জড়িত লোকদের অশেষ ধন্যবাদ ৷ যদিও এখানে আমার প্রশ্ন জেগেছিল, এখানে এই বইটি কেন? এটাতো কোন মুক্তিযুদ্ধের বই নয় ৷ মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলার ভুখন্ডের এক অংশে জাতি ও তার সাথে জড়িত অধিকারবোধ নিয়ে প্রথমে সরকারের সাথে একদল জনগোষ্ঠীর বিরোধের সুত্রপাত, পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যা মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা এখনো চলমান ও মীমাংসাহীন - তার উপর লেখা বই ৷ ও হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে একদল পাহাড়ীর অংশগ্রহন, অন্যদিকে কিছু এলিটদের বিরোধীতার সামান্য আলোচনা আছে হিল ট্র্যাকসের ঘটনাপঞ্জি হিসেবে ৷ কিন্তু তা অবশ্যই যথেষ্ঠ নয় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ই-লাইব্রেরী ধরণের সংগ্রহশালায় স্থান পেতে ৷ তাই অমুক্তিযুদ্ধের বই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় এমনি উদেশ্যবিহীনভাবে স্থান পাবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা ‍। তবে এখানে আমার এই লেখার উদেশ্য কেন এই বইটি এই সংগ্রহশালায় এবং তার অন্তনির্হীত কার্যকারণ কি হতে পারে তার অনুসন্ধানে কোমর বেঁধে নামা নয় ৷ এখানে আমি হুমায়ুন আজাদের ঐ নির্দিষ্ট বইয়ের মধ্যে নিজেকে নিবিষ্ট রাখতে ও আমার অনাগত পাঠককে স্বাগত কিংবা ভাগত জানাতে চাই ৷

চলুন তাহলে মূল আলোচনার দিকে আগানো যাক ৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান হিংসার ঝর্ণাধারা - বইটির প্রারম্ভিকায় হুমায়ুন আজাদের বক্তব্য এই রকম ' এই ছোটো বইটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও তার সমস্যা সম্পর্কে পাঠক পাবেন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচয়, যা উপস্থাপিত হয়েছে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে' (আজাদ ১৯৯৭: ৯)৷ এই উক্তির মাধ্যমে লেখক আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর সৃষ্টিকর্মের সত্যতা কিংবা মূল্য সম্পর্কের ধারণা পাঠককে ধারণা দিতে চেয়েছেন ৷ এটা হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের একটা কৌশল বা প্রচারণা । যার প্রধান উদ্দেশ্য হতে পারে, এক; পাঠককে বইটিতে আকৃষ্ট করানো, দুই; লেখক যা সত্য হিসেবে বিশ্বাস করেন তা তাঁর ভবিষ্যত পাঠককুলকে সুকৌশলে বিশ্বাস করানো- জাদু বিদ্যায় সম্মোহিত করানোর মতো ৷ আমার লেখার উদেশ্য হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগাম ও এর সমস্যা সম্পর্কে ছোট একটি বইয়ে দাবীকৃত 'একটি পূণার্ঙ্গ পরিচয়' কে অসম্পূর্ণ কিংবা উনার দাবিকৃত নিরপেক্ষতাকে পক্ষপাতমূলক লেখা – এই বলে সাব্যস্ত করে সমালোচনা করা নয় । সে দৃষ্টতাও আমার নে়ই। অন্যভাবে বললে, লেখাটির উদেশ্য হুমায়ুন আজাদের লেখা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ভুল বা সঠিক, বাস্তবতাবর্জিত কিংবা বাস্তবতা প্রতিফলিত-এগুলো দেখানো আমার আলোচনার প্রধান লক্ষ্য নয়।

আমার লক্ষ্য হচ্ছে তার ব্ই লেখার পিছনের পটভূমি ও লেখার পদ্ধতি, ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যে সময় সমাজ রাষ্ট্র জাতি শ্রেণীতে অবস্থান তাঁর লেখায় সেগুলোর কোন প্রভাব আছে কিনা দেখা, পরিশেষে উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি থাকে তাহলে তার সৃষ্ট জ্ঞান কি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, কি উদেশ্য এর পিছনে থাকতে পারে তা খোঁজে দেখা । যেহেতু জাতিগতভাবে আমি একজন পাহাড়ী/ আদিবাসী, হিল ট্র্যাকসের চরম গোলযোগ সময়ে শৈশব পার করা একজন মানুষ- সেহেতু আমাকে স্বীকার করতেই হবে হুমায়ুন আজাদের এই বইয়ের উপর আমার বিশ্লেষণ হবে হয়তো তাঁর নিজের দাবিকৃত নিরপেক্ষ বা অবজেক্টিভ লেখার বিপরীতে আমার জীবন অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধিতে জারিত সাবজেক্টিভ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ৷ আবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম, জাতিগত বিষয়ক এবং শক্তিমানের ক্ষমতাহীন জাতিগোষ্ঠীকে পরিচয় করানোর মধ্যে সুপ্ত রাজনীতি বিষয়ক কিছু পড়াশোনাও আমার পাথেয় হবে এই যাত্রায় হুমায়ুন আজাদকে শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট বইয়ের উপর ভিত্তি করে জানার জন্য - তিনি আসলে কতটুক নিরপেক্ষ ছিলেন বা থাকতে পেরেছিলেন তাঁর নিজের বিশাল প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধী ভাবমূর্তির মধ্যে থেকে । ‌

দ্বিতীয়ত, মিশেল ফুকো নামক এক পন্ডিতের কোন বিষয়ের অধ্যায়ন বা বিশ্লেষণে ডিসকোর্স নামক পদ্ধতির ব্যবহারের আমার সামান্য পড়াশোনাকে আমি কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো ৷ ডিসকোর্স বলতে আমি এখানে কোন বিষয়ে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের উদেশ্য এবং এটার সাথে ক্ষমতার বা রাজনীতির কি সম্পর্ক থাকে তা বুঝাতে ব্যবহার করবো ৷ সাথে এডওয়ার্ড সাঈদ আরেক পন্ডিতের অরিয়েন্টালিজম (প্রাচ্যতত্ত্ব) নামক তত্ত্বের ব্যবহার ৷ ফয়েজ আলমের মতে, অরিয়েন্টালিজম হচ্ছে একটা লেখার-জ্ঞান চর্চার পদ্ধতি যেখানে পশ্চিমের লেখকরা নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে জ্ঞানের একটা কাঠামোর মধ্য থেকে প্রাচ্যকে নিয়ে গল্প উপন্যাস, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি লেখা বা প্রাচ্য সম্পর্কে অধ্যয়ন ও চর্চা করে থাকেন ৷ তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, ফুকোর ডিসকোর্স/জ্ঞানেরভাষ্য (জ্ঞানের উৎপত্তি), ব্যাখা ও ক্ষমতা তত্ত্বের ধারনা সাঈদকে সহায়তা করেছিলেন উপনিবেশের সাথে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভুমিকা খোঁজে দেখতে৷ তবে আলমের মতে, অরিয়েন্টালিজম (প্রাচ্যতত্ত্ব) শুধু পূর্ব ও পশ্চিম এই সমীকরণে নয় বা ইউরোপিয়ান উপনিবেশের সময়কালে জ্ঞান চর্চার পদ্ধতিকে নয়, এর পরবর্তী বিভিন্ন জায়গায় যেমন ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, ফিলিস্থিনে ইসরাইল, ভারত উপমহাদেশের দেশভাগের পরে পূর্বপাকিস্থানের প্রতি পশ্চিমপাকিস্থানের আচরন এরকম অনেক উদাহরনে প্রাচ্যতত্ত্বকে প্রয়োগ করা যায় ৷ সেই একই বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের পথ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি বাংলাদেশ তথা প্রান্তিকতার (peripheri) প্রতি কেন্দ্রের আচরনকে আমি হুমায়ুন আজাদের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ৷

বইটির তথ্যসংগ্রহ ও লেখার পটভূমি
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের মধ্য থেকেও হুমায়ুন আজাদের কাছে দূর দ্বীপবাসিনীর মতো, যার রূপের বয়ান সে শুনেছে তৃতীয় কারোর মাধ্যমে, তৃষ্ণার্ত হয়েছে তাকে দেখার কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী গন্ডগোল তাঁর ইচ্ছায় সেধেঁছে বাঁধ ৷ বিপরীত দিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম তাঁর কাছে কোন প্রেতপুরির গল্পও, যেটা দেশের মধ্য থেকেও ভয়ংকর নিষিদ্ধ এক অঞ্চল । সেখানে সেনাবাহিনী দেশের অন্য অংশের জনগণের জন্য অদৃশ্য এক দেওয়াল তুলে রেখেছে ৷ তাই মাঝেমধ্য কোন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে তিনি শুনেন- সেখানে তাঁর প্রিয় কিন্তু দুই জেনারেল ( জিয়া ও এরশাদ) এর দ্বারা কলংকিত হওয়া সেনাবাহিনীর কাহিনী এবং তাদের সহযোগী পূর্ণবাসিত বাংগালীরা পাকিস্থানী কায়দায় ন্যাকারজনক নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ৷ এবং বিশ্বাসও করেছেন ঐ গল্প তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই । গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য কারণ তখনো মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি জাগরুগ । এবং বাংলাদেশে দুই জেনারেলের আমলে সামরিক শাসনের কর্মকান্ডও মানুষকে ঐ গল্গে বিশ্বাস করাতে সহায়তা করেছে (আজাদ, ১৯৯৭:২৮-২৯) ৷ এই ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের পূর্বে ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের মূল্যায়ন ।

যে বইটি নিয়ে আমার আলোচলা, এটি হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর প্রথম লেখা নয় । তারও প্রায় একদশক আগে ‘রক্তাক্ত বিপন্ন পাহাড়’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর লেখকের ভাষায় ‘আবেগতাড়িত’ এক প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন ‘সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’ নামে এক পত্রিকায় (পরে প্রবন্ধটি ‘নিবীড় নীলিমা’ বইয়ে সংযোজিত হয়)। আশির দশকের শেষান্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর আবেগঘন লেখায় যা তিনি লিখেছিলেন, তা ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের অধিকারের পক্ষে ৷ তাই এই বইটি লেখার উদেশ্য হচ্ছে তাঁর পূর্ববতী খন্ডিত ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রবন্ধের বিপরীতে সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ লেখা বা বয়ান দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা ৷ অর্থাৎ তাঁর পূর্ববতী লেখাকে সংশোধনের প্রয়াস (আজাদ, ১৯৯৭:৯) ৷

প্রথমটাতে, প্রবন্ধে, লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন বিপ্লব চাকমা নামে এক পার্বত্যবাসীর দ্বারা । দ্বিতীয়টার,বই, লেখার উৎস সরকার ও সেনাবাহিনীর আমন্ত্রনে, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ও জিপে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখা ও জানা । সময়কাল ৯-১১ জুন ১৯৯৭ সাল অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তির (২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ ) সামান্য কয়েকমাস পূর্বে ভ্রমন । তবে সেনাবাহিনীর আয়োজনে ঐ সফরটি পার্বত্য চট্টগ্রামে হুমায়ুন আজাদের প্রথম পদার্পন নয় । তারও আগে তিন দশকের বেশি সময়ের পূর্বে তিনি গিয়েছিলেন সেখানে কিন্তু প্রকৃতির বা বৃষ্টি বাধসাধার কারনে চারদিন অবস্থানের পরেও লেখকের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু না দেখা ও জানা হয়নি ৷ তাই সরকার বা সেনাবাহিনীর আয়োজনে ঐ সফরটি ছিলো তাঁর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, একই সাথে সেখানকার মানুষ ও তিন দশকের বেশি জাতিগত সমস্যার অভিজ্ঞতা লাভের প্রথম সুযোগ (আজাদ ১৯৯৭: ৪০)৷

আনিসুজ্জামানের 'বিপুলা পৃথিবী' পড়ে জানা যায়, সে সফরে ঢাকার বুদ্ধিজীবিরা দুইভাগে গিয়েছিলেন । একগ্রূপে ছিলেন আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, সিরাজুল ইসলাম সহ আরো কয়েকজন । তাঁদের যাত্রাপথ ছিল ঢাকা থেকে চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট, সেখান থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে হিলট্র্যাকসের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন । তবে সম্ভবত জেলাসদরে অবস্থান ও ঘুরাঘুরিতে সেনাবাহিনীর জিপই তাঁদের একমাত্র ভরসা ছিলো । আনিসুজ্জামানের বয়ানে জানা যায় যে-'রাঙ্গামাটিতে (প্রশান্ত ত্রিপুরার মতে জায়গাটি হবে খাগড়াছড়ি, কারণ রাঙ্গামাটিতে রিক্সা চলেনা) আমি সামরিক বাহিনীর জিপে করে চলেছি , দেখি উল্টোদিক থেকে রিক্সায় আসছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক; আমার বিশেষ স্নেহভাজন প্রশান্ত ত্রিপুরা ৷ আমি জিপ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম ৷ একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে বললো 'আপনি, সার !' আমার মনে হলো জুলিয়াস নাটকে ব্রুটাসের ছুরিকাঘাতে আহত সিজারের উক্তি, তুমি ব্রুটাস, যেন আবার ধ্বনিত হলো ৷ প্রশান্তকে বললাম , 'সার্কিট হাউজে আছি ৷ সন্ধ্যার পর এসো ৷ অনেক কথা আছে ৷ সামরিক বাহিনীর জিপে আমাকে দেখার পর হয়তো তার আর আমার কাছে আসতে ইচ্ছে হয়নি (আনিসুজ্জামান ২০১৫ :৫০১)৷ ' তাই বলা যায় হুমায়ুন আজাদের বইটি লেখার তথ্যউপাত্ত মূলত: সেনাবাহিনীর দেওয়া; সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার-জিপে করে সেনাবাহিনীর চোখেই তিনি পার্বত্য দেখেছেন।

উপজাতির রূপকল্প : কবির নাকি বাঙ্গালী জাতির কল্পনা?
‘রক্তাক্ত বিপন্ন পাহাড়’ নামক পাহাড়ীদের স্বপক্ষে লেখা প্রবন্ধে, হুমায়ন আজাদ লিখেছেন 'ওই অঞ্চলের কথা ভাবলেই দেখতে পাই পাহাড়, বাঁশঝাড়, শাল-কড়ই-কমলালেবুর বন, বক্ষবাসহীন শুভ্রতরুণী, সরল শান্ত পুরুষ, নৃত্যগীত আর উৎসবে মদ্যপানের উল্লাস'(আজাদ ২০১০:৭৮)৷ কবি মনের কল্পনায় তিনি দেখেছেন- দেশের মধ্যে 'আধুনিক সভ্যতা' উপেক্ষা করে তাঁর ভাষায় উপজাতিরা 'আদিমতা'য় চমৎকার জীবিনযাপন করে ৷ তাই বর্বর আধুনিকতার মুখোশে ক্লান্ত লেখকের মন সেই রোমান্টিক আদিম নৈসর্গিক জীবনের জন্য, তাকে ছুয়ে দেখার জন্য কি কাতর! কবির কল্পনার কোন সীমা নেই, থাকা উচিতও নয় ৷ কিন্তু কোন সমাজ ব্যবস্থার কোন ছবি তিনি যদি আঁকেন তা হওয়া উচিত বাস্তবতার যতদূর কাছাকাছি ৷ তবে লেখকের মতে, এখানে তিনি খটখটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন বই তিনি লিখতে চাননি ৷ তিনি যা লিখেছেন তা হচ্ছে রাজনীতি আর সাহিত্যের মিশ্রন - রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহিত্য ৷ যেখানে তিনি নিজেই চালক তাঁর কল্পনার ঘোড়ার ৷ তাই পাহাড়ী নামক পুরো একটা জনগোষ্ঠী কবির রোমান্টিক কল্পনায় বর্তমান থেকে শব্দে - কাব্যের ব্যঞ্জনায় সুদূর অতীত কিংবা পুরোপুরি কল্পনার জগতে রোমান্টিকতার হাহাকারে মূর্তমান হয়ে ওঠে ৷ অতীত ও বর্তমান, বাস্তব আর কল্পনা এখানে মিলেমিশে একাকার ৷

একইভাবে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা ' বইটিতে তিনি লিখছেন যে- ‘ক্যাম্পের শীর্ষে উঠে তাকালে সৌন্দর্যে বিবশ হয়ে আসে রক্তমাংস; প্রেমিক- প্রেমিকরা যেখানে উঠলে এক আলিঙ্গনেই এক ঋতু কাটিয়ে দিতে পারবে; ...’ । কিন্তু আফসোস তাঁর - ‘ওই পাহাড়ে নেই কোন প্রেমিক প্রেমিকা, তারা সেখানে কখনো যেতে পারবে না ; - সীমানা পাড়া, সাজেক, ঘনমোড়, তানখইতং, সুবলং, বিলাইছড়ি, থানচির মতো অসাধারন দুর্গম সুন্দর স্বর্গে কোন প্রেমিক প্রেমিকা নেই, আছে নিঃসঙ্গ তরুণেরা, যারা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে (আজাদ ১৯৯৭: ৩১)'৷ শেষ লাইনে কবি যেন তাঁর শব্দ-বাক্য–উপমা-উৎপ্রেক্ষায় রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষদের কথায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ৷ প্রশ্নজাগে কারা এই নিঃসঙ্গ তরুণদের দল ? এই উত্তরের পূর্বে চলুন আরো কিছু জিজ্ঞাসার ফয়সালা করি ৷ এই সব পাহাড় কি আসলেই জনবিরলহীন কোন দ্বীপ ? পাহাড়ে বসত জাতিগোষ্ঠীতে কি কোন তরুন তরুনী নেই ? তাদের ভালবাসার মতো কোন মানবিক অনুভূতি নেই, গান নেই গল্প নেই হৃদয়ের ভাব আদান প্রদানে ? ত্রিপুরাদের পুন্দা- লালমতি, চাকমাদের রাধামন -ধনপুদি সহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রেমের গল্পগুলো তিনি শুনেছেন কিনা জানিনা ৷ পাহাড়ে প্রতিটি শিশুই কি তাহলে ভালবাসাহীন মৈথুনে জন্মায় ? নাহ লেখক এখানে তা বলতে চাননি ৷ তাঁর হৃদয়জুড়ে আসলে নিঃসঙ্গ আধুনিক যক্ষদের বেদনায় কাতর ৷ সে বেদনার হাহাকারের মেঘে ঢেকে যায় ঐখানকার অধিবাসী পাহাড়ী তরুণ তরুণীদের প্রেমবিরহের গল্প ও গান ৷ লেখকের কালবৈশাখীর ন্যায় দুর্বার আবেগের মেঘে ক্যাম্পের আশেপাশের সব জনপদ, ঐ জনপদে মানুষের দুঃখেবদনার গল্প হারিয়ে যায় কবির কল্পনা থেকে –তাঁর হৃদয়জুড়ে রয়ে যায় শুধু সৌন্দর্য লীলাভূমিতে নিঃসঙ্গ তরুনদের গল্প ৷ কারা সে তরুনদের দল ? এর পরবর্তী লাইনে মনোযোগ সহকারে পড়লে এর উত্তর পাওয়া যায় । হুমায়ুন আজাদের নির্বাসিত যক্ষরা - 'সুদর্শন ও মেধাবী - ইংরেজি বলতেই তারা বেশি অভ্যস্ত, এটাই তাদের বিছিন্ন করে রাখে দেশবাসী থেকে ; আর সৈনিকেরা দক্ষ ৷ ক্যাম্পগুলোতে তাদের দুটিই প্রধান শত্রু : নি:সঙ্গতা ও মশা, শান্তিবাহিনী তাদের গৌণ শত্রু (আজাদ ১৯৯৭: ৩১) ৷’ প্রশ্ন হতে এটা কি শুধু কবির কল্পনা, নাকি তিনি যে সমাজ- জাতি -শ্রেণির প্রতিনিধি তার প্রতিচ্ছবি ? আমার মনে হয়, দ্বিতীয়টি ৷ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তার রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজের পরমপরস্পরা যে লিখিত বা অলিখিত অর্জিত জ্ঞান আছে তিনি তার উপর ভিত্তি করে বইটি লিখেছেন ৷ তিনি সে জ্ঞানের চর্চা করেছেন মাত্র ৷ এভাবে দূর অতীত বা অস্তিত্বহীন কোন সময় বা সমাজকে বর্তমানের কোন সমাজের উপর আরোপ করেন ৷ সাঈদের প্রাচ্যবিদরা প্রাচ্য সম্পর্কে যে ছবি আঁকেন এই ছবি কি খুববেশি তফাত ?

প্রাচ্যতত্ত্ব ও হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদের মতে- ‘বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সমগ্র জনগনের মতোই পাহাড়ী জনগনকে আধুনিক গনতান্ত্রিক অধিকার সম্পন্ন স্বচ্ছল ও শিক্ষিত মানুষে পরিনত করা ; এবং তাদের দ্রুত সার্বিক উন্নতি সাধন ৷ তাদের আদিম সমাজ কাঠামোর মধ্যে সাধারন মানুষদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই; তাই ঐ সামন্ত সমাজ কাঠামো ভাঙ্গা দরকার (আজাদ ১৯৯৭: ৯)'' ৷ পড়ে দেখলেই বুঝা যায় লেখক নিজেকে কোন জাতির -রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী (‘নিজ’ বাঙ্গালি জাতি) হিসেবে নিজকে শ্রেষ্ঠ-সভ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন ‘অপর’ পাহাড়িদের তুলনায় । তাই নিজের দায়িত্বে ঠিক করতে চান পাহাড়িদের ভালোমন্দের ভবিষ্যত ! এখানে প্রাচ্যতত্ত্বের আলোচনা টানা যায় । প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের বিখ্যাত রচনাগুলি ঘেটে সাঈদ দেখান ওগুলোয় প্রাচ্য বরাবরই নিকৃষ্ট, অযোগ্য ও অসভ্য চিহ্নিত হয়েছে ; তার বিপরীতে পশ্চিম সবসময় উৎকৃষ্ট, সভ্য, যোগ্য ও সক্ষম ৷ এই শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টতার বোধ প্রাচ্যতত্ত্বের সৃষ্টি ৷ এই বোধ এক পর্যায়ে পশ্চিমের রাজনীতিবিদ, পর্যটক, সৈনিক, ব্যবসায়ী , লেখক - শিল্পীদের প্ররোচিত করেছে প্রাচ্যকে কব্জা করতে ৷ এই জ্ঞানের পরস্পরা একটি নিদিষ্ট মনোভাব থেকে সৃষ্ট ৷ এর মধ্য রয়েছে অপরের প্রতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার আকাংখা ৷ তাই প্রশ্ন এই ধরনের জ্ঞান কিভাবে নিরীহ নির্দোষ হয়(ফয়েজ ২০০৮ :১৩) ? নিরপেক্ষতার ও পরিপূর্ণতার ব্যাপারতো পরে ৷ হুমায়ুন আজাদও প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের প্রতিনিধি মাত্র ।
অধিকন্তু তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা স্বাধীনতা বা শ্বায়ত্বশাসনের সমস্যা নয় , প্রধান সমস্যা হচ্ছে ওই অঞ্চলের সামন্ত প্রভুরা সাধারন মানুষদের বিকশিত হতে দেয়নি, তাঁদেরকে দাসে পরিনত করে রেখেছে ১৯০০ সালের বিধিমালা দিয়ে (আজাদ ১৯৯৭: ৯-১০)৷ ' পড়ার পর কোন পাঠকের - যার পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই কিন্তু ব্রিটিশ সামন্ত প্রভু বা জমিদারকে সম্পর্কে যার ন্যুনতম ধারনা আছে- মনে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সেই সামন্ত প্রভুদের কথায় সব’- এই জাতীয় শাসন চলছে সেখানে ৷ লেখক এভাবে দূর অতীত বা অস্তিত্বহীন কোন সময় বা সমাজকে বর্তমানের কোন সমাজের উপর আরোপ করেছেন ৷ স্বাধীনতা ও শ্বায়ত্বশাসনকেও একপাল্লায় 'বা' দিয়ে ব্যবহার করেছেন যেন এগুলো সমার্থক শব্দ ৷ কেন লেখককে পাহাড়ী সমাজ ব্যবস্থাকে দূর অতীতের কোন নিষ্ঠূর সামন্তীয় প্রথায় নিয়ে যেতে হয়েছলো, এই বয়ানের পিছনের কি রাজনীতি নিহিত – তা নিচের বাক্যে পরিস্কার অনুধাবন করা যায় । তাঁর যুক্তি- ‘পাহাড়ীরা তাঁদের দাবিগুলোকে গৃহীত ও বাঙলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চান, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী (আজাদ ১৯৯৭:৭)৷’ উপরোক্ত লেখায় বুঝা যায় হুমায়ুন আজাদের নিজস্ব অবস্থান, পাহাড়ীদের আন্দোলনের প্রতি তার সুস্পষ্ট বিপরীত অবস্থান ও তাকে সংবিধানের দোহাই দেওয়ার রাজনীতি ৷ একজন লেখক যিনি ধর্মীয় গ্রন্থের মতো সাধারণ্যে ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে মানব রচিত কোন সংবিধানের ভুলত্রুটি থাকলে তা সংশোধনের সমস্যা কোথায় ? সংবিধান কি কোন ঈশ্বরের প্রেরিত বাণী যা অপরিবর্তনীয় ? সংবিধানে কোন নীতি-বিধি-ভাষায় যদি জাতিগত কোন বৈষম্য থাকে, কোন জাতিগোষ্ঠীর অধিকার যদি তার দেশের সংবিধানের exclude হয়ে থাকে তাহলে পরিবর্তন পরিমার্জনের মাধ্যমে সমতার একটা ব্যবস্থা করা যায় ৷ সংবিধানের প্রতি লেখকের অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তি কি ? এটা কি তাঁর হৃদয়ে লালিত্য ও সুপ্ত অন্ধ জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ ? পাশের দেশ ভারত, দুরের দেশ সুইজারল্যান্ড, কানাডা এইরকম অনেক দেশে জাতিগত রাজনৈতিক বিরোধ বিভিন্ন রকম ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন বা স্বায়ত্বশাসনের মাধ্যমে সমাধান করা হয় ৷ যদি তিনি মানব লিখিত সংবিধানকে এমনই অপরিবর্তনীয় ভেবে থাকেন তাহলে এটা কিভাবে তার প্রগতিশীলতা ও প্রথাবিরোধীতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় ৷ নাকি তিনি মেজরিটি মানুষের অর্থাৎ বাংগালী জনগোষ্ঠী চাওয়া ও স্বপ্নের প্রতি আস্থাশীল ? যেটা কখনো আক্ষরিক কখনোবা বিকৃত গনতন্ত্রের উদাহরন হতে পারে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে শোষন ও অধিকার বঞ্চিত করার অভিপ্রায় থাকে ৷ এটাকে হয়তোবা ইংরেজিতে বলে tyranny of majority বা সংখ্যাগুরুর স্বৈরশাসন ৷ এটা শুরু হয়েছিলো বাংলাদেশের সংবিধানে একমাত্র বাংলাভাষা, জাতি, বাংগালীর ইতিহাস ঐহিত্যকে স্বীকৃতির মাধ্যমে ৷ মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ ও তিক্ষিকার ফল হিসেবে প্রাপ্ত রাষ্ট্রে অন্য জাতিগোষ্ঠীকে একদিকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে অন্যদিকে তাদের ভিন্নতাকে হেয় ভেবে আহ্বান জনানো হয়েছে বাংগালীতে আত্তীকরন কিংবা মিশে যাওয়ার জন্য ৷

আলোচনা ও উপসংহার
হুমায়ন আজাদের এই লেখা হচ্ছে সেই ঐহিত্যবাহি প্রাচ্যতাত্ত্বকদের পথ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জ্ঞানের উৎপাদন ৷ একটা বিশেষ উদেশ্যে, অথবা একটা বিষয়ে পূর্ব ধারনাগত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে লেখা ৷ এটা হচ্ছে কোন বিশেষ বিষয়ে ''লঘু চিত্তের কল্পনা নয়, বরং তত্ত্ব ও চর্চার সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি কাঠামো যার পেছনে রয়েছে প্রজন্মক্রমিক প্রচুর বিনিয়োগ (ফয়েজ ২০০৮:২০৫)৷ '' এই বিনিয়োগ হচ্ছে কোন ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোন উপাদান যেমন সেনাবাহিনী ও তার বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের অর্থ- সময়-শ্রম -মেধার ইত্যাদির বিনিয়োগ ৷ কেউ যদি বান্দরবান যান, তাহলে দেখবেন চিটাগাং থেকে বান্দরবানের শহরে প্রবেশের রাস্তা মোড়ে, বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের সামনের ব্রীজে , চিম্বুকসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে যাওয়ার মোড়ে জোড়ায় জোড়ায় সুদৃশ্য পাহাড়ী / আদিবাসি ও বাংগালীর নারীপুরুষের ছবি টাঙ্গানো , প্রতিটি সাইনবোর্ড নীচে কোন জাতি বা উপজাতি ( বাংগালীদের ক্ষেত্রে জাতি , পাহাড়ীদের ক্ষেত্রে ঊপজাতি ) আর্মিদের বয়ানে একটা জাতিগত পরিচয় দেওয়ার উদাহরণ দেখতে পাবেন ৷ এভাবে অর্থ, জ্ঞান বা প্রদর্শনের বিনিয়োগের উদেশ্য কি নেহাত দেশের কোন জাতি/উপজাতি গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরা নাকি বিশেষ রাজনৈতিক উদেশ্য নিজেদের মতো করে 'অন্য' দের উপস্থাপন? যার উদেশ্য প্রচারে প্রসার লাভ ও মিথ্যাকে সত্য পরিনত করার মিশন ৷ তিনি লিখেছেন যে, সরকার ও সামরিক বাহিনীর আমন্ত্রণে আরো অনেক বুদ্ধিজীবির সমভিব্যাহারে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন ৷ 'সেনাশাসন থাকলে আমি এই আমন্ত্রণ অবহেলা করতাম (আজাদ, ১৯৯৭:৮) ''- অভিমত তাঁর ৷ কারন দেশে তখন তাঁর গণতান্ত্রিক সরকার । তবে তিনি যদি খোঁজ নিতেন তাঁর সফরকালেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন ছিলো; অপারেশন দাবানল । এখনো চলে অপারেশন উত্তরণ নামে । তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখন ছিলো ? নাকি তা ‘দেশ’ নামক শব্দের কোন বাহ্যিক বা মানস চিত্রে স্থান পায়না ?

ও হ্যাঁ,হুমায়ন আজাদ পার্বত্য চট্টগ্রামকে খোলে দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানিয়ছেন ৷ তাঁর মতে, এই ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’ বানিয়ে রাখা সেনাবাহিনীর ইমেজই ক্ষতি করেছে বেশি ‍-''শক্তিমান মাত্রই খলনায়ক, আর বিদ্রোহীরা পায় সব সহানুভতি, যদিও নৃশংসতায় তারাও অতুলনীয় ৷ শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতেছে সেনাবাহিনী, এবং হেরেছে প্রচারে .. (আজাদ, ১৯৯৭:৩০)'' সে জন্য এই খোলে দেওয়ার যুক্তি ৷ অথার্ৎ সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, দেশি -বিদেশি গবেষক, মানবাধিকার কর্মী সবার সেনা নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ চলাচলের বাধার কথায় নিশ্চয় তিনি বুঝিয়েছেন ৷ এখানেই প্রশ্ন - তাহলে সরকার ও সেনাবাহিনী কেন এখনো সবার অবাধ চলাচলে প্রচন্ড ভয় পায়, কেন পার্বত্য অঞ্চলের বাইরের স্বাধীন গবেষক, সাংবাদিক ও বিদেশীদের জন্য হিলট্র্যাকসকে নো এন্ট্রি জোন টাইপের করে রাখা হয় ? হুমায়ন আজাদ জীবিতকালে নিশ্চয় এই বিষয়গুলো দেখেছেন, বেঁচে থাকলে দেখতেন এবং চিন্তা করতেন তাঁর কথার প্যারাডক্সটা কোথায় ৷

সবোর্পরি, এই বই আমাদের সামনে হুমায়ুন আজাদের অন্ধ জাতিয়তাবাদ, জাতিত্যভিমান ও কলোনাইজেশনের অন্যতম এক উদাহরণ যেন উন্মোচন করে । তার সাথে বিভিন্ন আর্মি অফিসারের ইত্তেফাক, নয়াদিগন্ত, ইনকেলাব, দৈনিক পূর্বকোণসহ হাজারো অনলাইন পত্রিকায় একই দিনে প্রকাশিত হওয়া একই কলামের ভাষা ও তথ্যে খুব বেশি ফারাক নাই ৷ ভাবতে অবাক লাগে, একজন সংবেদনশীল লেখক কিভাবে কোন জনগোষ্ঠীর জন্য অপমান সূচক শব্দকে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন (‘উপজাতি’ শব্দে তিনি জানেন পাহাড়ীরা আহত বোধ করেন তবু তিনি তাদের জন্য ‘উপজাতি’ শব্দই বরাদ্দ করেছেন ) এবং কিভাবে নিজেকে উন্নত ও সভ্য জাতির আসনে নিজেকে বসিয়ে অন্যদের শাসন – খবরদারি ফলাতে চান ৷ এর উত্তর হচ্ছে প্রাচ্যতত্ত্বে । সাঈদের মতে – ‘উপনিবেশী আগ্রাসনের সাথে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি ও জ্ঞান চর্চার নিবিড় সম্পর্ক ৷ বিশেষ ধরনের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা ও জ্ঞান চর্চা পশ্চিমাদের মনে প্রাচ্যকে নিকৃষ্টরূপে দেখায় ৷ প্রাচ্যকে কব্জা করতে ও বশ করতে প্ররোচনা যোগায় ৷ তাই সাঈদের মতে প্রাচ্যতত্ত্ব বা বিশেষ উদেশ্যে প্রাচ্যকে নিয়ে পশ্চিমাদের লেখা প্রাচ্যতত্ত্ব বা অরিয়েন্টালিজম হচ্ছে - জ্ঞান ও ক্ষমতার শয়তানী জোটের সবচেয়ে বড় নমূনা - এই জন্য যে, এটা উপনিবেশকতা (colonialism), উপনিবেশিক শাসকদের কাজ ( colonial rulers ) কাজকে বৈধতা দানের জন্য একধরণের বর্ম হিসেবে কাজ করে’ (ফয়েজ ২০০৮: ১২)। হুমায়ুন আজাদ হচ্ছেন সে ‘বক্তা মার্লো’ যিনি মুখে ‘মুখে সামাজ্র্যবাদের বিরোধিতা করে কিন্তু তার মনোভাব যুক্তির জাল বুনে আফ্রিকার স্বশাসনের বিরূদ্ধে (ফয়েজ ২০০৮:১৮) ৷

শেষান্তে, হুমায়ুন আজাদ যে জ্ঞানকাঠামো- মনোভঙ্গির উপর হিল ট্র্যাকস সম্পর্কে লিখেছেন তা আসলেই প্রাচ্যতত্ত্বেরই চর্চা । আমি মহামতি সাঈদের অরিয়েন্টালিজম তত্ত্ব মাথায় রেখে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে এই ধরনের জ্ঞান চর্চাকে বলবো 'ট্রাইবালিজম' আর যাঁরা এর চর্চা করেন তারা হচ্ছেন 'ট্রাইবালিস্ট' ৷ আমি মনে করি সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্বের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান শুধু পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের সম্পর্কের অধ্যয়নে নয়, প্রাচ্যের মধ্যে একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একই গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োগ করা যায় ৷ দেখানো যায় ক্ষমতাসীন সরকার/ জনগোষ্ঠী কিভাবে একই উপনিবেশিক কায়দায় শাসন ও শোষন করে, তার জন্য সুপরিকল্পিত জ্ঞান সৃষ্টি ও তার প্রসারে সচেষ্ট হয় ৷ উদেশ্য- শাসন শোষণকে বৈধতা দেওয়া, শোষিতের কন্ঠরোধ ও শোষণের বিভিন্ন উপায় বের করা ৷ অরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে যেমন মিশনারী, পর্যটক, সৈনিক, সরকারি কর্মকতা, একাডেমিশিয়ান সহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন আছে , ট্রাইবালিস্টদের মধ্যেও তার ব্যতিক্রম নাই ৷ হুমায়ুন আজাদ তাদেরই একজন এবং অবশ্যই অতি উজ্জ্বলতম । এবং এই বইটি কেন উগ্র সাম্প্রদায়িক লোকদের এতো প্রিয় ? এর উত্তর- হুমায়ুন আজাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি বা ব্র্যান্ড ৷ তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধীতার অন্যতম প্রতিভূ ৷ যার উক্তি বা লেখা অধিকাংশ প্রগতিশীল লোকেরা সত্য হিসেবে ধরে নেয় ৷ তাই যারা বাংলাদেশের উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন, হিলট্র্যাকসের সরকার বা সেনাবাহিনীর ধমননীতিতে বিশ্বাস করেন, সেখানে সরকার ও সেনাবাহিনীর সুপরিকল্পিত উদেশ্যে বাংগালী পূর্নবাসনের নীতিতে বিভিন্ন যুত্তি তর্ক ও তথ্যে জায়েজ করার চেষ্টা করেন হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্বাসের দিক দিয়ে বিপরীত মেরুতে থাকলেও শুধুমাত্র এই নিদিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তাঁর সর্বশেষ লেখা বই তাদের চিন্তাধারনাকে সাপোর্ট করেন ৷ এখানেই সেই রহস্যের উত্তর ৷ এটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরো দেখায় যে, প্রগতিশীল ও প্রথাবিরোধীতা এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হওয়া, উপনৈবিশক কায়দাকানুনকে সাপোর্ট করার মতো বৈপরীত্য লক্ষণও একসাথে সহাবস্থান করতে পারে । এবং সবচে বড়ো দূর্ভাগ্য যে, হুমায়ুন আজাদের সামনে কোন ‘প্রশান্ত’ ছিলোনা, যা আনিসুজ্জামানের ছিলো ; যা আনিসুজ্জামান কে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছিলেন -আমি ব্রুটাস নাতো ? তাই একই সফরে গিয়েও, একই যানবাহনে একই দৃশ্য দেখেও এবং একই ধরণের হিল ট্র্যাকস সম্পর্কে ব্রিফিং পেয়েও (আমার অনুমান) আনিসুজ্জামানের উপলব্ধি নিন্মরূপ-
‘নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের আদিবাসী বলার বিষয়ে আমাদের দেশে মতভেদ আছে, কে কে কখন দেশের কোন খন্ডে প্রবেশ করেছে, তা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে, আদম - হাওয়াও পৃথিবীতে এসেছেন স্বর্গোদ্যান থেকে, আদিবাসী অর্থে কেবল বসতিস্থাপনের সন তারিখ বুঝায় না, তাদের কতকগুলি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে জোর দেওয়া হয় তার উপরে ৷ আমরা পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালির স্বাধিকারের দাবি করেছি, তাদের পক্ষে যে দেশবাসীর যে অংশ বাঙ্গালী নয় তাদের নিজস্ব অধিকারের পক্ষালম্বন করা অবশ্যকর্তব্য ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রক্তপাত ঘটেছে, তা ঘটা উচিত ছিলোনা ৷ আশাকরি, আমরা এতদিনে বুঝতে পেরেছি যে, রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান কোথাও হয়নি, হতে পারেনা ৷ অতএব, আমাদের যে সমস্যা তার সমাধান খুঁজতে হবে সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে (আনিসুজ্জামান ২০১৫: ৪৯৮-৪৯৯ )’ ৷

(বি:দ্র:-এটি হিল ট্র্যাকসের উপর রচিত হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধ ও বইয়ের উপর ভিত্তি করে। এটার সাথে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম ও ব্যক্তিত্বকে মেলানো নিশ্চয় ঠিক হবেনা)

তথ্যসুত্র:
আজাদ,হুমায়ুন ১৯৯৭পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ৷
আজাদ, হুমায়ুন ২০১০,নিবিড় নীলিমা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ৷
আনিসুজ্জামান ২০১৫, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ৷
আলম, ফয়েজ ২০০৮, এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের নির্বাচিত রচনা,সংবেদ প্রকাশনা, ঢাকা ৷


মন্তব্য

সাব্বিহ হোসেন এর ছবি

সুন্দর, ছিমছাম, গোছানো লেখা। হুমায়ুন আজাদের বইটা পড়া না থাকলেও লেখা থেকে অনেকটাই বুঝে নেওয়া যায়। criticism হিসেবে অনবদ্য হয়েছে। আমি নিজেও আদিবাসী শব্দটাই prefer করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অাপনার কমেন্টের জন্য । আর আমার শ্রদ্ধা থাকলো আপনার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য । ভালো থাকুন । হরি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হুমায়ূন আজাদের এই লেখাটা সম্পর্কে কোনোই ধারণা ছিল না। রিভিউটা অনেক ভালো

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, ভালো লাগলো শুনে। হরি

সোহেল ইমাম এর ছবি

আমার মনে হয় উপজাতি, আদিবাসী এ ধরনের শব্দের কোনটা লাগসই হয় এই বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা উচিত কোন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জীবন যাপনের ধরন ও সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণ মূল্যটা দেওয়া। হুমায়ুন আজাদের বইটার পিডিএফ আমার কাছেই আছে এখনও পড়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু আপনার লেখাটা এখন এ বিষয়ক যে কোন রচনা পড়বার সময় ওরিয়েন্টালিজমের কথাটা মাথায় রাখতে উৎসাহিত করবে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

বইটা পড়া হয় নি তবে আপনার রিভিউটা চমৎকার লেগেছে। অনেকদিন পর এত চমৎকার এবং গোছানো রিভিউ পড়লাম। হিল ট্র্যাক্টস নিয়ে জানার স্বল্পতা রয়েছে। আপনার লেখা পড়ে আরও বিস্তারিত জানার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ

মন মাঝি এর ছবি

লেখাটা ভালো হয়েছে - এবং এরকম লেখা আরও আসা দরকার!

তবে আমার কিছু গৌণ অব্জারভেশন --

১।

যদিও এখানে আমার প্রশ্ন জেগেছিল, এখানে এই বইটি কেন? এটাতো কোন মুক্তিযুদ্ধের বই নয়.... ও হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে একদল পাহাড়ীর অংশগ্রহন, অন্যদিকে কিছু এলিটদের বিরোধীতার সামান্য আলোচনা আছে হিল ট্র্যাকসের ঘটনাপঞ্জি হিসেবে ৷ কিন্তু তা অবশ্যই যথেষ্ঠ নয় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ই-লাইব্রেরী ধরণের সংগ্রহশালায় স্থান পেতে ৷ তাই অমুক্তিযুদ্ধের বই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় এমনি উদেশ্যবিহীনভাবে স্থান পাবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা ‍। তবে এখানে আমার এই লেখার উদেশ্য কেন এই বইটি এই সংগ্রহশালায় এবং তার অন্তনির্হীত কার্যকারণ কি হতে পারে তার অনুসন্ধানে কোমর বেঁধে নামা নয় ৷

এখানে আপনাকে আমার বেশ প্যারানয়েড মনে হচ্ছে। অনেকটা কিছু বাঙালীর মতো যারা দুনিয়ার সবকিছুতেই আমড়িকা/ইসরায়েল/ইন্ডিয়া/সিয়াইএ/কেজিবি/র'/ইয়াহুদী/নাসারা - ইত্যাদির ষড়যন্ত্র খুঁজে। এমনকি একটা পিঁপড়া বায়ুত্যাগ করলেও তাতে কোনো-না-কোনোভাবে আম্রিকা বা সিয়াইএ পায়! একটা আর্কাইভে (ও হ্যাঁ, এটা ই-আর্কাইভ - ই-লাইব্রেরী না) অনেক ধরণের বইপত্র-দলিল দস্তাবেজই থাকতে পারে। ঐ আর্কাইভ যদি কোনো বিশেষ বিষয়ে ডেডিকেটেড হয়, তাহলেও। যদি দূরতম কোনো সম্পর্কও থাকে। কারন আমি যদ্দুর বুঝি, আর্কাইভ প্রধাণত স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি গবেষকদের গবেষণার র' রিসোর্স যোগানোর দায়িত্বও পালন করে। লাইব্রেরী প্রকাশিত সিস্টেমেটিক জ্ঞান অর্গানাইজডভাবে পাঠকের জন্য পরিবেশণ করে, আর আর্কাইভ ঐ অর্গানাইজড ও সিস্টেমেটিক জ্ঞান নির্মানের কাজে নিবেদিত গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, আপাত-অসংবদ্ধ কাঁচামাল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। কোনো নির্দিষ্ট গবেষণার ক্ষেত্রে ঐ কাঁচামালের "যথেষ্ঠতা", চূড়ান্ত মূল্য বা গুরুত্ব বিচারের দায়িত্ব বোধহয় গবেষকেরই, আর্কাইভিস্টের না। তাঁর ক্রাইটেরিয়া অন্যরকম। তাঁর কাছে তাই "যথেষ্ঠতা"-র চেয়ে এর "কাঁচামালত্বের" গুরুত্ব বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এটাতো তাইই, তাই না?
এছাড়া আর্কাইভের আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে ইউনিক বা দুর্লভ রিসোর্স সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। আপনার বর্ণনা থেকে মনে হচ্ছে এই বইটাও দুর্লভ হয়ে এসেছে। সেদিক থেকে এটা এই ক্রাইটেরিয়াও মীট করে। সবশেষ বলবো, "অমুক্তিযুদ্ধের বই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায়" স্থান পেলেই আপনি "উদ্দেশ্য" ( অসদুদ্দেশ্য আরকি!) খুঁজে পান - এমনকি আপনার কথা মতই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকা সত্ত্বেও। অথচ সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত অনেক বই যে ওখানে আছে, এমনকি --- "বাংলা স্বদেশী গান" - গীতা চট্টোপাধ্যায় (মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক আগে ২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে এর পটভূমি), "উত্তাল চল্লিশ-অসমাপ্ত বিপ্লব" - অমলেন্দু সেনগুপ্ত (মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক আগে ৪০-এর দশকে এর পটভূমি), "স্বাধীনতা-সংগ্রামে বাংলার নারী" - কমলা দাশগুপ্ত (মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক আগে ১৯০৫-১৯৪৭ এর পটভূমি), "সাধক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ" - পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক আগে এর পটভূমি), "নোয়াখালিতে মহাত্মা" - সুকুমার রায় (বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনেক আগে এর পটভূমি), "অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম" - অনন্ত সিংহ (পটভূমিঃ ১৯৩০-এর দশক, বিষয় সূর্যসেনদের আন্দোলন মনে হয়) ---- এগুলির মতো এত-এতগুলি সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত - এমনকি ,মুক্তিযুদ্ধের বহু বহু আগের বিষয় নিয়ে লেখা বই যে ঐ ই-আর্কাইভের একদম প্রথম পাতাতেই নাকের ডগায় জ্বলজ্বল করে ঝুলে আছে ভিজিটরের দৃষ্টি-আকর্ষণের জন্য- সেগুলি আপনার চোখেই পড়লো না একেবারে???!!! এগুলি নিয়ে একাবারও প্রশ্ন জাগলো না আপনার মনে - "এখানে এই বইগুলি কেন? এগুলি তো মুক্তিযুদ্ধের বই নয়!....এত্তগুলি অমুক্তিযুদ্ধের বই মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় এমনি উদেশ্যবিহীনভাবে স্থান পাবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা..."। যত সন্দেহ শুধু ঐ একটা বই নিয়েই!! কেন? আপনার এই সিলেক্টিভ ব্লাইন্ডনেসকে কি বলবো, বা এটা কিসের লক্ষণ? চলেন, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় এইসব সবগুলি অমুক্তিযুদ্ধের বইয়ের অন্তর্ভূক্তির মহাগোপন উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সিরিয়াস তদন্ত শুরু করি...

২।

কেন পার্বত্য অঞ্চলের বাইরের স্বাধীন গবেষক, সাংবাদিক ও বিদেশীদের জন্য হিলট্র্যাকসকে নো এন্ট্রি জোন টাইপের করে রাখা হয় ?

এই লাইনটা বুঝলাম না! শান্তিচুক্তির পর থেকে গত প্রায় ২০ বছর ধরে এরকম অবস্থা প্রায় নেই বলেই তো জানি। স্বাধীণ-পরাধীণ সব পদের সাংবাদিক, গবেষক, সাধারণ মানুষই পালে পালে হরদম পার্বত্য চট্টগ্রামে যাচ্ছেন বলেই তো জানি। এটা অবশ্য আমি বিস্তারিত জানি না, তবে আমি নিজেই আমার সাম্বাদিক-অসাম্বাদিক নানাপদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে একাধিকবার পাঃচঃ ঘুরে এসেছি, বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় আদিবাসী মানুষজনের সাথে মেলামেশা করেছি, তাদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি, তাদের সাথেই ঘোরাঘুরি করেছি, আড্ডা দিয়েছি - কৈ কেউ তো বাধা দেয়নি। সরকার, পুলিশ বা মিলিটারির সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও নাই। অনেক গবেষকও যান বলে জানি। বিদেশীও দেখেছি আমি। তাই এই লাইনটা একটু কনফিউসিং মনে হলো। আরেকটু খোলসা করলে ভালো হতো।

৩।

যার [হুঃআঃ] উক্তি বা লেখা অধিকাংশ প্রগতিশীল লোকেরা সত্য হিসেবে ধরে নেয় ৷

এইবার আপনি হাসালেন। আপনার কথিত প্রগতিশীল ঘরাণার বহু মানুষই হুমায়ুন আজাদকে তার কিছু ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও একজন প্রোফেশনাল সেলফ-ট্রম্পেটিং স্টান্টবাজ লাউডমাউথ বলে মনে করতেন।

সমালোচনা সত্বেও আপনার লেখার মূল বিষয়বস্তু কিন্তু আমার ভালো লেগেছে। তাই আপনার মতই মূল ইস্যু ছেড়ে সাইড ইস্যুতে কথা বলবো না - বলবো না করেও কিছু অব্জার্ভেশন বলেই ফেললাম। আশা করি কিছু মনে করবেন না। এগুলি সাইড-ইস্যুই।

****************************************

হরি ত্রিপুরা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনার চিন্তা উদ্রেককারী মন্তব্যের জন্যে ৷ নাহ আমি কিছু মনে করিনি বরং খুশিই হয়েছি আপনার মন্তব্যে আমার চিন্তাভাবনাকে আরো কিছু খোলসা করতে পেরেছি এজন্য ৷
১ নাম্বার পয়েন্ট: মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহ শালায় বইটি নিয়ে ৷ হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি সাইটটি দুর্লভ বইপত্রে সাজানো এবং অনেক সমৃদ্ধ ৷ আপনি উদাহরন হিসেবে যে বইপত্রের নাম উল্লেখ করেছেন সবগুলো নয় তবে কয়েকটি আমি পড়েছি আগেই ৷ আমি 'বেশ প্যারানয়েড' এই মন্তব্যে বিপক্ষে আমি অবশ্য প্রতিবাদ করবোনা ৷ তবে আমি যা একটু ঐ সাইট ঘেঁটেছি - মনে হয়েছে ওটাও একঘরানার সংগ্রহশালা ৷ আমার ভুলও হতে পারে ৷ উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, এখানে বিএনপি জামাতের আমলে সংখ্যালঘুসহ মুক্তিযোদ্ধার পক্ষাবলাম্বনকারী, আওয়ামীলীগ নেতাকর্মিদের অর্থাৎ ঐ আমলের সরকারের নির্যাতনের এবং মুক্তিযুদ্ধের বা পাকিস্তানের সময়ের উপর বেশ বেশ রিপোর্ট বই পত্র আছে কিন্তু আওয়ামী আমলের সংখ্যালঘু নির্যাতনের উপর রিপোর্ট বই পত্রআমার জানা মতে তেমন কিছুই নাই ৷ ব্র্যাকের একজন গবেষকের মতে,(প্রথম আলোতে প্রকাশিত বেশ কয়েক বছর আগের সাক্ষাৎকার) আওয়ামী আমলেই সংখ্যালঘুরা জায়গাজমি থেকে বেশি হারায় এবং এটার সাথে আওয়ামী লোকজন জড়িত ‍। নির্যাতন বা অন্যান্য মানবাধিকার ইস্যুগুলোও আমার মনে হয় বিএনপি-জামাত থেকে খুব কম না । তাই এই উদাহরনে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তাহলো শুধু মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেকার বা পরবর্তীকালে ইতিহাস বা এ সংশ্লিষ্ট কোন লেখা হলেই হবে না ৷ ঔ সাইটের বই সংগ্রহকারী লোকজন মুক্তিযুদ্ধ, তার পূর্বেকার বা পরবর্তী কালের ইতিহাসকে কিভাবে কিভাবে দেখে, তুলে ধরতে চায়- তার সাথে মিল থাকতে হবে , না থাকলে স্থান পাবেনা ৷ না হলে পাকিস্তান, বিএনপি বা জামাতের লোকজনদের লেখাও সেখানে স্থান পেতো (আমি এখানে বলছি না তাদের ইতিহাসের বয়ান ঠিক বা বেঠিক, একটি নিদিষ্ট বিষয়ের উপর নানান ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছি, তাদের বই রাখার জন্যও বলছি না ৷ 'একঘরানার' অর্থও খারাপ অর্থে এখানে মিন করছিনা, শুধু যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি একেকটা এই ধরনের সংগ্রহশালা বা এমনকি ব্লগসাইটও কি ধরনের রাজনৈতিক চেতনা বা আদর্শ , আগ্রহ, সদস্যদের রুচি ইত্যাদির উপর গড়ে উঠে ৷) ৷ তাহলে আপনি যে আমাকে যে 'সিলেক্টিভ ব্লাইন্ডনেস'এর কথা বলছেন তার পরিস্কার উদাহরন এখানে দেখতে পাবেন । আর এই দৃষ্টিকোন থেকে হুমায়ন আজাদের বইটির প্রসঙ্গ আমি তুলেছি ৷ হিল ট্র্যাক নিয়ে কিন্তু দেশি বিদেশী অনেক গবেষকের লেখা আছে এবং রেরার ও মূল্যবানও ৷ আমার আশা, হয়তো ভবিষ্যতে সেগুলো স্থান পাবে ৷
2 নাম্বার পয়েন্ট, আপনি অবগত আছেন কিনা জানিনা ৷ বৎসর খানেক আগের থেকে বাংলাদেশ সরকারের একটা সার্কুলারই জারি করা আছে যেখানে বিদেশিদের হিল ট্র্যাকসের কোন পাহাড়ির সাথে কথা বলতে হলে সরকারের অনমতি নেওয়ার কথা ৷ কেউ যদি বিনা অনুমতিতে বেড়াতে যায়, কথা বলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার এবং সরকারের ঐ সার্কুলারের বরখেলাপ ৷ অামার হাতে সরকারের ঐ সার্কুলারটা নেই তবে নিচের লিঙ্কটাতে এই বিষয়ে কিছু আইডিয়া পাবেন ৷
http://www.survivalinternational.org/news/10677
3 নাম্বার পয়েন্ট নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নাই ৷
আবারো ধন্যবাদ আপনাকে ৷

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাংলাদেশর প্রায় সকল বাঙ্গালীর মত আমিও পাহাড়িদের সমস্যার প্রকৃত বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারি না, এবং যখনই এ বিষয়ে নতুন একটি লেখা পড়ি, তখনই বিষয়টি আমার কাছে আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। আপনার এই লেখাটি পড়েও একই ভাবে পাহাড়ি সমস্যার দুর্বোধ্যতায় নতুন করে আক্রান্ত হলাম। আপনি যদিও এ লেখায় মূল ফোকাস করেছেন প্রথিতযশা লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি বইকে, তথাপি আমার মনে হয়েছে তার বাইরেও আপনি আরও বহু কিছু বলতে চেয়েছেন। প্রথমেই বলে নিই, আলোচ্য বইটি আমি পড়েছি কিন্তু বলা চলে বেশ হতাশই হয়েছি, কারন আমার মনে হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার প্রকৃত চিত্র এতে ফুটে তো ওঠেই নি, তা ছাড়া বইটিও তেমন মানসম্পন্ন বলে মনে হয় নি। কিন্ত আপনি এই বইটি থেকে যে সকল পয়েন্ট এবং উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন, সেগুলোই বরং ভাবনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বলে মনে হচ্ছে।

যেমন- পাহাড়িদের যে উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করার প্রচলন কিংবা চেষ্টা আছে, তাতে আপনার বিশেষ আপত্তি আছে মনে হয়েছে। তার পরিবর্তে কি অভিধায় তাঁদের ভূষিত করা যায় কিংবা করা উচিৎ, সে সম্পর্কে কিছু বলেন নি। কি সেটা? জাতি? নাকি আদিবাসী? যদি আদিবাসী হয়, তাহলে সেই আদিবাসীর ধরনটা কি ভারতীয় ধরনের, নাকি আইএলও ধরনের?
শান্তিচুক্তি বিষয়ে আপনার অবস্থানটা ঠিক পরিস্কার বুঝতে পারি নি। আপনি কি শান্তিচুক্তিটির বিরোধী? যদি বিরোধী হন, তাহলে ঠিক কি কারনে? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য- এই চুক্তিনামার প্রথমেই বলা হয়েছে " উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষন এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন"। অতঃপর ঐ অঞ্চলের মানুষকে বুঝাতে বারংবার উপজাতি কিংবা অ-উপজাতি টার্ম দুটি ব্যবহার করা হয়েছে।

আপনার পুরো লেখা জুড়ে বাঙ্গালী জাতির প্রতিই এক ধরনের বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছে। আমার মনে হয় এই ধরনের আরোপিত বিরূপতা সমস্যাটির কোনই সমাধান বয়ে আনবে না, বরং সমাধানের পথকে আরও কঠিন করে তুলবে। দেখুন জনাব হরিপুর্ন ত্রিপুরা, ভারত বিভাগের সময় পাহাড়িদের একাংশ যেমনটা চেয়েছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামটা ভারতের অংশে পড়লে ব্যাপারটা একরকম হত। কিন্তু এটা যখন বাংলদেশের অংশে পড়েছে, তখন এ দেশের মূল জনগোষ্ঠীকে আস্থায় না নিয়ে সত্যিকারের অর্থে বড় কোন অর্জন কি আদৌ সম্ভব হবে? মূল ইস্যু ছেড়ে সাইড ইস্যুতে ঢুকে পড়লাম কি? ক্ষমা করবেন, তবে আপনার মূল ইস্যু আসলে কোনটা, সে নিয়ে খানিকটা দ্বিধায় আছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বুঝা সহজ না দুর্বোধ্য সে আলোচনায় আমি আপনার সাথে দ্বিমত করতে পারবোনা ৷ কারন আমাদের একেক জনের অভিজ্ঞতা, জানার পরিধি, আগ্রহ ইত্যাকার বিষয় আলাদা ৷ একজনের জন্যে যেটা রকেট সাইন্স আরেক জনের জন্য সেটি হয়তো সহজ ৷
আপনার কখনো সরাসরি প্রশ্ন, কখনো মন্তব্য পড়ে আমি মোটামুটি যেভাবে আমার আলোচনা বা উক্তর সাজিয়েছি তা নিন্মরূপ :
প্রথমত; আমি হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের লেখার উপর ভিত্তি করে - তার এই লেখার পিছনের ইতিহাস, এটার সাথে জড়িত তার ব্যক্তিগত- সামাজিক-রাজনৈতিক মনোভঙ্গি , এবং এটার সাথে কোন ধরনের রাজনৈতিক উদেশ্য জড়িত কিনা তা দেখাতে চেষ্টা করছি একাডেমিক একটা তত্ত্বের মধ্যে ফেলে ৷ সবশেষে এই ধরনের লেখাকে কোন জ্ঞান কাঠামোর মধ্যে ফেলা যায়- তা বলার চেষ্টা করেছি ৷ এটা হচ্ছে মোটামুটি মূল বিষয় ৷ আমি দুঃখিত যে, আপনি বুঝতে পারেন নাই ৷

দ্বিতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের কি হিসেবে পরিচিত হতে চায়, হওয়া উচিত এবং কিভাবে সেখানকার সমস্যা সমাধান হতে পারে আনিসুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চেয়েছি হুমায়ুন আজাদের চিন্তার বিপরীতে ৷ একটা জনগোষ্ঠী অবমাননাকর শব্দে পরিচিত করানো, এবং খারাপ বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ স্কুলের টেক্স বই বিভিন্ন জায়গায় এখনো চলমান- সে জায়গায় প্রসঙ্গ 'ভারত না ILO' টাইপের অধিকারের আলোচনা বড্ড বেমানান হয়ে যায় ৷

তৃতীয়ত, চুক্তি নিয়ে আমার অবস্থান জানতে চাওয়া একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ৷ মাফ করবেন ভুল হয়ে থাকলে ৷ তবু কিছু বলি যেহেতু বিষয়টি ওঠে অাসছে - আপনি নিশ্চয় জানেন চুক্তির বয়স প্রায় দুই দশক ৷ যারা চুক্তির পরে জন্মগ্রহন করেছেন তাদের অনেকে এখন সাবালক ৷ অনেকে বোধহয় বাচ্চা কাচ্চার মা বাবাও ৷ কিন্তু চুক্তি সে নাবালকই রয়ে গেছে অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ন কোন ইস্যু বাস্তবায়ন হয়নি ৷ এ অবস্থায় বিগত দুদশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের একক পরিস্থিতি বলুক, পাহাড়ি ও সরকার-বাঙ্গালীদের সম্পর্ক বলুক দিন দিন ঘোলাটে বা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ৷ এই অবস্থায় আপনি যদি পাহাড়ীদের ওখান বাঙ্গালিদের বা সরকারকে আস্থায় নিতে বলেন তাহলে কি পরিহাসের মতো শুনাচ্ছে না? চলমান আগ্রাসন বজায় রেখে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আস্থায় নেওয়ার অাহ্বান জানানোর মতো ৷ তবে তার মানে এটার মানে একেবারে ধরে নেওয়া ঠিক হবেনা যে - টোটালী পাহাড়িরা , বাঙ্গালিরা দেওয়াল তুলে সেখানে চলছে ৷ এই সমস্যার মধ্যেও বন্ধুত্ব হচ্ছে, বন্ধুত্ব বজায় রাখে, কলিগরা একসাথে কাজ করছে ৷ সমস্যাতো প্রধান কারন পাহাড়ীত্ব বা বাঙ্গালিত্বের কারনে নয় ৷ সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালনায় অাছে কিভাবে যুগ যুগ ধরে এই জাতিগত লাইনের মধ্যে রাজনীতি বা তাদের পলিসির মাধ্যমের সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে যাচ্ছে ৷ সুতরাং আপনার যদি এমন ধারনা হয় আমি বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জাতিগতভাবে বাঙ্গালী বিদ্বেষী সেটাই মনে বড় ধরনের অন্যায় ৷
আমার লেখায় 'বাঙ্গালি বিরূপতার' যে অভিযোগ সে জন্য সেটা আমি সর্বাংশে প্রত্যাখান করি অাপনার প্রতিশ্রদ্ধা রেখেই ৷ হয়তো কোন বিষয়ে আপনার মনোভঙ্গি-বিশ্বাস এমন ধারনার জন্ম দিয়েছে ৷ আমি আমার লেখায় যেটা দেখাতে চেয়েছি তা হলো, কিভাবে উপনিবেশিক কায়দায় শাসন শোষনের জন্য, তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একদল ক্ষমতাশালী আরেকদল ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠির উপর খারাপ সমস্ত ধরনের বৈশিষ্ট্যনমূহ আরোপ করে, কুজ্ঞান, কুতথ্য, কুযুক্তির পাহাড় গড়ে তোলে ৷ হুমায়ুন আজাদ যেমনটি করেছেন ৷ কিন্তু তিনি একা নন৷ উপন্যাস থেকে গবেষনা নামে বিভিন্ন শ্রেনি মানুষের অসংখ্য বই আপনি হিল বিষয়ে খোজলে ঢাকায় পাবেন ৷ আমিও এটাও মনে করি, আজকে বাঙ্গালিরা যদি পাহাড়িদের জায়গায় হতো, পাহাড়িরা যদি একই রকম উগ্র জাতীয়তাকাদের চর্চা তারা করতো - তাহলে বাঙ্গালিরা একই পরিনতি বরন করতো ৷ মিয়ানমারে যেমন হয় ৷ সুতরাং সমস্যা রাজনীতি, সিস্টেমের ৷ তবে আমার অবস্থান যদি বলতে হয় - আমি বলবো আমি উগ্র জাতীয়তাবাদ-সাম্প্রদায়িকতার , উপনৈবেশিক ধরনের শাসন শোষনের বিদ্বেষী একজন লোক ৷ এটাই একজন মানুষ হিসেবে আমার সর্বপ্রধান পরিচয় ৷ অনেক কিছু লিখলাম আপনার প্রশ্ন ও মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ৷ কোথায়ও ভুল থাকলে মার্জনা আশা করছি ৷

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

১-

আমি দুঃখিত যে, আপনি বুঝতে পারেন নাই৷

বাঙ্গালীদের মধ্যে এটা এভাবে বলা শোভনীয় নয়, বলা যেতে পারতো- "আমি দুঃখিত যে, ঠিকমত বুঝাতে পারি নাই"৷ যাই হোক, বিষয়টা ছকে বাঁধা কোন জ্ঞান কাঠামোতে আবদ্ধ করে ফেলায় আমার তেমন আস্থা নেই, সে কারনেই সে দিকটা আমি এড়িয়ে গিয়েছি।

২- পাহাড়ের সমস্যা কেন আমরা পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি না, আপনার দ্বিতীয় উত্তরটি পড়লেই তা মোটামুটি বোঝা যায়। আমি আপনার কাছে সুনিদ্রিস্ট ভাবে জানতে চাইলাম পাহাড়িদের জাতিগত পরিচয় কি হওয়া উচিৎ, আপনি উত্তরটা দিলেন অপরিষ্কার ভাববাচ্যে। আপনি যদি আনিসুজ্জামানের অভিমতটাকেই আপনার মতামত বলে বুঝিয়ে থাকেন, তা হলে বিনয়ের সাথে বলতে চাচ্ছি তাঁর অভিমতটি সুচিন্তিত নয়, সেটার অন্তরালে নানা অসঙ্গতি রয়ে গেছে।

৩- চুক্তির বিষয়ে আপনার অবস্থান জানতে চাওয়া কোনই অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার নয়। চুক্তিটি যদি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে সে চুক্তিটির শুরুতেই যে কথাটি বলা হয়েছে, অর্থাৎ- " উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষন এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন" সেটা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই ধরে নেয়া যায়। আর যদি চুক্তিটি গ্রহণযোগ্য না হয়ে থাকে, তাহলে ঠিক কি কারনে তা গ্রহণযোগ্য নয়, সেটি উল্লেখ প্রয়োজন।
আর একটি বিষয়, চুক্তি সম্পাদন এক জিনিস, আর সেটির সকল ধারা সময়মত বাস্তবায়ন করতে পারা ভিন্ন জিনিস। সেক্ষেত্রে যেটা হওয়া উচিৎ, তা হল চুক্তির সকল ধারা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করা।

আপনি একটি কথা বারবার বলেছেন- উপনিবেশিক কায়দায় শাসন শোষনের জন্য ................। এ দিয়ে কি আপনি এই বুঝাতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে শোষণ কায়েম করেছে? কিভাবে? একটু ব্যাখ্যা করবেন?

অতিথি লেখক এর ছবি

১ নম্বর পয়েন্ট, অামার বাক্য চয়নের সমস্যাগত কারনের জন্য অাপনি যে আঘাত পেয়েছেন সেজন্য আমি সত্যিই দুঃখিত ৷

২ নাম্বার পয়েন্ট ;
"

পাহাড়ের সমস্যা কেন আমরা পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি না, আপনার দ্বিতীয় উত্তরটি পড়লেই তা মোটামুটি বোঝা যায়।

"

এখানে 'আমরা' শব্দ ব্যবহার করে আপনি এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছেন আমাকে ৷ এই 'আমরা' কি পুরো বাঙ্গালি সম্প্রদায় ? নাকি আপনি একাই ? না আপনিসহ আপনার বন্ধুমহল ? পুরো বাঙ্গালি যদি বলেন তাহলে বিনয়ের সাথে আমি দ্বিমত পোষন করবো ৷ উপরে যাঁরা আমার লেখাটি পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন তাঁরাও সবাই বাঙ্গালি ৷ যেহেতু কেউ যতই পড়ি ততই দুর্বোধ্য লাগে - এই ধরনের অভিযোগ বা মন্তব্য করেন নাই, সেহেতু আমি ধরেই নিতে পারি তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আগে পড়ুক না পড়ুক, আমার লেখা পড়ে কিছুটা হলেও আমি হুমায়ুন আজাদকে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছি তা নিজেদের মতো করে তাঁরা বুঝে নিয়েছেন ৷

কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি একটু অশ্চর্যজনক মনে হয়েছে- আপনি ঠিকই আনিসুজ্জামান ধরনের আদিবাসী বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিস্কার ধারনা রাখেন, নানান অসঙ্গতি বের করেন এবং বিষয়টি প্রত্যাখান করেন ৷ তাছাড়া আপনি ব্রিটিশ আমলের পরবর্তী দেশভাগের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস যা একটু উল্লেখ করলেন তাতেই বুঝা যায়- পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে আপনার পড়া কম না ৷ সুতরাং আনিসুজ্জামানের আদিবাসী ধারনায় আপনি একেবারেই পরিস্কার বুঝেন, দ্বিমত পোষন করেন কিন্তু CHT এর প্রসঙ্গ আসলে আবার ঘুলিয়ে যান, বার বার চুক্তিতে উল্লেখিত 'উপজাতি' শব্দকে আঁকড়ে ধরে আছেন- এই কন্ট্রাডিকটরি মন্তব্য থেকে আমি কি বুঝে নিতে পারি যে- আপনি CHT সমস্যার ব্যাপারে খুবই ভালো ধারনা রাখেন কিন্তু আপনি মানতে চান না ৷ এটা কি পরিস্কার দেখিয়ে দিচ্ছেনা যে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার 'দুর্বোধ্যতার' লক্ষন দেখা দিচ্ছে ? আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি উপরের যুক্তির জন্য ৷ কিন্তু এগুলো আলোচনা না করলে আমার মনে হয় বিষয়গুলো পরিস্কার হচ্ছে না ৷

দ্বিতীয়ত, আপনার জানা আছে কিনা জানিনা, উপজাতি ও আদিবাসী শব্দ প্রায় সমার্থকই ৷ তেমনি এবরিজিনাল, রেড ইন্ডিয়ান, জনজাতি বা এধরনের আরো শব্দ ৷ বাংলায় উপজাতি আর আদিবাসী শব্দের পার্থক্য হচ্ছে উপজাতি হচ্ছে একধরনের অবমাননাকর, উপনিবেশ আমলের গন্ধযুক্ত শব্দ হিসেবে বুঝায় ৷ তাই আধুনিক নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞানে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে এটা পরিহারযোগ্য শব্দ হয়ে ওঠেছে ৷ আপনি এই বিষয়ে এই লিঙ্কয়ে (https://www.youtube.com/watch?v=u9KgAXnn5-s) সামান্য ধারনা পাবেন CHT প্রেক্ষিতে ধরলে ৷

৩ নম্বর পয়েন্ট ; আপনি লিখেছেন যে,

"চুক্তির বিষয়ে আপনার অবস্থান জানতে চাওয়া কোনই অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার নয়।

"
আমার মূল লেখাটি আবার পড়লাম, আপনার মন্তব্যটি পড়ে কনফিউজড হয়ে ৷ আসলেই আমি চুক্তি সম্পর্কিত এবং চুক্তি নিয়ে আমার কোন অবস্থান সেখানে উল্লেখ করেছি কিনা জানতে ৷ একমাত্র হুমায়ুন আজাদের চুক্তির কয়েকমাস আগে ভ্রমনের ইতিহাস উল্লেখ করা ছাড়া কোথাও চুক্তি নিয়ে কিছু লিখেছি দেখলাম না ৷ চুক্তির প্রসঙ্গতো আপনার মন্তব্যে আসলো ৷ এবং এর প্রেক্ষিতে আমি কিছু বললাম, অপ্রাসঙ্গিক হলেও ৷ সুতরাং এই প্রসঙ্গে আমার অবস্থান জানতে চাওয়া প্রাসঙ্গিক - এটা কিভাবে এতো দৃঢ়তার সাথে বলেন ?

আর আপনি বলছেন, "

চুক্তি সম্পাদন এক জিনিস, আর সেটির সকল ধারা সময়মত বাস্তবায়ন করতে পারা ভিন্ন জিনিস।সেক্ষেত্রে যেটা হওয়া উচিৎ, তা হল চুক্তির সকল ধারা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করা।

"

তাহলে কি আমরা ধরে নেবো চুক্তি করা হয় বাস্তবায়ন না করার জন্য ? আর আমার জানা মতে যারা চু্ক্তি করেছে, পাহাড়ি-বাঙ্গালি যারা চুক্তির সাপোর্টার- কত আন্দোলন করেই যাচ্ছে সে প্রথম থেকে ৷ বিদেশী দেশ, জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরাম সহ আন্তর্জাতিক কতো সংগঠন চুক্তির বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে কতোবার কথা তুলেছে- - কিন্তু সরকারেরতো একই রোগ ৷ তারা চুক্তি সম্পাদন করছে কিন্তু দিন যতই যায় ততই দুর্বোধ্য ঠেকতেছে তাদের কাছে ৷

শেষান্তে কলোনাইজেশনের বিষয়টা বলছি ৷ আমি সংজ্ঞা দিচ্ছিনা, ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই অনেক পাবেন এবং তার অনেক বৈশিষ্ট্য পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে মেলাতে পারবেন ৷ এবং আপনিও উদাহরনই চেয়েছেন- কেন আমি CHT ইস্যুতে কলোনাইজেশনের বিষয় নিয়ে আসি ৷ তাই উদাহরনে বলছি ৷ আপনিতো জানবেন ব্রিটিশ পিরিয়ডের শেষান্তে সেখানে বাঙ্গালি (হিন্দু-মুসলিম- বড়ুয়া) ছিলো তিন শতাংশের নীচে আর আজকে বিপরীত ট্রেন্ডে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ৷ অতীতে বিভিন্ন্ যুক্তি কুযুক্তি দিয়ে এই জনসংখ্যাগত বিষয়টিকে পরিবর্তন করা হয়েছিলো ৷ এখনো হচ্ছে অথচ এখন পাহাড়িরা সংখ্যালঘু ৷ বিশেষ করে আশির দশকে প্রায় পাঁচ লক্ষ গরীব বাঙ্গালিদের স্বপ্ন দেখিয়ে সেখানে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো- বিদ্রোহ দমনের নামে শান্তিবাহিনীর বিরূদ্ধে ৷ শুধু এখানে নয়, তাদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো আরেকদল গরীব পাহাড়িদের বিরূদ্ধে ৷ যার পরিনাম- পাহাড়িদের উপর নির্বিচারে আক্রমন, একডজনের বেশি গনহত্যা, তাদের জায়গাজমি দখল, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের গনধর্ষণ ইত্যাকার ন্যাকারজনক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাসমূহ ৷ এখনো পাহাড়িরা তাদের জমি ফেরত পাইনি বরং দখল - উচ্ছেদ হচ্ছে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নামে ( যেমন পর্যটন করা, সেনা ক্যাম্প, তাদের ট্রেনিং এর জায়গা ) ৷ এখনো পাহাড়ি মেয়েরা ধর্ষিতা হয় কিন্তু বিচার পাওয়া যায় না, এখনো বাঙ্গালি পূর্নবাসন চলে নিরবে নিভৃতে ৷ তাদের রক্ষার নামে, সন্ত্রাস দমনের নামে, সীমান্ত রক্ষার নামে এখনো কিছুদূর পরপর সেনাক্যাম্প, চেকপোষ্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বলা হয় বিশ্বের সবচে মিলিটারাইজড জোন ৷ একটা রাষ্ট্রের তার অধীন একটা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর প্রতি এই রকমের আচরনকে তাহলে বলুন আমি কোন শব্দে বিশেষিত করবো ?

আপনার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আবারো অনেক কিছু লিখতে হলো ৷ জানিনা খোলসা করতে পেরেছি কিনা ৷ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ৷
হরি ত্রিপুরা

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ভাই হরি ত্রিপুরা,

ভুল বুঝবেন না, আমি কোন ধারনা আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছি না। চুক্তিপত্রের "উপজাতি" শব্দটির উপর জোড় দিয়ে আমি এই বিষয়টাই বুঝাতে চেয়েছি যে, এখন যেমন অনেকের কাছে উপজাতি শব্দটি একটা হীন অবজ্ঞাসুচক ধারনার সৃষ্টি করছে, মাত্র উনিশ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তখন এই চুক্তিনামার একজন প্রধান স্বাক্ষরকারী ছিলেন সন্তু লারমা, ব্যাপারটা যদি অবমাননাকরই হত, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই চুক্তিনামায় "উপজাতি" শব্দটি মেনে নিতেন না।

এবার উপজাতি এবং আদিবাসী শব্দদ্বয়ের প্রচলন ও ব্যবহারগত দিকটি একটু খতিয়ে দেখা যাক। ইংরেজরা ভারতে আসার আগে এই দেশের মানুষ অসংখ্য জাতি উপজাতিতে বিভক্ত ছিল। তবে লক্ষণীয় বিষয় হল তখন উপজাতীয় পরিচয়টাই ছিল মুখ্য। যেমন মুন্ডারী ভাষাভাষী সবাই হল খেরওয়ার জাতি, কিন্তু তাঁরা পরিচিত ছিল তাঁদের উপজাতীয় পরিচয়ে, যেমন মুন্ডা, সাঁওতাল, হো, খাড়িয়া ইদ্যাদি নামে। বাঙ্গালীদের মধ্যেও ছিল বহুসংখ্যক উপজাতি, যেমন- মালো, মালিয়া, ভূঁইয়া, চণ্ডাল, কৈবর্ত, পোদ, কলু, শীল, ইত্যাদি। ব্যবহারিক পর্যায়ে তাঁদেরও উপজাতীয় পরিচয়টাই ছিল মুখ্য। ইংরেজরা যখন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি বিস্তারিত বিভাগ করলো, তখন একদল মানুষকে তারা ট্রাইব হিসেবে চিহ্নিত করলো। তাঁদের হিসাবে সেটা খুব একটা অসংগত ছিল না, কারন যে সমস্ত বৈশিষ্টের কারনে কোন জনগোষ্ঠীকে নেশন বলা যায়, তারা সেরকম বৈশিষ্ট ধারন করছিল না। এই ট্রাইবেরই বাংলা অর্থ করা হয়েছিল উপজাতি। এই তথাকথিত ট্রাইবদের তখন এমন অবস্থান ছিল না যে তাঁরা এ বিষয়ে কোন মতামত প্রদান করবে। অনেক দিন ধরে বই পুস্তক এবং কথ্য ভাষায় তাই সামগ্রিক অর্থে "উপজাতি" টার্মটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।

অনেক পরে ভারতের কম্যুনিস্টরা বলতে শুরু করে তাঁরা জাতি নাকি উপজাতি, তার চেয়েও বড় কথা- তাঁরা হল এদেশের আদি বাসিন্দা, সুতরাং তাঁরা হল এ দেশের আদিবাসী। এর পরে পশ্চিম বাংলা এবং উত্তর ভারতের অনেক অংশেই ধীরে ধীরে আদিবাসী টার্মটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যদিও পরবর্তীতে সরকারিভাবে আদিবাসীর পরিবর্তে "জনজাতি" টার্মটি গ্রহন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও ভারতের অনুকরণে "আদিবাসী" শব্দটির প্রথম প্রচলন শুরু করে দৈনিক জনকণ্ঠ। দেশের প্রগতিমনস্ক শিক্ষিতজনের কাছে আদিবাসী টার্মটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে, যদিও ভারতে যে কারনে আদিবাসী টার্মটি প্রযোজ্য, বাংলাদেশে সে কারন বিদ্যমান ছিল না। মজার ব্যাপার হল- আওয়ামী লীগেরও নেতৃস্থানীয় অনেকেই আদিবাসী শব্দটিই ব্যবহার করতে থাকেন। কিন্তু যখন আইএলও'র "ইন্ডিজেনাস পিপল" এর সংজ্ঞা তাঁদের নজরে আসে এবং পাহাড়ি নেতাদের কেউ কেউ "ইন্ডিজেনাস পিপল" ও "আদিবাসী" সমার্থক বলে মত প্রকাশ করতে থাকেন, এবং কতিপয় এনজিও ও বিদেশী সংস্থা তাতে তাল জোগাতে থাকে, সেই সাথে বিএনপি যখন পার্বত্য চুক্তির ব্যাপারে নানা অলীক কথাবার্তা বলতে থাকে,তখন আওয়ামী সরকার আদিবাসী অভিধাটি পরিত্যাগ করে।

এখন আপনার কাছেই নিবেদন, একটা সুষ্ঠু বিধান প্রদান করুন।

বাকি প্রসঙ্গে পরে বলি।

অতিথি লেখক এর ছবি

আবার সেই একই মূল লেখায় বিষয়ের আলোচনার বাইরে আলোচনা চালিয়ে যেতেই হচ্ছে ৷ ধন্যবাদ আপনাকে আবার ৷

আপনি বলছেন যে

"এখন যেমন অনেকের কাছে উপজাতি শব্দটি একটা হীন অবজ্ঞাসুচক ধারনার সৃষ্টি করছে, মাত্র উনিশ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে ব্যাপারটা তেমন ছিল না।

"
আমার মতে, আপনার অবজারবেশনটি পুরোপুরি সঠিক নয় ৷ তার কারন, ইতিহাস যদি ঘাঁটেন অাপনি দেখবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম গঠিত রাজনৈতিক দলের নাম ছিলে, জনসমিতি ৷ ১৯২০ সালে গঠিত হয়েছিলো ৷ এরপরে পাকিস্থান/বাংলাদেশ আমলে যেটি হয় তার নাম জনসংহতি সমিতি ৷ পাকিস্থান আমলের প্রথম দিককার হতে বাংলাদেশ আমলের ১৯৭৫ পরবর্তী সশস্র বিদ্রোহ পর্যন্ত (এটি পরে আর CHT তখনকার বাস্তবতায় আর কন্টিনিউ হতে পারেনি) যে পাহাড়িদের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন ছিলো তার নাম - পাহাড়ি ছাত্র সমিতি ৷ আশির দশকের শেষার্ধে জন্ম হওয়া পাহাড়ি ছাত্রদের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ৷ সুবীর ভৌমিকের Insurgent Crossfire, প্রদীপ্ত খীসার (১৯৯৬) পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা - বইগুলোতে এই ব্যাপারে কিছু পাবেন ৷ তাহলে দেখুন, রাজনৈতিক সচেতন অধিকাংশ পাহাড়ি মানুষ বরাবরই উপজাতি শব্দটি এড়িয়ে চলেছে সে ব্রিটিশ আমল থেকেই ৷ নাহলেতো উপজাতি শব্দ তাদের সংগঠনের নামের সাথে লাগাতো ৷ আর বিশ্বব্যাপি অাদিবাসী বা ইন্ডিজিনাস গোষ্ঠীদের আন্দোলনও পুরাতন ৷ যার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে জাতিসংঘের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে আদিবাসী দশক ঘোষনা করাতে তারা সক্ষম হয় ৷ উদেশ্য আদিবাসী বিষয়ে আদিবাসী, সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ও সরকারের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা ৷ যার ফলে আদিবাসীরা তাদের অধিকার পেতে পারে ৷ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে ধরলে, পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা কিছু আন্দোলন এবং বাংলাদেশের আমলের সশস্র আন্দোলন- এগুলোওতো আদিবাসী আন্দোলন ৷ প্রধান দাবি-দাওয়াতো নতুন কিছু না ৷ সেই বাংলাদেশের, পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন হতে শুরু হওয়া দাবিসমূহ ৷ সুতরাং বাংলাদেশেও আদিবাসী আন্দোলন নতুন কিছু নয় ৷ শুধু আদিবাসী নামটি আগের চেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে এটাই পার্থক্য ৷
আর ইংরেজি ইন্ডিজিনাস পিপলের যে ক্রাইটেরিয়া তা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি লোকজনের সাথেই মিলে যায় ৷ আপনি যদি যদি ত্রিপুরাদের রাজমালা সমূহ পড়েন (বাংলাভাষার অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ), পাহাড়ি চট্টগ্রামের ব্রিটিশ পূর্ব ও পরের লেখাগুলো পড়েন তাহলে কোন কোন ক্রাইটেরিয়াগুলো মিলে যায় ধরতে পারবেন ৷ United Nations যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর যে নিদিষ্ট জনগোষ্ঠিকে একটি কমন টার্মের মধ্যে Indigenous হিসেবে আখ্যায়িত কের তা নিন্মরূপঃ

"of those who inhabited a country or a geographical region at the time when people of different cultures or ethnic origins arrived. The new arrivals later became dominant through conquest, occupation, settlement or other means".

"Understanding the term “indigenous”

Considering the diversity of indigenous peoples, an official definition of “indigenous” has not been adopted by any UN-system body. Instead the system has developed a modern understanding of this term based on the following:
• Self- identification as indigenous peoples at the individual level and accepted by the community as their member.
• Historical continuity with pre-colonial and/or pre-settler societies
• Strong link to territories and surrounding natural resources
• Distinct social, economic or political systems
• Distinct language, culture and beliefs
• Form non-dominant groups of society
• Resolve to maintain and reproduce their ancestral environments and systems as distinctive peoples and communities. (United Nations 2009)

তাছাড়া বাংলায় পাহাড়িদের পরিচয় কি শুধুই পাহাড়ি হবে, না অাদিবাসী, না ইংরেজির ইন্ডিজিসাস হবে সেটা বিতর্কের বিষয় হলেও সবচে বড় কথাতো,- আমি যে বললাম উপনৈবেশিক ধরনের শোষন নির্যাতন বন্ধ করা এবং মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা ৷ যে পাহাড়িদের জায়গাজমি দখলে নিয়েছে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা, যে সমস্থ লোক বা শ্রেণি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে তার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় নিয়ে আসা- যা এ ধরনের ঘটনাকে ভবিষ্যতে রোধ করবে- এই ধরনের বিষয়গুলোতো দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সংবিধানে কথিত 'সকলের সমান অধিকার' হিসেবে পাহাড়িরাও ন্যায্যতা পাওয়ার অধিকার রাখে ৷

এবার, উপজাতি এবং জাতি গঠনের ইতিহাস বিষয়ে আপনি যে চমৎকার আলোকপাত করেছেন এ বিষয়ে কিছু বলা যাক ৷ আপনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, "

ইংরেজরা যখন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি বিস্তারিত বিভাগ করলো, তখন একদল মানুষকে তারা ট্রাইব হিসেবে চিহ্নিত করলো। তাঁদের হিসাবে সেটা খুব একটা অসংগত ছিল না, কারন যে সমস্ত বৈশিষ্টের কারনে কোন জনগোষ্ঠীকে নেশন বলা যায়, তারা সেরকম বৈশিষ্ট ধারন করছিল না। এই ট্রাইবেরই বাংলা অর্থ করা হয়েছিল উপজাতি।"

সেখানে কিন্তু আপনি জাতিগত পরিচয় দানের রাজনীতি পাবেন ৷ কোন মাপকাঠিতে একদল নিলো জাতির পরিচয়, আরেকদলকে অভিহিত করলো উপজাতি হিসেবে ? চিহ্নিত করলো নিম্নশ্রেনীর হিসেবে ?

আপনি বলছেন যে, ভারতে কম্যুনিষ্টদের 'তথাকথিত উপজাতিদের' পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী নামে অভিহত করানো , যা পরবর্তীতে ভারতে ছড়িয়ে পড়া এবং বাঙ্লাদেশেও জনকন্ঠের মাধ্যমে প্রগতিমনস্ক শিক্ষিত লোকদের কাছে তা ছড়িয়ে পড়ে যদিও যে অর্থে ভারতে জনজাতি বা আদিবাসী শব্দটি প্রযোজ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য না - এই যে যুক্তি বা তথ্যগুলো লিখছেন, মেহেরবানী করে কি তথ্যসুত্রগুলো উল্লেখ করতে পারবেন ? এটা কি হুমায়ুন আজাদ ধরনের কেউ লিখছে, না সত্যিকারের ঐ বিষয়ের উপর স্কলারের লেখা একটু দেখতাম ৷ তথ্যসুত্রটি পাওয়া ও পড়ার পড়ে আসলে ডিসাইড করা যাবে আলোচনা আগাবে না আগাবেনা ৷ খামোখা একটা লোক এই বিষয়ে অারব্য রজনী টাইপের কিছু লিখলো, আর আমরা সময়-এনার্জি নষ্ট করে এখানে আলোচনা করবো - তার কোন মানে আছে বলে মনে হচ্ছেনা ৷

তথ্যসুত্র:
United Nations 2009,Who are indigenous peoples?,
http://www.un.org/esa/socdev/unpfii/documents/5session_factsheet1.pdf

মন মাঝি এর ছবি

অর্থাৎ, একটা জিনিস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল - আপনি আসলে "চুক্তি" পুরোপুরি মানেন না - বরং এর মধ্য থেকে আপনার পছন্দ ও সুবিধামতো cherrypicking করতেই বেশি আগ্রহী। cherrypicking-এর মাধ্যমে আপনি দুই নৌকাতেই পা দিয়ে চলতে চান - একইসাথে চুক্তি এবং চুক্তিবিরোধীতা - দূটোরই সুবিধা নিতে চান। যদিও সেটা স্বীকার করতে বা অন্যকে বুঝতে দিতে চান না (এবং অন্যরাও যাতে একই সুবিধা দাবী না করে সে ব্যাপারেও সতর্ক)! মোদ্দা কথায়, বলতে না চাইলেও এদিক থেকে আপনি আসলে চুক্তিবিরোধীই। বোঝাই যাচ্ছে, এজন্যেই আব্দুল্লাহ ভাইয়ের অতি সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে কেন আপনার এত অনীহা! হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

জনাব মন মাঝি সাহেব, যেহেতু আপনার তরী জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম সাহেবের যুক্তির স্রোতের অনুকুলে চলে সেহেতু আপনার 'আব্দুল্লাহ এ.এম ভাই' আর আমার বিতর্ককে আপাতত ফলো করলেই হয়তো আপনি আপনার উত্তর এখন যদি নাও পেয়ে থাকেন ভবিষ্যতে পেয়েও যেতে পারেন কোন এক জায়গায় ৷ আপাতত তাই আপনাকে একটু সবুর করতে হবে ৷ সে জন্য আমি দুঃখিত ৷

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

১- ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলের প্রথম থেকে বেশ কিছুটা সময়কালে গঠিত পাহাড়ি সংগঠনগুলোর কোনটির নামের সাথেই যেহেতু "উপজাতি" শব্দটি নেই, সুতরাং ইহা প্রমানিত যে- পাহাড়ি জনগণ কখনো নিজেদের উপজাতি হিসেবে ভাবতো না। বেশ! বেশ!! কিন্ত মুশকিল হল- এই সব সংগঠনের নামের সঙ্গে আদিবাসী শব্দটিও নেই, যা থেকে ধরে নেয়া যায় পাহাড়ি জনগণ নিজেদের আদিবাসী হিসেবেও দেখতে পছন্দ করে না। আর কেন শান্তি চুক্তিতে "পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া" সেই উপজাতিদের পক্ষে সন্তু লারমা স্বাক্ষর করলেন, উপজাতির বদলে কেন তিনি আদিবাসী লিখতে বললেন না?

২- যদিও আইএলও এর ইন্ডিজেনাস পিপল সংক্রান্ত ঘোষণার পুরোটা না পড়লে বোঝা যাবে না কেন এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বরং হুমকিস্বরূপ, তবুও যতটুকু আপনি উল্লেখ করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতেই বলি-

"একটি দেশ কিংবা ভৌগলিক এলাকা, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি কিংবা এথনিক অরিজিনের জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে, সেখানে নতুন করে একদল মানুষ আক্রমনের মাধ্যমে বিজয় ও দখলের মাধ্যমে .........."

আমরা যতটুকু জানি- একটি দেশ, অর্থাৎ বাংলাদেশ এর চট্টগ্রাম নামক ভৌগলিক অঞ্চলে সহস্রাধিক বছর যাবত বাঙ্গালী জাতির বিভিন্ন গোত্রের মানুষ বসবাস করে আসছে। আবার এই চট্টগ্রামের বেশ কিছু অঞ্চল ছিল পর্বতময় এবং প্রায় জনবসতিহীন। পরে বিগত তিন চারশ বছরে বিভিন্ন জাতিগত সংঘাতের কারনে মিয়ানমার এবং বর্তমান ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহন করে এবং বসবাস করতে থাকে। এই সকল নৃ-গোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল পশ্চাৎপদ প্রকৃতির এবং মোগল আমল থেকে বিশেষ ব্যাবস্থাধীনে সেখানের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত। পরে ধীরে ধীরে বাঙ্গালীরাও জীবিকার প্রয়োজনে পাহাড়ে গমন করতে থাকে এবং বসতি স্থাপন করতে থাকে।

এখন বিবেচনা করুন, কারা কিভাবে ইন্ডিজেনাস এবং কে কিভাবে উপনিবেশ স্থাপন করেছে।

৩- ত্রিপুরার রাজমালার বিস্তারিত পড়া হয় নি, সেখানে কি বলা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠী বহু শতাব্দী থেকে বসবাস করে?

৪-

কোন মাপকাঠিতে একদল নিলো জাতির পরিচয়, আরেকদলকে অভিহিত করলো উপজাতি হিসেবে ? চিহ্নিত করলো নিম্নশ্রেনীর হিসেবে?

মাপকাঠি নিশ্চয়ই ছিল, একটু কষ্ট করে স্টাডি করে দেখুন। ট্রাইবের বাংলা করা হয়েছিল "উপজাতি"। এই অনুবাদ যদি সঠিক না হয়ে থাকে তাহলে বিকল্প প্রস্তাব করে দেখতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, সেটা যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুমোদন লাভ করে।

৫-

"ভারতে কম্যুনিষ্টদের 'তথাকথিত উপজাতিদের' পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী নামে অভিহত করানো"

এ বিষয়ে সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পড়ে দেখতে পারেন।

৬-

যে অর্থে ভারতে আদিবাসী শব্দটি প্রযোজ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযোজ্য না

না এটা আমারই অভিমত। ভারতে যাঁদের আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, তাঁরা সবাই তথাকথিত সভ্য মানুষেরা ভারতে পদার্পণের অনেক আগে থেকেই ভারতের কোন না কোন স্থানে বসবাস করে আসছে, সেই অর্থে তাঁরাই সেখানকার আদিবাসী। কিন্তু বাংলাদেশে যাদের আদিবাসী বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাঁদের কেউই তিন চারশো বেশী সময়কাল ধরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাস করছেন না, এমনকি সাঁওতালরাও না। মোটকথা বাংলাদেশে তাঁদের আগমন বাঙ্গালীদের চেয়ে অনেক পরে। তাই তাঁদের কাউকেই "ইন্ডিজেনাস" অর্থে আদিবাসী বলার কোন কারন নাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের কয়েকদিনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে বিতর্ক হলো, তাতে আমি প্রচুর এনজয় করেছি, যদিও কখনো কখনো টকঝাল মনে হয়েছে ৷ এই কয়েকদিন তুমুল বিতর্কের পরে আজকে বিতর্কটি যে জায়গায় এসে দাড়িয়েছে- তাতে মোটামুটি পরিস্কার হয়েছে যে বিতর্কের আসলে মূল বিষয়টি কোথায় ৷ অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে এতদিন যে আলোচনা চলছিলো, তা আসলেই সাইড বিষয় ছিলো ৷ মূলত আপনার পছন্দের মূল আলোচনায় আমাকে টেনে নেওয়ার জন্য আপনি প্রথমে আমার লেখা মূল বিষয়ের বাইরে অপ্রসঙ্গিক বিষয়ের অবতারনা করেছেন এবং এতোদিন না বুঝতে পারা ' দুর্বোধ্যতার' রোগে ভুগেছেন ৷ তাই সর্বশেষ মন্তব্যের/বিতর্কের- উপজাতিরা উপজাতি শব্দ মানে কিনা মানেনা এবং বাংলাদেশে উপজাতি শব্দকে কে আনয়ন করলো তা পুরোপুরিই সাইড বিষয় ৷ তাই তাই ঐ বিষয়গুলোতে বিতর্কের আর অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি ৷ ধন্যবাদ আপনাকে আপনি কি বিষয়টিতে আসলেই আমার সাথে বিতর্ক করতে চান সেটা এতদিনে পরিস্কার করার জন্য বা মূল বিষয়টিতে বিতর্কে নিয়ে আসার জন্য ৷

আপনার সাথে আপনার কয়েকদিনের মন্তব্যের/প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কাউন্টার মন্তব্য/উত্তরের পরে এতদিনের পরে যে মূল আলোচনায় আসতে পারলাম তা মোদ্দাকথা হচ্ছে - পার্বত্য চট্টগ্রাম (বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গারও) সরকারিভাবে স্বীকৃত উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে বাংলায় আদিবাসী (ইংরেজিতে ইন্ডিজিনাস) হিসেবে পরিচয় করানো যায় কিনা, যায় না ৷

বিতর্কের জায়গাটা তাই এসে দাঁড়িয়েছে দুইটি প্রেক্ষিত বা পয়েন্টকে ধরে ৷ এক; প্রধানত সাংস্কৃতিগত বিষয়কে ধরে আদিবাসীর পরিচয় ৷ যে সাংস্কৃতিগত বিষয়ের ভিন্নতার জন্য সরকারিভাবে পরিচিত উপজাতি/ক্ষুদ্রনৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকজন মনে করে আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের সময় থেকে (যেমন বাংলাদেশে) তাদের জাতিগত স্বীকৃতি নাই, তাদের সাংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে ৷ যার কারনে তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার সহ বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত, রাষ্ট্রগঠনের পর থেকে ৷ তাই তাদের সাংস্কৃতিগত ভিন্নতার ভিত্তিতে তারা অধিকার দাবি চায় ৷

দুই নম্বর হচ্ছে - ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ধরে ৷ আধুনিক রাষ্ট্রের এই যে বর্তমান সীমারেখা আছে তাকে অতীতকালে প্রক্ষিপ্ত করে কে প্রথম একটি দেশের বর্তমান সীমানায় এসেছিলো তার ইতিহাসের ভিত্তিতে- আদিবাসী বলা যাবে কিনা যাবে না তার বির্তক ৷ তাই এই প্রেক্ষাপটে আদিবাসী মানে বাংলায় আদিবাসিন্দা বুঝায় ৷

উপেরের দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে আদিবাসী পরিচয়ের বিতর্কে আপনার অবস্থান ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে ৷ আদিবাসী বিতর্কে এই অবস্থানে থেকে আপনি সরকারিভাবে স্বীকৃত উপজাতি/ক্ষুদ্রনৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক সংগঠনের যেমন ILO, UN এর আদিবাসীইংরেজিতে ইন্ডিজিনাস) ক্রাইটেরিয়ায় ফেলতে নারাজ ৷ কারন আপনার মতে,-

"আইএলও এর ইন্ডিজেনাস পিপল সংক্রান্ত ঘোষণার পুরোটা না পড়লে বোঝা যাবে না কেন এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বরং হুমকিস্বরূপ। "

বাক্যটি পড়ে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি ভয় পেয়েছি ৷ অন্য যাঁরা পড়বেন তাঁরাও ভয় পাবেন ৷ উৎকন্ঠিত হবেন দেশের জন্য ৷ বিষয়টি তাই অত্যধিক গুরত্বের দাবি রাখে ৷ যদিও পরিস্কার নয় (যেহেতু আপনি শুধু হুমকিটার কথায় বলেছেন, বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার অবকাশ পাননি), তাই দেশের হুমকি মানে সার্বভৌমত্বের হুমকি হিসেবেই ধরা যায় ৷ তাই একদিকে বর্তমানে বাংলাদেশের আদিবাসী আন্দোলন, দেশের প্রগতিশীল অনেক বাঙ্গালীর তাতে সাপোর্ট করা, 'মানবতা ব্যবসায়ী গুটিকতক এনজিও(আপনার মতে)' এর এই আন্দোলনকে লুফে নেওয়ার প্রেক্ষিত, অন্যদিকে দেশের জন্য আদিবাসী পরিচয়ের হুমকি - এরই পরিপ্রেক্ষিতে সকলের বিষয় অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ৷ বুঝে না বুঝে আদিবাসী দাবির জন্য যারা আন্দোলন করছেন, যারা এর সাপোর্টার (পাহাড়ি -বাঙ্গালি যেই হোক) এবং আদিবাসী আন্দোলনের বিরোধিতাকারী সবার জন্য বিষয়টি জানা জরুরী ৷

তাই বিষয়টির অত্যধিক গুরত্বের প্রেক্ষিতে আমি মনে করি মন্তব্যের সেকশনে এই বিতর্ক না হয়ে টপিক বা মূল আলোচনায় হওয়া উচিত ৷ তাই আদিবাসী বিতর্ক এবং দেশের জন্য হুমকি কে গুরত্বের বিবেচনায় নিয়ে আমি আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি এই বিষয়টি নিয়ে এই ব্লগে (অন্য কোন ব্লগেও হতে পারে, তবে এই ব্লগে হলেই ভালো যেহেতু ইস্যুটি এখানে ওঠছে) লেখার জন্য ৷ তাতে বিষয়টি খোলসা হবে তথ্য-উপাত্ত সহকারে বিতর্কের মাধ্যমে ৷ তাতে সবাই পড়তে পারবে, জানবে এবং অংশগ্রহন করতে পারবে ৷ আমার মূল লেখায় উপরের কয়েকজন যাঁরা 'আদিবাসী' শব্দের সাপোর্টার, তাঁদেরও জানা দরকার ৷


আবারও বলছি, একদিকে আদিবাসী পরিচয় দেশের জন্য হুমকির প্রেক্ষিত আর অন্যদিকে সরকারীভাবে স্বীকৃত উপজাতি/ক্ষুদ্রনৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অনড় অবস্থানের কারনে বিষয়টি অতীব গুরত্বপূর্ণ ৷ যেহেতু আদিবাসী বিতর্কে আপনার অবস্থান ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে (আদিবাসী স্বীকৃতি পাওয়া না পাওয়ার সাথে ঐতিহাসিক বিষয় জড়িত), তাই ঐতিহাসিক বিষয়গুলো অবশ্যই আসবে ৷ তাই সেখানে ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও বির্তক করা যাবে ৷ আমি এ বিষয়ে আপনার লেখা আশা করছি এবং একটা ফলপ্রসু বিতর্কের ৷ তাই এখানে আর কোন বিষয়ে বিতর্ক করছিনা ৷ আপনি ভালো থাকুন এবং প্রচুর আনন্দ আর লার্নিং পেয়েছি আপনার সাথে বিতর্কে ৷ তাই আবারো ধন্যবাদ ৷

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ধন্যবাদ জনাব হরি ত্রিপুরা। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আদিবাসী অভিধা সঠিক নয় মানেই যে সেখানে বসবাসকারীদের প্রতি অন্যায় এবং শক্তিপ্রয়োগের নীতি অবলম্বন করতে হবে, এটা কিন্তু কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমার উপলব্ধি মতে এ দেশের যে কোন বাঙ্গালীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত প্রিয় একটি স্থান, সেই স্থানের মানুষদের প্রতিও তাঁদের ভালবাসার কোন কমতি আছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন কারনে যে মতপার্থক্য ও অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যৌক্তিক পর্যালোচনা এবং কার্যক্রমের মাধ্যমেই সেসব দূর করা উচিৎ বলে মেন করি।

ঠিক আছে, নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে এ বিষয়ে একটি পোষ্ট দেয়ার আশা পোষণ করছি, দেখা যাক। ভাল থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ সেটা সই জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম ৷ অতীব গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে একটা চমৎকার বিতর্কের তাহলে আশা করছি ৷ অধীর আগ্রহে থাকলাম আপনার লেখাটি পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ৷ ততদিন ভালো থাকুন ৷ ধন্যবাদান্তে
হরি ত্রিপুরা

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ভারতে ৩০-৪০ বছর আগে আদিবাসী শব্দটির প্রচলনই সেভাবে ছিল না, যেভাবে এখন আছে। প্রমান স্বরূপ এই সময়কালের আগের কোন লেখায় আপনি এখনকার অর্থবোধক আদিবাসী শব্দটিই পাবেন না। পুরোনো অভিধানগুলো খুলে দেখুন, সেখানে আদিবাসী শব্দটিরই অস্তিত্ব নেই। বাংলাদেশে ১০-১৫ বছর আগে আদিবাসী শব্দটি এখনকার অর্থ বহন করতো না। আগে আদিবাসী শব্দটিই বরং আদিম মানুষের কাছাকাছি একটা অর্থ প্রকাশ করতো বলে এটা আরও অগ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দটি জনপ্রিয় করেছে তখনকার জনপ্রিয় পত্রিকা জনকণ্ঠ, আর সেটা লুফে নিয়েছে মানবতা ব্যাবসায়ী গুটিকতক এনজিও। আর আমরা আমজনতা ঝাঁকের কইয়ের মত ঝাঁকেই মিশে যাচ্ছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

জনাব আব্দুল্লাহ এ. এম এর পরবর্তী লেখায় যেহেতু মূল বিষয়টি আসতেছে আপাতত তাই আদিবাসী সংক্রান্ত কোন বিতর্কের উপর আর আলোচনা করা যাচ্ছেনা ৷ উপরের মন্তব্যটিও একই ক্যাটাগরিতে পড়ে ৷ ধন্যবাদান্তে
হরি ত্রিপুরা

অতিথি লেখক এর ছবি

(জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম. এর প্রশ্ন ও মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার লেখা শব্দ ও বাক্যে বেশ কিছু ভুল দেখা যাচ্ছে । যার কারনে কিছু জায়গায় বুঝার অসুবিধা হচ্ছে । তাই একটু এডিট করলাম । আশা করি সংশ্লিষ্ট এডমিনরা এটা রেখে আগের একটু বাদ দিবেন । সে জন্য আগাম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি । )
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা বুঝা সহজ না দুর্বোধ্য সে আলোচনায় আমি আপনার সাথে দ্বিমত করতে পারবোনা ৷ কারন আমাদের একেক জনের অভিজ্ঞতা, জানার পরিধি, আগ্রহ ইত্যাকার বিষয় আলাদা ৷ একজনের জন্য যেটা রকেট সাইন্স আরেক জনের জন্য সেটি হয়তো পানির মতো সহজ ৷
আপনার কখনো সরাসরি প্রশ্ন, কখনো মন্তব্য পড়ে আমি মোটামুটি যেভাবে আমার আলোচনা বা উত্তরগুলো সাজিয়েছি তা নিন্মরূপ :

প্রথমত; আমি হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের লেখার উপর ভিত্তি করে - তাঁর এই লেখার পিছনের ইতিহাস, এটার সাথে জড়িত তাঁর ব্যক্তিগত- সামাজিক-রাজনৈতিক মনোভঙ্গি কি হতে পারে, এবং এটার সাথে কোন ধরনের রাজনৈতিক উদেশ্য জড়িত কিনা তা দেখাতে চেষ্টা করছি একাডেমিক একটা তত্ত্বের মধ্যে ফেলে ৷ সবশেষে এই ধরনের লেখাকে জ্ঞানের স্বীকৃত কোন কাঠামোয় ফেলা যায়- তা বলার চেষ্টা করেছি ৷ এটা হচ্ছে মোটামুটি মূল বিষয় ৷ আমি দুঃখিত যে, আপনি বুঝতে পারেন নাই ৷

দ্বিতীয়ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা কি হিসেবে পরিচিত হতে চায়, কি হিসেবে হওয়া উচিত এবং কিভাবে সেখানকার সমস্যা সমাধান হতে পারে আনিসুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চেয়েছি হুমায়ুন আজাদের চিন্তার বিপরীতে ৷ একটা জনগোষ্ঠীেকে যেখানে স্কুলের কঁচি বাচ্চাদের টেক্স বইসহ বিভিন্ন মাধ্য়ম বা জায়গায় এখনো অবমাননাকর শব্দে পরিচিত করানো হয় - সে জায়গায় 'ভারত না ILO' টাইপের অধিকারের প্রসঙ্গে আলোচনা বড্ড বেমানান হয়ে যায় ৷

তৃতীয়ত, চুক্তি নিয়ে আমার অবস্থান জানতে চাওয়া একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ৷ মাফ করবেন, ভুল হয়ে থাকলে ৷ তবু কিছু বলি যেহেতু বিষয়টি ওঠে অাসছে - আপনি নিশ্চয় জানেন চুক্তির বয়স প্রায় দুই দশক ৷ যারা চুক্তির পরে জন্মগ্রহন করেছেন তাদের অনেকে এখন সাবালক ৷ অনেকে বোধহয় বাচ্চা কাচ্চার মা বাবাও ৷ কিন্তু সে চুক্তি এখনো নাবালকই রয়ে গেছে অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ন কোন ইস্যু বাস্তবায়ন হয়নি ৷ যার কারনে বিগত দুদশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের একক পরিস্থিতি বলুক, পাহাড়ি ও সরকার-বাঙ্গালীদের সম্পর্ক বলুক দিন দিন ঘোলাটে বা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ৷ এই অবস্থায় আপনি যদি পাহাড়ীদের ওখানকার বাঙ্গালিদের বা সরকারকে আস্থায় নিতে বলেন তাহলে কি পরিহাসের মতো শুনাচ্ছে না বিষয়টা ? চলমান আগ্রাসন বজায় রেখে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আস্থায় নেওয়ার অাহ্বান জানানোর মতো ৷ তবে তার মানে- এটা ধরে নেওয়া একেবারে ঠিক হবেনা যে - টোটালী পাহাড়িরা বা বাঙ্গালিরা সেখানে দেওয়াল তুলে চলছে, দুই সম্প্রদায়ের মুখ দেখাদেখি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ । এই সমস্যার মধ্যেও বন্ধুত্ব হচ্ছে, মানুষ বন্ধুত্ব বজায় রাখে, কলিগরা একসাথে কাজ করছে, অনেকে একে অপরকে সাহায্য করছে অনেক সময় ৷ সমস্যাতো প্রধান কারনতো পাহাড়ীত্ব বা বাঙ্গালিত্বের জন্য নয় ৷ সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা অাছে তারা কিভাবে যুগ যুগ ধরে এই জাতিগত লাইনের মধ্যে রাজনীতি বা পলিসির মাধ্যমের সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে যাচ্ছে ৷ সুতরাং আপনার যদি এমন ধারনা হয় আমি বা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জাতিগতভাবে বাঙ্গালী বিদ্বেষী, সেটা বড় ধরনের অবিচার হবে ৷

আর আমার লেখায় 'বাঙ্গালি বিরূপতার' যে অভিযোগ সে জন্য সেটা আমি সর্বাংশে প্রত্যাখান করি অাপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ৷ হয়তো কোন বিষয়ে আপনার মনোভঙ্গি-বিশ্বাস এমন ধারনার জন্ম দিয়েছে ৷ আমি আমার লেখায় যেটা দেখাতে চেয়েছি তা হলো, কিভাবে উপনিবেশিক কায়দায় শাসন শোষনের জন্য, তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য একদল ক্ষমতাশালী জনগোষ্ঠি বা গ্রূপ আরেকদল ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠির উপর সমস্ত খারাপ ধরনের বৈশিষ্ট্যনমূহ আরোপ করে- কুজ্ঞান, কুতথ্য, কুযুক্তির পাহাড় গড়ে তোলে ৷ হুমায়ুন আজাদ যেমনটি করেছেন ৷ কিন্তু তিনি একা নন ৷ উপন্যাস থেকে গবেষনা নামে বিভিন্ন শ্রেনি মানুষের লেখা অসংখ্য বই আপনি হিল বিষয়ে ঢাকায় খোঁজলে পাবেন ৷ আমি এটাও মনে করি, আজকে বাঙ্গালিরা যদি পাহাড়িদের জায়গায় হতো, পাহাড়িরা যদি একই রকম উগ্রজাতীয়তাবাদের চর্চা করতো - তাহলে বাঙ্গালিরাও আজকের পাহাড়িদের একই পরিনতি ভোগ করতো ৷ মিয়ানমারে যেমনটা হয়, হচ্ছ ৷ সুতরাং সমস্যা রাজনীতি, সিস্টেমের ৷ তবে আমার অবস্থান নিয়ে যদি বলতে হয় - আমি বলবো আমি উগ্র জাতীয়তাবাদ-সাম্প্রদায়িকতার , উপনৈবেশিক ধরনের শাসন শোষনের বিদ্বেষী (বিরূপ) একজন লোক ৷ এটাই একজন মানুষ হিসেবে আমার সর্বপ্রধান পরিচয় ৷ অনেক কিছু লিখলাম আপনার প্রশ্ন ও মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ৷ কোথায়ও ভুল থাকলে মার্জনা আশা করছি ৷
হরি ত্রিপুরা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।