শৈশব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/১১/২০১৬ - ২:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“বাবা ওটা কী ছিল?”
"কোনটা অমিয়?”
“ওই যে যেটা আমি দেখলাম”
“কী দেখেছ অমিয় সোনা”
“ওই যে যেটা চলে গেলো!”

অমিয়র তখন আড়াই বছর। সারাদিন তুরতুর করে কথা বলে। এটা সেটা, কত কথা, কত জিজ্ঞাসা! আর বলেও খুব পরিষ্কার, আধো আধো বুলি ওর মুখে শুনিনি কোন দিন। কথা শেখার সময় ছেলেটা আমার কাছে ছিলোনা। ওর যখন চোদ্দ মাস, আমার স্ত্রী একদিন বলল,

“বাচ্চাটাকে পরিবারের কেউ দেখলোই না। চলো কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসি।”

আমি বললাম,

“কেমন করে যাই এখন! সেমেস্টার চলছে, আর তাছাড়া আমার থিসিস সুপারভাইজার কিছুদিন পর স্যাবাটিকালে চলে যাবে। এখন গিয়ে সামারে পুষিয়ে নেবো সে উপায়ও নেই।”

“তোমাকে যেতে হবেনা, আমি নিজেই পারবো। চার বছর একা একা ইংল্যান্ডে ছিলাম ভুলে যেওনা।”

“ভোলার কি উপায় আছে, সময়ে অসময়ে মনে করিয়ে দিতে ছেড়েছ কবে? কিন্তু এতো ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে একা একা এতো লম্বা জার্নি……”

“সে আমি ঠিকই সামলে নেবো।”

মাসখানেক পর ওরা চলে গেলো। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের দরজার সামনে অমিয়কে নামিয়ে দিয়ে বললাম,

“ভালো থাকিস বাবা”

মা’র হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো ছেলে, একটি বারের জন্যও পেছন ফিরে তাকায় নি।

আমার ছেলেটা শান্ত, খুব বেশি শান্ত। অনেক কষ্ট করে পৃথিবীতে এসেছে বলেই কিনা জানিনা, সব কিছুকেই দারুণ স্বাভাবিক ভাবে নেবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে ওর। ওর জন্মের দিন, আজ থেকে নয় বছর আগের কথা - সুমু সেদিন হাসপাতালে, আমি বাসায় ছেলের জন্য ক্রিব বানাচ্ছি। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। সুমুর ফোন,

“তুমি এখুনি চলে আসো, আমার পানি ভেঙ্গে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে এক ঘণ্টা পর ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাবে”

আমি নিজেও ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। ফোন পেয়ে বুকটা ধকধক করে উঠলেও ক্রিব বানানো শেষ করলাম। একটা বাচ্চা আসবে বাড়িতে, তার থাকার জায়গাটা তৈরি না করেই চলে যাবো!

বাসা থেকে হাসপাতাল মাত্র দশ মিনিটের পথ, কিন্তু ট্যাক্সিতে ওই দশ মিনিটকেই মনে হচ্ছিলো অনন্ত কাল।

হাসপাতালে গিয়ে দেখি সুমু গোসল করে পরিপাটি হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভালো করে চুল শুকায়নি। খোলা কাঁধে ভেজা ভেজা চুল, রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা জলপরী যেন এক আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

ডেলিভারি রুমে একজন ডাক্তার, একজন নার্স আর আমরা। সুমু বিছানায় শুয়ে, বিছানার পাশে একটা মনিটরে উঁচুনিচু রেখাচিত্র, আমার ছেলের হৃৎস্পন্দন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চলে গেলেন। যাবার আগে বললেন আমাদের একটু ঘুমিয়ে নিতে, এই নাকি সুযোগ। এরপর বহু বছর, চাইলেই আর ঘুমাতে পারবোনা। বলল চিন্তার কিছু নেই, নার্স থাকছে।

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম বলতে পারবোনা। হঠাৎ পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ডাক্তার পাগলের মত এই মনিটর সেই মনিটরে ঘোরাঘুরি করছে। বুকটা ধক করে উঠলো। সুমুও ততক্ষণে ঘুম ভেঙ্গে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে। নার্স ফিসফিস করে আমাকে জানালেন বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছেনা।

আমি জানতে চাইলাম কতক্ষণ ধরে পাওয়া যাচ্ছেনা। নার্স নিজেও জানেন না, সারা দিনের ক্লান্তিতে তাঁরও নাকি ঘুম পেয়ে গিয়েছিলো।

দুঘণ্টা পর। আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে ডাক্তার জনসন নিজেই আমাকে বললেন ভেতরে যেতে।

সুমুকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়েছে, লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া। কাল এখানে রিমাম্বারেন্স ডে’র ছুটি। হাসপাতালে একজন মাত্র অ্যানেস্থেশিয়া স্পেশালিষ্ট রয়েছেন যিনি অন্য জরুরী অপারেশনে ব্যাস্ত। আরেকটি শহর থেকে খবর দিয়ে একজনকে আনতে হয়েছে বলেই এতো দেরি।

আমি সুমুর হাত ধরে বসে আছি। নিঃশব্দ ঘরে সার্জনের ছুরির ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আর এয়ার কন্ডিশনারের সাঁই সাঁই আওয়াজ, আমি সুমুর হৃৎস্পন্দন অনুভব করি, আমার হৃদপিণ্ডটাও রাতের বুক চিড়ে ছুটে যাওয়া মেল ট্রেনের এঞ্জিনের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। কেবল জানিনা আমাদের ছেলেটার হৃৎপিণ্ড এখনও সচল, নাকি থেমে গিয়েছে গতি হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া লাট্টুর মত।

অল্পক্ষণ, নাকি অনেকক্ষণ! পর্দার আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে কেউ একজন ডাকলো আমাকে। সম্মোহিতের মত টলতে টলতে গিয়ে দেখি ডাক্তারের হাতে এই এতটুকুন একটা বাচ্চা, একটু একটু নড়ছে তার ছোট ছোট হাত।

“তোমাদের ছেলে”

সুমু পর্দার ওপার থেকে চিৎকার করে বলছে,

“বেঁচে আছে? সব ঠিক আছে তো?”

“সব ঠিক আছে”

“হাত পায়ের আঙুল গুলো গুনে দেখো, চোখ-মুখ-নাক-কান ভালো করে দেখ সব। আমার কাছে নিয়ে আসছে না কেন? কাঁদে না কেন আমার ছেলে?”

অমিয় কাঁদে নি। সারা জীবন শুনে এসেছি নবজাতকেরা থাকে ভেজা ভেজা, ইংরেজিতে যাকে বলে স্লাইমি। আমার ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন চৈত্রের খরতাপে শুকিয়ে আসা ধূসর জমিন। পানি ভেঙ্গে যাবার অনেক পরে সে পৃথিবীর আলো দেখেছে। মায়ের নাড়ি, যে নাড়ি তাকে তিল তিল করে পুষ্টি জুগিয়েছে এতগুলো মাস, সেই নাড়িতেই নাকি পেঁচিয়ে গিয়েছিলো বাছা আমার। অনেক লড়েও ছুটতে পারেনি। এইটুকুন হৃৎপিণ্ড কতটাই বা পারে!

জন্মানোর পর কাঁদেনি বলেই বোধহয় অমিয় খুব একটা কাঁদে টাদে না। ওর হয়ে আমিই কাঁদি, সময়ে অসময়ে।

ওরা চলে যাবার পর অনেকক্ষণ বসে ছিলাম এয়ারপোর্টের একটা বেঞ্চিতে। আমার দুচোখ উপচে জলের প্লাবন, লোকজন হেঁটে যেতে যেতে অবাক হয়। আমার তাতে বিকার নেই। পাঁচটা মাস কাটবে কী করে!

বাবা, মা, আর অ্যাই। এই তিনটি শব্দ সম্বল করেই ঢাকায় গিয়েছিলো অমিয়। গিয়ে পড়লো দুই খালার হাতে। আমি ফোন করলেই শুনি খালারা বলছে,

“বলতো বাবা রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর।”

“রোবিন্দ নাত টাকুর”

“এইবার বল ব্রহ্মপুত্র”

“বম্মপুত্ত”

“বল তো সোনা, কিংকর্তব্যবিমুঢ়”

“ভ্যা……………………।"

আমি এপাশ থেকে রাগ করে বলি,

“তোরা কী শুরু করলি এসব? এইটুকু বাচ্চাকে এত কঠিন কঠিন শব্দ শেখাচ্ছিস কেন? এটা রীতিমতো নির্যাতন।”

“হি হি।”

ঢাকায় গিয়ে ছেলে আমাকে ভুলেই গিয়েছে। আমি ফোন করলেই তিড়িং করে লাফ দিয়ে পালায় অন্য ঘরে। আমার রাগ হয় খুব। সুমু বুঝিয়ে বলে, বাদ দাও ছেলে মানুষ।

পাঁচ মাস পর। টার্মিনালের এরাইভাল গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে খিল ধরে গিয়েছে। হঠাৎ দেখি র‍্যাম্প দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরুচ্ছে ফুটফুটে একটি শিশু, অমিয়। আমার স্ত্রী দারুণ গর্বিত একটা হাসি নিয়ে তার পেছন পেছন।

আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। সুমু বলল,
“অমিয়, এটা তোমার বাবা”

অমিয় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“এটা বাবা!”

তারপর, আমার পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দিয়ে আমার সমস্ত অস্তিত্বে অদ্ভুত একটা শিহরণ জাগিয়ে দিয়ে টেনে টেনে গোল গোল করে বলল,

“বা---বা সু---ধু আ------দ----র ক-------------রে"

কী স্পষ্ট উচ্চারণ! কেবল স টাই এস S এর মতো।

আমি ওর একরাশ চুল ভরা মাথায় আমার নাকটা ডুবিয়ে বললাম

“বাবা সব সময় আদর করবে।”

সেই ছেলের আজ নয় বছর হল। ভারি দুরন্ত, মাঝে মাঝেই এমন সব কাণ্ড করে যে মনে হয় দেই ধরে ……। দিইনা, দেবার কথা মাথায় এলেই মনে পড়ে, “বা---বা সু---ধু আ------দ----র ক-------------রে"।

সকালে ঘুমিয়ে থাকা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো আড়াই বছরের অমিয়র জিজ্ঞাসা,

“বাবা ওটা কী ছিল? ওই যে যেটা আমি দেখলাম? ওই যে যেটা চলে গেলো!”

আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঘুমন্ত ছেলের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললাম,

“ওটা ছিল তোমার শৈশব। কেমন করে কোনদিক দিয়ে যে চলে গেলো! শুভ জন্মদিন অমিয়, শুভ জন্মদিন বাপ আমার।”


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

কী সুন্দর লেখা! চলুক
চোখের সামনে নিজের আত্মজ/আত্মজাকে বড় হতে দেখা..আহ!

আপনার ছানার জন্য আদর। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীডোর। ছানাকে বলে দেবো।

--মোখলেস হোসেন

জিপসি এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন টোকন ভাই। আমার ছেলেটাও সবে আট বছরে পড়ল, যায়নি এখনও বাপের বাড়ি। ঘুম পাড়ানি গল্প হিসেবে ও শুধু শুনতে চায় বাবা'র শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকথা।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ জিপসি। এরা মনে হয় আমাদের ছোটবেলার গল্পগুলো বিশ্বাস করেনা। দেশে নিয়ে যান পারলে।

---মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

কি অদ্ভুত যে ভালো লাগলো বলার ভাষা নেই!! আপনার লেখার ধরনটা এতো এতাখানি মুগ্ধ করে যে সেটা প্রকাশ করাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কত গুলো গল্প যে আমাদের শোনাতে শুরু করে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছেন সেটা মনে করলে ক্ষোভ জাগে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। গল্পগুলো শেষ করতে না পারার দুঃখ আমারই কি কম! একেতো আমি আলসে মানুষ, তার উপর কাজের চাপ। আরও দুই সপ্তা ক্লাস বাকি। তারপর বসতে পারবো।
--মোখলেস হোসেন

অর্ণব এর ছবি

আপনার লেখা যে এত ভালো!

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ অর্ণব। লেখা নয়, আসলে স্মৃতিটাই অপূর্ব।

--মোখলেস হোসেন

তাহসিন রেজা এর ছবি

ভীষণ ভালো লাগল লেখাটি পড়ে। অমিয়'র জন্য অনেক শুভকামনা হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তাহসিন রেজা। অমিয়কে জানিয়ে দিয়েছি।

--মোখলেস হোসেন

দেবদ্যুতি এর ছবি

অমিয়কে আদর। আপনার লেখাটাকে ভালবাসা।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দেবদ্যুতি। আপনাকেও শুভেচ্ছা।

---মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লেগেছে আপনার লেখা। সহজ, সাবলীল, কিন্তু অসাধারন।

- ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী। এই লেখাটা আপনার চোখে পড়ায় আমি যারপরনাই আনন্দিত।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।