One day in the life of Ivan Denisovich (আইভান ডেনিসোভিচের জীবনের একদিন) - পর্ব - ৩ : A novel by Alexander Solzhensitsyn

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ৩০/০১/২০১৭ - ১১:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর্ব - ৩ :

ঠিক যখন পিঠে নম্বর লেখা দলের লোকেদের সবাই বারান্দার দরজার দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে, সূখোভ কোনরকমে সব কাজ সেরে সেটার লেজের অংশটার সাথে জুড়ে গেলো। যার যা জামা-কাপড় আছে সব পরে থাকাতে তাদের মনে হচ্ছে বেশ মোটাসোটা, আর সবাই হেলেদুলে আড়াআড়ি ভাবে একলাইন ধরে জমায়েত হওয়ার ময়দানটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কেউ কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা নেই। বাতাসে শুধু পায়ের তলায় বরফ ভাঙার শব্দ।

অন্ধকার তখনো কাটে নি, যদিও পুর্বাকাশে সবুজাভ আভা দেখা যাচ্ছে। উদিয়মান সূর্যের দিক থেকে তাদের দিকে উড়ে আসছে একটা হালকা কিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ।

ভোরবেলা সবাই ময়দানে জমায়েত হওয়ার চেয়ে বাজে কিছুই হতে পারে না – অন্ধকার, তীব্র শীত আর ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শুরুর অপেক্ষা। জিহ্বা কেমন যেন নিঃস্বার হয়ে আসে। কারো সাথে কথা বলার সমস্ত ইচ্ছাই মরে যায়।

একটা নিম্নপদস্থ গার্ড ময়দানময় ছুটে বেড়াচ্ছে।

“তো তিউনিন, তোমার জন্য কতক্ষন অপেক্ষা করতে হয়? আবার দেরী?”

সূখোভ হলে ভয়ে কাদা হয়ে যেতো, কিন্তু তিউনিন সেই বান্দা না। এই ব্যাটার পিছনে সে একটা নিঃশ্বাসও নষ্ট করতে রাজী না। সে কোন জবাব না দিয়ে চুপ করেই রইলো।

এবং পুরো দল তাকে তুষারের মধ্যে দিয়ে অনুসরন করে এগিয়ে যেতে লাগলো, চিঁ চিঁ করতে করতে, হেলেদুলে, হেলেদুলে।

তিউনিন মনে হয় এক কিলো শুয়োরের চর্বি ঘুষ দিয়ে ভালোই তেল মালিশ করেছে, কারন তাদের ১০৪ নম্বর দল হেঁটে সেই সবসময়কার জায়গাতেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে, যেটা আশেপাশের দলের লোকেরাও দেখতে পাচ্ছে। তাহলে দূর্বল আর বোকা কোন দলকেই “সমাজতান্ত্রিক জীবনধারা” প্রকল্পে পাঠানো হচ্ছে। আহারে, আজকে ওখানকার অবস্থা খুবই কঠিন হবে, সাতাশ ডিগ্রী তাপমাত্রা, তুষার, তীব্র বাতাস। কোন আশ্রয় নেই। নেই কোন আগুনের ব্যাবস্থা।

একজন সর্দারের অনেক শুয়োরের চর্বির দরকার হয়; প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টকে তেল দেয়ার জন্য, আর নিজের উদর পূর্তির জন্যেও। তিউনিনের জন্য কোন পার্সেল না আসলেও ওর কখনোই কম পরে না। দলের কেউ যদি পায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আগে তিউনিনের কিছু উপহার হিসেবে নিয়ে হাজির হয়।

নয়তো এখানে টিকে থাকাটাই অসম্ভব।

লিস্ট ধরে হিসেব রাখার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র-গার্ড এক টুকরো বোর্ডের দিকে তাকালো।

“তোমার দলের একজন অসুস্থতার কারনে ছুটি নিয়েছে, তিউনিন। ২৩ জন উপস্থিত।”

“জ্বি, ২৩ জন।” তিউনিন মাথা ঝোঁকালো।

কে বাদ থাকলো? পান্তেলেয়েভকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেতো অসুস্থ ছিলো না।

সাথে সাথেই কথাটা কানেকানে ছড়িয়ে পড়লো। কুত্তার বাচ্চা পান্তেলেয়েভ, আবারও দেরি করেছে। মোটেও সে অসুস্থ না। নিশ্চয়ই গার্ডদের সাথে ঘোঁট পাকাচ্ছে, অন্যের নামে কানপড়া দিচ্ছে।

ওরা তাকে চুপিচুপি দিনের বেলাতেই ডেকে পাঠায়, দু’তিন ঘন্টার জন্য। কেউ দেখতেও পায় না, কিছুই জানতেও পারে না।

মেডিক্যাল অফিসারদের দিয়ে ঠিকই ব্যাপারটা কায়দা করে নেয়।

যতই দলগুলো তল্লাশির জন্য ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই সেটা কোটের কালো রঙে ছেয়ে যাচ্ছে। সূখোভের তার জ্যাকেটের নম্বর রঙ করানোর কথা মনে পড়ে গেলো, এবং সে গুঁতোগুঁতি করতে করতে একপাশে সরে আসলো। দু’তিন জন লাইনে দাঁড়ানো আর্টিস্টের কাছে তাদের পালা আসার অপেক্ষায়। তাদের সাথে সেও যোগ দিলো। এই নম্বরগুলো আসলে বিশাল আপদ ছাড়া আর কিছুই না; খুব বেশী স্পষ্ট হলে গার্ডগুলো দূর থেকেই চিনে ফেলে, আবার সময়মত রঙ না করালে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সোজা লক-আপে পুরে দেয়।

ক্যাম্পে তিনজন আর্টিস্ট আছে। ওদের কাজ ক্যাম্পের হর্তাকর্তাদের জন্য বিনে পয়সায় ছবি এঁকে দেয়া, আর এছাড়াও কয়েদীরা জমায়েত হওয়ার সময় পালা করে এসে নম্বর রঙ করে দেয়া। আজ ছাইরঙা দাড়িওয়ালা বুড়ো আর্টিস্টটার পালা। পাদ্রীদের কপালে তেল মাখিয়ে যেভাবে আশীর্বাদ করে, ওর রঙ মাখানোর কায়দাটা অনেকটা সেরকম।

বুড়ো লোকটা একের পর এক রঙ করেই যাচ্ছে আর মাঝেমাঝে দস্তানায় ফুঁ দিয়ে হাত গরম করে নিচ্ছে। দস্তানাটা পাতলা আর সুক্ষভাবে বোনা। তার হাত ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। সে শুধু কোন রকমে নম্বরগুলোর উপর রঙ চড়িয়ে যাচ্ছে।

নিজের জ্যাকেটের এস-৮৫৪ নম্বরটা রঙ করিয়ে কোমরের দড়ি দিয়ে সেটা ভালোভাবে না জড়িয়েই সূখোভ দলের সাথে যোগ দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই যেহেতু তল্লাশি শুরু হবে, তাই ভালো ভাবে জ্যাকেত গায়ে জড়ানো নিয়ে মাথা ঘামালো না। তক্ষুনি তার চোখে পড়লো তার দলের যেজার তামাক টানছে, তাও পাইপ না আস্ত সিগারেট। তার মানে চেয়েচিন্তে তার কাছ থকে দু’একটা টান দেয়ার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে সরাসরি না চেয়ে যেজারের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো এবং আধেক ঘুরে এমনভাবে দূরে দৃষ্টি মেলে দিলো যেন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সে আনমনা ভাব নিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেও লক্ষ্য করলো প্রতিটা টানের সাথে (যেজার খুব দ্রুত জোড়ে জোড়ে টান দিচ্ছে)জলন্ত ছাইয়ের একটা চিকন বলয় এগিয়ে যাচ্ছে, আর নিঃশব্দে সিগারেট হোল্ডারের দিকে এগুতে এগুতে সিগারেটের দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিচ্ছে।

ফেতিউকোভও ছোঁকছোঁক করা শেয়ালের মত কাছে এসে ঠিক যেজারের সমনে এসে দাঁড়ালো আর চোখ চকচক করে তার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলো।

সূখোভের তামাক একেবারেই শেষ, আর সন্ধ্যার আগে তামাকে টান দেয়ার কোন সুযোগই নেই। তার শরীরের প্রতিটা স্নায়ু শুধু একটা সুখটান দেয়ার তৃষ্ণায় এমন টানটান উদগ্রীব হয়ে আছে, যেন এর বিনিময়ে সে এই ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগও বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু সে কখনোই ফেতিউকোভের মত ছ্যাঁচরামি করতে পারে না, এভাবে কারো মুখের দিকে হাভাতের মত তাকিয়ে থাকা সম্ভব না।

যেজারের জাতের পরিচয়টা কেমন যেন জগাখিঁচুড়ি মার্কা। গ্রীক, ইহুদি, নাকি জিপ্সি বোঝা দায়। বয়সে বেশ তরুন। সে ছবি বানাতো। কিন্তু তার প্রথম ফিল্ম শেষ করার আগেই সে গ্রেফতার হয়ে যায়। তখন তার ছিলো কালো, মোটা পাকানো গোঁফ। ক্যাম্পে ওরা আর তার গোঁফ কামিয়ে দেয় নি, কারন দলিলে ওর ঠিকানা-ঠিকুজির রেকর্ডের সাথে রাখা ছবিটাও গোঁফ সহই।

“যেজার মারকোভিচ”, নিজেকে সামলাতে না পেরে হ্যাংলার মত ফেতিউকোভ বললো, “আমাদেরও একটু টানতে দাও না।”

তার মুখটা লোভ আর লালসায় একেবার জুলজুল করছে।

যেজার তার ঢুলুঢুলু কালো চোখের ভারী পাতা একটু তুলে ফেতিউকোভের দিকে চাইলো। কারন তামাক টানার সময় ব্যঘাত ঘটানো আর একটা টানের জন্য ঘ্যানঘ্যান শোনা তার একদম পছন্দ না। তামাক টানার চেয়ে ধূমপানের সময় তার মাথায় চলা চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়াটাই ওর কাছে বেশী বিরক্তিকর। সে তামাক টানে তার চিন্তাচেতনাকে খেলানোর জন্য যাতে তার ভাবনাগুলো ঠিকঠাক বয়ে যেতে পারে। কিন্তু সিগারেট ধরানোর সাথে সাথেই সে বুঝতে পেরেছিলো যে অনেক জোড়া চোখ শুধু একটা সুখটান দেয়ার জন্য বোবা আকুতি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

যেজার সূখোভের দিকে তাকেয়ে বললো, “আইভান ডেনিসোভিচ, এটা ধরো।”

আর তার বুড়ো আংগুল দিয়ে এ্যাম্বারের তৈরী হোল্ডার হতে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা খুলে দিলো।

যদিও সূখোভ ঠিক এটাই যেজারের কাছ থেকে আশা করছিলো, তবুও সে অবাক হওয়ার ভান করে খুব গদগদ ভাব করে একহাতে সিগারেটের টুকরোটা নিয়ে আর আরেক হাতের তালু সিগারেটের নিচে রেখে খুব সাবধানে নিলো যাতে ছাই আচমকা গড়িয়ে পড়ে না যায়। অনেকের মুখ পরিচ্ছন্ন, আবার অনেকের মুখেই খুব দূর্গন্ধ হয়, তাই খুঁতখুঁতে যেজার তাকে হোল্ডার সহ সিগারেট টানতে না দেয়াটা সূখোভ গায়ে মাখলো না, আর হাতের শক্ত আঙ্গুল না পোড়ে মত করে সে টানতে লাগলো। আসল কথা হচ্ছে ছিঁচকে শেয়াল ফেতিউকোভটাকে কাটানো গেছে। এখন সে ঠোঁট না পোড়া পর্যন্ত আরামে টানতে পারবে। হুমমম...।

ধোঁয়াটা যেন তার ক্ষুদার্ত শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা ছুঁয়ে বয়ে গেলো, মাথা আর পায়ের পাতা যেন ঝনঝন করে উঠলো। ঠিক এই সুখের মুহুর্তেই সে একটা চিৎকার শুনতে পেলো, “ওরা আমাদের ভেতরের জামাকাপড় খুলে ফেলছে।”

এই হচ্ছে বন্দীর জীবন। সুকোভের আস্তে আস্তে এসব অভ্যাস হয়ে গেছে। একেবারে যাতে গলার উপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে সেই চেষ্টাই করে যাওয়া।

কিন্তু এরা আবার ভেতরের জামা নিয়ে পড়লো কেন? ক্যাম্পের কমান্ডার নিজেইতো এগুলো বরাদ্দ দিয়েছিলো। নাহ, কিছু একটা গোলমাল আছে।

তাদের তল্লাশির পালা আসার আগে আরো কয়েকটা দল লাইনে আছে। ১০৪ নম্বর দলের সবাই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। ওরা দেখলো সিকিউরিটি চিফ লেফটেন্যান্ট ভলকোভয় স্টাফ কোয়ার্টার থেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে এসে চিৎকার করে গার্ডদের উদ্দেশ্যে কিছু বলছে। আর গার্ডেরা, লেফটেন্যান্ট ভলকোভয় না থাকলে যারা কোনরকমে দায়সারা ভাবে তল্লাসির কাজ সেরে ফেলে, আজ একেবারে পূর্ণ উদ্দ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো।

“শার্ট খুলে ফেলো”, সার্জেন্ট চিৎকার করে আদেশ দিলো।

কয়েদী বলো আর গার্ড বলো, ভলকোভয়কে কেউই পছন্দ করে না। এমনকি ক্যাম্পের কমান্ড্যান্টও নাকি ওর ভয়ে কাঁপে। ঈশ্বর বদমাশটাকে একেবারে ঠিক নামটই দিয়েছেন (রুশ ভাষায় Volk মানে নেকড়ে)। ব্যাটার চেহারা আর কাজকারবার দুটোই একেবারে নেকড়ের মতই। কালো, লম্বা, রাগী রাগী চেহারা আর খুব তড়িৎ গতিতে তার চলাফেরা। হয়তো ব্যারাকের পেছন থেকে হঠাৎ উদয় হয়ে ধরে বসলো, “হচ্ছেটা কি এখানে?”। এর হাত থেকে পালানোর কোন উপায় নেই। শুরুর দিকে, সেই ’৪৯ সালে সে নাকি তার হাতের সমান মোটা বেণী করে পাকানো চামড়ার চাবুক সাথে নিয়ে ঘুরতো। সেটা দিয়ে নাকি সে কয়েদখানায় চাবকে বেড়াতো। অথবা বন্দীরা যখন বিকেলবেলা মাথাগোনার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াতো তখন আচমকা পেছন থেকে উদয় হয়ে “লাইনে দাঁড়াসনি কেন, বদমাশ।” বলে সপাং করে কারো ঘাড়ে চাবুক কষে দিতো। যাকে মারা হয়েছে সে মারের তোড়ে দূরে উড়ে গিয়ে পরতো। আর দাঁতে দাঁত চেপে নিরবে হাত দিয়ে ঘাড়ের রক্ত মুছতো, টুঁ শব্দটি করলে আবার কয়েদখানায় নিয়ে নির্যাতনের ভয়ে।

এখন, কি জানি কি কারনে যেন, ভলকভোই আর চাবুক নিয়ে ঘোরে না।

সকালবেলা আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলে গার্ডরাও হালকা মেজাজে থাকে, যদিও সন্ধ্যায় থাকে না। কয়েদীরা বেল্ট খুলে কোট দু’পাশে মেলে ধরে দেখায়। পাশাপাশি পাঁচজন করে এগিয়ে যায়, আর পাঁচজন গার্ড অপেক্ষায় থাকে তাদের তল্লাশি করারা জন্য। গার্ডেরা তাদের বেল্টওয়ালা জ্যাকেটের চারিদিকে থাপরে থাপরে দেখে। দস্তানা খুলতে অনিচ্ছুক গার্ডেরা প্যান্টের হাঁটুর কাছে নিয়ম অনুযায়ী সেলাই করা একটিমাত্র পকেট হাতড়ে উঁচু হয়ে থাকা কিছু টের পেলে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অলস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি?”।

সকালের জমায়েতে কয়েদিদের কাছে এরা খোঁজেটা কি? ছু্রি? কিন্তু ছুরিতো ক্যাম্পের বাইরে নেয়ার জিনিষ না, ক্যাম্পের ভেতর পাচার করার জিনিষ। সকালে তাদেরকে নিশ্চিত করতে হয় কোন কয়েদি পালানোর উদ্দেশ্যে ৩ কিলো রুটি সাথে নিয়ে যাচ্ছে কিনা। একটা সময় ছিলো যখন কয়েদিদের রাতের খাবারের সাথে দেয়া দু’শো গ্রামের রুটির টুকরোগুলো নিয়ে গার্ডেরা এত উদ্বিগ্ন থাকতো যে প্রত্যেকটা দলকে এই রেশন বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কাঠের বাক্স বানিয়ে নিতে হয়ে ছিল এবং সবার জন্য গুনে গুনে রুটি সংগ্রহ করতে হতো। এই কাজ ওরা কি লাভের আশায় করতো, মাথায় ঢুকতো না। মনে হয় এটা শুধু মানুষকে যন্ত্রনা আর পেরেশানি দেয়ারই আরেকটা কায়দা। এ যেন অনেকটা প্রতিটা রুটির টুকরোর উপর টুক করে একটু কামড় দিয়ে চিহ্ন দিয়ে আবার রেখে দেয়ার মত, আসলে প্রতিটা রুটির টুকরোইতো দেখতে একই, দুটো মটরদানা যেমন একই রকম, সেরকমটাই, আর সবইতো একই বড় রুটি থেকেই কেটে নেয়া। আর দল বেঁধে হেটে চলার সময় ব্যাপারটা মাথায় শুধু ঘুরঘুর করে, একটা দুশ্চিন্তাই যন্ত্রনা দিতে থাকে, নিজের জন্য বরাদ্দ করা রেশনটা অন্য কাউকে বঞ্চিত করে দেয়া হবে নাতো? কারন এ নিয়ে ভালো বন্ধুদের মধ্যেও ঝগড়াঝাটি লেগে যায়, এমনকি মারামারি পর্যন্তও গড়ায়! একবার তিন বন্দী একটা লরি-ট্রাকে এক বাক্স রুটি নিয়ে পালিয়ে গেলো। এতে তাদের মগজে আবার সুবুদ্ধি গজালো। সবাইকে যার যার রুটি হাতে করে নিতে হবে, তারা নতুন আদেশ দিলো।

তল্লাশির প্রথম কাজ হচ্ছে কেউ ক্যাম্পের ইউনিফর্মের নিচে সাধারন পোশাক পরে আছে কিনা তা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রত্যেক বন্দীর কাছ থেকে সাধারন পোশাকের শেষ সুতো পর্যন্ত জব্দ করে রেখে দেয়া হয়েছে, এই বলে যে বন্দী জীবন শেষে ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু আসলে কেউ বন্দী জীবন শেষ করতে পারে নি।

মাঝেমাঝে গার্ডেরা বন্দীদের হাতড়ে হাতড়ে বাইরের লোকের পাঠানো চিঠির খোঁজে। কিন্তু এভাবে জনে জনে খুঁজতে গেলেতো একেবারে রাতের খাওয়ার সময় পার হয়ে যাওয়ার দশা।

তারপরেও ভল্কোভয় চিৎকার দিয়ে তন্নতন্ন করে তল্লাশি করার আদেশ দিলো। আর গার্ডেরাও তাদের দস্তানা খুলে সবাইকে প্যান্টের ভেতর গুঁজে রাখা জ্যাকেট (যার ভেতর ব্যারাকের ভেতরকার উষ্ণতা সযত্নে জমা করা) বের করার আর শার্টের বোতাম খোলার নির্দেশ দিলো। তারপর তারা হেঁটেহেঁটে বন্দীদের হাতড়ে বেড়াতে লাগলো কেউ নিয়মের বাইরে কিছু লুকিয়ে রেখেছে কিনা তার খোঁজে। একজন বন্দীর শুধু একটা শার্ট আর তার নীচে একটা গেঞ্জি ছাড়া কিছু পরলে কেড়ে নেয়া হবে, এই হলো বন্দীদের জন্য ভল্কোভয়ের আদেশ। যাদের আগে তল্লাশি হয়েছিলো তাদের ভাগ্য ভালো। ওদের অনেকে গেট পার হয়ে গেছে। কিন্তু বাকীদের জামাকাপড় খুলে দেখাতে হচ্ছে। যার পরনেই অতিরিক্ত পোশাক পাওয়া যাচ্ছে, সেটা এই ঠান্ডার মধ্যেও ততক্ষনাৎ খুলে কেড়ে নেয়া হচ্ছে।

ব্যাপারটা এভাবেই শুরু হলেও এক পর্যায়ে বেশ ভজঘট মত লেগে গেলো, সারীর মাঝখানটা হয়ে গেলো ফাঁকা। ওদিকে গেটের কাছে দাঁড়ানেও গার্ডেরা “জলদি কর, জলদি কর” বলে তাড়া দিতে লাগলো। ফলে যখন ১০৪ নম্বর দলের তল্লাশিরর পালা এলো তখন গার্ডদের কিছুটা ছাড় দিতে হলো। ভল্কোভয় গার্ডদের বললো যারা যারা অতিরিক্ত কাপর পরেছে সবার নাম লিখে রাখতে এবং অভিযুক্ত সবাইকে কোথায় এবং কিভাবে লুকিয়ে রেখেছে তার লিখিত ব্যাখ্যা সহ অতিরিক্ত কাপর সন্ধ্যায় জমা দেয়ার নির্দেশ দিল।

সুখোভের কাপরচোপর নিয়ম মতই ছিল। আয় ব্যাটা, যত ইচ্ছে হাতাহাতি কর। আমার বুকের ভেতরকার আত্নাটা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাবি না তোরা। গার্ডদের নজর পরলো সেযার একটা ফ্লানেলের ভেস্ট, আর ওদিকে বুইনভস্কি একটা ওয়েইস্ট কোট বা কোমর-বন্ধ জাতীয় কি একটা পরে আছে। বুইনভস্কির ক্যাম্পের বন্দী জীবনের বয়স মাত্র তিন মাসেরও কম। সে বাঁধা দিল। নেতাগিরির অভ্যাস ওর এখনো যায় নি।

“এই ঠান্ডার মধ্যে মানুষের কাপর-চোপর কেড়ে নেয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই। ক্রিমিনাল কোডের আর্টিকেল নাইন তোমরা জান না।”

কিন্তু তাদের সেই অধিকার খুব ভালো ভাবেই ছিল। সেই কোডও তাদের জানা। বন্ধু, তুমিই মনে হয় আইনটা ঠিক মত জান না।

ওদিকে বুইনভস্কি বলেই যাচ্ছে “তোমরা সোভিয়েত নাগরিকের মত ব্যাবহার করছো না, তোমরা কমিউনিস্টের মত ব্যাবহার করছো না।

ওর আইনের কচকচানি শুনতে শুনতে ভলভয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে গেল। সে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, “দশ দিনের জেল।” এবং পাশে দাঁড়ানো সার্জেন্টকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলো, “আজ সন্ধ্যা থেকেই শাস্তি শুরু।”

সকাল থেকে শাস্তি শুরু করা এদের একেবারে অপছন্দ। একজন লোকের পুরো একদিনের খাটনি বাদ পড়ে যায়। তাই সারাদিন রক্ত পানি করা খাটনি খাটিয়ে তারপর জেলে পুরে দেয়াটাই রীতি।

জেলখানাটা কাছেই, সকলে জড়ো হওয়ার যেই মাঠটা, তার বামে। ইটের তৈরী দালানটার দুইটা অংশ। দ্বিতীয় অংশটা যোগ হয়েছে গত শরৎকালে। আগে জায়গা খুব কম ছিলো। জেলখানায় আগে ছিল আঠারোটা সেল, নির্জনবাসের কুঠুরিগুলো ছাড়াও। ওগুলো বেড়া দিয়ে আলাদা করা। ইটের তৈরী জেলখানাটা ছাড়া পুরো ক্যাম্পটাই কাঠের তৈরী।

ঠান্ডাটা কাপড়ের ভেতর ঢুকে গেছে। এত কষ্ট করে গায়ে কাপড় জড়ানোটাই বৃথা গেল।

সূকোভের পিঠের ব্যাথাটা দারুন কষ্ট দিচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বিছানায় শুয়ে একটা দারুন ঘুম দেয়া যেত! মোটা কম্বলের নিচে শুয়ে পড়তে পারাটাই তার এখন একমাত্র চাওয়া।

বন্দীরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কোটের বোতাম লাগাচ্ছে আর কোমড়ের দড়ি পেঁচাচ্ছে। বাইরে থেকে সেপাইরা চেঁচাতে লাগলো, “জলদি আসো, জলদি আসো”।

পেছন থেকে গার্ডেরা হুড়ো দিতে লাগলো,”এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও”।

প্রথম গেট। ক্যাম্পের সীমান্ত এলাকা। তারপর দ্বিতীয় গেট। গার্ড-হাউজের কাছে প্রতিটি পাশ বরাবর রেলিং দেয়া।

“হল্ট!”, একজন সেপাই চিৎকার করে নির্দেশ দিলো। যেন তারা একপাল ভেড়া। “সবাই পাঁচজন পাঁচজন করে দলে ভাগ হয়ে যাও”।
(চলবে)

- ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

পর্ব ২ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56426

পর্ব ১ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56419


মন্তব্য

নৈ ছৈ এর ছবি

পর্বগুলির জন্য অপেক্ষা করি।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে। অনেক ধন্যবাদ নৈ ছৈ। ৪র্থ পর্ব আপলোড করেছি। কেমন হচ্ছে জানালে উপকৃত হব। উপদেশ একান্তভাবে কাম্য।

-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।