হাসিনা' কে ঘিরে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিময়তা ।। পর্ব ২

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৭/২০০৭ - ২:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৮৮ পারিবারিক বিপর্যয়ের বছর ।
তখনো আমরা পিঠাপিঠি দু ভাইবোন । বোন কয়েকমাস ধরে শুয়ে আছে শেরেবাংলানগরের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে । হৃদরোগ ধরা পড়েছে । হার্টের একটা ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে । দ্রুত অপারেশন জরুরী । সেই ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে মাত্র ১টা কিংবা দুটো হার্টের অপারেশন হয়েছে তখনো ।
ডাক্তার রা কোনো ভরসা দিতে পারছেননা । বলছেন সিংগাপুর কিংবা ব্যাংককে নিয়ে যেতে । নিয়ে যে যাওয়া হবে-টাকা কোথায়?

পরিবারের অর্থনৈতিক বিপর্যয় তো শুরু সেই ১৯৭৫ এ । এক একটা রাষ্ট্রীয় ঘটনা অনেকটুকু প্রভাব ফেলে ব্যক্তির জীবনে- সে ব্যক্তি রাজনীতির হোক কিংবা অরাজনৈতিক ।
আমার বাবা কি রাজনীতির মানুষ ছিলেন । না ছিলেন না । আমি কোনোদিন তাকে মিছিলে যেতে দেখিনি,কোন সভামঞ্চে বক্তৃতা দিতে দেখিনি,কোনো দলীয় মানুষের সাথে তাঁর সখ্যতা দেখিনি । বাবা কি তবু রাজনীতির মানুষ ছিলেন না? নিশ্চিত ছিলেন ।

২০০১ এর এপ্রিলের ২০ তারিখ । আমাদের ঘরে বিয়ের উৎসব ।ছোটমামার বিয়ে । সেই বিয়ের সকাল বেলা ক্লিনিকে মারা গেলেন বাবা । পাশের বেডে ঘুমে আমি ও আম্মা । আমরা কিছুই বোঝলাম । এমনই নাটকীয় ছিল তাঁর মৃত্যু এবং বেঁচে থাকা ।
বাবাকে কবর দিয়ে ফিরে আসার পর মুহুর্ত থেকে তাঁর চেহারা আমি আর মনে করতে পারিনা ।

বাবার কথা মনে পড়লেই একটা শীর্ন দীর্ঘ কাঠামো চোখে ভাসে । সাদা পায়জামা, খদ্দরের পাঞ্জাবী । এই লোকটা আমার বাবা । সাদা পায়জামা, খদ্দরের পাঞ্জাবী এর বাইরে অন্য কোনো পোষাক তাকে পড়তে দেখিনি কোনোদিন । অন্য কোনো পোষাক পড়েননি ১৯৬৬ র ছয়দফা ঘোষনার পর থেকে ।

কৃষি কর্মকর্তা ছিলেন । পাকিস্তানী শাসনের শেষদিন গুলোতেও এই পোষাক পড়ে অফিস করেছেন । '৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পরের দিন গুলো কি পাকিস্তানী শাসনের চেয়ে ও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল?
আমাদের যমজ দু ভাইয়ের জন্ম সেই রাষ্ট্রীয় হত্যার পরে । তার আয়ু নিয়ে আমি বেঁচে আছি । সে চলে গেছে তিন্দিন পর । আমার সে ভাইকে বাবা দেখতে পারেননি । আমাকে দেখেছেন প্রায় তিনবছর পর । সামরিক সরকারের হুলিয়া মাথায় বাবা তখন ফেরারী-কখনো আগরতলা, কখনো গৌহাটি ।
একজন নিতান্ত নিরীহ গুরুত্বহীন মানুষ, মানুষ হত্যা করতে পারবেনা বলে যুদ্ধে যেতে পারেনি(এই অনুশোচনা তাকে তাকে তাড়া করেছে সারাজীবন)সেই মানুষ কি করে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়? না, সেই গল্প জানিনা আমি । সেই দিনগুলোতে আসলেই কি ঘটেছিলো কেউই তা জানেনা । বাবা অনেক কথা বলতেন । কথা বলতেন শিশুদের সাথে,আড্ডা জমাতেন রিক্সাওয়ালাদের সাথে । আমি তার মতো এতো প্রানবন্ত হতে পারিনি । কিন্তু সেই দিনগুলোর কথা বাবা কাউকেই বলেননি । চেপে রেখেছেন নিজের ভেতর ।

কেবল মনে পড়ে,পরের সামরিক শাসকের সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পত্র এসেছিলো,'নির্দোষ প্রমানিত হওয়ায় আপনাকে চাকুরীস্থলে ফিরিয়া যাইতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে' । নিম্নমানের সেই মানুষের তখন রাষ্ট্রীয় ফাজলামো মেনে নেয়ার সাধ ছিলোনা আর ।
আজ ২০০৭ সালে যখন জলপাই গনতন্ত্রের সুবাতাসে উর্দিওয়ালা ছাড়া দেশের সবশালারাই দুর্নীতিবাজ তখন সন্দেহ জাগে, সেই ১৯৭৫ এ আমার বাবা ও কি দুর্নীতিবাজ ছিলেন?
সেই দুর্নীতিবাজের একমাত্র কিশোরী মেয়ে প্রায় চিকিৎসাহীন হয়ে পড়েছিলো হাসপাতালের বেডে ১৯৮৮ সালে ।
আর মারা যাচ্ছে নিশ্চিত-সেই বোনকে শেষবারের মতো দেখতে গিয়ে এক কিশোরের দেখা হয়ে গিয়েছিলো, আকাশী রংয়ের তাঁতবোনা শাড়ী পড়া এক ভীষন মায়াবী মহিলার সাথে ।

সেই মায়াবী মহিলা এখন আর আকাশী রংয়ের তাঁতবোনা পড়েননা । তাঁর গলায় এখন মুক্তোর মালা । গতকাল তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ।
সেই দেখা হওয়ার গল্প হতে পারে আরেক বেলা ।

***********
***********

এই বিস্ময় আমি উপভোগ করি । মাঝে মাঝে কি-বোর্ড স্বাধীন হয়ে যায়। আংগুলের সাথে তার গোপন সমঝোতা হয় আমার অগোচরে ।এই ভাবে লেখা হয় ,আসলে যা লেখার কোনো পরিকল্পনা থাকেনা আমার ।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আপনার অনুভুতিটা অন্তর ছুঁয়ে গেল। বল্গাহীন অনুভুতি আসলে বল্গাহীন লিখা উচিত। আপনার বাবার জন্য হ্যাটস অফ শ্রদ্ধা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

আরিফ জেবতিক এর ছবি


২০০১ এর এপ্রিলের ২০ তারিখ । আমাদের ঘরে বিয়ের উৎসব ।ছোটমামার বিয়ে।সেই বিয়ের সকাল বেলা ক্লিনিকে মারা গেলেন বাবা ।

আমি আর রনি, জুয়েলের বিয়ে উপলক্ষে সিলেট গেছি সারারাত জার্নি করে।ভোরে ঘরে পৌছে দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি।আধো ঘুম,আধো জাগরন।তখনই টেলিফোনে পেলাম এই খবর।
রনি বিষাদ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমেই বললো,‌'সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে খুব রসিকতা করেন।কিন্তু তিনি জানেন না সেই রসিকতাগুলো আমাদের কাছে বড়ো অশ্লীল আর ইতরামি রসিকতা মনে হয়।''

কথাটি আজো কানে বাজে।

G।-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মাহবুব মুর্শেদঃ
কৃতজ্ঞতা । বিষাদের অংশীদারিত্ব নেয়ার মতো কমরেডস পাওয়া এক জীবনে অনেক কিছু ।

আরিফঃ
সেই! এই সব নির্মম রসিকতা হাসি
ভালোই হয় এইসবে, হেড টু হেড খেলে যাওয়া যায় সহজে ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চোখ ভিজে গেলো।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বুঝতে পারছি না, এমন আবেগময় একটা লিখা পড়ার পরে কি বলা যায়। অনুভূতিকে প্রকাশের ব্যর্থতাটাই মনে হয় অনেক সময় মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

জাহেদ সরওয়ার এর ছবি

অন্য রকম লেখা। কারন আঙুলে চাকা লাগানো আছে। আর রক্তে শিহরণ।

*********************************************

সৌরভ এর ছবি

পড়লাম, শুধু এটাই জানিয়ে রাখি।
মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই।
চোখ ভিজে গেল।

------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অচেনা এর ছবি

মন্তব্য করার যোগ্যতা আমারো নেই।

-------------------------------------------------
যত বড়ো হোক ইন্দ্রধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা॥

তারেক এর ছবি

পড়েছি... আর কিছু বলতে পারব না
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অরূপ এর ছবি

শ্রদ্ধা

নজমুল আলবাব এর ছবি

মনে হয় তুমি আমার, আমাদের কথা সব বলে যাচ্ছ... আমরা নিজেরাই শুনছি নিজেদের কথা তোমার মুখে...

সুজন চৌধুরী এর ছবি

কান্দায়া ছাড়লেন।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

অমিত এর ছবি

আপনার বাবার জন্য শ্রদ্ধা থাকল।লেখা নিয়ে কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকলাম।
_______ ____________________
suspended animation...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেলো পড়ে। খুব ভাল লেখা।

ঝরাপাতা এর ছবি

কষ্টের কথা কি বলিব, কষ্ট কাহাকে বলে? অসাধারণ।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সময় দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা সকলে ।
কেনো যে লিখছি এভাবে,নিজে ও জানিনা ঠিক ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

কেন লিখছেন জানার দরকার কী? নিজেকে খুলে দিয়ে লিখে যান।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

কেমিকেল আলী এর ছবি

ভোট দিলাম, আর বেশি কিছু বলার নাই

নিঘাত তিথি এর ছবি

পড়লাম...।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।