বখতিয়ার খিলজির একটি পরাজয় পালক

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৭/২০১৭ - ৭:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে ভারতবর্ষে সবাই চেনে। ভারতবর্ষের বাইরেও অচেনা নন তিনি। উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। কারো কাছে তিনি মহানায়ক, কারো চোখে তিনি মহাভিলেন। বখতিয়ার খিলজির বীরত্বের কিংবদন্তি সবাই জানলেও তাঁর শেষ অভিযান সম্পর্কে খুব বেশী মানুষ জানে না।

সুদূর পশ্চিম এশিয়া থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে একের পর এক রাজ্য জয় করা শেষে বখতিয়ার খিলজি বঙ্গবিজয় করেছিলেন ১২০৪ খৃষ্টাব্দে। বঙ্গবিজয়ের পর তিনি খুব বেশীদিন ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি। কেননা বঙ্গবিজয়ের দুবছরের মধ্যে অনিবার্য দুর্ভাগ্য তাঁর নজরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের উত্তরের দুর্গম প্রায় অগম্য রাজ্য তিব্বতের দিকে।

লোকে বলতো দুনিয়া-বিচ্ছিন্ন দেশ তিব্বতে আছে সোনা, রূপা আর মূল্যবান রত্নরাজি। বখতিয়ার খিলজির কাছেও সেই খবরই ছিল। উপরি হিসেবে আরো আছে বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য পথ সিল্ক রুট যেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে চীনের সাথে বিশ্ববাণিজ্যের দরোজায় খাম্বা গেড়ে বসে যাওয়া যাবে।

খোঁজ খবর নিতে গিয়ে মিলে গেল আলী মেক (Ali Mech) নামের এক হিমালয়বাসী উপজাতীয় বাসিন্দার, যে পথ দেখিয়ে বখতিয়ার বাহিনীকে বাংলা থেকে তিব্বতে নিয়ে যাবে। যুগে যুগে এই উপমহাদেশের মানুষ বিদেশী শক্তির এমন সহায়ক গাইড হিসেবে কাজ করে এসেছে। আলেকজাণ্ডার, বখতিয়ার খিলজি বা ভাস্কো-দা-গামা কেউ তাদের মহান সেবা থেকে বঞ্চিত হননি।

অতঃপর ১২০৬ খৃষ্টাব্দের এক শুভদিনে দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে বখতিয়ার খিলজি উত্তরবঙ্গের দেবকোট (Debkot- দিনাজপুর সংলগ্ন প্রাচীন গৌড়ের অংশ ছিল) নগরী থেকে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রার পূর্বে তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী আলী মর্দান খিলজিকে দেশ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘোড়া ছোটালেন উত্তর দিকে।

ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ ধরে এগিয়ে তাঁর বাহিনী কামরূপ রাজ্যে প্রবেশ করলো। তারপর কামরূপের রাজার সাহায্যে(ভীত সাহায্য?) তিস্তা নদীর প্রাচীন সেতু পেরিয়ে, সিকিম ভূটানের মাঝামাঝির পার্বত্য এলাকা দিয়ে তিব্বতের চাম্বি উপত্যকায় (Chumbi Valley) প্রবেশ করলেন।

খিলজি বাহিনী চাম্বি উপত্যকায় পৌঁছেই তৎকালীন রীতি অনুসারে বিজিত নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার কর্মসূচীতে নেমে পড়লো। নির্বিচার খুন খারাবি লুটতরাজের মহোৎসব চলল দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। আতংকিত তিব্বতবাসী দিশেহারা প্রায়। বেঘোরে মারা পড়লো অনেকে।

কিন্তু কতদিন সহ্য হয় মানুষের? চোখের সামনে নিজের ঘরবাড়ি গ্রামগঞ্জ লণ্ডভণ্ড হতে দেখতে দেখতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তিব্বতীরা একসময় জেগে উঠলো। এক অজ্ঞাতনামা নেতৃত্বের ডাকে ঐক্যবদ্ধ হলো মার খাওয়া তিব্বতী জনগোষ্ঠি। গড়ে তুললো অভিনব এক গেরিলা বাহিনী। সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম গেরিলা বাহিনীর জন্ম হয়েছিল তিব্বতেই। দেশ প্রতিরক্ষার প্রবল প্রত্যয়ে তিব্বতী গেরিলা বাহিনী চাম্বি উপত্যকার নানান অংশে লুকিয়ে থেকে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করলো খিলজি বাহিনীর উপর।

কিছুদিন পর প্রতিকূল আবহাওয়া এবং তিব্বতী গেরিলা বাহিনীর সেইসব চোরাগোপ্তা হামলায় খিলজি বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠে গেল। কিছুতে সামাল দিয়ে উঠতে পারল না সেই আক্রমণ। এক পর্যায়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল। উপায় না দেখে বখতিয়ার খিলজি এবার তাঁর বাহিনীকে পিছু হঠার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে দাবার ছক পাল্টে গেছে। এবার পেছন ফেরার পথও বন্ধ প্রায়।

কামরূপের রাজা প্রতাপশালী খিলজি বাহিনীর তিব্বত প্রবেশে বাধ্য হয়ে যে সহায়তা করেছিল, সেই রাজা খিলজি বাহিনীর দুরাবস্থায় বিগড়ে গিয়ে তিস্তা সেতু অবরোধ করে রাখলেন। অতএব বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পরাজিত বখতিয়ার খিলজি প্রায় সব সৈন্যকে পেছনে রেখে মাত্র শ খানেক সহযোগীকে নিয়ে বিকল্প একটা পথে কোনমতে প্রাণটা নিয়ে বাংলায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। পেছনে ফেলে আসা সৈন্যদলের পরিণতি সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

বিপর্যয় সেখানেই শেষ নয়। তিব্বতের ব্যর্থ অভিযান শেষ করে ফিরে আসার পর বখতিয়ার খিলজি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মধ্যযুগে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো রাজা বাদশাদের অসুস্থ হওয়া মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। খুব কাছের লোকেরাও তখন ক্ষমতা ও জীবন দুটোর উপরই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

বখতিয়ার খিলজির উপর হুমকি হয়ে দাঁড়ালো আলী মর্দান খিলজি, যাকে তিব্বত অভিযানে যাবার সময় গদি রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ অবস্থায় বখতিয়ার খিলজিকে হত্যা করে দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করলো আলী মর্দান।

বেচারা বখতিয়ার খিলজির জীবনের সমাপ্তি ঘটলো একটি পরাজয় পালক মুকুটে গেঁথে।

---------------------------------
তথ্যসুত্র:
১. Buddhism and Islam on the Silk Road -Elverskog, Johan (2011-06-06).
২. The River of Golden Sand: The Narrative of a Journey Through China and Eastern Tibet to Burmah- William John Gill; Henry Yule (9 September 2010).
৩. A Comprehensive History of Medieval India: Twelfth to the Mid-Eighteenth Century- Farooqui Salma Ahmed (2011).
৪. বাংলাপিডিয়া


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বিস্তারিত জানা হলো। ভালো লাগলো অনেক। শুভেচ্ছা রইলো।
রায়হান অর্ক

হাসিব এর ছবি

উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল।

আপনি নিশ্চিত?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এখানে একটু ভুল আছে। লেখা উচিত ছিল 'উপমহাদেশের এই অঞ্চলে' অর্থাৎ বঙ্গদেশে। উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বে সূচনা তার আগের শতকেই হয়েছিল মুহম্মদ ঘোরির মাধ্যমে। কিন্তু মুসলিমরা এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে সপ্তম অষ্টম শতক থেকেই।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মুস্তাফিজ এর ছবি

উপমহাদেশে মুসলমান রাজত্বের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল।

সুচনা সম্ভবত মোহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে হয়েছিলো (৭১২ খৃ) এরপর সবুক্তগীন এসেছিলেন। তবে স্থায়ী শাসন শুরু হয়েছিল মোহাম্মদ ঘোরী'র আমল থেকে। ঘোরীর সেনাপতি ছিলো কুতুবুদ্দিন আইবেক আর বখতিয়ার খিলজী ছিলেন কুতুবুদিন এর অধীন।
বাঙ্গলায় সম্ভবত বখতিয়ার খিলজীই প্রথম এসেছিলেন।

...........................
Every Picture Tells a Story

হাসিব এর ছবি

এই অঞ্চলে ক্ষমতা দখল করতে খিলজীর আগে কেউ এসেছে এরকম প্রমাণ নেই। তবে খিলজির আগে মুসলিম বসতির আভাস আছে।

মন মাঝি এর ছবি

চলুক

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আগ্রাসনের হিসেব করলে মোহাম্মদ বিন কাসেমের নাম সবার আগে আসে এটা ঠিক। তিনি সিন্ধু পর্যন্ত বিজয় করেছিলেন। তারপর তিনি মারা যান কিংবা তাকে হত্যা করা হয়, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে স্থায়ী কোন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি সেই বিজয়ে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কিছু কিছু বিষয়ে আপনার সাথে আমার ভিন্নমত আছে। সেগুলো কী তা ছয় বছর আগের এই পোস্টে দেয়া আছে।

আমার পোস্টটা দেবার পর আমি যখন আরও পড়েছি তখন ইখতিয়ারের উত্তরাভিযান নিয়ে আরও নানা প্রকারের মত পেয়েছি। কেউ বলেছেন সে নেপালের বাগমতী অতিক্রম করে উত্তরে গিয়ে পাহাড়ীদের পিটুনি খেয়েছিল (যেমনটা আমি লিখেছিলাম); কেউ বলেছেন সে ডোকা লা দিয়ে তিব্বতে পৌঁছেছিল (যেমনটা আপনি লিখেছেন); আবার কেউ বলেছেন সে কামরূপ দিয়ে তিব্বতে যাবার চেষ্টা করে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিতে খাবি খেয়েছিল।

আমি নিজে প্রথম মতটিতেই স্থির। কারণ, উত্তরাভিযানে সবাই ইখতিয়ারকে পূর্ব দিকে ঠেলে কারণ মেচদের সাথে ইখতিয়ারের মিত্রতা। মেচরা একটি বোড়ো-কাচারী জনজাতি বলে তাদের আবাস পূর্ব দিকে হবে বলে ধরা হয়। এ'কথা সত্য যে, ভারত-বার্মা সীমান্তের পাটকাই পর্বতমালা থেকে মেচ'রা যখন হিজরত করে তখন তারা মূলতঃ ব্রহ্মপুত্র নদের দুই ধার বরাবর বোড়ো-কাচারী এলাকায় বসতি স্থাপন করে। কিন্তু এ'কথাও সত্য যে মেচদের একটা গ্রুপ বর্তমান ভারত-নেপাল সীমান্তের কাছে 'মেচি' নদীর উত্তর দিকে বর্তমান নেপালে বসতি স্থাপন করে। এখনো নেপালের ঝাপা জেলায় হাজার পাঁচেক মেচ বাস করেন।

ইখতিয়ার পূর্ব দিকে যাত্রা করলে তাকে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো, বিশাল প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিতে হতো, এবং শেষে হিমালয়ের পূর্ব রেঞ্জ পাড়ি দিতে হতো। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে এই ২০১৭ সালেও কোন সেনাবাহিনী এই রুট ধরে উত্তরবঙ্গ থেকে তিব্বতে যেতে রাজী হবে না। তাছাড়া এই পথে পদে পদে নানা বোড়ো-কাচারী জনজাতিদের দুর্ধর্ষ গ্রুপ ছাড়াও প্রবল ক্ষমতাধর কাচারী রাজ্য ছিল। এত কিছু পাড়ি দিয়ে ইখতিয়ারের লুটেরা দল বেশি দূর যেতে পারার কথা না। যদি এই পথে সে তিব্বতে পৌঁছে থাকতো তাহলে আসামের ইতিহাসে ইখতিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতো। বাস্তবে তা হয়নি।

ডোকা লা দিয়ে ইখতিয়ারের তিব্বতে পৌঁছানোর তত্ত্ব খুব হালে পানি পায় না এই পথের দুর্গমতার কারণে। এই পথটা যদি এতো সহজ হতো তাহলে ভারতীয়রা বহু বহু কাল আগে অথবা ব্রিটিশরা আরও পরে এই পথে তিব্বতে খাবলা বসাতো। স্মর্তব্য দশম শতকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাংলা থেকে তিব্বতে গিয়েছিলেন নেপালের পথে। এই ২০১৭ সালেও অত্যাধুনিক ভারতীয় ও চীনা সেনাবাহিনী ডোকা লা দিয়ে এপাশ ওপাশ করতে বা এর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে খাবি খায়।

বাংলা আক্রমণের বছর দেড়েকের মধ্যে নিহত ইখতিয়ার আসলে বেশি দূর যেতে পারেনি, সেটা সময় হিসেব করলে বোঝা যায়। তাছাড়া সমৃদ্ধ বাংলায় লুটপাট চালানোতে যে সুবিধা সেটা রেখে তার লুটেরা দলের লোকজন দুর্গম পথে অজানা তিব্বতে যেতে রাজী ছিল না। ফলে লোক যোগাড় করতেই তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এতে বেশি সময় চলে যায়।

বাগমতী নদীতে ইখতিয়ার যে পরিমাণ নাকানিচোবানি খেয়েছিল তাতে তার ফুসফুসে পানি ঢুকে গিয়েছিল। সুতরাং আলী মর্দান খিলজী'র ছুরিকাঘাতে নিহত না হলে ইখতিয়ার ফুসফুস সংক্রমণে মারা যেতো।

ইখতিয়ারকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা সম্ভবত গত এক-দেড়শ' বছরের। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইখতিয়ারকে ঠেলেঠুলে তিব্বতে পৌঁছানো হয়েছে। আসলে ইখতিয়ার নেপাল পর্যন্ত পৌঁছে নেপালীদের মার খেয়ে ল্যাজ গুটিয়ে বাংলায় ফেরত এসেছিল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বখতিয়ার খিলজি যে অঞ্চলে পৌঁছেছিল সেটি তিব্বতের অধীনে ছিল কিনা, এখন তা বলা মুশকিল। কেননা গত ৮০০ বছরে এই অঞ্চলের রাজ্য সীমানা বহুবার পাল্টেছে। তবু অনুমান করা যায় তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চল ছিল সেটি। নেপাল তখন নেপাল নামে পরিচিত ছিল না। নেপাল ভুটান নামের রাজ্যগুলোর জন্ম খুব বেশী আগের না। হিমালয়ের সমগ্র এলাকা আসলে তিব্বতী ভাবধারার জনগোষ্ঠিরই ছিল। জাতিগতভাবে সমগ্র হিমালয়ান অঞ্চলই তিব্বতী ভাবধারার বহু জনগোষ্ঠির বসবাস। ভুটাস সিকিম থেকে সুদূর উত্তরখণ্ড বা লাদাখ পর্যন্ত প্রায় একই রকম সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছে।

আপনি যে মতটা দিয়েছেন সেটা যথেষ্ট বিবেচনার দাবী রাখে। যেসব গবেষক এই বিষয়ে কাজ করেছেন তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ সুত্র অনুযায়ী মত প্রকাশ করেছেন। তবে কোন পথে প্রবেশ করেছেন সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো খিলজি সাহেব ওখানে কঠিন মার খেয়েছিলেন এবং সেই মারটা প্রাণঘাতি ছিল। প্রচলিত ইতিহাসে বীরত্বের কাহিনী যেভাবে প্রচার করে, এই মারা খাওয়াটাকে তার এক দশমাংশও প্রচার করে না। বলা চলে একদম অন্ধকারেই রাখা এই অংশটুকু।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আলোচনাটা যদি আমরা ইখতিয়ারের উত্তরাভিযানের সময় কাল অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে সীমাবদ্ধ রাখি তাহলে জটিলতা কমে। তাই আমরা ঐ সময় কালের ঘটনাবলী নিয়েই বলবো।

নেপাল দেশটার কমপক্ষে গত তিন হাজার বছরের ইতিহাস পাওয়া যায়। এই সময়ের মধ্যে নেপালের উত্তরের এক আধটু তিব্বতীরা কখনো দখল করেছিল কিনা সেটা নিশ্চিত না। করে থাকতেও পারে। তবে মেচি নদী বা দক্ষিণ নেপাল দূরে থাক মধ্য নেপাল পর্যন্ত তিব্বতীরা কখনোই দখল করতে পারেনি। ত্রয়োদশ শতকে নেপাল শাসন করেছে প্রবল ক্ষমতাধর মল্লরা, যাদের অধস্তন পুরুষদেরকে আজও আমরা দেখতে পাই 'মাল্লা' পদবীতে। মল্লদের সময়ে তিব্বতীরা নেপালে হাত বাড়ানো দূরে থাক বরং পশ্চিম তিব্বত নেপালীদের দখলে ছিল। সুতরাং ইখতিয়ার যে মার খেয়েছিল সেটা মল্লদের হাতে হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

ভুটান নামটার সংস্কৃত অর্থ 'তিব্বতের অন্ত'। তার মানে ভুটান কখনো তিব্বত না। ভুটানে তিব্বতের শাসন ছিল, তবে ত্রয়োদশ শতকের আগে। ঐ সময়ে ভুটানীরা নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করা শুরু করেছিল। ইখতিয়ার ভুটানে যায়নি এটা নিশ্চিত। ভুটান দিয়ে তিব্বতে সরাসরি পৌঁছানো ঠ্যালা আছে!

বাকি থাকে সিকিম। এটা ত্রয়োদশ শতকের পরের ভাগে মানে গুরু তাশী'র সময়ে তিব্বতের শাসনে আসে। কিন্তু সেটা তো ইখতিয়ারের গালগল্পের পরের কথা।

আপনি ঠিকই বলেছেন, পথটা যে দিক দিয়েই হোক উত্তরাভিযানে ইখতিয়ার যে মার খেয়েছিল সেটা আর এই জন্মে ভুলতে পারেনি। তার আগেই সে পরপারে পাড়ি দিয়েছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার এর ছবি

আসামের ইতিহাসে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত হতেন? তখন কি অহমিয়া ইতিহাসরচনা শুরু হয়েছে?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কোন মানুষ বা কোন ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য কি সমসাময়িককালে ইতিহাস রচনা শুরু হওয়া আবশ্যক?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার এর ছবি

সমসাময়িক কোন সোর্স না থাকলে যেটা করা যায় তা হল argumentum ex silentio। খুব মজবুত কিছু না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পৃথিবীর বয়স 4.543 billion বছর, পক্ষান্তরে এই পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচে' পুরনো লিখিত বিবরণের বয়স মাত্র 5,400 বছর। রেলিক্‌স এন্ড রুইন্‌সকে সমসমায়িক সোর্স ধরলে সময়কালটা ঠেলেঠুলে 3.3 million বছর পর্যন্ত যাবে। তার মানে গোটা পৃথিবীর ইতিহাসের 99.93% খুব মজবুত কিছু না। বাকি 0.07%-ও যে খুব মজবুত কিছু তাও না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

ইগ্‌নোরেন্স ইজ ব্লিস! হাসি

****************************************

সমাচার  এর ছবি

আপনি বলেছিলেন বখতিয়ার আসাম দিয়ে গেলে তিনি আসামের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হতেন। আমি বলেছি, তিনি আসাম দিয়ে গেলেও আসামের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত না হতে পারেন। সমসাময়িক আসামের ইতিহাসের কোন প্রমাণ না থাকার মানে এই নয় যে তিনি আসাম দিয়ে যান নি। আমার কথা কি বোঝা যাচ্ছে? মৌনতাভিত্তিক যুক্তি বা argument from silence কোন ঘটনার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে ব্যবহৃত হলে সেটা সমস্যাজনক। পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ে যা বললেন সেটা আমার বক্তব্যের খণ্ডন নয়, দৃঢ়ীকরণ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইখতিয়ার তো ইবনে বতুতা বা মার্কোপোলো ধরনের পর্যটক অথবা স্যুয়াঙ চ্যাঙ বা ফা শিয়েনের মতো সন্ন্যাসী ছিল না যে আসামের উপর দিয়ে তিব্বতে গেলে কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। ইখতিয়ার যাচ্ছিল একদল লুটেরা নিয়ে। তারা পথে যেখান দিয়ে যাচ্ছিল সেখানেই যুদ্ধ বাঁধাচ্ছিল বা লুটপাট চালাচ্ছিল। সুতরাং ইখতিয়ার আর তার দল গোটা আসামকে এফোঁড় ওফোঁড় করে তিব্বতে গিয়ে থাকলে সে আদতে গোটা আসামটাই জয় আর লুট করে যাবার কথা তাই না! সেক্ষেত্রে বাংলার ইতিহাসের মতো আসামের ইতিহাসেও ইখতিয়ার ঠাঁই পেয়ে যেতো।

কথাটা কি পরিষ্কার হলো?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার এর ছবি

ষষ্ঠপাণ্ডব, ইতিহাসে কোন ঘটনার বর্ণনা থাকলে ঘটনা ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া যায়, কিন্তু বর্ণনা নেই মানে ঘটে নি, তা জোরাল যুক্তি নয়, সম্ভাবনা মাত্র।
তিব্বতে তো যেতে পারে নি। আসাম কেন দখল করে নি সেটা তো ঘটনাধারাতেই পরিষ্কার।
আসামের ইতিহাসে এর আদৌ কোন উল্লেখ নেই? আসামের উপর লেখা কিছু বইতে এর উল্লেখ আছে।

সমাচার এর ছবি

আবার বলি, ঘটনা ঘটলে বিবরণ থাকতে পারে, কিন্তু বিবরণ নাই মানে ঘটনা ঘটে নাই, তা নাও হতে পারে। আর আসামের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন তাঁরা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন তো। আর কানাই-বড়শী লিপির যে সমালোচনা যাকারিয়া হাজির করেছেন তা কনক্লুসিভ নাও হতে পারে।

মন মাঝি এর ছবি

জনাব, প্রথমতঃ কথাটা আমি বলি নাই এবং আপনাকেও কিছু বলি নাই - আপনি আমার কাছে জবাব দিচ্ছেন কেন? না-বলা কথা বলার জন্য খামাখা অভিযুক্ত করছেন কেন? আমার কথা কি বোঝা যাচ্ছে?

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

ও হ্যাঁ, তবে একটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল বটে - ইতিহাসরচনা শুরু না হওয়ার কারনে লিখিত সমসাময়িক সোর্স না থাকায় কোন ঘটনা ঘটেনি এমন দাবী যদি কেউ করে থাকে - এক্সপ্লিসিট বা ইমপ্লাইড যাই হোক - তাকেই কি আপনি argumentum ex silentio বলতে চাইছেন?

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ভারতে মুসলিমদের প্রথম আগমন প্রফেটের জীবদ্দশায়। সেটা দক্ষিণ ভারতে, সমুদ্র পথে। কেরালাতে নাকি দুই ক্বেবলাওয়ালা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। মসজিদের তথ্যটির সত্যতা যাচাই করিনি।

ভারতের সাথে মুসলিমদের প্রথম যুদ্ধ হয়েছে দ্বিতীয় খলিফা উমর বিন খাত্তাবের সময় ৬৪৪ সালে। সেনাপতি সুহাইল ইবনে আদী ইরাকের হাকাম ইবনে আ'মর এবং ইরানের উসমান ইবনে আবী আল আ'স-এর বাহিনীর সহযোগিতায় রাই রাজা রাসিলের বাহিনীর মুখোমুখি হয়। মুসলিমরা সিন্ধু নদের পশ্চিম তীর পর্যন্ত দখল করে ফেলে। খলিফার কাছে সংবাদ পৌঁছে সিন্ধুর পূর্ব তীরের দেশ বিরান। সেখানে লাভের আশা নেই। তাই তিনি সুহাইলকে ওখানেই থেমে যেতে নির্দেশ করেন। যে সংবাদবাহক খলিফা উমরকে এই সংবাদ দিয়েছিল সে সম্ভবত ভারতীয়দের টাকা খেয়েছিল অথবা ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নয়তো ওই সপ্তম শতকে মুসলিমরা ভারত দখল করে ফেলতো অথবা ভারতে মার খেয়ে বাড়ী ফেরত যেতো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

প্রফেটের জীবদ্দশায় মুসলিমদের এদিকে আসার তেমন কোন তথ্য প্রমাণ চোখে পড়েনি। ওমরের আগে দূরদেশে অভিযান পরিচালনার নজিরও দেখিনি। কেরালার যে মসজিদের কথা বলা হয় সেটাও নেহায়েত অনুমান। পুরোনো আমলের কথা বলতে গিয়ে দু চারশো বছর এদিকসেদিক করে ফেলা এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম একটা চরিত্র। তাছাড়া মুসলিমরা তখনো অত শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেছে বলে বিশ্বাস হয় না।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

উমরের আগে এদিকে কোন অভিযান হয়নি সে'কথা সত্য। তবে মসজিদটা প্রফেটের জীবদ্দশাতেই হয়েছিল। এই খবরটা দেখুন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

হ্যাঁ এই খবরের সুত্রে ভারতীয়দের দাবী মোতাবেক এটা ভারতের প্রথম মসজিদ এবং সেটা ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দেই। অবিশ্বাস্য লাগে, তবু এটা ঠিক যে বাণিজ্য সুত্রে আরবদের সাথে ভারতের যোগাযোগ ইসলামের অনেক আগের যুগের। সেই হিসেবে দেখতে গেলে হতেও পারে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ভদ্রলোকের নাম কিন্তু বখতিয়ার নয়, বখতিয়ার হল তাঁর পিতার নাম। তাঁর নাম ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ, আর তিনি হলেন বিন বখতিয়ার, অর্থাৎ বখতিয়ারের পুত্র। তবে খিলজি টাইটেলটা ব্যবহার করা যেতে পারে, কারন সেটা বংশ পদবী হাসি । এ বিষয়ে পাণ্ডবদা ইতিপুর্বে বিশদ জানিয়েছিলেন।

মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের বিষয়ে সমসাময়িক তথ্য জানার প্রায় একমাত্র উপায় হল মিনহাজ লিখিত তবাকাৎ ই নাসিরি, কিন্তু এই গ্রন্থেও রয়েছে নানা রকম অসঙ্গতি। যেমন- মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার ঠিক কবে নবদ্বীপ তথা বাংলা দখল করেছিলেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন দিন তারিখ নাই। তবে সেই গ্রন্থ অবলম্বন করে বিভিন্নজন অনুমানভিত্তিক বছর নির্ধারন করেছেন এরকমঃ র‍্যাভার্টি- ১১৯৩ সাল, ব্লখম্যান- ১৯৯৭-৯৮ সাল, ই থমাস- ১২০২ সাল এবং ষ্টুয়ার্ট- ১২০৩ সাল। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দোপধ্যায়ের অভিমত অনুযায়ী সালটি ১২০০ খ্রীস্টাব্দ।

তিনি নবদ্বীপ আক্রমন করলেন কেন, এ বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। নবদ্বীপ কি তখন বাংলার রাজধানী ছিল? যদি তাই হবে, তাহলে সেটা ত্যাগ করে এসে লক্ষণাবতীতে তাঁর রাজধানী স্থাপন করলেন কেন? তিনি কি আদৌ নবদ্বীপ দখল করেছিলেন? তাহলে এর পঞ্চাশ বছর পর মুগিসুদ্দিন উজবুককে কেন আবার নতুন করে নবদ্বীপ দখল করতে হল? লক্ষণাবতীর মত অতি গুরুত্বপুর্ন স্থান তিনি কিভাবে দখল করলেন, সে বিষয়েও কবি নীরব।

আলী মেচ তাঁকে তিব্বত আক্রমন করার জন্য বর্দ্ধনকোটের প্রান্তরে এনে হাজির করেন, যেখানে গঙ্গার চেয়ে তিন চারগুন চওড়া একটি নদী প্রবাহমান। মিনহাজ নিজে এই নদীর নাম বলেছেন বেগমতি, অন্যরা কেউ নমকদি, কেউ তমকরি কেউ বা ব্রহ্মপুত্র। বর্দ্ধনকোটের অবস্থান ছিল প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের কাছে, বগুড়ার মহাস্থানের কাছে এখনও বর্দ্ধনকোট নামে স্থান আছে। সে হিসেবে নদীটি করতোয়া হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তিস্তা নামে তখন বৃহৎ কিংবা উল্লেখযোগ্য কোন নদী ছিল না, ছিল ত্রিস্রোতা। ত্রিস্রোতার একটি হল করতোয়া, অন্য দুটি আত্রাই ও পুনর্ভবা। বর্দ্ধনকোট থেকে দশ দিন উজিয়ে এসে সেই নদীর একটি পাথরের সেতু পেরিয়ে তারপরের যে কাহিনী মিনহাজ বর্ননা করেছেন, তাতে অসঙ্গতি আরও অনেক বেশী। সে সকল অসঙ্গতি উপেক্ষা করলে অবশ্য একটি বিষয়ই থাকে, তা হল মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারের শোচনীয় ব্যর্থ অভিযান। তিব্বত তো বহু দূরের পথ, বিন বখতিয়ার সম্ভবত আসামের বন্য পার্বত্য অঞ্চলে কিছুদিন নানা দুর্ভোগ সহ্য করেই পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

হিমু এর ছবি

ইখতি-বখতি সাহেবের নামের এই বিন নিয়ে কিন্তু অনেক জলঘোলা হয়েছে। মেজর র‍্যাভার্টি তবকাৎ-ই-নাসিরির অনুবাদ করার সময় এই বিন হাজির করেন। তিনি নাকি বারোটি পুঁথি দেখেছিলেন, তার মাঝে চারটিতে "বিন" পেয়েছিলেন। র‍্যাভার্টির আবার বিন-বাতিক ছিলো, তিনি আলি মর্দানকেও আলি বিন মর্দান লিখে গেছেন। তবকাৎ-ই-নাসিরির সমসাময়িক গ্রন্থ তাজ-উল-মাসির এবং খানিক পরের গ্রন্থ ফুতুহ-উস-সালাতিনেও এনাকে ইখতিয়ারউদ্দিন (উপাধি) মুহম্মদ বখতিয়ার (নাম) খলজি বলা হয়েছে। আর তুর্কি-পার্সিদের নামের মধ্যে বিন খুব একটা চলতি কিছু ছিলো না। তৎকালীন আর কোনো তুর্কি শাসকের নামের মধ্যে কি বিন পাওয়া গেছে?

Emran  এর ছবি

মুহম্মদ বিন তুঘলক (যদিও সম্রাট হওয়ার আগে তাঁর নাম ছিল জুনা খান)।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মেজর র‍্যাভার্টি'র অনুবাদ পড়ার সময় নিচের ফুটনোট যখন পড়বেন তখন সেখানে নাস্তালিকে লেখা মন্তব্য/উদ্ধৃতিগুলো পড়ার চেষ্টা করবেন। ভাষাটা জানা না থাকলে বিষয়টা একটু কঠিন, তবে একটু চেষ্টা করলে পড়তে পারবেন। তাহলে দেখতে পাবেন ফারসী বা আরবী যখন ইংলিশ হয়েছে তখন কত পালটে গেছে। আমি এই পদ্ধতি অনুসরণের চেষ্টা করি। ভারতবর্ষের ইতিহাসের পুরনো বইগুলো সরাসরি ফারসী/আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা উচিত। এই কাজটা বাংলা একাডেমি বা এশিয়াটিক সোসাইটি বহু কাল আগেই করতে পারতো।

পার্সীরা নামের মাঝখানে 'বিন' বা 'ইবনে' ব্যবহার করার কথা না। তুর্কীস্তানীদের (তুর্কী নয়) মধ্যে এর ব্যবহার খুব অল্প, তুর্কীদের মধ্যে আরও কম। Emran-এর বলা মহম্মদ বিন তুঘলক অথবা ফিরোয বিন রজক'রা তুর্কীস্তানী, তুর্কী নয়।

ইখতিয়ার ছাড়া ভারতের তুর্কী শাসক কারা? কোন্‌ বংশ?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

তবকাৎ-ই-নাসিরির অনুবাদ বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার করা। তবে সেখানে তিনি বেশ কিছু ভুল অনুসিদ্ধান্তও যোগ করেছেন; যেমন তাঁর মতে বখতিয়ারের জয় করা নওদীয়াহ নদীয়া নয়, বরং উত্তরবঙ্গের নওদা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাংলা একাডেমি'র অনুবাদটি আমার চোখে পড়েনি। জনাব যাকারিয়া এটি কি মূল ভাষা (ফারসী) থেকে অনুবাদ করেছেন নাকি ইংলিশ থেকে? ইংলিশ থেকে অনুবাদ করা হয়ে থাকলে আমার আগ্রহ নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

হ্যাঁ, জনাব যাকারিয়া এটি কি মূল ফারসী থেকেই অনুবাদ অনুবাদ করেছেন, তবে ভূমিকায় তিনি যা বলেছেন, তাতে হতাশ হতে পারেন। ভূমিকায় তিনি বলেছেন- "ফারসী ভাষায় আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ" এবং "ইতিহাসেও আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত"। হয়ত বিনয় করেই বলেছেন, যাই হোক।
ইখতি-বখতি নাম প্রসঙ্গে তিনি পাদটীকায় কী বলেছেন তা নিজেই দেখুন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আবদুল্লাহ্‌ ভাই, খেয়াল করে দেখুন এখানে ফারসী ভাষা আর তার বাংলা উচ্চারণ যা দেয়া আছে তাতে ছোট ছোট এদিক ওদিক তো আছেই সাথে শব্দ বাদ দিয়ে যাওয়াও আছে। আর মূল ফারসী থেকেই যদি অনুবাদ হয়ে থাকে তাহলে পদে পদে মেজর সাহেবের দোহাই টানা হয়েছে কেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার এর ছবি

ছোটখাট এদিক ওদিক যা বর্ণান্তরে আছে সেটা অর্থোদ্ধারে কি কোন গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করছে? সেই আমলে একটা অপেক্ষাকৃত কম সুলভ মূল গ্রন্থ ফার্সি থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে মোটামুটি স্বীকৃত একটা ইংরেজি অনুবাদের দোহাই টানা কি অপ্রাসঙ্গিক?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনি ঠিকই বলেছেন যে ছোটখাটো এদিক ওদিক বা শব্দ ছুটে যাওয়া যা এখানে আছে সেটা অর্থোদ্ধারে গুরুতর সমস্যা করছে না। তবে এমনটা চোখে পড়লে পাঠকের আস্থা কমে যায়।

সেই আমল মানে কোন আমল? আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া সাহেবকৃত তাবাকাৎ-ই-নাসিরী'র বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৩ সালে। মূল গ্রন্থ (ফারসী) তখন দুর্লভ ছিল না। তাছাড়া দুনিয়ার সেরা গ্রন্থাগারগুলোর অনেকগুলোতে উনার অ্যাক্সেস ছিল। উনি নিজে ভালো ফরাসী আর আরবী জানতেন। নিজের অনুবাদের শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য উনি তাবাকাতের ইংরেজী, ফরাসী, আরবী, উর্দ্দু অনুবাদের সাথে যাচাই করে নিতে পারতেন, হয়তো তা করেছেনও। কিন্তু নিজের লেখায় পদে পদে মেজর সাহেবের দোহাই টানলে অনুবাদে পাঠকের আস্থা কমে যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার এর ছবি

যাকারিয়া সাহেব লিখেছেনঃ "মওলানা আবদুল হাই হাবিবী সম্পাদিত মূল ফারসী গ্রন্থটি এদেশে দুষ্প্রাপ্ত। ডক্টর আবদুল গফুর কাবুল থেকে গ্রন্থটি (দুই খণ্ড) যদি আনিয়ে আমাকে না দিতেন, তবে এ গ্রন্থের অনুবাদ আমার পক্ষে সম্ভব হত কিনা সন্দেহ"। আর র‍্যাভারটি সাহেব ১২টি পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেইসাথে বিপুল টীকাটিপ্পনি তো আছেই। ফলে যাকারিয়া সেই পাঠকেও সমুচিত গুরুত্ব দিয়েছেন। যাকারিয়া সাহেব অনুবাদ করতে গিয়ে ঠিক পূর্ণাঙ্গ পাঠ সমালোচনা বা টেক্সচুয়াল ক্রিটিসিজম করার মতো প্রস্তুতি হয়তো রাখতেন না। অবশ্যই এটা বিশ্বমানের বিদ্যাচর্চার জায়গা থেকে দৃষ্টিকটু বা অর্বাচীন ঠেকতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমার মতে সঙ্গত বলতে হবে।

সমাচার  এর ছবি

তুর্কিস্তানি আর তুর্কির পার্থক্যটা একটু খুলে বলবেন?
বখতিয়ার বা খলজিরা তুর্কি এটা নিশ্চিত হওয়া গেল কিভাবে? আদ্রেঁ উইঙ্ক থেকে শুরু করে বেশ কিছু ঐতিহাসিক এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আর পার্সিদের নামে বিন কম থাকত এই তথ্য কোথায় পেলেন? সামানি, ঘোরি, খারেজমি, গজনবি সুলতানদের নামের তালিকাটা দেখেন।

আলমজান এর ছবি

সুলতানদের নামের মধ্যে তো বাবার নাম না থাকাই অস্বাভাবিক, কারণ দুই একটা একসিডেন্ট বাদ দিলে বাবার ছেলে হওয়াই সুলতান হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। সুলতান দিয়া সব মাপা কি ঠিক? আম আদমীর নামের মধ্যে যে বিন কম থাকত, ইহা বুঝা যায় বখতিয়ার খিলজীর সঙ্গে যে খিলজীরা বাংলায় আসছিল, তাদের নামে। আলী মর্দান, মোহাম্মদ শিরান, গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ, কারুর নামের মধ্যেই তো বিন নাই। সম্ভবত এই কারনে যে উহারা ছোট ঘরের পোলা। উহারা সুলতানের ঘরের পোলা হইলে হয়ত চোদ্দটা বিন লাগাইয়া পরদাদার গুষ্ঠী জাহির করত।

অতিথি লেখক এর ছবি

তুর্কিরা হল আনাতোলিয়ার তুর্কীভাষী বাসিন্দা। আর তুর্কিস্তানীরা হল মধ্য এশিয়ার তুর্কিক জনগোষ্ঠী, যারা বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, এবং জিঞ্জিয়াং (চীন) অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। আফগানিস্তান, রাশিয়া, এবং মঙ্গোলিয়াতেও কিছু তুর্কিক বাস করে।

Emran

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই হচ্ছে তুর্কীস্তানী লোকজন। আর এই হচ্ছে তুর্কী লোকজন। একটু কষ্ট করে পড়ে নিন।

না, ইখতিয়ার তুর্কী এটা খুব নিশ্চিত তথ্য না। বরং 'খিলজী' গোত্রের বেশিরভাগ মানুষ তুর্কীস্তানী। সুতরাং গরমশিরের খিলজীরা তুর্কী নাকি তুর্কীস্তানী এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।

সামানীরা পারসী। তাদের সুলতানদের নামের মাঝখানের 'বিন' বা 'ইবনে' মূলত আরবীভাষী ঐতিহাসিকদের কৃতিত্ব। ফারসীভাষী ঐতিহাসিকরাও তখন কলোনিয়াল চশমা পড়ে 'বিন' বা 'ইবনে' লিখে গেছেন। পারসীদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' না থাকার মূল কারণ এই শব্দ দুটো আরবী, ফারসী নয়।

ঘোরীরা তাজিক নাকি খাঁটি পারসী সেটা নিশ্চিত না। এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' থাকার ব্যাখ্যা পূর্বরূপ।

খোয়ারেজমীরা আসলে পারসী সাম্রাজ্যে বসবাসকারী নন্‌-রেসিডেন্ট তুর্কীস্তানী। এদের ওপর থেকে আরবদের প্রভাব যত কমেছে এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' ইত্যাদির ব্যবহার তত কমেছে। শুধু তাই না এক সময় এরা আরবী পদবী খলিফা/সুলতান/আমীর বলার বদলে ফারসী পদবী 'শাহ্‌' ব্যবহার করা শুরু করেছে।

গজনভীরা খোয়ারেজমীদের মতো পারসী সাম্রাজ্যে বসবাসকারী নন্‌-রেসিডেন্ট তুর্কীস্তানী। এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' নাই। এদের প্রচলিত নামগুলো পুরনো পারসী সম্রাটদের মতো এক শব্দের (যথা, সবুক্তগীন, ইসমাইল, ইব্রাহিম, মাহমুদ, তুঘরুল ইত্যাদি)। এরাও নিজেদেরকে আরবী পদবী খলিফা/সুলতান/আমীর বলার বদলে ফারসী পদবী 'শাহ্‌' ব্যবহার করতো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সমাচার  এর ছবি

১। উইকি নিবন্ধে শুরুতেই যেভাবে বলেছে যে 'তুর্কি' বলতে আনাতোলিয়াবাসী তুর্কিজাতীয়দের বোঝায়, এই সংজ্ঞা সেই যুগের জন্য অপ্রযোজ্য। যাই হোক, মূল কথা হচ্ছে, খলজিরা খুব সম্ভব তুর্কি ছিল না।
২। আপনি লিখেছিলেনঃ "পার্সীরা নামের মাঝখানে 'বিন' বা 'ইবনে' ব্যবহার করার কথা না।" তারপর জানিয়েছেন যে পার্সি সুলতানদের নামে "বিন" পেলে তা আরবিভাষী ঐতিহাসিকদের কৃতিত্ব।
তো সামানি সুলতানদের মুদ্রায় নামে যে "বিন" থাকত সেটা কি আরবিভাষী ঐতিহাসিক বা তাঁদের ফার্সিভাষী সাগরেদরা বসাতেন?
মূল কথা ঐ "আরবি প্রভাব" বাড়া কমা। যতদিন রাজকীয় পরিচয় নির্মাণে আরবি প্রভাব বেশি ছিল, ততদিন "বিন" মোটামুটি বহাল তবিয়তে ছিল। অর্থাৎ রাজার জাতিগত পরিচয়ের চেয়েও অনেকাংশে বিরাজমান রাজকীয় সংস্কৃতির স্বরূপ ছিল মূল বিষয়।

সমাচার  এর ছবি

পুনশ্চ, গজনবি মুদ্রায় "বিন" শব্দের ব্যবহার আছে। এও ঐ রাজকীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা তো বটেই। কিন্তু রাজপুরুষ "পার্সি" বা "তুর্কি" বলে রাজকীয় নামে "বিন" থাকবে না এটা খোঁড়া যুক্তি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যেখানে গঙ্গার চেয়ে তিন চারগুন চওড়া একটি নদী প্রবাহমান

- ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের কোর্স পালটে গিয়ে আজকের যমুনা নদী তৈরী হতে তখনো শ'পাঁচেক বছর বাকী ছিল; তো ঐ আমলে উত্তরবঙ্গ বা হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গার চেয়ে তিন/চার গুণ চওড়া নদী মিনহায হুজুর কোথায় পেলেন? বাঙালী বা পূর্ব ভারতীয়রা কি নগরের নামের শেষে 'কোট' ব্যবহার করে? 'বর্দ্ধনকোট' নামটাই তো সঠিক বলে মনে হচ্ছে না। আলী মেচ-এর দেশ খুব কাছাকাছি উত্তরবঙ্গের কোথাও হয়ে থাকলে তার পক্ষে আবার দক্ষিণ দিকে নেমে তথাকথিত বর্দ্ধনকোটে নিয়ে যাবার কারণ কি? সেখান থেকে আবার দশ দিন উজিয়ে (১০০ থেকে ৩০০ মাইল) উত্তরে কোথায় গেলো? মহাবীর ইখতিয়ার তো মনে হচ্ছে তাহলে বাংলার সীমাই ছাড়াতে পারে নি! আর পাহাড়ী নদী কি চওড়া বেশি হয়, নাকি গভীর বেশি হয়? মিনহায হুজুর কী বলেন?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গার চেয়ে তিন/চার গুণ চওড়া নদী মিনহায হুজুর কোথায় পেলেন?

সেটা তো আমারও প্রশ্ন। হতে পারে, লোকশ্রুতিতে শোনা ব্রহ্মপুত্রকে তিনি এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন, কিংবা ইখতিয়ারের যে সহযোদ্ধার কাছে তিনি ঘটনার বর্ননা শুনেছেন, বয়সজনিত কারনে তাঁর স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল, কিংবা সে ব্যাক্তির হয়ত বাড়িয়ে বলার অভ্যাস ছিল। তাঁর বর্ননা মতে এই সেতুর ছিল ২০টি খিলান, পাথরের তৈরি খিলানগুলি যদি ১০/১২ চওড়া হয়ে থাকে(এর চেয়ে বেশী হওয়া সম্ভব নয়), তাহলে সেতুর দৈর্ঘ ২০০/২৫০ ফুটের বেশী হয় না। সেখানে গঙ্গার গড় প্রসস্থতা ১০০০ ফুট, সে হিসাবে বাগমতির প্রসস্থতা হওয়া উচিৎ ছিল ৩০০০ ফুট।

মহাবীর ইখতিয়ার তো মনে হচ্ছে তাহলে বাংলার সীমাই ছাড়াতে পারে নি

আমারও তাই মনে হয়। মিনহাজ সাহেব জানিয়েছেন সেতু পার হয়ে তিনি ১৫ দিন ধরে পথ চলে তিব্বতের প্রান্তরে এসে উপনীত হন। তিনি যদি করতোয়া পার হয়ে ১৫ দিন ধরে পথ চলেন, তাহলে আর যাই হোক, তিব্বতের ধারে কাছেও পৌঁছতে পাড়ার কথা নয়।

হিমু এর ছবি

বখতিয়ারের অভিযান শুরু হয়েছিলো জানুয়ারি মাসে। গঙ্গার শীতকালীন প্রবাহ মনে হয় একটু কম, সেক্ষেত্রে নদীর প্রশস্ততাও কমে আসার কথা।

আর মিনহাজের বর্ণনায় নদীর দুটো অংশের কথা, বা দুটো নদীর কথা আছে। যেটাকে তিনি গঙ্গার চেয়ে তিনগুণ প্রশস্ত ও গভীর বাঙ্গামাতি বলছেন, সেটা কিন্তু বখতিয়ারসেনা পার হয়নি। সেটার তীর ধরে দশদিন এগিয়ে তারা পাথরের সেতুর দেখা পায় (সিলহাকোপুল বা সিল সাকো (শিলাসাঁকো, স্কেচ দেখুন), যেটা আসামের বরনদীর ওপর)। সেখানে নদীর প্রশস্ততা গঙ্গার তিনগুণ, এমন কোনো কথা মিনহাজ বলেননি।

নলিনীকান্ত ভট্টশালী ধারণা করেছিলেন, বাঙ্গামাতি আসলে নদীর নাম নয়, বরং স্থানের নাম, এবং এটি রাঙ্গামাতি বা রাঙামাটি হবে (ফারসি বে আর রে গুলিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়)। মন্তখাব-উৎ-তাওয়ারিখে বদাউনি কিন্তু এ প্রশস্ত নদীর নাম লিখেছিলেন ব্রহমনপুতর। কামরূপে ব্রহ্মপুত্রের তীরে রাঙামাটি নামের জায়গা দিয়ে বখতিয়ার কামরূপে প্রবেশ করেছিলেন, এমনই অর্থোদ্ধার করেছেন কেউ কেউ। করতোয়ার তীর ধরে কিছুদূর এগিয়ে ব্রহ্মপুত্রের আদিপথ পর্যন্ত যাওয়া তো আর অসম্ভব নয়?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

মিনহাজের কাহিনীতে অনেক অসঙ্গতির কারনেই নদী নিয়েও এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। মর্ধানকোট বা বর্দ্ধনকোটের নদীটি যদি করতোয়া হয় এবং তা গঙ্গার চেয়ে তিন গুণ প্রসস্থ হয়, তাহলে এক ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করে। আবার যদি সেটা ব্রহ্মপুত্র হয়, তাহলে তা অন্যরকম প্রশ্নের উদ্রেক করে। তবে বাগমতির বদলে রাঙামাটি অন্য আর এক ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। পশ্চিম আসামের বড় একটি অংশ এক সময় রাঙামাটি নামে অভিহিত হত।

হাসিব এর ছবি

বেগমতি আরেকটা বানান।
ডঃ আব্দুল করিমের বইতে মিনহাজের সূত্রে বলা হয়েছে,
লখনৌতি থেকে বের হয়ে উত্তরপূর্ব দিকে কয়েকদিন যাবার পর বর্ধনকোট নামে এক শহরে পৌঁছান। এই শহরের পূর্বদিকের নদী বেগমতি অতিক্রম না করে পাড় ধরে ১০ দিন চলার পর একটা পাথরে বানানো সেতু পার হন। এই সেতু পার হবার ১৫ দিন পর এক জায়গায় ইখতিয়ারের বাহিনী আক্রমণের শিকার হয়।
লখনৌতি থেকে ২৫ দিন হেঁটে আসলে কোথায় পৌঁছানো যায়? সিলেটের পাহাড়ে?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ফারসি বে আর রে গুলিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়

- দ্বিমত। ফারসীতে এই দুই বর্ণের চেহারা একেবারে ভিন্ন। বাংলায় বরং 'ব' আর 'র' গুলিয়ে যাবে। ফারসীতে 'দ', 'জ/য/ঝ' আর 'র' গুলিয়ে যেতে পারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

তবকাৎ-ই-নাসিরি ১২৬০ সালে শেষ করা হাতে লেখা পুঁথি। গবেষকদের হাতে যে কপি গেছে, সেটা আসল না হয়ে অনুকৃতি হওয়াই মনে হয় স্বাভাবিক। ঐ আমলেও নিশ্চয়ই দুই-চার ঘর "পরিস্থিতির স্বীকার" পার্টি ছিলো।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হে হে ইতিহাস রচনায় পরিস্থিতির শিকার হবার ব্যাপারে ইবনে খালদুনের তত্ত্ব পদে পদে স্মরণীয়! দেঁতো হাসি


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

নোট: "পরিস্থিতির স্বীকার" পার্টি = যারা পরিস্থিতির শিকারকে পরিস্থিতির "স্বীকার" লেখে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এইবার সব কিলিয়ার! দেঁতো হাসি আমি অন্য কিছু বুঝেছিলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

মিনহাজের মতে, এই শহর নাকি প্রাচীনকালে গরশাসপ শাহ (সম্ভবত পৌরাণিক চরিত্র) নামে কোনো এক চরিত্র চীন থেকে ফেরার পথে পত্তন করেন। রংপুর-বগুড়া এলাকার বর্ধনকুঠিকে বর্ধনকোট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর সুরক্ষিত স্থান অর্থে "কোট" শব্দটা বাংলা, তৎসম মূল থেকে এসেছে। বখতিয়ারের খুনী আলি মর্দানও নারকোটি নামের এক এলাকা শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিলো।

বর্ধনকোট থেকে নদীর তীর ধরে দশদিন এগোনোর পর কুড়িটা খিলান আছে, এমন এক পাথরের সেতুর দেখা মেলে। বখতিয়ার দু'জন সেনানায়ককে সসৈন্য এ সেতু নিরাপদ রাখার দায়িত্ব দিয়ে সেতু পার হন। তারপর পনেরো দিন তিনি গিরিসঙ্কটের ভেতর দিয়ে যাত্রা করে ষোড়শ দিনে সমতলভূমিতে পৌঁছান। সেখানে একটি দুর্গ পেয়ে সেটি তিনি আক্রমণ করেন, কিন্তু ঐ এলাকার লোকজনও রুখে দাঁড়ায়। স্থানীয়দের অস্ত্র ছিলো বাঁশে তৈরি বর্শা এবং বাঁশ-রেশমের বর্ম ও শিরস্ত্রাণ, তারা অনেক লম্বা ধনুক ব্যবহার করতো। বখতিয়ারের বাহিনী এদের "তুর্কি" হিসেবে শনাক্ত করে। এ লড়াইয়ে বখতিয়ারের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। বন্দীদের জেরা করে জানা যায়, অকুস্থল থেকে ৫ ফারসাং (একটা ঘোড়া ঘণ্টায় যতখানি হাঁটতে পারে, কমবেশি ৩ মাইল বা ১২ হাজার হাত) দূরে কারামবাত্তান নামে এক মস্ত শহর আছে, সেখানে ৫০ হাজার অশ্বারোহী "তুর্কি" সৈন্য অপেক্ষা করছে, তাদের ডেকে আনার জন্যে লোক এরই মাঝে যাত্রা করেছে, পরদিন সকালেই তারা হাজির হবে। মিনহাজ পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানেন, কারামবাত্তান প্রকৃতই বড় শহর, তার প্রাচীর পাথরের, প্রতিদিন তার বাজারে ১৫০০ ঘোড়া বিক্রি হয়।

বখতিয়ার এসব শুনে নিজের সেনানায়কদের সাথে আলাপ করে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার ফেরার পথ কামরুদের (কামরূপ) রাজা পুরোটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাতে মানুষ বা ঘোড়ার খাবার না মেলে। বখতিয়ারের সেনা তখন নিজেদের অভুক্ত ঘোড়া মেরে খেতে বাধ্য হয়।

আবার সেই পাথরের সেতুর কাছে এসে বখতিয়ার দেখতে পান, এর দুটো খিলান কামরূপের রাজা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার নিযুক্ত দুই সেনানায়ক নিজেদের মাঝে ঝগড়া করে দায়িত্ব ছেড়ে সরে গেছে। নদী পার হওয়ার জন্য কোনো নৌকাও সেখানে ছিলো না। নৌকা সংগ্রহের জন্যে তিনি যখন একটি স্থান চয়ন করলেন, তখন তাকে বলা হলো, অদূরেই একটি বড় মন্দির আছে, সেখানে সোনা ও রূপার বড় বড় মূর্তি আছে, যার ওজন ২ হাজার মিসকাল (কাবুল স্ট্যান্ডার্ড ধরলে ৯.২ কেজি)। বখতিয়ার তখন সসৈন্য সে মন্দিরে আশ্রয় নেন। কামরূপের রাজা তখন এ খবর পেয়ে লোক লাগিয়ে পুরো মন্দির বাঁশের সড়কি পুঁতে ঘেরাও করেন। বখতিয়ারের বাহিনী তখন ঘেরাও ভেঙে নদীর দিকে ছোটে, কামরূপসেনা পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু নদী অত্যন্ত দুস্তর থাকায় বখতিয়ার মাত্র শ'খানেক সৈন্য নিয়ে নদী পার হতে সক্ষম হন, বাকিরা মারা পড়ে। তার ফিরে আসার খবর পেয়ে আলি মেচের আত্মীয়রা সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং অনেক সেবা করে দেওকোটে পৌঁছে দেয়। সেখানে ফিরে বখতিয়ার নিহত সৈন্যদের স্ত্রী-সন্তানদের রোষের মুখে পড়েন। তিনি পথে বেরোলে সবাই তাকে গালাগালি করতো। অভিযানের ক্লান্তি ও মনপীড়ায় ভুগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং আলি মর্দান এক ফাঁকে পাহারা এড়িয়ে তার আস্তানায় ঢুকে ছুরি মেরে তাকে বধ করে।

বখতিয়ারের বাহিনী কোথায় কামরূপসেনার হাতে মার খেয়েছিলো, সে জায়গাটি শনাক্ত করা হয়েছে। গৌহাটির কাছে কানাই-বড়শী গ্রামে একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেখানে লেখা আছে, ১১২৭ শকাব্দের ১৩ চৈত্র সমাগত "তুরুস্ক"গণ এখানে বিধ্বস্ত হয়। কানাই-বড়শী গ্রামের অদূরে সিলহাকোপুল এলাকায় পাথরের সেতুও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ নিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী আলোচনা করেছিলেন। কারামবাত্তান শহরকে ভূটানের কারুগোম্পা ধরা হয়।

বখতিয়ার ভূগোল-অশিক্ষিত ছিলেন, তার ধারণা ছিলো কামরূপ পেরোলেই তিব্বত-তুর্কিস্তান। তার বাহিনী ভূটানিদের "তুর্কি" হিসেবে শনাক্ত করে, সম্ভবত গাত্রবর্ণ ও মঙ্গোলয়েড চেহারার কারণে। ঐ এলাকার ভূপ্রকৃতি সম্পর্কেও তিনি আগাম কোনো তথ্য সংগ্রহ করেননি, অভিযানে বেরিয়ে তিনি এর অসারতা টের পান। কৌশলেও তিনি স্থানীয়দের কাছে ধরা খান।

দ্রষ্টব্য যে মিনহাজ-ই-সিরাজ তবকাৎ-ই-নাসিরি রচনা করেন বখতিয়ারের মৃত্যুর প্রায় চার দশক পর, তার সঙ্গীদের সাক্ষাৎকার থেকে তথ্য নিয়ে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'কোট' বাংলা শব্দ হলেও নগরের নামের শেষে কোট যোগ করা বা কুঠি-কে কোট লেখা এটা ফারসীভাষী লেখকদের কাজ বলে মনে হচ্ছে। যেমন, ইংরেজরা চিটাগাং, সিলহেট, ড্যাকা, রংপোর, জ্যাসোর ইত্যাদি বানিয়েছিল।

আপনি যা বর্ণনা দিলেন তাতে আর সংশয়ের অবকাশ নেই। মহাবীর ইখতিয়ার আসামের লোকজনের হাতেই পিটুনিটা খেয়েছিলেন।

কারামবাত্তানের ব্যাপারে ভট্টশালী মহাশয়ের ব্যাখ্যা মানতে পারছি না। ইখতিয়ার যেখানে মার খেয়েছিল সেই হাজো-গুয়াহাটি এলাকা থেকে ভুটান সব আমলেই দূরে ছিল। আর কারু গোম্পা লাদাখে না?

ইখতিয়ারের ভূগোল-ভূপ্রকৃতি-আবহাওয়া তো বটেই ভিন্ন জাতির মানুষের ভিন্ন প্রকারের অস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কেও ধারণা ছিল না।

শুধু সাক্ষাতকারের ওপর নির্ভর করে কোন বয়ান লিখলে তাতে এমন বড় বড় প্রমাদ/বিভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। রাসু'র বর্ণনায় ময়নাদ্বীপে বাঘ, সিঙ্গী সবই ছিল। একটু মাথা খাটালে বোঝা যায় ময়নাদ্বীপে বাঘ থাকা সম্ভব হলেও সিংহ থাকা সম্ভব নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু এর ছবি

ইখতিয়ার যেখানে মার খেয়েছিল সেই হাজো-গুয়াহাটি এলাকা থেকে ভুটান সব আমলেই দূরে ছিল।

বখতিয়ারসেনা দুই জায়গায় মার খেয়েছে। প্রথমবার খেয়েছে "তিব্বত" যাওয়ার পথে, যেটা হাজো-গুয়াহাটি থেকে পনেরো দিন যাত্রাপথের দূরত্বে। কারামবাত্তান তার খানিক দূরে। মিনহাজ লিখে গেছেন, কারামবাত্তান থেকেই "তানগানাহ ঘোড়া" এনে লখনৌতি রাজ্যে বিক্রি করা হতো। এটাকে টাঙন ঘোড়া ধরে নিয়েছেন অনেকে, কাজেই কারামবাত্তান ভূটানে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কানাই-বড়শীর কাছে মার খেয়েছে দ্বিতীয়বার।

সমাচার এর ছবি

লখনৌতিতে অবস্থানকালে মিনহাজ কারামবাতানের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন কামরূপ ও তিব্বতের মধ্যে ৩৫টি সুবিখ্যাত গিরিপথ আছে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বিন বখতিয়ার সম্ভবত আসামের বন্য পার্বত্য অঞ্চলে কিছুদিন নানা দুর্ভোগ সহ্য করেই পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তিব্বত যাবার পথে আসামের উপর দিয়ে যাবে কেন এই প্রশ্নটা মূলতবী রেখে মনে পড়লো আসাম অভিযানও সহজ কাজ ছিল না। এই সেদিন মহা পরাক্রমশালী মোগল সেনাপতি মীর জুমলা আসাম অভিযানে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়ে ফেরত আসার পথে প্রাণত্যাগ করলেন। মুসলমান সেনাপতিরা দক্ষিণ পূর্বে যতখানি বীরত্ব দেখাতে পেরেছেন হিমালয়ের দিকে গেলেই কেন জানি বারবার হোঁচট খেয়েছেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বগুড়া রংপুর দিনাজপুর কুচবিহার সহ তখনকার উত্তরবঙ্গের অনেক অংশই কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমনকি বর্দ্ধনকোটের সমীপে যে করতোয়া নদী, তার পুর্ব থেকেই শুরু হত কামরূপ রাজ্যের সীমা। সেই অর্থে আসাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

খিলজি সাহেব মনে হয় তিব্বতের এই চিপায় পৌঁছেছিলেন। এটাই তিব্বতের চাম্বি উপত্যকা। মূল তিব্বত এখান থেকে অনেকদূর, অগম্য। কিন্তু বাংলা থেকে এই অংশের দূরত্ব খুব বেশী না।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

হ্যাঁ, এটা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে লখনৌতি থেকে খুব বেশী পুবে না যেয়ে করতোয়া ধরে এগিয়ে এখনকার রংপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, শিলিগুড়ি পেরিয়ে সিকিম রাজ্যে ঢুকে পরলেই হল। তখন সেটাই তিব্বত, অনেক পরে ইংরেজরা সেটা তিব্বতিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। কামরূপের ব্যাপারটাও এতে মিলে যায়, কিন্তু সমস্যা বেঁধে যায় গঙ্গার চেয়ে অনেক বড় একটা নদী নিয়ে। ব্রহ্মপুত্র ছাড়া সেরকম নদী আর নেই। আর ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে গৌহাটির দিকে চলে গেলে আবার চাম্বির রুটটা বাতিল হয়ে যায়। মুশকিল!

হাসিব এর ছবি

নীড় সন্ধানী, আপনি যে বইগুলো থেকে লিখেছেন সেগুলো মনে হয় ফেলে দেয়াই ভালো হবে চাল্লু

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ফেলে দেয়া লাগবে না, ওগুলোর কাজ অন্য বিষয়ে বহাল আছে। অন্য বিষয় পড়তে গিয়ে খিলজি সাবের এই ঘটনা চোখে পড়ছিল। লেখার মূল ইস্যু হলো খিলজি সাবের শেষ অভিযানটা চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হইছিল। ওইটা ঠিকই আছে। বিতর্কটা হলো তিনি কোন পথ দিয়ে কিভাবে গেলেন এবং যেখানে মারা খেলেন সেটা তিব্বত কিনা। আর সেই ঘটনা যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী কেউ লেখেনি, তাই এই বিষয়ে শতভাগ সহি কিছু বলা সম্ভব না। সব তথ্যকেই অনুমান এবং যুক্তির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হাসিব, পিঠে ছালা বেঁধে একটা কথা বলি। বাংলা ভাষায় লেখা, এখন বাজারে মেলে, ইতিহাসের বইগুলোর খুব ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সব বিশুদ্ধ গল্পের বই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা ইংলিশ বই পড়ে সেটার ভাবানুবাদের সাথে নিজস্ব চিন্তাভাবনা, প্রচলিত গালগল্প, কিছু মীথ মিলিয়ে লেখা হয়। ভারি ভারি নামের এসব বই (যাদের লেখকরা সাধারণত আরও ভারি ভারি নামের) আমার কাছে বিশুদ্ধ আবর্জনা বলে মনে হয়। আমাদের মতো মানুষদের তাই ভরসা ইংলিশ বই পড়া।

কিন্তু পড়ার সময় একটু যুক্তি খাটিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় ইংলিশ বইগুলোতেও (ক) কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে (খ) কিছু বিষয়ের ভুল ইন্টারপ্রিটেশন করা হয়েছে (গ) কিছু বিষয় লেখক বুঝতে পারেননি (ঘ) কিছু ক্ষেত্রে লেখকের সাথে ঐ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও সামাজিক মূল্যবোধের পার্থক্য ব্যাপক থাকায় লেখক তাদের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি (ঙ) সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত জীবন দর্শন ও আইনের আলোকে পূর্বতন ঘটনাবলীকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই তালিকাটা আরও লম্বা করা যাবে।

জাতীয় পর্যায়ে অন্তত এই ভূখণ্ডের ইতিহাস রচনার কোন উদ্যোগ না থাকায় ইংলিশ ভিন্ন অন্য ভাষা, যেমন, ফারসী, আরবী, হিন্দী, উর্দ্দু, সংস্কৃত, পালি, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজ, চীনা ভাষায় লেখা এই অঞ্চলের ইতিহাসের বই/লেখাগুলো বাংলায় অনুবাদ হয় না। ভাষার বাধাটা অতিক্রম করা গেলেও আরও একটা বাধা থেকে যায়। কলোনিয়াল প্রভু এবং দাস উভয়ে কলোনিয়াল চশমা পড়ে ইতিহাস লেখেন। তাতে সাধারণ মানুষের আসল অবস্থা জানার বিশেষ উপায় থাকে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

ইংরেজি লেখা অনেকগুলোর মূল আশ্রয়ের একটা একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে গড় ট্রেন্ড হলো ইংরেজিতে যা লেখা সেটাকে বেটার ধরে নিয়ে আগানো। মনন ডিকলোনাইজ করাটা জরুরী। এখানে কলোনি বলতে ইউরোপিয়ান কলোনিয়াল কেবলাই একমাত্র কেবলা না। ইউরোপিয়ান ঝুটা, বাকি সব ঠিক এটাও একটা চিন্তাপদ্ধতি। এ থেকেও সাবধান থাকা জরুরী।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে ইউরোপই একমাত্র কেবলা না। চিন্তায়-মননে পরাধীন মানুষের কেবলা দিকে দিকে। কিছু দিন আগে একটা হিন্দী সিনেমাতে দেখলাম এক সাহেব যুক্তি (!) দিচ্ছে, "I am White, so I am right!" ব্যাপার হচ্ছে এই যুক্তিতে ভারতবর্ষের মানুষদের বড় অংশ গভীর আস্থা রাখে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।