মধ্যযুগে চট্টগ্রামের ইতিহাসের বিভ্রান্তিকর সময় ১৫৪০-১৫৮৬

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: রবি, ৩১/০৩/২০১৯ - ৮:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[মুখপাঠ: এটি চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রশ্নবোধক পোস্ট। চট্টগ্রামের ইতিহাসটা বাংলার মূল ইতিহাস থেকে একটু আলাদা এবং গোলমেলে। আদিকাল থেকেই চট্টগ্রাম বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নভাবে শাসিত হয়েছে বিভিন্ন পরদেশী শাসকদের হাতে। হাজার বছরের ইতিহাসে চট্টগ্রাম বহুবার শাসিত/দলিত/মথিত হয়েছে আরাকান, ত্রিপুরা, সুলতান, পাঠান, মোগল ইংরেজ ইত্যাদি নানান শক্তির হাতে। গত ৫০০ বছরের শাসনকালের মধ্যে ষোড়শ শতকের প্রায় পুরোটা চট্টগ্রাম নিয়ে ত্রিমুখী কাড়াকাড়িটা এত বাড়াবাড়ি ছিল যে এই অঞ্চলটা কখন কার দখলে কতদিন ছিল কেউ শতভাগ নিশ্চিত করতে পারেননি। এর মধ্যে সবচেয়ে অস্পষ্ট সময়কালটা হলো ১৫৪০-১৫৮৬। এই সময়টাতে বারবার হাতবদল হয়েছে চট্টগ্রাম। একের পর এক আরাকান, পাঠান ও ত্রিপুরার মধ্যে যে বিচিত্র রকমের যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে সেই ইতিহাসের সত্যিকারের চেহারাটা খুঁজে বের করা পাঠকের জন্য দুরূহ কাজ। শুধু পাঠকই নন গবেষকরা ও বিভ্রান্ত। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের দেয়া তথ্যের মধ্যেও প্রচুর ফারাক দেখা যায়। তাই এই সময়কালকে অস্পষ্ট বা বিভ্রান্তিকর সময় মনে হয়েছে আমার। তবে আমার বিশ্বাস এখানে কেউ না কেউ এই বিপুলায়তনের প্রশ্নবোধক লেখাটি পড়ে কোথাও কোথাও আলোর নিশানা দিতে পারবেন। লেখার মধ্যে তথ্য বিভ্রাট থাকলে সেটি শোধরানোর পরামর্শ দিতে পারেন। তাহলে তা হবে পোস্টের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।]

নসরত শাহ থেকে শেরশাহ, ত্রিপুরা এবং আরাকান - বিক্ষিপ্ত শাসনপর্ব
১৫৩৮ সালে গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম শেরশাহের অধিকারে এসেছিল অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু বাংলায় ক্ষমতার পালাবদলের দুর্বলতার সুযোগে আরাকানের মেঙবেঙ চট্টগ্রাম দখল করে নিয়েছিলেন। ফলে ১৫৪০-৪১ সাল থেকে চট্টগ্রাম আবারো বাংলার হাতছাড়া হয়ে যায়। আরাকানে মেঙবেঙ বা মিনবিন এর শাসনকাল শুরু হয়েছিল ১৫৩১ সালে এবং দীর্ঘ ২২ বছর সেই শাসন জারি ছিল। ১৫৪১ থেকে ১৫৫৩ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকান অধিকারে ছিল বলে অনুমান করা যায়। ১৫৫৩ সালে মেঙবেঙ এর মৃত্যুর পর বাংলার শাসক শামসুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ গাজী আরাকানমুখী অভিযান চালান ১৫৫৪ সালে। সেই অভিযানে চট্টগ্রাম দখল করে আরো দক্ষিণে আরাকানের রাজধানী ম্রোহাং পর্যন্ত অধিকার করেন। তবে ম্রোহাং দখলে রাখা সম্ভব ছিল না বলে তার অধিকার ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত দখলে রাখেন। এই সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার সুলতানের অধীনে ছিল বছর দুয়েক।

রাজমালায় বলা হয়েছে বিজয়মানিক্য বঙ্গদেশে অভিযান চালিয়ে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে চট্টগ্রাম কেড়ে নিয়ে রামু অবধি অধিকার করেছিলেন এবং উত্তরে সোনারগাঁও পর্যন্ত দখল করেছেন। তবে ওই ঘটনার সময়কাল নিয়ে বড় ধরনের বিভ্রান্তি আছে। বাংলার সব প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকগন সময়কালটিকে ১৫৫৬ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু রাজমালার বিজয়মানিক্য খণ্ডে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে চট্টগ্রাম অধিকারের ঘটনাটি ঘটেছিল সোলায়মানের সময়কালে। যদি সোলায়মান কররানির সময়কালে ঘটে থাকে তাহলে সময়কালটা ১৫৬৭ সালের পর হবার কথা। কেননা ১৫৫৬ সালে সোলায়মান ক্ষমতাসীন ছিলেন না। সোলায়মান কররানির সময়কাল হলো ১৫৬৬-১৫৭২। রাজমালাতে সোলায়মানের উড়িষ্যা বিজয়ের কথাও লেখা আছে। উড়িষ্যা বিজয়ের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৫৬৮ সালে।

ভূপেন্দ্রচন্দ্র সম্পাদিত রাজমালায় সেই সময়কালের ঘটনাগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে-

পরাজিত ত্রিপুরাবাহিনীকে চরকা উপহার
বিজয়মাণিক্যের বিপুল সেনা মধ্যে একটি পাঠান ফৌজ গঠিত হইয়াছিল। চট্টগ্রামে মুসলমান শক্তি বৃদ্ধি পাইতেছিল দেখিয়া বিজয়মাণিক্য দুই হাজার সৈন্য লইয়া স্বয়ং যুদ্ধ যাত্রা করেন। তাঁহার সঙ্গে এক সহস্র পাঠান সৈন্য গিয়া মিলিত হইবে এইরূপ কথা রহিল। বিজয়মাণিক্য চলিয়া যাওয়ার পর পাঠানদের সহিত উজিরের ঝগড়া বাঁধিয়া গেল। রাজকোষ হইতে অর্থের ব্যবস্থা হইলেও বেতন বাকী পড়িয়াছিল, সেইজন্য পাঠানেরা ক্ষেপিয়া উঠিয়া উজিরকে মারিয়া ফেলে। উজিরের পুত্র প্রতাপনারায়ণ ভয়ে পলাইয়া গেলেন। উজিরের মৃত্যুর পর পাঠানেরা বিদ্রোহের জন্য চেষ্টা পাইতে লাগিল, পূর্ব্ববঙ্গের এ অঞ্চলে যত পাঠান ছিল তাহাদের একত্র হইবার চেষ্টা চলিল। তাহাদের মধ্যে পরামর্শ হইল রাজধানী লুট করিতে হইবে এবং চট্টগ্রামের পথে বিজয়মাণিক্যকে অবরোধ করিয়া তাঁহার প্রাণ সংহার করিতে হইবে। কিন্তু ইহা অচিরেই মহারাজের কানে উঠিল, তখন বিজয়মাণিক্য সংহার মূর্ত্তি ধরিয়া স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন এবং পাঠান সেনাকে ধরাশায়ী করিলেন। যাহারা প্রাণ লইয়া পলাইতে পারিল তাহারা গৌড়ে যাইয়া নবাবের দরবারে লাঞ্ছনার কথা নিবেদন করিল।

বিজয়মাণিক্য পাঠান দলনের দ্বারা যেমন স্বরাজ্য নিষ্কণ্টক করিলেন তেমনি অমিত বিক্রমে নবাব সৈন্য পরাজিত করিয়া চট্টগ্রামের পূর্ণ আধিপত্য লাভ করিলেন। চট্টগ্রাম হইতে বিতাড়িত হওয়ায় পূর্ব্ববঙ্গ অঞ্চলে নবাবের অধিকার খর্ব্ব হইয়া পড়িল। নবাব সুলেমান বীর পুরুষ ছিলেন, উড়িষ্যা বিজয় দ্বারা তাঁহার যশ চতুর্দ্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং ত্রিপুরেশ্বর হইতে তাঁহার পরাভব বিজয়ীর যশোরাশি ম্লান করিয়া ফেলিয়াছিল। ইহার প্রত্যুত্তর স্বরূপ নবাব নিজ শ্যালক মমারক খাঁকে সেনাপতি করিয়া দশ হাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দিয়া চট্টগ্রাম জয় করিতে পাঠাইলেন। পাঠানবাহিনী ঝড়ের ন্যায় সহসা আসিয়া পড়িল, তজ্জন্য চট্টগ্রামে সেনা সন্নিবেশ পূর্ব্ব হইতে রাখা হয় নাই, কাযেই চট্টগ্রাম জয় করিতে পাঠানদের বেগ পাইতে হয় নাই। মমারক খাঁ সুলেমানের বিজয় কেতন চট্টগ্রামে উড়াইয়া দিলেন।

যখন বিজয়মাণিক্য ভগ্নদূত মুখে এ সংবাদ শুনিতে পাইলেন তখন তাঁহার ক্রোধানল জ্বলিয়া উঠিল। তিনি সেনাপতিগণকে যুদ্ধ সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া চট্টগ্রাম অভিমুখে সসৈন্যে তাহাদিগকে রওয়ানা করাইলেন। সুদীর্ঘ আট মাস ধরিয়া চট্টল অবরোধ চলিল, কিন্তু পাঠান সেনানী মমারক খাঁকে তাহারা কিছুতেই হঠাইতে পারিল না। বিজয়মাণিক্য সেনাপতিদের অকৃতকার্য্যতায় অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন, বাহিরে এভাব প্রকাশ না করিয়া তাহাদিগকে চট্টগ্রাম হইতে ডাকাইয়া আনিলেন। রাজার ডাকে তাহারা যুদ্ধ স্থগিত রাখিয়া রাজধানীতে আসিয়া ভয়ে ভয়ে রাজদর্শন করিল। মহারাজ বিজয়মাণিক্য যেমন বীর ছিলেন তেমনি রসগ্রাহী পুরুষও ছিলেন। জয়ন্তী রাজের সহিত রসিকতাই তাহার নিদর্শন। সেনাপতিদের নিয়া এইবার যে রসিকতা করিলেন তাহার তুলনা ইতিহাসে অল্পই দেখা যায়। ভীত সেনাপতিগণকে সম্বোধন করিয়া মহারাজ বলিলেন, “চট্টল সংগ্রামে তোমাদের বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া পুরস্কারস্বরূপ আমি তোমাদিগকে এক একটি চরখা দিতেছি, অস্ত্র ফেলিয়া তোমরা নিজ নিজ ঘরে যাও, ঘরে গিয়া চরখা কাটায় মন দাও।” সেনাপতিরা মাথা নীচু করিয়া রহিল। তখন এক একটি চরখা দিয়া তাহাদিগকে রাজদ্বার হইতে বিতাড়িত করা হইল।
[রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৩]

চট্টগ্রাম বিজয় এবং বলির সেনাপতি মোবারক খাঁ
জয়ন্তী যুদ্ধের পর শ্রীহট্টে কালনাজির স্থাপিত হইয়াছিল—এইবার কালনাজিরের ডাক পড়িল। কালনাজির বীর পুরুষ। মহারাজ তাঁহাকে প্রধান সেনাপতিরূপে চট্টলে পাঠাইয়া দিলেন। কালনাজির আসিয়া দেখেন ত্রিপুর সৈন্যের মধ্যে বড়ই উৎসাহের অভাব, সেনাপতিদের উঠাইয়া নেওয়ায় ইহারা দমিয়া গিয়াছিল। কালনাজির সৈন্যগণকে চাঙ্গা করিয়া তুলিলেন। তারপর ভীষণ সংগ্রাম বাঁধিল। নাজিরের আগমনে পাঠান সৈন্য কোমর বাঁধিয়া যুদ্ধে নামিল—অস্ত্রের ঝনৎকার ও বন্দুকের আওয়াজে কানে তালা লাগিয়াছিল। রক্ত নদী বহিয়া গেল, হাতিগুলি কালো মেঘের ন্যায় রণক্ষেত্র ছাইয়াছিল এবং মেঘনাদের ন্যায় মুহুর্মুহু গর্জ্জন করিতেছিল। নাজির সেনাপতি রণমদে মত্ত হইয়া ত্রিপুর সৈন্যের পুরোভাগে থাকিয়া যুদ্ধ চালনা করিতেছিলেন, তখন সন্ধ্যা ঘনীভূত হইয়াছে এমন সময়ে পাঠানের অস্ত্রাঘাতে নাজির প্রাণত্যাগ করিলেন। সেনানীর মৃত্যুতে ত্রিপুর সৈন্যের বিজয় উল্লাসে বাধা পড়িয়া গেল, পাঠানের জয়ধ্বনিতে দিগন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। ত্রিপুরসেনা সন্ধ্যার অন্ধকারে কোথায় যে গা ঢাকা দিল তাহার খোঁজ পাঠানেরা আর লইল না। রণশ্রান্ত হইয়া তাহারা গড়ের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িয়া আহার বিহারে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

এদিকে ত্রিপুরসেনা শৈলমালার নীচে জমাট বাঁধিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল এখন উপায়? পরাজিত হইয়া রাজধানীতে প্রবেশ করিলে সকলেরই মাথা কাটা যাইবে, তার চাইতে এখানেই প্রাণ দেওয়া ভাল। এইরূপ মরিয়া হইয়া তাহাদের দলপতি এক ফন্দী আঁটিল, গড়ের যে দিকটা পাহাড়ের গায়ে ঠেকিয়া আছে এবং দুর্ল্লঙ্ঘ্য বলিয়া মাত্র জন কয় প্রহরী রহিয়াছে, তাহার নীচ দিয়া এক সুড়ঙ্গ কাটিয়া একেবারে গড়ের প্রবেশ-পথে পৌঁছান যাইবে। আজ রাত্রেই সুড়ঙ্গ করিয়া গড়ে প্রবেশ করিতে হইবে কারণ পাঠানেরা বুঝিয়াছে ত্রিপুর সৈন্য দেশে পলাইয়াছে, তাই নিশ্চিন্ত মনে গভীর নিদ্রায় ঢলিয়া পড়িবে। যেমন কথা তেমনি কায! তিন হাজার সৈন্য সুড়ঙ্গ খনন করিতে লাগিয়া গেল, আর ঐদিকে শ্রান্ত পাঠানেরা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতে লাগিল। গভীর অন্ধকারের মধ্যে ত্রিপুরসেনা পিঁপড়ার স্রোতের ন্যায় পিল্ পিল্ করিয়া সুড়ঙ্গ মুখে একেবারে দুর্গদ্বারে উপস্থিত! যে প্রহরীরা পাহারায় ফিরিতেছিল, তাহারা ব্যাপার বুঝিবার পূর্ব্বেই নিহত হইয়া গেল। তখন মুক্ত দ্বার পথে ত্রিপুরসেনা গড়ের মধ্যে ঢুকিতে লাগিল, ভিতরের প্রহরীরা এই কাণ্ড দেখিয়া দামামা পিটিয়া দিল। তখন এক মহা সোরগোল উঠিল। যে দিকেই পাঠান চোখ কচ্‌লাইয়া জাগিয়া উঠে সেদিকেই ত্রিপুর সেনা যমের ন্যায় তাহার শিয়রে দণ্ডায়মান। এ অবস্থায় আর যুদ্ধ কি হইবে? গড় দখল হইয়া গেল, মমারক খাঁ বন্দী হইলেন।

চট্টল অধিকার হইয়া গেলে পাঠানশিবিরের ধনরত্ন মহারাজের ভেট স্বরূপ সংগৃহীত হইল, তাহার মধ্যে পাঁচশত সোনার কুমড়া ছিল, হাতী ঘোড়ার ত কথাই নাই। বিজয়ী ত্রিপুর সৈন্য সগর্ব্বে রাজধানী প্রবেশ করিল। বিজয়মাণিক্য মমারক খাঁকে মুক্তি দিতে চাহিয়াছিলেন কিন্তু ঘটনাচক্রে মমারক খাঁ নিহত হন। পাঠান সেনার পরাজয়ে বিজয়মাণিক্য যেমনি বিজয় তিলক পরিলেন, গৌড়েশ্বর তেমনি মরমে মরিয়া গেলেন। যুদ্ধের সাতদিন পরে গৌড়ের নবাব সুলেমান মহারাজকে চিঠি দিলেন, “ভাই, বিরোধ ভুলিয়া যাও—তুমি আমার সখা; পদ্মার ঐপার অবধি যাত্রাপুর প্রভৃতি দেশ তোমাকে ছাড়িয়া দিয়া উভয় রাজ্যের সীমানা নির্দ্ধারণ করিব। মমারক খাঁকে মুক্তি দাও ইহা আমার সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ।”

ত্রিপুরেশ্বর সোনার পাতে মুড়াইয়া নবাবের পত্রোত্তর পাঠাইলেন, মমারক জীবিত নাই, এজন্য প্রত্যর্পণ করিতে না পারায় বড়ই দুঃখিত।
[রাজমালা (ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ/৪]

সংশয়-১
দেখা যাচ্ছে রাজমালায় ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ থাকলেও সময়কালটা উল্লেখ নেই। কিন্তু সোলায়মানের কথা উল্লেখ করায় মনে হচ্ছে সময়টা ১৫৬৬ পরবর্তীকাল। সোলায়মান কররানির সময়কাল ছিল ১৫৬৬-১৫৭২। বিজয় মানিক্যের শাসনকাল ১৫৭০ সালে সমাপ্ত। রাজমালা সঠিক বলে ধরতে গেলে ঘটনাটি ১৫৬৬ থেকে ১৫৭০ এর মধ্যে ঘটেছিল। সোলায়মান খান উড়িষ্যা বিজয় করেন ১৫৬৮ সালে। এই ঘটনাটি উড়িষ্যা বিজয়ের পরের ঘটনা। সুতরাং সেটা কি ১৫৬৯ সালে ঘটেছিল? রাজমালার পরবর্তী অংশের একটি তথ্য আবার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। সেখানে দাউদ নামের একজন গৌড়েশ্বরের কথা আছে যিনি মোগলদের ভয়ে সপরিবারে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহন করার জন্য বিজয় মানিক্যের কাছে দুত পাঠিয়েছিলেন। এ কথা সত্য হতে পারে না। কেননা দাউদ কররানী ক্ষমতায় এসেছেন ১৫৭৩ সালে, আর বিজয়মাণিক্য মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫৭০ সালে। তার মানে রাজমালার সব তথ্য সঠিক মেনে নেয়া যাচ্ছে না।

সংশয়-২
সেই সময়ে আরেকটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় ইতালীর পর্যটক সিজার ফ্রেদেরিকির কাছ থেকে। পর্তুগীজদের হাতে চট্টগ্রামের গভর্ণর নসরত খান নিহত হয়েছিলেন। নসরত খান যখন গভর্ণর তখন বাংলার শাসক কে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আরাকানী ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হয়। তবে তার আগে আরো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার আছে।
আরাকানের সাথে নসরত খানের কী সম্পর্ক ছিল?
নসরত খানের ত্রিপুরা অভিযান কতসালে ঘটেছিল?
হত্যাকাণ্ডটি মোবারক খানের আগে ঘটেছিল নাকি পরে?
সিজার ফ্রেদেরিকি আসলে কত সালে চট্টগ্রাম এসেছিলেন?

সংশয়-৩
ওই সময়কালের শাসক নিয়ে ড. আহমদ শরীফ লিখিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসে’র(৪০ পাতায়) দুটি তথ্য নিয়ে সংশয় আছে-
১. ১৫৩৮-১৫৫৩ আফগানদের হাতে ছিল চট্টগ্রাম।
২. ১৫৫৪-১৫৭৩ পর্যন্ত ত্রিপুরার অধীনে ছিল চট্টগ্রাম।

যদি এই দুটি তথ্য ঠিক হয় তাহলে আরাকানের অধীনে কখন ছিল? আরাকানীরা বলছে ১৫৩২ থেকে ১৫৫৩ পর্যন্ত মেঙবেঙ এর দখলে ছিল চট্টগ্রাম। এটাও ঠিক না। অন্ততঃ ১৫৪০ পর্যন্ত আরাকানীরা চট্টগ্রাম দখল করেনি। মেঙবেঙ এর প্রথম আট বছর চট্টগ্রামমুখী অভিযান হয়েছে বলে প্রমান নেই। ওই সময়টা চট্টগ্রাম ছিল গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ ও শেরশাহের দখলে। রামুর মন্দিরে আরাকানী শাসক চান্দিলা রাজার নাম পাওয়া গেছে ১৫৪২ সালে। ১৫৫৪ সালে শামসুদ্দিন গাজী আরাকানের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করে। তাতে মনে হয় তার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলেই ছিল। মেঙবেঙ এর মৃত্যুর পর আরাকান দুর্বল হয়ে পড়েছিল বলে মনে হয়। তাই ১৫৫৪ থেকে ১৫৬৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বাংলার অধীনে ছিল।

বিজয় মানিক্যের চট্টগ্রাম বিজয়ের ঘটনা নিয়ে ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি
অনুমান করা হয় ১৫৬৯ সালে বিজয়মানিক্যের অভিযানে চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধীনে চলে যায়। সেই অভিযানে চট্টগ্রামের শাসক বা সেনাপতি মোবারক খাঁকে ধরে নিয়ে বলি দেয়া হয় ত্রিপুরার মন্দিরে। এরপর তিন বছর চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধিকারে ছিল। ১৫৭৩ সালে দাউদ খানের হাতে চট্টগ্রাম বিজিত হয় যা ১৫৭৬ টিকেছিল। ১৫৭৬ সালে মেঙ ফালঙ চট্টগ্রাম অধিকার করে আবারো আরাকানভুক্ত করে। ১৫৮৫ সালে অমরমানিক্য চট্টগ্রাম অভিযান চালায় রাজধর মানিক্যের মাধ্যমে সেই অভিযানে কিছুদিন চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে আসে। কিন্তু সেই দখল বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় এবং পাল্টা আরাকানী আক্রমনে অমরমানিক্য শোচনীয় পরাজয়বরন করে আত্মহত্যা করে। তারপর থেকে চট্টগ্রাম এক নাগাড়ে আরাকান অধিকারে চলে যায়।

এবার বিজয়মানিক্যের চট্টগ্রাম অভিযান এবং চট্টগ্রামে ত্রিপুরার শাসন বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের তথ্যের গরমিলগুলো দেখা যাক:-

# অধ্যাপক সুনীতিভূষণ কানুনগোর মতে ১৫৫৬ থেকে ১৫৬৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধীনে ছিল। [History of Chittagong Vol-1, Suniti Bhushan Qanungo] (পৃ.১৯৬)

# গবেষক ঐতিহাসিক এস.এম. আলীর মতে ১৫৫৬ সালে বিজয়মানিক্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন। সেই সময়ই মোবারক খানকে ধরে নিয়ে বলি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি মোবারক খানকে রাজমালায় বর্ণিত সোলায়মান কররানীর শ্যালক হিসেবে মেনে নেন না। তিনি বাহাদুর শাহ(১৫৫৫-৬১)এর শ্যালক বলে বিশ্বাস করেন।[Arakan rule in Chittagong (1550--1666 A.D)-S.M. Ali, Journal of Asiatic Society of Pakistan]

# অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর মতে বিজয়মানিক্য ১৫৫৬ সালে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। মোবারক খানকে বলি দেবার প্রতিশোধ নিতে সোলায়মান কররানী পাল্টা অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম দখল করেন।(১৫৫৬ সালে অভিযান হলে মোবারক খান সোলায়মান কররানীর শ্যালক হতে পারে না)[Bengal-Arakan Relations – Mohammad Ali Chowdhury]

# রাজমালায়(কৈলাস সিংহ এবং কালিপ্রসন্ন সেন দুজনের সম্পাদিত বইতেই) কোন সাল উল্লেখ করা নেই। তবে বলা হয়েছে গৌড়েশ্বরের শ্যালক মোবারক খানকে বলি দেয়া হয়। রাজমালার দুই সম্পাদকই টীকায় গৌড়েশ্বর হিসেবে সোলায়মান কররানীর নাম উল্লেখ করেছেন। যুক্তি হিসেবে বিজয়মানিক্য খণ্ডের একটি ছত্রকে দেখানো হয় যেখানে বিজয়মানিক্যের সাথে পত্রবিনিময়ে দাউদ বাদশার নাম উল্লেখ করা আছে মোবারক হত্যার বর্ণনার পর। সেই দাউদ বাদশাহ সপরিবারে ত্রিপুরার রাজার আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু দাউদ কররানীর মতো শক্তিশালী নৃপতি কখনো ত্রিপুরার কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করতে পারেন এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তাছাড়া দাউদ কররানী ক্ষমতায় আসেন বিজয়মানিক্যের মৃত্যুর কয়েক বছর পর।

# ড.আহমদ শরীফের মতে ১৫৫৬ থেকে ১৫৭৩ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধীনে ছিল ( চট্টগ্রামের ইতিহাস – ড. আহমদ শরীফ পৃ.৪০)। (তাহলে সোলায়মান কররানীর চট্টগ্রাম দখল করে বাঁশখালীর ইলসা থেকে মুদ্রা জারির ঘটনা কখন ঘটলো?)

# ড. আহমদ শরীফের বইতে ১৫৩৮ থেকে ১৫৫৩ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শেরশাহ বংশের শাসনাধীন ছিল ( চট্টগ্রামের ইতিহাস – ড. আহমদ শরীফ পৃ.৪০)। তাহলে ১৫৪২ সালে মেঙবেঙ এর গভর্ণর চান্দিলা রাজার নামে শিলালিপি চট্টগ্রামে আবিষ্কার হয় কী করে?

# ড.আহমদ শরীফের বইতে আরাকানী সুত্র দিয়ে বলা হয় নসরত শাহ ১৫৫৫-৫৬ থেকে ১৫৬৯-৭০ পর্যন্ত চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন। তিনি আরাকানীদের ভেট দিয়ে ক্ষমতায় ছিলেন। আবার বলা হচ্ছে নসরত খানের সময়ে চট্টগ্রাম ত্রিপুরার অধীনে ছিল (চট্টগ্রামের ইতিহাস – ড. আহমদ শরীফ পৃ.৪২)।

নসরত খান কার হয়ে চট্টগ্রাম শাসন করতেন? গৌড়, ত্রিপুরা নাকি আরাকান? মোবারক খানের সাথে বিজয় মানিক্যের যুদ্ধের সময় নসরত খান চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন? হিসেব মিলছে না। ড. আহমদ শরীফের বইতে নসরত খান সম্পর্কে তিনটি তথ্য আছে। তিনি-

১. ত্রিপুরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন
২. পাঠানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন
৩. পর্তুগীজদের হাতে নিহত হয়েছিলেন

নসরত খানের এই ঘটনাগুলোর সবটা সত্যি হতে পারে না। একটি সত্যি হলে অন্যটি মিথ্যা হয়ে যায় আপনাতেই। একই মানুষ দুই পক্ষে কাজ করতে পারে না একই সময়ে। তাছাড়া উপরের তিনটি ঘটনার সময়কাল কবে তার উত্তর মেলেনি কোথাও।

আরাকানী সুত্রে জানা যাচ্ছে ১৫৫৬ থেকে ১৫৭০ পর্যন্ত আমিরজা খানের পুত্র নসরত খান চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন। এই তথ্যের সাথে রাজমালার দ্বন্দ্ব আছে। এই সময় নসরত খান চট্টগ্রাম শাসন করলে মোবারক খান কখন শাসন করেছিলেন? ত্রিপুরা সৈন্যদের হাতে তাঁর নিহত হবার ঘটনাটি কখন ঘটলো? বিজয় মাণিক্যের এই যুদ্ধে নসরত খান কি ত্রিপুরার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন? ত্রিপুরার শত্রু আমিরজা খানের পুত্র নসরত খান কিভাবে তাদের পক্ষে চট্টগ্রামের শাসক হতে পারেন সেটা বোঝা যায় না। কিন্তু এটা ঠিক যে নসরত খানের সময় চট্টগ্রাম ত্রিপুরারই অধীনে ছিল। নসরত খানের শেষ দিকে আরাকানের রাজা মেঙ সেত্যা চট্টগ্রামের উপর আগ্রাসন চালানোর উপক্রম হলে নসরত খান আরাকানীদের উপঢৌকন পাঠিয়ে তার সাথে সন্ধিস্থাপন করেন। কিন্তু আরাকানরাজের ইঙ্গিতে পর্তুগীজদের সাথে নসরত খান যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। সেই সময় বিজয়মাণিক্যেরও জীবনাবসান ঘটে। তারপর ত্রিপুরার রাজধানীতে ক্ষমতা নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে অস্থিতিশীলতার সুযোগে দাউদ কররানী ত্রিপুরার কাছ থেকে চট্টগ্রাম দখল করেন ১৫৭৩ সালে। কিন্তু মোগলদের হাতে দাউদ খানের পরাজয়ের পর বাংলা মোগল অধিকারে চলে গেলে আরাকানরাজ মেঙ ফালঙ চট্টগ্রাম দখল করার সুযোগ নেন ১৫৭৬ সালে। এভাবে ৬ বছরের মধ্যে তিনবার হাত বদল হয় চট্টগ্রামের অধিকার।

বিজয়মানিক্যের মৃত্যুর পর ত্রিপুরায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে বেশ কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটে এবং ত্রিপুরার শক্তির অবনতি ঘটে। এরপর অমরমানিক্যের সময়ে আবারো শক্তি অর্জন করে ত্রিপুরা। ১৫৮৫ সালে অমরমানিক্যের সময় চট্টগ্রাম দখলে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয় আরাকানের সাথে। সেই যুদ্ধের চুড়ান্ত ফলাফলে আরাকানশক্তি বিজয়ী হলে চট্টগ্রাম আরাকানী অধিকারভুক্ত হয় ১৫৮৬ সালে। এই অধিকার দীর্ঘ ৮০ বছর স্থায়ী হয়েছিল ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম বিজয় পর্যন্ত।

এই পর্যায়ে এসে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসলাম ১৫৪০-১৫৮৬ সময়কাল নিয়ে? প্রাপ্ত তথ্যগুলো দিয়ে এই প্রশ্নটির কোন বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই এই অধ্যায়কে আপাতত ইতিহাসের অস্পষ্ট সময় মেনেই আমাদেরকে আলোচনার সমাপনীর দিকে যেতে হবে।

অনিশ্চিত উপসংহার : ষোড়শ শতক জুড়ে চট্টগ্রাম কখন কার অধীনস্থ ছিল?

শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিক সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে একটা তালিকা দেয়া হলো। ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের একটা সাধারণ সমস্যা হলো ঐতিহাসিক উপাদানের সুত্রগুলো। অনেক ক্ষেত্রেই সুত্রগুলো নিরপেক্ষ হয় না। ঘটনার বিবরণী যারা লিপিবদ্ধ করেন তাদের অবস্থান প্রায়ই নিরপেক্ষ হয় না। মধ্যযুগে বাংলার যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছিল তা কোন না কোন শাসকের নির্দেশে। রাজকীয় ইতিহাস লেখক নিশ্চিতভাবেই রাজার বিরুদ্ধে যায় তেমন কিছু লিখবেন না। আধুনিক যুগের মতো শখের ইতিহাস লেখক/গবেষক মধ্যযুগে অনুপস্থিত ছিল। ফলে বর্তমান সময়ে যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন তাদের জন্য পুরোনো ঐতিহাসিক তথ্যগুলো শতভাগ সত্য বলে মেনে নেয়া কঠিন। কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনা নিয়ে দুই রাজ্য থেকে ইতিহাস লেখা হয়েছে। দেখা গেছে একই যুদ্ধ নিয়ে দু’পক্ষের বিবরণ দুরকম। মধ্যযুগে পনের-ষোল শতকের চট্টগ্রামের ইতিহাসের জন্য অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়েছে ত্রিপুরা ও আরাকানী বিবরণের উপর। যেহেতু ত্রিপুরা ও আরাকান দুটো পক্ষই চট্টগ্রাম দখল নিয়ে বাংলার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তাদের বিবরণও দুই রকম হয়েছে। আবার বাংলার পক্ষে কোন প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ নেই। মোগল শাসকেরা পরবর্তীতে যে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন তাও দূর থেকে শোনা ঘটনা। তাই ওই সময়ের ঘটনাগুলোকে ইতিহাসের অস্পষ্ট সময় মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। সকল পক্ষের তথ্যের সারাংশে একটি বিষয় পরিষ্কার যে ষোড়শ শতক জুড়ে চট্টগ্রাম নিয়ে ত্রিমুখী যুদ্ধবিবাদ অব্যাহত ছিল। সেই তিনটি পক্ষ ছিল বাংলা, আরাকান ও ত্রিপুরা। এই তিন শক্তির হাতেই ষোড়শ শতকে বহুবার হাতবদল হয়েছে চট্টগ্রাম। নীচে যে সময়চিত্র দেয়া হয়েছে সেটা শতভাগ সত্যি বলে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। এর মাঝে অনেকবার হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে তিন পক্ষ থেকেই। তাই এই সালগুলো দুয়েক বছর এদিক সেদিকও হতে পারে। তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম অধিকার বিষয়টি সবসময় সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম অঞ্চল দখল করা হয়েছে তেমন নাও হতে পারে। কিছুক্ষেত্রে কর্ণফুলীর উত্তর ও দক্ষিণ তীর দুপক্ষের দখলে ছিল বলে মনে হয়। একই ঘটনা নিয়ে ত্রিপুরার সুত্র ও আরাকানের সুত্রে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। একই সময়কালে দুই পক্ষ থেকেই চট্টগ্রাম অধিকারে রাখার দাবী করা হয়েছে। তবু সমসাময়িক সুত্রগুলো মিলিয়ে যথাসম্ভব যৌক্তিকভাবে সাজালে চট্টগ্রাম দখলে রাখার সময়কালটা এরকম হতে পারে। যেহেতু শতভাগ সঠিক তথ্যের নিশ্চয়তা নেই তাই প্রতিটি তথ্যের ক্ষেত্রে ‘সম্ভবত’ শব্দটি যোগ করে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়।

১৫০০-১৫১২ = আরাকান (মেঙ রাজা)
১৫১৩=ত্রিপুরা (ধনমানিক্য)
১৫১৩=বাংলা (আলাউদ্দিন হোসেন শাহ)
১৫১৪=ত্রিপুরা (ধনমানিক্য)
১৫১৫-১৫১৭=বাংলা(আলাউদ্দিন হোসেন শাহ)
১৫১৮-১৫২৪=আরাকান (থাজাতা/মেঙ খং রাজা)
১৫২৫-১৫৪০=বাংলা(নসরত শাহ, গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ, শেরশাহ)
১৫৪১-১৫৫৩=আরাকান (মেঙবেঙ)
১৫৫৪-১৫৬৫=বাংলা (শামসুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ গাজী-সোলায়মান কররানি)
১৫৬৬-১৫৭২=ত্রিপুরা (বিজয়মানিক্য) এবং বাংলা (সোলায়মান কররানি)*
১৫৭৩-১৫৭৬=বাংলা(দাউদ খান কররানি)
১৫৭৬-১৫৮৫=আরাকান (মেঙ ফালঙ)
১৫৮৬-১৫৮৮=আরাকান/ত্রিপুরা(মেঙ ফালঙ/অমরমানিক্য)
১৫৮৮ থেকে ১৬৬৬ পর্যন্ত এক নাগাড়ে আরাকানের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম। মেঙ ফালঙ থেকে চেন্দা সুধর্মা পর্যন্ত।

* ১৫৬৬ থেকে ১৫৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কার অধীনে কতদিন ছিল সেটা নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে যা বোঝা গেছে ওই সময়কালে চট্টগ্রাম বিজয়মানিক্য এবং সোলায়মান কররানীর মধ্যে একাধিকবার হাতবদল হয়েছে ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------

মূলত যে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে এত বিপুলায়তনের লেখাটা নামাতে হয়েছে তা হলো - মোবারক খাঁকে বলি দেবার ঘটনাটি কার আমলে ঘটেছিল? কত সালে ঘটেছিল? মোবারক খাঁ কার শালা?

বলাবাহুল্য, প্রশ্নটি অমীমাংসিত রেখেই লেখাটি শেষ করতে হচ্ছে।

পাদটীকা

  • ১. প্রধান তথ্যসুত্র:
    ১. History of Chittagong Vol-1, Suniti Bhushan Qanungo
    ২. Bengal-Arakan Relations – Mohammad Ali Chowdhury
    ৩. ARAKAN, MIN YAZAGYI, AND THE PORTUGUESE (1993) - Michael W. Charney
    ৪. Eastern Bengal District Gazettiers – Chittagong – O’Mally
    ৫. Arakan rule in Chittagong (1550--1666 A.D)-S.M. Ali, Journal of Asiatic Society of Pakistan, Vol. XII, No. III, December 1967
    ৬. চট্টগ্রামের ইতিহাস – ড. আহমদ শরীফ
    ৭. বাংলার ইতিহাসের দু'শো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল. (১৩৩৮ - ১৫৩৮ খ্রীঃ). সুখময় মুখোপাধ্যায়
    ৮. ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর রাজমালা ,
    ৯. রাজমালা - কৈলাশচন্দ্র সিংহ সম্পাদিত
    ১০. বাংলার ইতিহাস, সুলতানী আমল – আবদুল করিম

মন্তব্য

অবনীল এর ছবি

ধীরে ধীরে পড়ছি লেখাটা। মূল্যবান তথ্যবহুল এবং অসাধারন। আপনার এই গবেষনালব্ধ প্রশ্নগুলো চট্টগ্রামের ইতিহাসের উপর নতুনভাবে আলোকপাত করবে। পরিশ্রমসাধ্য এই কাজটা সম্পাদনের জন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাতেই হচ্ছে।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই বিশাল আকারের লেখাটি পড়া খুব কষ্টসাধ্য কাজ। সেই কাজটি করার চেষ্টা করেছেন বলে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

এইরূপ মরিয়া হইয়া তাহাদের দলপতি এক ফন্দী আঁটিল, গড়ের যে দিকটা পাহাড়ের গায়ে ঠেকিয়া আছে এবং দুর্ল্লঙ্ঘ্য বলিয়া মাত্র জন কয় প্রহরী রহিয়াছে, তাহার নীচ দিয়া এক সুড়ঙ্গ কাটিয়া একেবারে গড়ের প্রবেশ-পথে পৌঁছান যাইবে। আজ রাত্রেই সুড়ঙ্গ করিয়া গড়ে প্রবেশ করিতে হইবে কারণ পাঠানেরা বুঝিয়াছে ত্রিপুর সৈন্য দেশে পলাইয়াছে, তাই নিশ্চিন্ত মনে গভীর নিদ্রায় ঢলিয়া পড়িবে। যেমন কথা তেমনি কায! তিন হাজার সৈন্য সুড়ঙ্গ খনন করিতে লাগিয়া গেল, আর ঐদিকে শ্রান্ত পাঠানেরা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতে লাগিল।

এটুকু পর্যন্ত পড়ে মন্তব্য করছি। এক রাতের মধ্যে পাহাড় ফুঁড়ে সুড়ঙ্গ কেটে গড়ে হানা দেওয়ার ব্যাপারটা একটু কষ্টকল্পনা মনে হচ্ছে। সুড়ঙ্গের প্রস্থচ্ছেদ বরাবর তিন হাজার সৈন্যের সবাই একবারে কাজ করতে পারবে না, বড়জোর আট-দশজন পারবে। বাকিরা টুকরি ভরে মাটি-পাথর সরাতে পারবে বড়জোর। মাইনার-স্যাপার বা খনিকসেনাদের কাজ সাধারণত হপ্তা থেকে মাসব্যাপী হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

রাজমালার কিছু কিছু অংশ রূপকথা মনে করে পড়তে হয়। রূপকথায় এমন অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে রাজাকে খুশী করতে গিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহের অংশে আজকালকার হলিউড বলিউডি বীরত্ব ভর করেছে লেখকের চেতনায়। কোনরকম গাণিতিক অংক দিয়ে তার হিসেব মেলানো অসম্ভব। ইতিহাসের সুত্র হিসেবে ব্যবহার করলেও শতভাগ তথ্য শুদ্ধ বলে মেনে নেবার উপায় নাই।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

চিটাগাঙ/চট্টগ্রাম নামটার ইতিহাস নিয়ে কিছু লিখুন না?

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

চট্টগ্রাম নামের উৎস নিয়ে এত বিচিত্র লেখালেখি আছে যে তার মধ্যে সত্যিটা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব মনে হয়। উইকিপিডিয়াতে যে সারাংশটুকু আছে তা কপি করে দিলাম-

বৈচিত্রময়ী চট্টগ্রামের নামও বৈচিত্রে ভরা। খ্রিষ্টীয় দশক শতকের আগে চট্টগ্রাম নামের অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ চট্টগ্রাম নামের কোন উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই দেখা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পন্ডিতগণের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এখানকার শাসক গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বহু নামে খ্যাত করেছিলেন। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‌‌-সুহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, শ্রীচট্টল, চাটিগাঁ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু কোন নামের সঙ্গে পাঁচজন একমত হন না। সে সব নাম থেকে চট্টগ্রামের নাম উৎপত্তির সম্ভাব্য ও চট্টগ্রামের নামের সঙ্গে ধ্বনিমিলযুক্ত তেরটি নামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।

চৈত্যগ্রাম: চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত এই যে, প্রাচীনকালে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম। চৈত্য অর্থ বৌদ্ধমন্দির কেয়াং বা বিহার। এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয় বলে চৈত্যগ্রাম নামের উদ্ভব হয়। পরবর্তীকালে চৈত্যগ্রাম নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।

চতুঃগ্রাম: ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও'মলি সাহেবের মতে, সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার। চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃগ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।

চট্টল: চট্টগ্রামের তান্ত্রিক ও পৌরাণিক নাম ছিল চট্টল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণগ্রন্থে চট্টল নামের উল্লেখ দেখা যায়।

শাৎগঙ্গ: বার্ণোলী সাহেবের মতে আরবি শাৎগঙ্গ শব্দ বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়েছে। শাৎ অর্থ বদ্বীপ, গঙ্গ অর্থ গঙ্গানদী। চট্টগ্রাম গঙ্গানদীর মোহনাস্থিত বদ্বীপ- প্রাচীন আরব বণিক-নাবিকদের এই ধারণা থেকে এর নামকরণ করা হয়েছিল শাৎগঙ্গ। পরবর্তীকালে শাৎগঙ্গ নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।

চিৎ-তৌৎ-গৌং: খ্রিষ্টীয় দশম শতকের মধ্যবর্তীকাল অবধি ফেনী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে নাফ নদীর উত্তর তীরের মধ্যবর্তী ভূভাগটির চট্টগ্রাম নাম প্রচলিত ছিল না। তখন এই ভূরাজ্যটি আরাকানরাজ্যভূক্ত ছিল। তৎকালীন আরাকানরাজ সুলতইং চন্দ্র ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে নিজ অধিকৃত রাজ্যাংশের উক্ত ভূভাগের বিদ্রোহী 'সুরতন'কে ( সুলতানকে ) দমন করতে এসে সসৈন্য আধুনিক সীতাকুন্ড থানার কুমিরার কাউনিয়া ছড়ার দক্ষিণ তীর অবধি অগ্রসর হন এবং সেখানে একটি পাথরের বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করে তাতে চিৎ-তৌৎ-গৌং (যুদ্ধ করা অনুচিত) বাণী উৎকীর্ণ করে স্বদেশে ফিরে যান। তখন থেকে এই ভূভাগটি চিৎ-তৌৎ-গৌং নামে খ্যাত হয়। আরাকানের প্রাচীন রাজাদের ইতিহাস রাজোয়াং সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। কালক্রমে চিৎ-তৌৎ-গৌং নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়।

চাটিগ্রাম: সম্ভবত রাজোয়াং বর্ণিত উপরিউক্ত চিৎ-তৌৎ-গৌং নামটি মধ্যযুগে বিবর্তিত ও সংস্কৃতায়িত হয়ে চাটিগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়। গৌড়ের রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেবের ১৩৩৯-১৩৪০ শকাব্দে ও রাজা মহেন্দ্র দেবের ১৩৪০ শকাব্দে চট্টগ্রামে তৈরি মুদ্রায় টাকশালের নাম চাটিগ্রাম উল্লেখ দেখা যায়। বাংলার সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ ( ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি. ) ও সৈয়দ নাসির উদ্দিন নশরত শাহ্‌র আমলে (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.) কবীন্দ্র পরমেশ্বর বিরচিত পরাগলী মহাভারতে এবং বৈষ্ণব সাহিত্য চৈতন্য-ভাগবত প্রভৃতিতে চাটিগ্রাম নামের উল্লেখ রয়েছে।

চাটিজান: চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জ্বীনপরী অধ্যুষিত দেশ। পীর বদর শাহ্‌ এখানে আগমন করে অলৌকিক চাটির (মৃৎ-প্রদীপ) আলোর তেজের সাহায্যে জ্বীনপরী বিতাড়িত করে নামাজের জন্য আজান দেয়ার ফলে এই স্থানের নাম হয় চাটিজান।

চতকাঁও/চাটগাঁও:বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ্‌র (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) ও সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ্‌র (১৪১৮-১৪৩২ খ্রি.) মুদ্রায় চতকাঁও টাকশালের নাম উৎকীর্ণ দেখা যায়। ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে লিখিত সুবিখ্যাত সুফি সাধক মুজাফফর শামস বলখির চিঠিতে চাটগাঁও নামের উল্লেখ দেখা যায়।

সুদকাওয়ান: আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত মরক্কোর অধিবাসী ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বঙ্গ ও আসাম পরিভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামকে সুদকাওয়ান নামে উল্লেখ করেন।

চাটিকিয়াং: চীন দেশ থেকে ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫, ১৪২২ বা ১৪২৩, ১৪২৯ ও ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে মোট সাতবার বাংলার সুলতানদের দরবারে রাজদূত প্রেরিত হয়েছিল। তাদের লিখিত বিবরণে চট্টগ্রামকে চাটিকিয়াং রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

শাতজাম: তুর্কি সুলতান সোলায়মানের রেডফ্লিটের ক্যাপ্টেন সিদি আলী চেহেলভি ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে জাহাজযোগে ভারত মহাসাগরীয় দেশসমূহ পরিভ্রমণ করেন। এবং এ সময় তিনি আরাকান থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন করেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম শাতজাম নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

চার্টিগান: পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পরিভ্রমণ করেন। তাঁর লিখিত ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম চার্টিগান রূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

জেটিগা: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ফ্যান্ডেন ব্রুক অঙ্কিত মানচিত্রে চট্টগ্রামের নাম জেটিগা রূপে লিখিত আছে।
=================================
এগুলা ছাড়াও আরো নাম আছে গবেষকদের বই পুস্তক জুড়ে। এটুকু পড়েই ক্লান্তি লাগে বলে আর দিলাম না।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মন মাঝি এর ছবি

দারুন!!!!

****************************************

মন মাঝি এর ছবি

চলুক

****************************************

এক লহমা এর ছবি

যাক, শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পেরেছি! হাসি অ্যামার পড়তেই এত সময় লাগল, গুলিয়েও যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। আপনার তাহলে কি অবস্থা হয়েছিল!!!!
চট্টগ্রামের নামের উৎপত্তির মন্তব্যটাও দামী কাজ হয়েছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই জটিল পেচগিময় লেখাটা পড়ে ওঠার জন্য অভিনন্দন আপনাকে হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সত্যপীর এর ছবি

কয়েকবার পড়লাম। সপ্তদশ শতাব্দীর আগের উপমহাদেশ (বিশেষত পূর্বাঞ্চলীয় ইতিহাস) সম্পর্কে আমার পড়াশুনা স্বল্প বিধায় আলোচনায় যোগ দিতে সময় লাগতেছে। আবার এসে জানাচ্ছি, কয়টা জিনিস ক্রস চেক করে আসি তারপর।

..................................................................
#Banshibir.

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনি এবং সচলের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ/পড়ুয়ারা আলোচনায় অংশ নিলে আমার সংশয়মূলক পোস্টটি উপকৃত হবে। সময় লাগলে লাগুক। অপেক্ষায় থাকবো যদি কোন একটা সমাধান মেলে। ওই সময়ের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা বইপত্রের সংখ্যা খুব কম। সে কারণে কাজটা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

পনের-ষোল শতকের চট্টগ্রামের ইতিহাসের জন্য অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়েছে ত্রিপুরা ও আরাকানী বিবরণের উপর

এতে কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে। যদি সুলতানী তরফেও কিছু বিবরণ থাকতো, তাহলে লাভের মধ্যে এই হত যে, প্যাঁচ আর এক প্রস্থ যুক্ত হতো। দেঁতো হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এটা খারাপ বলেন নাই। ইতিহাস লেখকদের কাজই হলো প্যাচের উপর নতুন প্যাচ যুক্ত করে তাকে আরো জটিল করে তোলা এবং আমাদের মতো শখের পাঠকদের মগজে ঘুটার পর ঘুটা দেয়া।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দুর্দান্ত এর ছবি

"ইহার প্রত্যুত্তর স্বরূপ নবাব নিজ শ্যালক মমারক খাঁকে সেনাপতি করিয়া দশ হাজার পদাতিক ও দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য দিয়া চট্টগ্রাম জয় করিতে পাঠাইলেন"

গৌড় থেকে অশ্বারোহী সৈন্যদের চট্টগ্রাম যাবার পথ কোনটা ছিল?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

প্রশ্নটি এতদিন পর চোখে পড়লো। গৌড় থেকে চট্টগ্রাম আসার পথটা রাজমালায় বলা নেই। ইতিহাসে সব তথ্য বিস্তারিত দেয়া থাকে না। তবে স্থলপথে যেহেতু এসেছে আসার পথে অনেক নদী নালা খালবিল পেরিয়ে আসতে হয়েছে সেটা নিশ্চিত। সেকালে নদীতে সেতু ছিল না। সেতুর বদলে বিকল্প হিসেবে নৌকা বা ভেলায় করে নদী পারাপার করতে হয়েছে এটা অনুমান করা যায়। নদী পারাপারের একটা পদ্ধতির কথা পেয়েছিলাম ত্রিপুরা কতৃক আরাকান আক্রমণের বিবরণে। সেখানে কর্নফুলী নদী পার হয়েছিল একটার পর একটা নৌকা জোড়া দিয়ে। অন্য নদীগুলো পারাপারের ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো সেটা ভাবার মতো বিষয় বটে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।