ভুল চর্চার দেশ

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: শনি, ৩১/০১/২০০৯ - ২:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলাদেশের আয়তন আসলে কত? --- ১ লক্ষ ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার ... আরে না না ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আয়তন আরো বাড়ছে কারণ বঙ্গোপসাগরে নাকি বিরাট চর জেগে উঠছে। আবার কেউ কেউ ভাবেন যে, চর/ভূমি জাগবে না কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমূদ্রের পানির গভীরতাও বাড়ছে।

এরকম নানা রকম তথ্যে চারপাশ ভরপুর। আমরা দিনকে দিন এতে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি। কিন্তু কেউ কি ভাবে না যে বর্গকিলোমিটার হল ক্ষেত্রফলের একক - এটাকে আয়তন বলা হচ্ছে কেন? যত্রতত্র এরকম ভুল প্রয়োগ দেখি -- এই রিকশা যাবে নাকি? - এর একটা উদাহরণ। আর পথে প্রান্তরে ভুল বানানের ছড়াছড়িতো আছেই .... জাতিকে জাতী লিখে এর যে জাত মেরে দেয়া হচ্ছে সেদিকে কারও কি নজর আছে! কিংবা ফটোস্ট্যাট, পোস্ট, মাস্টার ইত্যাদিতে ষ-ত্ব বিধানের তোয়াক্কা না করে ষ ব্যবহারও আছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যে এ্যাত এ্যাত ভুল বিষয়ে মিডিয়াতে কোনরকম উচ্চবাচ্য নাই দেখে। সবাই কি ভুলের বিজ্ঞাপনমূল্যের কথা ভেবে এসব মেনে নিচ্ছে?

ভুলের বিজ্ঞাপনমূল্য: একটি মুদি দোকানের বাইরে ভুল বানান আর ব্যাকরণে দোকানের পণ্যের প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখে একজন সদাশয় ব্যক্তি দোকানদারকে বিষয়টি অবহিত করলেন এবং সঠিক বানান ও ব্যাকরণগুলোও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেও বাইরের ওগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি দেখে ভেতরে গিয়ে রাগান্বিত ভাবে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে দোকানি জানালেন যে, এই ভুলগুলো ইচ্ছাকৃত। কারণ এই ভুল বানান-টানান দেখে ক্রেতারা ভাবে যে ভেতরের লোকটা বোকাসোকা ...কাজেই এখান থেকে সুবিধা আদায় করা যাবে। ভুল বানানে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর থেকে তাই বিক্রি বাট্টাও বেড়ে গিয়েছে। B-)

এছাড়াও ভুলগুলোর সপক্ষে রয়েছে নানা রকম যুক্তি (!) -- ভাষা পরিবর্তনশীল, এর সাথে এ সংক্রান্ত রীতিনীতিও পরিবর্তনশীল। সুতরাং "দেশের আয়তন" বলা ঠিকই আছে। একই ভাবে, রিকশা এবং এর চালকও সমার্থক। আবার কেউ কেউ বলতে পারেন - মিয়া তোমার সমস্যা কী? হুদাই তেনা প্যাঁচাও ক্যা? পছন্দ নাইলে ফুট - এ্যাত প্যাচালের দর্কার কী?

কিছুদিন জাপানে থাকার ভাগ্য হয়েছিল (সেটা সৌভাগ্য না দূর্ভাগ্য সেই তর্কে না যাই ...)। যেখানেই গিয়েছি বিষ্মিত হয়েছিলাম ওদের সাফল্যে। আমাদের মত একই রকম হাত-পা ওয়ালা মানুষ হওয়া সত্বেও ২য় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত বিধ্বস্ত একটা জাতি কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেটা কল্পনা করতেও কষ্ট হত। জাপানে প্রবাসী কোন বাঙালি ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া - কোথাও গিয়েই শান্তি পায় না। পৃথিবীর কোথাও জাপানের মত এ্যাত পরিচ্ছন্ন, এফিসিয়েন্ট এবং সাহায্যপ্রবণ সিস্টেম কোথাও নাই বলেই শুনেছি। জাপানের এই ঈর্ষনীয় দক্ষতা বইয়ের মলাটের মত বাইরের আবরণ হতে পারে - সে ব্যাপারে অন্য কোথাও অন্য সময়ে তর্ক হতে পারে। আমার অবাক লাগতো যে ওরা পারলে আমরা পারি না কেন?

যতই দিন যায় ততই বুঝতে পারি যে জাপানিদের সাথে আমাদের এটিচ্যুডগত বিরাট তফাত রয়েছে। যারা "দ্যা লাস্ট সামুরাই" সিনেমাটা দেখেছেন তাঁরা খেয়াল করবেন যে টম ক্রুজের একটা ডায়লগ ছিল - এরা খুবই পারফেকশনিস্ট। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় সেই কথার সত্যতা খুঁজে পাই - জাপানিদের মুখে তুলে খাওয়ানো রীতির সমস্যা নিয়ে একটা ব্লগও লিখেছিলাম একসময়। ছোটবেলা থেকেই একজন জাপানী শিশুকে কষ্টসহিষ্ণু এবং পরিশ্রমী করে গড়ে তোলা হয়। তাদের মানসিকতাটাও খুব চমৎকার - এর পেছনে চারিদিকের পরিবেশেরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে হয়। কারণ অন্য অসভ্য দেশ থেকে আগত লোকজনও ওখানে সভ্য হয়ে চলার চেষ্টা করে ... আবার সভ্য জাপানীরাও বাংলাদেশে এলে অনেকক্ষেত্রেই অসভ্যতা করে।

ওরা যেখানে একটা জিনিষ সঠিকভাবে করার জন্য বার বার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে সেখানে আমরা কোনরকমে দায়সারা গোছের কাজ করেই ক্ষান্ত দেই। একজন বাড়ির মালিক যদি ঘরের কোনো কাজ করে তাহলে অনেক যত্ন নিয়ে করে, কিন্তু একজন চাকর দায়সারা গোছের করে ... কারণ এটা তাঁর নিজের সম্পত্তি না। প্রায় দুইশ বছর ইংরেজদের গোলামী করে আমাদের এটিচ্যূডে সেই চাকরের মানসিকতা গেঁথে গেছে বলেই মনে হয়। সেজন্যই দায়সারা গোছের কথা বলি। ভুল জানা সত্বেও ঠিকটা বলার গরজ দেখাই না .... .... । এই চর্চা শুধু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ না - এটা জাতীয় চরিত্র হয়ে গেছে। রাজনীতি বলুন, নির্মান শিল্প বলুন, ব্যাবসা বলুন ... সব জায়গাতেই এই চর্চা।

কোন পত্রিকাকেও দেখলাম না দেশের ক্ষেত্রফল লিখতে .... ইংরেজি area শব্দের বাংলা ক্ষেত্রফল কিংবা এলাকা হলেই শোভন হয়। কিন্তু আয়তন কথাটার ইংরেজি হল volume - যেটা দৈর্ঘ্য * প্রস্থ * উচ্চতা নির্দেশ করে। প্রতিনিয়ত তাই দেশের আয়তন ১ লক্ষ ৪৪/৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার শুনলে এটাকে দৈর্ঘ্য * প্রস্থ * ভুলের চর্চা করার মাথা নীচু আত্মমর্যাদাহীন গোলাম জাতির অভ্যাস - বলেই মনে হয়।

এই দেশটির জন্মই হয়েছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে - দেশের নামটা দেখলে তা-ই মনে হয়। সামনেই (আগামীকাল থেকেই) ফেব্রুযারী মাস। লোক দেখানো বাংলা ভাষা প্রেম চর্চা শুরু হয়ে যাবে কাল থেকেই। কিন্তু তারপরেও কি কেউ দায়সারা ভাব বাদ দিয়ে দায়িত্ব নিয়ে সঠিক কাজ করবে?


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

লোক দেখানো বাংলা ভাষা প্রেম চর্চা শুরু হয়ে যাবে কাল থেকেই। কিন্তু তারপরেও কি কেউ দায়সারা ভাব বাদ দিয়ে দায়িত্ব নিয়ে সঠিক কাজ করবে?

একমত।
আমি আশাবাদী, ইদানিং জিমেইলে বাংলা লেখা ই-মেইল পাই অনেক। ফোনেটিকে বাংলা লিখছে অনেকে। অনলাইনেও বাংলা বিস্ৃতি বাড়ছে।

বাউলিয়ানা এর ছবি

দারুন টপিক..
একবার এক স্যার বলেছিলেন, পৃথিবীর কোথাও "ডিপার্টমেন্টাল স্টোর" নাই (শব্দটা ডিপার্টমেন্ট স্টোর), কিন্তু এই দেশে আছে-কারন ভুল যে..

এনকিদু এর ছবি

কারণ এটা তাঁর নিজের সম্পত্তি না। প্রায় দুইশ বছর ইংরেজদের গোলামী করে আমাদের এটিচ্যূডে সেই চাকরের মানসিকতা গেঁথে গেছে বলেই মনে হয়।

একশত ভাগ সহমত ।

দেশটা তো আমার না, রাজার ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

প্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে খুব সুন্দর করে লিখলেন। কত ভুলের চর্চা যে আমরা করছি।

*****
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

দময়ন্তী এর ছবি

উফ্ সত্যি এই ভুলগুলো এমন দিনের পর দিন ধরে অবলীলায় করে যায় ----

আর একটা ভীষণ প্রচলিত কিন্তু ভুল প্রয়োগ হল "ফলশ্রুতি' ৷ লোকে "ফল'' এর বদলে কেন, কি আনন্দে যে ফলশ্রুতি লিখে যায় ---- নবনীতা দেবসেনের এই নিয়ে একটা লেখা আছে ৷
-----------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

শামীম এর ছবি

মন্তব্যের জন্য সকলকে ধন্যবাদ। সিস্টেমের মধ্যে পড়ে নিজেও যে কত ভুল করে চলছি ...... মন খারাপ
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

বিপ্রতীপ এর ছবি

আমি নিজেই কত্ত বানান ভুল করি... মন খারাপ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

অনিকেত এর ছবি

সময়োচিত একটি লেখার জন্যে ধন্যবাদ।

রাগিব এর ছবি

চমৎকার।

আরেকটা উদাহরণ হলো উৎসবের সময়ে "মার্কেটিং" করতে যাওয়া হাসি

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

শামীম এর ছবি

শপিংকে মার্কেটিং বলে বউ-এর কাছে কত যে ঝাড়ি খাইছি .... এখন আর ভুল হয় না হাসি । (মার্কেটিং = বাজারজাত করা)
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

শপে গেলে যদি হয় শপিং, তাহলে মার্কেটে (ধরা যাক, নিউ মার্কেটে) গেলে তা মার্কেটিং হবে না কেন? চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সময়োচিত লেখা। দ্য লাস্ট সামুরাই-এর সেই সংলাপটি আমারও মাথায় গেঁথে আছে। অনেক জায়গায়ই সেই কথাটার রেফারেন্স দিই।

জিজ্ঞাসু এর ছবি

অতি উত্তম লেখা।

আমাদের দেশে পারফেকশনের পারসেপশনই নাই। গণ্ডগোলটা পারসেপশনেও। আমরা কিন্তু কিছু না জেনেও বলি, "জানি, জানি"। কিছু না বুঝেও বলি, "বেশ বুঝেছি; পারব"। কিন্তু কাজের শেষে দেখা যায় সে রামায়ণও বোঝেনি, সীতাও বোঝেনি। অর্থাৎ মূল সমস্যাই থেকে যাচ্ছে আমাদের পারসেপশনে। আর এ সমস্যা অবশ্যই আমাদের দেশের শীর্ষপর্যায় থেকেই ক্রমশ নিচের দিকে পরিবাহিত। কী বলি, আর কী করি, তা করার আগে না জেনেই বলি, আর করার পরেও বুঝি না - ভুল করেছি কি শুদ্ধ করেছি।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

পোস্টটা মজার। তবে বানান ভুলের ব্যপারটা আর শব্দ ব্যবহারের ভুলটা বোধ হয় এক না।
অসাবধান শব্দটা "ভুল" হলেও একে অনবধান বললে শ্রুতিকটু লাগবে। সন্দেশ কে খাবার জিনিস না বলে খবর বললে শুদ্ধ না হয়ে বরং ভুলই হবে। এইজন্যই মনে হয় বাংলা ব্যাকরণে যোগরূঢ় শব্দ নামের একধরণের শব্দ আছে।

শব্দ ব্যবহারের ইতিহাসই অনেক ক্ষেত্রে শব্দের অর্থের সীমানা বদলে দেয়, অনেক ক্ষেত্রে অর্থও পাল্টে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রফল ১৪৪৯৯৮ বর্গ কিমি বলার চাইতে প্রচলিত বাংলায় আয়তন বলাটাই যুক্তিযুক্ত। এক সময়ে লাক্স সাবান বলতে বাংলায় গা-ধোয়া সাবান বোঝাত, এখনো মবিল বলতে বাংলায় ইঞ্জিন লুব্রিক্যান্ট বোঝায়। ওরকম বাংলাদেশে মার্কেটিং শব্দটাও বহুল প্রচলিত। এগুলো idiomatic usage of words. ভুল মনে হয় না।

বানান যেহেতু লেখ্যভাষারই ব্যপার, কথ্য ভাষার ব্যপার না, সেজন্য ওটাকে প্রমিত করা সহজ। শব্দ ব্যবহারের ভুল বা ব্যত্যয়গুলো আরো বেশি গভীরে প্রোথিত, ওগুলোকে প্রমিত না করে বরং এক পর্যায়ে মেনে নেয়া হয়। এব্যপারটা কম বেশি সব ভাষাতেই আছে।

শামীম এর ছবি

ঠিকই বলেছেন। তবে, আপনি পরীক্ষক হলেও হয়তো, ছাত্র যদি আয়তনের ইংরেজি Volume না লিখে Area লিখে তবে তা কেটে দেবেন। অথচ হয়তো নিজে আয়তন এবং Area একই অর্থে ব্যবহার করার সময় যুক্তির অভাব হবে না।

আমরা কোন স্ট্যান্ডার্ড মানি না, এটা আমাদের দুইশ বছরের পরিশোধিত রক্তে নাই। ময়লা ফেলার ডাস্টবিনকে পাশে রেখে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলে -- এর পেছনের যুক্তিও অকাট্য: ডাস্টবিনে থাকলে ময়লার ট্রাকের কর্মচারীদের চোখের অগোচরে থেকে যাবে! রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠাবে/নামাবে -- অন্যদের সুবিধা অসুবিধা দেখার দরকার নাই: এর পেছনেও যুক্তি আছে। ট্রাফিক সিগনাল মানবে না -- অথচ পয়সা খরচ করে এটা বসাতেই হবে। রাস্তার মোড়ে রিকশা রাখতে হয় না -- কিন্তু নিজে রিকশা ভাড়া করার সময় ঐ জায়গা থেকেই নেব। যত্রতত্র গাড়ি থামানো যায় না, রাস্তার মাঝখানে গাড়িতে উঠানামা করতে হয় না -- জানি...কিন্তু নিজের বাসার সামনে রাস্তার মাঝে বাসের গতি কমিয়ে নেমে পড়বো। ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে বিল দেয়ার কথা অন্যকে বলবো কিন্তু নিজে গিয়ে প্রথমে লাইনের সামনে অথবা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচিত লোক খুঁজবো ... ... সব জায়গাতেই হিপোক্রেসি -- আমি নিজেও এই দলের বাইরে নই।

পোস্টের মূল বক্তব্য ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত নয় বরং আমাদের চাকরের মনোভাব সম্পর্কে -- ভুল কাজের সপক্ষে যুক্তি খাড়া থাকবেই কিন্তু ওটা সঠিকভাবে করার ইচ্ছা থাকবে না।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

আপনার আয়তন বনাম ক্ষেত্রফলের বিতর্ক দেখে আমার ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান ক্লাসের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। স্যার এক এক করে সবাইকে প্রশ্ন করলেন -- পৃথিবী আর বিশ্ব কি এক কথা না দুই কথা? সবার মাথা আউলা। এইটা কোন প্রশ্ন হইল? পৃথিবী মানে world, বিশ্ব মানেও তো তাই। পুরা ক্লাসে আমি একলাই মনে হয় একবার মিউ মিউ কইরা বললাম, স্যার দুই কথা। আমারে থামায়া দিয়া স্যার তখন সবার মত জরিপে ব্যস্ত। শেষমেষ ক্লাসের সবাইরে দেইখা আমিও গড়বড়। কইলাম স্যার, সবাই যেডা কইল ঐডাও তো মিথ্যা না। স্যার তখন বুঝায়া বললেন। সাহিত্যের ভাষায় পৃথিবী আর বিশ্ব এক কথা এটাতো ঠিক, কিন্তু এইটা তো বিজ্ঞানের ক্লাস। বিজ্ঞানের ভাষায় পৃথিবী বলতে এই আমাদের মাটির পৃথিবীই বুঝায়, চাদ-সুরুজ-গ্রহ-তারা ঐসব পৃথিবীর মধ্যে পড়ে না, বিশ্বের মধ্যে পড়ে।

মোদ্দা কথা হইল ক্ষেত্রফল শব্দটা গণিতের পরিভাষা, ঠিক সাধারণ বাংলায় প্রচলিত না।
প্রচলিত বাংলায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রফল বলাটা বিশ্বকাপ না বইলা পৃথিবীকাপ বলার মতই উদ্ভট শোনাবে। খুউব খিয়াল করলে দেখবেন বাংলায় volumeমাপার অভ্যাসটা তুলনামূলক নতুন। দুধ তো বাঙালী গরু যেদিন থেইকা চড়ায়, সেদিন থেইকাই খায়। কিন্ত দুধ যে আগে সের মাপে বিক্রি হইত, লিটারে না এইটা খিয়াল করসেন? মনে হয় আগে volume আর area র পৃথক ধারণা ছিলনা। আয়তন শব্দটাও মনে হয় অনেক পুরানো, কারন জমিজমা মাপামাপি বহুকাল আগে থেইকাই হয়। ক্ষেত্রফল শব্দটা মনে হয় যখন বাঙালী জ্যামিতি শিখল তখনকার বানানো। (মনে হয় কইলাম কারণ এই মুহুর্তে সোনার বাংলা অভিধান হাতে নাই, কারো হাতে থাকলে ভুলটা ধরায়া দিয়েন)।

তয় কথা হইল এখন যখন বাঙালী জ্যামিতি শিখসে, এখনকি ব্যপারটা শুদ্ধ করা যায়না? যায়। আপনার আমার মত গনিতজানা মিস্ত্রিরা সেইটা চাইও। কিন্তু এটা সম্ভব কিনা সেটার রায় দিবে ভাষার চলমান ইতিহাস। বিজ্ঞানের খাতায় জমির আয়তন লিখলে আমি কাইটা দিব ঠিকই, কিন্তু সাহিত্যে বা কথ্য ভাষায় জমির আয়তন কইলে কাটবার ক্ষমতা আমার নাই। শব্দ নিয়া খেলা যাদের নেশা, মানে কবি-সাহিত্যিকরা, তাদের অবশ্য আছে। দেখা যাক কি হয়। আইজ থেইকা আমিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রফল কমুনে।

বাকী যে কথাটা কইলেন, মানে বাঙালী স্ট্যান্ডার্ড মানে না কারন তাদের দাসাভ্যাস, এইটা পুরাপুরি মানলাম না। গণতন্ত্র লইয়া যদ্দুর লাড়ালাড়ি করসি, তাতে বুঝি, স্ট্যান্ডার্ড যদি মানুষে নিজেরা নিজের ইচ্ছায় নিজেদের প্রয়োজনে বানায়, তাইলে তারা নিজেরাই তা মানে। সমস্যাটা হইল, ঐরকম গণতন্ত্র বাংলাদেশে আছে নাকি? ময়লা রাস্তায় না ফালায়া ডাস্টবিনে ফালাইতে হইলে তো বুঝতে হইব এইডা না করলে ক্ষতি কি? বেশির ভাগ মানুষেই তো সারাদিন রাইত ডাস্টবিনে থাকে আর ঘুমায়, সেই হিসাবে রাস্তাই কি আর ডাস্টবিনই কি?

যাই হোক। আপনার শুদ্ধি আন্দোলনে আমিও সামিল। ময়লা রাস্তায় ফালামুনা।

শামীম এর ছবি

শুদ্ধ ভাষা অনেকটাই সচেতন মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল বলে আমার ধারণা।

এখন মিডিয়া-ই যদি সচেতন ভাবে অামাদের অসচেতন মনে ভুল গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করে তখন মন খারাপ লাগে, মেজাজ খারাপ হয়। এই অভিযোগটা গুরুতর।

তবে আমার ধারণা, মিডিয়া সচেতন ভাবে না, বরং অসচেতন ভাবে এই কাজটা করছে। এখন চারিদিকে যত চ্যানেল আর পত্রিকা ... উপযুক্ত লোক পাওয়াই মুশকিল। তাই যদু-মদু, শালা, বন্ধুর বান্ধবীর চাচার দুলাভাইয়ের সম্বন্ধী.... .... যারে হাতের কাছে পায় তারেই কাজে লাগায় দেয়; পাশাপাশি স্বচ্ছ নিয়োগে দূর্নীতিতো আছেই --- যোগ্য লোকটা আইওয়াশের ইন্টারভিউ-এ বাদ পড়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয় ... ভুলের মহোচ্ছব লাগে।

আর দূর্নীতি করে যখন কোন লোক উপরে উঠে তখন তার ভুল যেন কেউ না ধরে সেজন্য তার আশেপাশে আরো গোঁয়ার গোবিন্দ লোকজন জড়ো করতে থাকে। উপযুক্ত লোকগুলো কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ভাল উপদেশ/পরামর্শকে তখন তারা থোড়াই কেয়ার করে।

বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় সেই সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের জ্ঞান এবং দক্ষতা/দূরদর্শীতা প্রয়োগ করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তারপর কী হয়! পাড়ার পাতিমাস্তান, সুযোগে মন্ত্রী (কিংবা সেই উপায়ে উপরে উঠে আসা শীর্ষ কর্মকর্তা) ... সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নিজের শালাকে কাজ পাইয়ে দেয়। এই দেশে জ্ঞান মূল্যহীন .... ভুলটাই ঠিক।

এই দেশে জ্ঞান মূল্যহীন হওয়ার পেছনে দুইশ বছরের ভূমিকা আছে। যাদের জ্ঞানী মনে করে মানুষ নির্ভর করেছে -- আসলে তাঁরা কাজ করেছে শোষকদের পক্ষে। কাজেই ধীরে ধীরে মানুষের অবচেতন মনে ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছে যে - লীডার ভুয়া ... এঁর কমান্ড মানার চেয়ে না মানাই ভাল। ফলাফল: সবাই মাতব্বর। কোথাও কেউ নিয়ম মানে না। (আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে)

স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে আপনার কথার সাথে একমত ( নিজেদের ইচ্ছায় নিজের প্রয়োজনে)। Evolution-এর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান/অভিজ্ঞতা বা সহজ ভাষায় ঠেকে শেখার উপরে কিছু নাই। আমাদের চোখের সামনে যে সভ্যতার ঠুলি ঝুলে আছে সেটা আরোপিত সভ্যতা। এই সভ্যতার উপযুক্ত হওয়ার আগেই এটা আরোপ করা হয়েছে - তাই এই অবস্থা। সুতরাং যেটা দরকার সেটা হল ... ঠেকে শেখার ব্যবস্থা করা। ইলিয়াস কাঞ্চনের বউ দূর্ঘটনায় মারা গেছেন বলে উনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেন ..... .... সমস্ত নিয়ম তুলে দেয়া হোক -- মানুষ হোক ইচ্ছার রাজা। তারপর এর অসুবিধা বুঝে ঠেকে শিখুক।

=========
হুমায়ুন মার্কা সাহিত্যিক বা শফিক রেহমান মার্কা ভাষাবিদেদের দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার দরকার নাই।

নজরুলের গান: খেলিছো ... এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে।

দেখলেন, এখানেও "বিশ্ব" কিন্তু "পৃথিবী" না। কাজেই ভাষা নিয়ে যারা খেলাধুলা করেন, তাঁদের মধ্যেও একটা নীতি আছে ... থুক্কু.. ছিলো।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

মাহবুবুল হক এর ছবি

ধন্যবাদ। অনেক ভুলের মধ্যে আমাদের বসবাস। ভুলগুলোকে ভুল স্বীকার না করাটাও আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এই ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

শামীম এর ছবি

একেবারে মনের কথাটা ধরতে পেরেছেন -- ভুল স্বীকার না করার প্রবণতাটাই সমস্যা।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

শাহ্ আসাদুজ্জামান এর ছবি

শামীম ভাই, ভুল নিয়া বিতর্ক তো অনেক হইল, এইবার চলেন একটু ভুলা-ভুলি খেলি। একটা ভুল স্বীকার কইরা কেউ যে ভুল স্বীকার করেনা আপনের এই ধারণা ভুল প্রমাণ করি। আমি যে আপনার ভুল-তত্বের ভুল ধরতে গিয়া নিজেও ভুল করসি, এইটা ভুলেও চোখে পড়ে নাই। আগের একটা কমেন্টে শব্দ প্রকরণের নাম ঝাড়তে গিয়া রূঢ়ি এর বদলে মনে হয় যোগরূঢ় বলসি। আবারো excuse - হাতে ব্যাকরণ বই বা অভিধান কোনটাই নাই।

কনফুসিয়াস এর ছবি

ভাল লাগলো। প্রচলনে শুদ্ধ বলে একটা কথা আছে। এই কথার আওতায় অনেক ভুলকেই অনেকে শুদ্ধ দাবী করেন। অথচ আমাদের উচিৎ শুদ্ধ কথাটারই প্রচলন ঘটানো।
-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।